bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

দেশভাগ: সংকীর্ণ রাজনীতি, জাতীয়তা ও সংস্কৃতিচেতনার বহুচ্ছিন্ন বৈজয়ন্তী ꘡ শামীম সাঈদ






বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা, তা ব্যক্তির, দলের, সম্প্রদায়ের কিংবা মহৎ-সমষ্টির; প্রকৃতপক্ষে তা মানুষের সংকট। দেশ-কালের গণ্ডিকে ছাড়িয়ে এটি প্রকৃতই সামগ্রিক মানুষেরই সংকট। প্রসঙ্গটি না জাতীয়তার, না সাম্প্রদায়িকতার। কিন্তু এই বিষয়গুলোই মানুষের অস্তিত্বের অংশ হয়ে, চেতনায় প্রকটরূপে বিরাজ করে, করছে। বিরাজ করছে সংকীর্ণতার সুরত নিয়ে। কিন্তু, মানুষ তো অনুসন্ধান করে ফিরেছে, অনুসন্ধান করছে তার সংহতির সূত্র, ঐক্যের চাবিকাঠি। যা কিছুই তার ঐক্য ও সংহতির মৌল উপাদান, তাই যেন আজ মানুষের প্রধানতম দুর্বলতা। মানুষের বৈচিত্র্যময়, স্বাতন্ত্র্যময় স্বরূপ চিহ্নিত করণের যেটি স্মারক, সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বিভাজনরেখা। সম্ভবত, এটিকে সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে না দেখলে, সংকটটির প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হবে না। আলোচ্যে বিভাজনের বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিত প্রত্যয় ‘দেশভাগ’। এই প্রত্যয়টির সাথে যুক্ত ‘দেশ’ ও ‘ভাগ’ সুনির্দিষ্ট দুটি শব্দমাত্র নয়, বরং এই শব্দ দুটির ধারণাকাঠামোর সাথে যুক্ত আরো প্রত্যয়সমূহ যা এই ‘দেশ’ ধারণা ও বোধের বাহিরান্তরকে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উপকরণে বিশ্লিষ্ট করে দেখাবে। এবং এই স্বতন্ত্র শব্দ দুটিও স্বতন্ত্র দুটি প্রত্যয়ও বটে। সুতরাং সমাজবিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি ব্যতিত বক্তব্যসংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে বুঝতে পারা সহজ নয়, হয়তো বোঝা সম্ভবও নয়। কেননা, দেশ প্রত্যয়টি একক ভাবেই যতোগুলো প্রত্যয়গত অন্বয় নিয়ে স্বয়ং স্বরূপতায় প্রকাশিত, সেই প্রত্যয়সমূহই আবার স্বয়ং স্বতন্ত্রতায় ব্যাপত্ত ও নিবিষ্ট মনোযোগ দাবী করে পাঠে ও অনুসন্ধানে। এবং শব্দবন্ধে যুক্ত ‘বিভাজন’ অর্থবাচকতার ‘ভাগ’ শব্দটিও, যা কিছুতেই দ্ব্যর্থকতাহীন নয়, ফলে সেটির প্রতিও ভিন্নার্থক দৃষ্টিকোণসমূহ সমাজে প্রচল রয়েছে। ফলত, কেবল ‘দেশভাগ’ ধারণাটির মধ্যে আদতেই কোনো নির্দিষ্টতার ইঙ্গিত নেই। বহুবিধ প্রত্যয়গত বোধের উন্মোচন ও স্পষ্টিকরণের ভিতর দিয়ে দেশ ধারণাটি নিজস্ব স্বারূপে উদ্ভাসিত হলেই কেবল সংকটের মূলে যেতে পারা যাবে বলে ধারণা করি। প্রসঙ্গটি মূলত বিভাজনের। বিভাজন দেশের। এবং এই ‘দেশ’ ধারণাটি একই সাথে মানুষের স্বতন্ত্রতা, বৈচিত্র্য ও সংহতি বোধের ধারক। কিন্তু দেশের বিপরীতে থাকে আরো দেশ, মানুষের বিপরীতে বিরাজিত আরো মানুষ। দেশ ধারণার সাথে যুক্ত ভূখ-, ভূগোলগত রূপরেখা, সীমানার ধারণা, নাগরিকতার বোধ, রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া, ক্ষমতার আত্মজ প্রবণতা এবং সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মানুষসংশ্লিষ্ট ক্রিয়া-প্রক্রিয়া ও প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সামষ্টিক ফলাফলগত নতুন সমাজ-রাষ্ট্রিক উন্মেষ। আর এই সমাজ-রাষ্ট্রিক ব্যাপ্তির ভিতর মানুষেরা মূলত তাদের বৈচিত্র্যের, স্বাতন্ত্র্যের দাবীতে বিচ্ছিন্ন হয়; বিভাজিত হয় বিপরীতরূপে ঐক্যের নামে, সংহত হওয়ার মানসে। সুতরাং মানুষের চেতনায়, প্রকৃতিতে সর্বদা এক অনির্ণেয়, প্রতিকারহীন বৈপরিত্য বিরাজ করে। মানুষ বৈপরিত্যে বসবাস করে, বাস করে দ্বন্দ্বের ভিতর, দূরত্ব ও নৈকট্যের বিপরীতমুখী প্রবণতায়। সুতরাং এই সংকটের দার্শনিক অনুসন্ধান হওয়া জরুরি, কিন্তু, দার্শনিক অনুসন্ধানটিকে অন্য পরিসরের জন্য তুলে রেখে বরং এর সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানেই এখানে নিবিষ্ট হওয়া যাক!

পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত তাদের নিজেদের সম্পর্কে পারস্পরিক সামগ্রিক অভিজ্ঞতাজাত ধারণাসমূহ অর্থগতব্যঞ্জনায় ও স্বরূপতায় পূর্ণতা লাভ করে নি, স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। এর প্রধানতম কারণ হলো মানুষেরা বহুধা বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন। তাদের বিচ্ছিন্নতা ভৌগলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং এতদজাত মানসকাঠামোগত। বিশ্বজুড়ে তারা বিচ্ছিন্ন বটে নানান দলে-উপদলে, সমাজে, রাষ্ট্রে কিংবা সম্প্রদায়ে; কিন্তু বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তারা পরস্পরের প্রভাব মুক্তও নয় কিছুতেই আর অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নিজেদের মধ্যে সংহত। তারা সংহতিপ্রিয় বটে, নিঃসন্দেহে; কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন মানুষেরা (দলে-উপদলে, সমাজে, রাষ্ট্রে কিংবা সম্প্রদায়ে) সর্বদা পরস্পরের সংস্পর্শে এসেছে যে সংহতির খাতিরেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, বরং তারা সংঘাত প্রবণতায়, লুণ্ঠনমানসে এবং সাম্রাজ্যিক উচ্চাভিলাষে লড়াই-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতেও পরস্পরের কাছে এসেছে, এ-ও অনস্বীকার্য সত্য। মানুষের জন্য, আদিতে যে সংগ্রামটি ছিলো প্রধানত প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে, কিন্তু সমাজ বিকাশের ধারায় মানুষ অন্য আরেক প্রকৃতির প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এই প্রকৃতি হলো মানুষের নিজস্ব প্রকৃতি, প্রবণতা, সহজাততা তথা মানুষ-প্রকৃতি। এই মানুষ-প্রকৃতি বা মানুষ-সত্তা যা অবধারিতরূপে আরেকটি সত্তার জন্ম দিয়েছে। এই সত্তা হলো মানুষের সমাজসত্তা যার স্বরূপ প্রকাশ পায় মানুষের সংস্কৃতিরূপে। এবং এটি মানুষ-সত্তা থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন কোনো অস্তিত্ব নয়, মানুষের সমাজসত্তা তথা সংস্কৃতি মানুষসত্তা তথা মানুষপ্রকৃতিরই বাহ্যিক ক্রিয়ারূপ এবং বরং তা মানুষের দ্বৈতসত্তার সমষ্টিগত প্রতিরূপ। বিশ্বপ্রকৃতির অংশে মানুষ সংগ্রামশীল। সংগ্রামশীল তার দ্বৈত সত্তা নিয়েও, দ্বৈতসত্তা অন্তর্গত দ্বন্দ্বে সর্বদা ক্রিয়াশীল। এই দ্বন্দ্বের স্বরূপরি এমন; প্রথমত, মানুষের মানুষ-সত্তাই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে/ভিতরে অস্তিত্বের সংগ্রামে (এখানে বিশ্বপ্রকৃতির সমগ্র ও অংশও পরস্পর দ্বন্দ্বশীল) সমাজ-সংস্কৃতিকে রূপায়িত করে চলে, কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই সমাজসত্তাই আবার মানুষকে তার মানুষ-সত্তার বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষ-সত্তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্যে রূপান্তর ঘটাতে সচল হয়ে ওঠে এবং তাতে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কাঠামো দান করতেও প্রভাবক হয়ে ওঠ। মনুষ্য প্রকৃতির বিচিত্রতা ও সমাজসত্তার বিচিত্রতার যে পারস্পরিক ও বিপরীতমুখী ক্রিয়াশীলতা যা প্রকারান্তরে প্রতিক্রিয়াশীলতা, তা মানুষের অন্তর-বাহিরে দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। মানুষপ্রকৃতিকে কেবল প্রকৃষ্টরূপে চেনা যায় তার দ্বন্দ্ব প্রবণতায়। এখানে, দেশভাগের আলোচ্যের পরিসরে এই মানুস-সত্তা ও তার সামাজিক সত্তা প্রসঙ্গটির অবতারণার কারণ হলো এই যে, পৃথিবীজুড়েই স্থান ও কালের ভেদে মানুষের সমাজসত্তা তথা সংস্কৃতির বহু স্বতন্ত্ররূপ বা বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। আর এই বৈচিত্র্যের নিরিখেই আন্তঃসাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বও ক্রিয়াশীল। দেশভাগের আলোচনায় এই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বই বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। যেকোনো কাল ও ভৌগলিক পরিসরেই ‘দেশভাগ’ মানুষের বহুমুখী ও বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের পরিণতি। সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব অন্যতম। সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে আলোচ্য এই কারণে যে তা মানুষের সত্তারূপ ও সংহতির সূত্র। এই দ্বন্দ্বের মূলে অন্যতম প্রধান নিয়ামক মানুষের জীবিকা, বাসস্থান বা ঠিকানা, পরিচয় তথা তার অস্তিত্বের সংকট। সংকট মোকাবেলার মানসে মানুষের বিরোধাবস্থান স্বয়ং সেই সংহতিকে শিথিল করে দেয়।

প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামপ্রক্রিয়া নানান সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিকে মানুষকে সংহত করেছিলো বটে, কিন্তু সংহত হবার ফলেই তাদের আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসাটিও সম্মুখে আসে প্রকট রূপে, স্বতন্ত্রতার স্মারকে ও বিভাজক রূপে। এই বিভাজন সমাজ বিকাশের ধারায় জটিলতর স্তরেরই কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য। আর আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসাটিও তাদের উপলব্ধ হয়, তাদের বিভাজনজাত স্বাতন্ত্র্যচেতনা জাগ্রত হবার পরিণতি হিসেবে। কিংবা এও কি বলা যায় না যে, মানুষের স্বাতন্ত্র্যবোধই তাকে বিভাজিত করছে? জিজ্ঞাসার উত্তর অনুসন্ধানের ফাঁকে এই সিদ্ধান্তে নিঃসন্দেহেই আসা যায় যে, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও বিভাজনমানস কিছুতেই বিসমসাময়িক নয়, বরং তা যুগপৎ ব্যাপার, মানুষের মানুষসত্তায় ও সমাজবাস্তবতায়। কিন্তু, নিশ্চয়ই, এই স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগ্রত হওয়ার ঘটনা মানুষের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচকই ছিলো আদিতে। কেননা, আদিতে মানুষের মধ্যে বিশিষ্টরূপে রাজনীতিচেতনার কোনো প্রকাশ দেখা যায় নি। মহান রাষ্ট্রচিন্তক এ্যারিস্টটল মানুষকে জন্মসূত্রেই রাজনৈতিক প্রাণী বলে যে দাবী করেন, তা এখন নিশ্চয়ই বহুমুখী প্রশ্নের অভিঘাতে পূর্বের মতো আর সুরক্ষিত নয়। কীভাবে সমাজ-বিকাশের সাথে মানুষের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও মানসজটিলতার ক্রমাগ্রগমন হয়েছে, তা সমাজতত্ত্ব ও তাত্ত্বিকগণ অতিবিশদেই তুলে এনেছেন আমাদের জ্ঞানপরিমণ্ডলে। সুতরাং মানুষের রাজনৈতিক প্রাণী হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার বির্বতনমূলক দীর্ঘ কালপরম্পরা, তার উপস্থান এখানে বাহুল্য জ্ঞান করেই এড়িয়ে যাওয়া চলে। তবু, সামান্য কথা এই যে, সেখান থেকেই মানুষের আত্মপরিচয় অন্বেষার একটি বির্বতনমূলক পরিক্রমণরেখা পাই। এই বির্বতনমূলক পরিক্রমণ পথেই সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের কালপরিক্রমায় মানুষের আত্মপরিচয়ের নির্ণীতির সাথে আরো কিছু পালক যুক্ত হয়ে নির্মাণ করেছে তার অত্মপরিচয়ের বৈশিষ্ট্যগত বিবেচনা, চিহ্ন ও তার মাত্রাগত তারতম্য। রাজনৈতিক পরিচয়, সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভৌগলিক পরিচয়, সাম্প্রদায়িক পরিচয়, জাতীয়তাবাদী পরিচয়-চিহ্নিত এইসব পালকসমূহই কি স্বাতন্ত্র্য ও বিভাজনের স্মারক নয়? এবং এইসব চিহ্নিত পরিচয়ের প্রত্যেকটির রয়েছে প্রত্যয়গত স্বরূপ, মাত্রা ও স্বরূপগত বিভিন্নতা যা মানুষকে স্বভাবতই করেছে স্বাতন্ত্র্য মনস্কতায় ও বিচ্ছিন্নতাবোধে বহুধা, বিভাজন-চৈতন্যে বিচিত্র সত্তামান। বিচিত্র সত্তার ধারণাটিও মানুষকে অনিবার্যতায় বিভাজিত করে ফেলে, বিভাজিত করে ফেলছে।

বিশ্বজুড়েই বিভাজনের হাজারো উদাহরণ বিদ্যমান। ফলে, এবিষয়ক ভাবনার পরিধিও বিশ্বব্যপ্তই। কিন্তু এসংক্রান্ত ভাবনার পরিধি যা-ই হোক, আলোচনার ব্যপ্তিসীমা আপাতত বৈশ্বিক করা আমার ইচ্ছে নয়। এপর্যায়ে এসে কালসীমার রাশ না টানতে হলেও স্থানিক ক্ষেত্রটি নির্দিষ্ট করা জরুরি। তাই পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে বসে তাই সংকটপরিপ্রেক্ষিত হিসেবে সীমায়িত এই ভারতীয় উপমহাদেশকেই নির্দিষ্ট করা গেলো। চোখ ফেরাতে চাই বিশ শতকের ভারতের দিকে। বিশ শতকের মধ্যভাগের যে ঘটনাটি এখনো পূর্বাপেক্ষাও অধিক, এতদাঞ্চলের মানুষের চিন্তায় ঝড় বইয়ে দিচ্ছে, মানস জগতে ট্রমা হিসেবে স্থায়ী হয়েছে তা মূলত ভারতভাগের বাস্তবতা তথা দেশভাগের বাস্তবতা। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রসঙ্গেই আমাদেরকে বারে বারেই অতীতমুখী হতে হচ্ছে। অতীত মুখে আমাদের অনুসন্ধানী নজর ফেলতে হয় এবং জ্ঞানদৃষ্টি ফেরাতে হয়; কেননা, আমাদের কেবলই মনে হয় যে, বর্তমানের নানান সংকটসমূহের নিদান যেন নিশ্চয়ই সেই ভারতভাগ তথা দেশভাগের কার্য-কারণ বাস্তবতার ভিতরেই নিহিত রয়েছে, আর তার পরিণতি ও উত্তরপরিণতিই আমাদের এই বর্তমানের সংকটকাল। এবং আমাদের বর্তমান সংকটটিও এক পরিচয়সংকটজাত সমাজদ্বন্দ্ব ও তজ্জাত সংঘাতের ফল। আর তার সাথে নিরাময়হীন বিষক্রিয়া ঘটিয়েছিলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রচেতনার ভ্রান্তোপলবদ্ধি। এবং এই ভ্রান্তিরও নিদান অনুসন্ধান জরুরি এবং তা ভারতের মানুষের কয়েক হাজার বছরের সমাজ-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাব ও প্রভাব ধারার বিবর্তন ও বিকাশ পরিক্রমার কোন পর্যায়ে এর সূত্রপাত তারও অনুসন্ধান দরকার। কাল পরিসরের কোনো এক অংশে এ অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক মানসপটে নিশ্চয় তার ছাপসূত্র রয়েছে। এবং এ অঞ্চলের হাজার বছরের উপনিবেশ-বাস্তবতাও সেই সাংস্কৃতিক মানসকাঠামো গঠনে কীভাবে ভূমিকা রেখেছে অথবা রাখে নি, তাও অবশ্যই অনুসন্ধানেয়।

প্রসঙ্গ তো এই-ই, বিভাজন: দেশভাগ; ভারত ভাগ। ভারতীয় সমাজের উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দির সংস্কৃতিকাঠামোর মধ্যে এর সুনির্দিষ্ট কারণ তো ছিলোই। কিন্তু, ভারতের সংস্কৃতিতে উনবিংশ শতকের পূর্বের প্রায় চার হাজার বছরে নানা জাতির আগ্রাসন, উপনিবেশ ও সাংস্কৃতিক যে প্রবাহ, সেই সাংস্কৃতিক প্রবাহের ভিতরেও কি বিভাজনোন্মুখ কোনো প্রবণতা ছিলো? সেটিও অনুসন্দানেয়। আদতে ভারত একটি বৃহৎ সমন্বিত ভূখ- এবং এ অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি চরিত্রগতভাবেই সমন্বয়ধর্মী। এখানে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ছিলো বটে, কিন্তু একটি মূলগত ঐক্যও ছিলো। সেটি কেমন? সেটি হলো ভারতীয় সমাজের ভিত্তিকাঠামোর ঐক্য। ঐক্যের কারণ দীর্ঘকাল পরিসরে এর রূপান্তরহীনতা। ধরা যাক, এ অঞ্চলের বিশেষ ধরনের সমাজব্যবস্থা, হাজার বছরে অপরিবর্তিত সমাজের ভিত্তিকাঠামো অর্থাৎ এশীয় উৎপাদনব্যবস্থার (এসিয়াটিক সোসাইটি) বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক ভিত্তি। যদি বলা হয় যে, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য কিংবা প্রবণতাসমূহ এই এশীয় উৎপাদনব্যবস্থার দীর্ঘ, সহস্র বছরের ধারাবাহিকতা, এটি অনস্বীকার্য প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় কৃষিসভ্যতার কিছু প্রলক্ষণ তো এখনো বর্তমান। ভারতের সেই বিশেষ ভিত্তিকাঠামোটি প্রায় অপরিবর্তিতরূপে বিশ শতক পর্যন্ত টিকে ছিলো। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা কিংবা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মতো প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা একেবারে কখনোই লুপ্ত হয়ে যায় নি, বরং ধ্বংস ও ধ্বংসের থেকে পুনর্নির্মাণ, কখনো স্বকীয় ভিত্তির উপরেই অন্য নতুন সংস্কৃতিকে আত্মিকরণ করেই এর ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে। অতীতের সে ছোট ছোট গ্রাম তথা স্বনির্ভর বিশ ও বিশবাসী বা বৈশ্যগণের সে এক অনড় জীবন ব্যবস্থা ছিলো। বিশের প্রধান বিশপতি, জনের শাসক রাজন; এমনই সামাজিক অনুশাসনিক অঞ্চলের প্রাচীন ভারতের মানুষেরা সমাজ বিকাশের ধারায় সামন্ত, মহাসমন্তের শাসনাধীন হলেও, তারা ছিলো এক অনন্য সাস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যে ঐক্যের বলয়ে। এই ঐক্য ছিলো সামাজিক ও জীবন-জীবিকার পদ্ধতিতে। ঐক্যের ভিতরে বৈচিত্র্যেরও অনুসন্ধান মেলা দুষ্কর ছিলো না অবশ্য। বৈচিত্র্যের কার্যকারণও বহুবিধ। অন্যতম সাংস্কৃতিক, সাম্রাজ্যিক আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক মিশ্রন। ভারতের সমাজের অনড় প্রায় ভিত্তিকাঠামোর এই ঐক্যের ভিতরেও ভারতের মানুষ ব্যাপক সাংস্কৃতিক মিশ্রণের স্বীকার হয়েছে। এ সংস্কৃতি তার উদরে ধারণ করেছে নানান বিশ্বাস, রীতি-আচার-অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, সাহিত্য-শিল্পের বিচিত্র ধারা ও সমাজ বিকাশের বহু স্তরের বৈচিত্র্যময় দর্শন। এবং এটি মান্য যে, এই সমন্বয়ধর্মীতা ও বৈচিত্র্যে ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টাও প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চলের শাসক ও শাসিতের অস্তিত্বের স্বার্থে অনিবার্য সাংস্কৃতিক অভিযোজন প্রয়াস, স্বীকার্যে দ্বিধা নেই। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ভারত মূলত দ্বন্দ্বমুখর বাস্তবতার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ভারতে বহুজাতির উপনিবেশ হয়েছে। আর উপনিবেশ সৃষ্টিকারী বিজয়ীগণ এদেশের মানুষের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নানাবিধ রূপান্তর ঘটিয়েছে। তবে, তারা যেমন সম্পূর্ণ নিজেদের সংস্কৃতি এখানে প্রতিস্থাপন করতে পারে নি, তেমনই এদেশের মানুষের সংস্কৃতিকেও পুরোটা গ্রহণ করে নি বা করতে সক্ষম হয় নি। ফলে, সুদূর অতীত থেকেই ভারতীয় সমাজে সংস্কৃতির তিনটি রূপগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়১ প্রথমটি ভারতের অভিজাতদের সংস্কৃতি। এই অভিজাতরা সাধারণত সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ বটে, কিন্তু তারা সকলেই শাসক শ্রেণির নয়, বরং তাদের কেউ কেউ শাসনপ্রক্রিয়ায় সুবিধাভোগী ও সহযোগি এবং তাদের অনেকেই বিদেশীও। কিন্তু সমাজে সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও এরাই সমাজের উপরিকাঠামো নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নশ্রেণির মানুষের যাপনজাত। যদিও এরা-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংস্কৃতির ভিত্তিকাঠামোর এরা রূপকার কিন্তু নিয়ন্ত্রক নয়। এরা মূলত শাসিত ও শোষিত শ্রেণি। তৃতীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো বিদেশী তথা ঔপনিবেশিকদের প্রভাবের উপজাত। এই প্রভাবটি ছিলো নিশ্চিতরূপেই দ্বিপাক্ষিক, গ্রহণ-বর্জনের। কিন্তু, এই সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ যে সর্বদাই শান্তিপূর্ণ ছিলো তা মোটেই নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিলো বল প্রয়োগের মাধ্যমে। বলা যেতে পারে, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভাব, বলপ্রয়োগ ও সংঘাতই সাংস্কৃতিক সমন্বয় প্রবণতার তথা বৈচিত্র্যে ঐক্য প্রচেষ্টার কার্যকারণগত পরিভাষা। আর এই বৈচিত্র্য ও ঐক্য প্রচেষ্টা অনেকটাই কেবল উপরিকাঠামোগত তথা সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আগ্রাসনের সাথে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হলেও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও দেশীয়-বিদেশীয় পারস্পরিক সমঝতারূপে সমন্বয়সাধনে এগিয়েছে ভারতের মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতি। শুধু বিদেশী নয়, ভারতের অঞ্চলভিত্তিক শাসক যারা ছিলেন, ছোট কিংবা বৃহৎ সামন্ত, মহাসামন্তগণও অভ্যন্তরীণ দখলদারিত্বে সক্রিয় ছিলো। তারাও আন্তঃআঞ্চলিক সংস্কৃতির মধ্যে প্রভুত্বসুলভ প্রভাবে নিয়ন্ত্রক হতে চেষ্টা করেছে, সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটিয়েছে। কিন্তু, তার পরেও এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা নানারূপে প্রবাহিত হয়েছে, এবং আজ পর্যন্তও তার স্বকীয়তার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পূর্ণত বিলুপ্ত হয় নি, তার অনেকগুলোই টিকে আছে এবং তা রূপান্তরিত অবয়বেও চেনা যায়। আর, কালে কালে এ অঞ্চলের শাসক বর্গের চরিত্র, শাসনমানস ও অভিপ্রায় যা ছিলো, তা যা-ই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের জৈবনিক প্রবণতা ও মানসিক স্থিতি ছিলো সম্প্রীতি ও সহাবস্থানোন্মুখ। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও সে অঞ্চলসমূহ আলাদা করেই স্বতন্ত্র ও স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়ে সমুন্নত থাকতে সক্ষম হয়েছে এবং থেকেছে, দ্বন্দ্ববাস্ততার মধ্যদিয়েও। সংঘাতসংকুল সময় পার করেছে তারা কিন্তু, কালপরম্পরার ব্যপ্তিতে তাদের সাংস্কৃতিক-স্বাতন্ত্র্যের অভিব্যক্তি কখনোই বিভাজনমূলক হয় নি। নিশ্চয় বিভাজনের বীজটি অন্য ভাবে, অন্য কোনো কালে রোপিত হয়েছিলো।

অনুসন্ধান মানসে ঘটনা ও প্রসঙ্গের অকুস্থলেই আসা জরুরি। ভারতভাগের কাল বিংশ শতক, প্রাসঙ্গিক অনুসন্ধানে না হয় আবারো কালসুত্রে পশ্চাৎমুখী হওয়া যাবে। এখন কথা বিশ শতকের। সবারই সম্ভবত জানা কথা, ভারতসমাজে একটি বাজার প্রচল কথা আছে, বলা হয়ে থাকে যে, ভারত ভাগ হয়েছিলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। এটি কি ইতিহাসেরও সত্য, নাকি এ-সংক্রান্ত সত্যের স্বরূপটি অন্য রকম? সংকটটি কি তবে দুটি স্বতন্ত্র ‘জাতীয়তাবোধের’ উন্মেষে? কিংবা, সেটি দ্বিজাতিত্বের বোধ না হয়েও কেবল স্বয়ং জাতিত্বের বোধটিই কি সংকটের স্বরূপ অন্তরে ধারণ করছে? এই আলোচ্যে প্রাসঙ্গিকতায় এই জিজ্ঞাসাসমূহ উঠে এসেছে। জাতি, দ্বিজাতি কিংবা বহুজাতি; সংকট আসলে প্রতিটি স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচয়জ্ঞাপক প্রত্যয়ের ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো, ইতিহাস এমনই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু দ্বিজাতিত্বই কি সংকট? আধুনিক কালে জাতীয়তাবোধ যদিও সংকীর্ণতার স্মারক, বিভেদবাচক। আর জাতীয়তাবোধের উন্মেষই হয় স্বতন্ত্র হয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে, বিপক্ষ বা প্রতিপক্ষের বিপরীত পক্ষ হয়ে। তবু, জাতি এক বা একাধিক হওয়াটা সঙ্কটের কারণ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় মোটেই যা হয়েছে ভারতবর্ষে, কেন না, জাতীয়তার একটি উদার বাহ্যাভিব্যক্তিও আছে আর বিশ্বে বহু জাতি তাদের স্বতন্ত্রতা নিয়ে টিকে রয়েছে তাদের ভূমির অখণ্ডতা নিয়েই। একই ভূখণ্ডের ভিতরেই সার্বভৌমতায় বহু জাতির বসবাস দুর্লভ নয় পৃথিবীর ইতিহাসে। এবং ভারতবর্ষেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে স্বাতন্ত্র্যে সমন্বয় ও বৈচিত্র্যে ঐক্য স্থাপিত হতে দেখেছি। তাহলে এই আধুনিককালে ভারতে এই বিভাজন কেন? কি সমস্যা ভারতের সমাজ-রাষ্ট্রিক বাস্তবতায়?

মানুষের আধুনিকতম দল কিংবা সম্প্রদায়গত স্বতন্ত্রতাসূচক ও আত্ম-পরিচয়মূলক প্রত্যয় ‘জাতি’। আর ভারত তো বহু জাতির সমন্বিত ভূমি। তবে, এই কেবল দ্বিজাতিত্বের দাবীটি কেন ভারতে? সংকটটি এখানেই না-কি জাতিত্ব চিহ্নিত করণের ভিত্তিবোধে? প্রতিটি জাতির জাতীয়তাবোধের একটি ভিত্তিগত বোধ থাকে। জাতীয়তা নামের বৃক্ষটি একদল মানুষের ঐতিহ্যের ভিতর থেকে অঙ্কুরিত হয়। তার ভিত্তি ভাষা হতে পারে, সংস্কৃতি হতে পারে, নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হতে পারে কিংবা হতে পারে ভূমিভিত্তিক পরিচয়ও। আর ভারতের ক্ষেত্রেও জাতিগত সংহতি ও বিভাজনের মূলে রয়েছে জাতিত্ব বোধের বিশেষ ধারণা। কিন্তু উনবিংশ শতকে ভারতে বহু জাতিত্বসূচক আদর্শ ও মতধারা থাকা সত্ত্বেও যে আদর্শ ও মতধারা দিয়ে জাতিত্ব চিহ্নিত হলো তা যে কিছু সংকীর্ণ সেটি এখন নিশ্চিত করে, বাজি ধরে বলা যায়, কেন না, তা সংস্কৃতির একটি সংকীর্ণ অংশ মাত্র, এবং তা সামগ্রিক সংস্কৃতিকে মোটেই ধারণ করে না। উনসাংস্কৃতিক এই উপাদানটিই ভারতের মানুষের জাতিগত সংহতিতে যেমন শক্তির পরিচায়ক তেমনই দুর্বলতা ও বিভাজনের বীজ। আর জাতীয়তা নির্ধারণ করতে ভারতে মানুষের বিশেষ বিভ্রাট তৈরি হয়েছিলো। বিভ্রাটটি ছিলো এই যে, প্রকৃতপক্ষে কীসের ভিত্তিত্বে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের জাতিগত পরিচয় চিহ্নিত করা হবে, এই জিজ্ঞাসায়।

উনিশ শতকে, ততোদিনে ভারতের মানুষ সংস্কৃতিগতভাবেই দ্বিধাবিভক্ত হয়েগেছে। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে কয়েকজন ইংরেজ সুশীলই ভারতে ইউরোপীয় আধুনিক জাতীয়তার ধারণাটি এনেছিলো। ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের সে-ই ছিলো অঙ্কুর। কিন্তু, উৎস ও অঙ্কুরকালের ভাবনা ও ধারণাটিও তাদের কাছে দ্বিধাহীন ছিলো না। এখানকার হিন্দু ও মুসলমান, দুই সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্নরূপে সেখান থেকে জাতীয়তার প্রেরণা নিয়েছিলো। হিন্দুগণ জাতীয়তার প্রেরণার প্রশ্নে ভীষণ দ্বিধান্বিত ছিলো। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিলো না। হিন্দুদের দ্বিধা মূলত এই যে, তারা কিসের ভিত্তিতে তাদের জাতীয়তা নির্ধারণ করবে? ইংরেজ সুশীলগণ ভারতীয়দের সামনে তুলে ধরলেন বেদের গৌরব, প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ও দর্শনের মহিমা। ভারতীয়দের তারা আত্মঅহমে দৃঢ় হতে শেখাতে চাইলেন। কিন্তু, ভারতীয়গণ নিলেন সিন্ধুর হিন্দু নাম আর ভাবাদর্শ নিলেন বেদ থেকে। আর কিছু ভারতীয় তো নিলেন গীতা ও মহাভারতের সমাজাদর্শ হিন্দু নামেই। কিন্তু, বিভ্রাট হলো এই যে, হিন্দু বা সিন্ধু একটি আঞ্চলিকতার পরিচায়ক এবং তা খণ্ডিত সাংস্কৃতিক গতিধারার নির্ণায়ক শব্দ যা দিয়ে সমগ্র ভারতের মানুষের জাতীয়তা নির্ধারণ সম্ভব হলো না। যারা বেদের পক্ষে ছিলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে তারাও নিলেন মূলত আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আদর্শ।

 ভারতে জাতীয়তার উন্মেষকালে সংকটটি ছিলো এই যে, বহু দার্শনিক চিন্তার, বহু সমাজ-সাংস্কৃতিক আদর্শের, অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ রীতি-আচার ও মানবিক আদর্শের সমাহারের এবং বহু ধর্মমত ও বিশ্বাসের ভারত সমাজে সমষ্টির সংহতিবাচক জাতীয়তা নির্ধারণ করতে চেষ্টা হলো কেবল একটি কিংবা দুটি ধর্মমতের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ধর্মীতা ও বৈচিত্র্যে ঐক্যের যে পরম্পরাগত প্রবণতা, তাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটানো হলো, তা পরিত্যয্য হলো এই আধুনিক কালে এসে। কিন্তু, হিন্দুদের ভিতরে যেভাবে ধর্মের আদর্শে জাতীয়তা নির্ধারণের চেষ্টা হলো, তা করেও মানুষকে সংহত করা সম্ভব হচ্ছিছিলো না, জাতীয়তাবোধের জোসটা ঠিক আসছিলো না তাদের মধ্যে, এমনকি ধর্মভীরু মানুষদেরকে ধর্মের সংকীর্ণ আদর্শের দোহায় দিয়েও জাতীয়তাবোধে সংহত করা যাচ্ছিলো না। ফলে একটি প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে হয়েছিলো এবং সে প্রতিপক্ষটি ছিলো এদেশীয় মুসলিম সম্প্রদায়, যারা এদেশেরই মানুষ। কিন্তু, জাতীয়তার আদর্শে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে উপনিবেশ থেকে মুক্তির প্রশ্নে প্রতিপক্ষ হবার কথা ছিলো বিদেশী-শাসক ইংরেজকগণই। সাম্প্রদায়িক চেতনার এটি একটি বৈশিষ্ট্য যে, তাদের একটি প্রতিপক্ষ চায়। যদিও আধুনিক জাতীয়তাবাদসমূহও প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িকতাই। কিন্তু, সম্প্রদায়ের পরিচয় যদি হয় ধর্মের পরিচয়ে এবং সেই ধর্মসম্প্রদায় যদি এমন সংঘাত মানসে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রতী হয় ও স্বতন্ত্রতা রক্ষার নামে করতে থাকে প্রতিপক্ষকে অন্যায্য আঘাত, তখন ধর্মাদর্শের মাহাত্ম্য আর থাকে না। ধর্মের ঐশ্বরিক আদর্শ হয় ভূলুণ্ঠিত। এভাবেই হয়েছে ভারতের মানুষের জাতি চেতনার উন্মেষ। এই হলো ভারতীয়দের স্বাধিকার চেতনা আর জাতীয়তাবোধের ভিত্তিচিন্তা। আর জাতীয়তাবোধের ভিত্তি হিসেবে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হিন্দুত্বই প্রাসঙ্গিক, তবে ইসলাম ধর্ম আর মুসলিমরাই বা সে দাবী থেকে দূরে সরে থাকবে কেন? কেন না, ততো দিনে ভারতের আনাচে-কানাচে শুরু হয়ে প্রায় সমগ্র ভারত জুড়েই হাজার বছরের (অষ্টম শতকের শুরু থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ) মুসলিম শাসনের অবদানে মুসলিমদেরও সাংস্কৃতিক ভিত্তিটি মোটেই নড়বড়ে নয় আর। ফলে, এই প্রতিক্রিয়াতেই মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাসকে আশ্রয় করেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের বীজও তখনই অঙ্কুরিত হয়েছে। এই আলোচনায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে ফিরবো যথাপরিসরে। কিন্তু, হায়! ভারতীয়দের আত্মঅধিকার সচেতনতা এই! স্বাধিকারের দাবীতে সংহত হতে গিয়ে সেই বিভাজনের অমোঘ ফাঁদেই তারা ধরাশায়ী। অথবা, সংকট প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা এ-ও হতে পারে-তবে ধর্মের বিকল্প হিসেবে ভারতীয়দের জাতীয়তার ভিত্তিটি কী বা কী কী হতে পারতো? সংস্কৃতি? সেতো পরিবর্তনশীল, নিরন্তর প্রবাহী। আর এমন প্রবাহ কালে কালে বিশ্বে অসংখ্য। কোন দিক থেকে কোন সংস্কৃতির ঢেউ এসে এর গতি, রঙ, রূপসহ বৈশিষ্ট্য বদলে দেয় তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে! ভারতের হাজার বছরের সংস্কৃতিই তো তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সংস্কৃতি ভারতীয়দের জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারলো না। কারণ? প্রাক-আর্য কাল থেকে আজ পর্যন্ত সিন্ধু অববাহিকার হরপ্পা-সভ্যতার (মহেঞ্জোদরোসহ) তথা ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগত স্বরূপ কি একই আছে? তাহলে সিন্ধু, আর্য কিংবা হিন্দু নামের সাংস্কৃতিক পরিচয়েই বা কীভাবে ভারতীয়দের জাতীয়তা স্থির হতে পারে? আর সংস্কৃতির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বৈশিষ্ট্যই বা কীভাবে স্থির থাকতে পারে এর অনিবার্য রূপান্তরশীল প্রবণতার কারণে? আর এ সত্যটিও ভুলবার নয় যে হরপ্পা সভ্যতার উত্তরাধিকার বলতে সমগ্র ভারতবর্ষকেই বোঝানো মোটেই ইতিহাসপ্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে না, কেন না, তা কেবল ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমারেখার ভিতরেই নিদর্শন দিয়েছে ও নির্দেশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলও সমৃদ্ধ সামাজি ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষ্যে উজ্জ্বল এবং এ অঞ্চলও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতার দাবী তুলে জাতিসত্তার নামে আলাদা হতে চাইতে পারে। সংস্কৃতির নামেও ভারত সেই তো বিভাজনের কবলেই পড়ে। ফলে সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ভারতের জাতীয়তা স্থির হওয়া সম্ভব হলো না। আর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে জাতীয়তা স্থির হওয়া আধুনিক কালে এসে মোটেই সহজ নয় কিংবা প্রায় অসম্ভব। এই বিভ্রাট কেবল ভারত নয় বরং পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের জন্যই প্রাসঙ্গিক, কেন না, কোনো অঞ্চলের সংস্কৃতিই খুব বেশিদিন আর তাদের সংস্কৃতির স্বকীয়তা, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না। তবে কি ভৌগলিক সীমারেখা দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক ভূগোলের রেখা দিয়ে অথবা রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যে জাতীয়পরিচয় স্থির হবে? সেও কি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সহস্রাব্দের কাল ব্যপ্তিতে স্থির রাখা সম্ভব? তবে কি ভূখণ্ডের সীমারেখা বদলে গেলেই মানুষের আত্মপরিচয়টিও বদলে যাবে? ফলে দেখা যাচ্ছে, সমন্বয় মানস ও ঐক্য প্রচেষ্টা বিবর্জিত সংহতিবাচক জাতিত্বের চেতনাই স্বয়ং আধুনিক মানুষের জন্য এক মহা সংকটরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এটি ভারতের মানুষদের জন্যও সত্যি। বিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতের সীমারেখার যে কাটাছেঁড়া, তা মানুষের এই সংকটটিকে সামনে নিয়ে আসে, প্রকটরূপে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকে। তাহলে? ধর্মীয় পরিচয়ই কি তবে ভারতীয়দের জাতীয়তার সমাধান ছিলো? তা যে হতে পারে নি ইতিহাসকালে তা প্রমাণ হয়েছে। তাহলে, ভারতীয়দের এই বিভাজন, জাতীয়চেতনার সংকট ও সমাধান আসলে কি কিংবা কোথায়? সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি, এই তিনের কালধারায় কি উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব মিলবে? বিভাজন কি রোধ করা যেতো কিংবা রোধ করা যাবে ভবিষ্যতেও? সংস্কৃতির ভিত্তিতে নিরূপিত জাতীয়তা ভারতকে অখ- রাখতে যথেষ্ট ছিলো না উগ্র স্বাতন্ত্র্যবাদ, বিভাজনকামিতা ও একই সাথে সংহতি চেতনা দিয়ে। কেবলই সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তার নজির, এই আধুনিক কালে, বিশ্বে বিরল। কিংবা, কোথাও আছে কি এমন? ফলত, ভারতেও তার নজির সৃষ্টি হতে পারে নি।

ভারতীয়গণ অতিপ্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহ্যিক জাতিত্বে হিন্দু হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই হিন্দু পরিচয়ও মূলত সিন্ধু অববাহিকার কোল ঘেঁষা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযুক্ত ছিলো খ্যাতি সীমারেখায়, তা ছিলো আঞ্চলিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই পরিচায়ক; সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ নিশ্চয় সে পরিচয়ে চিহ্নিত হতে পারে না। তাও বা যদি করা যেতো, সেক্ষেত্রেও এটি পরিতাপের বিষয় যে, এই মানুষেরা তাদের আদি সভ্যতার স্থানিক পরিচয়জাত যে সিন্ধু বা হিন্দু জাতিয়তা তাও হারিয়ে ফেলেছে। যা টিকে আছে তা মূলত সংকীর্ণ ধর্মমানস। কেন না, হিন্দু শব্দটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠে মানুষের ধর্মচেতনা ও ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির পরিচায়ক। আর এই ধর্মমানসের মধ্যেও মানবিকতা ও ঐশ্বরিক মহানুভবতা রয়েছে সামান্যই। যা আছে তা মূলত সামাজিক স্তর বিন্যাসের সংকীর্ণ রীতিকাঠামো। কিন্তু, এমন সংকীর্ণতা নিয়েও উনিশতকের গোড়াতে ভারতের মানুষ বিভিন্ন অঞ্চল কিংবা প্রদেশ বা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক অঞ্চলের মানুষেরা ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর হয়েও স্বভূমিবোধে কিছু একাত্ম হতে পেরেছিলো এবং অঞ্চলসমূহের মধ্যে যে সংহতির সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিলো তারও কারণ ছিলো ধর্মীয় বোধের ঐক্যই মূলত। সংহত, হিন্দুগণ হিন্দুত্বে, মুসলিমগণ মুসলমানত্বে। অখণ্ড ভারতীয় বোধের সংহতি সেখানে নেই। এবং প্রকৃতই যা বলবার তা হলো, এই সম্ভাবনাটি দেখা গিয়েছিলো মূলত ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকেই। এটি ঘটেছিলো হিন্দু ও মুসলমান, দুই সম্প্রদায় থেকেই কিছু মাত্রাগত তারতম্যে। ভারতে কোথাও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যায় নি, কোনো কালেই। দেশভাগ পূর্বকালে তো নয়-ই। ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তার উদাহরণ মূলত, দেশভাগের পরের বাংলাদেশেই আপাত দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু, এখন বাংলাদেশের যে ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিত্বের চেতনা তা হুমকির সম্মুখীন। কারণ উদারনৈতিক ভাষা-সাংস্কৃতিক যে বাঙালী জাতীয়তাবোধ, তা মার খেয়েছে এ-অঞ্চলের মানুষের সংর্কীণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সমাজ-রাজনৈতিক চেতনার কাছে, হার মেনেছে উদারনৈতিক, মানবিক সংস্কৃতিচেতনা। সংস্কৃতিচেতনা বলতেও যা আছে তাও নেয়া হয়েছে ধর্মচেতনার খোলসে সংকীর্ণ করেই। সংস্কৃতিচেতনার এই সংকীর্ণ স্বরূপটিই প্রকটিত হয়েছিলো ভারতবর্ষে, ভারতভাগের প্রাককালে। আর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সেই অমানবিক সংকীর্ণ খোলস থেকেই বের হতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু, এই দেশটির স্বাধীনতা লাভের যে চেতনাগত ভিত্তি, ধর্মচেতনার সংকীর্ণ খোলস ভেঙে বৃহৎ পরিসরের উদারনৈতিক, মানবিকতাবোধের ভাষা-সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশ প্রবণতা ও প্রচেষ্টা, তারও মুখ থুবড়ে পড়ার বাস্তবতাও দেখতে হয়েছে, হচ্ছেও; খুব বেশি দিন আর তা সুদৃঢ় থাকতে পারে নি।

দেশভাগ বলতে ভারতভাগ, ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান কিংবা আরো স্পষ্ট করে বললে, বাংলা ভাগ, পাঞ্জাব ভাগ, কাশ্মির ভাগের নিরাময়হীন মর্মন্তুদ বাস্তবতা। ঘটনার নিদান রয়েছে সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজতৈকি পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যেই, আর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক বিবেচনাসমূহও অনিবার্য। দেশভাগ বলতে ভূখণ্ডগত বিভাজন না বুঝে বরং বোঝা উচিত সাংস্কৃতিক বিভাজন এবং চূড়ান্তে মানুষেরই বিভাজন। ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা কিংবা সভ্যতা ও ঐতিহ্যের নামে মানুষের বিভাজন। মামুলি ভূখণ্ডের বিভাজন এ কিছুতেই নয়, কেন না, ভূমির সীমানা বিচারে ভারত অখণ্ড ছিলো না কোনো কালেই। তবে, এ অঞ্চলের মানুষেরা ভূমিগত বিভাজনে থেকেও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় অনন্য ঐক্যে বসবাস করেছে কয়েক হাজার বছর ধরে। মনে রাখা দরকার যে, স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য কখনোই বিভাজনের পরিভাষা নয়। বিভিন্ন কালে ভারতের অঞ্চলসমূহের মধ্যে শাসনসীমার অদল-বদল হলেও সেই ভিন্ন ভিন্ন শাসনসীমার মানুষদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈরিতা দেখা যায় নি। সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা কিংবা সভ্যতা ও ঐহিত্যগত চিহ্নের প্রশ্নে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে নি। শাসককুলের মধ্যে সাম্রাজ্যিক লড়াই ছিলো কিন্তু কখনোই গণমানুষের মধ্যে আঞ্চলিক বৈরিতা দেখা যায় নি সাংস্কৃতিক কারণে। কখনোই এই সমস্ত মানুষদের কোনো সীমানার অধীনেই থাকতে বিশেষ অনিহা কিংবা দ্রোহীমানসের প্রকাশ দেখা যায় নি সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতার নামে। সংস্কৃতির বহু রূপান্তর সাধিত হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির যেটি মূল সূত্র, সেটি কখনোই ছিন্ন হয় নি। ভারতীয় সংস্কৃতির রূপটি একটি সামগ্রিক সমন্বিত সংস্কৃতিরই রূপ। নানান উদ্দেশ্যে নানান নৃ-গোষ্ঠী, ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ তাদের মেধা, সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতি নিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু সংস্কৃতির বিশেষ একটি প্রলক্ষণকে প্রাধান্য দিয়ে ভূখণ্ড নয়, প্রধানত জনগোষ্ঠীকে বিভাজিত করেছে, এমন দেখা যায় নি ঊনিশ-বিশ শতকের পূর্বে।

দেশভাগ বিষয়টি আসলে সাংস্কৃতিক তথা মানুষের বিভাজনই। বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে এই যে বিভাজন, সেটিও অবশ্য দুএকশত বছরের সাংস্কৃতিক রূপান্তরের বিশেষ পরিনতি নয়, বরং প্রায় হাজার বছরের রূপান্তরের ফেরের প্রকাশ। কিন্তু, রূপান্তরই কি মূল সমস্যা? তা কিছুতেই নয়। সাংস্কৃতিক রূপান্তর একটি অনিবার্য ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ফলে রূপান্তরে দোষারোপ করা মোটেই উচিত কর্তব্য নয়। তবে? সমস্যাটি অন্যখানে। সমস্যা এই যে, এই দীর্ঘ সময়ের রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও সংর্কীণতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সংকীর্ণ সংস্কৃতি চেতনার বীজ রোপিত হয়েছে, তা অঙ্কুরিত হয়েছে এবং তা বৃদ্ধি পেয়ে ফল দিয়েছে এই বিশ শতকে এসে। ভারতীয় সংস্কৃতির রূপান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একটি বিচ্যুতি ঘটেছিলো। সৃষ্টি, নিমার্ণ, গ্রহণ-বর্জন ও আত্মিকরণই তো সাংস্কৃতিক রূপান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটিই ব্যহত হয়েছিলো। আর তা ঘটেছিলো মুসলমানদের আগমনের ফলেই। কীভাবে? ব্যাখ্যা করছি পরে, তার আগে বলি যে আর্য, শক, হুন, মঙ্গোল কিংবা ইউরোপীয়দের আগমনে সংস্কৃতির রূপান্তর প্রক্রিয়ার স্বাভাবিকতায় কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চলেছে। সাংস্কৃতিক রূপান্তরের রাজনৈতিক প্রচেষ্টসমূহ ক্রিয়াশীল ছিলো সর্বদাই। কিন্তু, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যা ঘটেছে, তা আসলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এবারে বলছি; মুসলমানদের আগমনে সাংস্কৃতিক লেন-দেনটা হতে পারে নি যথা নিয়মে। যেটি ঘটেছে ও ঘটাতে চাওয়া হয়েছে তা ছিলো এক পাক্ষিক প্রভাব প্রচেষ্টা। ভারতে আগত, বিজয়ী তুর্কী, আফগান, ইরানীয় ও তাজিক মুসলমানদের সংস্কৃতিতে বিশিষ্টতা দান করেছিলো তাদের নব্য গৃহীত ধর্মের প্রেরণা। সে ধর্মের বিশিষ্টতা এই যে, এ ধর্ম মূলত স্বমতসর্বস্ব ও পরমতে অবিশ্বাসী অর্থাৎ পরমত গ্রহণে তাদের ধর্মের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। যেখানে ধর্ম সমাজের উপরিকাঠামোর একটি অংশমাত্র, সেখানে মুসলমানদের ধর্মই সমগ্র সংস্কৃতি তথা সমাজব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো, দিক নির্দেশনা দিতে চাইলো এবং অপর সকল মানুষের সংস্কৃতির স্থলে তাদের ধর্মনিষ্ঠ সংস্কৃতি প্রতিস্থাপন করতে চাইলো। মুসলমানদের ধর্মনিষ্ঠ সংস্কৃতিচেতনার এই দিকটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একদা এমন মত পোষণ করেন যে, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের সঙ্গে মেলাবার পথে প্রথম বাধা, ওদের সাথে মিশে না গেলে মেলাবার উপায় নেই।৫ অর্থাৎ কোনো সংস্কৃতির পক্ষে মুসলমানদের সাথে মিশবার একটিই উপায় আর তা হলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বকীয়তাকে সম্পুর্ণরূপে ত্যাগ করে পরিপূর্ণরূপেই মুসলমানদের সংস্কৃতি গ্রহণ করা। বলা যেতে পারে যে, মুসলিম সংস্কৃতি সর্বগ্রাসী।

এটি ইতিহাস স্বীকৃত যে মোটামোটি অষ্টম শতকের শুরু থেকেই ভারতে মুসলমাদেন বিজয়াগমন ঘটতে থাকে। তবে তা ব্যাপক মাত্রায় নয়। কিন্তু, মধ্যএশিয়ার দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতিতের হাতে এই বেগ বৃদ্ধি পেয়েছিলো এবং প্রবল হয়েছিলো। অষ্টম শতকের পূর্বেও মধ্য এশিয়ার জাতিসমূহ বারবারই ভারতের দুর্ভেদ্য দ্বার ভেঙে ঢুকে পড়েছে। তুর্কী, তাতার, মুঘোল ও মঙ্গোল প্রভৃতি জাতিসমূহ এমনিতেই ছিলো যুদ্ধকৌশলে চরম নির্মম ও প্রায় অপ্রতিরোধ্য, সেই সাথে তাদের সমরাদর্শে যুক্ত হয়েছিলো আগ্রাসী সেমেটিক ধর্মের অনুপ্রেরণা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মার খাওয়া, তাড়া খাওয়া যাযাবর সেমেটিক জাতির সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যে রয়েছে চরম উগ্রতার আশ্রয় ও লালন। ফলে তাদের সংস্কৃতিমানস থেকে সৃষ্ট ধর্মটিও যে তেমনই উগ্র হবে সে ব্যাপারে দ্বিধা থাকে না, অন্তত ঐতিহাসিক কার্যকারণেই সে দ্বিধা মনে ঠাঁই পায় না। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো মধ্যএশিয়ার দুর্ধর্ষ, আগ্রাসী যোদ্ধা জাতিসমূহ। ফলে, মধ্যএশিয় মুসলমানদের সাম্রাজ্য বাড়ানোর তৃষ্ণা ও বিশ্বজয়ের অনুপ্রেরণা প্রবল করেছিলো এই সেমেটিক ধর্মটি। আর, ধর্মান্ধতার যে উগ্রতা, তার সাথে অন্য আর সব উগ্রতার তুলনা অসম হয়। মুসলমানদের বিজয়োন্মাদনার প্রকৃত স্বরূপ রাষ্ট্র দখলের মধ্যে নয়, বরং তা অন্য আরেকটি জাতি বা মানবগোষ্ঠীর জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে পদানত করে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সামাজিক-ঐশ^রিক অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে উদগ্র হয়। রাষ্ট্রীয় পরাজয় ভারতবাসীর কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু, মুসলমানদের আগমনে অনেকাংশেই তাদের জীবনানুশাসন ও সংস্কৃতির পরাজয় ঘটেছিলো। এ পরাজয় অন্য একটি সংস্কৃতির আগ্রসনের নিকট, একটি সেমেটিক ধর্মচেতনার নিকট। ভারতীয়দের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক যাপনে এই সংকটটিই ক্রমশ প্রবল হয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ আছে যে, ভারতীয়রা সর্বদাই বিজয়ীদের সংস্কৃতিকে অংশত আত্মস্থ করেছে, আর বিজয়ীরাও ভারতীয়দের সংস্কৃতিকে অংশত গ্রহণ করে এতে নতুন প্রাণ দান করেছে। ভারতীয়দের মধ্যে অন্যের সংস্কৃতি আত্মসাৎ করবার ক্ষমতা ছিলো, সাংস্কৃতিক আত্মিকরণে অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু, ভারতীয় সংস্কৃতি মুসলমানদের সংস্কৃতিকে আত্মিকরণ করতে পারে নি। মুসলিম সংস্কৃতি গ্রহণ বা আত্মিকরণের অর্থ দাঁড়াতো নিজ সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণত বিসর্জন দিয়ে মুসলিম সংস্কৃতিকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করা। এ হলো কোনো সংস্কৃতির পক্ষে আত্মবিসর্জন, সত্তাহত্যার সামিল। আর মুসলমান সংস্কৃতিতে আত্মিকরণ বিষয়টি একেবারেই নেই, এ কেবল নিজ সংস্কৃতিকে অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে চায়, চরম অনমনীয়তায়। তাই ভারতে আগমনের শুরু থেকে প্রায় সাতশ বছরে মুসলমানদের সংস্কৃতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির দাগও লাগতে পারে নি, কিন্তু, ভারতীয়দের সংস্কৃতির উপরে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবচিহ্ন বেশ স্পষ্ট ও গভীর। যদিও শেষের দিকে মুঘোল মুসলিম শাসকদের প্রচেষ্টায় মুসলিম সংস্কৃতির এই অবরোধ, প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টাও হয়েছে, কিন্তু, সেখানে প্রতিরোধ ও বিরোধও যথেষ্ট ঘটেছে, ভারতের আনাচে কানাচে। ফলে, মুসলমানদের আগমনে সাংস্কৃতিক লেনদেন প্রক্রিয়া তথা সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রক্রিয়াটি ব্যহত হয়েছে ভারতে আর মানুষদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব অমোঘ হয়ে বিরাজ করেছে।

মুসলমানদের ভারতে আগমনের পর থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই সাংস্কৃতিক সংঘাতটি চর্চিত হয়ে চলেছে। এই সংঘাতটি ক্রমশই সমাজের অন্যান্য উপাদানের সাথেও সংশ্লিষ্ট হতে থাকে। অর্থাৎ অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সামগ্রিক সমাজকাঠামোতেই এর প্রভাব পড়ে ও বিভাজন রেখাটি ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে এবং একটি ফাটলের অস্তিত্ব জাগিয়ে তোলে। আর, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিভাজনসূচক ফাটলটি কীভাবে স্পষ্ট হয়েছে তারও কিছু ইতিহাসনিষ্ঠ ঘটনাপুঞ্জি খতিয়ে দেখা যায়, যেন তা থেকে বিভাজনের কার্যকারণ সূত্রটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইতিহাসসূত্রে জানা যায়, মধ্যএশিয়ার সাথে ভারতের যোগাযোগ অতীপ্রাচীন। সেটি ইসলামপূর্ব কাল থেকেই। তাদের অনেকেই এ অঞ্চলে বসতি করেছে, বসবাস করতে থেকেছে। ইসলাম পরবর্তীতে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। আর ইসলাম গ্রহণ করেছে নানা কারণেই ভারতীয় অমুসলিমদের উল্লেখযোগ্য অংশ। এবং বলাই বাহুল্য যে ভারতীয় মুসলিমদের সমস্তটাই ধর্মান্তরিত মুসলমান নয়। বরং, বিজয়ী মুসলিম শাসকগণ, তাদের শাসনসহযোগি রাজকর্মচারীগণ, ধর্মপ্রচারকগণ ও শাসনসুবিধাভোগী বহিরাগত মুসলমানগণ মিলেই এদেশে মুসলমান জনবিন্যাস নির্মাণ করেছে। তারা যেমন এদেশের সংস্কৃতির সাথে অন্বয় স্থাপন করে নি, তেমনই ভাষাটিও নিয়ে এসেছে বাহির থেকেই। সংস্কৃতির মতো ভাষাটিও চাপাতে চেয়েছে ভারতীয়দের জিহ্বায়। তারা নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থনৈতিকভাবে পুষ্ট হয়েছে আর নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অভিজাত আসনে। তাদের বিপরীতে এদেশীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানগণ মূলত ভূমিকা নিয়েছে সেই অভিজাতদের প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত অনুশাসনের অনুগত হিসেবে। এইসব প্রান্তিক মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান প্রান্তিক অমুসলিমদের থেকে বিশেষ পৃথক ছিলো না, ছিলো সমান্তরালের। কিন্তু, তা সত্ত্বেও অনমনীয়, আত্মমতসর্বস্ব, স্বজাত্যশ্রেষ্ঠতাবোধের ধর্মীয়চেতনা তাদেরকে দিয়েছিলো এমন এক অহং যে, তারা প্রান্তিকতার সমান্তরালে থেকেও অপর প্রান্তিকদের থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে চেয়েছে। যখন মুসলমান শাসনের পতন হয়েছে, তখন যদিও প্রান্তিক মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থানের বিশেষ হেরফের হয় নি, কিন্তু অভিজাতদেও অর্থনৈতিক পতন হয়েছে আর ধসে পড়েছে তাদের শ্লাঘার ইমারত। আর ব্রিটিশ শাসনাধীনে হিন্দুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থানের বিশেষ উন্নতি ঘটে। হিন্দুসমাজে সামাজিক গতিশীলতার ঢেউ লাগে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। হিন্দুদের বিশেষ প্রতিপত্তিতে মুসলিম অভিজাতগণ ঈষান্বিত হয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈকিত অবস্থান পুনরুদ্ধারে ও মুসলিম ক্ষমতার পুনঃ প্রতিষ্ঠার মানসে তাদের মধ্যে এক নবতর রাজনৈতিক অভিপ্সা গড়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক অভিপ্সায় সাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রান্তিক মুসলমানদের সমর্থনও ইন্ধন হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনাধীনে আধুনিক ভারতে এই হলো মুসলিম জাতীয়তাবোধের অন্তরকথা।

বিভাজনকে স্পষ্ট করতে মুসলিমদের পক্ষ থেকে আরেকটি যে ভেদসূচক সামাজিক মাত্রা কাজ করেছে তা হলো মুসলিম সংস্কৃতির ওয়াহাবীবাদ। উনিশ ও বিশ শতকের ভারতে মুসলমান সমাজপ্রেক্ষাপটে দুজন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছে যাদের মাধ্যমে বিভাজনরেখাটি প্রকট হয়েছে। তারা হলেন কিংবদন্তীর দুই সৈয়দ আহমদ। একজন কট্টর শরীয়তবাদী ওয়াহাবী মততাত্ত্বিক অযোধ্যার রায় বেরেলীতে জন্ম নেয়া মুসলিম ধর্ম সংস্কারক সৈয়দ আহমদ শাহ বেরেলী, আরেক জন দিল্লির অভিজাত স্যার সৈয়দ আহমদ খান। এই স্যার সৈয়দ আহদম খাঁন নিজেকে মুসলমানদের শেষ নবীর সাইত্রিশতম বংশধর বলে দাবী করতেন ও স্বীকৃতও ছিলেন।৮ জানা যায় তার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন শেষদিকের মুঘোল রাজপরিবাহের অন্তরঙ্গ বন্ধু সম্পর্কের ও উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী। সেই বংশ পরম্পরা থেকে আগত সৈয়দ আহমদ খানের মুসলিম আভিজাত্যের শ্লাঘা এমনই উচ্চতার ছিলো যে, তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ প্রসূত মুসলিম জাতীয়তাবোধের ঘোষণায় ও তদমুখী যথাকর্মযোগে দ্বিজাতীয়তায় ভারত ভেঙে গেলো। আর সৈয়দ আহমদ বেরেলী তার স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেই, যথাকর্মযোগে বিভাজনচিহ্নে কুঠার আঘাত করেছেন। হাজার বছরের সহাবস্থানে থাকার ফলে মুসলিমদের সাংস্কৃতিক অনমনীয় অবস্থান সত্ত্বেও তা ভারতীয় অমুসলিম সংস্কৃতি দ্বারা কিছু তো প্রভাবিত হয়েছেই এবং পরবর্তীকালেও তার কিছু প্রবাহ থেকে যায়। আর, যে ভারতীয়রা ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তারাও নতুন ধর্মের তাবুতলে এলেও পূর্বচর্চিত সামাজিক সংস্কার সম্পূর্ণত ত্যাগ করতে সক্ষম হয় নি। এবং মুঘোল সম্রাটদের সাংস্কৃতিক উদারনৈতিক শাসননীতির কারণেও মুসলমানদের সংস্কৃতিতে সামান্য মিশ্রণ ঘটে হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম সংস্কৃতির। আর সেই সাথে উদারপন্থী মুসলিম সূফীদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিলো সেই মিশ্রন ক্রিয়ায়। এমনই পরিস্থিতে ‘শামসুল হিন্দ’ খ্যাত গোঁড়া মুসলিম ধর্মগুরু শাহ আব্দুল আজিজের শিষ্য সৈয়দ আহদম শাহ বেরেলী সংস্কৃতি ও ধর্ম সংস্কারের ব্রত গ্রহণ করেন আর সংস্কৃতি থেকে হিন্দুয়ানি দূর করতে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক কলহে ইন্ধন দিতে থাকেন, নেতৃত্বে কট্টর মুসলমানদের সংগঠিত করতে থাকেন। ভারতের শিখদের সাথে তিনি কয়েকবার যুদ্ধেও নেতৃত্ব দেন আর একবার তো পাঞ্জাবের পেশোয়ার দখল করে নেন শিখদের পরাজিত করে।শিখদের বিরুদ্ধে এই জয় সৈয়দ আহমদ ও মুসলমানদেরকে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষায় মনে ও দেহে বলিষ্ঠ করে তোলে। আর উনিশ শতকের বিশের দশকে আরব ফেরত, ওয়াহাবী মানসে অসহিষ্ণু হাজী শরিয়ত উল্লাহ এবং প্রায় সমসাময়িককালে তিতুমীরের ধর্মচেতনাপুষ্ট কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র ভারতের আপামর মুসলিম মানসে অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে। প্রান্তিক পর্যায়েও মানুষে মানুষে সম্পর্কে ফাটলমুখ প্রশস্ত হয়। ওয়াহাবী মতবাদ পুষ্ট হাজি শরিয়ত উল্লাহ ও তিতুমীরের আন্দোলন অংশত ব্রিটিশ বিরোধী হলেও তা ধর্মের লেবাসেই ছিলো দুর্মর এবং তা প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড়ীয় রাজনৈতিক অভিলাষায় যুক্ত হয়েছে। যদিও সৈয়দ আহমদ খান ওয়াহাবী আন্দোলনকে সর্বতভাবেই সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন, কিন্তু তিনি মুসলিম বুর্জোয়াদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবস্থানের কারণে ও শিক্ষানুরাগের কারণে অবিসংবাদিত নেতা হতে পেরেছিলেন। তারই মতাদর্শে মুসলমানদের রাজনৈতিক অভিলাষ সুদৃঢ় হতে পেরেছিলো। আর বিপরীতপক্ষে হিন্দু বুর্জোয়া ও অভিজাতগণও সম্প্রদায়গত বিরোধ ও দ্বন্দ্বে প্রায় সমমাত্রায় কিংবা কিঞ্চিতাধিক দমন, পীড়ন ও প্রতিরোধে সচল থেকেছে অনেকটা রাজানুকুল্যেই আর থেকে চূড়ান্ত বিভাজনকেই ত¦রাণিত করেছে।   

হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে আসি ফের। ভারতসমাজে অবৈদিক-বৈদিক আর্য-ক্ষাত্র শাসন, হিন্দুত্বের উত্থান, বৌদ্ধদের জয়যাত্রা, পুনঃ হিন্দুদের ক্ষমতায় আরোহন ও নানান অবক্ষয়ে মুসলিমদের কাছে চূড়ান্ত পরাজয় এবং মুসলিমদের প্রায় দীর্ঘ হাজার বছরের আংশিক ও প্রায় সম্পূর্ণ ভারত শাসন এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কের পরম্পরা বিশ্লেষণের চিন্তাকোণকে জটিল ও দীর্ঘ পরিসর দিয়েছে। ভাবা যেতে পারে, হিন্দগণ মুসলিমদের পদানত হয়ে দীর্ঘ হাজার বছর থেকে বৃটিশ শাসনাধীন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পুনঃ সমাজ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মর্যাদাবান হতে চাইছে, সেই সাথে হৃত মর্যাদা পুনরোদ্ধারে মুসলিমগণ মরিয়া, তখন মানুষের সম্পর্ক আর সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের স্বরূপটি কেমন! এমনই ঐতিহাসিক পরম্পরাগত তাৎপর্যে এবং ইংরেজদের আধুনিক শিক্ষা ও ইউরোপীয় জাতীয়তাবোধের মোড়কে হিন্দুদের জাতীয়তাবোধটি কেমন তার স্বরূপ কিছু উন্মোচিত হতে থাকে উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতের হিন্দু চিন্তাশীল, সমাজ-সংস্কারকগণের চিন্তায়, বক্তৃতায়, লেখায় ও সমাজ-রাজনৈতিক নানান তৎপরতায়। সেসবই উঠে আসতে থাকে সেসয়ের কিছু সাময়িক পত্রে। উল্লেখ করা যেতে পারে হিন্দুরক্ষণশীল ‘ন্যাশনাল পেপার’, ‘নবজীবন’, উগ্র রক্ষণশীল ‘বঙ্গবাসী’ ও ‘আর্য্যদর্শন’ পত্রিকাসমূহের কথা। এই সাময়িক পত্রসমূহই সেই কালে হিন্দু জাতীয়তাবাদের চারাটিকে পানি ও সার দিয়ে মূল-কাণ্ডে দৃঢ় করে তোলে। মুসলিম সম্প্রদায়ে যেমন সৈয়দ আহমদ খাঁন নামটি আসে সর্বাগ্রে, তেমনই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনারায়ণ বসুর নামটিই আসে আগে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবে।১০ আর হিন্দুজাতীয়তাদের পালে হাওয়া দিতে দেখা যায় কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের কাউকে। উল্লেখ্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। তারই অর্থানুকুল্যে ১৮৬৭ রাজনায়ারণ বসুর ভাবাদর্শে প্রথম ‘হিন্দুমেলা’র আয়োজন হয়। আর এতে প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠে শ্রীমান বসুর যোগ্য শিষ্য নবগোপাল মিত্র। বসুর পরে উনিশ শতকের ষাটের দশকে নবগোপাল মিত্রই হিন্দুজাতীয়তাবাদের দৃঢ় বেদী নির্মাণ করেন।  সাহিত্যেও হিন্দু জাতীয়তাবাদ চর্চিত হতে থাকে। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’-ই বোধহয় প্রথম প্রচেষ্টা। পরে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটকে, নবীনচন্দ্রসেনের কাব্যেও তা সগরিমায় প্রকাশিত। এবং সমসাময়িককালেরই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমট’ আরেকটি অবশ্য উল্লেখ্য উদাহরণ। আরো উল্লেখ্য, শিশির কুমার ঘোষ ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ বা ভারত সভা। ফলে, এইসবেরই প্রতিক্রিয়ায় ও মুসলমানদের সচেতন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে ১৮৬৩ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠত হয় ‘‘মহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ এবং এই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল স্কুল’ যা পরবর্তীতে কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে রূপ লাভ করে।১১ তিনিই উর্দুকে মুসলমানদের মাতৃভাষা জ্ঞান করে সেভাষায় অনুবাদ করে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি ‘ট্রান্সলেশন সোসাইটি’ও গঠন করেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি উর্দুকে ভারতীয়দেও একমাত্র জাতীয় ভাষা মনে করতেন আর মনে করতেন জাতীয় ভাষার উন্নতি ছাড়া ভারতবাসীর উন্নতি সম্ভব নয়।১২ পরে তিনি অনেক পাকিস্তানি লেখকদের কলমে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা ও পাকিন্তান প্রতিষ্ঠার আদি পিতা হিসেবে আখ্যায়িত হয়েচেন।১৩ এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘ সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’। এই ধারাবাহিকতা অব্যহত থাকে ১৮৮৫ সালের ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠায় ও ১৯০৬ সালে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার মতো ইতিহাসের অমুছনীয় ঘটনাসমূহের মাধ্যমে এবং নানান সমাজ-রাজনৈতিক ঘঁন-অঘটন তারিখ পরম্পরায় তা শেষ ১৯৪৭ সালে এসে। বাংলা ঘটে যাওয়া হিন্দুজাতীয়তাবাদের উৎসঘটনাসমূহকে আঞ্চলিকতায় ক্ষুদ্রার্থে দেখার সুযোগ একেবারেই নেই। কেন না, তৎতকালে বাংলা ছিলো সমগ্র ভারতের জাতীয়-রাজনৈতিক তৎপরতার রোলমডেল। দেশভাগের আর্থ-সামাজিক ও রানৈতিক দ্বন্দ্বমূলক কার্যকারণ বোধহয় অনেকটা খোলাসা করা গেলো। আরো স্পষ্ট করে জানতে বরং ভারতের প্রায় অথৈ ইতিহাসে ডুব দেয়া যেতে পারে। এই নিবন্ধে অন্তত সেবিষয়ে আরো বিস্তৃতির সুযোগ দেখছি না।

উল্লিখিত সংর্কীণতাই ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির অন্যতম প্রধান সংকট। ভারতের সাম্প্রদায়িক দ¦ন্দ্বের নিরসন হয় নি কিছুতেই। হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতি সমন্বয়ের সকল সম্ভাবনা তিরেহিত হয়েছিলো ক্রমে ক্রমে নানান সমাজৈতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। যদিও মুঘোল শাসকগণ তাদের শাসনের প্রায় পাঁচশত বছরে নিজেদের শাসনকে সুদৃঢ় ও স্থায়ী করতে ভারতের সকল ধর্মচেতনাসংশ্লিষ্ট মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাতেও কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। সমাজের নানা স্তর থেকেই প্রকাশ্য কিংবা গোপন, এই সমন্বয় চেষ্টার বিপক্ষে বিরোধকণ্ঠ সোচ্চার হয়েছে। এই প্রচেষ্টাকে সদার্থক বিবেচনা করাই যায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগণ তাদের প্রায় দু’শ বছরের শাসনের শেষের দিকে শাসনকালকে আরো স্থায়িত্ব দিতে বরং মুগল শাসকদের উলটোপথেই হেঁটেছে অর্থাৎ তারা বিভক্তকরণ নীতিতে আস্থা রেখেছে। অবশ্য এই নীতি তাদের ইউরোপীয় শাসন নীতিরই ঐতিহ্য। ইংরেজগণ কেবল ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংর্কীণতাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে তাদের বিভক্তকরণ নীতিতে। অবশ্য ‘Devide and rule’ নীতির জন্য ইংরেজদেরকে বিশেষ দোষারপ করা যায় না। কেন না, পূর্বেই বলেছি ভারতীয়দের জন্য তারা বিশেষ কমও করে নি। ইংরেজদের গুণগান করবারও অনেক কারণ রয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সেই বন্দনায় ‘ছোট ইংরেজ বড় ইংরেজ’ শির্ষক একটি মূল্যবান নিবন্ধই লিখেছিলেন। তবু, ইংরেজগণের কৃতকর্মের প্রাপ্য সমালোচনা তো করাই যায়। তাদের মন্দত্বও তো নেহায়েত কম নয়। একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষ জীবনে ইংরেজদের মানসিক কদর্যে বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি তা প্রকাশও করেছেন তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ শির্ষক প্রবন্ধে। কিন্তু, পুনঃ প্রশ্ন। এই যে ব্রিটিশদের বিভক্তকরণ নীতি, তার জন্য সম্পূর্ণ দোষ কি তাদের উপরেই আরোপ করবো? নিশ্চয় নয়। কিন্তু এতোকাল অধিকাংশ বিবেচনাতে তাদের বিভক্তকরণ নীতিকে সমালোচনা করা হয়েছে একচক্ষু দৃষ্টিতে। যদিও বিভক্তকরণ নীতিতেও তাদের শেষ রক্ষা হয় নি। ভারতীয়দের নিজস্ব সংস্কৃতি ও রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্বে তারা শেষের দিকে প্রায় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এই সত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই এবারে বরং ইংরেজদের অপশাসননীতির সাথে ভারতীয়দের নিজ সাংস্কৃতিক সংর্কীণতাকেও স্বীকার্যে আনার সময় এসেছে। স্বীকার্য এ-ই। ভারতীয় সংস্কৃতির সংকীর্ণতার দিকটি তুলে ধরা গেলো। কিন্তু এই আলোচনার পরিসরে হিন্দু-মুসলিম বাইনারি সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু সংস্কৃতির অন্তর্গত জাতি-বর্ণভেদজাত সংঘাত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের শিয়া-সুন্নি কিংবা অন্যান্য মাজহাবজাত অন্তর্গত সংঘাতসমূহকে আলোচনার বাহিরে রাখেছি, কেন না, তা সমাজের ও সম্প্রদায়ের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ হলেও কোনো জনগোষ্ঠীকে ভূমির সীমা দিয়ে সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতার চিহ্নে বিভাজিত করে নি অর্থাৎ দেশভাগের মতো দৃশ্যমান বৃহৎ বিভাজনের কারণ হয় নি। আর বিভাজনের কিছু কারণ নিশ্চয় রয়েছে আধুনিক কালজাত ‘দেশ’ কিংবা ‘রাষ্ট্র’ ধারণার ভিতর আর আধুনিকতা প্রসূত সমূহ জাতি ও জাতীয়তার চেতনার ভিতর। জাতীয়তাবাদ হলো সার্বভৌমত্বের সাংস্কৃতিক বোধ। পরম্পরাগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার সীমকরণ জাতীয়তাবোধের অধুনিকতম মাত্রা। সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতার সাথে বুর্জোয়া নেতৃত্বমানস যুক্ত হলে তা সাংস্কৃতিক পারম্পর্যের সাথে দ্বন্দ্বশীল হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবশিত হয়। আধুনিককালে কোনো রাষ্ট্রই জাতীয়তা নামের সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। নিশ্চয় কারো এ স্বীকার্যে দ্বিধা থাকবে না যে মানুষের (ভারতীয়দেরও) আধুনিক জাতীয়তাবোধও বিভাজন প্রক্রিয়ায় খুরধার অস্ত্র। অন্য জাতির প্রতি বিরোধ, বিদ্বেষ কিংবা স্বার্থগত সংঘাত ব্যতিত কোনো বিশেষ জাতীয়তার প্রকাশ নেই। জাতীয়তা সভ্যতার পরাক্রান্ত শত্রু।১৪ ভারতীয় জাতীয়তা ভারতকে অন্যসকল জাতি ও জাতীয়তা থেকে স্বতন্ত্র ও নিজেদের ভিতরে সংহত করতে এবং সংহত রাখতে পারতো। কিন্তু, ভারতীয়দের অন্তর্গত সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব থেকে জাত অভ্যন্তরস্থ দ্বৈতজাতীয়তার সংঘাত সেটি আর হতে দেয় নি। ভারত সংহত থাকতে পারে নি।



তথ্য ও প্রাসঙ্গিক ধারণাসূত্র:

১. ড. তারা চাঁদ, ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব (অনু.) (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ২০০৫), পৃ. ১০
২. অমর দত্ত, ঊনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙলাদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদ (কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ১৯৯৪), পৃ. ২০-২৬
৩. ইরফান হাবিব, মধ্যযুগের ভারত (নয়াদিল্লি: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, ২০১৫), পৃ. ৩০ 
৪. গোপাল হালদার, সংস্কৃতির বিশ্বরূপ (কলকাতা: মনীষা গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৮৬), পৃ. ১১৩
৫. শিবপ্রসাদ রায়, রহস্যময় আর এস এস (কলকাতা: প্রেরণা প্রকাশনী, ১৯৯৫)
৬. গোপাল হালদার, পূর্বোক্ত পৃ. ১১৩
৭. গোপাল হালদার, পূর্বোক্ত পৃ. ১১৫
৮. ড. জাফর আহমদ ভূঁইয়া, স্যার সৈয়দ আহমদ রচনাবলী পরিচিত ও পর্যালোচনা (ঢাকা: ঝিঙেফুল, ২০১৩), পৃ. ১৬, ২০
৯. আব্দুল মওদুদ, ওহাবী আন্দোলন, দশম মুদ্রণ (ঢাকা: আহমদ পাবলিশিং হাউস, ২০১৭), পৃ. ১৮, ১৯
১০. অমর দত্ত, পূর্বোক্ত পৃ. ১০
১১. ড. মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায়, জাতীয়তাবাদী জিন্না: চিন্তার ক্রমবিবর্তন (কলকাতা: প্রগ্রেসিভ পাবলিসার্স, ২০০১)
১২. ড. জাফর আহমদ ভূঁইয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০
১৩. ড. জাফর আহমদ ভূঁইয়া, পূর্বোক্ত পৃ. ৬
১৪. তোমাহের হোসেন চৌধুরী, সভ্যতা, পঞ্চম মুদ্রণ (ঢাকা: কথা প্রকাশ, ২০১৬), পৃ. ৩২ 


লেখক পরিচিতি:

শামীম সাঈদ ( জন্ম: ১৯৭৯)
শামীম সাঈদ কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। জন্মকাল ১০ জানুয়ারি, ১৯৭৯ সাল। জন্মস্থান কলসনগর, লালপুর, নাটোর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। শিল্পসাহিত্যের ত্রৈমাসিক ‘অনুপ্রাণন’ এর সদস্য সম্পাদক।প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: এই কথা বৃষ্টিবাচক (২০১৩), এভাবে খুলবে না আঁচলের খুঁট (২০১৪), সদা ভাগতেছে ভববান (২০১৪), নাঙ পূরাণ (২০১৭) ও স্বৈরমতি পিরিতের শূল (২০১৮)। সম্পাদিত গল্পগ্রন্থ: কুঁড়িকাল ও যুগযাপনের গল্প (২০১৪)।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ