bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

গল্প লেখার গল্প | হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হক

আমি ছােটগল্প সচেতন হয়ে লিখতে শুরু করি ষাটের শুরুতে। ১৯৬০ সালে আমি যে গল্পগুলাে লিখেছিলাম, আমি মনে করি ওখান থেকেই আমার লেখালেখির শুরু। তার আগে যা গল্প-উপন্যাস লিখেছি, সবই প্রায় অসমাপ্ত থেকে গেছে। একটা কাঁচা উপন্যাস লিখেছিলাম ১৯৫৭ সালে, যেটি পরে ‘শামুক’ নামে বেরিয়েছে। ওটা আমার প্রথম লেখা হলেও হতে পারে। মানিক স্মৃতি পুরস্কার প্রতিযােগিতায় জমা দিতে ওটা লিখি। দৌলতপুর কলেজ বার্ষিকী ম্যাগাজিনে ‘পাষাণবেদী’ ও ‘লাঠি’ নামে দুটো গল্প লিখি। কবিতাও লিখেছি একটা-দুটো। মুকুল নামে একটি পত্রিকা বের হত ন’পাড়া থেকে। ওখানেও দুটো গল্প বের হয়েছে। ‘পাষাণবেদী’ গল্পটি ছিল পাটকল শ্রমিকদের নিয়ে, আর দারিদ্র্য নিয়ে ‘ভাত’ নামে আরও একটি গল্প লিখি। এই গল্পগুলাে আর কোনাে সংকলনে স্থান পায়নি। তাই ‘শকুন’ই আমার প্রথম সিরিয়াস গল্প। সেটা ওই ১৯৬০ সালেই সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে ওই আমার প্রথম স্বীকৃতি হয় বিদ্বজ্জন মহলে।

শকুন’ গল্পের পটভূমি আমাদের গ্রাম, বর্ধমানের এক অখ্যাত জনপদ। কয়েকজন আমার বয়েসী দুষ্টু ছেলে মৃতপ্রায় এক শকুনকে নিয়ে যে নিষ্ঠুর মরণ খেলায় মেতেছিল তা আমার মনে তখনই গেঁথে গিয়েছিল। পরে ওই ঘটনাটা ভাবতে গিয়ে আমি শিহরিত হয়ে উঠি এবং একদিন ওই গল্পটা একটানা লিখে ফেলি। সমকাল পত্রিকার সম্পাদক আমার একটা লেখা ফেরত দেবার দু’বছর পরের ঘটনা এটা। তারপর আর আমাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

আত্মজা ও একটি করবী গাছ
খুলনায় তাে অনেক দিন ছিলাম এবং খুলনা শহরে তারপর যে কলেজে চাকরি করতাম সেখানকার কোয়ার্টারে এবং সেখানকার দুটো-তিনটে বাসায় ওই সময়টা আমার কেটেছিল। ওই দেশ থেকে এই দেশে আসার পর লেখাপড়া শেষ করে যখন চাকরিতে ঢুকলাম তখন এইসব জায়গাতে থাকতে হয়েছিল আমাকে। একটা সময় আমি ফুলতলাতে ছিলাম। কারণ আমরা সবাই মানে পরিবার-পরিজন সুদ্ধ যখন ও দেশ থেকে এ দেশে চলে আসি, এটাকে মাইগ্রেট করা বলা যেতে পারে আর কি! তার আগে আমি লেখাপড়া করার জন্য কলেজে আমার বড় বােনের কাছে এসেছিলাম কারণ আমার ভগ্নিপতি দৌলতপুর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। আমি তাে ১৯৫৪ সালে এ দেশে আসি। এটা আমার মনে হচ্ছে ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে হবে। এই সময়টাতে আমি ফুলতলায়—খুলনা থেকে দুই মাইল দূরে, যশােরের দিকে। এখানে সপরিবারে আমরা চলে আসি এবং থাকতে শুরু করি। এইখানে থেকেই আমি প্রায় প্রতিদিনই বাসে চড়ে দৌলতপুর কলেজে যাওয়া এবং প্রায় বাসে করেই ফিরে আসা; কলেজ শেষ করে খুলনায় আমাদের প্রাণপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সন্দীপন’-এর আকর্ষণে যেতাম—এ রকম এক অর্থে বলা যায় যে, জীবনটা ছিল ভবঘুরের মতাে আরকি! যাই হােক, ফুলতলায় যখন চলে আসি তখন একটা চমৎকার গ্রামীণ পরিবেশ পেতাম এবং ফুলতলার গ্রামীণ পরিবেশ আমাদের বর্ধমানের গ্রামীণ পরিবেশের মতাে মােটেই নয়। আমাদের দেশ যে বর্ধমান তা কেবল ধু ধু প্রান্তর, বিশাল বিশাল বাঁধ এবং গ্রামে শুধু একটা গাছ যদি থাকে তা খুব বড় বড় আর তা না হলে বৃক্ষহীন, কোনাে বনবাদাড় কিছুই তাে নেই। কিন্তু এখানে ফুলতলায় তা ছিল না। ফুলতলায় আমরা যখন মাইগ্রেট করে চলে আসি তখন আমার বাড়ি ছিল খুব নির্জন একটা জায়গায়। ফুলতলা বাজার বলে যেটা এখন পরিচিত সেখান থেকে বড়জোর এক মাইল। ওই জায়গাটার কী নাম ছিল মনে নেই, ওটা পরে আমার নামে নাম হয়েছিল প্রফেসর সাহেবের বাড়ি। ওই স্টপেজটা খুলনা থেকে ১১ মাইল হবে, ওইখানেই বাস থামত। পরবর্তীকালে আমি ওখানে সবসময় নামতাম বলে ওইখানেই বাস থামত। ওখান থেকে ভেতরে একই ঢুকলেই এমন একটা নির্জনতা—আমার অভিনব লাগে এইজন্য যেদেশ থেকে এসেছি তার তুলনায় কত ঘনসন্নিবব্ধ বৃক্ষরাজি। এখানে একেকটা পথ যেন সুরিপথ। দু’পাশে মুখে এসে লাগছে নানা লতাপাতা। কিছু ফুলগাছ আছে, কিছুকিছু বনজ ফল আছে, এইসব সরু সরু পথ আছে। এইসব পথের দু'পাশের কিন্তু একটা-দুটো করে বাড়ি এবং এত নির্জন সেই বাড়ির বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না যে, এই বাড়িতে লোকজন আদৌ বসবাস করে কিনা! আমাদের সাড়ে তিন বিঘাতে ছােট্ট একটা বাড়ি, যেখানে মেঝে ছিল সেটা বুক পর্যন্ত প্রায় উঁচু। তার মানে চার-পাঁচটা সিঁড়ি পার হয়ে তারপর বারান্দায় পা দেওয়া। এই বারান্দার সঙ্গে সমতলে অন্য ঘরগুলাে। আর এক পাশে অন্ধকার একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ছাদে যেতাম মাঝে মাঝে, খুবই ভালাে লাগত, বিশেষ করে শীতকালে। ছায়াচ্ছন্ন একটা বাড়ি, রােদ প্রায় পাওয়া যেত না। কাজেই আমি প্রায়ই ও্ই সময়টায় ছাদে চলে যেতাম। ওই একতলার ছাদে গেলে রােদ প্রায় পাওয়া যেত না। পাশে যে আমগাছটা আছে সেটা তার ডালপালা বিস্তার করে ছাদের অনেকটাই জুড়ে ছিল। আমি যেখানে গিয়ে বসতাম সেখানে পায়ের কাছে রােদ কিন্তু মাথার উপর এই আম গাছের ডাল—এ রকমই একটা জায়গায় আমি বেতের চেয়ার নিয়ে বসতাম। ছােট একটা টেবিল ছিল আমার। ওইখানে অনেক সময় পড়াশােনা করতাম, ভালাে লাগত। এই হলাে পরিবেশটা। ফুলতলাতে আমারই মতাে কিছু মানষ এসেছিল এবং তারা সত্যিকারের দুরবস্থার মধ্যে পড়ে এসেছিল। তারা বিতাড়িত কিনা আমি জানি না, আমাদের কেউ বিতাড়ন করেনি কারণ আমাদের গ্রাম মুসলমানপ্রধান গ্রাম নয়, হিন্দুপ্রধান গ্রাম ছিল। আমাদের প্রতিপত্তি ছিল। আমার বাবার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শুধু আমরাই এসেছিলাম, বাকিরা সব ওখানে থেকে গেছে। অদ্ভুত একটা নির্জন জায়গা, অন্ধকারের মধ্যে ছায়াচ্ছন্ন একটা রাস্তা। একটু এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা বাড়ি। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের তত্ত্বাবধানে কালবেলা  নামের ছােট্ট একটা পত্রিকায় ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটা বেরিয়েছিল। তা আমি ওই দোতলায় বসে পড়ছিলাম আর তখন তাে দুটো-একটা গল্প লেখা হয়েছে, শকুন লেখা হয়েছে, তখন আমি গল্প লিখছি, কিন্তু সামনে কোনাে দীক্ষা ছিল না। তারাশঙ্কর কিছু পড়া ছিল—গল্পের চেয়ে উপন্যাসই বেশি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ্য ছিল বলেই প্রাগৈতিহাসিক পড়েছিলাম। তার আগে তাে ছােটগল্প তেমন নেই। শরৎচন্দ্রের ছােটগল্প তাে আধা উপন্যাস। সত্যিকারের ছােটগল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ আমি তখনাে তেমনভাবে পড়িনি। অল্প দু-চারটে গল্প পড়েছি— গুপ্তধন  ভালােভাবে পড়েছি। শরৎচন্দ্রের মেজদিদি  পড়েছি। আর কিছুই নয়। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় এসব হলাে কী করে? একঅর্থে নিজের থেকেই। গল্পের মতাে আরকি! আমি যখন লিখতে বসলাম মনে হলাে ছাদে বসে একটা গল্প লিখব। কী লিখব ঠিক করিনি। তারপর ভাবলাম উদ্বাস্তু হয়ে যারা এসেছে তাদের কথা। উদ্বাস্তুদের তখন ঘৃণার চোখে দেখা হতাে । অবাঞ্ছিত লোক, নিজেদের খাওয়া-দাওয়া জোটে না, বাড়িঘর নেই, কুঁড়েঘর বেঁধে এখানে-ওখানে থাকছে, রেশনের চাল-গম বেশি বেশি নিচ্ছে, ভালাে চোখে দেখা হচ্ছে না উদ্বাস্তুদের। অন্তত গ্রাম এলাকায় যারা এসেছে তাদের নীচ চোখেই দেখা হতো। তবে আমাদের ওরা ওসব ভাবত না। কারণ ময়মনসিংহে আমাদের ৩৬ বিঘা জমি ছিল, অনেক প্রতিপত্তিও ছিল। আমাদের কারাে মুখাপেক্ষী হতে হয়নি। আমি কিছুদিন পরেই ফুলতলায় সংস্কৃতিবান একজন মানুষ হিসেবে খুবই প্রিয় পাত্র হয়ে গিয়েছিলাম এবং নাটক করা শুরু করলাম। একটার পর একটা নাটক মঞ্চস্থ করলাম। ওরা তাে অবাক! কোনাে দিনও এসব দেখেনি। তখন বিধায়ক ভট্টাচার্য ছিল নামকরা নাট্যকার। মহিলা শিল্পী পাচ্ছিলাম না, মহিলা সাজতে হচ্ছে পুরুষদের। মাঝখানে বিভিন্ন মহিলা শিল্পী বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড় করা হয়েছিল। আমি তখন বােধহয় দুটো-তিনটে গল্প লিখেছিলাম। ‘শকুন’ লিখেছি, তারপরে বােধহয় ‘একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে’ লিখেছি—এ রকম কয়েকটা গল্প আমি তখন লিখেছি। তা পূর্বমেঘ-এ বেরিয়েছে। তা ওই বাড়িতে যখন থাকতে লাগলাম তখন আমি দৌলতপুর কলেজের শিক্ষক, সিনিয়র। তার আগেই তিনটে কলেজে মাস্টারি করা হয়ে গেছে। ওইখানে ওই সকালবেলাতেই হয়তাে আমি খেয়েদেয়ে চলে যেতাম। তখন আমার বিয়ে হয়েছে। ১৯৬৫ সালেই প্রথম মেয়ে হয়েছে—শুচি। বাড়িতে অনেক লােক আমাদের, বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা, আমার ভাবি, আমার মা-বাবা ছােট ভাই—এ রকম অনেক লােকজন। বেশ গমগমে বাড়ি। তখন ওই সময়টা আমি শীতের দিনে মুড়ি নিয়ে উপরে চলে যেতাম। বেতের চেয়ারে বসতাম, টুলটা সামনে নিয়ে। টুল মানে গােল একটা টেবিলের মতাে। খাতা-কলম থাকত। এর আগে আমি শুনছিলাম যে, এখানে উদ্বাস্তু একটা-দুটো পরিবার এসেছে। তাদের বাড়িগুলাে ভালাে না। লােকেরা বলত, বাড়ির পুরুষ মানুষেরা ভালাে না। আমি সেটা বিশ্বাস করতাম না। একটা-দুটো পরিবারকে চিনতাম। একটা পরিবার ছিল ভদ্র। আরেকটা পরিবার, যাদের খুব দুর্নাম ছিল। কিন্তু ওই পরিবারের ছেলেরাও আমাদের সাথে মিশত। একজন পরে কানাডা পরবাসী হয়ে গেল। তার মামা ছিল এখানে। একটু দূরে বাড়ি। আমার আড্ডা ছিল চায়ের দোকানে। আমার আড্ডা দেওয়ার পাকা জায়গাও তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেখানে লাইব্রেরি গড়ে তুলি। তা আমি ছাদে বসে ভাবছি কী লেখা যায়, তখন মনে হলাে, আচ্ছা চার বন্ধু নিয়ে একটা গল্প লিখি । আমি নিচে বসে গল্পটা একটু লিখছিলাম –চার বন্ধু একটা রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিচ্ছে। এই চার বন্ধুর মধ্যে একজন ছিল যার নামে খুব দুর্নাম ছিল—নিজের মামাতাে বােনকে ব্যবহার করার জন্য। আমি শুধু ভেবেছিলাম মানুষ দুর্দশায় পড়লে এরকম হতেই পারে-এটুকুই ওই গল্পের বাস্তবিক ভিত্তি, আমি যখন গল্পটা লিখলাম তখন দেখলাম একেবারে সমরেশ বসুর মতাে গল্প হয়ে যাচ্ছে কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতাে। আমি খানিকটা লিখে কেটে ফেলে দিলাম। শীতকালের দিন, উপরে বসে আছি। তারপরে মনে হঠাৎ আবির্ভূত হলাে একটা বাক্য—‘এখন নির্দয় শীতকাল’–এই বাক্যটা কিভাবে কলমে এলাে আমি বলতে পারি না। আগে নিদয় লিখেছিলাম। এই নিদয়টা হচ্ছে ‘বুড়াে আংলা’ বলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে বইটা আছে সেখানে ওই ছেলেটার নাম নিদয়। বাস্তবেই ছেলেটা নিদয়। কিন্তু পরবর্তীকালে ওটা নির্দয় করা হয়েছিল, পত্রিকার সম্পাদক করেছিলেন। এখনও বােধহয় নির্দয় লেখা হয় সব জায়গায়। কিন্তু আমি লিখেছিলাম ‘এখন নিদয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম। উল্টো রকম ভাবে। হিম ঠাণ্ডা নামছে নয় । চাঁদের আলােয় পালদের বাড়ির টিনের হিম ঝকঝক করছে—এই বাক্যটাও চলে এলাে। হিম ঝকঝক করছে এরকম তাড়া করা শব্দ আরকি! তার পরে শােনা গেল কিছুলােক বেরিয়ে এসেছে, একটা শিয়াল ওখানে এসে একটা মুরগি নিয়ে চলে গেছে। তা যেন মুরগিটা আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম। শিয়ালটা মুরগি নিয়ে পালাচ্ছে আর তার পেছনে কিছুলােক লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে। আমি যখন লিখছি তখন সকালবেলা। তবে কাঠামাে সাজিয়ে নিয়ে লিখতে বসিনি। লেখা নিজে থেকেই এসেছিল। তারপর বাক্যের পর বাক্য বেরােতে লাগল। এমনকি আশপাশে যে গ্রামটা আছে সেখানে একটা মােল্লাবাড়ি ছিল। সেই বাড়ির ছেলে বখে গিয়েছিল, তার নাম দিয়েছি ইনাম। তবে গল্পের চরিত্রটা নিজেরই তৈরি। বাকি চরিত্রগুলাে ইনামের বন্ধু—চোর, পকেটমার—নানা চরিত্র তৈরি করেছিলাম। আমাদের গ্রামে একজন পকেটমার ছিল, পরে তারসঙ্গে সখ্য হয়। সে কিভাবে পকেট মারত, মার খেত আমাকে বলেছিল । এইভাবে গল্পটা অগ্রসর হচ্ছে। পারিপার্শ্বিকের বর্ণনা দিয়ে প্রথম প্যারাটা হয়ে গেল। দ্বিতীয় প্যারাতে মিঞা বাড়ির ছেলে ইনাম জলে মুখ দেখছিল। এমন সময় সুহাস বলল, এখানে কী করছিস? চল, চল। তার পর ফেকু এলাে। ফেকু হলাে ওই পকেটমারটা। একজনের হাতে একটা রেডিও আছে। তারপর বলল—‘চল বসে থাকতে ভালাে লাগছে না ওই বিলের দিকটায় যাই’। ফুলতলা ঢুকতেই ডানে বিরাট বিল ছিল। যাই হােক, ওই বিলের কিনারা থেকে ছড়ানাে-ছিটোনাে গ্রামের বাড়িগুলো দেখা যেত। এবার পারিপার্শ্বিকের বর্ণনা—একটা ঘর থেকে আওয়াজ আসছে, ভেঁসে আসছে একটা কথা–‘কাঁথা দে, শীতে মরি গেলাম রে’-এ রকম একটা আওয়াজ আসছে। ওখানে দেখা যাচ্ছে ডাক্তারবাবু বসে আছে, ধবধবে ফর্সা শরীর, তার পৈতেটা দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু বসে আছে আর এরা আপনমনে গল্প করতে করতে তিনজনে মিলে যাচ্ছে। আমি কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে তাও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি। কিন্তু আমি আগাগােড়া রাস্তাটাকে আমার বর্ণনায় জঙ্গুলে করলাম, খােলামেলা করলাম না। ওরা তিনজনে যাচ্ছে, একজনের হাতে একটা রেডিও আছে। তারপর সংলাপ শুরু–‘শালা খেয়াল গাইছে! রেডিওতে শব্দ, তারপরে কণিকার ওই গানটা ‘সখী আঁধারে একেলা ঘরে’—সেইসঙ্গে দূরে কীর্তন হচ্ছে। কীর্তনের আওয়াজ আসছে। বেশ একটা জমজমাট পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। তারপর একটু একটু করে ওই বাড়ির দিকে যাওয়া। এভাবেই গল্পটা লেখা। আগাগােড়া গল্পটা একটু অন্যরকম হয়ে গেল। গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম চেহারা নিল। মনে হলে, আমার কলম সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন কথা বলার সাহস পেল, পরবর্তীকালে এটাকে যে বলা হলাে শতাব্দীর সেরা গল্প, তা বােধহয় সমালােচকরা একটা নতুনকিছু পেয়েছিলেন বলেই বিবেচনা করেছিলেন।

ছােটবেলায় আমার পাশের গ্রামে পাঠশালাটা বসিয়েছিলেন এক দৈবজ্ঞ বাহ্মন, যবগ্রামে। ওখানে একটা-দুটো পাকা বাড়ি ছিল। ওইখানে একজন চমৎকার কৃষক ছিলেন, যার গােটা বাড়িটা ঝকঝক করত। ঘরের চাল এমন করে কাটা মনে হতাে একটা ধনুক বেঁকে আছে। কল্পনা করা যায় না! তার ছেলে পড়ত আমাদের স্কুলে। তার যে বৈঠকখানাটা ছিল সেখানে ঢুকলেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে যেত। ঢুকেই ছিল একটা বাগান—যার ডান দিকে ছিল একটা করবী গাছ, রক্তকরবী। যেটা উঁচু হয়ে আছে মনে হচ্ছে মাটি থেকে যেন ফোয়ারা উঠেছে এবং এই ফোয়ারা উঠে উপরে লাল ফুল খুব ইমপ্রেস করেছিল আমাকে। তখন আমি কাছে গিয়ে একটা-দুটো করবী ফুল নিয়ে শুঁকে দেখলাম মিষ্টি একটা গন্ধ আছে। ভেতর দিকে আতাগাছ, পেয়ারাগাছ। অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিল বৈঠকখানা, আর বৈঠকখানার পেছনে নানা রকম গাছপালা। ওই বৈঠকখানার নিচু বারান্দায় পাঠশালাটা ছিল। আমি প্রত্যেক দিন যেতাম পাঠশালায়। নানা কারণে ওই বৈঠকখানাটা আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। বৈঠকখানার সামনে ওই যে একটা জলের ফোয়ারার মতাে গাছ এবং তার মাথায় টকটকে লাল ফুল, কাছে গেলেই একটা মৃদু গন্ধ, ওই স্মৃতিটা রয়ে গেল আমার মধ্যে। আর কোনাে দিনও গেল না। কাজেই গল্পটার নাম স্থির হলো— ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। এটা আমার জানা ছিল, কিন্তু আমাদের গ্রামে ওই ফুলের গাছটা ছিল না কিন্তু! আরেকটা ফুল ছিল যেটাকে লোকে করবী বলে, কলকের মতাে দেখতে ছোট হলুদ ফুল। আমরা বলতাম কলকে ফুল। তো সেই অর্থে আমাদের গ্রামে একটাও করবীগাছ ছিল না, ছিল একটা মল্লিকা এবং ওই কলকে ফুলের গাছ। এই ফুলে বিষ হয় কিনা আমি জানতাম না। কিন্তু আমাদের গ্রামে একটা লােক ওটা খেয়ে মরতে বসেছিল। সেই ছেলেবেলার স্মৃতি থেকেই করবীর প্রসঙ্গ, বাকিটা কল্পনা। ওখান থেকে যারা এসেছে তারা তাে খুব দরিদ্র, ফুলতলাতে ওদের খুব ছােট চোখে দেখা হতাে। একমাত্র আমাদের বাড়িটাকে বলা হতো প্রফেসর বাড়ি। বাকি সব রিফিউজি। চুরি-ডাকাতি যাকিছু হতাে সব রিফিউজিরা করছে বলে সবাই মনে করত। এ রকম দুর্নাম ছিল। সেজন্য রিফিউজিদের ভালাে চোখে দেখা হতাে না। সেখানে ওই যে অন্ধকার একটা এলাকা, সরু একটা পথ গিয়ে সেই বাড়ির সিঁড়ি, সিঁড়িতে একটা কিছু শােয়ানাে আছে, সেটা সরিয়ে দিলে করবীগাছ। এর পরে একটা পােড়ােবাড়ি মালিকবিহীন। তখন এত ঘরের অভাব ছিল না, অনেক পােড়ােবাড়ি ছিল ফুলতলাতে, এইটুকুই আমার কল্পনা। যার বাড়ির দুর্নাম ছিল সেই বাড়িতে আমি কোনােদিনও যাইনি। কাছেই ওই অর্থে ভিত্তিহীন নয় আবার স্বচক্ষে দেখা করবীগাছওয়ালা বাড়ি তাও নয়। এই গল্পটা ফুলতলায় থাকতেই ছাপা হয়েছিল। আমার এই গল্পটা ওখানকার কেউ কেউ পড়েছিল, তাতে আমার দু-একজন ভক্তও জুটেছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে আমার ছাত্র হয়েছিল। তারমধ্যে একজন ইজাজ হােসেন লেখক-কবি, আরেকজন ছিল ইংরেজির অধ্যাপক।

খাঁচা 
খাঁচার প্রথমে নাম দিয়েছিলাম ‘আততায়ী আঁধার’। তারপর দেখলাম অত কঠিন নাম দেওয়ার কোনাে মানে হয় না। তখন আমি মনে করলাম, যে মানুষেরা আটক হয়ে আছে, কোথাও যেতে পারছে না সেজন্য ওই সময়টাতে ওই যে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসে তাে তার আগে কিছুদিন তাে প্রেসিডেন্ট ছিল খাজা নাজিমুদ্দিন ও তার বাঙালি চামচা নুরুল আমিন এইসকল দালাল জুটেছিল। ওই সময়ের পটভূমিতে বােঝা যাচ্ছিল যে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটবে। তখন একবার হিন্দুদের সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করে দেওয়া হলাে আইন করে। হিন্দু সম্পত্তি কেনা যাবে কিন্তু যারা বিক্রয় করতে চাইবে তারা দেশে থাকতে পারবে না—এ রকম একটা আইন হলাে। একটা সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ তখন সেখানে চলছিল। আমার মনে হলাে এই যে সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠী এখানে আছে তারা কি একেবারে খাঁচায় বন্দি হয়ে গেল। বের হতেও পারবে না, থাকতেও পারবে না। কোনো চাকরি তখন নেই। হতদরিদ্র পঞ্চাশের দশকে চাকরি কোথায়? ষাটের দশকেই বা চাকরি কোথায়? তার ওপর আইন করে ওই সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার তখন মনে হলাে এই নামটা দেওয়ার দরকার নেই, আমি তখন গল্পটার নাম দিলাম ‘খাঁচা'। তখন পাকিস্তানি আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর খুব নির্যাতন করা হয়েছিল। নির্যাতনমূলক আইন সংখ্যালঘুদের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। কেউ সম্পত্তি ফেলে দিয়ে চলে গেল আশপাশের প্রতিবেশীরা সেই সম্পত্তি ভােগ করতে লাগল। এইসব কাণ্ড এই দেশেই ঘটেছে। সেইজন্য আমি ওই ‘খাঁচা’ গল্পটা লিখেছিলাম। যারা কেউ কেউ যাব যাব করেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারছে না, তাদের নিয়েই আমি কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করেছিলাম। সম্প্রতি সিনেমা হয়েছে ওই গল্পটা নিয়ে, জয়া আহসান অভিনয় করেছে। এই ঘটনার পটভূমি এপার বাংলা-নড়াইল অঞ্চল হতে পারে। ভাষাটাও সেইভাবে লেখা। এই গল্পের কোনাে স্থান নিয়ে আমি ভাবিনি। কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিবারকে নিয়েও এই গল্পটা নয়। বাংলাদেশে আমি এ রকম সংখ্যালঘু কিছু পরিবারকে আটক থাকতে দেখেছি। এই গল্পটা রাজশাহীতে বসে লেখা। এই সময়ে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তাঁর প্রথম গল্প লিখেছিল। সেখানে তাঁর বাল্যকালটা খুব খারাপ কেটেছে। ওটা ওর বাস্তব জীবনের গল্প। ওর বাবা খুব দরিদ্র ছিল। ও স্টেশনমাস্টারের ঘরে এসে বসে থাকত। এটা আমি জ্যোতিপ্রকাশের মুখে শুনেছি। একবার এক পাওনাদার তাকে এসে বলেছিল— ‘পাওনা কবে শােধ করবে? করতে পারলে করাে, আর তা না হলে তােমার ঘটিবাটি সব নিয়ে নেব।’ তখন ও বলেছিল, আর ক'দিন সময় দাও। ‘আর কত সময় দেব? আজকে তােমার ছাতাটা নিয়ে গেলাম’, বলে ছাতাটা নিয়ে চলে গেল। এই যে পরিবেশটা এটা জ্যোতিপ্রকাশের জীবনের ঘটা একটা ঘটনা। আমি এই রকমের প্রেক্ষাপটেই গল্পটা লিখেছিলাম। খাঁচার মধ্যে যারা আটকা পড়েছে তারা কেউ বাইরে যেতে পারবে না। নড়াইল আর খুলনার দিকে এরকম অসংখ্য পরিবার ছিল। অত্যন্ত দরিদ্র কিন্তু তাদের মধ্যে হিন্দুরা মুসলমানদের থেকে সাংস্কৃতিকভাবে একটু উন্নত ছিল। ভাষার এদিক-ওদিকও ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যখন কেউ যেত আমি বলতাম—‘কে যাচ্ছেন গাে?’ উত্তর আসত ‘পাল মশাই'। আমি তাদের বাড়িতে গিয়েছি। কেমন করে কলসি হাঁড়ি তৈরি করে, কেমন করে দাগ দেয়, চাকাটা কী করে ঘােরায়। অসম্ভব সুন্দর লাগত কুমােরদের কাজ দেখতে। তারা কুমােরের কাজ করত। সেজন্য মনে হতাে এ রকম কোনাে কোনাে পরিবার এমন আটক হয়ে আছে যে, এদিকেও থাকতে পারে না, ওদিকেও যেতে পারে না। আমাদের পাশে যে বাড়িটা ছিল সেখানে বেশ কয়েক ভাই থাকত। তার মধ্যে আমাদের সঙ্গেই বিনিময় করেছিল একজন আমাদের বাড়িটা। তার পর তিনি তার ভগ্নিপতির বাড়িতে চলে যান। আমরা টাকা দিয়েছিলাম, দলিল হয়েছিল বিনিময়ের। কিন্তু আমরা দিয়েছিলাম ৫০০০ টাকা। এই গল্পটা খুলনাতে বসেই কথা। তখন হয়তাে এটা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা নয়, পরিস্থিতিটা এমন যে হিন্দুরা অদ্ভুত এক আটক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে, যেতেও পারে না থাকতেও পারে না, সম্পত্তি বিক্রি করতে গেলে বিক্রি হয় না, বা কেউ নিতে চায় না। তারা বলে—‘নিষেধ আছে, আইন তৈরি হয়েছে’। অসম্ভব একটা পরিস্থিতি। অম্বুজাক্ষ ও সরােজিনী কাল্পনিক চরিত্র নয়। এদের মতাে লােক আছে কিন্তু এরা কোনাে নির্দিষ্ট চরিত্র নয়। এরকম মানুষ ছিল আমি মনে করি। কল্পনার চেয়েও বেশি, অনেক বেশি বাস্তব এগুলাে ।

আমৃত্যু আজীবন
অনেকের মতে এটা আমার সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প। আবার কেউ বলেছেন, এটা নাকি পথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলাের মধ্যে একটা। তাদের মধ্যে এমন একজন আছেন, যাঁর নামটা ইচ্ছে করেই বলছি না, তার বুদ্ধি, বিবেচনা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনাে সন্দেহ করা চলে না। সত্যিকারের এক জ্ঞানতাপস মানুষ তিনি। তিন বলেছিলেন, এ রকম গল্প নাকি বেশি নেই। বেশ বড় গল্প। গল্পটা একেবারে অন্যরকম করে লেখা। এটারও মােটামুটি প্রথম কয়েকটা বাক্য আমি খুলনা শহরে প্রথম যে বাসাটায় ছিলাম সেখানে বসে লিখেছিলাম। তখন আমার একটা কন্যা হয়েছে মাত্র। সেই বাসায় বসে থাকতে থাকতে লিখি আর লিখতে লিখতে আমি বােধহয় ফুলতলায় চলে আসি। ফুলতলার গ্রামে যে আমাদের বাড়ি তা ছাড়িয়ে খানিকটা গেলে যশােরের পথে বাঁ হাতে বিশাল একটা বিল পড়ত। এই বিলের কোনাে ধারণা আমাদের শুকনাে দেশ বর্ধমানের লােকেদের ছিল না। এই বিল আমি জীবনে এই প্রথমবার দেখলাম। সেই আদিগন্ত বিস্তৃত বিল। ঝােপঝাড় অল্পস্বল্প দুটো-একটা আছে। জল কোথাও আছে, কোথাও নেই। অনেক দূরে জল চিকচিক করছে। এটাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল ব্রহ্মাণ্ডের এক অপার বিস্ময়। এই বিল দেখে সত্যিই আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি মাঝে মাঝেই ওই বিলের দিকে চলে যেতাম এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। তখন মনে হলাে যে, এমন কি একটা গল্প লেখা যায় মধ্যে একটা চিরন্তরতার ব্যাপার থাকবে! এই বিলটা কবে থেকে আছে তার বয়স নির্ধারণ করা যাবে না। এযেন অনাদিকাল থেকে ছিল, আছে এবং অনাদিকাল ধরে থাকবে। এই বিলের মধ্যেই ধরা আছে মানুষের জীবন। কারণ বিলের যেখানটায় শুকনাে সেখানে মানুষ চাষ করে, যেখানে জল সেখানে মাছ ধরে। ওইটাই হচ্ছে ওখানকার সমস্ত মানুষের জীবনসংগ্রহ। ফুলতলাতে চাষবাসের কোনাে ব্যাপার ছিল না। চাষের জমি আমি তেমন দেখিনি। ওদের সর্বঅর্থে সম্বল ছিল ওই বিল। কই, মাগুর, নানারকম মাছ আর বিলের শক্ত জায়গায় চাষবাস—এই জিনিসটা আমায় খুব মুগ্ধ করেছিল। তখন গল্পটা কিভাবে যেন মনে এলাে, তবে তার বিন্যাস কী করে ঘটালাম তা আমি বলতে পারব না। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটা গল্প শুরু এইভাবে—‘গুরু গুরু করে মেঘ ডেকে উঠল। বর্ষা শুরু হলাে’। আমি প্রভাবিত হইনি কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলাে এইভাবেই যদি গল্পটা শুরু করা যায় তা হলে কেমন হয়। আকাশে মেঘ ছিল তখন। ওইভাবেই গল্পটা শুরু। তার পরে গল্প অন্য রাস্তায় চলে গেছে। ওই কদম আলি বলছে— ‘আর কখন যাবি রে রহম আয়’, তখন বৃষ্টির মধ্যে তারা এগিয়ে গেল—তারপরে ও গল্প সম্পর্কে আমার আর ভাবতে হয়নি। তাদের চাষের গরু একটা মারা গেল। তার পরে ওখানে একটা বিরাট সাপ দেখা গেল। সাপ আমি দেখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু যত বড় বলেছি তত বড় নয়। যখন সে ফণা তুলল, তখন মনে হলাে সমস্ত জগৎ আবৃত করে সে আছে। এটা রূপক হিসেবে। বিলের অনন্ত জীবনের রূপক। সেটাই তুলে ধরা হয়েছে এর মধ্যে। সমস্ত গ্রাম আশপাশে যাকিছু আছে সবটাই যেন ওই সাপের মুখের মধ্যে, বিবরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এটা জীবন-সংগ্রামের ব্যাপার। রহম আলির আর করম আলির ওই কঠিন জীবনের কথা। আর সব শেষে যা হয়েছে—রহম আলি ও করম আলির জমি কেড়ে নেবে, তখন তারা কী করবে? গরু দুটো বিক্রি করতে নিয়ে গেল। একদম হতাশ জীবন। বাড়ি ঢুকতেই ঘরের দাওয়ায় বৃষ্টির দিনে একটু দাঁড়িয়েছিল, আর বাজ পড়ে একজন মারা গেল। ছেলে তখন ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। এই কাহিনি কল্পনা নয়। সেই লাইনগুলাে আমার মধ্যে এসেছিল। আমি কল্পনা করে কিছু লিখি না। যেটা আসে সেটা অবশ্যই মত্তিকার ঘনিষ্ঠ, তা না হলে আকাশকুসুম কল্পনা করে আমি কোনাে গল্প লিখিনি। ওই গল্পের প্রতিটা ছত্র অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা। ওইকথা বলতে বলতে কখনাে কখনাে দার্শনিকতা চলে এসেছে। আকাশের মতাে করে পড়ে আছে বিল, একঝাঁক পাখি আসছে আবার চলে যাচ্ছে দূরে। এই বিলটা সেইজন্য অনন্ত জীবনের প্রতীক আমার কাছে দেখা দিয়েছে। আমি এর কাছাকাছি কোনাে গল্প পড়েছি বলে মনে পড়ে না। আমি জানি না হেমিংওয়ের কোনাে গল্পের প্রভাব আমার এই গল্পে আছে কিনা। ফকনারের ‘বিয়ার’ বলে একটি গল্প ছিল। এই বিয়ার গল্পটা একটা শক্তি যাকে পরাজিত করা যায় না। বারবার মানুষের জীবনে ফিরে আসে। ফকনারের এই গল্পটা তােমাদের পড়া উচিত। এই বিয়ার গল্পের সঙ্গে যদি কেউ মনে করে আমার গল্পের মিল আছে—আমার নিজের তেমন কিছু মনে হয় না। কেউ কেউ অবশ্য মনে করে। তাই হয়তাে কেউ কেউ মনে করে আমৃত্যু আজীবন গল্পের মতন গল্প পৃথিবীতে খুব কম আছে। বিয়ারে এই গল্পের মতাে গভীরতা নেই। তবে আছে একটা মৃত্যু। সেই বিয়ারটা প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার সঙ্গে আমার গল্পের সাপটার একটা মিল আছে, যাকে কেউ মারতে পারে না, যে মারা যায় না। এখানেই গল্পটা প্রতীকী হয়ে গেছে। মানুষের জীবন ক্রমাগত শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু মানবকে মারা যায় না। তা ক্রমাগত থেকেই যায়। এটাই আমার জীবনের মূল দর্শন। এই বিল চিরকালীন জীবনের প্রতীক।

জীবন ঘষে আগুন
এই গল্পটা '৬৯ সালে লেখা। তখন সবে দেশে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। তখন কিভাবে যেন এই গল্পটার পরিকল্পনা মাথায় এলাে। সবটাই আমার ছেড়ে আসা গ্রামের পটভূমিতে তৈরি। আমাদের গ্রামের পাশে ক্ষীরগ্রাম নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানে একটা দিঘি আছে, যেটা এক মাইলের বেশি লম্বা। তারপরে আছে পর পর তিনটি দিঘি । দিঘি থেকে নেমে সড়ক পথ । আমাদের গ্রাম ছিল কাদায় ভরা। তবে মাটিতে বালির আধিক্য থাকায় কাদা তেমন চটচটে ছিল না। ওই গ্রামে একটা মেলা বসত প্রতি বৈশাখে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন শুরু হয়ে মেলা এক মাস স্থায়ী হতাে। প্রথম দিকটা আম-কাঁঠাল, নানা রকম ফল যেমন তাল ও কলার পসরা বসত। তারপর একটা-দুটো করে মনিহারি দোকান ইত্যাদি। আরও এগিয়ে গেলে অনেক মিষ্টির দোকান। আশপাশে যত ভালাে মিষ্টির দোকান ছিল ক্ষীরগ্রামে, সব ওই মেলাতে আসত। আমাদের গুরুমশায়রা ও বয়স্করা ওই মেলায় আসত। যাবার সময় বলত— ‘যাবি রে মেলা দেখতে?’ প্রায় সমবয়সী ভগ্নিপতি ও শ্যালক আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে মেলায় যেত। তারা যখন বলত—‘কিছু নিবি রে?’ তখন আমি বলতাম—‘ওই ছুরিটা নেব।’ ছুরিটা দশ আনা দিয়ে আমায় কিনে দিত। তারপর মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে কী মিষ্টি খাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করত। আমি বলতাম রাজভােগ খাওয়া যাক। ভেতরে সুগন্ধি দেওয়া বড় রাজভােগ। আমরা একটা-দুটো করে খেতাম। মেলা থেকে বেরিয়ে এসে যে দিঘিটা জলে পরিপূর্ণ সেখানে আসতাম। সেই দিঘি থেকেই ঠাকুর ওঠানো হয়েছে। যােগাদ্যা ঠাকুর, পাথরের একটা ঠাকুর। ওকে জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এর পরে জলের মাঝখানে নিয়ে আসা হতাে। পুজোর আগে আগেই কিনারাতে চলে আসেন তিনি নিজেই। তখন আবার জল থেকে তুলে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে যােগাদ্যা পুজো হয়। অজস্র বলিদান হয়। পাঁঠা হাজার হাজার। দুপুরবেলায় মােষবলি। দারুণ রােমহর্ষক ব্যাপার। সার্কাস আসত মেলায়। জাদু হতাে। একটা মানুষের দুটো মাথা—এ রকম নানা রকম জাদু। সার্কাস দেখার খুব আনন্দ ছিল। একটা পাঁঠা সিঁড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে ওপরে তারে উঠল, তারের ওপর উঠে খেলা দেখিয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তারপর বাঘের খেলা, হিংস্র বাঘ। বাঘ তাে পােষ মানে না! একেবারে ছ’ছটা বাঘ একসঙ্গে। হাতের লাঠিটাকে বিদ্যুতের মতাে ঘােরানাে হতাে। এতে ওরা খুব ভয় পেত। বাঘগুলাে সব রয়েল বেঙ্গল। আবার কখনাে কখনাে ছ'টা সিংহ একসাথে। কখনাে কখনাে আগুনের একটা বলয় তৈরি করা হতাে। সিংহের পিঠে চাবুক মারলে তারা সেই আগুনের বলয়ের মাঝখান দিয়ে এপার থেকে ওপারে লাফিয়ে পড়ত। এই খেলাগুলাে সব শেষে হতাে। তার আগে জোকার, ট্রাপিজের খেলা ইত্যাদি অনেক কিছু দেখানাে হতাে। এক টাকা লাগত দেখতে। পরবর্তীকালে সার্কাসে সামনের দিকে কিছু চেয়ার দেওয়া হয়েছিল। তাদের জন্য হয়তাে ৫ শিকে। আর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল শতরঞ্জি। সব মাটিতে বসে আছে। ওরা ওই এক টাকা দিয়েই দেখত। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত আমি সার্কাস খুব এনজয় করেছি। এই মেলাতে লােক জড়াে হতাে শুকনাে প্রান্তর পার করে। চারপাশ থেকে লােক আসছে—সঙ্গে একটা করে পাঁঠা, সেটা বলির মানত দেওয়া আছে। কারাে হাতে পাঁঠা, কারাে হাতে ছাগল, কারাে ঘাড়ে তার মেয়ে। চারপাশ থেকে লােক আসছে তাে আসছেই। নাপিত আর কামার—দু’জনের কাজ এখানে। নাপিতের কাজ ছেলেগুলাের চুল কেটে ন্যাড়া করে দেওয়া। আর কামারের কাজ হচ্ছে বলিদানের। একটার পর একটা পাঁঠা বলি দিচ্ছে। হাঁড়িকাঠের ওপর মাথাটা ঢুকিয়ে একজন পা ধরে টানছে, গলাটা একটু লম্বাটে হয়ে যাচ্ছে—মারছে কোপ। আলাদা হয়ে গেল। ওরা আবার বলি হয়ে গেলে ঘাড়টা নিয়ে নিত, সেইজন্য এমন করে কোপ মারত যাতে ঘাড়ের সামনের অনেকটা অংশ চলে আসত। তাতে মাংস হতাে। তারপরে এই কাটা পাঁঠাটা যারা মানত করত তারা পিঠে বেঁধে নিয়ে যেত। অনেক আগে যখন নরবলি হতাে তখন তেঁতুলে বাগদিদের মধ্যে একজনকে বলি দেওয়া হতাে শুনেছি। পরবর্তীকালে ওর ঘাড়ের ওপর খাঁড়া ঘষে একটুখানি রক্ত নিত। তারপর একসময় নরবলি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা নরবলি দেখিনি, মহিষ বলিদান দেখেছি। মহিষের গলা মােটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ওপরে কাঠের ঘূর্ণিতে টানা হতাে। ৭-৮ জন লােক টানছে আর মােষের ঘাড়টা লম্বা হয়ে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত মােষের চারটে পা উল্টে গেল। চারটে পা-ই যখন উল্টে গেল তখন মােষের ঘাড়টা মনে হচ্ছে সরু। তখন পাশ থেকে মারত কোপ। আমাদের গ্রামের কামারই এই কাজ করত। তারপর এখান থেকে নিয়ে গিয়ে মন্দিরে তারা নিবেদন করত একসময়, যারা মানত করেছে। কিন্তু মা তাে পাঁঠা খায় না। তাই তারা সেটা বাড়ি নিয়ে যেত। যােগাদ্যা কালীর আরেক রূপ। চার হাতওয়ালা কালী। আমার এই গল্পটা এটাকে ভিত্তি করেই লেখা। চারদিক থেকে মানুষ আসছে তাে আসছেই। মিলিত হচ্ছে এক জায়গায়। আর ওই মেলাটা সূত্ৰপাত করার জন্য বর্ধমানের মহারাজা হাতি পাঠাতেন অতিথিদের জন্য। তারা হাতির পিঠে চড়ে আসতেন। সেজন্য ‘রাতারাতি রাজার হাতি এসে গেল’–এটা দিয়ে আমার গল্পটা শুরু। তারপর পদ চতুষ্টয় মাটিতে বসে যাচ্ছে, গ্রামের ছেলেপুলে তাদের পিছু নিয়েছে, ‘হাতি তাের গােদা পায় মারব লাথি’—বলছে। হাতির পায়ের ধুলাের ওপর ছাপ পড়েছে, সেখানে গড়াগড়ি খেয়ে মুসলমান ছেলেরা বলছে-‘হাতির মতন গােদা করে দাও গাে আল্লাহ।’ এইসব আছে গল্পে। গ্রামীণ পরিবেশটা ধরা হয়েছে এভাবে। আশপাশের সমস্ত এলাকাটা ধরা হয়েছে। এই গল্পে আমার দেখা রাঢ় ধরা পড়েছে, শুকনাে রাঢ়। সেখানকার প্রথা ইত্যাদি। লাঙলের কথা বলা হয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের ১১ তারিখে লাঙল দেওয়া হয়— সেইজন্য হাল লাঙল বলা হয়। ঠাকুর এসে একটা বক্তৃতা দিয়ে, সিঁদুর লাগিয়ে দিতেন মােষের পিঠে। আর ফালওয়ালা একটা লাঙল তার পিঠে বেঁধে দেওয়া হতাে। ছােট, তেজি মােষ। এরপর সেটাকে যেমন খুশি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পিঠে বাড়ি মেরে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হতাে। তখন গ্রামের লােক তার পিছু পিছু ছুটত। আর লাঙল নিয়ে মােষগুলাে যখন ছুটতে শুরু করেছে তখন সেই লাঙল কখনাে জমি স্পর্শ করছে, কখনাে বা মােষের পায়ে বিঁধছে। তখন সেই মােষটা একসময় খুঁতাে হয়ে গেল। তখন ওইখানেই লাঙল চালানাের শেষ। বাগদিপাড়ায় অনেক পেশা আছে। বাগদিরা অচ্ছুৎ। তাদের ছােঁয়া যায় না । কিন্তু তাদের মেয়েদের কোনাে দোষ নেই। বাবুরা তাই যখন-তখন ওদের ঘরে ঢুকে পড়ে। এইসব বাস্তব চিত্র। ওখান থেকেই গণযুদ্ধ শুরু। একটা বাবু যখন একজনের বাড়িতে ঢুকেছে, তখন বাগদিরা চারপাশ ঘিরে ফেলল। সেই লােকটাকে ধরে ফেলে এবং তার পর সমস্ত মুসলমানপাড়া ঘুরে বাগদিরা বাবুদের বাড়ি আক্রমণ করল। এইভাবে গল্পটা শেষ হয়েছে। রাজার হাতি তখন লাফ দিচ্ছে, শোনা যাচ্ছে হাতির ডাক। এটা আমার দেখা রাঢ়বঙ্গের জীবনচিত্র ছাড়া আর কিছু না। রাঢ়ের উপােসী মানুষের, তেঁতুলে বাগদিদের, মুসলমানদের জীবনচিত্র। মেলাটা রাঢ়ের এক যাপনচিত্র। লেখাটা এক্ষণ পত্রিকায় বেরােলে অনেকের প্রশংসা পায় । মূলত খুলনাতে বসেই লিখেছিলাম গল্পটা। শেষ কিছুতেই হচ্ছিল না। সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য কলকাতায় আমাকে একবার পাকড়াও করে ৭৩ মহাত্মা গান্ধী রােডের অফিসে আমাকে আটকে রেখে লেখাটা শেষ করতে বাধ্য করেন। সত্যি এমন সম্পাদক আমি ইহজীবনে দুটো দেখিনি। 

বিধবাদের কথা
এই গল্পটার পটভূমি একটু অন্যরকম। আমার ধারণা কুষ্টিয়া জেলার দূর দূর প্রান্তে কিছু গ্রাম আছে। কোনাে কোনাে গ্রাম প্রায় বর্ডারের কাছে। এখানে কেউ যায় না। সেইরকম একটা জায়গার দু’জন স্বামীহারাকে নিয়ে এই গল্প। এর অনেকটাই আমার কল্পনা। এরা স্বামীহারা এবং পরে পুত্রহারা। এরা দুই বােন। এরা দু’জনেই বিধবা। কিন্তু আমি তাে বিধবা থেকে শুরু করিনি। ওরা যখন ছােট তখন একজন বাপের এক কোলে, আরেকজন আরেক কোলে উঠত। সেইভাবেই মানুষ। একজন কালাে আর একজন ফর্সা। ওরা দু’জন যখন বিধবা হয়ে গেল সেই প্রথম দিকের কাহিনি আমার একটু লেখা হয়েছিল। একজন বলত, ‘তুই মায়ের এই বুকটা খা আমি ওইটা খাব’। ‘তুই বাবার এই কোলটায় চড়, আমি ওইটায় চড়ব’। এই রকমই ছিল। পরে যখন ওরা দুই বােন বিধবা হয়ে গেল, নিদারুণ দুর্দশায় পড়ল। কী খাবে ঠিক নেই। স্বামী অকালে চলে গেল। স্বামী লােকের বাড়ি পাট কাটত, চাষবাস করত। ওরা দু’বােন, ওদের দুই স্বামী, ওরা দু’ভাই। একজনের ছেলে। ভালাে। আরেকজন দুর্দান্ত বদমাশ। এভাবেই গল্প এগিয়ে গেল। আমি এমন দুই বােন বাস্তবে দেখিনি। তবে কালাে বউ আর কটা বউ আমাদের গ্রামে অনেক ছিল। মুসলমানপাড়ায় একজনের চোখ খুব নরম কটকট করে। ওই কটা আর কালাে দুই বিধবাকে সামনে রেখে এই গল্পটা লিখেছিলাম। ওই দশকটার কথা চিন্তা-চেতনায় কাজ করেছিল। সময়টা সিক্সটিজের শেষ দিক। এরকম দারিদ্র্য আগেও দেখিনি পরেও না। তার পর দুর্ভিক্ষ হয়েছিল '৭৪ সালে। এইসব মিলিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলাম। ‘বিধবাদের কথা’ গল্পটা লেখা এভাবেই। কী করবে তারা এই প্রশ্নটা  ছিল বাংলাদেশে। পাকিস্তান আমলে কী দুর্দশার মধ্যে তারা ছিল তা কল্পনা করা যায় না। ২৩ বছর তাে কাটালাম। এখানে সেইসময় আমাদের অবস্থাও শােষণে জর্জরিত। ওদের অবস্থা আরও শােচনীয়। তারপর ওদের সম্পত্তি দখল, তাড়িয়ে দেওয়া ভিটেমাটি ছেড়ে, এখান থেকেই আমি এই দুই মহিলাকে গড়ে তুলি। এদের কোনাে বাড়ির বউ হিসেবে দেখিনি। আমাদের বাড়িতে পাঁচ বউ ছিল, কিন্তু আমাদের অবস্থা হতদরিদ্র ছিল না। বাড়িতে বিধবা ছিল না। তখন আইয়ুব সাহেবকে কেউ পছন্দ করে না। একদল বলে সে গরিব—আর ওরা দুশমন। ইয়াহিয়া খানও দুশমন। এসব নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে দু’ভাইয়ের মধ্যে। এইসময় এটা হতাে। তারপরে কেমন যেন গােটা বাংলাদেশই বিধবা হয়ে গেল। মনে হলাে এ দেশটা বিধবাদের দেশ হয়ে গেছে। দেখাশােনার লােক নেই। এমন অবস্থা বাংলাদেশের হয়েছে। এটা এতটাই পরিত্যক্ত যে, মুত্যুও যেন এদের পরিত্যাগ করেছে। দুর্ভিক্ষের সময় অবস্থাটা এ রকমই ছিল। প্রকারান্তরে এটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প। শেষে তাে তাই হলাে। দু’জন বিধবা, কারাে সন্তান নেই। তখন তারা কাঁথা সেলাই করছে। নিজের জীবনের ছবি আঁকছে। একজন সন্তানদের ছবি আঁকছে। ‘বিধবাদের কথা’ গল্পটা আমার কাছেও খুব কষ্টদায়ক। তারা পরস্পরের সাথে কথা বলছে না, কাঁথা সেলাই করে যাচ্ছে। তারা জরি দিয়ে জীবনের ছবি আঁকছে। রুক্ষ প্রকৃতির যে মহিলা তার একরকম ছবি, আর একজন নরম প্রকৃতির তার আরেকরকম ছবি। সে তার ছেলের ছবি আঁকছে। আসলে সেলাই করছে। সেলাই ব্যাপারটা শিল্প হিসেবে দেশজ। আর সেটাই আমি এনেছি গল্পের শেষে রূপকের আশ্রয়ে।

২০১৯




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ