করোনা মহামারীর অস্থির সময়ে গত মে-জুন মাসে কথাসাহিত্যিক মেহেদী উল্লাহ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে সমসময়ের কবি, কথাসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীগণের সাথে 'হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার' (Half an hour chatting about culture) শিরোনামে প্রায় প্রতিদিনই চিন্তামূলক আলাপসমূহ প্রকাশ করেছিলেন, যা সে সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। গতিপথ বাংলা ওয়েবজিনের আলাপ-সিরিজে প্রতি রবিবার মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার এর একটি করে পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে।
মেহেদী উল্লাহ’র টাইমলাইন: বৃহস্পতিবার, ২৮ মে ২০২০; সন্ধ্যা ০৭ টা ৪৯ মিনিট
আজ থাকছেন কবি ও পপুলার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর দেব জ্যোতি ভক্ত (Dev Jyoti Bhakta)। সংস্কৃতি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে—
মেহেদী উল্লাহ : সাধারণত আমরা দেখি, বাঙালি সংস্কৃতিতে দেবর-ভাবি একটা ব্যাপার আর কি! কিন্তু ঢাকা শহরে যেখানে পাশের ফ্লাটেই ভাই ভাইকে চিনতে চায় না, সেখানে 'পাশের বাসার ভাবি' ব্যাপারটা আপনার মধ্যে কীভাবে জন্ম নিল। নাকি আমি পাশের বাসার ভাবি সম্পর্কে অজ্ঞ?
দেব জ্যোতি ভক্ত : আমি সিরিজ লিখতাম; বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। প্রথম লিখছিলাম - বালক-বালিকা সিরিজ। ১২ সালের দিকে। এরপর লিখলাম - প্রাক্তন প্রেমিকা সিরিজ। ১৩ সালের দিকে। এরপর একটা বিল্ডিং নিয়ে সিরিজ লেখা শুরু করলাম। অনেকগুলো ক্যারেক্টর ছিলো। বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালার মেয়ে, আরও বিভিন্ন তলার ভাড়াটিয়া, আর পাশের বাসার ভাবি। কিন্তু দ্যাখা গ্যালো - ফেসবুকে যখন এই সিরিজ দিলাম, সবাই বারবার পাশের বাসার ভাবিকে পড়তে চাইতো ৷ তাই হঠাৎ করে আমি পাশের বাসার ভাবি নিয়ে সিরিজ করি।
এটা এতো প্ল্যান করে করা হয় নাই। হুট করেই হইছে।
মেউ : আপনার 'পাশের বাসার ভাবি' সম্পর্কের মধ্যে একটা সুপ্ত লিবিডো চেতনা আছে, সেজন্যই কি পপুলার হলো?
দেব জ্যোতি ভক্ত : পপুলার ক্যান হইছে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নাই। আর এতো পপুলার হবে এটা আমি নিজেও বুঝি নাই আগে৷
মেউ : এটা লেখার সময় 'সবিতা ভাবি'র অবচেতন কখনো কাজ করে?
দেব জ্যোতি ভক্ত : হুম, কাজ করছে এরকম কিছু। অবচেতনভাবে না, সচেতনভাবেই কাজ করছে। সচেতনভাবেই চেষ্টা করছি - সবিতা ভাবি টাইপ কিছু না হয় যেনো। হয়ও নাই। খুবই সিম্পলভাবে গল্প আগাইছে; অনেককিছুর সম্ভাবনা হয়তো অনেকেই দেখছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাশের বাসার ভাবি একেবারেই পাশের বাসার ভাবি হয়ে ছিলো। এর বেশি কিছু না।
মেউ : শরৎচন্দ্রের 'রামের সুমতি'র ভাবি চরিত্রের মতো ভাবি কেউ আপনার ছোটবেলায় ছিল?
দেব জ্যোতি ভক্ত : নাহ, ছিলো না।
মেউ : আচ্ছা। ওখানে, শ্যামলালের পত্নী নারায়ণী যেবার প্রথম ঘর করতে আসেন—সেই বছরে রামের বিধবা জননীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি আড়াই বৎসরের শিশু রাম এবং এই মস্ত সংসারটা তাঁর তেরো বছরের বালিকা পুত্রবধূ নারায়ণীর হাতে তুলে দিয়ে যান। রাম খুব জ্বালাত।
কাদম্বরী দেবীকে মনে পড়ে, ভাবি প্রসঙ্গে? রবীন্দ্রনাথের একই বাসার ভাবি!
দেব জ্যোতি ভক্ত : কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে আমি খুবই কনফিউজড। সম্পর্কটা কি রকম ছিলো, সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি কি রকম ছিলো, এইসব ব্যাপার নিয়ে আমি খুবই কনফিউজড। তার মানে এটাও হতে পারে যে, আমি এতো বেশি ভেবেছি বা এতো বেশি জানার চেষ্টা করেছি যা আমাকে কনফিউজড করে দেয়। আর আরেকটা ব্যাপার আমি খেয়াল করছি, কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে একেকজন গবেষক একেক রকম কথা লিখেছেন। যা পড়ে আমার মাথা ঘুরায়। যেমন ধরেন - কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট। এইখানে ডাক্তারের খরচের নথি থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু বলা হয়েছে৷ কিংবা রবীন্দ্রনাথের জীবনে নারী'তে আরও অনেক প্রসঙ্গ..
মেউ : বাহ। আচ্ছা৷ ভাবি নিয়ে এটাই লাস্ট! আর ভাবব না। কখনো নিজের বাসার ভাবি বা পাশের বাসার ভাবির প্রেমে পড়েছেন?
দেব জ্যোতি ভক্ত : দূরের বাসার ভাবির প্রেমে পড়েছি..
মেউ : আমাকে এট্টু বলেন না, কেমন ছিল সেটা?
দেব জ্যোতি ভক্ত : আমার সব প্রেম-ই দুর্দান্ত; এরচে' বেশি কিছু বলার নাই।
মেউ : যদিও বলেছিলাম, ভাবি নিয়ে আর ভাবব না। সরি কথা রাখতে পারি নি!
দেব জ্যোতি ভক্ত : কথা রাখতে না পারাটা অপরাধ না। এটা আমার ভেতরেও আছে।
মেউ : আচ্ছা, এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, ফেসবুকে আপনার পোস্টকৃত বিভিন্ন পেশায় কাজ করারত ছবিগুলো শুধু ছবি নয়, এটা সেই পেশার মানুষগুলো ও তাদের কাজকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এই চিন্তা কীভাবে এলো?
দেব জ্যোতি ভক্ত : এটার পেছনে অন্য কারণ আছে। সেটা পরে কখনও বলবো৷ তবে এটুকু বলি - অনেকের ধারণা - আমি শুধু ছবিই তুলি। ব্যাপারটা তা না। আমি কোন কোন সময় তাদের সাথে কাজ করি, আড্ডা দেই, খাওয়া-দাওয়া করি বা আরও অনেক কিছু। শুধু বলে রাখি - আমার এই ব্যাপারটা ফেসবুকের মতো এতোটা সহজ ও সরলরৈখিক না৷
মেউ : ঠিক তাই। যেসব পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন কুলি। ওমর সানি একবার কুলি হইছিলেন ছবিতে, তাকে বেশ মানিয়েছিল! এত কুলি এখন গেল কোথায়! তারা নিশ্চিত ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। কিন্তু তাদের ড্রেসগুলো নিশ্চই আছে। প্লাটফর্মে গিয়ে পুরনো স্টেশন মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করলেই আগের কুলি ও কুলির ড্রেস মিলতে পারে। কুলি পেশায় আপনাকে দেখার সম্ভাবনা আছে নাকি? আর তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
দেব জ্যোতি ভক্ত : সব পেশায় দ্যাখা যাবে। কুলি পেশাটা এখনো টিকে আছে। তবে কয়েকটা পেশা একেবারেই বিলুপ্তির পথে৷ যেমন - ডুব দিয়ে পুকুর বা নদী থেকে প্রয়োজনীয় হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র খুঁজে দেওয়া। আমি ছোটবেলায় এই পেশা দেখছি। কিংবা নৌকার গুন টানা। একটা রশি বাঁধা থাকতো নৌকার সাথে৷ আর নদীর পাড় দিয়ে একজন/দুইজন বা আরও কয়েকজন মিলে সেই দড়ি টানতো।
মেউ : আচ্ছা। আমি কিছুদিন আগেও ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে দূরের একটা স্টেশনে গেলাম, চা খেতে গেছিলাম, আর ট্রেন থেকে চারপাশ কেমন লাগে দেখতে৷ স্টেশনে ছিলামও অনেকক্ষণ। কুলি খুঁজলাম, পাইলাম না। হয়ত বড় স্টেশনে আছে, যেমন, লাকলাম, কমলাপুর।
দেব জ্যোতি ভক্ত : হুম। আমার যতোটুকু মনে হয় - বড়ো স্টেশনে আছে সম্ভবত। এছাড়া লঞ্চেও আছে কুলি।
মেউ : হ্যাঁ, ডুব দিয়ে জিনিসপত্র তালাশের পেশাটা হারিয়েই গেল, সেজন্যই বোধ হয় আল মাহমুদের মায়ের সোনার নোলক আর খুঁজে পাওয়া যায় নি—দেশের ভাবমূর্তিগত জায়গা থেকেও এই পেশাটা গায়েব?
দেব জ্যোতি ভক্ত : না বোধহয়। আবার হতেও পারে.. হাহাহা
মেউ : জটিল প্রশ্ন। বুদ্ধিজীবীরা জানবেন।
দেব জ্যোতি ভক্ত : অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমার অসীম ভালোবাসা৷ তারা আমাকে সার্কাস না দ্যাখার অনুভূতির অন্যরকম স্বাদ দেন।
মেউ : সার্কাস কি?
দেব জ্যোতি ভক্ত : ছোটবেলায় দেখতাম.. সার্কাস খেলা হইতো। আপনি নিশ্চয়ই জানেন৷
মেউ : হা হা। আচ্ছা। আপনি ফেসবুকে প্রচুর কন্টেন্ট সৃষ্টি করেন, এর মধ্যে ভিডিও আছে এক ধরনের, ভয়েস মেলান এবং অভিনয় করেন, এর প্রচুর নারী দর্শক রয়েছে। কারণ কি?
দেব জ্যোতি ভক্ত : কারণ যে কি তা আমি জানি না। আমার প্রচুর জানার ঘাটতি আছে। এই জানার ঘাটতি আমাকে আনন্দ দেয়৷ যা কিছু বেশি জানার চেষ্টা করেছি বা যা কিছু বেশি জেনেছি সেগুলোর অধিকাংশই আমাকে প্রচুর অস্বস্তি দিছে।
মেউ : আপনার এমনও ফ্যান আছে, আমাকে ইনবক্স করে, দেব জ্যোতিকে কীভাবে চেনেন? আমি বলি, সে তো 'জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা' কমিটির সময় থেকে! না বুঝেই হেসে চলে যায়। আমি কি নামটা ঠিক বললাম?
দেব জ্যোতি ভক্ত : নামটা ভুল হইছে। কমিটিটা ছিলো - জাতীয় স্বাস্থ্য সচেতন কমিটি। হাহাহাহাহা। কি দুর্দান্ত এক ব্যাপার ছিলো।
মেউ : হ্যাঁ, আপনিই ঠিক। এই বিষয়ে সবাইকে বিস্তারিত জানানোর জায়গা এটা না, পরে কখনো জানাব। দুর্দান্ত। জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিছে সেই সময়টা।
এসব এক্টিভিটির মাখামাখিতে আপনার কবি পরিচয়টা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এই দেশে এখন কবিপরিচয় ব্যাপারটা কেমন? একবাক্যে যদি বলেন?
দেব জ্যোতি ভক্ত : এদেশে কবিপরিচয় ব্যাপারটা ক্যামন তা না বলি? বরং আগের প্রসঙ্গ থেকে একটা কথা বলি - জীবনের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম, হতাশ হয়ে গেছিলাম তখন কি যেনো এক জাদু শিখলাম আমরা; আমি, আপনি আর নির্ঝর। দ্যাখা গ্যালো তখন জীবন আমাদের পিছনে ছুটতেছে। এটা কবিতা, গল্প বা অন্য যেকোনো কিছু থেকে ছোট কিছু না। কেউ না বুঝলেও এটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝেন বা ফিল করেন।
মেউ : ঠিক। জীবন যাপন করতে পারাই বড় শিল্প! আর্ট করতে গিয়ে জীবনটাতেই আর আঁটে না কোনো কোনো মানুষ।
আপনি কয়েক বছর আগে আমাকে কক্সবাজারের সি বীচের একটা রিসোর্টে থাকা অবস্থায় টেকনাফ থেকে আসবেন বলে আর আসেন নি। আমি বিশ্বস্ত অর্থে মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলাম।
ব্যাপারটা কি ইলুয়েশন ছিল, না সত্যি? বাংলাদেশে যৌবনের বিশ্বস্ততা আসলে কি জিনিস?
দেব জ্যোতি ভক্ত : হাহাহা.. আমি আসবো বলেও যে আসবো না এটা তো আমার কাছ থেকেই আপনি পাবেন। সে অধিকার আমার আছে। আবার আমি আসবো না বলেও যে আসবো, সেটাও আপনি জানেন। আমি এজন্য কখনও দুঃখিত বলবো না। তবে এটা সত্যি আমি আসার হালকা একটু চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারি নাই। হালকা চেষ্টায় অনেক কিছুই সম্ভব না।
আর বাংলাদেশে যৌবনের বিশ্বস্ততা কি জিনিস তা আমি জানি না। আমারে এতো জটিল প্রশ্ন ক্যান করতেছেন? আপনি তো জানেন, আমি এসব জটিল ব্যাপার জানি না।
মেউ : আপনি অনেক জটিল বিষয় সহজ করে বলেন। স্যাটায়ার করেন। সেজন্য বলা। সহজ ও স্যাটায়ার আমি কম পারি। যৌবনের ভারি ভারি বস্তা আমার কাঁধে। কিন্তু আপনি মুক্ত এসব থেকে। অথবা যুক্ত। যৌবন, কারো জন্য তপোবন, কারো জন্য লবণ! দেখা যাক, আমাদের যৌবন কেমন কাটে! ভালো থাকবেন ভাই। ধন্যবাদ আমাকে সময় দেওয়ার জন্য। ভালো থাকবেন।
দেব জ্যোতি ভক্ত : আপনিও ভালো থাকবেন। যদি বেঁচে থাকি আমি আর আপনি দুজনেই তাহলে বুড়ো বয়সে আবার একসাথে কিছুদিন থাকবো৷
মেউ : অনেক ইচ্ছা আমার। আশাকরি।
ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ
অন্যপ্রান্তে: দেব জ্যোতি ভক্ত কবি ও পপুলার কনটেন্ট ক্রিয়েটর। জন্ম গোপালগঞ্জ, শৈশব গ্রামে কাটলেও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘মানুষের মত একা’ (২০১৮) ও গল্পের বই ‘পাশের বাসার ভাবি’ (২০২০)।
ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ
লেখক পরিচিতি:
![]() |
মেহেদী উল্লাহ (জন্ম:১৯৮৯) |
0 মন্তব্যসমূহ