আশপাশের পুকুর জলা গুলো খালি। বৃষ্টি নাই। তাই পানিও নাই। আর লাল মাটির গাঁয়ে এমনিতেও পানির বড় আকাল। দুই এক বাড়ী ছাড়া গাঁয়ে একটাও নলকুপ নাই। ভোটের আগে চেয়ারম্যান নাকি একটা টিউবল দেবে বলেছে। ভোটে পাশ করে তিনি আর এই মুখো হন নাই।
তাই গাঁয়ের একমাত্র জলাধার- এজমালি কুয়ায় গড়গড় ঘড়ঘড় করে বালতি ফেলা হল। একসাথে মেলা বালতি। কানা ফুটো বালতিগুলোতে পানি তুলতে তুলতে আর সেই পানি আগুনে ছিটাতে ছিটাতে আগুন আরো জোরে ফড় ফড় করে উঠলো। মনে হলো আগুন-দৈত্য এবার সত্যিকার রাগ দেখাচ্ছে! দেখতে দেখতে নিমিষেই সব ছাই ভস্ম হয়ে গেল। সবাই বলল- আহা রে।
বাড়ীর সাথে আরও কত কি যে পুড়ল! গেরস্তের গরু-ছাগল হাঁস মুরগী সব পুড়ে গেল।পরদিন সকালে নিভে যাওয়া আগুনের ধোঁয়া ওড়া দেখতে দেখতে কেউ একজন বলল- ঘর সবারেই মানে না। কলিমের বাপটা অভাগা!
সেটা কলিমের গল্পও। পুড়ে যাওয়া স্মৃতির সাথে কলিমদের বাড়ী পোড়ার গল্প।
কলিম আমার চেয়ে বয়সে বছর তিনেকের বড় হলেও আমরা একই সাথে ইসকুলে যেতাম। সে গেরাম থেকে আমি সেবারই ইসকুলে যেতে শুরু করেছি। কলিম ইসকুলে যায় আরো আগে থেকে। কত আগে থেকে সে আমি জানি না। আমার চেয়ে বড় কেলাস পড়ে। ইসকুলের পথ ঘাট সব চেনে। বয়সে বড় বলে আমাকে ওর সাথেই পাঠাতো মা। কখনো মা নিজেই আমাদের গেরামের শেষ রাস্তার মোড় পর্যন্ত আগায়া দিত।
পথের কোন বাঁকে সরকার বাড়ী, হাজী বাড়ীর ইয়া বড় বড় কুকুরগুলো জিব লেলিয়ে বসে থাকে কলিম সেটা জানে। ছোট ছোট ইসকুলগামী ছেলে ছোকরাদের দিকে কুকুরগুলোর যে একটা বাড়তি হিংসে আছে সে আমি টের পেয়েছিলাম একদিন একাই ও পথে ইসকুলে যাওয়ার সময়। ভয়ংকর কুকুরগুলো এড়াতে রাস্তা ছেড়ে কোন কোন বাড়ীর ভেতর দিয়ে যেতে হবে কলিম সেটাও জানে।
কলিমের আরও জানা ছিল পাথারে ফাঁকা রাস্তার পাশে এক লম্বা লাইনের খেজুর গাছের মধ্যে কোন গাছের গোড়ায় নাগ-নাগিনির হাঁড়ি আছে। সে হাঁড়িতে কলিমের স্বপ্নও ছিল।
স্বপ্নের সেই হাঁড়িতে অনেক ছেলে-পুলে সমেত নাগ-নাগিনি বাস করে। নাগিনি কোনদিনও বুড়িও হয় না। মরে ও না। নাগিনির মাথায় নীল রঙের মনি। সেই নীল মণির অনেক পাওয়ার। নীল মণি রত্ন দিয়ে নীল আলো বের হয় ঠিকরে ঠিকরে। রাতে নাগিনি রাস্তায় বের হলে হাট ফেরা লোকেদের কেউ কেউ সে আলো দেখেছে। একবার এক বাইদার দল খবর পেয়ে এসেছিল নাগ-নাগিনিকে ধরতে। পারেনি। সে গল্প আমাকে শুনিয়েছিল, কলিম।
একদিন সকালে ইসকুলে যাওয়ার পথে সেখানে একটা পাতলা কাগজের মত ছেড়া ছেড়া ছাই-সাদা ছাল দেখলাম। সাপের মতই আঁকাবাঁকা। শুকনো ঘাসের ওপর পড়ে ছিল। ভয়ে আমার গা শির শির করে উঠল। কলিম দেখে অভিজ্ঞের মতই বলল- ‘ওইটা নাগিনির গায়ের চাম। ইস মণিটা যে কই রাখছে নাগিনি?’ আমি সেদিন কলিমের চকচকে একজোড়া চোখ দেখলাম। সেই চকচকে চোখ আমি প্রায়ই দেখি। তবে সে চোখ কলিমের নয়। অন্য কারও!
কলিম জানাল যে, নাগিনির খোলস পাল্টাইতে কয়েকদিন সময় লাগে। তখন নাগিনি মাথার নীলমণি খুলে লুকিয়ে রাখে। হাঁড়ি থেকে দুরে। খুব গোপনে অন্য কোন জায়গায়। যাতে হাঁড়ির অন্য কোন মেয়ে সাপ টের না পায়। টের পেলেই তো ক্ষমতা শেষ। যদি সেই নীলমণি রত্ন অন্য কোন মেয়ে সাপ পেয়ে যায় তাহলে সেই সাপই তখন নাগিনি হয়ে ওঠে। আর আগের নাগিনি আপনা আপনি মারা পড়ে। তখন নতুন নাগিনি পাওয়ার পায়। নীলমণি রত্ন মাথায় থাকলে নাগিনি বুড়িও হয়না। মরে ও না।
এই ফাঁকে মানুষের মধ্যে যদি কেউ মনি টা দখল করে নিতে পারে। তাহলেই হইসে! সারা দুনিয়ার বাদশাহ হওয়া যায়। এরশাদ হওয়া যায়। কলিম তখন এরশাদ হতে চাইত। এ তখনো বুঝি নাই। এরশাদ মানে কি সেইটা পরে বুঝছি! কলিম আমাকে বলল- চল্ ভাই, মনি খুঁজি।
কি এক আজব কান্ড করেছিল কলিম! এখনো আমার মাথায় আসে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেদিন আমরা মনি পাইলাম না। কলিম বলল- ভাই, তুই ইসকুল যা।
কলিম কোন কিছু না বলেই রাস্তার পাশে বসে পড়ল। আমি তাকে জোর করলাম। শেষে বললাম আরবি দেশের খেজুর দেবে ইসকুলে- বাবা বলেছে। মন খারাপ করে কলিম উঠে দাঁড়াল। বই গুটিয়ে ধরে ইসকুলের পথে হাঁটা ধরল। সাথে আমিও।
সেবার কি কারণে যেন সৌদি আরবিরা বাংলাদেশকে পাকা শুকনো খেজুর পাঠালো। বন্ধুত্বের উপঢৌকন হিসেবে নাকি কি কারণে সেই খেজুর পাঠাল আমরা জানি না। সে তো বড়দের ব্যাপার স্যাপার। আমরা শুধু দেখি কার্টনে কার্টন খেজুর! কেউ কেউ বলল দানের খেজুর। হেড স্যার বললেন- ত্রাণের খেজুর। আর মোস্তা চেয়ারম্যানের লোকেরা দুইহাত আসমানে উঠায়ে বলেছিল- বেহেশতী খেজুর!
সেই খেজুর পেতে আমাদেরকে ইসকুল থেকে কয়েক মাইল হেঁটে যেতে হল। লাইন ধরে। সেই লাইনের একবারে আগায় আমাদের ইসকুলের হেডস্যার। হেড স্যারের নির্দেশমতই চলেছিল লাইনটা। আমি সাইজে বেশি ছোট খাট হওয়াতে লাইনে সবার সামনে। তার আগে হেড স্যার। আর সবার পেছনে কলিম। চেয়ারম্যানের বাড়িতে খেজুর বিতরণ চলছিল। সেখানে অন্য সব গুলো ইসকুলের ছাত্ররা এসেছে। কী এক হুলস্থুল পড়ে গেছে সেখানে। চেয়ারম্যানের লোকেরা মহা উৎসাহে বেহেশতি খেজুর বিতরন করে যাচ্ছে। লাইন ধরে আমরা ছাত্ররা দুই হাত পেতে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাড়ায়ে আছি। এদিকে খাড়া রোদের সময় সবাই ঘেমে নেয়ে একাকার। একসময় কেউ একজন হাতে দুই টুকরো খেজুর দিয়েই মিলিয়ে গেল। আমি কলিমের অপেক্ষা করলাম। আগেই হেড স্যার ঘোষণা করেছিলেন এখান থেকেই ইসকুলের ছুটি।
ওটাই ছিল শেষ ছুটির দিন। ছুটি শেষে কলিমের সাথে বাড়িতে ফিরে আসা। এরপর আর দেখা হয়নি কলিমের সাথে। কোন দিনও না। এমন কি স্বপনেও নয়।
চৈত্রি মাসের মাঝ রাতে কলিমদের বাড়ীটা তখনও ফড় ফড় করে পুড়ছিল। আমরা আমাদের বারান্দা দেউড়িতে দাড়িয়েই সে শব্দ শুনলাম। চারদিকে কান্না-কাটি আর সোর গোল পড়েছে।সব মানুষ জেগে উঠেছে। দৌড়াচ্ছে। এদিক থেকে সেদিকে। দিগ্বিদিকে। আবার ওদিকে কেউ কেঁদে উঠছে। কেউ হাপাচ্ছে।
সারা রাত ধরে গোটা গ্রাম লাল হয়ে থাকল। কামার শালে গণগণে লোহা যেমন লাল হয়ে থাকে তেমন। আগুনের কুন্ডলিগুলো ছোট বড় বড় দৈত্যের আকার নিল। সেসব বদমেজাজী দৈত্যরা ক্ষেপে গিয়ে সবকিছু গিলে ফেলতে চাইল। বাতাসে দৈত্যের থাবা এসে উদ্ধারকারী মানুষগুলো খামচে ধরতে চাইল। ওদেরও মুখে পুরে খেয়ে ফেলতে চাইল। মানুষে আগুনে যুদ্ধ চলল।
গাছে গাছে সবুজ পাতা গাছগুলোও যেন ভড়কে গিয়েছে। বাড়ী পোড়া আগুনের দাপাদাপিতে অজ অন্ধকার গেরাম আলোয় ভরে থাকল। আমাদের বাড়ীর দেউড়িতে এসে কেউ যেন পিছলে পড়ল। হাউমাউ করতে করতে লোকটা বলল- হায় হায় কোনোঠেয় পানি নাই বাহেএএ।
তখন আমাদের বাড়ীর নলকুপে একটার পর একটা বালতি ভরার শব্দ। আর গম গম করে লোকগুলো দৌড়ে যাচ্ছে।বালতি হাতে। আগুনের ফড়ফড় শব্দের দিকে। আমি মায়ের কোলে চড়ে সাপটে ধরে আছি। বাবা অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছিল বালতি হাতে। বাড়ির আরো বউ ননদের সাথে মা আমাকে কোলে নিয়ে যখন কলিমদের বাড়ীতে গেল- তখন রাত নাকি ভোর বোঝা গেলনা। তখনো আগুন জ্বলছিল।তবে আগুনের তেজ তখন ধোয়ায় নীল হয়ে উঠেছে। দুরের ফাঁকায় বিলাপ করতে করতে পাথর খন্ডের মত মাটিতে পড়ে ছিল কেউ কেউ। মা আমাকে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
তেজ কমে আসা রাক্ষুসে আগুনের দপদপ করা আলোয় দেখলাম কলিমের বাপ আর মাকে। কালিতে মাখামাখি অর্ধ নগ্ন শরীর। কেউ একজন আধপোড়া কাপড়ে কলিমের মায়ের নগ্নতা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করল। উপস্থিত সবার মুখে গলায় যেন ধ্বংসের আহাজারি। একটা অসম্ভব বিপর্যয় সবাইকে খেয়ে ফেলেছিল যেন!
উপস্থিত লোকেরা হতভম্ভ হয়ে দাড়িয়ে ছিল। আগুন থেকে বাড়ীটাকে বাঁচাবার সব চেষ্টা তখন নিষ্ফল হয়ে গিয়েছে। কলিমের ছোট ছোট ভাইবোন গুলোকে কেউ কেউ কলিমের মায়ের কাছাকাছি নিয়ে এল। কলিমের মা ওদের দিকে তাকাল। ঘুরে আমার দিকেও তাকাল। প্রাণপণ চিৎকারে ‘মো র ক লি ম রে’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে আমার মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিল।
এরপর কী ঘটেছিল? সেটা বর্ণনা করার মত ভা্ষা আমি এখনও শিখিনি।
তবে এখনও আমার মনে হয়, যদি সেইদিন কলিম নীল মণি রত্নটা খুঁজে পেত!
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি:
![]() |
হাসান পারভেজ (জন্ম ১৯৮০) |
0 মন্তব্যসমূহ