হাসান আজিজুল হক
এখন নির্দয় শীতকাল,
ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল
গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায়, একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির
টিনের চাল হিম ঝক ঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে
দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে। হঠাৎ তখন স্কুলের খোয়ার রাস্তার দুই পাশের বনবাদাড় আর
ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ থেকে হু-ই-উ চিৎকার ওঠে।
ঈশেন কোণ থেকে ধর ধর লে লে শব্দ আসে, অন্ধকার--ভূত অন্ধকার কেঁপে কেঁপে ওঠে, চাঁদের আলো আবার ঝিলিক দেয় টিনের চালে। গঞ্জের রাস্তার ওপর উঠে আসে
ডাকু শিয়ালটা মুখে মুরগি নিয়ে। ডানা ঝামরে মুমূর্ষু মুরগি ছায়া ফেলে পথে,
নেকড়ের মতো ছায়া পড়ে শিয়ালটারও, চাঁদের
দিকে মুখ তুলে চায় সে, রাস্তা পেরোয় ভেবেচিন্তে,
তারপর স্কুলের রাস্তার বাদাড়ে ঢোকে। হাতে লাঠি চাঁদ, মণির বাড়ির লোক ঠ্যাঙাড়ের দলের মতো হল্লা করে রাস্তায় পড়ে, কোনদিকি গেল শালার শিয়েল, কোনদিকি ক দিনি।
আরো হিম নামে।
বড় পুলের ওপর থেকে নিচের পানিতে আপন ছায়া দেখতে চায় সরদারদের
ছোট তরফের বড় ছেলে ইনাম। পানির রুপোলি মেঝেয় হাতড়ে বেড়ায় নাক-মুখ। হিম নামে
যে শব্দ করে, বাতাস
আসে শিরশির, খড়মড় উড়ে যায় বাদাম খোলা। খাদের
আসশ্যাওড়ার পাতা থেকে আলো চলকে ওঠে, কাঁঠাল গাছের
পুবদিকের ডাল হাত নাড়িয়ে ডাকতেই থাকে বিচ্ছিরি। অজস্র খঞ্জনি বেজে ওঠে ঝনঝন।
ইনাম পুল ছেড়ে ধুলো ভেঙে শুকনো বিলের কিনারায় দাঁড়ায়। সেখানে
শঙ্খচূড়ের মতো দেখায় যে ধবল পথটা এখন তা ত্রস্ত হয়ে এলো, ফেকুর বাঘের মতো শরীরটা দেখা গেল, তার পেছনে সুহাস। ওরা খুব গল্প করছে। যে জন্যে এখানে এখন, এত রাতে, সে সম্বন্ধে কোনো কথা নেই। কখন সুহাস
ছোট মামার বিয়ের বরযাত্রী গিয়েছিল, অমৃতের মতো পুরী
খেয়েছিল আর অঢেল মিষ্টি সেই গল্প। ট্রানজিস্টারটা বেজেই যাচ্ছিল ফেকুর বগলে,
ওরা কেউ শুনছিল না, কণিকা বিলের
কিনারায় দারুণ ঠাণ্ডায় বৃথাই গাইছিলেন অন্ধকারে একা থাকার যন্ত্রণা। বিনিয়ে
বিনিয়ে। আর আশ্চর্য, একটা পাখিও ডাকছিল না। রেডিওডা বন্দ
করে দে--ওদের দেখে ইনাম বলল। অসহ্য লাগছিল তার। আইছিস--দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা দুজন।
সুহাস হাসল, বিড়ির ধোঁয়ায় কালো দাঁতগুলো প্রায় মুখের
বাইরে চলে এলো। ইনামের আবার অসহ্য লাগল। রেডিওডা বন্দ করে দে--বলল সে। কেউ শোনপে
না, শোনলেও এদিকি আসবেনানে কেউ, ফেকু
বল। সেজন্যি বলতেছি না, খারাপ লাগতেছি গানডা। কণিকার গলা
টিপে দিল ফেকু। এখন চল, দেরি করলি ঘুমোয়ে পড়বেনে আবার,
ফেকু বলল আর ট্রানজিস্টারটা সুহাসের হাতে দিল। সেটা নিতে নিতে
সুহাস প্রশ্ন করে, কেডা? বুড়োটা,
আবার কেডা! সন্ধে হলি ঘুমিয়ে পড়বে বুড়ো--থু করে থুথু ফেলে বলে
ফেকু।
যেতে যেতে বাতাস বেড়ে গেল একটু--ফাঁকা বিল থেকেই আসছিল বাতাসটা।
শুকনো পাতার শব্দ হচ্ছিল। ঝপ করে মাছ লাফিয়ে উঠল কাজীদের পুকুরে আর বেড়ার ফাঁক
দিয়ে দেখা গেল খাঁদের বাড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে উঠোনে। উনুনের আগুন দপ করে জ্বলে
উঠলে খাঁদের সুন্দর সুন্দর মেয়েদের মুখ একবারের জন্যে ঝলসে উঠল। ইস্কুলি যাতিছিস
না আজকাল? সুহাস
জিগগেস করে। না--ইনাম জবাব দেয়। পড়বি না আর? না,
পড়লি আমারে কেউ শিনি্ন দেবে ক! চাকরি করবি। হয়, চাকরি গাছে ফলতিছে! সুহাস আর কিছু বলে না। ট্রানজিস্টারটা নিয়ে খুচরো
শব্দ করে শুধু আর বেঢপ বুটজুতো দিয়ে ধুলো ছড়ায়। নাকে ধুলো এসে লাগতেই রুখু গন্ধ
পাওয়া যায়। ইনামের বিকেলের কথা মনে পড়ে, হাটবারের কথা,
মাছের কথা। মাছ থেকে নদী। নদী এখন প্রায় শুকনো, চড়া পড়ে গেছে। গরুর গাড়িতে লোকে বালি আনছে নদী থেকে। বাঁকের কাছে
কাশ হয়েছে। এ পাড়ে স্কুলবাড়ি, বড় সজনে গাছে ফিঙে,
তার লম্বা লেজের দুলুনি। স্কুলের পেটাঘড়ি ভেঙে গেলে এক টুকরো
রেল ঝুলিয়ে লোহার ডাণ্ডায় ঘনাৎ ঘনাৎ আওয়াজ--হুড়মুড় করে হেডমাস্টার...শালার
জোকার একডা, বই-বগলে মাস্টার তারাপদ, তার পাকানো চাদর, আধভাঙা দাঁত আর মুখে কথার
ফেনা। এই সব মনে পড়ল। ঝরঝর করে ছবিগুলো এলো; যেন দক্ষিণ
বাতাসে নিমের হলুদ শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে, আর ছবিগুলো চলে
গেল যেন ট্রেনটা যাচ্ছে পুল পেরিয়ে, মাঠের বুক চিরে আর
ন্যাংটো ছেলেটা দাঁড়িয়ে দেখল। ছবিগুলো পেরিয়ে যেতেই খেয়াল হয় সুহাস সেই
গল্পটা আরো তোরজোড় করে বলছে, ছোট মামার বিয়ের বরযাত্রী
যাবার গল্প। ওর একটা কথাও শুনছে না ফেকু, সে দাঁড়িয়ে
পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। চাঁদের আলোর মধ্যে দেশলাই-এর আগুনটা দেখাল
ম্যাড়মেড়ে আর ফেকুর বিতিকিচ্ছি মুখটা দেখা গেল, কপালের
কাটা দাগটা, মুরগির মতো চোখ, নিচে
ঝোলানো ঘোড়ার মতো কালো ঠোঁট। খাবি নাহি? ফেকু জিগগেস
করে। সুহাস গল্প থামিয়ে সিগারেট নেয়, দেশলাই-এর কাঠিটা
নিভে যাওয়ায় আর একটা জ্বালায়, তারপর আবার গল্প শুরু
করে, লঞ্চে যাতি হয় তো, মধুমতী
নদী দিয়ে--অন্ধকারের মধ্যি গেলাম--দু পাশে গেরাম না কি কিডা জানে--মনে হচ্ছিল
সোন্দরবন। এমন অন্ধকার আর এমন জোঙ্গল বুজিচো? ইনামের মনে
হলো সুহাস গতকাল থেকে গল্পটা বলছে আর আগামীকাল পর্যন্ত বলবে। নাপিত বিটা কমিয়ে
কতি পারে না? একেবারে অসহ্য লাগলে এই কথা ভাবল ইনাম।
সুহাসের গল্পে এক শটা পল্লব--ছোট মামার চেহারার বর্ণনা, বিয়ের
সম্বন্ধ, পাত্রীর খোঁজ, পাত্রীর
কাকার সঙ্গে ছোট মামার বাবার ঝাগড়া, বিয়ের দিন
ধোপাবাড়ি থেকে সিল্কের পাঞ্জাবি ভাড়া নিয়ে আসার ঝকমারি--কিচ্ছু বাদ দিচ্ছিল না
সে--তাই ইনাম খেপে গিয়ে বলল, তোর ছোট মামা বিয়ে করতি
গিলো ক্যানো ক তো? সুহাস কান দিল না; সকালে সূর্য উঠতি মধুমতী ঝকঝক করতিছে, জ্যাঠামশাই
ধপ করে কাদায় পড়িল লঞ্চ থেকে নামতি গিয়ে আর মামির বোনেরা যা সোন্দর সে আর কলাম
না। তোর মামার বাড়িটা কোয়ানে, মামার শালীরা বেড়াতি
আসলি কস আমাকে--ফেকু কথা না বললেই নয়, তাই বলে। সেটি
হচ্ছে না, বুজিচো--চোখ বন্ধ করে মনের আরামে বলল সুহাস। ও,
তাই তুমি মাসে পাঁচবার করে ছোট মামার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতি যাচ্ছো?
বুজিচি, ওখেনে তো পয়সাকড়ি লাগে না;
আরামেই আছো দেহা যায়--ফেকু চোখ মটকে বলে।
রাহাত খানের টিনের চাল দেখা যাচ্ছে না আর, পুল কোথায়, বিল সরে
গেছে কখন। চাঁদমণির বাড়ির লোকজন চুপ করে গেছে। একটা মুরগির শোক আর কতক্ষণ থাকে!
কাল হয়তো বসু বাবুদের ইটখোলায়, না হয় সরকারদের
পোড়োবাড়ির ভেঙে-পড়া সিঁড়িঘরের মধ্যে বেচারির চকচকে পালক, হলদে ঠ্যাং কিংবা ঠোঁটের টুকরো পাওয়া যাবে। চাঁদমণির বাড়ির লোকজন
কাজেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু বুড়িটা বসে আছে, ফাটা
পায়ে তেল ঢালছে আর পিদিমটা কেন নিভছে না তা পিদিমটা ছাড়া আর কেউ জানে না। কী
ঠাণ্ডারে বাবা--বউ অ বউ, আর একটা খ্যাঁতা দে, মরে গেলাম, হেই বউ। বউটা কুম্ভকর্ণের ঘুম
ঘুমোচ্ছে, ছেলেটা বকছে বিড়বিড় করে, মরে যাচ্ছে না ক্যানো, কেডা জানে! বুড়ি আর
একবার চেঁচায়, কিন্তু হঠাৎ হাওয়াটা ওঠে, সুমসাম শব্দ জাগে, বুড়ির কাঁপা গলা কেউ শুনতে
পায় না। এই রকম জীবন চলতে থাকে। ফেকু ঠোঁটে কুলুপ দেয়, সুহাস
হঠাৎ ট্রানজিস্টারের চাবিটা ঘট করে খুলেই বন্ধ করে, ইনাম মাথা
নিচু করে ভাবতে থাকে।
রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ওপর পা ঠুকে ধুলো ঝাড়ে ওরা। পাশের গলি-পথটায়
ঢোকার সাথে সাথে জাপটে ধরে অন্ধকার আর সপাং করে চাবুক চালিয়ে দেয় কী একটা লতা।
ফেকুর ঠোঁট খোলে, জঘন্য
একটি গাল দিয়ে ওঠে লতাটিকে। তারপর শান্ত হয়ে গল্প শুরু করে, শালা, আজকাল এত বেশি ধরা পড়তিছি ক্যানো কতি
পারিস? এই কথায় সুহাসের চোখ দুটি চকচক করছে কৌতূহলে,
একটা কথা কই, কিছু কবি না ক? ফেকুর সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই সে বলে, অত
মার খাস কী করে, আমাকে বলতি পারিস? শালার দাদা এক চড় মারলি চোহে অন্ধকার দেহি। মার খাওয়াডা শিখতি অয়,
বুঝিচো বাপধনু--ওস্তাদের কাছে শিখতি অয়। লেহাপড়ার জন্যি
ইস্কুলি যাতি অয় যেমন, তেমনি--ফেকু বলে। ইনামের আবার
অসহ্য লাগে, ইস্কুলি লেহাপড়া বিয়োচ্ছে, বিটার শালার মাস্টাররা--ইনাম এমন কথা বলে যা মুদ্রণযোগ্য নয়। ফেকু তখন
বলছে, ইস্টুপিড হলি আর মার খাতি না জানলি মানুষের পহেটের
কাছে যাতি নেই, পহেটথে--ট্যাহা বারোয়ে থাকলিও না। টাকার
কথা শুনে ইনাম অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ল। টেণ্ডু ড্রাইভারের কথা শুনে একবার ভিড়ে
হাত দিয়েছিল বটিমুখো এক ভদ্রলোকের পকেটে। কাগজ খড়মড় করে উঠল আর এমন শব্দ উঠল যে
মনে হলো, কানে তালা লেগে যাচ্ছে। অ্যাও বলে গড়র গড়র
গর্জন করে উঠল লোকটা। কিন্তু আসলে ভদ্রলোক গলা ঝাড়ছিল। কাজেই ইনামের কাছে পয়সা
নেই। নারকেল চুরি করে বিক্রি করলে হয়; কিন্তু ভাতের
চালের অভাবে উপোস করে থাকতে বড়ো কষ্ট।
পথটায় অন্ধকার থকথক করছে। মাথার ওপর বাঁ দিকের লতা ডান দিকে চলে
গেছে জাল বুনতে বুনতে। গল্পের ঝোঁকে ফেকু সুহাসের ওপর এসে পড়ে আর সুহাস চিৎকার
করে, উরে, মরিছিরে বাপ। ফেকু বলে, দেহিস, রেডিওডা ফালাস না।...সেদিন কী হলো ক দিনি, এক
বাস লোক--বাস যাচ্ছে চলি্লশ মাইল পঞ্চাশ মাইল স্পিডি, সামনের
লোকটার পাঞ্জাবির পহেটথে নোটগুলো বারোয়ে আছে--হাত দিতি খপ্ করে ধরে ফেলল। তারপর
উরে মারে, ভাগাড়ে যেন গরু পড়িছে! কপালের ঘা শুকোয়নি
এহনও। এইবার গুণ্ডোটা শুরু করিছে--ইনাম ভাবল। গল্প শুনতে শুনতে সুহাস
ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দেয়, গর্জন করে ওঠে সেটা।
আওয়াজটা কিম্ভূত শোনা যায় ঠাণ্ডা আর স্তব্ধ অন্ধকারে। সুহাস থু-থু ফেলে বলে,
শালা খ্যাল গাতিছে--বলেই চাবি বন্ধ করে এবং 'তুমি যে আমার জীবনে এসেছ' ধরে দেয়। ভিটে থেকে
একটা কুকুর উঠে এসেছে--ক্ষীণ চিৎকার করার চেষ্টা করছে। গলা যখন ফুটল না, ইনামের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সমস্ত পাছাটা দোলাতে শুরু করে। নড়েচড়ে গরম
হতিছ শালা--ফেকু মন্তব্য করল এবং কেন তার জীবন নষ্ট হলো, কে
কে নষ্ট করল আর পকেট মারার কৌশল, তার নিজস্ব নৈপুণ্য,
সাফল্য আর পিটুনি খাওয়ার অভিজ্ঞতা বলেই যেতে লাগল। করবটা কী কতি
পারিস? লেহাপড়া শিখলি না হয়--। লেহাপড়ার মুহি
পেচ্ছাপ--ইনাম বলল। আবার অসহ্য লাগল ওর। তা হলি--ফেকু ভেবেচিন্তে বলল, উঁচো জায়গায় দাঁড়োয়ে সবির ওপর পেচ্ছাপ। কাজ কোয়ানে? জমি নেই খাঁটি, ট্যাহা নেই ব্যবসা করি--কী
কলাডা করবানে?
পাখিদের কোনো গান নেই এখন। শব্দ যা শোনা যাচ্ছে চাপা। কুয়াশা আর
হিম জড়িয়ে আছে ওদের। সামনে বিড়ালটা যখন পার হয়ে গেল, শুধু দুটি জ্বলজ্বলে চোখ দেখা গেল তার। সুহাস
ফেকু ইনাম কথা বন্ধ করেছে। সুহাসের বগলে ট্রানজিস্টার, ফেকু
মাফলার মুখের ওপর জড়িয়ে নিল, ইনাম হাতে হাত ঘষে একটু
গরম করতে চেষ্টা করল। ডাইনে পালদের বাড়ি, মাটির
হাঁড়িকুড়ি তৈরি করে, পরিচয় জিগগেস করলে রাস্তা থেকে
হেঁকে জবাব দেয়, পালমশাই; তাদের
বাড়ির পলেস্তারা--খসা দেয়াল, কারণ বাড়িটা আসলে সেনদের।
ওরা চলে গেছে পঞ্চাশে। বাতাবিলেবু গাছটার পাশ দিয়ে যেতে চড়াৎ করে একটা পাতা
ছেঁড়ে ইনাম আর ঠাণ্ডা উঠোনটার দিকে চেয়ে থাকে। পোড়ামাটির গন্ধ নাকে লাগে,
কালো জ্বালাগুলো ছড়িয়ে আছে দেখা যায়, ভাঙা দরজায় ফাঁক দিয়ে ঘুম-জড়ানো গোঙানি ভেসে আসে। সব ঘুমোয়ে
পড়িছি--সুহাস বলে। ফেকু সায় দেয় ঘোঁৎ করে। আজ না আসলিই হতো--সুহাস অভিযোগ করতে
থাকে, ভয় করতিছে আমার। ফেকু ভ্যাংচায়, ভয় করতিছে, কচি ছ্যামরা, দুধু খাবা! সুহাস বলেই চলে, বুড়োরে দেখলি
আমার ভয় করে। একবার মনে হয় মরে যাবেনে এহুনি, একবার মনে
হয় আমাদের সব কডারে খুন করবেনে। বাড়ির মধ্যি ঢোহার সময় মুখডা দেহিছিস? দেহিছি--তুই থো, তাচ্ছিল্য করে ফেকু, পয়সা পালি মুখডা কেমন হয় দেহিস একবার। ফেকু হারামজাদাটারে খুন করতি
পারলি হতো--ইনাম ভাবল। তখুনি সুহাস ফেকুর দলে মিশল। সে বলছে, এট্টু এট্টু সর হইছে এমন ডাবের মতো লাগে মেয়েডারে। ঠিক কইছি না,
ক? তোরও খুন করতি পারলি হতো--ইনাম আবার
ভাবল।
ওরা এখন হাসাহাসি করছে,
ঢলাঢলি করছে, কলবল করে আলাপ করছে। দু পা
এগিয়ে ভেতরে ডাক্তার বাবু বসে আছেন--মোটা শাদা বিরাট শরীর, হারিকেন জ্বলছে, তাই খোলা দরজা দিয়ে দেখা
গেল। পুকুরের বাঁধাঘাটে একটি মাত্র শুকনো পাতা তখন ফরফর পাক দিতে থাকল। বাঁদিকের
খোলা জায়গাটা এসে গেছে, কুয়াশার সঙ্গে মিশে ঘোলা দুধের
মতো চাঁদের আলো খুদে খুদে মরা ঘাসের ওপর পড়েছে। পেছনের জামগাছটা কালো, তার পেছনে সব কালো এবং নির্জনতা। আর এই সব ছাড়িয়ে যেতে আরো নির্জনতা,
পোড়োজমি, জঙ্গল, পানের বরজ, কাশ আর লম্বা ঘাস আর মজা পুকুর আর
বিল। এখন ডাইনে দড়ি দিয়ে ঝোলানো বাঁশের গেট। গেট পেরিয়ে খানিকটা ফাঁকা জমি চিত
হয়ে শুয়ে। কিছুই ফলেনি সেখানে। ইনাম পেছনে আছে, অনেকটা
পেছনে, এমনকি ফিরে যেতে পারে হঠাৎ এমন মনে হচ্ছে। লাল আলো
আসছে কাঠের রড লাগানো জানলা দিয়ে। মজা পুকুরে শিয়ালের চকচকে চোখে ঝিলিক। ঘোড়ার
মতো চিঁহি চিঁহি করে ডেকে ডানা ঝটপট করে পুরনো ডাল ভেঙে বাজপাখিটা নড়েচড়ে বসল।
ফেকু দড়ি ঝোলানো বাঁশগুলো তুলে ধরেছে, হাত নেড়ে ডাকছে
সুহাসকে, সুহাস ট্রানজিস্টারটা হাতে নিয়ে অন্য হাতে ঠোঁট
চেপে আছে, কিছুতেই এগোচ্ছে না। ইনাম চট করে সামনে এসে
ফেকুর কাছে টাকা চায়, দুডো ট্যাহা দে--কাল দিয়ে দেবানে।
বাঁশগুলো ছেড়ে দেয় ফেকু, অ, খালি
হাতে মজা মারতি আইছ? মুহূর্তে সোনালি হাত সামনের
আবছায়ায় ভেসে ওঠে। সেই হাত মাথায় রাখে। চুল সমান করে দেয়। আঙুলে তেল লাগলে
আঁচলে মোছে। ইনাম নিজে কিনে দিলেও মিলের শাড়িটা খুলে নেয়া যায় না তখন। ব্যাকুল
হয়ে ইনাম বলে, দুডো ট্যাহা দে, কাল
দেবানে সত্যি কচ্ছি। ট্যাহা লাফাচ্ছে, মোডে দুডো ট্যাহাই
আছে আমার কাছে--ফেকুর মুলোর মতো দাঁতগুলো কড়মড় করে ওঠে। তাহলি সুহাস দে--দে
সুহাস কচ্ছি, কাল দিয়ে দেবানে, ঠিক
কচ্ছি, দে সুহাস, তোদের মা কালীর
দিব্যি, কাল দিয়ে দেবানে--ছটফট করে ইনাম। সুহাস বলে
ফেকুকে, কিছু কয়নি এতক্ষণ, কেমন
গুডি গুডি আসতিছিল দেহিছিস? উরে তুই কি ইস্টুপিড--সে হাসে,
মাইরি কচ্ছি, পহেটে হাত দিয়ে
দ্যাখ--দুডো ট্যাহা আছে মোডে, দাদার পহেটথে মারিছি,
মাত্তর দুডো ট্যাহা। তখন ইনাম ক্ষান্ত হয়। গেটের কাছে ফেকু আর
সুহাস গলাগলি দাঁড়িয়ে। জানলার কাঠের রডে মুখ লাগিয়ে বুড়োমানুষ চিৎকার করে,
কে, কে ওখানে গো--অ্যাঁ? লাল আলোটা সরে যায় জানলা থেকে, হড়াম করে
দরজা খোলে, হাতে হারিকেন নিয়ে খোলা জায়গা পেরিয়ে গেটের
কাছে আসে মানুষটা। সমস্ত উঠোনটায় বিরাট ছায়া, খাটো
লুঙ্গির নিচে শুকনো দুটো পা। গেটের পাশে করবী গাছটার কাছে এসে দাঁড়ায়। আলোটা
মুখের কাছে তুলে ধরে লোকটা। বোশেখ মাসের তাপে মাটিতে যেন ফাটলের আঁকিবুঁকি এমনই ওর
মুখ। ঠাণ্ডা চোখে ইনামকে দ্যাখে, সুহাসকে দ্যাখে, ফেকুকে দ্যাখে, দেখতেই থাকে, বিঁধতেই থাকে, হারিকেনের বাতিটা তোলে কাঁপা
হাতে, এসো। তোমরা? ভাবলাম কে
আসছে এত রাতে! তা কে আর আসছে এখানে মরতে? জেগেই তো ছিলাম।
ঘুম হয় না মোটেই--ইচ্ছে করলেই কি আর ঘুমানো যায়--তার একটা বয়েস আছে--
অজস্র কথা বলতে থাকে সে,
মানে হয় না, বাজে কথা বকবক করেই যায়।
এসো, বড্ড ঠাণ্ডা হে, ভেতরে এসো।
কিন্তু ভেতরে কি ঠাণ্ডা নেই? একই রকম, একই রকম। দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর-বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে। সবাই
ভিতরে আসতে করবী গাছটায় একটা ডাল ঝটকানি দেয়--পায়ের নিচে মাটি ঠাণ্ডা শক্ত আর
সে জন্য ইনামের গোড়ালিতে ব্যথা করছে।
ভিতরে কালো রঙের চৌকিটা পড়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মুরগিগুলো কঁ কঁ করে
উঠল। আবার হু-উ-উ চিৎকার এলো। বিলে বাতাস উঠছে শোনা গেল। ভাঙা চেয়ারে ভদ্রলোকটি
বসে। হারিকেন মাটিতে নামানো। ওরা তিনজন চৌকিতে কাছাকাছি বসেছে। কেউ কথা বলছে না।
বুড়োর অ্যাজমার কষ্টের নিঃশ্বাস পড়ছে। তুখোড় লোকটা এখন চুপ-ভস ভস বাতাস ছাড়ছে
মুখ দিয়ে। খোঁচা-খোঁচা শাদা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। শিরাওঠা আঙুলগুলো চেয়ারের হাতলে
পড়ে আছে। নোংরা নখ দীর্ঘদিন কাটা নেই। গলার কাছে শ্লেষ্মা এসে জমলে বাতাস
যাওয়া-আসা প্রায় বন্ধ হয়ে এলো। ইনামের ইচ্ছে হলো একটা নল দিয়ে সাফ করে দেয়
ফুটোটা। তারপর কী খবর? অ্যাঁ?
সব ভালো তো? ঘড়ঘড় করে একটানা কথা
আরম্ভ হয়। আক্ষেপ বিলাপ, মরে গেলেই তো হয় এখন, কী বলো তোমরা? টক করে মরে গেলাম, ধরো। তার পরে? আমার আর কী--ড্যাং ড্যাড্যাং
ড্যাং, চলে গেলাম, বুঝে মরগে তুই
বুড়ি--ছানাপোনা নিয়ে বুঝে মরগে।... এই তোমরা একটু-আধটু আসো, যখন তখন এসে খোঁজখবর নাও। সময় অসময় নেই বাবা তোমাদের। তোমরাই ভরসা,
আমার পরিবার তোমাদের কথা বলতে অজ্ঞান। ফেকু ভয় পেয়ে গেছে এখন।
বুড়োর মুখের দিকে বারবার চেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে আর সিঁটিয়ে যাচ্ছে। সুহাস
চোখ দুটো গোল গোল করে চেয়ে আছে। বুড়োর মুখ এখন বহুরূপী। সুহাস ভাবছে, বুড়োটা খুন করবেনে মনে হতিছে আমার। আজ ক্যানো যে আলাম! না আসলিই ভালো
হতো।... তোমরা না থাকলে না খেয়ে মরতি হতো এই জঙ্গুলে জায়গায়--বুড়ো বলছে,
বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আবার আমাদের কম্ম--হ্যাঃ। ওসব
তোমরা জানো। আমরা শুকনো দেশের লোক, বুইঝলে না? সব সেখানে অন্যরকম, ভাবধারাই আলাদা আমাদের।
এখানে না খেয়ে মারা যেতাম তোমরা না থাকলে বাবারা! ছেলেমেয়েগুলো তোমাদের কী ভালোই
না বাসে! এই দ্যাখো না, বড় মেয়েটা, রুকু এখন চা করতে যাচ্ছে তোমাদের জন্যে--একটা শ্লেষ্মার দলা
শ্বাসনালিটাকে একবারে স্তব্ধ করে দেয়, তাতে চোখ কপালে
তুলে বুড়ো কাশছে। কথার খই ফুটছিল অথচ এখন মরে যাবে নাকি? আমরা চা খাব না, আমরা চা খাব না--চিৎকার করে
ওঠে সুহাস আর ফেকু। খাবে না? বুড়ো সামলে নিয়ে শান্তভাবে
বলে, অ, ঠিক আছে। তাহলে তোমরা
এখন চা খাবে না--অ্যাঁ--আচ্ছা, ঠিক আছে।
বিল থেকে বাতাসটা উঠে আসছে। এখন অশ্বত্থগাছটার মাথায় ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, এগিয়ে
আসছে, খঞ্জনির বাজনাও এগিয়ে এলো সঙ্গে, খোলের চাঁটি আর কী বিশাখার কথা, কী তমালের
কথা--সব এসে আবার দূরে চলে গেল। সুহাসের চাদরের মধ্যে নোট খড়মড় করে। সেগুলো
নিয়ে ফেকু নিজের পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে, দলা
পাকায়, ভাবে, ভয় পায়, শেষে বুড়োর দিকে ঝুঁকে পড়ে, সুহাস আর আমি
দিচ্ছি।
চেয়ারের ওপর লোকটা ভয়ানক চমকে ওঠে। পড়ে যাবার মতো হয়। খটাখট
নড়ে পায়াগুলো, তোমরা
দিচ্ছ, তুমি আর সুহাস? দাও। আর
কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই-বা শুধতে পারব এই সব টাকা? সুহাস উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবে এখন? এত
তাড়াতাড়ি? রুকু রাগ করবে--চা করতে দিলে না ওকে। ওর
সঙ্গে দেখা না করে গেলে আর কোনোদিন কথা বলবে না। দাঁড়াও--হারিকেনটা রেখে বুড়ো
বেরিয়ে যায়। ছায়াটা ছোট হতে হতে এখন নেই। মুরগিগুলো আবার কঁ কঁ করে ওঠে,
কথা বলে ওঠে এক বৃদ্ধ স্ত্রীলোক। তীক্ষ্ন গালাগালি অন্ধকারকে
ফাড়ে, চুপ, চুপ, মাগি চুপ কর, কুত্তী--এবং সমস্ত চুপ করে যায়।
বুড়ো ফিরছে এখন--মাথা নামিয়ে কাঁধ ঝুলিয়ে ঘরে ফিরে এসে ফিস ফিস করে, যাও তোমরা, কথা বলে এসো, উই পাশের ঘরে। ইনাম তুমি বসো, একখুনি যাবে কেন?
এসো গল্প করি।
বুড়ো গল্প করছে, ভীষণ শীত করছে ওর, চাদরটা আগাগোড়া জড়িয়েও
লাভ নেই। শীত তবু মানে, শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে
না তাকে। আমি যখন এখানে এলাম, আমি যখন এখানে এলাম,
হাঁপাতে হাঁপাতে, কাঁপতে কাঁপতে সে বলছে,
বুঝলে, যখন এখানে এলাম...তার এখানে আসার
কথা আর কিছুতেই ফুরোচ্ছে না--সারা রাত ধরে সে বলছে, এখানে
যখন এলাম--আমি প্রথম একটা করবী গাছ লাগাই...তখন হু হু করে কে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর
ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ--সুহাস হাসছে হি হি হি--আমি একটা করবী
গাছ লাগাই, বুঝলে? বলে থামল
বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল,
ফুলের জন্যে নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ, করবী
ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। আবার হু হু ফোঁপানি এলো আর
এই কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে
যেতে থাকল বুড়োর মুখ--প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ আর ইনাম তেতো
তেতো--এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
![]() |
হাসান আজিজুল হক জন্ম: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ |
বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক। কৈশোর থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু হলেও ষাটের দশকে ‘শকুন’ ও ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হক শক্তিমান গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’(১৯৬৪)। উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ: আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭); জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭) এবং বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: আগুনপাখি (২০০৬); সাবিত্রি উপাখ্যান (২০১৩)। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের বই: কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১)।
0 মন্তব্যসমূহ