bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

জয়দীপ দে’র গল্প: ইলিশের গন্ধ


৩ নম্বর প্লাটফরমের এক মাথায় দাঁড়িয়ে নতুন স্টেশনের টিকিট চেকিংয়ের গেটটা দেখার চেষ্টা করে গফুর আলি। বৃথা চেষ্টা। কেশো রোগীর মতো খুক খুক করতে করতে একটা শান্টিং ইঞ্জিন এসে সব যেন আড়াল করে দেয়। শান্টারের পেছনে ঢাকা মেইলের কেটে ফেলা বগিগুলো। বাকি বগি নিয়ে একটু পরই সাজবে চট্টলার রেল। গফুর আলির দু'চোখেই এখন ছানি। সবকিছুই ঘোলা ঘোলা। তার ওপর টুকরো টুকরো কিছু কালো দাগ ভাসে। গফুর আলি জানে না, কিন্তু ডাক্তারদের ধারণা, এটা গ্লুকোমার লক্ষণ। গফুর আলি আপন মনে হাসে আর ভাবে কত এ রঙ্গখেলা! পিকচার টিউবেরও তো আয়ু আছে…

গফুর আলি ডাঁটিঁ ভাঙা মোটা গ্লাসের চশমাটা আগে-পিছে নিয়ে চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ করার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থির করতে পারে না শান্টারের নম্বরটা কত। বাইশ সতেরো না বাইশ সাতাশ। দুটোই সে চালিয়েছে। ৮০০ হর্সপাওয়ারের এ ছোট্ট ইঞ্জিনগুলোর টান ছিল দুর্দান্ত। এটা নিয়ে সে মেঘনা টেনেছে। কর্ণফুলীর সঙ্গে কখনো গেছে কিনা, ঠিক মনে পড়ছে না। তবে মজা ছিল তেইশ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোয়। উল্কা ছুটতো সত্যি উল্কার গতিতে। এর আগে গ্রিন অ্যারো। গফুর আলির কাছে স্মৃতি এখন অনেকটা অধরা। চোখ বন্ধ করে হাতড়ালে যেমন এটা ওটা পাওয়া যায়, তেমনি অক্লেশে মাঝেমধ্যে কিছু স্মৃতি ভুরভুরি তোলে। এতে নেই পরম্পরা, নেই সাযুজ্য। সব ছেঁড়া ছেঁড়া। গফুর আলি অবসরে সেসব ছেঁড়া টুকরোগুলো মেলানোর চেষ্টা করে। মনে মনে গেঁথে রাখতে চায় তার ফেলে আসা দিনের পূর্ণ ফিরিস্তি।

সে বছর আয়ুব সাই বোধহয় ক্ষমতায় এল। খবরটা পেয়েছিল সে লাঙ্গলকোট বাজারে সবজি বেচতে এসে হামজা সর্দারের কাছে।

'এরোই ভালা অই যা, ইসকান্দার মিরজার আমল নাই রে। আইউব সাই আইছি। হাছার চমড়া তুলি হালাইব।'

এতটুকুন তার স্পষ্ট মনে আছে। আগেপিছের কিছুই মনে নেই। কেন পাছার চামড়া তুলে ফেলানোর মতো কঠিন ভয় দেখানোর প্রয়োজন হলো হামজার আর এর প্রতিক্রিয়াই বা সে কী করেছিল। ...এরপর ঢোলের আওয়াজ। রেল কোম্পানির লোক নেয়ার ঘোষণা। চাকরি করতে চাইলে সকালের ট্রেনে উঠে পড়লেই হবে। এর মধ্যে আর কিছু মনে নেই গফুর আলির। ফের স্মৃতি যখন জেগে ওঠে, তখন সে ফোরম্যান ফার্নান্দোজের বাংলোয়। লাল দুটো গাভীর জন্য বস্তা ভরা ঘাস কেটে আনে কাছের পাহাড়গুলো থেকে। ফার্নান্দোজের বউয়ের নাম ছিল ক্যামিলা। কালো মেম। ভীষণ কিপটে ছিল নিঃসন্তান মহিলাটি। বাংলোর সব ফল পেড়ে ঘরে লুকিয়ে রাখত। পচে যেত, কিন্তু কাউকে দিত না। আর তেমন কিছুই মনে নেই গফুর আলির। ক্যামিলাকে সে একবার স্নান করতে দেখেছিল। সে স্মৃতিটাও আর চোখে ভাসে না। এরপর একদিন লোকোশেডে কয়লার গুঁড়ো ঝাড়ু দেয়ার কাজ। আরেক দিন ফার্নান্দোজ তাকে হাসি হাসি মুখে উঠিয়ে দিল পিতলের বিশাল ইঞ্জিনটার পিঠে। বেলচা দিয়ে টিন্ডার থেকে কয়লা নিয়ে ফায়ার চেম্বারে ফেলার কাজ। একটা সময় ইঞ্জিনের পুরো ক্যাবটা অগি্নকু- হয়ে যেত। সে আগুনের ভেতরে বসে লোহার শলা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফায়ার চেম্বারের আগুন বাড়ায়। তারপর বড় কোনো স্টেশনে দাঁড়ালে হাতির শুঁড়ের মতো একটা পিলারের নিচে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনের ট্যাংকটা ভরিয়ে নিতে হতো পানিতে। সে পানিতে ইচ্ছামতো ভিজিয়ে নেয়া যেত শরীর। কি শান্তি!

এর মধ্যেই চলে এল জেনারেল মোটরের ইঞ্জিন। কয়লা-পানির বালাই নেই। তেলে চলে। একেকটার এই দশাসই গড়ন। বোঁচা নাক। জন্ম আমেরিকায় হলেও দেখতে জাপানিদের মতো। ফায়ার চেম্বারে কয়লা ছুঁড়তে ছুঁড়তে জানালা দিয়ে দেখত ওয়ান আপ ছুটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। যেন একটা রক্তমাখা তীর ছুটে গেল। ধোঁয়া নেই, আওয়াজ নেই। কেবল একটা গাম্ভীর্য ছড়িয়ে গেল নীরবে। সেই স্বপ্নের ডিজেল ইঞ্জিনের ক্যাবে বসার সুযোগ হলো দেশ স্বাধীনের পর। বিহারি সব ওস্তাদরা গা ঢাকা দেয়ার পর ফায়ারম্যান থেকে এক লাফে সে ড্রাইভার হয়ে গেল।

নানা এমুই আইয়েন।

জেএলআইয়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে সবুজ একটা কাগজ নাড়িয়ে মিজান ইশারা করে। গফুর আলির চিন্তার সুতো কেটে যায়।

জেএলআই মানে জুনিয়র লোকো ইন্সপেক্টর। কাজ হলো স্টেশনে আসা ইঞ্জিনের নম্বর টুকে রাখা। তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়। তার ওপর আছে অফিসে বসে মাইলেজ পাওয়ার সুযোগ। তাই নেতাগোছের লোকজনই এখানে পোস্টিং পায়। মিজান অল্প দিন হয় এ পদে এসেছে। মূলত সে লোকো মাস্টারের সহকারী। কিন্তু অল্প দিনেই সে তার পরোপকারী স্বভাবের জন্য সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তার বাবাও রেলে চাকরি করতেন।

জেএলআইয়ের রুমে জমজমাট আড্ডা জমেছে। রানিং স্টাফ ইউনিয়নের দুজন নেতা আছেন। একজন গার্ড, একটু পরই চট্টলার ডিউটিতে যাবে। কয়েকজন জুনিয়র সহকারী লোকোমাস্টার।

ওস্তাদ, আছেন কেমন। রানিং স্টাফ ইউনিয়নের সেক্রেটারি খসরু উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল গফুর আলিকে।

গফুর আলি কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কে যেন বলে উঠল, নানা তো ভালা আছে, ইস্টিশনে আই নানি তুঁয়ায়।

গফুর আলি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না, ওই হালা আটকুড়ার ব্যাডা, তোর মায়রে...

এর মধ্যে একটা হাসির দমক গফুর আলির কথাগুলো মুছে দেয় প্রেক্ষাপট থেকে।

মুরবি্ব বইয়েন। শয়তান পোলাপাইন, মুরবি্ব মানে না।

তারপর আদিরসাত্মক গল্পের ঝড় ওঠে। গফুর আলি সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। জুনিয়র লোকোমাস্টাররা দাঁত কেলিয়ে হাসে।

নানা, ট্যাংকের কী খবর?

ধুর ধইনচার পুত, মাজার জোর থাহন লাগে। কষার লালা মুছতে মুছতে গফুর আলি আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তোর জন্মের আগে সিংগুল লাইনে টু স্টউকের ইঞ্জিন দিয়া ৫ ঘণ্টায় থ্রি আপরে নিয়া গেছি। সাতশ একরেও তো পারছ না ৫ ঘণ্টাত আইনতে... এত ভালা লাইন, এত ভালা ডাব্বা... চঁইয়ার গাড়ি চালাছ না ব্যাডা...

গফুর আলির আবার স্মৃতির ভুরভুরি ওঠে। তার ওস্তাদরা ছিল একেকজন পৌরুষ্য-উজ্জ্বল ব্যক্তি। পাহাড়তলী শেডে প্রথম যার হাত ধরে ইঞ্জিনে ওঠা, সে এক বিহারি বুড়ো। নাম এরফান। চুল-ভ্রূ সব পেকে কাশ হয়ে গেছে। অথচ ক্যাবে উঠলে সে বাঘ। ইচ্ছামতো খিস্তিখেউড়ি ছাড়ত। মাঝেমধ্যে মাল খেয়ে ঝিম ধরে বসে থাকত গদিতে। ট্রেন চলত বেপরোয়া। ডেড স্টপেজের মায়রে বাপ। কিন্তু আউটার সিগন্যালে এলেই নিপুণ হাতে গাড়ির গতি নিজের মুঠোয় নিয়ে আসতো। আর কালাম ড্রাইভার ছিল তেল চুরির ওস্তাদ। কিন্তু বড় দিলদার মানুষ। ক্যাবে উঠলেই এটাওটা খাওয়াতেই থাকত। গ্রেড ওয়ান ড্রাইভার হয়ে গুডস ট্রেনের ট্রিপ মারার জন্য ছিল উদ্গ্রীব। লাকসাম কি হালিশহর কি শর্শীদি কি ফাজিলপুর, সুযোগ পেলেই ইঞ্জিন থামিয়ে ট্যাংক খুলে দিত শ্যালো মেশিনের পাইপ ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য। দু-তিনবার হাতে নাতে ধরাও পড়েছিল। চাকরির পর একটা টাকা বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি। তেল চুরির প্যানাল্টি দিতে গিয়ে সব শেষ। কালাম ড্রাইভারের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। লোকের মুখে শুনেছে, যে লোক অন্যকে খাওয়াতে বড় ভালোবাসত, সে না খেতে পেরে মারা যায়। কেউ কেউ নাকি তাকে ভিক্ষা করতেও দেখেছে। রহমত ড্রাইভার ছিল আরেক বাঘ। ডেডম্যান প্যাডেলে পাথর বসিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ত। সিগন্যাল এলেই আপনা থেকেই জেগে উঠত। তারপর জাদুর মতো করে পুরোটা ট্রেন তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসত। তার দুই ছেলে এখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। সে মাঝেমধ্যে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে লোকোশেডে আসে। সেদিনের সে তাগড়া জোয়ান আজ এক শ্বেতশুভ্র বৃদ্ধ। দেখলেই সুখবোধ হয়।

নানা, পাসগা নেন... ২৭ তারিখ সিংগুল কুপ একটা দিছে।

ডিএমই সাহেবের সিল-ছাপ্পড় মারা সবুজ রঙের পাসটা খুব কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করে গফুর আলি।

কোনাই যাইবেন মুরবি্ব। খসরু উৎসুক হয়ে ওঠে।

এমনই সময় বাইরে মেঘ ডেকে বৃষ্টি শুরু হয়। ডিপ্রেশনের কারণে দুদিন ধরে আকাশ থমথমে ছিল। এ বৃষ্টি চলবে টানা তিনদিন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে একটা ট্রেন ঢুকল ৩ নম্বর প্লাটফরমে। তিনটি মাত্র প্যাসেঞ্জার বগি আর একটা মালের গাড়ি।

কোনগা আইছে নাতি, গফুর আলি চশমার দুর্ভেদ্য প্রাচীর ডিঙিয়ে তাকায় মিজানের দিকে।

ফোরটিন ডাউন।

জালালাবাদ। লোড কত?

লাগেজভ্যানসহ আষ্ট।

হায় রে।

গফুর আলির সোনালি দিনগুলো স্মৃতির সরোবরে ঘাই মেরে ওঠে। প্রত্যেক লোকোমাস্টারের পছন্দের একটা ট্রেন থাকে। গফুর আলির ছিল জালালাবাদ। আশির দশকে সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের একমাত্র ট্রেন। তখনো এত বড়ো স্টেশন হয়নি। পুরনো স্টেশনের চারটা প্লাটফরম নিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশন। স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথাজুড়ে থাকত জালালাবাদের রেক। ছিল সেকেন্ড ক্লাস সস্নিপার, ফার্স্ট ক্লাস, এসি সস্নিপার। সব মিলে ১৫-১৬টা তো বগি থাকতই। চা বাগানের সাহেবরা আসতেন ফার্স্ট ক্লাসে চেপে। তারা ট্রেনে ওঠার আগে ড্রাইভারকে ডেকে বকশিশ ধরিয়ে দিতেন। চাওয়া একটাই, ট্রেনটা যেন সময়মতো যায়। অকশনটা ধরা যায়। ডিসি এসপি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবাই তখন জালালাবাদের যাত্রী। কারণ চট্টগ্রাম তখন সিলেটের ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার।

এরই একগা গন্ধ ফারনি কোনো? গফুর আলি অবচেতনে বলে ওঠে।

কিয়ের গন্ধ নানা।

ইলশার।

ও নানা, আন্নের মাথা খারাপ অই গেছেনি। ইস্টিশনে ইলিশ মাছ হান কোনায়। এ রেয়াজউদ্দিন বাজারনি…

এরোই বেকুবচুদা... তুই কী বুইজবি। প্রত্যেকগা ট্রেনের একগা নিজস্ব গন্ধ আছে। আওয়াজ আছে। তোগো দিলে তো আল্লায় ভালোবাসা দে ন। তোরা কী বুইজবি।

গফুর আলি ঘুমের ঘোরে যেন হাতড়ে পেয়ে যায় স্মৃতির অমূল্য পরশপাথর। খলবল করে বলতে থাকে তার ইলিশের গন্ধময় সেই দিনগুলোর কথা। জালালাবাদ তখন সাহেব-সুবা আর চা পাতায় ভরপুর একটা ট্রেন। তার পাসিং দিতে ২ মিনিট লেট হলে পরদিন স্টেশন মাস্টারসহ পয়েন্টসম্যানকে ডেকে পাঠানো হতো সিআরবিতে। ডিটিএস ডিএমইর চোখ যেন লেগে থাকত ট্রেনটার গায়ে। গফুর আলি বুকিং ক্লার্ককে এটাওটা দিয়ে খুশি রাখত। বিনিময়ে মিলত জালালাবাদের ডিউটি। জালালাবাদ লাকসামে এলে চাঁদপুরের ইলিশের ব্যবসায়ীরা চলে আসত ক্যাবে। একজোড়া দেড় হাত সাইজের ইলিশ ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করত, ট্রেন যেন সময়মতো বটতলী চলে যায়। সেখান থেকে মাছ যাবে রেয়াজউদ্দিন বাজার। তারপর ছড়িয়ে পড়বে সারা চট্টগ্রামে। গফুর আলির স্পিডমিটারে গতির ঝড় উঠত। যত তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া যাবে, বউয়ের হাতে তাজা মাছের পেটি ভাজা খাওয়া যাবে।

সেবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। মালের বগিতে আর যেন জায়গা হয় না ইলিশের। ড্রাইভার আর ফায়ারম্যান মিলে চার হালি ইলিশ পেয়েছিল ভাগে। একেকটা ইলিশ দেড় হাত লম্বা। কিন্তু আফসোস, ইলিশটা ভালো করে খেতেও পারল না গফুর।

কালে চট্টগ্রামে এসে দুপুরে লোকাল নিয়ে ছুটতে হলো আখাউড়া। সেখান থেকে অর্ডার পেয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে সৈয়দপুর। কেলকোয় ডেড ইঞ্জিন বুঝিয়ে দেয়ার কাজ। ফেরার পথে গৌরীপুর এসে সে খবর পেল, তার সন্তান খুব অসুস্থ। শেষে ভৈরব এসে টু ডাউন ধরে চলে এল চট্টগ্রামে। তার তিন বছরের ছেলেটা ইলিশ খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। বাসায় কেউ ছিল না বলে বউ-সন্তানটাকে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেনি। পরে প্রতিবেশী রতন বসাক শিশুটাকে রেলওয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে। গফুর আলি হাসপাতালে গিয়ে দেখে, ছেলেটা বিছানার সঙ্গে যেন লেপ্টে গেছে। শরীরে কয়েকটা কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু নেই। ডাক্তার রওশনারার হাতে ছেলেটার জন্ম। গফুর আলি খুশিতে সেদিন তিন কেজি মিষ্টি দিয়ে গিয়েছিল তার বাংলোয়। তাই বোধহয় ভদ্রমহিলার টান ছিল ছেলেটার প্রতি। তিনি গফুরকে ডেকে নিয়ে বললেন, গফুর দেরি কইরো না, মেডিকেলে নিয়ে যাও। বাচ্চার অবস্থা ভালো না। সেদিন দুপুরেই ছেলেটা মারা যায়।

ছেলেটা গেল, সঙ্গে করে ইলিশ মাছের স্বাদ নিয়ে গেল। এর পর থেকে গফুর আলির মুখে আর ইলিশ রোচে না। তবে গন্ধটা তাকে এখনো উন্মাতাল করে তোলে। মাঝেমধ্যে বাজারে গেলে ইচ্ছা হয় এক জোড়া ইলিশ নিয়ে নিতে। কিন্তু এক জোড়া ইলিশ কিনতে গেলে তো তার পেনশনের অর্ধেকটা টাকাই চলে যাবে। মাস চলবে কী করে?

খসরুর ঝাঁকুনি খেয়ে আবার বাস্তবে ফিরে আসে গফুর আলি।

মুরব্বি, কইলেন না তো কুনাই যাইবেন।

ঢাকা।

কিল্লাই।

জেডিজি সাবের লগে দেখা কইত্যাম।

কী পারপাস?

খসরু, তোঙগো এহানে বহুত ড্রাইভাররে চুক্তিভিত্তিক নেয়। আঁরে যদি নেয়।

এই বয়সে হাইরবেননি মুরবি্ব।

কী কস, এই আটকুইড়া ব্যাডাগো তুন ভালা পাইরমু। খালি থ্রটলগা ধরাই দে।

ইগুন বাদ দেন। আল্লাহ-খোদার নাম লন।

ওরে, আল্লাহ-খোদার নাম নিলে তো আর ভাত জুডে না রে... তিনগা মাইয়ারে বিয়া দি জমি-জিরাত সব হারাইছি। পেনশনে লামছাম যা পাইছি, তিন শয়তানে ভাগ গরি লই গেছে। আঁই কেনে বাঁইচতাম। তোগো মতো একগা হোলা থাইকলে এ বুড়া বয়সে হতে হতে হাডিনি রে...।

নানা, গাড়ি কেন্নে চাইলাইবেন, আন্নের তো চোখের জ্যোতি নাই।

আঁর জ্যোতি নাই; তোরার আছেনি? গফুর আলি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। তোগো চোখ থাইকলে আইজ রেলের এ অবস্থা হয়!

চলন্ত সাইকেলের চেনটা যেন পড়ে গেল। না সেক্রেটারি খসরু না জেএলআই মিজান না চট্টলার গার্ড সাহেব, কেউ আর কথার খেই খুঁজে পায় না। গফুর আলি সবুজ কাগজটার ভেতরে কী যেন খোঁজে।

<><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><>

লেখক পরিচিতি: 

জয়দীপ দে, কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৮০ তে চট্টগ্রামে রেলওয়ে হাসপাতালে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। সে সূত্রে রেলপাড়ায় বড়ো হওয়া। আদিভিটা সিলেট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিষয়ে পড়েছেন। বর্তমানে সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: হারকিউলিসের পাখা (২০১৩); উপন্যাস: কাসিদ (২০২০), নিষুপ্ত (২০১৯), গহন পথে (২০১৯)। এছাড়া ভ্রমণ কাহিনী: মাদ্রাজের চিঠি (২০১৯)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ