bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

ঈশ্বরের চোখ : আদিপাঠ

কুলদা রায়ের গদ্য: জলের মধ্যে লেখাজোখা: পর্ব ১০

ঈশ্বরের চোখ: আদিপাঠ

আমার ঠাকুরদা একজন ব্যর্থ মানুষ। পৃথিবীতে ব্যর্থ মানুষের গল্পই বেশি। ব্যর্থ মানুষের আঙুল কাটা।

ঠাকুরদা থাকত রাস্তার পাশে একটি পুরানো গোয়াল ঘরে। গরু ছিল না বলে এটা হল গুদাম ঘর। গোবর আর গোচনার গন্ধ ভেসে বেড়াত। আর ছিল একটা বড় দাস মাছি। ওর ছিল পুঞ্জাক্ষী। ঘাড় না ঘুরিয়েও চারিদিক দেখতে পেত।

ঠাকুরদা আর দাস মাছিটি এক সঙ্গে চেয়ে থাকত দোতলা বাড়িটির দিকে। বাড়িটির রং নেই। ছাদ ভাঙা। জল পড়ত বৃষ্টির দিনে। কার্নিশে বেড়ে উঠেছে বটগাছ।

একদিন জানতে চাইলাম, কী দ্যাখো দাদু?

ঠাকুরদা কোন উত্তর দেয়নি। আমার ছোটখাট ঠাকুরদা, হালকা পাতলা নিভৃতচারী মানুষটি- আমার ডান হাতটি ধরল। তার হাতটি থরথর করে কাঁপছে। মুখটি বিষন্ন । চোখ দুটো স্থির।

ঠাকুরদা দেখাল- একটা পথের রেখা, হু হু প্রান্তর, আর অনন্ত আকাশ। জলের মধ্যে হাত রেখে বলল, টের পাচ্ছিস?

জলের মধ্যে আরো জল। মাছ। কচুরিপানা। আর বিপুল ঢেউরাশি। ওপারে ধানক্ষেত। রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা। মেঘগুলো দাঁড়িয়ে থাকে না। উড়ে যায়। ঝরে পড়ে। আবার উড়ে আসে।

একটি গাছের দিকে চেয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছিস?

পাতার পরে পাতা। ফুল ফুটেছে। ফল ধরেছে। একটি পাখি উড়ে এসে বসেছে। লেজ নাচাচ্ছে। আরেকটি পাখি উড়ে যাচ্ছে বহুদুরে। তার ডানা নড়ছে। বীজ লেগে আছে ঠোঁটের উপর।

মাটির উপরে পাটখড়ি দিয়ে ঠাকুরদা লিখে দেখালেন, অ।

আমি বললাম, অ।

ঠাকুরদা বলল, স্বরে অ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো। ইনি অজর। প্রতিদিনের। চিরকালের। পুরনো কাল থেকে ভেসে এসেছে। ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। একে হত্যা করা যায় না। ইনি কখনো মারা যান না।

আমার ঠাকুরদা কিন্তু মারা গেল। সেদিন ছিল ভোরবেলা। শান্ত বাতাস। ডালুপিসির মা বলল, ওরে, উনি তোদের দিন দিয়ে গেছেন। আহা, কী দিন।

ওঁ অদ্য নো দেব সবিতঃ

প্রজাবৎ সাবী সৌভাগম্ৎ ।

পরা- দুঃস্বপ্নং সুব।।

হে দেব সবিতাঃ! তুমি সর্ব-প্রসবকারী, প্রসব কর আমাদের জন্য পুত্র পৌত্রাদি সৌভাগ্য ,বিদুরিত কর দুঃস্বপ্ন-দুঃখদুরিতপূর্ণ দুর্ভাগ্য ; প্রদান কর পরম সৌভাগ্য; প্রেমভক্তি, যেন মায়া মোহে আমরা অভিভূত না হই।

এই রকম কোন একদিন সুর্য উঠছে সবিতৃদেব হয়ে। আর তখন দাদা আমি আমার বোনেরা মায়ের হাত ধরে নেমে এসেছি অই পুরনো বাড়িটির দোতলা থেকে। দোতলার কার্নিশে সর্বপ্রসবকারী এই সূর্য ঝুলে থাকলেন। তিনি অভিভূত। গুদাম ঘরটি আমাদের ঘর। ঠাকুরদার নড়বড়ে তক্তপোষটি বাবার তক্তপোষ। শুয়ে শুয়ে বাবা চেয়ে থাকে- নির্মল আকাশের দিকে। বাবা খুব তাড়াতাড়ি ঠাকুরদা হয়ে গেল।

বাবার হাতের মধ্যে কৌশিকের হাত। গোহাটা পেরিয়ে কৌশিকের ঠাকুরদা নতুন একটি পথ খুঁজে বেড়ায়। শিরশির করে হাত কাঁপছে। কৌশিক বলে উঠল, কী দেখছ, দাদু।

একটি দীপ্যমান সূর্য উঠছে। মাথার উপরে পুত্র পৌত্রাদিক্রমে এসে গেছে। অন্ধকার সূর্যকে গিলে খাচ্ছে। মায়া হয়। হাহাকার জাগে। বাবা বলল, অন্ধকার। অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনা রে।

বাবা এই গভীর অন্ধকারের মধ্যে চলে গেল। নীরবে চলে গেল। কে তাকে ফেরাবে?

আমার দাদা বাবার মতই হাঁটে। পথে প্রান্তরে। আকাশে। বাতাসে। হাতের মধ্যে ফর ফর করে ওড়ে একটি খসখসে কাগজ। লেখা, মহামান্য আদালত এমত মনে করিতেছে যে- এই ভূমিতে যাহারা পুত্র পৌত্রাদিক্রমে বসবাস করিতেছে, ইহার প্রকৃত মালিক ক, খ, গ, ঘ, ঙ। ইহার উপরিস্থিত যে গ্রহটি নির্মিত আছে- উহা গবাদিপশুর বাটি বলিয়া বর্ণিত আছে। এই গবাদিপশুর মালিক ক, খ, গ, ঘ, ঙ।

-কী দেখছিস, দাদা?

-কিছুই না। কিছু দেখতে পাইনারে ভাই। অন্ধকারও না। সব শূন্য।

এইতো আমার গল্প। পুত্র পৌত্রাদিক্রমে পরিযায়ী পাখিমানবের গল্প। আর কি বলার আছে আমার!

কিছুতো বলতে হবে। বল রায়। কথা বল রায়।

অধীর আগ্রহে মেরী মাতোস আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঘরটি ছোট। সদাপ্রভু ঊর্দ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসি হাসি মুখ। বুকের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একটি পথ। বহুদূরে।

মেরী মাতোস বলল, তোমাদের টেগোর বলেছেন- মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। কেন পাপী হচ্ছ?

পাপ কী? পূণ্য কী? এ এক জটিল ধন্ধ হে ধর্মরাজ। তারপর যক্ষ বললেন, বার্তা কি? আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অতঃপর জলপান কর।

জনহীন মহাবনে স্বর্ণময়-পদ্মশোভিত সরোবরে তাঁর ভ্রাতারা প্রাণহীন নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে আছেন। ভ্রাতাদের গায়ে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নাই। ভূমিতে অন্য কারো পদচিহ্ন নাই।

যুধিষ্ঠির তখন দেখলেন, তালবৃক্ষের ন্যায় মহাকায় বিকটকার সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী এক যক্ষ বৃক্ষে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন, আমি বহুবার বারণ করেছিলাম। তথাপি তোমার ভ্রাতারা জলপান করতে গিয়েছিল। তাই তাদের মেরেছি। যুধিষ্ঠির, তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তারপর জলপান করো।

আগে ছিল এক পায়ে দাঁড়ানো বক পাখি। এখন ধর্মগুণে যক্ষ। মহাতেজা। কী করে কে জানে? ঝামেলা করে লাভ নেই। যুধিষ্ঠির বলল-

অস্মিন মহামোহময়ে কটাহে

সূর্যাগ্নিনা রাত্রিদিনেন্ধনেন।

মাসর্তুদর্বী পরেঘট্টনেন

ভূতানি কালঃ পচিতীতি বার্তা।

-এই মহামোহরূপ কটাহে কাল প্রাণিসমূহকে রান্না করছে। সূর্য তার অগ্নি। রাত্রিদিন তার ইন্ধন। মাস-ঋতু তার আলোড়নের দর্বী (হাতা/ খুন্তী)। এই বার্তা।

- আশ্চর্য কি?

প্রাণিগণ প্রত্যহ যমালয়ে যাচ্ছে। তথাপি অবশিষ্ট সকলে চিরজীবি হতে চায়। এর চেয়ে আর আশ্চর্য কি আছে?

- সুখী কে?

হে জলচর বক, যে লোক ঋণী ও প্রবাসি না হয়ে দিবসের অষ্টমভাগে (সন্ধ্যাকালে) শাক রন্ধন করে সেই সুখী।

আর বাকী সময়? হাওয়া খাও। হাওয়া গাও। হাওয়া বিলাও।

এই ধন্ধে পড়িয়া আমার প্রাণ উড়িয়া যায় হে যুধিষ্ঠির। তুমি ধর্মপুত্র। মাতা কুন্তীর অনুরোধে সাক্ষাৎ ধর্ম জন্মবীজ বুনে দিয়েছিল। আবার তোমার তাত বিদুর মৃত্যুকালে ধর্মে লীণ হয়ে গিয়েছিল। ধর্মের জয়ই সর্বত্র। মিছে কথা বলি কি করে। আমার স্ত্রী ম্যানহাটন থেকে ফিরে আমাকে একটি আপেল দিল। আমি জানি, এই আপেলটি সকালে নিয়েছিল ঘর থেকে। খায়নি। এখন আমাকে দিয়ে বলছে, খাও। আপেল নিষিদ্ধ ফল। ফলে- স্বর্গ হৈতে বিদায়। কোন স্বর্গ? ভুল স্বর্গ। সদিয়া খেতে খেতে বলে, রায়- কোথা হৈতে আনিয়াছ এই সুমিষ্ট আপেলটি?

-পরলোক।

-পর..লউক! সদিয়া খেতে খেতে হাসে। আজ খুব সুখী। বলে, গুড রায়। এই পর..লউক দেশটি তো ভাল। তোমার দ্যাশ? টিসু পেপারে মুখ মুছে বলে, এই দ্যাশে যাইতে পারিলে ভাল হৈত। যে দ্যাশে মাগনা আপেল ফ্রুইট পাওয়া যায় হেই দ্যাশে না যাইয়া পারা যায়?

সদিয়ার গার্বেজ ক্যানের উপরে বসি। যেতে যেতে সদিয়া বুড়ি একটি নাইজেরিয়ান গান ফেলে গেছে হাওয়ায়। বেশ বুঝতে পারি, কুন্টে কিন্টো ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে আছে। কয়েকটি শক্তহাত তাকে সাঁড়াশির মতো ধরে ফেলেছে। আঙুলগুলো সাদা। সে চলে যাচ্ছে সমুদ্রের ভিতর দিয়ে। এই সমুদের ঢেউগুলো মুক্ত । আর যে পাখিরা ওড়ে তাদের ধরে ফেলবার কেউ নেই। ওরা স্বাধীন। আর আমি চলে যাচ্ছি মানুষের মধ্যে দিয়ে। দাসের পৃথিবীতে। শেকড়চ্যুত। এই গান আমার মা আমাকে শুনিয়েছিল। আমার বউ শোনাচ্ছে তার ছেলেকে। তার বউ শোনাবে তার অনাগত ছেলেকে- মেয়েকে। হা ঈশ্বর, তোমার আপেলগুলোর কোনো দোষ নাই। সর্পতো মহৎ। দোষ অই বাসনার। কেন বাসনাবশে খাইলে হে মাতা হাওয়া। কেন তোমার শেকড় হারাইলে?

অ্যা মা রম ক্যাডুম্যাবে আইয়ামু ইয়া পোতা

অ্যা না মা চ ইনা ওবাদুম।

মানা এবে নিন্যা বো মিলি না অচিচি

ওহ, অনইয়া ইয়া বোজেলম অইয়াম

ইফা ব আকালাকাম*

এই শেকড়ের কথাটিই লিখলাম। একটি একটি অক্ষরে। পূর্ণ একটি বাক্যে। পূর্ণ একটি জলে। পূর্ণ একটি কান্নায়।

দূর সম্পর্কের মেঘ অথবা বোন শকুন্তলা লিখল, সাহিত্যের জায়গাটি আপনার নয়। ওটা কালিদাসের। আপনি কেন এখানে এসেছেন? দেখেছেন- কতবড় সিঁড়ি।

সত্যিই তো। অনেক বড় সিঁড়ি। ধাপে ধাপে উঠে গেছে কৈলাসে। স্বর্গের দরোজায়। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কালা পাহাড় আর ধলা পাহাড়। গেলেই পান করে আর জানতে চায়, তোমার গেট পাস আছে? তুমি কোন দলের? কোন মালের?

কী কাণ্ড। আমারতো স্বর্গ বলে কোন ব্যাপার নেই। আমার মাতামহ আমার মাতামহীর অনুরোধে আপেল গিলেছিল। স্বর্গ থাকে কি করে? আমার কি দরকার এইসব বাতেনি সিঁড়িতে পা রেখে?

বাতেনি সিঁড়িতে পা রাখার অনেক আগেই আমার ঠাকুরমা দ্রৌপদী সহসা ভূপতিত হলেন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তাকে জয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন চিরযৌবনা। এ কারণে পঞ্চভ্রাতাকে খাদ্য দেহ দানে মুগ্ধ রাখতে হয়েছে। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা কোনও অধর্মাচরণ করেননি। তবে কেন তিনি সিঁড়িতে উঠতে পারলেন না? ঠাকুরদা যুধিষ্ঠির বললেন, অর্জুনের প্রতি এর বিশেষ পক্ষপাত ছিল। এখন তার ফলভোগ করছেন।

সহদেব, নকুল, অর্জুনও পথের উপরে ধুলোর ভিতরে পড়ে গেলেন। পড়ে ছটফট করতে করতে তাকিয়ে দেখল, স্বর্গের সিঁড়ি খুব খাড়া। ওখানে ওঠা খুব কঠিন।

একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন যুধিষ্ঠির, ভীম আর একটি লোহিত বর্ণের কুকুর। অনন্তর ভীম ভূপতিত হয়ে বললেন, মহারাজ, মহারাজ, দেখুন আমিও পড়ে গেছি। আমি আপনার প্রিয়। তবে আমার পতন হল কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি অত্যন্ত ভোজন করতে এবং অন্যের বল না জেনেই নিজ বলের গর্ব করতে। এই বলে যুধিষ্ঠির ভীমের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে অগ্রসর হলেন। একটি কুকুর তাঁর পিছনে চলল। তিনি স্বগের্র সিঁড়িতে একটি পা রাখলেন। কুকুরটিও লাফিয়ে উঠল সিঁড়িতে। যুধিষ্ঠির আরেকটি সিঁড়ি পার হলেন। কুকুরটিও তার সঙ্গী হল। স্বর্গের দরোজা দিয়ে ঢুকতে গেলে দারোয়ান কালাপাহাড় আর ধলা পাহাড় গ্লাসে চুমুক দিল। চোখ ঢুলু ঢুলু। বলল, তাত, তোমার লগে এইডা কে? যুধিষ্ঠির ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আমার আত্মার সঙ্গী।

যোগ্য সঙ্গী। হা হা হা। কালাপাহাড় আর ধলা পাহাড় হেসে কুটি কুটি। একদলা খৈনি মুখে পুরে বলল, এই হালায় দেখছি পশুমেহনকারী। অরে নরকের দরোজাডা দেহাইয়া দে।

ধর্মরাজ নরকে যাবে? তাও একা একা। অবস্থা ভয়ংকর। তাইলে ধর্মরাজ হৈয়া কী লাভ হৈল হে কেশব। তখন কুকুরটি আপন রূপ পরিবর্তন করিয়া ধর্মদেব হৈলেন। তিনি অতি গুরুগম্ভীর এবং লাবণ্যময় হৈলেও কিছুটা বিষণ্ন। ধর্মের সূক্ষ তত্ব ব্যাখায় অতি চিন্তাহেতু তিনি পুরাতন অম্বল রোগী। থেকে থেকে তার হিক্কা ওঠে। আর গ্যাসবায়ু নির্গত হয়। সর্বগ্রাসী খিদে পায়। খিদে পেলে তার নখদন্ত বের হয়। ধর্ম আর ধর্ম থাকে না। খ্যাপা কুকুর হয়ে যায়। কুকুররূপ ধারণ করে ঘুরে বেড়ায়। আর কুন্তিকে খুঁজে বেড়ায়। কুন্তির গর্ভে তিনি যুধিষ্ঠিরের জন্মবীজ ঢেলেছিলেন। কুন্তিদের গর্ভে আরও ধর্মপুত্তর জন্মদানে ইচ্ছুক। এই ইচ্ছা এত প্রবল যে কুকুররূপ না হইয়া উপায় নাই। তিনি কুকুর নহেন- তিনি ধর্ম। তিনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ইললিগাল জন্মদাতা পিতা শ্রীমান ধর্ম। তাহার বংশদণ্ডটি দীর্ঘ। ছুরিকার মতো ধারাল। সর্বদা উষ্ণ। এবং তীর্যক। বীর্যবান। তিনি যুধিষ্ঠিরকে ঠেলে নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করিলেন। বলিলেন, ওহে গর্দভবৃন্দ, স্বর্গে একাকী যাওয়া যায় না। সদাসদরূপ কুকুর লাগে।

মহাভারতের কথা অতি মুল্যবান।

কুলদা রায় ভনে শুনে গুণবান।।

সৌতি বললেন, চরাচর গুরু হৃষীকেশ হরিকে নমস্কার করে আমি ব্যাসপোক্ত মহাভারতকথা আরম্ভ করছি। কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন। এখন অপর কবিরা বলছেন। আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। তারা বলছেন-

এখন এই কুকুরটি একটি কিশোরকে ঘেউ ঘেউ করিয়া বিরক্ত করিতেছিল। কিশোরটি মহাবনে একাকী ধনুর্বিদ্যা চর্চা করিতেছিলেন। তাহার মনোযোগ ছিন্ন হওয়ায় তিনি সাতটি তীর ছুঁড়িয়া মারিয়া উহার মুখটি সেলাই করিয়া দিলেন। কুকুরটির মুখে রা নাই। দেখিয়া অর্জুনের কম্প হৈল। তিনি গুরু দ্রোণাচার্যের মুখপানে তাকাইলেন। তাহার চেয়েও বীরের পয়দা হল কী করে? এটাতো কথা ছিল না, গুরু! তাইলে তো ধর্মযুদ্ধে জেতা যাবে না। ধর্মকথা মিথ্যা হৈয়া যায়!

দ্রোণাচার্য তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, কে তুমি?

-আমি একলব্য। নিষাদপুত্র। শুদ্র।

-অ, শুদ্র। নীচু জাত। ছোটলোক। হা হা হো হো করে হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে হাঁচতে হাঁচতে পঞ্চপাণ্ডব আর কৌরবপুত্রগণ বিষম খাইতে লাগিল। উহাতে মহাবনে মহাভুমিকম্প উপস্থিত হৈল। বনের পশুপক্ষি ভয়ে ছুটিয়া পলাইল। আর সমুদ্রে দীর্ঘ ঢেউ জাগিয়া উঠিল।

-হু। বৎস। তোমার তুল্য যোদ্ধা এ ভবে আর কেউ নাই। ইহা মানিতেছি। তোমার গুরু কেডা?

একলব্য তাহার বামপাশের ঝোপজঙ্গল সরাইয়া একটি মৃন্ময়মুর্তি বাহির করিলেন। যুধিষ্ঠিরাদি চমকাইয়া উঠিলেন। সমস্বরে কহিয়া উঠিল, গুরু দ্রোণাচার্য! আপনি? ছোটলোকদিগকে বিদ্যাশিক্ষা দিতেছেন? ছি ছি ছি। আমাগো নুন খাইয়া আমাগো লগে নাফরমানী- বেঈমানী?

দ্রোণাচার্য আসলে ব্রাহ্মণ। তবে নাপিতও হৈতে পারেন। কোন কিছুই ঠিক নাহি। নাপিতের বুদ্ধি অতি চমৎকার। তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন, খামোশ!

সবাই শান্ত হৈল। তিনি জিজ্ঞাসিলেন, ওকে, গাই। ওয়েলডান। এইবার তুমি আমারে গুরু দক্ষিণা দাও।

- বলুন, আপনি কী চান।

-তোমার আঙুল। তোমার বুড়ো আঙুল। কাচকলাটি- বুঝলে।

ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির অবিচল রহিলেন। অবিচল তাহাকে থাকিতে হয়। কেননা ধর্মের তত্ব অতিশয় সূক্ষ এবং জটিল। একজনের কাছে যাহা পূণ্য- তাহা অন্যের কাছে পাপ। সুতরাং পূণ্য কী? পাপ কী?

এই জটিল রহস্যকথা ভাবিতে ভাবিতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির দেখিলেন, অতি ছোটলোকের পুত্র একলব্য তাহার বুড়ো আঙুল কাটিয়া গুরু দ্রোণাচার্যের পায়ের কাছে রাখিলেন। কাটা আঙুলটি লাফাইতে লাগিল। আর অর্জুন তাহা হাতে নিয়ে নাড়িয়া চাড়িয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলেন- ইহাতে কোনো যাদু আছে কিনা। একলব্য ধনুর্বান ফেলিয়া গভীর বনের ভিতরে চলিয়া গেল। তাহার আঙুল হইতে দরদর করিয়া রক্ত ঝরিতেছে। তাহাকে আর কোনদিন দেখা যায় নাই। তিনি আউট। পুরাণকথা হৈতে চিরকালের জন্য আউট। ধর্মকথা ইন। ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী। অথঃ মহাভরতের কথা আপাতত সমাপ্ত।

এই লগে একজন স্বখ্যাত পরিযায়ী কবির কাছে একটি অভিজ্ঞানতুল্য অঙ্গুরীয়সহ পত্র গেল, এই কুলদা রায় লোকটি খুব খারাপ। অতিশয় শুদ্র। সে চান্স পাইলে মহাভারত লেখে। বেদমন্ত্র পাঠের পরে বাইবেল পড়ে। কত্তোবড় বেত্তমিজ! উহার জন্য মহামুনি কৌটিল্য শাস্ত্রে গীত করিয়াছেন- শুদ্রের কানে সিসা ঢালিয়া দাও যদি সে বেদমন্ত্র পাঠে আগ্রহ দেখায়। তাকে আমি ঘৃণা করি। শাস্ত্রে আমার শ্রদ্ধা অবিচল হে ভ্রাতঃ। শাস্ত্রবিহীন কিছু নাই। শাস্ত্রই গেটপাস।

হা হা হা। কে কার ঘৃণার জন্য অপেক্ষা করে? কে কার করুণার জন্য অপেক্ষা করে। ভালবাসার জন্য অপেক্ষা করে?

মেরী মাতোস বলল, তোমাকে ভালবাসে এমন কে কে আছে এই চরাচরে রায়?

-আমার স্ত্রী। আমার কন্যাদ্বয়।

মাতোস আমার সঙ্গে ঘুরছে। আর কি সব বলছে। আর কি সব নোট করছে। রাস্তা পেরিয়ে পার্কে ঢুকেছি। পাতাগুলো সবুজ থেকে এখন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। হাওয়ায় ঝরে ঝরে পড়ছে। শীত আসছে।

-গুড। রায়, এই পার্ক তোমাকে ভালবাসে না?

আমি পার্কের গাছগুলোর বাঁকলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। প্রাণ বুঝতে পারি। এই আমার ভাই গাছ- অই আমার বোন গাছ।

-আর এই পুকুরটি?

-আমার মা। আমার মা-ইতো এই পুকুরটি।

-আর এই পার্কের হলুদ হাওয়া?

-আমার বাবা।

-আর মাথার উপরের আকাশ?

-আমার ঠাকুরদা।

মেরী মাতোস পড়িলেন, ইশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি; আর তাহার, সমুদ্রের মৎস্যদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুগণের উপরে, সমস্ত পৃথিবীর উপরে, ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় সরীসৃপের উপরে কর্ত্তৃত্ব করুক। পরে ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্ত্তিতে মনুষ্য সৃষ্টি করিলেন; ইশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহাকে সৃষ্টি করিলেন; পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। সোহম। আমিই তিনি। তিনিই আমি।

গার্বেজ ক্যানের উপরে বসে আমি এই তারই কথা লিখছি। একটি শব্দ লিখি। আরেকটি শব্দ এসে এসে যায়। একটি পূর্ণ বাক্য হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে ঈশ্বরের মানুষ। ঘরবাড়ি। বাগান। সর্পগন্ধ্যা। না-মৃত্যু। জলতরঙ্গ।

তরঙ্গ থেকে একটি ব্যাঙ উঠে আসে। পাশে এসে বসে। তার গা থেকে সোনার আলো বেরোয়। কোনো এক পাখি উড়ে আসে। তার জল থেকে হীরের দ্যূতি ঠিকরে পড়ে। কোন এক ফুলদল ফুটে ওঠে প্রাণের ভিতরে। ছায়ায় ছায়ায় সুগন্ধি।

আর শত শত দেবদূত আমাকে ঘিরে গাইছে গান। শান্ত হাওয়া করছে একদল পরী। আমি যেন তাদের ছোট ভাইটি। আলাভোলা। গরীব। সে কেবল গরীবই থাকতে চায়। আর চায় শুধু ঈশ্বরের দুটো চোখ। আর কিছু নয়। স্নিগ্ধ। শীতল। প্রাণদায়ী।

আর সব মিথ্যে। মিথ্যে। মিথ্যে। ব্যর্থতার অন্য নামইতো মিথ্যে। আমার ঠাকুরদা একজন ব্যর্থ মানুষ। ব্যর্থ মানুষেরা আঙুল কাটে। গল্প বলে।

আঙুল কাটিয়া কলম বানাইলাম

চক্ষে জল কালি

পাঁজর কাটিয়া লেখন লেখিয়া

পাঠাই বন্ধুর বাড়ি রে,

-আমি আগে জানি নাই।


এ বেলেম ইমবো আকাম, ওয়েমে ইফি এডেমেডে

অনায়া ইমমিলিমবু এডেমেডে অজি,

ওবিম না এটিওয়া এটিওয়া

ইনজি টালু জি লেটে

-ওহ অনায়া ইনফুলুনায়া ইলমাভো ইয়া

..............................................................................

* পবিত্র বাইবেলের প্রাচীন বাংলা অনুবাদটি আমাকে দিয়েছেন আমার অগ্রজা ক্রিস্টনা রোজারিও। আর মহাভারতের অংশটি রাজশেখর বসু মহাশয়কৃত। গানটি কবি জসীমউদ্দিনের সোজনবাদিয়ার ঘাট থেকে উদ্ধৃত। এটা একটা মুর্শিদা গান। নাইজেরিয়ান ইবো ভাষার গানটি আমার প্রাণের বান্ধবী জেনিফার বলেছে। (*কখন সূর্য উঠবে আমি জানি না/ আমি চেষ্টা করছি তীরে পৌঁছাতে/ চারিদদিকে শুধু জল আর অন্ধকার/ কে আমাকে নিয়ে যাবে বান্ধবের কাছে/ হা কপাল আমার...)

-------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি:

কুলদা রায়: জন্ম ১৯৬৫ খৃস্টাব্দ

কুলদা রায় কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। জন্ম বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ময়মনসিংহ) থেকে পড়াশোনা করেছেন। থাকেন আমেরিকার নিউইয়র্কে। কথাসাহিত্যের ওয়েবম্যাগ গল্পপাঠের প্রধান সম্পাদক।

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য গল্প (২০২০); বৃষ্টি চিহ্নিত জল (২০১৫); কাঠপাতার ঘর (২০১৩); কাকমানুষের চকখড়ি (২০১০)। প্রবন্ধ গ্রন্থ: রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি ও অন্যান্য বিতর্ক (২০১৫)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ