bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

সঞ্জয় সরকারের গল্প: মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার



সন্ধ্যাবেলায় দোকানের ক্যাশবাক্স মুছে দোকানে জল ছিটাচ্ছে মধু দা। দূর থেকে কেউ কেউ মধু দা’র সাথে কথোপকথন করছে।

- ও মধু দা রসগোল্লা রইছে নাকি হুদাহুদি দোকান খুইল্লা থুইছো?

মধু দা জোর গলায় উত্তর দেয়।

- রসগোল্লা হাইজ্জাকালেই শ্যাষ। তুমি আইছো রাত্রিবেলা। মুই তোমারে কত কইর‌্যা কইছি বেইল থাকতে আবা তুমিতো মোর কথা হোনো না। পাবলিকে রসগোল্লা রাইখ্যা যাইবে তোমার লাইগ্যা। তোমার জন্য রসগোল্লা না থাহাই ভালো। তুমি মিয়া খালি মোড়ামুড়ি করো।

- এইতো মধু দা তুমি মানুষ চেনলানা। কাইল আইতেআছি সকাল সকাল।

মধু ঘোষ। সাকিন গৌরনদী, জেলা বরিশাল। বগুড়া রোডের মাথায় মধু দা’র মিষ্টির দোকান। দোকানের সামনে বড়ো করে পুরান সাইনবোর্ডে লেখা ‘মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। তার নিচে লেখা ‘শুধুমাত্র রসগোল্লা বিক্রেতা’। মধু দা গর্ব করে বলেন বর্ধমানের শক্তিগড়েরর ল্যাংচা যেমন সত্যজিৎ রায়, শচীন দেব বর্মণ, অমিতাভ বচ্চন খেয়ে পাগল তেমনি বরিশালের এই রসগোল্লা খেতে মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে জীবনানন্দ দাশ প্রায়ই ভীড় করতেন। বিভূতিভূষণ বরিশালে এসে নদী দেখে শঙ্কিত হয়েছিলেন যদিও রসগোল্লা খেয়ে উন্মাদের মতো প্যাকেট ছাড়াই শার্টের পকেটে পুরেছিলেন।

মধু দা’র বাবা বেঁচে থাকতে এসব গল্প নিতাই ঘোষই করতো। বাবা নিতাই ঘোষ মারা যাওয়ার পর বাবার মুখে শোনা এই গল্পগুলো মধু দা’ আরও রসিয়ে রসিয়ে বলে। বিভূতিভূষণ যে কয়েকদিন বরিশালে ছিলেন তাতেই নতুন বাজারের এক ভদ্রলোকের সাথে তার খুবই খাতির হয়। সেই ভদ্রলোক শেক্সপিয়রের সব রচনা পড়েছেন। অবাক করা কথা শুধু পড়ার জন্য নয়, ভদ্রলোকের কাজ ছিল শেক্সপিয়রের ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করা। একসময় মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর জনৈক ব্যক্তির চার পাঁচদিনের আড্ডা জমে উঠেছিলো। তখন জীবনানন্দ দাশ কলকাতায়।

তাই মধু দার দোকানে ঢুকলে মনেহবে এ এক সাহিত্য আড্ডাখানা। একদিকে জীবনানন্দ দাশ, একদিকে বিভূতি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল যারা তার দোকানে খেতে এসেছিলেন আর খেতে আসেননি সকলের ছবি টাঙানো। বহুদিন দোকানের কোনো নাম ছিল না, সকলে জানতো রসগোল্লার দোকান হিসেবে। মধুদা শখ করে নিজের নামে দোকানের নাম দিয়েছে- মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। সাইনবোর্ডে আরও লেখা- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী।


প্রতি সকালে মধু দা শীতলাখোলা থেকে বের হয়ে পরিপাটি বেশে নটা নাগাদ দোকানে পৌঁছে যায়। কাজের একমাত্র সহযোগী মধুদার জমজ মাখন ঘোষ। যে কেউ নতুন আসলে এ ব্যাপারে গুলিয়ে ফেলবেই। কে মধু আর কে মাখন আলাদা করা ভারি কষ্ট। মধুদাকে বাজারে দেখেছেনতো দোকানে এসে দেখবেন একই লোক। মধুদাকে দোকানে দেখবেন তো বাজারে গিয়ে দেখবেন একই লোক। জীবনানন্দ দাশের বাড়ির সামনে ডাস্টবিনের নোংরা ময়লা, পঁচা শসা, নষ্ট বাতাবিলেবুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মধু দা। আবার দোকানে গিয়ে দেখবেন দিব্যি দোকান খুলে আছে সেও মধুদা। এরপর ধীরে ধীরে গোলক ধাঁধা ভাঙ্গবে।

সকাল থেকে মধু আর মাখন দুজন মিলে শুরু করে দুধ কেনা। মোটামুটি এক হাজার পিস রসগোল্লার দুধ সংগ্রহ হলে তারা লেগে যায় পরের কাজে। এরপর দুধ থেকে প্রথমে ছানা তৈরি তারপর ছানা থেকে রসগোল্লা। দীর্ঘসময় জল শুকানোর জন্য ছানা সাদা মার্কিন কাপড়ে ছানা ঝুলতে থাকে রান্নাঘরে। মনে হবে দুধে ভর্তি গাভীর নরোম ওলান ঝুলে আছে। ছানাগুলো ঢেলে রাখা হয় বড়োসড়ো পাত্রে যেনো ফুটন্ত ছাতিমের মতো জমে থাকে ছানা। থোকা থোকা হেমন্তের ছাতিম ছড়ানো পাত্রে পাত্রে। গাভীর দুধ ছাড়া মহিষের দুধ দিয়ে রসগোল্লা বানানোর ক্ষেত্রে মধু একেবারেই রাজি নয়। অনেক দোকানে এসব থাকলেও মধু বাবার দেখানো পথ থেকে সরে আসেনি। চিনির পরিমাণ কম দিয়ে হাল্কা মিষ্টির রসগোল্লা বানায় মধু আর মাখন।

তা মধুদার দোকান শ বছরের পুরনো। দোকানের পুরনো চেহারা অনেকখানেই বদলে গেছে ঠিকই কিন্তু বদলায়নি দোকানের স্বভাব। পাকা ঘর তোলার পর মধুদা মিষ্টি রাখার শোকেস বানিয়েছে দোকানে, গ্লাসে মোড়ানো শোকেজে বিকেলবেলার বাঁকা রোদ এসে পড়লে জ্বলজ্বল করতে থাকে দোকান। মন্দিরে ওঠার সিঁড়ির মতো শোকেসে একধাপ একধাপ করে পাঁচ ধাপ বেঁধে নিয়েছে। প্রতি ধাপে ধাপে মিষ্টি থাকার কথা থাকলেও কেউ কোনোদিন সেই শোকেসে মিষ্টি দেখেনি, যাও দেখেছে তা খোলা মার্কেটের কিছু ব্রেড; এসব লোকজন রসগোল্লা আর রস দিয়েই খায়। আর রঙ নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরনো টিনে ভরপুর এই শোকেস, টিন ভর্তি নিমকি। নিমকি রাখার জন্য শখ করে মধুদা ক্যানেস্তারাও কিনেছে দুচারটা। মধুদার দোকানে খাবার বলতে এই তিনপদ। মিষ্টি তাও মিষ্টি বলতে রসগোল্লা, যে মিষ্টিই আপনি খোঁজেন না কেন দোকানে রসগোল্লাই মিষ্টি, মিষ্টিই রসগোল্লা।

দুপুর একটা নাগাদ ছানা দলে গরম রসে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা। এই একহাজার রসগোল্লা রাখার জন্য মধু দা ব্যবহার করে কয়েকটা বড়ো গামলা। বয়সী মধু আর মাখন টলতে টলতে একটা গামলা বাইরে টেবিলে রাখে যেখান থেকে পরিবেশন করা হবে। সন্ধ্যা ছয়টা হতে হতে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যায় একহাজার রসগোল্লা। কেউ এসে দোকানে বসে এক ঠ্যাং বেঞ্চে তুলে ঠ্যাং এর উপর হাত রেখে ব্রেড বা নিমকি দিয়ে খায় রসগোল্লা। প্রতিপিস দশ টাকা। মধুদা কখনোই রসগোল্লা কেজিকে বিক্রি করে না। কেজি মানেই গ্রাহকের লস, রসগোল্লা বেচা হবে পিস হিসাবে। যদিও অনেকে অপরিচিতজনই কেজিতে দাম জানতে চায়, এভাবে কেজিতে বিক্রি করলে মধুদা লাভ করতে পারতো অনেক কিন্তু মধুদা অপরিচিতকে ঠকাতে চায় না।

দক্ষিণমুখী দোকান ঘরে নেই কোনো আসবাব। ঢুকেই হাতের বাম দিকে এক চৌকির উপরে বহু আগেকার ক্যাশবাক্স।বাক্সের উপরের অংশে দুটো ময়ূর মুখোমুখি আঁকা, নিচের পায়াতে বাঘের হাঁ করা মুখ। চৌকির উপরে রেক্সিন বিছানো, তার উপরে শীতলপাটি, ঠাণ্ডার দিনে বাহারি ফুলতোলা নক্শী কাঁথা। ক্যাশবাক্সের মুখোমুখি দুই সারিতে চারটা টেবিল। একসাথে ষোলোজন আরাম করে বসা যায়, ভিড়ভাট্টা হলে চব্বিশ জনেও সমস্যা হয় না। কিছু লোক আসেন প্যাকেট ভর্তি রসগোল্লা নেন, চলে যান। গামলায় সাজিয়ে রাখা রসগোল্লা দেখলে মনেহবে সদ্য বর্ষায় জলে ভিজে ফুটে আছে কদম ফুল। ক্যাশবাক্সের মাথার উপরে দেয়ালে সাঁটানো নিতাই ঘোষের ছবি। ছবির উপরে সোনার সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি। প্রতিদিন নিতাই আর সিদ্ধিদাতা গণেশ নিয়ম করে ফুল-জল পায়। ছবিতে যত্ন করে ফুলের মালা দেয়া, ছবির নিচে ট্রেতে সকাল-সন্ধ্যা আগরবাতি জ্বলে। ঘরের ডানদিকে ফাঁকা দেয়ালের উপরের অংশের বহু পুরনো দিনের ঘড়ি। সেকেন্ডের কাঁটা নেই কিন্তু ঘড়ি স্বাভাবিক সময় ঠিকঠাক দিয়ে যাচ্ছে। কটকট করে সেকেন্ডের কাটার শব্দ বাইরে থেকে স্পষ্ট, সাধারণত দোকানে হট্টগোল কম থাকলে ঘড়ির সরব উপস্থিতি লক্ষ করার মতো। নিতাই ঘোষ জীবিত থাকা থেকেই এই দোকানে খাবার পরিবেশনের সকল প্লেট, বাটি কাসার। কাঁসার বাটি বা কাঁসার প্লেটে করে দেয়া হয় মিষ্টি। মধুদা শখ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন নিতাই ঘোষের ব্যবহৃত ট্রানজিস্টর’র জন্য সুন্দর বাক্স বানিয়ে দোকানে গুছিয়ে রেখেছে। এখনো মধুদা সকাল-সন্ধ্যা বিবিসি-বাংলার সংবাদ শোনে। বাদামী ফড়িং এর মতো পাখা মেলে দেয়া শক্ত দুটো ফ্যান ঝুলছে মাথার উপরে। মিষ্টির শোকেসের এককোণায় কালীপ্রসন্ন সিংহের ঢাউস দুখণ্ডের মহাভারত। যেদিন সকাল সকাল বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায় সেদিন মধুদা মহাভারত খুলে পড়তে থাকে। মধুদা কবে কোথায় কিভাবে ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা পড়েছিলো আজ আর মনে করতে পারে না। বড়ো ভালো লেগেছিলো কবিতাগুলো। মনেহয়েছিলো তার জন্যই এইসব কবিতা কবি লিখেছেন। দোকানের একপাশে তাই ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা টাঙ্গিয়ে রেখেছে মধুদা-

যা থাকে কপালে ভাই, টেবিলেতে খাব।

ডুবিয়া ডবের টবে, চ্যাপেলেতে যাব॥

কাঁটা ছুরি কাজ নাই, কেটে যাবে বাবা।

তুই হাতে পেট ভোরে, খাব থাবা থাবা॥


রাস্তা দিয়ে লোকজন আসা-যাওয়া করে। কেউ ঘরে এসে বসে। তারা জানে আজ মিষ্টি শেষ তবুও মধুদার সাথে দুকথা বলার থাকে তাদের। বারেক মিয়া এসে বসে মধুদার দোকানে।

বারেক মিয়া একটু গলাখাকারি দিয়ে ডাকে- মধুদা, ও মধু-উ-দা, মহাভারত পড়তেআছো বুঝি। তা কুরুক্ষেত্রের লাঠালাঠি শ্যাষ দেতে পারছো না খালি খালি সামনে খুইল্ল্যা বইয়া থাহো।

মধুদা মহাভারত বন্ধ করে বারেক মিয়ার সামনে এসে বসে।

- ক বারেক কি কইতে চাও। তোর দিনকাল ভালা যায়তো? নাকি তুইও আইজকাল উন্মাদ অইয়া গেলি। আও কম কম।

- না রে মধুদা। গ্যাছালাম নদীর ওপার, হউর বাড়ি। তো মাহফিলে দলে দলে লোক আইতেআছে। ভালো ঠেকতে আছিলো না, চইল্যা আইলাম। হেরপর হুনি বটতলার মোড়ে ফুলবন নামে নতুন মিষ্টির দোকান দেছে। পুতিদিন মিষ্টি আইবে ঢাকা গুইন্যা। মনডা ব্যাজার অইয়া যায় না কওতো দেখি মধুদা।

এতক্ষণ পর মধু সচকিত হয়ে শোনে বারেক মিয়ার কথা।

- শোন বারেক সেই বাবার বয়স থাইক্যা তোরে চিনি। গণ্ডগোলের সময় তোর বাপের জোরেই আর পুতিবেশী মোসলমানগো অনেকের সাহসেই বাবা ডর ভাইঙ্গ্যা বরিশালে থাইক্যা যায়। হেরপর ব্যবসা মোগো খারাপ যায় নাই। দ্যাশ মোগো সুনাম দ্যাছে, হগল কিছুই দ্যাছে। এখন এই ফুলবন না ফুলজঙ্গল কোনহান দিয়া আইলো!

রুবিনা এসে দোকানে দাঁড়ায়।

- মধুকাকা তখনকার রাখা মিষ্টিগুলা দিয়ে দেন নিয়ে যাই। মধু মিষ্টিগুলো রুবিনার হাতে দিয়ে দেয়। রুবিনাও একই কথা বলতে থাকে।

- কাকা, ফুলবন নামে মিষ্টির দোকান হইতেছে বটতলায়। ফেসবুকতো তুমি বোঝো না কাকা, এরা ফেসবুকে পেজ খুলছে।

একটার পর একটা মিষ্টির ছবি দিতেছে। লোকজনতো মনেহয় হুমড়ি খাবে মধুকাকা। তুমি একটু কয়েকটাদিন কম কম মিষ্টি কইরো, আবার নষ্ট না হয়।

রুবিনাদের বাড়ির নিচের এক অংশ ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিলো মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের যাত্রা। সেসময় দোকান ছিলো টিনের। এখনতো মধু নিজেই জমি কিনে ঘরবাড়ি তুলেছে। উপরে থাকার ঘর নিচতলা দোকান। রুবিনাদের বাড়ির মুখোমুখি দোকান। রুবিনার বাবা প্রায়ই যে কথা বলে রুবিনারও থেকে থেকে তাই মনেহয়। এ অঞ্চলে কিছু কিছু হিন্দু ময়রা আর ঘোষ না থাকলে খাঁটি মিষ্টি খাওয়া হতো না। এতোদিন পর রুবিনার মনে হচ্ছে বরিশাল শহরের মিষ্টির ব্যবসায় সেই পুরনো বংশপ্রথা ভাঙবে মনেহয়। রুবিনার বাবা মোতালেব মিয়া সেসব কানে নেয় না। হজ্ব ফেরৎ মোতালেব মিয়ার ঘরে হিন্দু ঘরের মিষ্টি ছাড়া দিন পার করা ভার। এই নিয়ে মোতালেব মিয়াকে অনেক কথাই বলতে চায় অনেকে কিন্তু মোতালেব মিয়ার জ্ঞানগরিমার পরিসীমা ভেবে কেউ কথা বলতে সাহস করে না। বিধায় সকলে চুপ থাকে। তবে বিষয়টা নিয়ে অনেকেই খুশি নয়। অখুশি হওয়া লোকজনের সংখ্যা শহরে একেবারে কম নয়। 

সকলে পরদিন ভীড় জমায় ফুলবন মিষ্টির দোকানে।

দুপুর দুপুর মধুদার মিষ্টির দোকানে গ্রাহক থাকে কম। কম চাহিদায় মিষ্টি সেদিন কিছু অবশিষ্ট থেকে যায়। সন্ধ্যাবেলা বারেক মিয়া আসে দোকানে। ভার ভার মন নিয়ে হলেও বারেক মিয়া নতুন মিষ্টির দোকানের বর্ণনা দেয়। সেও একবার দেখতে গিয়েছিলো। এতো গল্প শহর জুড়ে কেউ না গিয়ে পারবে কেন? বারেক মিয়া দেখে এসেছে বিশ পদের মিষ্টি, রসমালাই, সন্দেশ, দধি। রসগোল্লাতো আছেই। মধুর মনখারাপ হয়ে যায়। সারাদিন গ্রাহক না থাকার ব্যাখ্যাটা বুঝতে পারে মধু। মধু জানতে চায়,

- বারেক ঢাকা দিয়া এতদূর মিষ্টি আয় কেমনে, নষ্ট অয় না?

- তা অইবে ক্যা মধু দা, ফ্রিজ সেট করা গাড়িতে আয়।

- হেইসব বাসি জিনিসের স্বাদ থাহে! লোকে তাই খাইতে যাইতেআছে!

যাক বারেক মিয়া তুমি এই পঞ্চাশটা মিষ্টি বাসায় লইয়া যাও। হগনজিরে খাওয়াইও।

মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দেয় মাখন। মাখনের মন মেজাজ খারাপ হলেও সন্ধ্যের পর সেও একবার চুপচাপ বাইরে থেকে ফুলবন মিষ্টির দোকান দেখে এসেছে। বাইরে কেমন বাহারি আলো দোকানের নামের লেখার ওপর জ্বলছে। ভিতরে চকচক করছে ঘর, দোকান চারদিক থেকে কাচ দিয়ে ঘেরা। মিষ্টি যাই হোক দোকান দেখেই ঢুকতে মন চাইবে যে কারো। মাখন চেয়েছিলো তাদের দোকানটাকে এমন করে সাজালে হয়তো লোকজন বাড়বে দোকানে কিন্তু তাতে রাজি হয়নি মধু।

এরপর মাস দু পরের কথা। ফুলবন মিষ্টির দোকানে একে এক ধরা পড়েছে নোংরা মিষ্টি, মিষ্টিতে মরা মাছি, পঁচা বাসি খাবার। লোকে আবার সেই মধুদার দোকানে ভীড় করেছে। সেই পুরনো স্বাদ, পুরনো দিনের খাঁটি ছানার রসগোল্লা নিতে আবারও মধুদার দোকানে ভীড় করছে মানুষ। ইদানীং মধুদার মুখে হাসি। মন মেজাজ সবসময় চাঙা। চোখে মুখে শক্ত সাহসের চিহ্ন।

এর মধ্যে রুবিনা এসে হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে দোকানে।

- মধু কাকা, মধু কাকা। মাখন কাকা, কই আপনারা।

মধু মিষ্টি বানানোর ঘর থেকে সামনে আসে। হাতে ছানা আটকে আছে, তখনো দুটো ছানার বল হাতে।

- আচ্ছা মধু কাকা তোমার দোকানের নামে ফেসবুক পাতা দেখতেছি। কে করছে? তোমরা করাইছো? তোমরা তো ফেসবুকই বোঝার কথা না।

মধুদা মাথা নেড়ে বলে সে কিছুই জানে না। ফেসবুক কথাটা উঠতি ছেলেমেয়েরা দোকানে মিষ্টি খেতে এলে শুনেছে আর শুনেছে বারেকের মুখে এতটুকুই তার ফেসবুক জ্ঞান। বাড়ির লোকজন বলতে কেউ এ ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যস্ত।

- আচ্ছা মা রুবিনা, ভাল অইছে না? ফুলবন তো নাকি ফেসবুক দিয়ে কি কি করে, তো তুমি আমাগো দোকান পাটের কথা দিয়া দ্যাও না সেখানে।

- না, মধু কাকা এটা যারা খুলছে তারা দিতেছে। আমার আর দেয়া লাগবে না।

- তাইলে তো ভালো।

মধু বাংলা পড়তে জানে, রুবিনার দেখানো মোবাইলে মধু দেখে তার আর মাখনের ছবি, দোকানের ছবি সেই ফেসবুকে আর মধ্যখানে লেখা মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। মধু এতে খুশি হয়। নিজের নামধাম মোবাইলে দেখা যাচ্ছে। কত লোক দেখছে সেই মোবাইলের লেখা।

এরপর ফুলবন মিষ্টির দোকানে লোকজনের উপচে পড়া ভীড় আর কোনোদিন দেখা যায়নি। বরং মধুর সুনাম আরও বেড়েছে। ফুলবনের চকেচকে আলো এখনো বটতলার মোড়ের অন্ধকার দূর করে রাস্তায় এসে পড়ে। প্রতিদিন অপরিচিত অচেনা লোক ফুলবনে খায়দায়, গল্প করে। মালিকপক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করে। বছর ঘুরলে ফুলবনের দোকানে নতুন রঙ লাগে, পুরনো অপবাদ ধীরে ধীরে ভুলে যায় মানুষ তার পুরনো অসুখের মতো। রঙিন ফুলবনের ডেকোরেশনে আসে রঙিন বাতি, গরমে থাকে এয়ারকন্ডিশন, থাকে মিষ্টির হোম ডেলিভারি। তবুও মধুদার রসগোল্লার স্বাদে ফুলবন নিরুপায় হয়ে যায়।

সেদিন শুক্রবার দুপুরের পরপর শহরে লোকজনও কম। হঠাৎ শোরগোল চারিদিকে দলে দলে লোকজন ধেয়ে আসছে বগুড়া রোডের মাথায়। মধু আর মাখন দোকানে বসে মহাভারত পড়ছিলো। ততোদিনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ, শুরু হয়েছে গান্ধারীর বিলাপ। দূর থেকে ভেসে আসছে স্লোগান।

মধু দেখতে পায় রাস্তায় সবই অপরিচিত লোক। কোথা থেকে এতো লোক আসলো সে কিছুই বুঝতে পারে না। হঠাৎ মিছিল থেমে যায়। কেউ একজন বলতে থাকে- এই হলো মালাউনের মিষ্টির দোকান। প্রতিদিন এই দোকানের রেডিওতে মার্কিনিদের আফগানিস্তানে হামলার খবর শুনে হাসিঠাট্টা করে মধু আর মাখন। আপনারা কেউ কি জানেন-- এই মালাউনের দোকানে কাজী নজরুলের ছবি নাই। আছে হগল হিন্দুগো ছবি--

হঠাৎ মিছিলের মধ্য থেকে কেউ একজন অস্ফূট স্বরে বলে-- কবে করেছে হাসিঠাট্টা কেউ কি দেখেছে? কিন্তু প্রবল স্লোগানে তার কথা হারিয়ে যায়। এমন প্রশ্ন কে উত্থাপন করলো তা অনেকেই জানতে চায় কিন্তু মিছিলে কে কথা বলেছে তা কেউ স্বীকার করে না। হট্টগোল বেঁধে যায়।

অন্যদিকে থেকে আচমকা একজন চিৎকার করে বলতে থাকে- মিষ্টির ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিছে, মিষ্টি নাকি এতই সুস্বাদু যে লোকজন হইহুল্লোড় করে মিষ্টি কেনে। এই দেখেন মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ফেসবুক পাতা। কেউ কেউ বলতে থাকে এই গলা ফুলবন মিষ্টির দোকানের কারো। কেউ বলে না না ফুলবনের নয়। এই গলা নদীর ওপার থেকে আসা মানুষের মতো।

কারো কাছে মনেহয় এই স্বর রাজনৈতিক স্লোগানের মতো।

মুহূর্তেই সকলে ফেসবুক খুলে এই পোস্ট দেখতে পায়। এইসবই ঘটছিলো মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে খানিক দূরে। মধু আর মাখন কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পায় হাজার হাজার মানুষ তাদের দোকানের দিকে ছুটে আসছে। বারেক মিয়া, রুবিনা হট্টগোলের মধ্যে ছুটে আসার চেষ্টা করলেও তারা বারবার মানুষের বাঁধার সম্মুখীন হয়। হইহুল্লোড় থেমে গেলে বারেক মিয়া দেখে দোকানের স্বর্ণের গণেশের বেদীতে গণেশ নেই। রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে রসগোল্লা। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে শোকেজের গ্লাস, খাবারের টেবিল বেঞ্চ সব রাস্তায়। মধু আর মাখনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাটিতে ভেঙে যাওয়া নিতাই ঘোষের ছবিটা তুলে যখন মোতালেব সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন কেউ কেউ পথে এই কথা বলছিলো যে ফুলবনের লোকজন নাকি ভাংচুরে সবার আগে ছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে জীবনানন্দ দাশ, নজরুল, বিভূতিভূষণ। সবচেয়ে বেশি ভাঙচুর হয়ে পড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। অভিমন্যুকে বধ করার জন্য ঘিরে ধরে রেখেছে অসংখ্য মহারথি। মহাভারতের পাতা থেকে কেউ ছিড়ে ফেলেছে সেই পাতা।

এরপর বহুদিন আর মধু মাখনের খোঁজ মেলেনি।

দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা-- জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী--লেখাটি মাঝে মাঝে ক্ষয়ে গেছে।


<><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><><>


লেখক পরিচিতি: 

সঞ্জয় সরকার, কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৮৮ সালে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ তারাপুর গ্রামে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: পরশ পিপুল (২০২০); কাব্যগ্রন্থ: যেতে হবে যাই (২০১৯)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ