bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

যে ভাষা নিয়ে আমরা খেলছি আজ তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি রক্তস্নাত রাষ্ট্র -- মাহমুদুল হক


সাক্ষাৎকার গ্রহণ : লতিফ সিদ্দিকী||

[রােদ্দুরের প্রথম সংখ্যায় মাহমুদুল হককে নিয়ে ক্রোড়পত্র করতে চাওয়ার প্রথম অন্তরায় ছিলেন স্বয়ং মাহমুদুল হক। তাঁকে রাজি করানাের কাজটি সহজ ছিল না। ইচ্ছে ছিল তার একটি নতুন লেখা ছাপবার। তিনি লিখছেন না অনেক দিন। তাই সে ইচ্ছা পূরণ হল না। এরপর ভাবলাম তার সাক্ষাৎকার নেব। এই আশায় বহুবার তার বাসায় গিয়েছি। কোনাে কোনাে দিন টানা ৭/৮ ঘন্টা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি বলাটা বােধহয় ঠিক হল না। বলা উচিত, শুনেছি তার কথা । অচিরেই বুঝতে পারলাম এভাবে সাক্ষাৎকার নেয়া হবে না। বিষম ফোরে পড়া গেল যা হােক। অবশেষে বাঁচিয়ে দিলেন তিনি নিজেই। বললেন, পাঠক জানতে চায় এরকম বিষয়ে কিছু প্রশ্ন দিও আমি উত্তর লিখে দিব। আমাদের লিখে দেয়া প্রশ্নমালা থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। প্রশ্নমালার শেষে একটি ছক দিয়েছিলাম তাকে পূরণ করার অনুরােধসহ। তাতে একটা পরিচিতি পাওয়া যেত তাঁর। যেমন, তার জন্ম কবে, কোথা বাবার নাম কী, মার নাম কী, কোথায় কোথায় লেখাপড়া করেছেন এইসব। তা তিনি সেই কর্মটি পূরণ করার বদলে লিখলেন-'আমি এখনও মরিনি, আমাদের দেশে চার হাতপা ছড়িয়ে যারা বেঁচে আছে, এখনও তাদের আড়ালেই আমি জ্যাস্ত। আমি বেঁচে আছি, একথা বলছি না, বলছি আমি ভীষণ রকম জ্যান্ত। মােটকথা আমি বেঁচে আছি এ কথাটি মাথায় রেখে সব কিছু করলেই চলবে। মাহমুদুল হক। জন্ম অ্যাতাে অমুক অতাে তমুক অ্যাতাে এসব না করে, নতুন একটা কিছু করাে না। অতিমাত্রায় স্পর্শকাতরদের কাছে তাঁর এক কথাগুলাে অহংকার বলে মনে হতে পারে। হােক। রােদুর মনে করে এ অহংকারটুকু করার মতাে সঞ্চয় মাহমুদুল হকের আছে]

রােদ্দুর : মীজানুর রহমান সম্পাদিত রূপছায়ায় প্রকাশিত দ্রৌপদীর আকাশে পাখি দিয়েই সম্ভবত আপনার উপন্যাস লেখার শুরু। এর প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বলবেন কি? 

মাহমুদুল হক : দ্রৌপদীর আকাশে পাখি সম্ভবত আমার প্রথম উপন্যাস-ই হবে। সে সময় নিজের আনন্দের জনাে অনেক লেখাই লিখতাম, সব আর এখন মনে পড়ে না। তবে দ্রৌপদীর আকাশে পাখি উপন্যাসটিতে যা-ই থাকুক না কেন, লেখার পেছনের কাহিনিটি বেশ মজার। আমার একজন ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে পড়া বন্ধুর দেখা পেলাম. জগন্নাথ কলেজের কমন রুমে, সে চুটিয়ে দাবা খেলছিল তখন; নিজামউদ্দিন ইউসুফ, ১৯৫৮-র শেষের দিকের ঘটনা। আমরা স্কুলে একই ক্লাসে পড়েছি মাত্র এক বছর, তারপরই এ খুলনায় চলে যায়। ও থাকত ওর বড়ভাইয়ের সঙ্গে, তিনি তখন অবিবাহিত তার ওপর আবার রাশভারি গোছের মানুষ। কাজেই নিজামের সঙ্গে খুব একটা জমেনি বন্ধুত্বটা। তবে খুব ভালাে ক্রিকেট বুঝত, আজিমপুর কলােনির মাঠে বিকেলের দিকে আমাদের বেশ কয়েকজনকে সে রীতিমতাে তালিম দিত। কয়েক বছরের ব্যবধানে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল নিজামউদ্দিনের, এবারের দেখাটা ছিল ভিন্ন রকম। এতদিন পর সে যেন সাতরাজার ধন হাতে পেয়েছে। সে আবিষ্কার করল আমি শরশ্চন্দ্র। সে সময় আমি ব্যাপটিস্ট মিশনে বন্ধুবান্ধবদের ঘরে বেশিরভাগই রাত কাটাতাম। এমনকি বাইরের অনেকেই জানত মিশনের হােস্টেলে থাকি। তখন নিজামউদ্দিনের একমাত্র কাজ হল আমাকে মানুষ করে গড়ে তােলা। বয়েসে এক আধবছরের ছােট-ই হবে সে, কিন্তু কর্তৃত্ব করতে ছাড়ে না। বাকিতে সিগ্রেটের ব্যবস্থা করে দেয়। নিয়মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়ে আসে, বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোতলায় দু'জনের মুখােমুখি বসে লেখাপড়ার কাজ করতে হয়। শরীফ মিয়া তখন পাম গাছের নিচে ইট বিছিয়ে চা আর বাটার-টোস্ট খাওয়ায় পড়য়াদের। দু'ঘণ্টা লেখাপড়ার পর একটি বাটার-টোস্ট আর এককাপ চা জুটত, আর সে চা ছিল এমন, তখন যারা খেয়েছে তাদের সকলেই তা জানে। নবাবপুরের ক্যাপিটাল, কোর্টের সামনের মিরান্ডার আর চিত্তরঞ্জন এভিন্যুর রিভার ভিউ কাফের বিখ্যাত চা-পায়ী চাতকদলের অনেকেই শরীফ মিয়াকে ততদিন আবিষ্কার করে ফেলেছিল। শরীফ মিয়া শিংয়ের চিরুনি আর বােতামের কাজ করত আগে, মুখে বলত আইভরির কথা। তবে আইভরি সম্পর্কে তার তেমন কোনাে ধারণাই ছিল না, অবশ্য শরীফ মিয়ার নিরীহ ভাবভঙ্গিতে আর কথা বলার ধরনে তা ধরা খুব কঠিন ছিল। আমি তখন নাটাল, ট্রান্সভাল, অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট অথবা জোহানেসবার্গের পথে পথে ঘুরছি মনে মনে। কী জানি কেন (আজও আমার কাছে এ-এক দুয়ে রহস্য) হীরা-জহরত আর রত্ন-সামগ্রীর এক দূর-দূরান্তরের রহস্যলােক কেবলই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেইন্ট হেলেনার কবি পাকা ফলের চেহারার ফজলুল হক সেলবর্ষী শরীফ মিয়ার ইটালি চাখানায় এসেছেন দু-একবার সে সময়, গল্প করতেন নজরুলের। এই রকমই এক সময়ে মীজানুর রহমানের রূপছায়া (তখনকার একমাত্র সিনেমা মাসিক পত্রিকায় টিপু সুলতানের একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস ছাপা হল। এর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে কলকাতার উল্টোরথ প্রতি সংখ্যায় একটি করে উপন্যাস ছাপতে শুরু করেছিল। ব্যাপারটি তখনকার দিকে খুবই অসম্ভব ও নতুন ছিল। শহীদ সাবের এ ব্যাপারে এতই উৎসাহিত ছিলেন যে, তিনি ক্ষেপে উঠেছিলেন ঢাকায় ওই ধরনের একটা কিছু প্রবর্তন করার জন্য। তিনি তখন আজিমপুর কলােনির তার অবসরপ্রাপ্ত পিতার ১০/জে ফ্ল্যাট থেকে রােকনপুরে চলে এসেছেন, খুব সম্ভব এখনকার দৈনিক বাংলার ফজলুল করিমের বাসা। আমাকে ভালােবাসতেন। যেখানে যেতেন, সে বেগম সুফিয়া কামালের বাসাই হােক, পোটলা বেঁধে নিতেন আমাকে। তিনি বললেন, তুমি একটা শুরু করাে, একশ’ পৃষ্ঠার মধ্যে, আমিও একটা লেখা ধরেছি, অর্থাৎ উপন্যাস। তাঁর কথায় সত্তর টাকায় ফরাশগঞ্জের এক জবরদস্ত কোঠাবাড়ির দোতলার একটা ঘরও পত্রিকার অফিক্স হিসেবে ভাড়া নেয়া হল। এই উপলক্ষে আমি যে উপন্যাস রু করলাম, তা বেড়েই চলল, ব্যাধ ও নীলদুপুর। অফিসের ভাড়া একবারই দেয়া হয়েছিল, তারপর থেকে ভাড়া বাকি পড়া শুরু হল। সে বলল, তােমার এখন আর কোনাে কাজ নেই, কাজ একটাই, তাহল একটি ছােট উপন্যাস লেখা। সে আমাকে সময় দিল এক সপ্তাহ। এর মাত্র কিছুদিন আগে বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম শেষ করেছি, বলতে কি এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতার ভেতর আছি। মাঝে মাঝে আমি রূপলাল হাউসের সামনে বসে থাকি সারা বিকেল। নিজামউদ্দিন গভীর আগ্রহ নিয়ে বলে, তুই নিশ্চয়ই কিছু ভাবছিস, ভালাে ভালাে, খুব ভালাে। মাঝে মাঝে একটা নৌকা ভাড়া করি, বুড়িগঙ্গায় ভাসতে ভাসতে রূপলাল হাউসের দিকে তাকিয়ে থাকি একা একা। পাড়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে নিজামউদ্দিন, পানিতে তার খুব ভয়। সে মৃগীরােগী, হঠাৎ হঠাৎ যে কোনাে সময় তাকে ভয়ঙ্কর মূৰ্ছা আক্রমণ করে। এক অদম্য উৎসাহ নিয়ে নিজামউদ্দিন দূর থেকে হাত নেড়ে ইশারা করে, জানতে চায় রূপলাল হাউস দেখতে দেখতে আমার কোনাে ভাব আসছে কি না। আমি জানাই, ভাব আসছে। দূর থেকে বিশাল বাড়িটার দোতলায় মাঝে মাঝে কেবল আবছা মতাে একটি মেয়েকে দেখা যেত, আর কিছু নয়। আমি ধরে নিলাম তার নাম ইলা। ইলা তাকে তৈরি করেছে নিজের দেহ থেকে।। সদ্য মগজে ঢুকেছে বিষয়টি। সে যাক। রূপছায়া অফিসের টেবিলের ওপরে রেখে এলাম ছােট্ট উপন্যাসটি, সম্পাদককে না পেয়ে। এক সপ্তাহ পরে আবার গেলাম খবর নিতে, খবর হয়েও গেল, পেলাম, চিরকালের সুহৃদয়, প্রাণের ধন, অসম্ভব ধীর আর শিশুমনের মানুষ মীজানুর রহমানকে (এখন যিনি ত্রৈমাসিক পত্রিকার জন্য বিখ্যাত)। নিট লাভ যাকে বলে। দ্রৌপদীর আকাশে পাখির লেখককে সােজা তাদের তখনকার শরগুপ্ত রােডের বাসায় ধরে নিয়ে গেলেন, একে একে পরিচয় করালেন বাড়ির সকলের সঙ্গে। একদিনেই হয়ে গেলাম বারি ছেলে। এর আগে আমি সাহিত্যচর্চাকে এক ধরনের চুরি-চামারি চর্চা বলে মনে করতাম, এত দুচ্ছাই শুনতে হত। এই প্রথম জানলাম, অনেক ভালােবাসা পাওয়া যায়, অনেক সম্মান পাওয়া যায়, সাহিত্যচর্চা একটি সাধারণ ব্যাপারও নয়। একদিক দিয়ে এটা একটা কালও হল। অতি সতর্কতার ফলে মাকড়সার জালে মাছি হয়ে গেলাম। বই ছাপা হচ্ছিল চাবুক প্রেসে। মাসিক পত্রিকার সঙ্গেই এক এক ফর্মা করে চাপা হয়। আনিস চৌধুরী তখন করাচিতে কর্মরত। সেখান থেকে চিঠি এল, কে এই লেখক কী তার পরিচয়। মীজানুর রহমানের (তহবিল শূন্য হলেও) উৎসাহ এই রকম ছােট ছােট ঘটনায় দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণতর হচ্ছে। তিনি শুধু একটি কাজই করলেন, ইলাকে লায়লা করে দিলেন কেটে। শুনে মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় নিজামউদ্দিনের। এক মিনিটের ভেতর তার বােঝা হয়ে গেল যে, এ মানুষ ক্ষতিকর, কালাপাহাড়, এর রসবােধ নেই, আমি যেন তার হাত থেকে পাণ্ডুলিপি ছিনিয়ে আনি। এই সময় আমার বই বের করার ব্যাপারে মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহরও বােধহয় অমত ছিল। তিনি মীজানুর রহমানের কাছে সেই রকমই কিছু ব্যক্ত করেছিলেন বলে শুনেছি। তার ধারণা মতে, বই প্রকাশের ব্যবস্থা করে আমার মাথার নাটবলটু ঢিলা করে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এক রকম পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্রে একদিকে তিনি আমার অগ্রজ, অপরদিকে হাতে খড়িও তাঁর কাছে, আমি তখন তাকে ভয়ই পেতাম, ততদিনে চোখকান ফুটে গেছে আমার, ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়াই তার থেকে। এক সময় আমার নিজেরও মনে হল এ বই ছাপা উচিত নয়। বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গােলাম পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল লেখাটিতে, বুঝতে পারছিলাম নিজেই। হঠাৎ করেই, এর অল্পকাল পরেই আমার জীবন অন্য একখাতে মােড় নেয়, হারিয়ে ফেলি লেখালেখির সকল উৎসাহ। মাসিক রূপছায়া পত্রিকার প্রকাশনা আর্থিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়, দ্রৌপদীর আকাশে পাখিও প্রকাশিত হয়নি, যদিও বেশ কয়েক ফর্মা ছাপা হয়ে গিয়েছিল। এই হল প্রথম উপন্যাসটির ইতিবৃত্ত।
কথায় কথায় উল্লেখ করেছিলাম ব্যাধ ও নীল দুপুর উপসটির। দ্রৌপদীর আকাশে পাখির আগেই শহীদ সাবেরের কথায় ও লেখাটা শুরু। যখন দেখলাম আকারে বড় হয়ে যাচ্ছে তখন থেকে গেলাম। আহসান হাবীব বলছেন লিখতে, বলছেন যা পারাে, যতদূর পারাে, যেভাবে পারাে একটু একটু করে হলেও উপন্যাসটি শেষ করাে। দ্রৌপদীর আকাশে পাখির আগে শুরু এ লেখা শেষ করতে সময় লেগেছিল অনেক, তখন আমি এই কর্মকাণ্ডে ল্যাজেমুড়োয় নাজেহাল অবস্থায়। উপন্যাস শেষ করে হাবীব ভাইয়ের হাতে দিলাম। প্রায়ই হাবীব ভাই আসেন, দুনিয়ার কথা হয়, ভালােবাসতেন আমার মুখে নানা ধরনের গল্প শুনতে। কিন্তু কোনােদিনই উল্লেখ করেন না বইটির কথা। এইভাবে তিন বছর। একদিন সংকোচের সঙ্গে হাবীব ভাইকে বললাম, হাবীব ভাই, আমি বুঝতে পেরেছি আমার লেখাটি কাচা।' হাবীব ভাই কিছু বললেন না, পরদিনই আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন লেখাটি। এর মাঝে এলাকা নামে আমি একটি বিশাল রচনায় হাত দিয়েছিলাম। ফজল শাহাবুদ্দীনকে মাঝে মাঝে দু-একটি পরিচ্ছেদ পড়ে শুনিয়েছি কখনাে কখনাে। আমার ধারণা ছিল পাঁচ বছর লাগবে শেষ করতে লেখাটি। মন বসে থাকে না। জীবনের জটিলতায় নিজের অজান্তে পদে পদে জড়িয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি না তখন। একদিন সব ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে (বােধহয় বাড়ি বদলের সময়) সমাপ্ত-অসমাপ্ত সব লেখাই এত জোলাে, এমন অর্থহীন, এমন ছেলেমানুষি মনে হল যে ফেলে দিলাম সব। প্রতিজ্ঞা করলাম সব ভুলে যাব, এসবের সঙ্গে আর জড়াব না নিজেকে। ব্যাধ ও নীলদুপুর আমার শুরু করা প্রথম উপন্যাস, আর এলাকা হল এমন একটি উপন্যাস যা কখনাে শেষ করা যেত না, বা শেষ হয়নি। তেষট্টির গােড়ার দিকে নিজামউদ্দিন লন্ডনে চলে যায়। এরপর দেখা দীর্ঘ সাত বছর পরে। ততদিন অনেক কিছুই বদলে গেছে; দেশ এক অতিদ্রুত পরিবর্তনের দিকে ছুটে চলেছে। সারা দেশে তখন আমি পরিচিত হয়ে গেছি এক নম্বরের জহুরি হিসেবে। নিজামউদ্দিনের সঙ্গে তার ফিচঁসে ভিভিয়ান। ভিভিয়ান ফরাসি মেয়ে। স্বদেশ আর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পরিচয় করানাের উদ্দেশেই নিজামউদ্দিন তাকে সঙ্গে নিয়ে এসছে। তুমিই তাহলে সেই লোক' ভিভিয়ান আমাকে বলে। কোন লােকের কথা বলছ?' আমি প্রশ্ন করি। তুমি তাে এদেশের রমা রোলার—' বুঝলাম নিজামউদ্দিন কে কী কী পড়িয়েছে। এরপর মােট চারবার সে দেশে থেকে ঘুরে গেছে। শেষবার এসেছিল এই '৯২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। উদ্দেশ্য একুশে ফেব্রুয়ারির সব অনুষ্ঠান ভিডিওতে ধারণ করা। যাবার আগে হঠাৎ অন্যদিক মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে বললে, 'তুই এক নম্বরের পাষণ্ড, হৃদয়হীন নিষ্ঠুর অমানুষ। কারণ? কারণ আর কিছুই নয়, এ পর্যন্ত আমি ওর নামে কোনাে বই-ই উৎসর্গ করিনি।
প্রথম থেকেই আমাকে এমন এক শাসনের বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল নিজামউদ্দিন যে তাকে দেবার মতাে কোনাে যােগ্যতা আছে বলে মনে হত না আমার। অনেক পরে আমি জেনেছিলাম, আমার সিগ্রেটের ধারদেনা থেকে শুরু করে আরাে অনেক কিছুই সে চালাত ঠিকই, কিন্তু দিনের পর দিন তখনই সে না খেয়ে থাকত যা তখন আমি জানতাম না। কলম্বাে প্ল্যান'-এর আওতায় তার বড়ভাই তখন আফ্রিকা না কোথায় যেন কর্মরত ছিলেন, অভিমানবশত কারাে কোনাে সাহায্যই সে নিত না। জানলাম, অতি সামান্য তার চাওয়া, যা আমি দিতে পারি। কালাে বরফ হয়তাে আরাে অনেকদিন আলসেমির কথা গায়ে দিয়ে ঘরে পড়ে থাকত। নিজামউদ্দিনকে উৎসর্গ করার তাগিদেই বইটি বের করা। তার শরৎচন্দ্র বা রমা রোলার যে বহুদিন আগেই মৃত্যু ঘটেছে, তা সে জানে কিন্তু বিশ্বাস করতে চায় না সে একথা । 

প্রশ্ন : ১৯৭৩-এ বই আকারে প্রকাশিত যেখানে খঞ্জনা পাখির সঙ্গে সমীপেষুতে মুদ্রিত অনুর পাঠশালার দূরত্ব কতখানি? এ বইয়ে সন্দাসীসহ কয়েকটি চরিত্র শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে, আবার ফালানি ফকিরা'রা বলে আঞ্চলিক ভাষায়। কারণ বলবেন কি? মা চলে যাওয়ার পর অনু সরুদ্দাসীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। সে সদাসীকে আবিষ্কার করে এবং যে ঋষিপাড়ায় ঢোকে সে তার অচেনা। বিষয়টি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে—এই চেনা মানুষ ও পরিচিত পটভূমি বদলে যাওয়ার বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলবেন কি? 

মাহমুদুল হক : ১৯৭৩-এ মাসিক সমীপেষুতে প্রকাশিত অনুর পাঠশালার সঙ্গে পুস্তকাকারে প্রকাশিত যেখানে খঞ্জনা পাখির দূরত্ব অতি সামান্য; বলা যায় নিছক ছাপার ভুল সংশােধন। সরুদাসী ঋষিদের মেয়ে। ঋষিদাসরা নিজেদের বাইরে শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলত, সরুদাসীর ভাষায় আমার জানামতে কোনাে ভুল নেই। তবে ‘ইলুম প্রত্যয় নিয়ে আ.ন.ম. বজলুর রশীদ সাহেবও কাগজে আপত্তি তুলেছিলেন। ফালানি বা ফকিরাদের ভাষা ঢাকাইয়া ভাষা। বিশদভাবে বলতে গেলে বলতে হয় কুট্টি ভাষা। কুট্টি ভাষা আর ঢাকাইয়া ভাষার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। আমি কুট্টি ভাষা বলতে বুড়িগঙ্গার ওপারের চুনকুঠিয়ার ভাষাকেই নিয়েছিলাম। এক কথায় আঞ্চলিক ভাষা বলে সবকিছুকে চালানাে যায় না। বুড়িগঙ্গার ওপারেই আঞ্চলিক ভাষা প্রায় চার ধরনের। কুট্টিদের ভাষা, পুবাদের ভাষা, চৌরাদের ভাষা, কিংবা কাছাইরাদের ভাষার তফাত অনেক। অনুর পাঠশালায় আমি চুনকুটিয়ার আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলাম। তবে শেষাবধি আমি এই সিদ্ধান্তেই পৌছেছিলাম যে এ ভাষা অতিমাত্রায় চপল স্বভাবের। এর ভেতরের চাপল্য নিজস্ব গতিতে চলে, বারবার লেখকের নিয়ন্ত্রণের বইরে চলে যেতে চায়। এই উপন্যাসের শেষাংশে কেন পটভূমি বদলে গেল গল্প তাে সেটাই। 

প্রশ্ন : জীবন আমার বােন সম্ভবত সর্বাধিক সমালােচনার মুখােমুখি হয়েছে। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিকে নানাজনে নানাভাবে দেখেছেন। অনেক সমালােচক একে দেখেছেন নেতিবাচক উপন্যাস হিসেবে। থােকাকে কেউ কেউ দেখেছেন শুধুমাত্র আইডিয়া হিসেবে। আপনার বক্তব্য কী? 

মাহমুদুল হক : জীবন আমার বােন সম্পর্কে নতুন করে কিছুই বলবার নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের অসহযােগ আন্দোলনের পঁচিশ দিনের কিছু খণ্ডচিত্র এতে আছে, যা সম্পূর্ণ ঢাকা শহরকেন্দ্রিক; আমি মুক্তিযুদ্ধের কোনাে ইতিহাস রচনা করিনি, কোনােদিন ঠাট্টাচ্ছলেও বলিনি এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। জানি মুক্তিযুদ্ধের কোনাে সঠিক ইতিহাস এ পর্যন্ত রচনা করতে না পারায় অক্ষমতা আমাদের বিদ্বজ্জনকে অন্ধ গলিতে কীভাবে মিছামিছি ছােটাছুটি করাচ্ছে। জীবন আমার বােন সাপ্তাহিক বিচিত্রার জঘন্যতম কণ্টকশয্যায় (রশীদ করীমের মতে) যখন, সেই তখন থেকেই, অর্থাৎ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার বহু আগে থেকেই বহুভাবেই সমালােচিত হয়ে আসছ । গত পনেরাে-ষােলাে বছরে এত পরস্পরবিরােধী আলােচনা-সমালােচনা হয়েছে যে মাঝে মাঝে আমি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। বহুদিন আগে সন্তোষদা সংবাদে একটি দীর্ঘ সমালােচনা লিখেছিলেন জীবন আমার বােনের। কায়েস আহমেদ তার সূত্র ধরে কিছু কথা, অর্থাৎ নিজের ভিন্ন ধরনের মত প্রকাশ করেছিলেন। আমার নিজের ধারণায় একমাত্র কায়েসই কিছু রসবােধের পরিচয় দিয়েছিল। বাবার টেবিলকে বহুবার আমি লেখার টেবিল করেছি, ঠিকই, কিন্তু লেখার টেবিলকে কোনাে দিন পল্টন ময়দান করে তুলিনি, তা আমার কাজও নয়। কমলকুমারকে আমাদের সময়ের প্রতিভার অপচয়ের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন কিছুদিন আগে একজন স্বনামধন্য লেখিকা, কিন্তু বােঝা গিয়েছিল অন্তর্জলী যাত্রার কেবলমাত্র ভূমিকাটি বােঝার মতাে রসবোেধও যদি তার থাকত তাহলে এত হাসাহাসি হত না। কী জানি, অনেকের হয়তাে সমতলের ঘাস মুখে ভালো লাগে না, তারা পাহাড়ে গিয়ে ঘাস খেতে চায়। এই সব সংক্রামক রােগ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মাঝে মধ্যে ঢাকার পত্রপত্রিকাতেও বিজবিজ করে ওঠে। সমালােচকের দীর্ঘবিচার-বিশ্লেষণে জানা গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে জীবন আমার বোন-এর লেখকের বিশেষ অবদান হলাে গালিগালাজের ভাষা নির্মাণ। অধুনালুপ্ত তখনকার একমাত্র রুচিশীল সাহিত্য মাসিক গণসাহিত্যে তার একটা লিস্টও বেরিয়েছিল। যেমন, ১. চান্স পেলে কানকো মার বের করবাে একদিন; ২. চোত মাসের কই কোথাকার; ৩. একটা কাঁট বেল্লিক; ৪. ঝাল লগড়াচ্ছিস কেন আমাকে নিয়ে; ৫. খেল খতম, পয়সা হজম; ৬. তাের মতাে এই এলুম বলে মাঝরাতে দেবদাস হয়ে ঘরে ফিরি না; ৭. কি কূট কচালে ছুড়িরে বাবা; ৮. তুই একটা ইপিট, ষাঁড়ের গােবর, গােস; ৯. তাের শালা মুখের কোনাে ট্যাকসাে সেই, একটা ডাস্টবিন; ১০, মাঝে মাঝে এমন গােলালু মার্ক কথা বলিস ভপ!; ১১. আগে তাে পকেটে গুচ্ছের ন্যাকড়া আর ঢিল ভরে রাখতিস, এখনাে চলে ওসব; ১২. একে যােনী, দুয়ে স্তন, তিনে দংশন, চারে বর্ষণ, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার জানামতে, কেবলমাত্র একটি গালিই জীবন আমার বোনে ছিল, সমালােচক যার সন্ধান পাননি, বলতে হবে সেটা আমার নিজেরই বরাতের জোর। তাের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেব' কথাটা গালি, কারাে কারাে কাছে অশ্লীল মনে হতে পারে গালিটি, অবশ্য এমন হতে পারে তখনই যখন বই থেকে তাকে আলাদা করে তুলে নেয়া হবে । মানব সমাজ প্রগতির দিকেই যাচ্ছে, অনেকের মতাে আমিও তা বিশ্বাস করি; কিন্তু আমি দেখতে চাই বা দেখে থাকি আমার নিজের চোখ দিয়ে, বুঝতে চাই ধার না করা মগজ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বের অবস্থার দারুণ বর্ণনা আছে এ বইয়ে, কিন্তু সে রকম অবস্থা কেন সৃষ্টি হল, কারা ছিল পেছনে, তা উপলব্ধি করার কোনে উপায় নেই’ সমালােচনায় এসব কথাও ছিল। ভাগ্যিস, ঝুড়ি কোদাল কাঁধে নেয়ার দাবি কেউ করেনি, কেননা, আলােচনা-সমালােচনায় শুধু ওইটুকু বাকি ছিল। প্রতিক্রিয়ার ব্যাকরণ হিসেবে ‘পেনিং' কথাটা এসেছিল; বলা যায় জোর করে জীবন আমার বােনের কাঁধে চাপানাে হয়েছিল; যতদূর জানি কেবলমাত্র পারফমিং আর্টের ক্ষেত্রেই তা প্রযােজ্য। কিন্তু এসব কথা থাক, কামারের ঘরে কোরান পড়ে কোনাে লাভ নেই । সংক্ষেপে আমার নিজের একটি বিশ্বাসের কথা বলছি। আমার ধারণা, আমাদের আমির বাংলাভাষা এখনও সম্পূর্ণ তার নিজস্ব রূপ ধারণ করেনি, করতে চলেছে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলা সম্ভব নয়। সন্দীপন কিংবা মান্নান সৈয়দ এমন মনােলােভা বাংলা নিয়ে খেলেছেন যে, আমার হিংসা থাকলে অবশ্যই এঁদের হিংসা করতাম। মান্নান সৈয়দের তৈরি এই বাংলা মদ ক’জনের মনে ধরেছে? দোষ ভাষার নয়, দোষ লেখকেরও নয়, পাঠকের রসবােধের। ভাষার বিবর্তনের পর্যায়ে অনেক কিছুই দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, এ দোষা লেখকের নয়। মান্নানের মতােই আরাে অনেকেই অনেক সম্ভাবনার পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু কোনাে কিছুই বেশিদূর পর্যন্ত কখনােই গড়ায়নি। যে ভাষাটি নিয়ে আমরা খেলছি আজ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি রক্তস্নাত রাষ্ট্র, এ কথা যেন সকলের মনে থাকে। শুধু ‘বই ল্যাখা নয়, একসঙ্গে অনেক কিছুই করার আছে আমাদের। 

প্রশ্ন : নিরাপদ তার হিরন শেষ পর্যন্তু যার কাছে ফিরে যায়, সে তার কেরামত নয়। একটা দীর্ঘ এবং দুঃসহ পথপরিক্রমার পরও হিরনের মুখ কেরামতের নাম। এই কেরামতক সে মনের ভেতর কীভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন? নারীবাদীরা হিরনের পরিণতিতে অসম্ভষ্ট হলে আপনার বক্তব্য কী হবে? 

মাহমুদুল হক : নিরাপদ তন্দ্রার হিরন শেষ পর্যন্ত তার প্রেমিক-পুরুষের কাছেই ফিরে এসেছিল, তবে মানুষটি যে কেরামত নয় তখন তার এ বােধ লােপ পেয়েছিল। সে তখন ভাবছিল মাত্র গত কালই সে জলেশ্বর মাঝির নৌকো চেপে জয়পাড়া থেকে ঢাকায় এসেছে। সে শুধু চিনেছিল বস্তির একটি ঝুপড়ি, যেখানে সে প্রথম বসবাস করেছিল। এ তার স্বপ্নের ঘর, এখানেই সে রচনা করতে চেয়েছিল বেহেশত। বেহেশত হয়নি, হয়েছিল দোজখ । হিরনকে আমি প্রেমের প্রতিমূর্তি হিসেবে গড়তে চেয়েছিলাম। তখনও পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল একমাত্র নারীই জানে প্রেম কী। অষ্টম এডোয়ার্ড নিয়ে অনেক হয়েছে, আর কত? হিরন সব বিস্মৃত হয়ে ফিরে এসেছিল বলেই সে মহান, তখন সে আর সাধারণ মানবী নয়, তখন সে নিজেই রূপান্তরিত প্রেমে, অার প্রেম, প্রেমের কখনাে মৃত্যু হয় না। নানাভাবে তা রূপান্তরিত হয়। মাংস ব্যবসায়ী বা অপ্রেমিকেরা এই রূপান্তরকে সাধারণ পাগলামি হিসেবেই দেখে থাকে। আমি যে প্রেমকে হামানদিস্তায় ফেলে ঠুকে ঠুকে মাথার মুকুট করেছি, তার নাম হিরন। কত কথাই সে বলেছে, কত সুখ, কত দুঃখের কথা, এমনকি তার নিজের মাও যে তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে সে কথাও ‘বাপজানের জামায় একটা বােতাম টেকে দেওয়াও আমার অপরাধ। আচ্ছা কোনাে মা তার নিজের পেটের মেয়েকে বাপ ভাতারি বলে? অনেক বিস্মৃতির মাঝেও তার এই-কুৎসিত নােংরা কথাগুলাের জ্বালা সে ভােলনি, কিন্তু কই কোথাও তাে সে কাঁদেনি! | 

প্রশ্ন : খেলাঘর-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি জীবন আমার বােনের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট এবং দ্বিধাহীন। যুদ্ধ সম্পর্কে এটা কি আপনার পরিবর্তিত মূল্যায়ন? 

মাহমুদুল হক : খেলাঘর-এর কাহিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ এখানে স্পষ্ট এবং দ্বিধাহীনভাবেই থাকার কথা।

[সূত্র : রােদ্দুর ১ম সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৯২]




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ