bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

গ্রামে প্রচলিত গল্প ꘡ নূরুননবী শান্ত

নূরুননবী শান্ত

আমাদের গ্রামের লোকেরা একটাই গল্প বছরের পর বছর ধরে শুনতে এবং বলতে পছন্দ করে। সেসব গল্পের বেশিরভাগই রূপকথার মতো শোনায় কিন্তু তাতে রাজা বা রাক্ষসের দেখা মেলে না। একবার টুরু ভাই, যিনি কাঠ চেরাই করে বালবাচ্চা পালেন, এইরকম একটা গল্প বলার পর আমাকে বলেন যে, আসলে এটা তার বাবার বাবা, মানে দাদা--যিনি ছেলেমেয়েদের পাঠশালায় পাঠানো জরুরী ভাবতেন--এই গল্পটা বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলেন যাতে পাঠশালার শিশুদের গল্প দিয়ে মজিয়ে পড়াশুনায় মনোযোগী করানো যায়। ছেলেমেয়েরা পাঠশালামুখী না হলেও, গল্পটি ছেলে-বুড়ো সবাই ভালোবাসতো। কারণ গল্পটি বলার আগে তিনি প্রতিবারই বলতেন যে, সেটা ছিলো সত্যিকারের ঘটনা। এর ফল হয়েছিলো এই যে, গাঁয়ের কিছু ছেলে-মেয়ে গল্পের চরিত্রের প্রতি দুর্বলতাবশত পাঠশালা ত্যাগ করে সেই যে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো তা আর জানা যায়নি। সেই দুঃখে টুরু ভাইয়ের দাদা নাকি পণ্ডিতগিরি ছেড়ে দিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন এবং তারপর থেকে সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে যাকেই কাছে পেতেন, গল্পটি শোনানোর আগেই বলে নিতেন যে গল্পের ঘটনাগুলো আবার কেউ যেন সত্যিকারের ঘটনা মনে না করে। গল্পটির মধ্যে এমন কী আছে যে তা আমাদের গ্রামে এতকাল ধরে এত জনপ্রিয় তা আমি জানিনা, এমনকি গাঁয়ের যাঁরা জ্ঞানী লোক তারাও জানেন না। পুরো ঘটনাটা শোনার পর হয়তো এ সংক্রান্ত উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর আপনারা দিতে পারবেন।

ব্রিটিশ আমলের গোড়ার কথা। আমাদের গ্রামে একবার এক ফিরিঙ্গি এসে পাঠশালা দেখে মুগ্ধ। তিনি বললেন, এই পাঠশালা থেকে এণ্ট্রান্স পাশ দিয়ে মাষ্টার, কেরানী অনেক কিছু হওয়া যাবে! এমনকি আপনারা চাইলে আপনাদের বালবাচ্চারা রাজশাহী, রংপুর, কলিকাতা যেতে পারবে বড় বড় পাশ দেওয়ার জন্যে!

হিতাম আলী নামের এক যুবক সেই পাঠশালায় যেতো এবং গল্পটি তার সম্পর্কেই গড়ে উঠেছিলো, কারণ সে নাইন ক্লাসে ওঠার পর কিছুতেই আর এক ধাপ উপরে উঠে কোনোদিন টেন ক্লাস হতে পারে নি। দ্বিতীয় বারের মতো যখোন সে ফেল মারলো মা-বাবা তাকে তিন দিন না খাইয়ে রাখলো। তবে নাইন ক্লাসের পরীক্ষায় তৃতীয়বার ফেল করার পর সে নিজেই ভাতের উপর রাগ করে উপোস করতে লাগে। তাই দেখে মায়ের পরাণ পুড়তে থাকে এবং সেই কোমল-হৃদয় নারী নিজেও নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেন। আসলে আমাদের গ্রামে আজকালকার দিনের মতোই তখনো মায়েদের মন ছিলো অতি কোমল এবং সন্তান বলতে পুরোপুরি তাঁরা বেহেস্তী রহমত জ্ঞান করতেন। কিন্তু বাবাদের ব্যাপার এখনকার দিনের মতো তখনো ছিলো ভিন্ন রকম। তারা সন্তানদের জন্য যে পদ্ধতিতে চিন্তা করতেন তা তাঁরা বাস্তবমুখী বিবেচনা করতেন। তো হিতামের বাবা সাব্যস্ত করলেন যে লেখাপড়ায় অপারগ ছেলেকে গাঁয়ের রীতিমাফিক এখন অবশ্যই চাষের কাজে মন দিতে হবে। গ্রামে যে লোকটি সবচেয়ে ভালো লাঙ্গল বানানোর কারিগর, তাঁকে ইতিমধ্যেই খবর দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো। অপরপক্ষে, হিতাম আলী কিন্তু চাষবাসের জীবন ভীষণ অপছন্দ করতো। সেকালে নাইন ক্লাস পর্যন্ত পড়াটাও সোজা ব্যাপার ছিলো না! তবে নাইন ক্লাসের অহমিকা নয়,বরং এই ভাবনা হিতামকে চাষবাসের প্রতি বিরূপ করেছিলো যে, চাষীরা উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও দারিদ্র্য ঘোচাতে অক্ষম অথবা তাঁদেরকে চিরকাল ‘চাষা’ বানিয়ে রাখার একটা কোনো চক্রান্ত কোথাও আছে। হিতাম যেমন তার বাবার গায়ে-গতরে কাদা-মাটি আর শস্যের গন্ধ পেয়ে অনেক সময়ই পুলকিত হতো কিন্তু তাদের গোটা সংসারের কারো গায়েই সুখের গন্ধ পাওয়া যেতো না। তাছাড়া হিতাম লক্ষ্য করতো যে চাষীদের গাত্রবর্ণ ও শারীরিক গঠন এমন কিম্ভূত হয়ে ওঠে যে বাবু লোকেরা ‘চাষা’ দেরকে চিরকাল ছোটলোকের শ্রেণিভূক্ত গণ্য করে থাকে।

কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের গ্রামে তখোন কেউই রীতির বিরুদ্ধে যেয়ে পাপ করতে পারতো না। তবে রক্তের মধ্যে কারো যদি রীতিবিরুদ্ধতা থাকে, তাকে তো কেউ আর বেঁধে রাখতে পারে না। সুতরাং এক রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে, টুরু ভাইয়ের বর্ণনা মতে সেটা অমাবশ্যাই ছিলো, হিতাম আলী গৃহত্যাগ করে পীরগাছা ষ্টেশনের প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে ভাবতে থাকে যে এখন কোথায় যাওয়া যায়।

এইরকম আকাশ-পাতাল ভাবনার মধ্যে একটা রেলগাড়ি এসে প্লাটফর্মের ধারঘেঁষে দাঁড়ায়। কোনদিক থেকে এসে সেই রেলগাড়ি কোনদিকে চলে যায় সে কথা টুরু ভাই কেন, গ্রামের আর যারা যারা গল্পটি জানে তারাও ঠিক করে বলতে পারে না। তো সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে দিশাহীন হিতাম লাফ দিয়ে সেই রেলগাড়ির একটি কামরায় উঠে একটা বেঞ্চের ফাঁকা এক কোণায় বসে ক্লান্তি কাটানোর জন্য ঝিমুচ্ছিলো। তখোন এক ফিরিঙ্গি চেকার এসে হিতামকে স্মরণ করিয়ে দেন যে কামরাটির জানালায় জানালায় লোহার শিক বসানো দেখেই তার বোঝা উচিৎ ছিলো যে সেটা মহিলা যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত কামরা ছিলো। অধিকন্তু ছওয়াল-জবাবের মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত হলো যে এই গৃহত্যাগী যুবকের কাছে টিকিট পর্যন্ত ছিলো না। রেলগাড়ি তখন, আপনারা নিশ্চয় অনুমান করতে পারেন, ধীর গতিতে চলতো, একইসাথে ফিরিঙ্গি চেকাররা যে খুব কড়া স্বভাবের হয়ে থাকবে এটা তো সর্বজনবিদিত। এই গল্পের চেকারবাবু তার উপর ছিলেন বদ মেজাজী এবং সেই মেজাজের জোরে বাবুটি করলেন কি, হিতামকে চলন্ত রেলগাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে এক অজায়গায় নামিয়ে দিলেন। হিতামের চলন্ত রেলগাড়ি থেকে নামার কোনরূপ পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকায় সে গড়িয়ে চাকার নিচে চলে গেলো। লোহার চাকার কোন্ ফাঁক দিয়ে হিতামের জীবন রক্ষা পেলো সেটা একটা রহস্য। তবে রেলগাড়ি বহুদূরে চলে যাবার অনেক্ষণ পর পর্যন্ত সে জ্ঞান হারিয়ে নিশ্চেতন হয়ে পড়ে ছিলো।

প্রসঙ্গত বলা দরকার যে আমাদের গ্রামে যেসব গল্প প্রচলিত আছে সেগুলোর বেশিরভাগের মধ্যে মূল চরিত্রের জ্ঞান হারানোর ব্যাপার আছে। কোনো কোনো গল্পে অলৌকিক, অস্বাভাবিক ঘুমের ব্যাপারও অবশ্য আছে। চরিত্রের জ্ঞান ফিরলে বা ঘুম ভাঙলে সমস্ত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মূল ঘটনা সমেত বদলে যেতে দেখা যায়। এ গল্পটিও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।

তো জ্ঞান ফেরার পর হিতাম আর কোনো রেললাইন দেখতে না পেয়ে ফাঁপরে পড়ে যায়। বেশিক্ষণ ফাঁপরের মধ্যে থাকার সুযোগ তার হলো না, কারণ অজ্ঞান অবস্থায় যে সে তার নিচের কাপড় নষ্ট করে ফেলেছিলো তার জন্য সে লজ্জিত বোধ করছিলো এবং আশেপাশের গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গলের সামনেও সে বিব্রত বোধ করছিলো। অনেক সময় বাদে হিতাম বুঝতে পারলো যে সেখানে কোনো মানুষ-জন নেই এবং অন্যের দুর্গতি দেখে ভেংচি কাটার অভ্যাস গাছপালাদের নেই। তখোন সে লুঙ্গির ভালো অংশ দিয়ে নিজের গু মোছামুছি করে গায়ের ফতুয়া কোমরে কোনরকমে পেঁচিয়ে নিয়ে উত্তর দিকে অনেক সার সার সুন্দর গাছের রেখার ধার দিয়ে বুকের মধ্যে অনেক ভয় নিয়ে হাঁটতে লাগলো। ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে আর হিতামের তখন অন্তহীন ক্ষুধার পেট। কানের ভেতরে সেইরকম শব্দ হচ্ছিলো, মাঝদরিয়ায় ঝড়ের মধ্যে পড়লে যেরকম হয়। তারোপর এবরো-থেবরো আলপথ দিযে হাঁটতে গিয়ে সে উপর্যুপরি হোঁচট খাচ্ছিলো। তখন ভোরের আলো রঙিন হয়ে দেখা দিয়েছে। হিতামের পেটে যেন বাঘ ঢুকে শিকারের জন্য লাফচ্ছিল সেই সময়।

অতঃপর, ঘন গাছ-গাছড়ার ভিতর দিয়ে সার সার সুদৃশ্য মাটির ঘর দেখতে পেয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় হিতাম আলী। আলপথ ছেড়ে সড়কপথে উঠে সে দেখতে পায় ছবির মতো পয়-পরিষ্কার মেটে রাস্তার রূপ। ক্ষুধা বিস্মৃত হয়। এও সে মনে করে যে কাছে পিঠে কোথাও নদী বয়ে গেছে বিরাট স্রোত বুকে নিয়ে। কেননা, স্বাস্থ্যবতী যুবতীরা ভেজা শাড়ির জল ঝরাতে ঝরাতে হাসতে হাসতে পথের চারদিক আলো করে চলে যাচ্ছে। তখন সকালের শীতল হাওয়া এসে হিতামের উদোম গায়ে লাগছিলো, কিন্তু শীত করছিলো না একটুও। নদীবর্তী অঞ্চলের লক্ষণগুলো হিতামের জানা ছিলো। তখনই তার আবার লোকেদের বলা কথা মনে হলো যে, নদীর হাওয়ায় ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্ষুধার চোটে আবারও হিতামের অস্থির লাগে। তখন পরিচ্ছন্ন পথের অনতিদূরে এক চাপকল-তলায় দুজন মাঝ বয়সী নারী-পুরুষকে গলা ধরাধরি করে বসে থাকতে দেখে সে। কিছুক্ষণ পরেই তাদের একজন কল চাপতে আরম্ভ করে এবং অন্যজন কলের মোটা নলের মুকের তলায় মাথা দিয়ে জোরে জোরে হাসতে লাগে। বদলাবদলি হয়। অন্যজন কল চাপতে আরম্ভ করে এবং প্রথমজন কলের মোটা নলের মুখের তলায় মাথা দিয়ে জোরে জোরে হাসতে লাগে। হিতামের প্রতি তারা ভ্রক্ষেপও করে না। একবারো বলে না, ‘কাঁয় তোমরা? কোন গাঁও?’ বিপরীত দিক থেকে এক বালিকাকে হাসতে হাসতে বেনী দুলিয়ে আসতে দেখে হিতাম কথা বলার সুযোগ নেয়, ‘ক্যা বাহে, চেংরিকোনা, হামাক একনা ভাত খোয়াইবার পারিমেন?’ কারো কথায় কর্ণপাতের অবসর যেন বালিকার নেই। সে যেমন যাচ্ছিলো, তেমনি মনোরম করে দুলে দুলে হেঁটে হিতামকে পার হয়ে গেলো। সেই পথ দিয়ে তারপরে যাচ্ছিল এক বুড়ো মতোন মানুষ যার হাতে দুইটা মোটাতাজা গরুর দড়ি। গরুগুলোকে মোটেই ‘হট হট’ ‘পায়েত্তলে’ করতে হচ্ছিলো না, অথচ তারা শৃঙ্খলার সাথে পাশাপাশি হাঁটছিলো। হিতাম এই সুযোগটাও নিলো, ‘ক্যা বাহে, চাজি, খুবএ ভোক নাগছে গো, একনা ভাত খোয়াইবার পারিমেন?’ ইনিও যেমন যাচ্ছিলেন, তেমনি হাসি হাসি মুখ করে নিজের কাজের দিকে যেতে লাগলেন।

প্রসঙ্গত বলে নেওয় ভালো, আমাদের গ্রামে প্রচলিত গল্পগুলোর বেশিরভাগ চরিত্রই হয়ে থাকে হাসি হাসি মুখের। এই গল্পে হারানো জ্ঞান ফিরে পাবার পর হিতাম যেসমস্ত চরিত্রের মুখোমুখি হয়, তারা সবাই সদাহাস্যময়। যাই হোক, গল্পটি বলে নেওয়া যাক।

তারপর, এক জোয়ান মেয়ে, লাল শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে, গোবরের ডালি বাঁকা কাঙ্খে নিয়ে, একদিকে বাঁকা হয়ে, হাসি হাসি মুখখানি করে, যেন কি এক সুখের স্মৃতি মনে ভাঁজতে ভাঁজতে অইপথ দিয়ে চলেছেন। হিতাম বললো, ‘বু’জান, মুই কাইল থাকিয়ে উপোসোত আছোং...’। সেই মেয়ে হিতামের মুখের পানে চেয়ে খিল খিল করে উঠলেন। তারপর হিতামের কাছে এসে ওর এলোমেলো লালচে চুলের জঙ্গলে বাম হাতের পাঁচ আঙুল চালিয়ে দিয়ে মৃদু ঝাঁকি সৃষ্টি করে হাসতে হাসতে যেদিকে যাবার, কোণাকার কোমরে ঢেউ তুলে, নদীর ঢেউয়ের মতোই, সেইদিকে চলে গেলেন। হিতামের কেমন যেন মাথার ভেতরে রিমঝিম সুর বাজতে বাজতে লাগলো। তার মনে হলো যে এমন সোনালী সকাল দুপুরে না চড়তেই চারিদিকে রাত্রি নেমে এলো, এখন ঘুমোবার সময়। ঝকঝকে পথের কিনারে ঢলে পড়ে চোখ বুজে স্বপ্ন দেখতে লাগলো হিতাম। দেখে এক বিবেকবেশী সাধু তাকে কানের কাছে আস্তে আস্তে বলছে যে, সে রাস্তা ভুল করে এমন এক ভিনগাঁয়ে প্রবেশ করেছে, যেখানকার সবকিছু সাধারণ সমাজের থেকে অন্যরকম। সেখানকার সমাজে মানুষের জীবন গুটিকয় শব্দ আর অল্পকিছু অসামান্য সুখানুভূতির সমন্বয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেখানকার সমাজে নঞর্থক কিছু নেই।

এরপর হলো কি, দুপুর গড়ালো। হিতামের স্বপ্নভঙ্গ হলো। তখন যে কুমারী মেয়েরা দূরের ঘাট থেকে কল কল করতে করতে ভেজা কাপড়ে অই পথ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো, তারা একটুখানি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালো। যেন কি মজার ব্যাপার! তাই তারা হাসতে হাসতে রাস্তায় গড়িয়ে পড়লো। তাদের ভেজা গায়ে ধূলিকণা লেগে গিয়ে জড়ির মতো ঝকমক করতে লাগলো। তারা এ ওর গায়ে চিমটি কেটে বলতে লাগলো, ‘ইহাকে ভ্রাতা-ভ্রাতা লাগে’।

এই গল্পের যে স্থানে হিতামের অবচেতন অনুপ্রবেশ ঘটে, সেখানে যেকোন আগন্তুক ‘ভ্রাতা’ সম্বোধনে সম্বোধিত হয়। কোন জনেরই গাঁয়ের লোকেরা নাম রাখতে জানে না, শব্দ-সংকট হেতু। সেকারণে কুমারীরা ‘পুষ্প’ নামে আর কৌমার্য যাদের ঘোচে, তারা ‘নারী’ নামে চিহ্নিত হয়। পুং লিঙ্গের সকল মানব ‘পুরুষ’ নামে পরিচিত হয়। অবশ্য এই গ্রামে প্রচলিত আরো অনেক বহুমাত্রিক শব্দ গল্পের ধারাবাহিকতায় নিশ্চয় বোধগম্য হবে। আমাকে অবশ্য, যেহেতু আমার মেধা নিয়ে সংশয় আছে, টুরু ভাই সবকিছু ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন। যাইহোক...

একজন পুষ্প কহিলো, ‘কালক্ষেপন মন্দ, নির্মাণ রহিয়াছে’। সাথে সাথেই তারা সব কলকল করতে করতে হাত ধরাধরি করে চলে গেলো। হিতাম রিমঝিম সুর-মূর্ছনা করোটিতে নিয়ে আবার ঘুমের অতলে ডুবে গেলো। সময় গড়ালো। বিকেলের রঙ নিভে যাবার আগে উজ্জ্বলতর হতে লাগলো। এদিক দিয়েই তখন সেই কুমারী মেয়েরা ডাঙ্গুলি খেলতে চলেছে। তাদের একজনের অস্থির সফেদ হাত ‘চেঙ্গু’ ও পেন্টি’ নাচাচ্ছিলো। প্রত্যেকের ডুরে শাড়ি হাঁটুর কাছে তোলা করে পরিধান করা এবং কোমরে আঁচল পেঁচানো। কিন্তু এইখানে এসে তাদের নাচন, ছন্দময় চলা থেমে গেলো। তারা এবার হাসলো না। কথা বললো না। এ ওকে চিমটি কাটলো না। কেবলমাত্র দুই গালে দুই হাতের তর্জনী দিয়ে চিন্তা করার ভঙ্গিতে ঠেস দিয়ে নিজের মনে অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলো, ‘পুরুষখানা এখনো মরে!’  শেষে একজন সদ্যযৌবনা বলে ওঠে, ‘ইহাকে সর্বাধিক নির্মাণক্ষম পুরুষের মাটিতে মারিয়া দিই’। তাতে করে সব মেয়েরা মিলে হিতামকে উচ্চতা সাপেক্ষে কেউ হাতে, কেউ কাঁধে, কেউ মাথায় তুলে নিয়ে কলকল করতে করতে একটা সুদৃশ্য মাটি, অর্থাৎ মাটির ঘরে উপস্থিত হয়। সেইখানে মিহি করে বোনা এক শীতলপাটিতে শোয়ানো মাত্রই হিতামের ঘুম ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। উচ্চারিত শব্দগুলো বুঝলেও হিতাম ওদের কথার পুরো ভাব বুঝতে পারে না। শুধুমাত্র এই দেখে খুশি হয় যে সেই বুড়ো মতোন লোকটা ওর দিকে বড় মাছের মুড়ো দিয়ে সাজানো ভাপ ওঠা ভাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভ্রাতা, অমৃত লইয়া মরো। সুখ হইবে।’ বাস্তবিক হিতাম তখন এমন ক্ষুধার্ত যে, কোনো দুর্বোধ্যেরই অর্থ ভাবতে যাওয়ার অবকাশ তার ছিলো না। গোগ্রাসে ভাতের কাড়া তুলে মুখে দিতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন করতে লাগলো আমাদের গ্রামের ফেল করা হিতাম।

সেই ক্ষণে কুমারীদের চোখে-মুখে ক্রোধ ফুটে উঠলো পষ্ট হয়ে। (বৃদ্ধ) পুরুষের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠলো ঘৃণা। তারা সবাই বলাবলি করলো, ‘এ অসভ্য! এ অপুরুষ!’ হিতাম তো আর খেতে পারে না। না-চিবোনো ভাতের কাড়া মুখের মধ্যে নিয়ে হা হয়ে থাকলো। তাদের রুষ্টতার কারণ হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘বয়া হন না, বাহে, উদিনক্যা থাকিয়ে মুই উপোসোত আছোং’। শুনে তাদের বলাবলি স্তব্ধ হয়ে গেলো। কুমারীরা আবার দুই গালে দুই হাতের তর্জনীর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। অর্থাৎ, তারা ভাবতে লাগলো। ভেবে কোন কুল-কিনারা তারা পেলো কিনা তা তারাই বলতে পারবে, তা বোঝা আমাদের সমাজের কারো পক্ষেই বোধকরি সম্ভব নয়। তবে, তাদের দেহের ভঙ্গিতে আনন্দ উদ্বেলিত হলো।

এই আনন্দের কারণ একটু পরেই আমরা বুঝতে পারবো।

এখন, (বৃদ্ধ) পুরুষ বললেন, ‘মরিয়া লও, সুখ হইবে, ভ্রাতা’। কুমারীদের একজন ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো, ‘আরে বোকা পুরুষ, ঘুমাও, ঘুমাও, ভালো লাগবে’ এবং ভ্রূকুটি প্রদর্শন করলো।

এদিকে, সন্ধ্যাকালের সামান্য পরে, ভ্রূকুটি করা সেই কুমারী সুগন্ধী ভাত আর হরেক পদের তরকারীর সমাহারে সজ্জিত গোলাকার পাতার বাসন নিয়ে হিতামের সিথানে উপস্থিত হয়ে রিণঝিন শব্দে চুড়ি বাজিয়ে চললো। চোখ খুলে হিতাম আলি দেখতে পেলো যে, জোৎস্না ঝলোমলো করে তুলেছে সমস্ত জগৎ। কুমারীরা, নারীরা, পুরুষেরা গান গেয়ে ওদিক-এদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। যেন সে এক বিশেষ উৎসবের রাত। আপনাদের খুলেই বলি, সেটা ছিলো সেই অদ্ভূত গাঁয়ের সকল পুস্পদের নারী হয়ে ফুটে উঠবার রাত। কিন্তু পুষ্পদের সংখ্যার তুলনায় একজন পুরুষ কম পড়ে গিয়েছিলো। সেখানকার এমন রীতি যে অতিরিক্ত পুষ্প সেদিন হাসতে হাসতে নদীর স্রোতে ভেসে যাবে। ভেসে ভেসে সেই পুষ্প, অর্থাৎ, কুমারী কোথায় যাবে সেটা কিন্তু কেউ জানে না। তবে টুরু ভাইয়ের ধারণা সেই কুমারীকে ঘিরে অন্য কোনো ভাটির গাঁয়ে আরেকটা গল্প তৈরি হয়ে থাকবে হয়তো। সে কুমারীর রূপে আর বুদ্ধিতে ভরে উঠে থাকবে হয়তো সেই গাঁও।

তো আসল গল্পে ফিরে আসি।

হিতাম সেদিন সেই গাঁয়ে উপস্থিত থাকায় কোনো পুষ্পকে আর ভাসতে হলো না নদীর স্রোতে। তাইতো গাঁয়ে এতো আনন্দের বন্যা। এত গান বহু বছর হয় নি সেখানে।

তারপর, চুড়িতে সুরের মূর্ছনা তোলা সেই পুষ্প হিতামের বিস্ময়-বিমুগ্ধ হা-মুখে পাতার থালা থেকে অমৃত তুলে দেয় এক চিমটি। আঁচল দিয়ে হিতামের মুখ কতো যত্ন করেই না মুছে দেয়। তারপর বলে, ‘আমাকে নির্মাণ করো! অন্যথায় আমি চির-মরিব’। তারপর, নিরাভরণ হতে হতে হতে হতে কুমারীর দেহপল্ল­বের রঙ গোলাপী আভায় রঞ্জিত হয়। হিতাম বলে, ‘মোর কথা শোনেন, বাহে। মুই তো গোস্যা করিয়া বাড়ি-ঘর ছাড়ি আইচ্চোং। মোর ভিতি ভরসা না করেন। মুই এলাও নয় কেলাস পাশ দিবের না পাইছোং, বাহে’। কুমারী দাঁড়িয়ে উঠে দুই গালে দুই হাতের তর্জনীর ঠেস দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, সে ভাবতে লেগে যায়।

টুরু ভাই আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর দাদা এই পর্যন্ত বলার পর শিশুদের  শিশুশিক্ষা থেকে পাঠ দিতেন এবং সে পাঠ মুখস্ত বলতে পারলেই গল্পের বাকি অংশ তিনি বলবেন। কিন্তু, তারপর এক পর্যায়ে টুরু ভাইয়ের দাদার কি দশা হয় সে কথা তো এই গল্পের শুরুতেই সবাই জেনেছেন। বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার। তবে এ কথা সত্যি যে, হিতামকে আমাদের গ্রামে আর কখনোই দেখা যায় নি।

গল্পগ্রন্থ: গ্রামে প্রচলিত গল্প (২০০৯)


লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
নূরুননবী শান্ত (জন্ম ১৯৭১)
নূরুননবী শান্ত গল্পকার, অনুবাদক ও আবৃত্তিশিল্পী। জন্মস্থান বগুড়া হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে রংপুর ও ঠাকুরগাও জেলায়।  পেশায় উন্নয়নকর্মী। প্রান্তিক মানুষের জীবন আচার সংস্কৃতি সমস্যা নিয়ে দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লেখালেখি করেন। কৈশোরে কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও গল্প লেখা শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়। প্রথম গল্প, ‘সুখলোকে যাত্রা’ শাশ্বতিক পত্রিকায় ছাপা হয়।
প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: গ্রামে প্রচলিত গল্প (২০০৯)।
প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থ: রাস্তা (২০১১); মেঘের ওপারে আকাশ (২০১৪); প্রিয় দুঃস্বপ্ন (২০১৭)।
প্রবন্ধ-সংকলন: প্রান্তকথা (২০১৯)।








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ