bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মঈনুল আহসান সাবের এর গল্প ꘡ কাফকা আসবে

মঈনুল আহসান সাবের

আবদুল হাই গণির সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। তবে তাকে আমি চিনি। তাকে অবশ্য আমি শুধু এ-কারণেই চিনি যে, সে আছে। না থাকলে চিনতাম না, তাতে ক্ষতি ছিল না, একজন আবদুল হাই গনিকে না চিনলে কিছু এসে যায় না।

গনির কথা বলতে গেলে আমাকে অবশ্য কিছু কিছু ব্যাপার ধরে নিতে হবে, কারণ আমি তাকে অতটা চিনি না যে, ধরে না নিলে তার গল্পটা বলতে পারব। ধরা যাক গনি চাকরিজীবী। কারণ সে চাকরিজীবী হলেই সুবিধা। সে, বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও আমদানি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন মার্কেট ইন্সপেক্টরের একজন। তার কাজ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের কোন্ পণ্য বাজারে কী অবস্থায় আছে, তা যাচাই ও রিপোর্ট তৈরি করা। ধরে নেব গণির নিজের ধারণা এই কাজ সে বেশ ভালো করে, অফিস অবশ্য সেরকম মনে করে না। 

গণির পরিবারের কিছু কথা বলা যাক। তার অবশ্যই একজন স্ত্রী থাকবে। স্ত্রীর নাম একটা হলেই হলো, রানী, হ্যাঁ, রানীই। ছেলে-মেয়েও থাকা দরকার, এক ছেলে এক মেয়ে, তার নিজের নাম গণি হলে কী হবে, সে হয়তো মেয়ের নাম রেখেছে পূর্ণিমা পরী, ছেলের নাম রেখেছে অনন্ত আকাশ। আপাতত এটুকু জানলেই হবে, আবদুল হাই গণির চাকরি ও পরিবার সম্পর্কে পরে, পরে প্রয়োজন পড়লে আরও কিছু জেনে নেওয়া যাবে। তবে চাকরি ও পরিবারের পাশাপাশি মাহমুদ খসরুর কথা আসবে।

গণির দীর্ঘদিনের বন্ধু মাহমুদ খসরু। সেই কলেজজীবনে এই বন্ধুত্বের সূচনা। স্কুল বা কলেজ জীবনের প্রায় কোনো বন্ধুর সঙ্গেই গনির সম্পর্ক নেই, রাখা হয়নি, কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে তা-ই বা কে জানে, তবে এটাও-বা কে জানে কীভাবে, মাহমুদ খসরুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা থেকে গেছে। এ সম্পর্ক না-থাকলেই বরং বলা যেত--স্বাভাবিক। খসরু দেশের একজন নামকরা লেখক, সে ব্যস্ত থাকে, লেখালেখিতে তো বটেই, নানা অনুষ্ঠানেও, টেলিভিশনেও ঘনঘন তাকে যেতে হয়। ব্যস্ততার পাশাপাশি তার কিছু অহংকারও থাকতে পারে, আছেও হয়তো, তবে তা সে কখনো আবদুল হাই গণিকে দেখায়নি। বরং আমরা জানব বা ধরে নেব, গণি গেলে, ফোন না করে গেলেও, খসরু কিছু সময় তার জন্য বের করবেই। এটা কেন করে মাহমুদ খসরু, গণি তা জানে না, আমাদেরও জানার দরকার নেই।

এটা বেশ লাগে আবদুল হাই গণির, এই-যে মাহমুদ খসরু তাকে খাতির করে। হয়তো গেল সে খসরুর ওখানে, অফিস থেকে বের হয়ে, বা কোনো ছুটির বিকালে তার মনে হলো--যাই, একবার খসরুর ওখান থেকে ঘুরে আসি, ভাবল সে আর গেল, দেখল দুজন পত্রিকার লোক, দুজন প্রকাশক, টিভি-চ্যানেলের কোনো কর্মী বসে আছে, তাকে বসে থাকতে হয় না, সে যেন খসরুর স্টাডিরুমে চলে যেতে পারে। সেসময় আমরা দেখব, আবদুল হাই গণি স্বীকার করবে, বেশ লাগে তার। আমরা আরো দেখব, যেটা সে স্বীকার করবে না, সেটা এরকম-- মাহমুদ খসরুকে সে হিংসা করে। গণির যে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান, এই হিংসাটা প্রকট হতে পারত, এবং সেটাকে অযৌক্তিক বলা যেত না। সে এরকম ভাবতে পারত, আরে, একসঙ্গেই-না পড়তাম আমরা! ছাত্র হিসেবে কী এমন খারাপ ছিলাম, তুমি কী এমন তালেবর ছিলে! এখন গল্প লেখো উপন্যাস লেখো, নাটকও, আবার কবিতাও নাকি লিখতে পারো, আর খসখস করে ওসব দুচার পাতা লেখো, গুচ্ছের টাকা পাও, আবার নামও হয়। কী আশ্চর্য, টেবিলে বসে, মনে যা আসে লিখে ফেলা, এটাকে কেন কাজ বলা হবে! তবে আমরা জানব, আবদুল হাই গণি তার এই হিংসা সংযত রাখে, কখনই ডালপালা ছড়াতে দেয় না। সে বরং এই অহংকারই বড় করে রাখতে চায়--মাহমুদ খসরু তার বন্ধু। এই বন্ধুর কাছে গেলে, সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার, ফেরার সময় আবদুল হাই গণি বুঝতে পারে, সে অনেকটাই নির্ভার বোধ করছে। অর্থাৎ সে যদি কোনো অস্বস্তি নিয়ে যায় খসরুর কাছে, অস্বস্তি থাকেই কোনো-না-কোনো, খসরু নানাকথায় তার অনেকটাই দূর করে দেয়। এটা এত অনায়াসে কীভাবে করে খসরু, গণি বুঝতে পারে না। খসরু স্বান্তনার কথা বলে না, বরং এলোমেলো কথা বলে, একটা শেষ না-করেই আরেকটা, অদ্ভুত সব কথা, সেদিন যেমন, মাস দুই কি আড়াই আগে, গণি গেছে খসরুর বাসায়, গিয়ে দেখল খসরু টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বই পড়ছে, তাকে অসময়ে দেখে বিরক্ত হতে পারত, হলো না, বলল, গণি তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছ। আমি আমার প্রিয় লেখকের বই, আসলে প্রিয় লেখক না, প্রিয় এক বই বলা যায়, সেটা পড়ছি। আগেও পড়েছি। আরেকবার পড়ছি।

গণি বলল, তাইলে খসরু তোমার বিরক্ত হওয়ার কথা। তোমার প্রিয় লেখকের প্রিয় বই পড়ার সময় আমি আমি আসলে তুমি কেন খুশি হবা।

নাহ্, এটা ঠিকই আছে। তুমি গ্রেগরকে চেনো?

গেগর?

গেগর না গণি, গ্রেগর। এক সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তার কী মনে হলো জানো?

কী মনে হলো গ্রেগরের, আমরা এতক্ষণ যতদূর চিনেছি গনিকে, তা জানার খুব একটা ইচ্ছা তার হওয়ার কথা না। আবদুল হাই গণির উৎসাহ হলো না। এইসব বইপত্রের গালগল্প তার ভালো লাগে না, বানিয়ে বানিয়ে সব লেখা। তাছাড়া সে আসলে এসেছে অফিসের কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য। মাথার দুইধাপ ওপরে যে আছে, আবুল বাশার কারণে-অকারণে বড়ই জ্বালাচ্ছে।

সেসব কথা শুনে মাহমুদ খসরু বলল--গণি, এক কাজ তুমি করতেই পারো। তোমার পেছনে সবসময় লেগে আছে, না?

আর বইলো না।

এক কাজ করো, তুমি চাকরি ছেড়ে দাও।

চাকরি ছেড়ে দিব?

দেবে না কেন? এত সমস্যা নিয়ে চাকরির কী দরকার!

তারপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব?

ঘুরবে। অত কষ্টের চাকরি করার চেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা অনেক ভালো।

হুঁ। আছ তো আরামে, তাই বোঝো না। দুই লাইন লিখে দাও আর খামভর্তি টাকা আসে। করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা চাকরি!

সমস্যা কী জানো? লেখকদের কষ্টটা কেউ দেখে না।

তোমাদের কষ্ট! লিখলেই টাকা, লিখলেই পত্রিকায় ছবি ছাপা হওয়া, লিখলেই ভক্ত।

ভেতরের কষ্ট কেউ বোঝে না।...গণি, এই যে বইটা পড়ছি না, তুমি কি আন্দাজ করতে পারো, কী কষ্টে এক লেখক তার উপন্যাসের প্রথম লাইনটা লেখে এভাবে : 'One morning, when Gregor Samoa woke from troubled dreams, he found himself transformed in his bed into a horrible vermin'?


দুই
খসরুর বাসায় ওদিনের পর আর যাওয়া হয়নি। তবে এসময়ে, আমরা দেখব, আবদুল হাই গণির মাথায় কিছু এলোমেলো চিন্তা ভর করেছে। তার হঠাৎই এরকম মনে হতে আরম্ভ করেছে. অনেক দৌড়াদৌড়ি সে করেছে, এখন অবশ্যই তার কিছু বিশ্রাম দরকার। ঠিক আছে, পুরো বিশ্রামের কথা সে বলছে না। কিন্তু এই অফিসের কাজ আর কাগজপত্র নিয়েও সে এত এত জায়গায় ঘুরে বেড়াতে চায় না। অর্থাৎ গণির ব্যাপারটা আমরা দেখব এরকম : সে চাকরি করে যেতে চায় বটে, তবে সেটা অফিসে চেয়ারে বসে, তার মতে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে করা আরামের চাকরি। এতদিন ধরে সে মাঠে-মাঠে ঘুরছে, দেশের যেখানে যেখানে ওদের ডিলার আর এজেন্ট আছে, ঘুরেফিরে তাদের অনেকের কাছেই তাকে যেতে হয়, বিক্রির পরিমাণ জানতে হয়, কমবেশির পরিমাণ বুঝতে হয়, বিক্রি কম হলে কেন বিক্রি কম হচ্ছে তার একটা ব্যাখ্যা তৈরি করতে হয়--তারপর ফিরে এসে অফিসের রিপোর্ট পেশ এবং অধিকাংশ সময় জবাবদিহি। এসব কতদূর পর্যন্ত সহ্য হয়। ধরাবাঁধা দুটো কথা পেয়েছে অফিস--‘সেল ফল করল কেন’, কখনো কখনো আবার ‘মার্কেট কী বলছে’। আরে বাবা, সে কি জনে জনে গিয়ে পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে বলবে. ‘এই যে ভাই আমাদের জিনিস বেশি করে কিনুন দেখি’? আর মার্কেট কী বলছে, সেটা সেকী বুঝবে, সে কি ডাক্তার, মার্কেটের পালস ধরে বসে আছে?

আন্দাজ করে নেওয়াই যায়, আবদুল হাই গণি যখন এতই বিরক্ত, একথা সে একদিন সত্যিই অফিসে বলেছিল। সে বলেছিল--মার্কেট কী বলে, সেইটার আমি কী জানি?

কে জানে?

আপনারা লোক রাখেন।

আপনাকে রাখা হয়েছে।

আমি তো সব জেলা-উপজেলার রিপোর্ট আইনা দেই।

কিন্তু মার্কেট কী চায়, এইটা আপনি বলতে পারেন না।

আবদুল হাই গণি কী করে বলবে, মার্কেট কী চায়! মার্কেট কি তার কানে কানে এসে বলে যায় সে কী চায়? নাকি মার্কেটের শরীরে কান পেতে শোনাটা, কী চায় সে, শোনাটা তার চাকরির মধ্যে পড়ে? আবদুল হাই গণির কথা যখন লিখতে বসেছি, তখন আমার জানাই আছে এসব হচ্ছে তার দুঃখের জায়গা। সে কি অত অত পড়াশোনা করেছে নাকি, মার্কেট বুঝবে? অফিসে আছে না কয়েকজন, দামি জামাকাপড় পরে, টাই পরে, ইংরেজিতে কথা বলে, অনেক টাকা বেতন দিয়ে তাদের রাখা হয়েছে মার্কেট বোঝার জন্য, তারা বুঝুক। সে কি অত টাকা বেতন পায়, না সে অত কঠিন লেখাপড়া করেছে? মার্কেটের ভাব বোঝা তার কাজ না, অফিসের বুঝতে হবে।

সমস্যা হলো অফিস কিছুই বুঝছে না। তার যে বিশ্রাম দরকার, এই বোঝার ব্যাপারটা আসবে অনেক পরে, এর আগের ব্যাপারগুলো বোঝার পর। এই নিয়ে, আমরা দেখব, আবদুল হাই গণির খুব মনখারাপ। এই মনখারাপের পাশাপাশি ইদানীং অদ্ভুত কিছু সমস্যা হচ্ছে তার। এই দিনকয়েক আগেই হলো, আবদুল হাই গণি যখন ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকা পৌঁছার জন্য বাস-টার্মিনালে এসে পৌঁছল।

সেদিন কী হলো, গণি বাস-টার্মিনালে এসে পৌঁছাল বটে তবে পৌঁছেও ঠিক বুঝতে পারল না সে পৌঁছেছে কি না। তার একবার মনে হলো, না, সে পৌঁছেনি। আরেকবার সে ভাবল, সে হয়তো পৌঁছেছে। তৃতীয়বার তার মনে হলো, তার কিছু অংশ পৌঁছেছে, বাকি অংশ এখনো পৌঁছতে পারেনি। এই শেষ চিন্তাটাই, আবদুল হাই গণি দেখল, বেশ পোক্ত হয়ে বসছে। একসময় এমন হলো, গণি ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সে কী ফেলে এসেছে, তা খুঁজে বের করতে।

ব্যাগের দিকে তাকাল সে, তার ভেতর কী কী আছে, তাও সে মনে করার চেষ্টা করল, কিছু কি সে হোটেলে ফেলে এসেছে? না, সেরকম কিছুর কথা সে মনে করতে পারল না। রুম ছাড়ার আগে সে একবার, দুবার, তিনবার...বহুবার দেখে নেয়। একবার, বছর এক কি দেড় আগে, জরুরি একটা কাগজ সে ফেলে গিয়েছিল। তাই নিয়ে কী কথা যে তাকে শুনতে হয়েছিল! বাইরে থেকে ফিরে মার্কেটের কী অবস্থা, সে রিপোর্ট যার কাছে দিতে হয়, সেই বাশার সাহেব খুব লেখাপড়া-জানা লোক, চেহারাটাও বেশ নায়ক-নায়ক, কিন্তু মুখটা অবলীলায় বড় খারাপ। বলল : গণি সাহেব, কয় বছর ধইরা এই লাইনে আছেন, মানে যাওয়া-আসার মধ্যে।

নিজের ভুলটা গুরুতর, বুঝতে পেরে সে নিজেই তখন গোটানো, কাঁচুমাচু হয়ে বলল : স্যার, হলো তো...প্রথম থেকে...।

হলো আর কই। এখনো চক্ষু দুইটা পকেটে নিয়া ঘুরেন।

সে চুপ করে থাকল।

শুনেন, চক্ষু দুইটা জায়গামতো থাকলে এমন জরুরি কাগজ ফেলায়া আসতে পারতেন না।

সেবার হেনস্তা হওয়ার পরিমাণ কম ছিল না। আবার তেমন কিছু ঘটলে, আরও বেশি হেনস্তা হতে হবে, তার জানা আছে, সুতরাং সে সতর্ক। এখন সে হোটেল রুম থেকে বের হওয়ার আগে বারবার দেখে নেয়, না, কিছুই ফেলে যাওয়া যাবে না। এই সতর্কতার ফলেই সম্ভবত, গত এক-দেড় বছরে আর কিছু ঘটেনি। কিন্তু যা হয়েছে, তার খুঁতখুঁতানি বেড়ে গেছে। এই যেমন, বাস-টার্মিনালে এসেও সে ভাবছে। এরকম ভাবনা, আবদুল হাই গণি মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে, বেশ কিছুদিন ধরে হলে এক কথা ছিল, বাশার সাহেবের ধমক খাওয়ার পর থেকে, কিন্তু তা না, গণি আন্দাজ করতে পারে, হচ্ছে মাস দেড়-দুই হলো। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে এসে, ঢাকায় ফেরার সময় তার প্রতিবারই মনে হচ্ছে সে কিছু ফেলে যাচ্ছে।

এই এখনও যেমন, সুস্থির হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবদুল হাই গণি অবশ্য ব্যাগ খুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। সে নিশ্চিত জানে, কিছুই সে ফেলে আসেনি। তার অফিসের কাগজপত্রও আছে ব্যাগে, তার লুঙ্গিও আছে, আর আছে যা যা থাকার। তা হলে বাকি থাকল কী? আবদুল হাই গণি প্রথমে চারপাশে তাকিয়ে নিল। তারপর পায়ের দিকে তাকাল, পায়ের পাতার দিকে সবকিছু ঠিক আছে, এমন না যে কিছু বাদ পড়েছে, হোটেলের রুমে বা পথে কোথাও থেকে গেছে। মাথায় হাত দিল গণি, মাথা থেকে মুখে, গলায়, বুকে, দুহাতের দিকে তাকাল। সবকিছু ঠিকঠিক আছে দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যদি এমনই হয় ওরকম মনে হওয়ার পর, যে, সে পৌঁছেনি, পৌঁছার পর যদি প্রতিবারই সে দ্যাখে ঠিকই পৌঁছেছে সে, পুরো, তবে ওরকম কেন মনে হয় তার!

মাহমুদ খসরুর কাছে যাওয়া দরকার, যদিও মাহমুদ খসরুর কাছে শেষবার যাওয়াটা সুখের ছিল না। কিন্তু আমরা দেখব, মাহমুদ খসরুর কাছেই যাওয়ার কথা ভাবছে গণি। যদিও সেদিন, সেদিন আসলে হয়েছিল কী, ঐ যে একটা ঈর্ষা আছে না তার খসরুকে নিয়ে, ওটা হঠাৎ খুব জানান দিতে আরম্ভ করেছিল। খসরু যখন বলল লেখকের নাম কাফকা না কী যেন, বিশাল এক লেখক, মাত্র ৪০ বছরের আয়ুর জীবনে কী অসাধারণ কাজ করে গেছে, কিন্তু তখন সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি..., আবদুল হাই গণির মাথা গরম হয়ে গেল। সেদিন, আমরা জানি, তার মাথা আগে থেকেই বেশকিছুটা গরম, সে ঠাণ্ডা করতে গিয়েছিল খসরুর কাছে, আর খসরু কি না আগে বলল কোন্ অদ্ভুত এক লেখকের স্বীকৃতি না-পাওয়ার কথা! আরে এই-যে সে পরিশ্রম করছে, হাড় মাংস এক করে সে অফিসকে কী না দিচ্ছে, সংসারকেও দিচ্ছে, আসরে সংসারের জন্যই তো সব, কিন্তু তার জন্য কি কোনো স্বীকৃতি আছে, না অফিসে না বাসায়? সেদিন তাই মাহমুদ খসরুর সঙ্গে তার একটু গরম বাক্য-বিনিময়ই হলো।

আবদুল হাই গণি সম্ভবত এভাবে আরম্ভ করেছিল--একটা মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল সে জন্তু হয়ে গেছে, না?

জন্তু, প্রাণী, পোকা, যা-ই বলো।...হুঁ, হয়ে গেছে। সে আর মানুষ নেই

সকালে ব্যাডার ঘুম ভাঙল আর দেখল।

ঘুম...সে যখন তার অবিন্যস্ত স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল, তখন।

তোমাদের বিশ্বসাহিত্যের এটা হইল একটা প্রধান রচনা, ঐ যে তোমরা বলো না--মেজর ওয়ার্ক, সেইরকম?

সেইরকম, মেজর ওয়ার্ক।

তোমরা লেখকরা কি এইটা জানো তোমরা আসলে ইয়ার্কি মারো?

গণি, তোমার মেজাজ আজ খারাপ।

আর কিছু বোকাচোদা পাবলিক আছে, তারা তোমাদের বই পড়ে।

তারা মিলিয়ে দেখার একটা সুযোগ পায় বলেই পড়ে।

একটা লোক সকালে ঘুম ভাঙলে দেখল সে জন্তু, সে পোকা, এর মধ্যে মিলিয়ে দেখার কী আছে?

গণি, শোনো, এ বইটা আমি প্রথম যখন পড়ি, তারপর দীর্ঘদিন নিজেকে আমার ওরকমই মনে হতো। মনে হতো, আরে, আমিও তো মানুষ না। ভার্মিন...রোচ...।

হইছে।

তাড়িত হওয়া বোঝো?

খসরু শোনো, আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি, তোমারে বলছি।

জানি সেটা। কিন্তু তুমি কি আরেকটা কথা জানো?

কী?

তুমি যখন এখান থেকে রওয়ানা দেবে, হাঁটবে, রিকশা নেবে কিংবা বাস, যেতে যেতে হঠাৎ হয়তো তুমি দেখলে তোমার মনে হচ্ছে তুমি অদ্ভুত এক জন্তু হয়ে গেছ...পোকা...।

ধরে নেওয়া যায়, মাহমুদ খসরুর এই কথার পর আবদুল হাই গণি কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, তারপর, ধরা যাক, বড় করে শ্বাস ফেলে সে বলেছিল--খসরু এখন আমি যাব।

আমরা ধরে নিই, আবদুল হাই গণি এরপর সত্যিই আর মাহমুদ খসরুর ওখানে ছিল না। সে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং রওয়ানা দিয়েছিল, মাহমুদ খসরু তাকে বলেছিল : গণি রাগ করে থেকো না, খুব তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু আবার। আজ তেমন গল্প হলো না। গণি হয়তো নামতে নামতে গম্ভীর গলায় বলেছিল, যত্তসব! আমরা দেখব, সেসময় এই ‘যত্তসব’ শব্দটাই তার মাথার ভেতর কাজ করে যাবে, যতক্ষণ সে পথে থাকবে, এমনকি বাসায় পৌঁছেও, একটা বিরক্তি কাজ করবে তার ভেতর--মানে হয়, এর কোনো মানে হয়--নিজেকে জন্তু, পোকা মনে হবে একজনের, অদ্ভুত; কই, মাহমুদ খসরু যে বলল তারও মনে হবে, তার একবারও মনে হচ্ছে না।

সে রাতে সে তার স্ত্রীকে বলেছিল--একটা মজার কথা শুনবে?

তার স্ত্রী যথারীতি উৎসাহ দেখায়নি, আমরা জানি তার স্ত্রী সংসারজীবনে বিরক্ত, গণির কোনোকিছুই আর মজার মনে হয় না। তা ছাড়া গণির অনেক মজার কথা শুনতে গিয়ে সে দেখেছে ওর মধ্যে কোনো মজা নেই।

এই যে স্ত্রী উৎসাহ দেখায়নি, আবদুল হাই গণি সেজন্য দমে যায়নি। স্ত্রীর ভেতর উৎসাহের অভাব সে দেখে আসছে, সেটা নিয়ে বসে থাকলে চলে না, সে তাই মাহমুদ খসরুর কাছ থেকে শোনা ঘটনা বলেছিল--গ্রেগরের স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা এবং নিজেকে অদ্ভুত এক জন্তু হিসাবে দেখা--এসব সে বিস্তারিত বলেছিল, চলে আসার সময় মাহমুদ খসরু তাকে কী বলেছিল--তাও; বলে হাসিমুখে তাকিয়ে থেকেছিল তার স্ত্রীর দিকে। আমরা আন্দাজ করে নিই, তার স্ত্রী শোয়া-অবস্থা থেকে উঠে বসেছিল, তাকিয়ে ছিল গণির দিক, বলেছিল--শুনো।

আবদুল হাই গণি আহ্লাদের সঙ্গে বলেছিল--কী, আজব জন্তু হইছি?

নাহ্, তুমি জন্তু আছই, এইটা আর হইবা কী!

মাহমুদ খসরুর কাছে যাওয়া দরকার। বড়মেয়ে পূর্ণিমা পরী, ডাকনাম পরী, তাকে নিয়ে নতুন সমস্যা শুরু হয়েছে। পরী শখ করে রাখা নাম, চেহারাটাও ওরকমই, নাম শখ করে রাখা হলেও বুঝেশুনেই রাখা। তা রূপের প্রাচুর্য থাকলেও পরীর বুদ্ধি কম। কোনো সত্যিকার পরীর সঙ্গে আবদুল হাই গণির দেখা ও পরিচয় হয়নি, অনেকের নাকি হয়, তাই তার জানাও হয়নি পরীদের বুদ্ধি কম না বেশি, তবে তার বড়মেয়ে পরীর বুদ্ধি কম, এটা তার নানাভাবে জানা হয়েছে। আগে বড় হতে হতে, তার যে বুদ্ধি কম এই প্রমাণ পরী বহুবার রেখেছে, আবদুল হাই গণি উপায়হীন আর স্ত্রী রানী নির্বিকার বলে সেসব মেনে নিতে হয়েছে। তবে শেষ যে কাণ্ডটি সে ঘটিয়েছে, গণির মনে হচ্ছে একটা উপায় যদি থাকত! পরী যে আবার ভেঙে পড়েছে, এটুকু অবশ্য মেনে নেওয়াই যায়, কারণ পরীর স্বতস্ফূর্ত প্রবণতা আছে প্রেমে পড়ার, সমস্যা হলো—এবার সে নাটা বাবুলের প্রেমে পড়েছে। নাটা বাবুল এলাকার মাস্তান, সেকেন্ড ইন কমান্ড, এই কিছুদিন আগেও এক বিকালে মদ খেয়ে রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পুরুষাঙ্গ ঝাঁকিয়ে ঘুরে ঘুরে গম্ভীর মুখে পেচ্ছাব করছিল, এই নাটা বাবুলকে পরীর খুব পছন্দ হয়েছে।

এই নিয়ে, দেখা গেল, আবদুল হাই গণির যত আপত্তি, তার চেয়ে বেশি আপত্তি তার স্ত্রীর। এটা অবশ্য গণি বুঝত না, যদি-না পরীর ব্যাপারে সে তার স্ত্রীকে কিছু বলতে যেত। ধরা যাক সে বলল—এইটা তুমি খেয়াল করবা না!
এই কথা সে একটু ক্ষোভের সঙ্গেই বলল। স্ত্রী অবশ্য, গণি ক্ষোভে আছে না কিঞ্চিৎ আনন্দে, কিঞ্চিৎ আনন্দে এই কারণে যে বেশি আনন্দে থাকার সুযোগ নেই, তা খুব কমই গুরুত্ব দেয়, তাই খুব চাঁছাছোলা গলায় পাল্টা জিজ্ঞেস করল—কী খেয়াল করব. কিসের কথা বলতেছ?

মেয়ে তোমার নাটা বাবুলের প্রেমে পড়ছে।

দ্যাখো। স্ত্রী বলল : এইটা নিয়া আমার মেজাজ গরম। তুমিই বলো সে কেন নাটা বাবুলের প্রেমে পড়ল, সে কেন লম্বু বাবুলের প্রেমে পড়ল না? খুবই মেজাজ খারাপ হইছে।

মানে!

শুনো, তোমার মেয়েরে জিগাও সে লম্বু বাবুলের প্রেমে কেন পড়ল না। লম্বু বাবুল কী দোষ করল!

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবদুল হাই গণি জিজ্ঞেস করল—এই লম্বু বাবুলটা কে?

স্ত্রী গলায় যথেষ্ট বিরক্তি তুলে এনে বলল—সেইটার আমি কী জানি। তুমি নাটা বাবুলের কথা বললা, আমিও তাই লম্বু বাবুলের কথা বললাম।

লম্বু বাবুল নামে কেউ আছে কি না, আবদুল হাই গণির ঠিকঠাক জানা নেই, থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে, সুতরাং লম্বু না নাটা, এই প্রসঙ্গে গণি থাকল না, সে বলল : আহা, মা হইছ, মেয়েরে চোখে চোখে রাখবা না?

চোখে চোখে রাখলে কী হইত?

এই-যে নাটা বাবুলের প্রেমে পড়ছে, এইটা পড়ত না।

শুনো, তোমার মেয়ের সমস্যা আছে, প্রেমে পড়বই, বিয়া দিয়া দাও।

বয়স হউক।

হইছে, ছোটবেলা থেইকা তার শরীর গরম। সে ছটফট করে।

আরে, মা হইয়া তুমি এইসব কী বলো।

ক্যান, তুমি দ্যাখো নাই? ছোটবেলায় তোমার বন্ধুরা আসলে সে কোলে গিয়া বইসা থাকত না? আর তোমার বন্ধুরাও তারে আদর করত?

ধ্যাৎ, তুমি মাঝে মাঝে এইসব কী যে বলো!

ঠিক বলি, তোমার বন্ধু আছে না, এবাদুর, পরীরে কত ভালোবাসে।

এবাদুর ভালো মানুষ.. ।

ও আচ্ছা! এবাদুর আমারে কী বলছে, এইটা শুনবা? এইতো সেইদিন, বলল, ভাবি, আপনি যে কী, এইটা বুঝেন না, মার্কেটে নামেন, দেখবেন কত ডিমান্ড।

আরে! এইসব কী বলো তুমি! মার্কেটে...!

এবাদ ভাই বলছে, তাই বললাম। মার্কেটে আমার ডিমান্ড আছে, এইটা সে জানে, আমি কেন আমারে সাপ্লাই দিতেছি না, এইটা এবাদ ভাই বুঝতেছে না।

এইসব আমারে আর বলবা না।

আচ্ছা, বলব না।

স্ত্রী আর বলল না বটে, তবে এটা বোঝাই যায়, আবদুল হাই গণির ভেতর কথাটা থেকে যাবে, আর মাঝেমাঝেই সেটা কেমন নড়েচড়ে উঠবে। আশ্চর্য, এবাদ এই কথা বলল, বন্ধু হয়ে বন্ধুর স্ত্রীকে এবাদ এই কথা বলতে পারল— মার্কেটে ডিমোন্ডের কথা; আর তার স্ত্রীও এই কথা শুনল। আবার, ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাইয়ের কথা ভাবলও নাকি, কে জানে! এবাদ বা স্ত্রীকে কাউকেই তার কিছু বলা হলো না, তবে এটুকু নিশ্চয়ই গণির মনে হতেই পারে— বলা দরকার বলা দরকার, এসব কী হ্যাঁ, এসব কী! এসব ডিমান্ড সাপ্লাই কেউ বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে, না স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বন্ধুর আলোচনা করে।

চাকরি করতে গেলে অবশ্য এসব আলোচনায় চলে আসে, ঐ যে, প্রথমেই বলা হয়েছে, আবদুল হাই গণির ধারণা চাকরিটা সে ভালো বোঝে, শুধু অফিস এটা বোঝে না। অফিস বলে, সে নাকি এখনো মার্কেটই বোঝে না, যদিও মার্কেট বোঝাই তার কাজ। বাশার সাহেব একবার এরকম একটা কথা বলল— গণি সাহেব...।

সে সেবার বাইরে থেকে ফিরেছে, পরের দিন অফিসে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর বাশার সাহেবের ঘরে ডাক এবং বাশার সাহেবের গলায় উষ্মা। আবদুল হাই গণি বিপদ টের পেল--জি স্যার... ।
হচ্ছে না।

কী হচ্ছে না, সেটা জানার জন্য আবদুল হাই গণি অপেক্ষা করতে লাগল।

চাকরি তো অনেকদিন হইল, না?

জি, প্রথম থেকেই.. ।

কিন্তু এই চাকরিটা আপনি এখনো ধরতে পারলেন না, অবাক কাণ্ড.. ।

আবদুল হাই গণি একবার, ঐ একবারই তার জীবনে আমরা জানি, ভেবেছিল বলবে—স্যার, চাকরির কি ল্যাঞ্জা আছে? ল্যাঞ্জা না থাকলে আর ধরব কেমনে?

তবে এও ঠিক, এরকম মনেই হয়েছিল শুধু তার, বলা হয়নি, কারণ এরকম ভাবতে হলেও সাহস লাগে। তাই এরকম এক দৃশ্যই আমরা দেখব—আবদুল হাই গণি মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকল বাশার সাহেবের সামনে, বাশার সাহেব বলে গেল—চাকরি করতেছেন মার্কেটে, কিন্তু কী ডিমান্ড কী সাপ্লাই আপনে এইটাই বুঝেন না! চলে?
এরকম কথা সে মেনে নিতে পারে না, আবদুল হাই গণি, যে সে মার্কেট বোঝে না। একমাত্র সমস্যা হচ্ছে, সে যে মার্কেট বোঝে, এটা কেউ বুঝতে চায় না। সবার বোঝার দরকার নেই, তার অফিসের লোকজন বুঝলেই হলো। এই অভিমানেই না, অভিমান বড় তীব্র হয়েছিল সেবার, গণি একবার ঠিক করেছিল সে ব্যবসা করবে। চাকরি করবে না সে, শালার চাকরির মুখে লাথি মারো, সে ব্যবসা করবে। ব্যবসা করার জন্য কিছু টাকা থাকলেই হলো, টাকা তার আছে, মানে চাকরি ছেড়ে দিলেই সে কিছু টাকা পাবে, বাকিটা পরিশ্রম। সে কি দেখেনি তার কিছু কিছু বন্ধু ব্যবসা শুরু করে কত অল্প সময়ের মধ্যে সাঁইসাঁই করে উঠে গেল, তাকে আর মনেও রাখল না, না রাখুক মনে, সে যখন ব্যবসা কর ধনী হবে, সেই-বা কাকে মনে রাখবে, অফিসের এইসব লোকজনকে তো না-ই।

তা মাহমুদ খসরু বলল—ব্যবসা করবে?

ফাইনাল।

বোঝো?

কী?

ব্যবসা।

এইটার মধ্যে বোঝার কী আছে?

কিসের ব্যবসা করবে?

করব। এখন ঠিক করি নাই কিসের। তবে করব।

তুমি পারবে না।

কী যে বলো না তুমি! কেন পারব না!

ঠিক আছে, আগে ঠিক করো কিসের ব্যবসা। তারপর মার্কেট সার্ভে করো। দ্যাখো যে ব্যবসা করবে, যদি প্রোডাকশনে যাও, ইন্ডেন্টর হও, এরকম কিছু। দ্যাখো ওটার ডিমান্ড কেমন... ।

আবদুল হাই গণির আর ব্যবসা করা হলো না। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলবে, মাহমুদ খসরুর জন্যই হলো না, খসরু এখন একটা ঝামেলা তৈরি করল। ঐ এক কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে দিল—আগে ব্যবসা ব্যাপারটা বোঝো, গণি। খুব বড় ব্যবসায়ী তো তুমি এখনই হতে পারবে না, তোমাকে হতে হবে ট্রেডার, ছোট, পণ্যবিক্রেতা। তা, যা তুমি বিক্রি করবে, তা বাজারে কেমন চলবে তা তুমি জানো? আগে বাজারটা দ্যাখো গণি, কোন্ জিনিসটার ডিমান্ড বেশি, আবার শুধু ডিমান্ড বেশি হলেই চলবে না। ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই এনশিউর করার একটা ব্যাপার... ।

খসরু, তুমি কি একটা ব্যাপার জানো?

কী?

তুমি আমার অফিসের খতরনাক বাশারের মতো কথা বলতেছ।

বললে বলছি। ভুল বলছি না।

আমি মার্কেট ইন্সপেক্টরের চাকরি করি কত বছর, এইটা জানো?

গণি, তোমার টাকা বেশি নেই, আমি এইটা জানি, জানি বলেই বলি, বুঝেশুনে নামো।

এই-যে ভয় ধরিয়ে দিল মাহমুদ খসরু, একটা ভজঘট পাকিয়ে দিল, আবদুল হাই গণির আর বুঝেশুনে নামা হলো না।

এই নিয়ে আবদুল হাই গণির অনেক দুঃখ। এই-যে তার ব্যবসা করা হলো না, সে ধনীলোক হয়ে যেতে পারত, এইটা হওয়া হলো না। তবে এই দুঃখ ছাপিয়ে তার অন্য দুঃখগুলো বড় হয়ে ওঠে। এই যেমন, এত বছর ধরে চাকরিতে আছে সে, অথচ অফিস তার কাজের মূল্যায়ন করে একটা প্রমোশন দেবে, সেটা দূরের কথা, উঠতে-বসতে তাকে অদক্ষ গণ্য করে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে, আর, সংসারের কথাই-বা সে কী বলবে; ...বলবে? এই সেদিন তার ছোটছেলে অনন্ত আকাশ কোনো এক রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনে যোগ দিয়েছে। শুনে সে বলল—শোনো, এখন হইল তোমার পড়াশোনার সময়। এইসব বাদ দাও।

ছেলে অবাক গলায় বলল—আব্বা, এইটা তুমি কী বলো! কত কষ্ট কইরা ঢুকলাম..।

ঢুকছ ঢুকছ, এখন বাইর হয়া আসো।

আব্বা, এখন সামনে আমার ব্রাইট ফিউচার.. ।

তোমার ফিউচার তোমার লেখাপড়ার মধ্যে।

শোনো আব্বা, তুমি বলতে পারবা লেখাপড়ার ডিমান্ড কী? কী ডিমান্ড? যেইটার বেশি ডিমান্ড, আমি সেইদিকে গেছি, পলিটিক্স করতে পারলে সুবিধা আছে, আর লেখাপড়া করলে আমি জানি না সুবিধা আছে কি নাই, তুমি আবার ভাইব-না আমি লেখাপড়া একদম বাদ দিয়া দিতেছি... ।

ছেলেও লেখাপড়া বাদ দেয় না। বাড়ির আর কেউ কিছুও না। একদিন পরীকে নিয়ে বসেছিল আবদুল হাই গণি, নাটা বাবুলকে নিয়ে আলোচনা। পরী গণির কথাটথা শুনে বারদুই চোখ মুছল, গণি যখন বুঝল, তার কথায় তাহলে কাজ হয়েছে, পরী বলল—আব্বা, তুমি এইসব কী বলো, বাবুল কি খারাপ? ঠিক আছে খারাপ। আমি তাকে ভালো করব।

আবদুল হাই গণি এদিক-ওদিক করে জানতে পেরেছে পরী এখন নাটা বাবুলকে সময় দিচ্ছে। একবার সে যখন ঢাকার বাইরে, পরী নাকি সকালে বেরিয়ে মাঝরাতে ফিরেছিল। ফিরেছে এই কত, না ফিরলেই-বা কী করার ছিল! এমনও শুনেছে গণি—নাটা বাবুল এমন এক ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, ব্যান্ডপার্টি নিয়ে এসে ধুমধাম করে পটকা ফুটিয়ে সে পরীকে তুলে নিয়ে যাবে। না, বিয়ে না, বিয়ে তো আকছার হচ্ছে, বিয়ের মতো অনুষ্ঠান করে আগে কি কাউকে তুলে নিয়েছে? তাহলে?

এদিকে তার স্ত্রী এবাদকে ভালো করার পরিকল্পনা নিয়েছে কি না, সে-বিষয়ে আবদুল হাই গণি নিঃসন্দেহ হতে পারছে না। নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য সে একদিন বুদ্ধি খাটাল, স্ত্রীকে বলল—এইটা কী ব্যাপার! এবাদ দেখি রোজই আসতেছে।

স্ত্রী গম্ভীর গলায় বলল—এইটা কী বলো! গত সপ্তাহে সে মাত্র দুইবার আসছে।

দুইবার নাকি? ...দুপুরবেলা?

দুপুরবেলা। এত জিজ্ঞাসা করো কেন।

আবদুল হাই গণি কী করে বোঝাবে তার আরও অনেককিছুই জানতে ইচ্ছা করে। এই যেমন দুপুরবেলা আসে এবাদ, তারপর? তখন বাসায় কেউই থাকে না, তারপর? তার জানতে ইচ্ছা করে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। জিজ্ঞেস করতে তার ভয় হয়। যদি রানী, তার স্ত্রী, হঠাৎ এইভাবে বলে বসে—হ্যাঁ, ঠিকই তো, বুঝতেই পারছ, আর কেন জিজ্ঞাসা করো।

এই ভয়ে রানীকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় না আবদুল হাই গণির। ঐ যে, একবার সে ভেবেছিল নাটা বাবুলের মুখোমুখি হবে। সেটাও হয় না। সে ভেবেছিল নাটা বাবুলকে গিয়ে বলবে, বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো উৎসবের আয়োজন করে পরীকে কেন তুলে নিয়ে যেতে হবে...যদি করতেই হয় বিয়ে করলেই হয়! কিন্তু এই-যে এই ছাড়টুকু দিতে হবে, বিয়ের কথা বলতে হবে, তুলে নেওয়ার দরকার কী, বিয়েই করুক; গেলে এই কথা বলতে হবে নাটা বাবুলের কাছে যাওয়া হয়নি আবদুল হাই গণির। সে যে যাবে, বলবে অন্যকিছু, পিতার মতো করে, সাহস হয় না গণির, যাওয়াও হয় না।

তবে যাওয়া হয় মাহমুদ খসরুর ওখানে। এটা অবশ্য হুট করেই যাওয়া, যদিও যাওয়ার ইচ্ছা প্রবলভাবে কাজ করে যাচ্ছিল তার ভেতরে, শুধু যাওয়া হচ্ছিল না। একদিকে যাওয়ার ইচ্ছা, এরকম মনে হওয়া--গেলে তো খসরুর ওখানেই যেতে হবে। ওকেই খুলে বলা যায় সবকিছু।...হ্যাঁ, সবকিছুই। ওকে বললেই হালকা হওয়া যায়। সব সমস্যা দূর হয়ে যায় ওকে বললে, তা নয়, কিন্তু ওকে বললে সুস্থির হওয়া যায়। কথা আছে না--কাউকে-না-কাউকে বলতে হয়। তা, বলতেই যদি হয়, বললে মাহমুদ খসরুকেই। আরেক দিকে আবার মাহমুদ খসরুর ওখানে যাওয়া থেকে এরকম ভেবে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা--আর কত, মাহমুদ খসরুকে আর কত! সবই বলতে হবে ওকে, সব! আর বলা মানেই তো নিজেকে ছোট করা! আবার, যদি তার এত দুঃখের কথা শুনেও মাহমুদ খসরু গুরুত্ব না দেয়, যদি তার সব কথা উপেক্ষা করে কোনো বইয়ের পাতা খুলে তার প্রিয় কিছু পড়তে আরম্ভ করে দেয়, একদিন শুরু করেছিল না, কী যে এক অদ্ভুত কথা, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একজন দেখল সে পোকা না প্রাণী কী হয়ে গেছে..।

মাহমুদ খসরু বলল--সমস্যা হলো কী জানো, আজ তুমি মোটেও ভালো দিনে আসোনি।

আবদুল হাই গণি বলল--ঠিক আছে খসরু, আজ গেলাম তাইলে।

আজ বিদেশ থেকে দুজন গেস্ট আসবেন। টিভি-চ্যানেলের লোক আসবে, ওদের সঙ্গে ওনারা আসবেন। আমাদের তিনজন তিনজনের ইন্টারভিউ নেব, আলাপচারিতা আর কী, দারুণ হবে।

খসরু, বললাম তো যাই। আরেকদিন আসব।

আরে রাখো। বসো তুমি। ঐ ওরা এসে পড়ল বলে। কতক্ষণ আর লাগবে। ঘন্টাদেড়েক। তারপর আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দেব। বুঝেছ, বসো।

আমরা দেখব, আবদুল হাই গণি এক দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে আছে। তবে সে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই পৌঁছে যাবে দুই বিদেশিকে নিয়ে টিভি-চ্যানেলের লোকজন। আর গণিও দ্রুত সেখানে থেকে সরে পড়বে। বাইরের লোকজনের সামনে সে খুবই অস্বস্তিবোধ করে। সে চলে যাবে মাহমুদ খসরুর স্টাডিরুমে। স্টাডিরুম মানে শুধু বইপড়া আর লেখার ব্যবস্থা না, ওখানে বিছানা আছে, আড্ডা মারার ব্যবস্থা আছে, পানাহারেরও। পান পছন্দ নয় গণির, একটু পরই কেমন আউলা-আউলা লাগে। এ ঘরের অন্যকিছুও অবশ্য গণির পছন্দের ভেতর আর পড়ে না। শুধু বই আর বই, লেখার খাতা, কলম, হাবিজাবি। মাহমুদ খসরুর বসার চেয়ারটা অবশ্য তার পছন্দ। দারুণ, তবে ঐ চেয়ারে সে বার-দুইতিন মাত্র বসেছে। ওটা খসরুর নিজের চেয়ার, ওখানে অন্য কারো বসা ভালো দেখায় না। গণি যা করে, অন্য চেয়ারেও বসে না, সে উঠে বসে বিছানায়, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে, ওভাবেই কথা বলে খসরুর সঙ্গে।

আজও সে তা-ই করবে। আবদুল হাই গণি উঠে বসবে বিছানায়। তার আগে বারকয়েক এরকম একটা ভাবনা আসবে তার মনে--তার বোধহয় চলে যাওয়া উচিত। খসরু ব্যস্ত, বলল ঘন্টাদেড়েক, কিন্তু কখন ফ্রি হবে কে জানে! এই এতটা সময় তাকে একা বসে থাকতে হবে, তারপর কাজ শেষ হবে যখন খসরুর, সে যে আড্ডা দেওয়ার মেজাজে থাকবে, তার নিশ্চয়তা নেই, হয়তো গল্পে বসে দেখা গেল সে শুধু ‘হুঁ হ্যাঁ’ করছে। এরকম ভাবনা তৈরি হলো বারকয়েক, আবার মিলিয়েও গেল। আমরা তাই দেখব, সে বসেই থাকবে।

তবে এও ঠিক, চুপচাপ বসে থাকা কঠিন কাজ। সে এসেছে কথাবলার প্রস্তুতি নিয়ে, আর এখন সে পাশের ঘরের কথা শুনছে, যেসব কথার অধিকাংশই সে বুঝছে না, বোঝার দরকারও নেই, এভাবে বসে না থেকে সে শুধু সময় কাটাতে পারলেই খুশি। আমরা দেখব, সময় কীভাবে কাটানো যায়, এই ভাবনায় আবদুল হাই গণি ব্যস্ত হয়ে উঠবে। কারণ এইভাবে বসে থেকে, তার আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, তার ঐ কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, যে কথাগুলো  সে খসরুর সঙ্গে শেয়ার করতে এসেছে, অফিসের কথা, পরীর কথা, আকাশের কথা, এবাদ আর রানীর কথা, তার নিজের কথা, তার যে কিছুই আর ভালো লাগে না, এই কথা।

আমরা দেখব, এসব কথা ভাবতে ভাবতে আবদুল হাই গণি বিছানা ছেড়ে নেমেছে। নামবে সে, বইয়ের শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখতে আরম্ভ করবে। কিন্তু আমরা এটা আগেই জানি, বই তার পছন্দের তালিকায় পড়ে না, এখন পড়ারও কারণ নেই। তবে সে সরে আসবে না, বেশ অনেকটা সময় নিয়ে বই দেখবে, একসময় অবশ্য টের পাবে তার মন কিছুই ভালো হয়নি, তখন সে শেলফগুলোর সামনে থেকে সরে আসবে। সরে এসে সে দাঁড়াবে খসরুর লেখার টেবিলের পাশে। লেখার রুলটানা খাতা, কয়েকটা কলম, বইও কয়েকটা। সেসব হাতে তুলে নিয়ে দেখতে আবদুল হাই গণির হাতে উঠে আসবে এমন একটা বই যেটা দেখে তার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠবে। আরে, এতদিন ধরে বইটা লেখার টেবিলের উপরই পড়ে আছে! এতদিনেও খসরু এটা আবার পড়ে শেষ করেনি! নাকি শেষ করে আবার পড়তে শুরু করেছে?

সে যাই হোক, আবদুল হাই গণির মনে এসব ভাবনা আসবে বটে, তবে সে কৌতূহলী হবে, হয়তো মজাও পাবে কিছুটা। বইটা সে তুলে ধরবে তার সামনে--বইয়ের নামটা পড়বে। লেখকের নামটা অবশ্য তার মনেই আছে, কেন মনে আছে এই ভেবে সে নিজেও অবাক হবে, মনে থাকার কথা না, যে লাইনটা বলেছিল খসরু, সেটাও মনে নেই, বিষয়টা মনে আছে...আছে...ঐ যে...ভাবতে ভাবতে গণি বইটা খুলল,...হুঁ, এই তো...আবদুল হাই গণির পড়তে অসুবিধা হবে, সে থেমে থেমে পড়বে--'One morning, when Gregor Samoa woke from troubled dreams, he found himself transformed in his bed into a horrible vermin.'

বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় এসে বসবে আবদুল হাই গণি। তার ইচ্ছা আরো কয়েকটা লাইন পড়ার। কিন্তু আমরা দেখব সে পরের লাইনগুলো পড়বে না। সে প্রথম লাইনটার দিকেই অপলক তাকিয়ে থাকবে--'One morning....।’

লাইনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবদুল হাই গণির মুখে হাসি ফুটতে দেখব আমরা--এইটা কী লিখছেন কাফকা সাহেব! লিখলেই হইল?

আবদুল হাই গণি হেসেই যাবে--হাঁ, লিখলেই হইল! একজন সকালে উঠে দেখল সে আর মানুষ নাই, সে জন্তু সে পোকা। পোকা বানায়া দিলেন...আপনারা লেখকরা পারেনও, কত কী লিখেন...কত কী বলেন, কলমে আসল আর লিখলেন একজন মানুষ এখন জন্তু.. ।

আবদুল হাই গণি হেসেই যাবে এবং তার এই হাসির মধ্যেই হঠাৎ আমরা দেখব সে হাসছে বটে, তবে তার দুইচোখ ভেজা, ভেজাই; কারণ আবদুল হাই গণি আঙুল দিয়ে তার দুচোখের কোণ মুছে নেবে। এখন তার মুখে আর হাসি নেই, সে অবশ্য তাকিয়েই থাকবে ঐ লাইনটার দিকে--কত কী পারেন, না কাফকা সাহেব, মানুষ বানায়া দিলেন পোকা...এইটা পারেন...এইটা...এই যে মানুষরে পোকা বানাইলেন যেমন, তেমনই ধরেন, একটা পোকার যদি ইচ্ছা হয় মানুষ হওয়ার, লিখতে পারবেন এইরকম, ধরেন--একটা পোকা হঠাৎ এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল সে মানুষ...।

আবদুল হাই গণিকে দেখে মনে হবে সে কিছুর অপেক্ষায় আছে।


      লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:       
মঈনুল আহসান সাবের (জন্ম ২৬ মে ১৯৫৮)
বাংলাদেশের প্রথিতযশা ও খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি পেশায় সাংবাদিক ও প্রকাশক। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৬) এবং একুশে পদক (২০১৯) পেয়েছেন। লেখালেখির শুরু হয় সত্তরের মধ্যভাগ থেকে। ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘মোহিনী তমসা’। এরপর থেকে গল্প, উপন্যাস লিখেছেন অনেক। এছাড়া কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন এবং অনুবাদও করেছেন। গল্পই তাঁর পছন্দের জায়গা। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পরাস্ত সাহস’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। 

উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ: স্বপ্নযাত্রা (১৯৮৪); আগমন সংবাদ (১৯৮৪); আগামী দিনের গল্প (১৯৮৭); ভিড়ের মানুষ (১৯৯০); কবেজ লেঠেল (১৯৯২); রেলস্টেশনে শোনা গল্প (১৯৯৮); কাফকা আসবে (২০১৯)।   
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: আদমের জন্য অপেক্ষা (১৯৮৬); পাথর সময় (১৯৮৯); মানুষ যেখানে যায় না (১৯৯০); সংসারযাপন (১৯৯৭); দূরের ঐ পাহাড়চূড়ায় (২০০৬); আখলাকের ফিরে আসা (২০১৪); আবদুল জলিল যে কারণে মারা গেল (২০১৫)।

  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ