bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মৃদুল মাহবুব এর গদ্য ꘡ কবিতার ভবিষ্যৎ

মৃদুল মাহবুব

১.
এক চোরাপথের নাম কবিতা। কিংবা কবিতা জাদুকর সৃষ্ট এমন এক স্যুডো-রিয়াল পথ, যে পথে পথিক হারিয়ে যায় ক্ষণিকের তরে, তারপর ফিরে আসে, ফিরে এসে তার ভেতর সেই অদ্ভুত পথের কিছু স্মৃতি থেকেই যায়। কবিতা হলো মনের ভেতর, দেহের ভেতর, স্মৃতির ভেতর এক জার্নি। মানুষ নিজের ভেতর নিজে হাঁটতে থাকে। কবিতা বা শিল্প জন্ম নেয় দেহে, মন আর স্মৃতির ভেতর। বহু প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান, কৌশল, চিন্তা, প্রজ্ঞা স্মৃতির ভেতর জন্মে বেঁচে থাকে। আমাদের সব স্মৃতির বা তার সব অংশের ডিটেইল দরকার নেই। তবে মানুষের স্মৃতির ভেতরের রক্ষিত হাজারো উপাদানের প্রয়োজনীয় অংশটুকু মানবের চাহিদামতো তৈরি হয়ে সচেতনতার মধ্যে প্রকাশিত হয়। স্মৃতির সচেতন প্রকাশই হলো শিল্প, সাহিত্য। চিন্তা আর প্রজ্ঞার সুচিন্তিত প্রকাশই কবিতার পাটাতন। এরই ওপর ভর করে কবিতা বৃক্ষের ফুল, পাতা, কাণ্ড, সৌরভ, সৌন্দর্য। স্মৃতি তো দেহের ভেতর জন্ম নেওয়া আলো-অন্ধকার, ছায়া-ছায়া বোধ। এই বোধ আর স্মৃতির তলানিতে যে ভাষা-সৌরভ, অবশেষ- তা-ই বোধ হয় কবিতা, দেহের ভেতর এই পথে যা-কিছু এসে গোপনে প্রবেশ করে কবিতার মধ্যে, তাকে খুঁজে পেতে হলে পাঠকের ঋদ্ধ অনুসন্ধানের প্রয়োজন। কেননা কবিতা একইসঙ্গে ধারণ করে সমাজ, দর্শন, ভূগোল, প্রেম, অপ্রেমের উষ্ণতা, মানব মগজের অন্ধকার, প্রগতির উচ্ছ্বাস, সজ্জা, সামঞ্জস্য, অনুপাত, হারমোনি বা এর ঠিক উলটোটাও সে বহন করে আপন রক্তের লসিকায়। কবিতাকে দেখতে হয় সামগ্রিকতাকে দিয়ে। পুরো বিশ্বের সমান দুটো চোখে আর ব্রহ্মাণ্ডের মতো একটা মগজ নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে হয় পাঠককে। কবিতার বিচার-আচার পাঠকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ওপর সীমাবদ্ধ। এবং একইভাবে কবিতার উপস্থাপন কবি-দক্ষতার ওপর সমানুপাতিকভাবে নির্ভরশীল। এ কারণে কবি এবং পাঠকের আদান-প্রদান বেশ কঠিন এক মস্তিষ্ক-রসায়ন। কবিতার বর্ণিল উপাদান, এর রং-ঢং, সজীবতা যেমন ধারণ করতে হয়, কবিতা-পাঠককে তেমনি এই রং-তামাশার আলকেমি কবিকেও বেশ আয়ত্তে নিয়ে আসতে হয়। কবিতা সর্বদা এক দ্বিমুখী সীমান্তে দাঁড়ানো। কবি দক্ষতার সঙ্গে পাঠকের উপলব্ধি জ্ঞান এখানে সরাসরি জড়িত। কবি যা লিখবেন পাঠক হয়তো তা বুঝবেন না, কিন্তু অন্য কোনো উপলব্ধির আয়নার সামনে তিনি দাঁড়াবেন। এই দাঁড় করানোটাই মহৎ কবিতার লক্ষণ। কবি আর পাঠকের অনুভূতি ভিন্ন হতে পারে। কবি আর পাঠক আরো বেশি অন্তঃসম্পর্কযুক্ত আমাদের এই সময়ের কবিতায়। প্রকৃত পাঠক অনেক বেশি ম্যাচিউর, ফলে এখন আর সমস্ত লেখাই, যে-কোনো বাণীই আর কবিতা হয়ে উঠতে পারেনা। এটাই এ যুগের কবিতা-বাস্তবতা। নতুন কালের পাঠকের সুচেতনা অর্বাচীন লেখাপত্রকে কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। এই বৈরী হাওয়ায় বসে কবি যখন লিখতে বসেন তখন তাকে মাথায় সমস্ত কবিতার পথরেখার একটা ম্যাপ নিয়ে কলম ছোঁয়াতে হয় কাগজে। কারণ তাকে এমন এক ভূগোলের উন্মোচন করতে হয়, যা কিনা অপরিচিত, অযাচিত; তবে সহজ উপলব্ধ, কষ্ট-কল্পনাহীন। শব্দজটকে কবিতা বলা যাচ্ছে না আর। বিকল্প পথই কবিকে বাঁচিয়ে নেয়। আর কবিতাকে খারিজ করার দুঃসাহস পাঠককে নিতে হয়। দুঃসাহস! কেননা পাঠককে উত্তর তৈরি করতে হয় কেন তিনি কবিতাটি বর্জন করছেন। ভালো লাগার যুক্তি বরং সহজ, ভালো না লাগার যুক্তি বড়ো কঠিন এবং প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে এই দায় বোধহীন পাঠকের জন্য কবিতা আর নয় আজ, অন্তত আজকের কবিতা। সেই কারণে কবিতা কবি ও পাঠকের যৌথ ব্যবস্থা। বেলজিয়ামের দামি রুপার প্রলেপ লাগানো আয়নায় দৃশ্যমান আমরা ছায়ার জন্য কবিতা লিখি না। আমরা কবিতা লিখি একজন প্রজ্ঞাবান সজীব স্মৃতিমত্ত পাঠকের জন্য, যিনি দুনিয়ার শুধু দৃশ্য নয়, অদৃশ্যও দেখতে পারেন। ‍কবি ও পাঠকের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, পরিপূরক। কবিতা আসলে সমাজের জন্য লিখিত হয়। নিজের জন্য লেখাপত্র কবিতার ফর্মে লিখলেও তা জার্নালের বেশি কিছু নয়। ফল যেদিন হলুদ হয়ে ওঠে, পাকে, সুঘ্রাণ ছড়ায়, বৃক্ষ তা জানে না, শুধু বনের পাখি বুঝে নেয়।

২.
নতুন কবিতা আসলে ভুল ব্যাকরণেই লেখা হয়ে থাকে। তবে মহৎ কবিতায় এই ব্যাকরণগত কোনো ভুলের দেখা মেলে না। তা ব্যাকরণ আত্তীকরণে বাধ্য হয়। কবিতা তো মানবচিন্তা সংরক্ষণের আদিমতম উপায়। এখন পর্যন্ত মানুষের চিন্তা ও তার পরিচয়ের নির্যাস থাকে শিল্প, সাহিত্য, গানে। যে সময়ের কোনো শিল্প, সাহিত্য, গানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, সে সময়টাকে চিন্তাহীন সময় অর্থে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মানুষের দুই রকম নৃতত্ত্ব আছে। একটা জৈব মানুষ আর একটা মনযুক্ত মানুষ। যত দিন যাচ্ছে মানুষ জৈব দেহ থেকে অধিক মনসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠছে। যত দিন যায় মানুষে মানুষে মানবিক সম্পর্ক বাড়তে থাকে। ফলে মানুষ আরো বেশি চিন্তার দিকে অগ্রসরমান। ফলে যতদিন যাবে ততই কবিতার জন্ম হবে, শিল্প হবে, সুর আর গান হবে। যারা ভাবে দুনিয়ায় কবিতার দিন শেষ তারা আসলে কবিতার পুরোনো ফর্মুলেশনের মধ্যে আটকে গেছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বেও কবিতার ফর্মকে মান ধরে এই সময়ের কবিতা প্রত্যাশা করলে নতুন কবিতার দেখা তারা পাবে না। শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পের ক্লোন শিল্পের প্রত্যাশায় তাদের হতাশ দিন কাটবে। পূর্ববর্তী কবিতা থেকে আরো বেশি শার্প কবিতা রচিত হবে এই কালে। তাকে কবিতার সংরক্ষণবাদীরা ঠিকমতো নির্ণয় করতে পারবে না। কারণ পূর্ব শিল্পমন্দিরের দেবীর পূজা অর্চনা থেকে বের হতে না পারা। পুরোনো চিন্তা আর প্রতিষ্ঠিত সত্যের মধ্যে মানুষ থাকতে চায় নিজ গোষ্ঠীর প্রতি নিবেদিত থাকার জন্য। গোত্রচ্যুত না হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, হেজিমনি ও নিজ গোষ্ঠীর চিন্তাকে বজায় রাখার জন্য যে-কোন নতুন কবিতা প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তবে এগুলো কাজ করে না। নতুন কবিতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় শিল্পমন্দিরের পুরোহিত। ফলে লিখতে থাকুন কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করেই। কবিতার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সমুখে। মানুষ জৈব মানুষ থেকে যত মনের মানুষ হয়ে উঠবে ততই আমাদের অধিক কবিতা লাগবে সমাজের চিন্তাকে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য। কবিতা হলো সেই শিল্পমাধ্যম, যার ক্ষয় শক্ত পাথরে গড়া ভাস্কর্য থেকেও ধীর। পাঁচ হাজার বছর আগের সাহিত্য আপনি পাঠ করেন কীভাবে! দর্শন অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে এক কাল থেকে অন্য কালে। কবিতার দ্যুতি আরো উজ্জ্বল হয়। এমনই অক্ষয় শিল্পমাধ্যম কবিতা। কবিতা মাধ্যমে সংরক্ষিত চিন্তা যুগের পর যুগ টিকে থাকে, দেশের পর দেশ জয় করে সে। হোমারের কবিতা আরো কত দূর অব্দি টিকে থাকবে? ভাবুন।

চিন্তায় মৃতরা শিল্পের মান নির্ধারণ করে ফেলেছে। ফলে সেই মানের বাইরে কিছু তৈরি হয় না। তাদের মান বিগত এক শ বছরের কবিতার ইতিহাস দিয়ে নির্মিত। ফলে যা-কিছু বিগত এক শ বছরের ট্রেন্ডের সঙ্গে যায় না, তা শিল্প, সাহিত্য, কবিতা না তাদের শিল্পমিতিতে। শিল্প ভুবন তাদের কাছে নিস্তরঙ্গ শ্যাওলা আক্রান্ত দিঘি। যে-কোনো দিন শেষ হয়ে যাবে। তারা কবিতার শেষ হওয়া নিয়ে চিন্তিত, জীবন্মৃত। সবল মাধ্যম নিজেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করে করে অগ্রসর হয়। কবিতারও সেই পরিবর্তন অনিবার্য। চলছেই যুগের পর যুগ। নিজের পরিবর্তনের মাধ্যমে সে সভ্যতায় টিকে থাকে। কবিতাও নিজেকে বদলে নিয়েছে। যারা এই পরিবর্তনের পক্ষে তারাই লিখবে নতুন কবিতার প্রাণ। শিল্পের সজীব আত্মা তারাই বহন করে নিয়ে যাবে সামনের দিকে।

৩.
নানারকম কবিতাকে কি একজন পাঠক বা কবি গ্রহণে সক্ষম? গ্রহণ-বর্জন পাঠক-রুচিনির্ভর। কবিতা উপলব্ধি নিতান্তই পাঠকের ‘শিল্প-অভিজ্ঞতা’প্রসূত। শিল্প-অভিজ্ঞতা তাই, যার ভেতর দিয়ে একজন পাঠকের জন্ম হয়। পাঠক যা-কিছু পড়েছে, তিনি যে ট্রেন্ডের সঙ্গে আছেন, যে শিল্পের পোশাককে তিনি ফ্যাশন মনে করেন, তা-ই তিনি পড়তে চান, তাই তার শিল্পরুচি। কবি যে কবিতা লেখেন তা তার শিল্পরুচির বাইরের কিছু নয়। আর যিনি পাঠক তিনিও কবিতাটিকে নিজ রুচির মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারছেন বা পারছেন না। এ কারণে সকল কবিতা সর্বগামী নয়। পাঠকের সেগমেন্টেশন আছে। কবিদেরও পজিশনিং আছে। সবাই তো আর সবার জন্য পণ্য উৎপাদন করবে না। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের কিছু কিছু কমন ফ্যাক্টর থাকে। এই শিল্পরুচির ওভার-ল্যাপিং দিয়ে বহুলাংশ-গণ-গ্রহণযোগ্য শিল্প-ভাষা তৈরি হয়। যেমন ত্রিশের দশকের শিল্পরুচি। এটা একটা শিল্পচিন্তার ওভারল্যাপ্ট যুগ। কলোনি-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে এমন ভালো মাত্রার শিল্পরুচির পারস্পারিক সংযুক্ততা আর কোনো দিন হয় নি। মধ্যযুগের কবিতায় আপনি কিছু কিছু কমন ব্যাপার পাবেন, যা যুগকে শাসন করেছে। কিন্তু এরপর বাংলা কবিতার এমন রুচিগত জায়গার সম্মিলিত প্রয়াস আর দেখা যায় নি। সেই ওভারল্যাপ্ট যুগের সম্মিলিত সৃষ্টি জীবনানন্দ দাশ। তিনি তো সর্বধ্বংসী, সর্বমান্য। কেন? তার পরবর্তী সময়ে এমন ফিগার আর নেই কেন? ত্রিশের সময় কি জীবনানন্দকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল? তিনি ত্রিশের শেষের দিকে এসে গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করেছেন। কেন? ত্রিশের কবিরা সম্মিলিতভাবে পাঠককে কোন রুচির দিকে প্রস্তুত করলেন? জীবনানন্দের বাংলা কবিতায় ব্যাপ্ত হয়ে ওঠার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে বিষয়গুলো মাথায় রাখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রবলয়ের বাইরের তেমন কিছুর শিল্পরুচি সাধারণ বাঙালি পাঠকের ছিল কি? নাকি কলোনির কালে শিক্ষিত কবিতাভোক্তাদের কাব্য-রুচি ইউরোপের কবিতা ও চিন্তা দ্বারা নির্মিত? ত্রিশের দশকে বিপুল ইংরেজি পড়ুয়া একটা শ্রেণির বিকাশ হয়ে গেছে। তারা কীসের জারণ নিয়ে নিজেদের শিল্পবোধ তৈরি করেছেন? জীবনানন্দ তথা ত্রিশের অন্য কবিদের উত্থান ও তৎপরবর্তী সময়ে বাকি দশকগুলো কবিদের সেই একই যাত্রাপথে পরিচালিত হওয়ার একটা স্থুল বিচার হতে পারে।
যে পাঠকের ইলিয়ট পড়ার অভিজ্ঞতা নেই বা যার পশ্চিম ইউরোপীয় কবিতার টেস্ট নেই, এমনকি যাদের বাংলা কবিতার আবহমানতার সঙ্গে সংযোগ নেই, সেই পাঠক জীবনানন্দকে ধারণ করেন কীভাবে? শুধু জীবনানন্দের কবিতার স্বাদ আস্বাদনের জন্য পাঠক এত কিছুর প্রস্তুতি নিয়ে ‍নিল তিনি কবিতা লেখার পরপরই? তবে পাঠক গড়ে ওঠে কীভাবে? যে-কোনো একজন লেখকের জন্য পাঠক প্রস্তুত হয় না। শুধু আপনার লেখা উপলব্ধি করার জন্য পাঠক প্রস্তুত হয়ে গাদাফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা অতিপ্রত্যাশা। পাঠক ও তার রুচি এবং তার শিল্পবোধ একটা সম্মিলিত ব্যাপার। জীবনানন্দের কবিতার যে গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তার একক কাব্য সাফল্য ও প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠেনি, তা বলাই যায়। ত্রিশের কবিতাভোক্তারা মূলত ইংরেজি লিটারেচারে শিক্ষিত একটা শ্রেণি। ত্রিশের যে কবিতার ভাব তা তো আর ইউরোপের নতুন নয়। প্রচলিতই ছিল। বাংলা যাদের মাতৃভাষা, ইংরেজি যাদের প্রভুর ভাষা তারা মূলত প্রস্তুতই ছিল। বাংলা ভাষায় লিখিত প্রভুর ভাবে কবিতা ভালোভাবেই গৃহীত হলো সমাজে। তবে এই নতুনের অন্তর্ভুক্তিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এভাবেই মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সাহিত্য আগায়। কুয়ার ব্যাং হয়ে থাকার মতো নির্বুদ্ধিতা ত্রিশের কবিরা দেখাননি। তাদের দৃষ্টি ছিল বিশ্বজনীন। ত্রিশের বাংলা কবিতাকে বলা যায় ইন্দো-ইউরোপীয় শিল্পচিন্তার ফলাফল। সরাসরি ইউরোপীয় কবিতার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সেই একই মাপের ও ভাবের সম্পূরক বাংলা (ইন্দো-ইউরোপীয়) কবিতা ও তার উপলব্ধি তো ত্রিশের বাঙালি কবিদের হাতে উৎপন্ন হয়েছে। মূল ও মূলভাবে উৎপন্ন কবিতার রুচি পাঠককে শাসন করেছে। সরাসরি অনুবাদকে বাংলা কবিতা হিসেবে নিতে পারার মতো স্বদেশিকতা তাদের ছিল রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর কারণেই মনে হয়। ত্রিশ রবীন্দ্রবিরোধী হলেও ঠাকুরের স্বদেশপ্রেম তাদের কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে মনে হয়। ফলে ইউরোপের আদলে বাংলা কবিতা কাজ চালানোর মতো। এটাই শিল্পের পরিবর্তন। যারা মানতে পারেননি তারা হারিয়ে গেছেন কোথায়, কোন সুদূরে, কেউ তা জানে না। কবিতা, শিল্পের, সাহিত্যের একটা আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড চালু হয়ে গেল প্রবলভাবে। এই ট্রেনের ইঞ্জিন হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিও কম ইন্দো-ইউরোপিয়ান ক্ল্যাসিক কবিতা লেখেননি। ফলে ত্রিশের আগ থেকেই পাঠক প্রস্তুত ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাবে বাংলা অক্ষরের কবিতা পড়ার।

সহি ইলিয়ট না পড়েও আপনি বহু ইলিটীয় উপাদান দ্বারা বাংলা ভাষায় আটকে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ প্রত্যেকের ওপর ইউরোপীয় কবিতার ধারাবাহিকতা মুছে ফেলা যায় না। সেই কারণে পাঠক ইউরোপীয় কবিতার সরাসরি পাঠ না থাকলেও, ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিতা পড়ার জন্য তারা প্রস্তুতই ছিল। ইউরোপের সাহিত্য শুধু রোমান হরফে নয়, বাংলা বর্ণেও লেখা হয়েছে, হচ্ছে এখনো। তৎপরবর্তী সময় এবং কবিতার ট্রেন্ড এর খুব বাইরে যায়নি। একা কোনো জীবনানন্দের জন্ম হতো না, যদি না ত্রিশের কবিতা নামক একটা সম্মিলিত বিষয় থাকত। প্রতিটি সময়ের একটা ট্রেন্ড থাকে, তার এক্সটেনশন থাকে। এই ধারাবাহিকতার বাইরের কবিতা ক্ষণজন্মা, সময়ে হারিয়ে যায়। পাঠক আর মনে রাখে না। পাঠক কী বিষয়ে শিক্ষিত, তার শিল্পবোধ কতটুকু, সে কোন সময়ে বসবাস করে, তার জীবনে কী প্রভাব ফেলে—সেটা জানা জরুরি কবিতার ট্রেন্ড জানার জন্য। পাঠককে জানা মানে নিজের কবিতাকেও জানা। কবিতার এই যে বিদেশি হয়ে ওঠা দোষের কিছু নয়। তবে, বাংলা কবিতার প্রবণতাটা জেনে রাখা দরকার।

কবির যে অনুভূত জগৎ, আত্মদৃষ্টি, ট্র্যাজিক মন তাই তাকে লিখতে বাধ্য করে। আত্মার লুমে যখন স্নায়ুর সুতোয় তৈরি হয় মনস্তত্ত্বের পরিধান, তখন সে কাব্য পোশাকের উজ্জ্বলতা নির্ভর করে তার নতুনত্বেরর ওপর, দৃঢ়তা নির্ভর করে উপকরণ বাছাইয়ের ওপর আর আয়ুষ্কাল নির্ভর করে কবি ও পাঠকের ‘শিল্প-অভিজ্ঞতা’র ওপর। নতুনত্ব, উপকরণ আর শিল্প-অভিজ্ঞতার বুননে তৈরি হয় কবিতার শরীর। আর যখন একে পাঠ করা হয়, শরীরের চোখ দিয়ে অনুভব করা হয়, দেহের ভেতর প্রবেশ করানো হয়, স্মৃতির সচেতনতায় উপলব্ধি করা হয়—তখনই জন্ম নেয় কবিতার। এটাকেই পাঠক উপভোগ করে, আনন্দ জেগে ওঠে। এর ভেতরের সব কারুকাজ। লিখিত শব্দমালা কবিতা হয়ে ওঠে। আর কিছুই থাকে না দৃশ্যমান তখন। কবিতা শেষ পর্যন্ত পাঠকগামী এক শিল্পমাধ্যম। তার শেষ গন্তব্য পাঠক। কবিতার কাছ থেকে পাঠক কিছু উত্তর আশা করে। আর তার এই প্রশ্নের ধরন নির্ভর করে তার ‘শিল্প-অভিজ্ঞতার’র ওপর। ফলে কবিতাকে বোঝার বা বোঝানোর যে বাসনা পাঠক এবং কবি উভয়ের পক্ষে থাকে তা নির্ভর করে দুজনের এই শিল্প-সন্ধির ওপর। যারা চর্চা করেন শিল্পের, যারা মেধাবী, রুচির শাসনহীন, বহু বৈচিত্র্য ধারণে সক্ষম তারাই ভাবীকালের পাঠক। শুধু তাদের জন্যই কবিতাশিল্প।

কবিতার যাত্রা সুদূরের পানে। মহৎ কবিতার ক্ষয় হয় না। নতুনভাবে সে জন্ম নেয় বারবার, যত দিন সভ্যতা আছে, মানুষের দেহ আর মন আছে। কবিতা জন্মের সমাপ্তি নেই। মহাবিশ্বের মত চক্রাকার, সদা সম্প্রসারণমাণ।

গ্রন্থসূত্র: কবিতাকলা ভবন শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক ব্যাবহারিক চিন্তা, প্রকাশক বৈভব, ঢাকা, প্রকাশকাল- ২০২০।

সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি:
মৃদুল মাহবুব (জন্ম ১৯৮৪)
কবি, গদ্যকার, চিন্তক, ক্রিটিক।
‘কবিতাকলা ভবন শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক ব্যাবহারিক চিন্তা’ শিরোনামে গদ্যের বই একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া প্রকাশিত কবিতার বই: উনমানুষের ভাষা (২০১৮); কাছিমের গ্রাম (২০১৬) ও জলপ্রিজমের গান (২০১০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ