bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মাহমুদুল হকের গল্প : প্রতিদিন একটি রুমাল



‘কতােক্ষণ ?'
‘তা' মিনিট তিনেক। খুব ফ্রেশ মনে হচ্ছে তােকে!' পা জোড়া লম্বা করে গা এলিয়ে বললে আলতাফ।
‘ফ্রেশ লাগছে বুঝি!' সবুজ গামছা দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে বললে, কাপড়কাচা সাবান দিয়ে গা ডললে অমন মনে হয়, একটু পরেই আবার দেখবে গা দিয়ে ছাই উড়ছে। স্বাধীনতার স্বাদ, বুঝলে হে ! চা ? চায়ের কথা বলবাে ?'
‘তাের তাে আবার লেমনটি! সারা বাংলাদেশের মানুষ কনডেন্স মিল্ক পায়, আর যতাে বায়নাক্কা তাের বেলায়। দুধ ছাড়া চা আমার রােচে না।'
‘মুড়ি ভেজে দিতে বলি তাহলে ?'
আলতাফ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললে, 'ওসব নিয়ে অযথা তাের মাথা ঘামাতে হবে না। চটপট তৈরি হয়ে নে, বেরুতে হবে, গলির মুখে গাড়ি রেখে এসেছি, আবার হাইজ্যাক না হয়ে যায়। এই পনেরাে দিনও হয় নি সামনের কাচটা গাঁটগচ্চা দিতে হয়েছে।'
সবুজ বললে, ‘তৈরি হয়ে নেওয়া মানে ? কাজ আছে নাকি ? একেবারে খেয়ে-দেয়ে বের হই বরং।'
নাহে, অতাে সময় নষ্ট করা যাবে না; কাজ আছে। তােদের নিয়ে এই এক ল্যাঠা, ঘরের বাইরে যাবার নাম শুনলে ব্যামাে চাগিয়ে ওঠে। রাবিশ, চটপট গায়ে জামাটা গলিয়ে নে তাে!'
আলতাফের সঙ্গে অযথা তর্ক জুড়বার সাহস হলাে না, কেননা তা বৃথা।

কি কৈফিয়ত দেওয়া যায় রেখার কাছে। কেমন যেন একটা আধবােজা ভয় মনের ভেতর ছমছমিয়ে উঠলাে সবুজের। কুচিকুচি কাচকি মাছ, বড় রুই মাছের টুকরাে, কয়েক রকমের আনাজ; অনেকদিন পর নিজে বাজারে গিয়েছিলাে সবুজ স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে, কচি শশা, জলপাই, পাতিলেবু, মােট কথা হ-য-ব-র-ল অনেক কিছুই কিনেছে সে। বড় একরােখা এই আলতাফ, বড় অবুঝ। এখন কৈফিয়তটা কি দেওয়া যায় রেখার কাছে—সবুজ মনে মনে প্রায় হাবুডুবু খেতে থাকে। 
’কি অতাে ভাবছিস?'
‘মানে ঘরে একটা কিছু বলতে হবে তাে?’
‘ইষ্টুপিট!' 
‘তাের তাে নেই, তুই বুঝবি না!'
‘রক্ষে করাে, বুঝবার শখও আমার নেই! সারা বাংলাদেশের লােক বউয়ের কথা ছাড়া একপা নড়ে না, সব শালা স্ত্রৈণ। চটপট নে বাপ, চটপট নে!’
‘কিন্তু--’
মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে আলতাফ বললে, ‘মানে রেখা তাে ? সব রেখাই এক একটা জলজ্যান্ত কিন্তু, এই নিয়ে তাের ওই ইছাপুরার কালিজে চাষাভুষােদের পড়ানাে মিষ্টি কুমড়াের মতাে মাথাটি না ঘামালেও চলবে। যত্তোসব! নে বাপ্ নে, আর জ্বালাসনি, সহ্যের সীমা পার হয়ে যাচ্ছে, তুই একটা যাকে বলে জ্যান্ত ক্যাডাভ্যারাস!'
সবুজ আর কালক্ষেপ করলাে না! কাজে যাচ্ছি এক্ষুনি ফিরবাে—এই জাতীয় একটা গোঁজামিল দিয়ে তড়ি-ঘড়ি তৈরি হয়ে নিলাে সে, বেরিয়ে পড়লাে।
গাড়িতে স্টার্ট দেবার পর বড় রাস্তায় উঠে গা ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে আলতাফ বললে, ‘হ্যা, এখন বল কোথায় যাবি, কোন চুলােয় নিয়ে যাবাে তােকে?'
‘তার মানে ?’ 
‘দুপুরটা কাটাতে হবে না?' 
‘ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না!'
‘দু'জনে মিলে চুটিয়ে আড্ডা মারবাে, বুঝলে খােকন!' 
‘কোনাে মানে হয় এর ! কেন আমার ঘরে কিছুক্ষণ বসলে কি পিপড়ে কামড়াতাে?’
‘কি মজা যে পাস তােরা ঘরের ভেতর আমি তা বুঝি না। এই জন্যে শালার বিয়ে করাটাকে হেট করি। ঘর আর ডাস্টবিনের ভেতর আমিতাে কোনাে ফারাক দেখি না। তুমি ব্রাদার একদম বরবাদ হয়ে গেছ, বিলকুল বরবাদ! বরবাদিউন!'
সবুজ আলগাভাবে বললে, বােধহয় তাই!' দীর্ঘনিশ্বাসও ছাড়লাে একটা, যা চোখ এড়ালাে না আলতাফের।
‘বােধহয় আবার কি, এ্যা, বােধহয় আবার কি ?' আলতাফ প্রায় অস্বাভাবিক রকম খেঁকিয়ে উঠে বললে, মরচে ধরা একটা টিনের সুটকেস আর কাঁঠাল হাতে করে শ্বশুরালয়ে যাওয়া, গণ্ডায় গণ্ডায় এণ্ডা-বাচ্চা তােলা, বউয়ের জন্যে টক আচার যােগাড় করা, বাজার আর ফুটপাথ ছেঁচে ছছতায় কুচোচিংড়ি আর কাপড়ের কাটপিস কেনা—এই হলাে তােদের জীবনের আদর্শের সারমর্ম! ই-ষ্টু-পি-ট! স্কুল লাইফে তুই ছিলি আমাদের মধ্যে আদর্শ চৌকস ছেলে! চমৎকার ক্রিকেট খেলতিস, ডিবেটে কচুকাটা করতিস বড় বড় চাঁইদের, ছবি আঁকতিস, কবিতা লিখতিস। স্ট্রাইক হয়ে যেতাে দুদ্দাড় তুই ডাক দিলে, আর এখন ? মাস্টারি করছিস, তা-ও শালার এক ধ্যাড়ধেড়ে গােবিন্দপুরে, কোথায়-না ইছাপুরায় এক টোমো কালিজে, এক একটা আধবুড়াে মাল সব, খেত চষে খালি পায়ে লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে কালিজ মারতে আসে, ভপ্! পােটলা-পুটলি বাঁধো, লঞ্চে চাপাে, তারপর যাও! হপ্তা অন্তে রুটিন মাফিক ওষুধ গেলার মতাে বৌরানীর তেল চিটচিটে ছারপােকা কুটকুটে বিছানা একরাত্রি ধন্য করে আবার ফিরে যাও,ই-ষ্টু-পি-ট! মরণও এর চেয়ে ঢের সম্মানের! দেশে এতােবড় একটা মুভমেন্ট গেল, উচিত ছিলাে তােদের ঝাঁপিয়ে পড়া, উচিত ছিলাে ডিমের খােসা, কলার খােসা, বিস্কুটের কাগজের মতাে ভেসে যাওয়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া!'
সবুজ হঠাৎ ছােটোছেলের মতাে অসহায়ভাবে বললে, 'আমি মৃত্যুকে ভয় পাই আলতাফ, সত্যি বলছি, ভয় পাই! পঁচিশে মার্চের আর্মি ক্র্যাক ডাউন না হলে কখনাে হয়তাে জানতেও পারতাম না জীবনকে এতাে ভালােবাসি, এতাে ভয় করি মরণকে!'
‘কৃমিকীট! কুমিকীট!’
‘যা বলিস--’
‘আরে গর্দভ মরণের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েইতো সত্যিকারের আনন্দ। চিলমারি অপারেশনে থাকলে বুঝতিস, মৃত্যু কতাে তুচ্ছ ব্যাপার, মৃত্যুকে নিয়ে কিভাবেই না ছেলেখেলা করেছিলাম আমরা প্রাইভেট আর্মির দস্যুরা। মরণকে আবার ভয় কি রে? তুই কি ভেবেছিস পৃথিবীটা একটা মস্ত রসগােল্লা, নরােম তুলতুলে মিষ্টি। বড়াে শক্ত জায়গা এটা, বুঝলে থােকন, বড়াে শক্ত জায়গা, বেঁচে যদি থাকতে চাও, যদি টিকে থাকতে চাও, লড়াই করেই তা সম্ভব! জীবনভর শুধু লড়াই আর লড়াই আর লড়াই—'
সবুজ খানিকটা আত্মগতভাবে বললে, আসলে আমি কাপুরুষ! তােদের মতাে মনের জোর নেই। দেখছিস না, আজ পর্যন্ত কেমন কুঁজো হয়েই হাঁটি, সিধা হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না পর্যন্ত এমন মেরুদণ্ডহীন!'

‘নাও ঠ্যালা! অম্‌নি নাকের জলে চোখের জলে শুরু হয়ে গেল!' 
‘সত্যি নিজের ওপর ঘৃণা ধরে গেছে আমার!'
‘থাম দিকি এখন! বল কোনদিকে যাবি। চটপট চটপট!'
‘তাের যেখানে খুশি! আমি আর কি বলবাে!' 
‘যেখানে খুশি, আপত্তি করবি না তাে?’
‘তাই বলে হাইড্রোজেন-এর আসরে নয়, অসহ্য মনে হয়!' 
‘ড্রিঙ্ক করলে কেমন হয় ?' 
‘রােজই তাে করছিস, আজকের দিনটা না হয় বাদই দিলি।'
‘এটাও নয়, ওটাও নয়, তবে কোনটা ? মন খুলে খায়েশটা বাতলাও না শালা বেশি ন্যাকামি না করে! সারা দিন উত্তেজনার ভেতর থাকতে চাই । চলনা কোনাে মেয়েমানুষের কাছে যাই। আছে নাকি সন্ধানে ?'
‘কাকে কি বলছিস?' 
‘তা-ও ঠিক। বৌ ছাড়া আর কাকেই বা তুই চিনিস ? আচ্ছা, সেই মেয়েটার কি হলাে রে ? সেই যে প্রেম করতিস চুটিয়ে ? কোথায় আছে ? দেখা হয়? রােকসানা রােকসানা, মনে পড়েছে।’ 
‘ঢাকাতেই থাকে। খুব অসুবিধায় আছে। ব্যাঙ্কে চাকরি করছে এখন।’
‘অসুবিধাটা কি ?’
‘সংসার চালাতে হচ্ছে!' 
‘যােগাযােগ আছে ?’
‘দু'একবার দেখা হয়েছে!' 
‘চলনা, রােকসানার ওখানে যাই।’
‘কি হবে গিয়ে ?’
‘কেন গুলতাপ্পি মেরে ঘর থেকে বের করবি, তারপর একটা ফুর্তি, ব্লা ব্লা ব্লা, আইবুড়াে ধিঙ্গি মেয়ে, চান্স লইতে দোষ কি ব্রাদের, ব্লা ব্লা ব্লা—' 
‘ওসব আমার দ্বারা হবে না!’
 ‘তাের দ্বারা না হয় ভিড়িয়ে দে আমার সঙ্গে, বুকের ভেতর বুটবাট শব্দ হচ্ছে, বড় খালি খালি লাগছে ক'দিন থেকে। প্রেম করা দরকার ?'
‘ওকে ভেড়ানাে মুশকিল!'
‘তােমার মাথা! গুডামবাসটার্ড! শালা পেটে পেটে এতাে হিংসা তাের! চুলােয় যাক, এখন বল কোনদিকে গেলে মেয়ে পাওয়া যাবে?'
‘দালাল ঠাউরেছিস নাকি? হঠাৎ ক্ষেপে গেলি কেন এমন?’
‘ঘােড়ারােগ! ঘােড়ারােগ! সারাদিন উত্তেজনার ভেতর হাবুডুবু খেতে চাই, ডুবে মরতে চাই--'
‘বেশ তাে আছিস, মাঝে মাঝে শুধু এই ঘােড়ারােগটা তােকে বিগড়ে দেয়! নিজেকে সামলাতে পারিস না?'
‘তুই জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের মতাে কথা বলছিস! ও শলার মতাে স্ত্রৈণ আর দেখিনি, শালা পয়লা লম্বর বউকাতুরে!'
রেখার কথা মনে হলাে সবুজের। মাথার ভেতরে একটা ভয় শিরশির করে উঠলাে। চটে যাবে রেখা, দুপুরে খাবে না, এতে কোনাে সন্দেহ নেই। বহুদিন পর বেশ গুছিয়ে মনের মতাে বাজার করেছিলাে সে; খুশি হয়েছিলাে রেখা! আলতাফটা একটা ঝড়। অন্যের অসুবিধার কথা সত্যি-ই ওর মগজে ঢােকে না, বড় অবিচার করা হলাে রেখাকে।
ছেলেমেয়ে আগলে ঢাকায় পড়ে থাকে রেখা। সব দায়ভাগই তার। সবুজ শুধু মাসের মধ্যে দু'চারবার ঘুরে যায়, মাস-পয়লা পয়সা দিয়ে যায়। ইছাপুরায় পড়ে থাকতে তার নিজেরও যে খুব ভালােলাগে তা-ও নয়; কিন্তু নিরুপায় । ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। টেনেটুনে চালাচ্ছিলাে এতােদিন কোনমতাে, এখন আর একেবারেই ভালাে লাগছে না। সংসার চলার অন্য উপায় থাকলে নির্ঘাৎ ছেড়ে দিতে কলেজের চাকরি, আর পেরে উঠছে না সে। 
'ড্যাশবাের্ডে প্যাকেট আছে, সিগ্রেট ধরিয়ে দে একটা! আলতাফ হুঁহু করতে করতে বললে, 'কোনদিকে যে যাই শালা! আন্ডার দ্য ব্যাম্, আন্ডার দ্য বু, আন্ডার দ্য ব্যাম্বু ট্রি--'
একরোখা হাওয়ার সঙ্গে সমানে নাক ঘষাঘষি করে দাপটে উড়ে যাচ্ছে গাড়িটা। সবুজ বুঝতে পারে, ঠিক এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট কোনাে লক্ষ্য নেই আলতাফের সামনে! নিছক পাগলামির ফেনিল উচ্ছাসে কাগজের ঠোঙার মতাে ভেসে যেতে চাচ্ছে সে।

রেখার চিন্তায় ডুবে গেল সবুজ আবার! সত্যি অবিচারের মাত্রাটা দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন অনাদর আর অবহেলায় একপাশে পড়ে আছে রেখা। উদাসীনতা একটা মারাত্মক রােগ ; তার নিজেকে এই রােগে ধরেছে। দু'একদিনের ছুটিতে বাড়িতে এলেই আলতাফের খপ্পরে পড়ে যায় সে, কাঁঠালের আঠার মতাে গায়ে লেগে থাকে আলতাফ, নাছােড়বান্দা। পিঠোপিঠি কয়েকটি মাস নিদারুণভাবে সঙ্গ দেওয়া থেকে বঞ্চিত করে আসছে সে রেখাকে। দায়সারাগােছের কয়েকটা টাকা তড়িঘড়ি করে হাতে গুজে দেওয়া, সম্পর্ক শুধু এইটুকু। আচ্ছা রেখা যদি ঠাণ্ডা মেয়ে না হতাে ? বন্ধু জব্বারের স্ত্রীর কথা মনে পড়লাে সবুজের, যাকে বলে ডিমান্ডিং, ভয়ানক রকমের ডমিনেটিং মহিলা। জব্বার আর জব্বার নেই, নাকে দড়ি দিয়ে উঠবস করাচ্ছে মহিলা। ওপর থেকে দেখে শুধু এইটুকু মনে হয়, নিছক শাসনের সম্পর্ক, তার ভেতর বিন্দুমাত্র ভালােবাসা নেই। ভালােবাসাহীন কোনাে জীবনের কথা ভাবতেই পারে না সবুজ।
‘আন্ডার দ্য ব্যাম্, আন্ডার দ্য বু, আন্ডার দ্য ব্যাম্বু ট্রি--' একটানা বাতাসের মতাে হুহু করে চলেছে আলতাফ। চোখ কুঁচকে একবার শুধু জিজ্ঞেস করলাে, ‘নিয়ে যাচ্ছিস না তাহলে রােকসানার ওখানে?' 
নীরবতাই একমাত্র আশ্রয় এক্ষেত্রে। সবুজ রেখার চিন্তায় আগের মতােই জুবড়ে থাকলাে। গত কয়েক মাসের মধ্যে একবারের জন্যেও রেখাকে নিয়ে বের হয়নি সে কোথাও! আলগাভাবে কয়েকবার প্রস্তাব দিয়েছিলাে রেখা গােপীবাগে নিয়ে যাওয়ার। গােপীবাগে ওর ছােট বোেন ঝিমকি থাকে। ইচ্ছেও ছিলাে, কিন্তু প্রতিবারই রাহুর মতাে উদিত হয়েছে আলতাফ, ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছে তাকে। রেখার একটা মস্ত বড় গুণ এই--সবকিছু খুব সহজে মেনে নেবার মতাে মানসিক সংযম তার বিপুল। যা অনিবার্য, কিংবা যা তুচ্ছ, তা নিয়ে অযথা মনের শান্তি নষ্ট করতে অভ্যস্ত নয় সে। ছ' বছরের বিবাহিত জীবন তাদের ; সবুজ সবসময় দেখে এসেছে—বলতে কি একবারে বৈবাহিক জীবনের সেই গােড়াপত্তন থেকে, সব সময় খুব সন্তর্পণে বিরােধের পাশ কাটিয়ে চলে রেখা। সংসারের বিশৃখলাকে সে ঘৃণা করে। "
‘বুঝেছি বৌয়ের কথা ভাবছিস তুই! তুইও শালা শেষ পর্যন্ত জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের মতাে ম্যাড়া বনে যাবি ? যাবাে কোথায়!’ 
সবুজ দীর্ঘশ্বাস চেপে গিয়ে বললে, ‘আগে বিয়ে-থা করাে, তারপর দেখা যাবে--'
‘রাখ তাের বিয়ে! এ শর্মাকে এখনাে চিনিসনি। বিয়ে করা বৌ নিয়ে মশারির তলায় ঢােকা আর আলুভত্তা দিয়ে পান্তাভাত গেলা আমার কাছে একই ব্যাপার। ছাড়াগরুর জন্যে পুরাে দেশটাই শালার সবুজ তৃণভূমি, কি বলিস, তাই নয়?'
‘মনে তাে হয় না!' নিস্পৃহ গলায় বললে সবুজ। 
'তার কারণ?’
'এইতাে একটু আগেই রােকসানা রােকসানা করে মাতলামি জুড়েছিলি! কেন ও ছাড়া দেশে আর মেয়ে নেই নাকি ? লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানােটা একটু বিদকুটে অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে তাের। নিজেকে শুধরে নেবার চেষ্টা কর এখন থেকে, তাের আখের খারাপ!'
‘বুঝলাম এতােক্ষণে! তাের শালা প্রেমের ঘাের এখনাে কাটে নি। রিপাের্ট করতে হবে তাের বৌয়ের কাছে।’
‘সে তুই পারিস--’
‘ভয় পেলি নাকি?' 
'রেখা আমাকে খুল ভালাে করেই চেনে—'
‘থাক থাক থাক—' বাধা দিয়ে আলতাফ বললে, কে কাকে কতােটুক চেনে সে আমার খুব ভালভাবেই জানা আছে। অন্য কোথাও বড়াই করিস, অন্তত এই শর্মার কাছে নয়। বড়াই করেছিস কি ফেঁসে যাবি। আমিই ফাঁসিয়ে দেবাে। বিশ্বাস না হয় জব্বারের কাছ থেকে শুনে নিস, কেমন পৌনেতেরােটা বাজিয়ে দিয়েছি হতভাগাটার!' হােহাে করে হাসতে লাগলাে আলতাফ পাগলের মতাে। 
‘ফাসিয়ে দিয়েছিস মানে?'
‘মানে আবার কি, অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে বেচারা। বৌয়ের কাছে কিলঘুষি খেতে খেতে নাকমুখ ফুলে গেছে গাধাটার। এমন ক্ষ্যাপা ক্ষেপে গেছে বেচারা যে এখন দেখা হলে কথাই বলে না, সােজা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দারুণ বমকে গেছে--'
বাষট্টি মডেলের একটা পুরনাে ফোক্সাগন তাকে ওভারটেক করায় রীতিমতাে উত্তেজিত হয়ে পড়লাে আলতাফ। ‘দেখাচ্ছি শালার বাহাদুরি' বলে গাঁক গাঁক করে উঠলাে সে। এক পর্যায়ে গাড়িটার পাশে পৌঁছুলাে, তারপর ভীষণভাবে চাপাতে শুরু করলাে তাকে। 
‘এই আলতাফ, একি হচ্ছে,' সবুজ ধমকালাে, ভয়ে শিউরে উঠলাে।
আলতাফ ক্রমাগত চাপাতে চাপাতে গাড়িটাকে রাস্তার পাশের ধুলােয় নামানাের পর বললে, 'কি বুঝলি ? আন্ডার দ্য ব্যাম, আন্ডার দ্য বু, আন্ডার দ্য ব্যাম্বু ট্রি--' 
‘তুই একটা ডাকাত, টিনেজার--’
‘পেছনে তাকিয়ে দেখ, কেমন ভড়কে গেছে শুয়ােরটা। মুখটা কেমন বাংলা পাঁচ করে রেখেছে, দেখ! এখন থেকে পেছনে পেছনেই আসবে। আমি ইক্ষু চুষে চুষে রাস্তায় ছিবড়ে ফেলে যাবাে, আর ও তা কুড়িয়ে কুড়িয়ে গালে পুরবে!' 
গাড়িটা শহরের বাইরে চলে এসেছে! রাস্তার দু'পাশে বিস্তীর্ণ জলাভূমি আর সবুজ শস্যখেত। ছত্রখান সবুজের এলােমেলােমি আর হাওয়ার দাপাদাপি মহৌষধের কাজ করে।
রৌদ্র ঝলসে উঠছে। কচুরিপানার তীব্র গন্ধে সবুজ রঙ ধরেছে বাতাসে। পুরনাে দিনের কথা মনে পড়ে সবুজের। জব্বার আলতাফ আর সে—এই তিনজন মিলে সুযােগ পেলেই বেরিয়ে পড়তাে একদিকে। কখনাে একদিনের জন্যে, কখনাে দু'দিনের জন্যে, নাম দিয়েছিলাে ঝটিকা সফর। কী ভালােই না লাগতাে! আর কখনাে সে সব দিন ফিরে আসবে কি! কিভাবেই না বদলে যায় জীবন! 
‘আলতাফ, আমরা কোথাও বসবাে কি?' 
‘বসবাে, একশােবার বসবাে--' 
‘তাের এই নাটুকেপনা স্বভাবটা আগে ছিলাে না কিন্তু!’
‘গুডগড! এখনও বৌয়ের জন্যে মন খারাপ করছিস? তােকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুইও শালার আরেক জব্বার!'

আঁধারঘন বাঁশবন দেখে গাড়ি থামালাে আলতাফ! রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে প্যান্টটা ওপরের দিকে ওঠাতে ওঠাতে বললে, ‘পেটে চর্বি জমে যাচ্ছে, ডায়েট কন্ট্রোল করতে হবে এবার থেকে!’
বাঁশবনের কাছে পৌঁছে আবার হুঁহুঁ শুরু করলাে সে, ‘আন্ডার দ্য ব্যাম্, আন্ডার দ্য বু—' 
বাতাসের আলিঙ্গনে উদ্বেল জলরাশি বাঁশবনের কোলে মাঝে মাঝে ছলাৎ ছলাৎ করে চলকে উঠছে। জলাভূমির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়া মুখর বাঁশবনের ছবি থেকে থেকে ভেঙে যাচ্ছে পানির ভেতর। রুমাল পেতে বসলাে দু'জন। নিজের দুটো আঙুল নাকের কাছে তুলে ধরলাে সবুজ। পােড়া সিগ্রেটের গন্ধ আঙুলে। রেখা এই আঙুল দুটোকে ভালােবাসে, বড় আদরের এ দুটি আঙুল। পচা ঘাস আর কচুরিপানার গন্ধে ভারি বাতাসের মাঝখানে এই আঙুল দুটো অদ্ভুত একটা অবসাদ এনে দিলাে। এই আঙুল দুটো এক একটা দিন রেখার ঠোঁটের চমু হয়ে কি মােহন ঝরে যায়! এই আঙুল দুটোর গায়ে এক একটা গভীর রাত কি বিশাল মৌমাছির ঝাঁক হয়ে উড়ে যায়। নরােম নিশ্বাসের চাদরে শুইয়ে একজোড়া ভিজে ঠোট যখন এই আঙুল দুটোকে ইচ্ছে করে বারবার হারিয়ে ফেলে আবার তা খুঁজে নিতে থাকে তখন এই একরত্তি—ছোট্ট হয়ে যায় জীবন ; মনে হয় এই ভালাে, এই-ই সব, দরিদ্র হয়ে বেঁচে থাকার মতাে আর কোনাে সুখ নেই, এবং বিপুল মানেই ভীষণ!
‘জব্বারের ব্যাপারটা শােন—’ সিগ্রেট ধরিয়ে পা দুটো লম্বা করে শুরু করলাে আলতাফ, 'সবসময় কানের কাছে ভ্যানভ্যান লেগেই আছে, ওর বৌয়ের মতাে বউ নাকি কারাে হয় না। এই নিয়ে ওর গর্বের আর শেষ নেই। ওর সম্পর্কে ওর বউয়ের নাকি ধারণাও হলাে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। বউ ছাড়া দুনিয়ার আর কিছু বােঝে না, ফিরেও তাকায় না কখনাে। দিলাম শালাকে ফাঁসিয়ে। সামান্য একটু ডােজ দিয়েছিলাম ওর বৌকে; ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, যেন একটু সামলে রাখে, কন্ট্রাক্টররা যে কি মাল দুনিয়া সুদ্ধু সবাই জানে। ব্যস্-- এ্যামন ধরা ধরলাে ওষুধে যে জবাবদিহি করতে করতে শালার প্রাণ ওষ্ঠাগত! সঙ্গে সঙ্গেই ওর বউ ধরে নিলাে স্বামী মহারাজ যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বেড়ায়; ভীষণ চাপা স্বভাবের চালাক লােক, ভেতরে ভেতরে পাক্কা শয়তান, যাকে বলে রংবাজ। আমার সামনেই আক্রমণ করে বসলাে জব্বারকে। বললে, সব ছেড়েছুড়ে সিনেমায় নেমে পড়, অভিনয় তাে ভালােই জানাে। তােমার বাপ তাে দুটো বিয়ে করেছিলাে, সেই বাপেরই ছেলে তাে তুমি, যাকে বলে খােদার গজব, বাপরে বাপ, মহিলার সেই রণচণ্ডী মূর্তি যদি দেখতিস—'
একটু থেমে স্বয়ংক্রিয় একটা যন্ত্রের মতাে হাতপা নেড়ে আবার শুরু করলাে আলতাফ, 'তুই কি বলবি তা-ও আমি জানি, কেননা, ঘরে তােরও বউ আছে। বলবি কাজটা ভালো করিসনি আলতাফ । হয়তাে তাই, কিন্তু কিছুটা প্রয়ােজন ছিলো। দিন দিন বড় বেশি হামবড়া ভাব এসে যাচ্ছিলাে বাঁদরটার । ঘুষে নাক পর্যন্ত চুবিয়ে রেখেছে নিজের, অথচ কোরাপশনের কথা উঠলে দাঁত বের করে দুনিয়াসুদ্ধ সকলের জন্মােদ্ধার করে তবে ছাড়বে, এটা কেন ? সব জায়গায় চালিয়াতি ? জাল জোচ্চুরির ভেতর এই যে জুবড়ে পড়ে আছো, টাকার বিছানায় ঘুমুচ্ছাে, এ নিয়ে তাে আমরা কেউ কখনাে বাদ সাধিনি। আমাদের সঙ্গে এতাে ডাঁট কিসের ? বুঝতে পারি দুনিয়াটাই এভাবে চলছে, তুমিও চলাে, কিন্তু টেক্কা দিতে আসো কেন? আমি শালার বিশুদ্ধ বণিক, টাকা-পয়সা দিয়ে প্রেম কিনি, দৌলত দিয়ে মব্বোতের সওদাগরি করি, ময়ূরপঙ্খী ভাসাই, আমার কাছে কিনা প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে আসে। কতােটুকু জানিস তােরা মেয়েদের ? ক’টা মেয়ে দেখেছিস তােরা ? ক'জনের সঙ্গে মিশেছিস? অভিজ্ঞতা বলতে তাে একমাত্র ঐ বিয়ে করা বউ, যা কি না আগাপান্তলা একটা জোড়াতালি আর গোঁজামিলের ব্যাপার। চোখে আঙুল দিয়ে শুধু সেইটুকুই দেখিয়ে দিয়েছি, আগাগোড়া যে জোড়াতালি আর গোঁজামিলের ব্যাপার, শুধু সেইটুকুই! তা না হলে চিন্তা করে দেখ, সত্যমিথ্যা একবার যাচাই করে দেখবার প্রয়ােজনও হলাে না মহিলার, উটকো একটা লােকের মুখে সন্দেহের একটা কথা শুনলাে আর অমনি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলাে, বাঁই বাঁই করে ঘােরাতে লাগলাে মুগুর, ইশ কী সাঙ্ঘাতিক মনের মিল, গুডাম্‌বাস্টার্ড--'
সবুজ অবসন্নের মতাে বললে, 'তাের কথা ঠিকমতাে বুঝতে পারলাম না আলতাফ। ওর ওপর তাের সত্যিকারের আক্রোশটা কোনখানে আমার কাছে তা পরিষ্কার হয়নি এখনাে। ও ঘুষ খায় অথচ অস্বীকার করে, অর্থাৎ হিপােক্রিট, কিন্তু এটাই তাে স্বাভাবিক নিয়ম। আর কথায় কথায় যে বউয়ের প্রসঙ্গ তােলে এটাও এমন কোনাে মারাত্মক অন্যায় নয়, বলতে পারিস ও খানিকটা স্কুলরুচির। দুটোর কোনটার সঙ্গে তাের বিরোধ ?’
আলতাফ উত্তরে বললে, ‘বিবাহিত জীবন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, এইসব নিয়ে গুচ্ছের অহঙ্কার ওর। হয়তাে লক্ষ্য করে থাকবি এই কারণেই সবকিছুর ওপরই ওর সবসময় এই ধরনের ইচ্ছাকৃত অবহেলার ভাব থাকে।
‘কি জানি--' দুঃখিত কণ্ঠে সবুজ বললে, 'তাের মতাে অতাে ভেবে দেখি নি। ভাবতে চাই-ও না— ’
‘বাদ দে ওসব' আলতাফ বলে, ‘হঠাৎ ঝিমিয়ে যাচ্ছি দুজন। বাজে প্যাঁচাল পেড়ে লাভ নেই, চল কোথাও গিয়ে জমি। আমি সারাদিন, সারা জীবনভর ভীষণ উত্তেজনার ভেতর থাকতে চাই, উত্তেজনাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়!

‘তাের ট্রিটমেন্ট দরকার--’
‘সেই জন্যেই মেয়েমানুষের কাছে যেতে চাই!’
‘ঘুরেফিরে একই চক্করে গিয়ে পড়ছিস বারবার!’ 
‘চক্কর তাে একটাই! জীবন মানেই উত্তেজনা, অস্থিরতা!' 
‘ওটা একটা ফর্ম্! বটতলার ফর্ম্!’
‘আমাকে এখনাে চিনলিনে বন্ধু! কি করি আমি জানিস ? ভাবতেও পারবি না তুই! বোঁ-বোঁ করে ঘুরে যাবে তাের মাথা। মেয়েলােক নিয়ে ইচ্ছেমতাে ছেলেখেলা করি আমি, মনের সাধ মিটিয়ে ওদের মাথার ভেতরে গুবরে পােকা ঢুকিয়ে দেই, আনডাসট্যানডাে?'
‘যেমন ?’
‘এই গতকালই তাে, ভাগ্যচক্রে একটি পাকা জিনিস জুটে গিয়েছিলাে কপালে, সারারাত আমার ওখানে ছিলাে! দারুণ মেয়ে। তুখােড় স্মার্ট ; যদিও একটু স্নব। ও আর এমন কি! কিছুই বাদ রাখি নি। ব্লা ব্লা ব্লা। এদিকে রাতভর কি করলুম জানিস ? রাতভর গুনগুন করে ওর পরিচিত অন্য একটি মেয়ের সুখ্যাতি চালিয়ে গেলুম একনাগাড়ে। দেহের সুখ্যাতি, মনের সুখ্যাতি, প্রাণের সুখ্যাতি! সুখ্যাতি, শুধু সুখ্যাতি ! বুঝলি কিছু ? ঐ মেয়েটির কথা তুলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকলাম সারারাত, অর্থাৎ রাশি রাশি মিথ্যাকথার ঝুড়ি। অমন মেয়ে হয় না। এর মতাে সুঠাম শরীর জীবনে দেখিনি। ঈর্ষায় জ্বলতে লাগলাে, আবার কি। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলাে। আমি তাে এই-ই চাই, হাতপা সেঁকে নিলাম ইচ্ছেমতাে। আমার স্বভাবটাই আগুন পােহানাে! কিতা বুঝলাইন দোস্তো ?

নিরুত্তর সবুজ ঘাড় গুজে বসে থাকে। প্রকাণ্ড দুপুরের মাঝখানে নিস্তব্ধ চারণভূমির ঝাঁ ঝাঁ রােদে ঘুরপাক খাচ্ছে বাতাস। তালগাছের মাথায় বাবুই পাখির বাসা দুলছে। একঝাঁক তীব্র হরিয়াল বাঁশবনের মুখর সবুজ জাল ছিন্নভিন্ন করে ঝটপটিয়ে উড়ে গেল একদিকে। শস্যের গন্ধে দিগন্ত প্রবাহী বিষন্নতা প্রতি মুহূর্তে শিউরে উঠছে। কি করুণ রাখালিয়া বাঁশি। প্রকৃতির ভেতর আকুলতা ছাড়া আর সবই ফ্যালনা।
হঠাৎ 'আ-মি' বলে চিৎকার করে উঠলাে আলতাফ। 
সবুজ চমকে উঠলাে!
গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাে আলতাফ। বললে, 'ঢের হয়েছে, মাটি মাটি লাগছে সবকিছু এখন কাট্টি মারা যাক—’
‘অমন বাঙ দিয়ে উঠলি যে হঠাৎ?’ 
‘আমি আছি, বুঝলি না?' হাে-হাে করে উঠলাে সে।
সবুজও উঠলাে। পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বললে, কদ্দুর কি হলাে আমার চাকরির ?'
‘হবে হবে--’
‘কোনাে ব্যবস্থা হয়েছে ?’
‘ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, কথা যখন দিয়েছি লিশচই হবে, লিশচই!' 
‘বিশ্বাস কর--' প্রায় ভেঙে পড়ে সবুজ বললে, ‘আমি আর পারছি না। একবার ঢাকা, একবার ইছাপুরা, এ আর ভালাে লাগছে না। ওখানে যা পাচ্ছি এ বাজারে তা এমন হাস্যকর ! জীবন চলেনা—'
‘বললাম তাে! এতাে উতলা হয়ে পড়ছিস কেন, যেমন করেই হােক ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করবাে আমি, আর কোনাে না কোনাে সরকারি কলেজে, এখন থাম তাে!'
'আমি জানি, ইচ্ছে করলেই তুই পারবি, তাের সার্কেল বিরাট, প্রচুর সাের্স! রেখাকে আমি কথা দিয়েছি, যে করেই হােক ঢাকায় চাকরি নেবাে, একসঙ্গে থাকবাে' 
‘ঘাবড়াইওমাৎ বেটা, ব্যবস্থা একটা হবেই!'
এবারে আলতাফের হাত চেপে ধরে সবুজ। খুব অসহায়, বিপন্ন মনে হয় তাকে। ‘কথা দিচ্ছিস তাহলে?
‘এতাে ভেঙে পড়ছিস কেন ? আচ্ছা গবেট তাে তুই! আগেও বলেছি এখনাে বলছি, হবে।'

সবুজকে দেখে মনে হয় এই সামান্য উত্তরে সে এমনই অভ্যস্ত যে আজ আর তাতে যেন আশ্বস্ত হতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেই ছােট হয়ে যাচ্ছে। দ্বিধাগ্রস্ত সবুজ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বারবার হোঁচট খায়। | গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ঝড়ের বেগে আবার শহরের দিকে ছুটতে থাকে আলতাফ।
‘তুই কোনাে কর্মেরই নয় রে সবুজ, কোনাে কর্মেরই নয়'—আলতাফ সামনের দিকে চেয়ে বলতে শুরু করলাে,—   ‘রােকসানার ওখানে গেলে একেবারে মন্দ হতাে না। মেয়েদের সম্পর্কে তার কোনাে ধারণাই জন্মায়নি এখনাে। তুইও একটা জব্বার। একবার আলাপ করিয়ে দেখতিস, বিশুদ্ধ বণিক আলতাফের ময়ূরপঙ্খীতে গ্যাট গ্যাট করে কেমন চলে আসতাে তাের গাল তােবড়ানাে রােকসানা সুন্দরী, ভাবতেও পারতিস না। কতােগুলাে শুয়ােরের বাচ্চা বলে ওটা নাকি একটা আর্ট। আর্ট না কচু। গুলি মারাে। যাকে বলে স্রেফ কায়দা। কায়দাটা জানা থাকলেই ফায়দা ওঠানাে যায়। যাহা হরিরামপুর তাহা বাঞ্ছারামপুর। টোকা দিতে জানতে হয়। টোকা দিয়েছ কি টুং টুং টাং কার না ভালাে লাগে!’
‘তুই জানিস না, বড় ভালাে মেয়ে রােকসানা--’
‘চেপে যা বে, চেপে যা! ভ দিয়ে যতােগুলাে শব্দ হয়, এই যেমন ভোঁদড়, ভােম্বল, ভােগেল, ভজকট, তার মধ্যে সবচেয়ে সস্তা আর রাবিশ শব্দ হলাে তাের ঐ ভালাে। তুই শালা গােড়াতেই এমন কাঁচা। তাের বদ্ধমূল ধারণা মেয়েরা শাড়িপরা অবস্থাতেই মায়ের পেট থেকে পড়ে। আব্বেশালা, আমরা, মানে এই পুরুষমানুষের জাত নিজেদের দরকারেই ওদেরকে শাড়িমােড়া করেছি, বুঝলায় চাঁনদু!' 
‘এত বাজে বকতে পারিস তুই আলতাফ!' 
‘হাজার হােক, তুই একজন মাসটের--' 
'যাই বলিস না কেন, ভীষণ বদলে যাচ্ছিস তুই, আগে তাে এমন ছিলি না! বছর তিনেক যাবৎ তােকে দেখছি দিন দিন কি ভীষণ একরােখা আর একপেশে হয়ে যাচ্ছিস তুই! শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে যে টোক্কর খাবি আল্লাই জানে। আর কতাে, এবার সুস্থির হ--'
‘সুস্থিরতা আমার ভাগ্যে লেখা নেই!' 
‘আচ্ছা ক্লান্তি লাগে না তাের ? টাকা-পয়সাও তাে নিছক কম কামাসনি, কিসের পেছনে ছুটছিস?'
‘মরীচিকা, বুঝলে বৎস, মরীচিকার পেছনে—' 
আচমকা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলাে সে। রাস্তার একপাশে রাখলাে গাড়িটাকে।
‘কি হলাে আবার?'
একটা সিগ্রেট ধরিয়ে লম্বা টান মারলাে আলতাফ। বললে, ‘সময় হলেই বুঝবি!' খুশিতে উপচে পড়ছে তার মেজাজ।
কুড়ি বাইশ বছরের একটি যুবতীকে নিয়ে পেছনের দিক থেকে একটা রিকশা আসছিলাে। ঘাড় ঘুরিয়ে একভাবে দেখলাে আলতাফ, তার ঠোঁটে হাসি, চোখে বিদ্যুৎ। না দেখে সবুজের গায়ে ছ্যাঁক করে সিগ্রেটের ছ্যাঁকা দিয়ে সে বললে, এক কথায় ব্লন্ড, তুই কি বলিস?'

মেয়েটি সত্যিই সুশ্রী। কিন্তু কোনােদিকেই তার তেমন মনােযােগ নেই; আলতাফের দিকে তাে নয়-ই। বিপুল বিষন্নতার ভারে নুয়ে আছে মেয়েটি। খুবই ভারাক্রান্ত। অন্য কোথাও তার মন পড়ে আছে, হাসপাতালে অথবা জেলখানায়, এই রকমই মনে হয় সবুজের। 
গাড়ির দরােজা খুলে নেমে গেল আলতাফ। ইশারা দিলাে মেয়েটিকে। রিকশা ছেড়ে তার নিজের গাড়িতে ওঠার আহ্বান জানায়। সবুজ দেখলাে ভয়ে এক মুহূর্তে নীল হয়ে গেল মেয়েটি। ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা বলতেই জোরে ছােটা শুরু করলাে রিকশাটি।
গাড়িতে উঠে পড়লাে আলতাফ।
‘কি হচ্ছে কি, আলতাফ তুই কি পাগল হয়ে গেলি?'
‘এখন কেউ যদি আমাকে পাগল করে, আমার দোষটা কি!' ‘
‘তুই যা ভেবেছিস, তা নয়—’
‘সব মেয়েই তাই, বুঝলে কচিবাচ্চা, সবই এক!' 
‘নির্ঘাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাের--'
‘আন্ডার দ্য ব্যাম, আন্ডার দ্য বু, আন্ডার দ্য ব্যাম্বু ট্রি--' হুঁহুঁ সুর ধরে রিকশার পিছু ধাওয়া করলাে আলতাফ, ভীষণ একরােখা আর জেদি চেহারা তার এখন।‘এ মেয়ে খেলুড়েটাইপের, চট করে ধরা দেবে না, বুঝলে কচিবাচ্চা, কিছুক্ষণ খেলাবে, এই আর কি!'
সবুজ কাতরভাবে অনুনয় করে বললে, ‘এটা একটা যা-তা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আলতাফ, তুই রিকশার পেছনে ছােটা বন্ধ কর এখন। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।'
রিকশার সামনে গিয়ে আবার থামলাে আলতাফ। আগের মতাে আবার ইশারা করলাে। রিকশাটা যখন দ্রুতগতিতে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে সে প্রায় আদেশের সুরে বললে, 'এই রিকশা থামাে, থামাে !’
ফল হলাে না কোনাে! মেয়েটির মুখের ঘুটঘুটে অন্ধকার এখন আরাে ঘনীভূত। প্রায় চোখ বন্ধ করে কাঠ হয়ে বসে আছে সে রিকশার ওপর। ভ্রূ কুঁচকে সিগ্রেট ধরালাে আলতাফ। সবুজ বুঝতে পারে ভেতরে ভেতরে কিছু একটা দমন করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ভয়াবহ রকমের কঠিন হয়ে উঠছে আলতাফের মুখ, পরাজয়ের গ্লানি।
‘তুই বরং আমাকে এইখানেই নামিয়ে দে, আমার খুব বিশ্রী লাগছে আলতাফ, দিন-দুপুরে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে হন্যের মতাে একটা মেয়ের পেছনে ঘােরার সত্যিই কোনাে মানে হয় না! ছি ছি ! তুই দেখছিস কোনাে রকমের রেসপন্সই দিচ্ছে না মেয়েটি, তবুও লেগে আছিস পেছনে। নিছক হ্যাংলামি—'
‘মাসটের, ওকে আমি গাড়িতে তুলবােই!' 
‘পারবি না তুই, আমি বলে দিলাম!' 
‘পারতে আমাকে হবেই--'
‘একটা মেয়ের পেছনে আঠার মতাে লেগে থেকে উপদ্রব বাধানাের কোনাে মানে হয় না। এ সম্পর্কে তাের ধারণা ভিত্তিহীন, নে নে এখন পিছু নেওয়া ছাড় । খুব কেদ্দানি দেখিয়েছিস--’
'তুমি ছুঁড়ি যতাে খেলুড়েই হও না কেন, কম নই আমিও। আমিও রামখেলুড়ে। গাড়িতে তােমাকে তুলবােই। আন্ডার দ্য ব্যাম, আন্ডার দ্য বু, আন্ডার দ্য ব্যাম্বু ট্রি--'
একবার সামনে একবার পেছনে, এই করতে করতে অনেক সময় ব্যয় করলাে আলতাফ, কোনাে রকমের অগ্রগতিই লক্ষ্য করা গেল না। সবুজ বুঝতে পারে ক্রমাগত নিজের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে আলতাফ, ক্রমাগত মরিয়া হয়ে পড়ছে ; দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি চালাচ্ছে। একবার ইচ্ছে করেই সামনে যেতে দিলাে সে রিকশাটাকে। ভয়াবহ কাঠিন্যে বদলে গেছে তার মুখ, জ্বলন্ত চোখজোড়া ঠিকরে বেরুচ্ছে, সবুজ ভয় পেলাে। আচমকা গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিলাে সে। তারপর ঝড়ের বেগে প্রায় তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে রিকশাটির কাছে পৌঁছে এক ধাক্কায় সেটাকে চুরমার করে দ্রুত বেরিয়ে গেল। ‘আলতাফ আলতাফ, একি করলি। একি করলি!'
কোনাে কথা বললে না আলতাফ। ও এখন নিজের ভেতরে ডুবে গিয়েছে, পঙ্কিলতার ভেতরে, অন্ধকারের ভেতরে। সেখানে পঙ্কিলতা না অন্ধকার, না নিছক খেলাধুলাে, একমাত্র সে-ই তা জানে।
এ রাস্তা ও রাস্তা করে শেষ পর্যন্ত সবুজের গলির মুখে পৌঁছুলাে। নীরবতা ঠাণ্ডা তরােয়াল হয়ে দুজনের মাঝখানে পড়ে আছে আড়াআড়ি। 
সবুজ দরােজা খুলে নেমে গেল গাড়ি থেকে।
আলতাফ সিগ্রেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাে ওর দিকে। বললে, ‘ভীষণ ঘেমে গেছিস, মুখ মুছেনে। সিগ্রেটের প্যাকেটটা রাখ, চারটে আছে--'
সবুজ পকেট হাতড়ালো। রুমাল খুঁজে পেল না। বাঁশবনের তলায় রুমাল পেতে বসেছিলাে, মনে পড়লাে। ফেলে এসেছে। প্রায়ই ফেলে আসে, রেখা বলে এতাে রুমাল হারাও কি করে!
‘জিজ্ঞেস করলি না তাে কিছু ?' আলতাফ বললে। 
‘কি জিজ্ঞেস করবাে?'
‘এই যে, আমি যা করলাম—'
আলতাফ স্টার্ট নেবার মুহূর্তে গাড়ির ভেতর থেকে বললে, ‘দোষগুণ যাই বলিস না কেন আমার ধরনটাই এখন এই। আমার যা প্রয়ােজন আমি তা জোর করে আদায় করে নেই, কারাে মুখ চেয়ে বসে থাকি না হা-পিত্যেশ করে। যেখানে তা সম্ভব নয় সেখানে গায়ের জোর খাটাই, প্রয়ােজন হলে উড়িয়ে দেই, নিজের অস্তিত্বের জন্যে এইসব করতে হয় আমাকে। বুঝতে পারছি খুব খারাপ লাগছে তাের, আমি দুঃখিত! মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা কর, ভুলে যা সবকিছু, দেখবি সবকিছু আবার কেমন ফর্সা হয়ে গেছে। দুনিয়াটাই এভাবে চলছে বন্ধু! ভুলে যাবার ক্ষমতা পর্বতপ্রমাণ হওয়া চাই!' 
(১৯৭৪)





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ