bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মাহমুদুল হকের গল্পস্থাপত্য


কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ||



তিনি, মাহমুদুল হক, আমাদের ছোটগল্পের শিল্পচৈতন্যের দিকের নির্মাতা, যেন আলোর দিশারী। কোন্ সে নির্মাণ, কেন এ নির্মাণ কিংবা কেন এ নির্মান ইত্যাদি নিয়েই এখানে কিছু কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছি। আমরা তাঁর গল্প পাঠকতো করবই, এর ভিতর দিয়ে আমাদের এক দীর্ঘ জার্নি হবে, জীবনের জার্নি, জীবনকে দেখার জার্নি। এভাবেই তাঁর গল্পের স্থাপত্যকৌশল আমরা দেখার চেষ্টা করব। আসলে কোনো শিল্পেই একতরফাভাবে বা একক সিদ্ধান্তে কিছু করা যায় না। তাঁর গল্পও একেবারে আমাদের মতো করে, সেভাবে, আমাদের কাছে ধরা দিবে না, গল্পের নির্মাণকৌশল হয়ত পাব না। কিন্তু তাকে গল্পের ভিতর দিয়ে একধরনের সৃজনলীলায় তো মত্ত হতেই হয়। তা করা দরকার, কারণ তাকে নিয়ে যতভাবে ভাবা যেত, দেখা যেত, খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কার করা যেত, তা বোধ হয় করা হয়নি। তিনি গল্পের স্বপ্নপুরুষ, একেবারে জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে জীবনকে হাজির-নাজির করার তিনি এক বিষয় বটে। তিনি নিজেই যেন এক স্বপ্নচারী। হয়ত আমাদের এ দেখায় খানিক মুগ্ধতা, খানিক চঞ্চলতা, এমনকি খানিক পক্ষপাতও থাকতে পারে। পক্ষপাত তাঁর পক্ষেই থাকা উচিত, যাতে পক্ষপাত ক্ষণে ক্ষণে নির্ণয় করে দেখা যায়।
তাকে পড়তে গেলেই আমাদের কেবলই মনে হয় আমরা এক স্মৃতিভাস্কর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছি। এ তাঁর অপূর্ব নির্মাণ কৌশলের জন্য, শিল্পের একটা স্বতঃস্ফূর্ত ধারা নির্মাণের জন্য হতে পারে। আমাদের মনে হয়, এ অভিজ্ঞতাকে মোকাবেলা করতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি যখন কথাসাহিত্য, বিশেষত উপন্যাস চর্চায় থাকেন, আমরা যখন তা পাঠ করি, তখনই মনে হয় আমরা এমন এক জায়গায় জড়ো হচ্ছি যেখানে একজন মানুষ নিজেকে ক্রমাগত নির্মাণ করেই চলেছেন। এর প্রমাণের নিমিত্তে সমন জারি করে তার লেখার সাহায্য নেয়ারও প্রয়োজন নেই, তার সৃজিত অনুর পাঠশালা, কালো বরফ, জীবন আমার বোন, মাটির জাহাজ, অশরীরী পাঠ করলে তার ভিতর থেকে ক্রমাগত মাহমুদুল হকের অবয়ব চিহ্নিত হতে থাকে। আমরা তার সেই চিহ্ন তাঁর গল্পে ক্রমাগত পাই না। ‘মনসা, মাগো’, ‘কালো মাফলার’ বা ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’-এ ধরনের কিছু গল্পে মাহমুদুল হকের অবয়ব ঝিলিক দেয়। আবার তা মিলিয়েও যায়। এই যেমন, আমরা এখন যে গল্পটি পাঠ করব, ‘হলধর নিকারির একদিন’, তাতে কিন্তু মাহমুদুল হকের সবাক চেহারা নয় বরং এমন এক গ্রামীণ বাস্তবতা আছে যেখানে তাকে পাওয়া যায় না। আমরা তাকে একভাবে হয়ত হারাই। এই যে তাকে পাওয়া বা না-পাওয়া, এতে আমার কেবলই রবিঠাকুরের কথা মনে পড়ে। উপন্যাসে মাহমুদুল হক নিজেকে দেখেছেন, গল্পে সমাজবাস্তবতারবিঠাকুরও তাঁর সৃজিত উপন্যাসে কলকাতার তখনকার কথিত বাবু-সংস্কৃতির কার্যকর বাহক ঠাকুরবাড়ির অন্তর্জগৎকে চিহ্নিত করেছেন। আবার তাঁর প্রায় গল্পেই পূর্ববাংলার জীবন-ক্যানভাস ভাস্বর হয়ে ওঠেছে।
আমরা এখন তবে ‘হলধর নিকারির একদিন’ পাঠ করে ৭০ দশকের এই উত্তপ্ত পূর্ববাংলাকে দেখব। মানুষের সামাজিক আশা আর আশাহতের ইতিবৃত্ত স্পর্শ করার বাসনা করব। তাঁর একটা জগৎ আছে, ভালো বা খারাপ-লাগা আছে, নিজেকে পরখ করার বাসনা আছে, কামনা আছে, হুহু কান্না আছেসবই তিনি তাঁর স্বোপার্জিত ভালোবাসা নিয়ে উপলব্ধি করেন। আমরা তাঁর সেই ইন্দ্রিয়তা, তাঁর উপলব্ধিকে খানিক পরখ করে দেখব। তিনি একধরনের নির্মাণের ভিতর থাকেন, তাতে মানুষকে তাঁর সতেজ অনুভূতিসহ জায়গা দেয়ার ব্যবস্থা রাখেন। তিনি জ্ঞানী হয়ে, বইপত্র মুখস্থ করিয়ে, তাঁর পাঠককে তার কাছে আসার আমন্ত্রণ জানান না। এমনকি তিনি তাঁর এ উপলব্ধি কোথায় পেলেন তাই ভাবতে ভাবতে পাঠক হয়ত অনেক বেলা পার করতে পারেন। তিনি তাঁর অর্জিত স্মৃতিকে ঝাপসা-জ্ঞান হতে দেন নাটাটকা রাখতে জানেন। সেই জানার ভিতর তার আশপাশের জনগণকে আমন্ত্রণ জানানোর বাসনা রাখেন। আমরা তাঁর বাসনা স্পর্শ করব। আমরা মূলত আমাদেরকেই স্পর্শ করব। এভাবেই তিনি পাঠমাধুর্যকে জীবনমাধুর্যের সমান রাখতে পারেন। আমরা আপাতত এমন সিদ্ধান্তে স্থির থাকি, তার সাহিত্য হচ্ছে জীবন-সত্যকে স্পর্শ করার সাহিত্য।
তাঁর সৃজনমুখরতা থেকে কোনো দর্শন বের করা মুশকিল। তিনি শিল্পের স্বাধীনতায় আস্থা রেখেছিলেন। তিনি যেন নিজের ঈশ্বরত্বকে নিজেই খোঁজ করে নিয়েছিলেন। কোনো দিকেই নির্দিষ্ট করে তাকাননি তিনি। এমনকি তিনি নিজেকেও ভালোভাবে দেখার ফুরসৎ পাননি! তখন, সেই ৬০ দশকের শুরুর সময়টা ছিল মূলত মার্কসবাদীদের। লাল পতাকায় তখন পাল লাগতে শুরু করেছে। তখন এর বাইরে অন্তত সাংস্কৃতিকভাবে অন্যকিছু ভাবটা কিছুটা হলেও স্রোতেব বাইরে চলে যাওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। তখন তার সারথী ধরতে পারি রশীদ করীম, রাহাত খান, সুচরিত চৌধুরীদেরতাদের নিয়েই বা একাই আলাদা জগৎ তৈরি করতে ছিলেন।
যে গল্পসমূহ নিয়ে আমরা কথা বলব, অথবা, মাহমুদুল হক যে গাল্পিক ব্যবস্থাপনা রেখেছেন তাই পরখ করতে করতে যাবো। তিনি যে ‘হলধর নিকারির একদিন’ নাম রাখলেন, গল্পের সেই দিনটি কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় একদিনে নির্মিত নয়, বরং তা দিনের আলোর দিনব্যাপী ঘটে যাওয়া ঘটনা। তাও শুরু হয় গ্রামীণ জীবনের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার শুরু থেকে শেষ হয় বিকাল বা সন্ধ্যায়। তবে গল্পপাঠের শুরুতেই এর শিরোনামই আমায় দারুণ ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে, অভিধান মোতাবেক নিকারি সেই নিম্নবর্গীয় মুসলমান সম্প্রদায় যারা জেলে-ব্যবসার সাথে নিজেদের জড়ায়। আর জেলে সম্প্রদায়ের অরিজিনাল সম্প্রদায়ের টাইটেল হচ্ছে জলদাস। এখানে তাদেরক সিম্পলি দাস বলা হচ্ছে। তবে আরেকটা প্যাঁচ হচ্ছে হলধরকে নিকারি বলা হচ্ছে! কেন? এ কি তবে পদবির কোনো সমাজতাত্ত্বিক রূপান্তর, নাকি গল্পের ভিতর দিয়ে হলধরের যে প্রাবল্যবাদী রূপান্তর দেখি, ক্রমশ মুসলমানদের ক্ষমতা নেয়ার কৌশল গ্রহণ করল, গল্পকার তার সৃজনীক্ষমতায় নিকারি বলে একধরনের ধাঁধা তৈরি করলেন? আমরা তাহলে একধরনের বৈসাদৃশ্যময় কোলাহলের ভিতর দিয়ে গল্পটি পাঠ করতে থাকি!
প্রথমত মনে হয় গল্পটির ভিতর গল্পের অপূর্ব মাদকতা আছে; এর এক প্রাণ আছে। সেই প্রাণের উপাদান আমি সর্বাঙ্গে ব্যাখ্যা হয়ত করতে পারব না। আমার তো মনে হয়, গল্পেরও কিছু সত্য থাকে। সেই সত্য প্রকৃত অর্থে গল্পকারই সৃজন করেন, আমি একজন পাঠক হিসাবে সেই সত্যের খানিক স্পর্শ নিই। বর্ণ, বাক্য, যতিচিহ্ন ইত্যাদি মিলে স্বল্পায়তনের একটা রাজত্ব এতে আছে। সেই রাজত্বরূপী অবয়বের যে নাটাইটা থাকে, থাকতে হয়, তার সবটাই আছে গল্পকারের হাতে। এতে উপন্যাসের নানান বিস্তার হয়ত অনেকেই আবিষ্কার করতে চাইবেন, আমার মনে হয় গল্পের যথার্থ একটা চেহারা এতে আছে। আমরা এর প্রথম অংশটুকু পাঠ করি বরং‘শেকল খুলে সবেমাত্র কোশা খালে নামিয়েছে হলধর, ঠিক এই সময় ভাঙ্গা গলায় তাকে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে ডাকে চৈতন্য দাস, ‘হলা, ও হলা, হলারে’গল্পের শুরু শুধু নয়, এ যেন এক জীবন-গল্পেরও শুরু। চৈতন্য সৃজিত ডাকের ভিতর একটা গ্রামীণ সম্পর্ক আগাগোড়া আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। পুত্রের প্রতি একধরনের ব্যাকুলতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি একধরনের হতাশাও আছে। কারণ আমরা ক্রমে বুঝতে পারব, হলধর শুধু বাইরেই যাচ্ছে না, এখানে তার বাবা আর বউকে সারাদিনের জন্য হতাশা আর টেনশনের ভিতরও রাখছে। সে শুধু নিকারিগিরি করতে যায় না, তাতে নানান মাতব্বরি বা ক্ষমতা-আয়ত্বে আনার প্যাঁচই থাকে না, বরং তার ভিতরে অন্য নারীর প্রতি এক নেশার শুরুও বলা যায়। গল্পটির শুরু থেকেই মেনকা নামের একটা বউ-চরিত্র থাকলেও তাকে আমরা কখনও দেখি না, সামনে পাই না। কখনও সে সামনে আসে না। একটা চরিত্র একটি বারের জন্য উচ্চারিত সত্তা না হয়েও ঘুরে-ফিরে চরম দাপটে বিরাজ করে। সে যে অবহেলিত, সে যে পাক-আর্মি দ্বারা লাঞ্ছিত, তার যে খড়কুটার মতোই একটা সামান্য জীবন সে বহন করছে, তবু তার নীরব তবে দাপুটে উপস্থিতি এ গল্পের চমৎকার এক শৈল্পিক দিক। যাই হোক, আমরা শুরুতেই চৈতন্য দাস নামের বাবাব দেখা পাই, সেও শত অবহেলার ভিতর তার প্রয়োজনীতা প্রমাণ করতে চায়। মানুষ যে একেবারে জীবনের শেষ সীমানায় থেকে অস্তিত্বশীল প্রাণী হয়ে চিরঞ্জীব থাকতে চায়, এ তারই একনিষ্ঠ প্রমাণ। আমরা এমনিতর নানান মাত্রার মাহমুদুল হককে আমরা পাই।
হলধর বাড়ি থেকে বেরিয়েই কোশা সহযোগে আরেক জায়গায় যায়। কাজ সেরে একটা মাছ কোশার ভিতর ফেলে সে আরেক জনের কাছে যেতে চায়, তাকে পেতে চায়, জীবন ভরাট করতে চায়, তার নাম গঙ্গা। কিন্তু গঙ্গা তাকে পাত্তা দিতে পারে না। কারণ তার ভগ্নিপতি মরে-মরে অবস্থা। এই অবস্থায় তো সে হলধরের সাথে রঙ্গরসের আলাপ করতে পারে না। হরধর একসময় ফিরে আসে, দেখা হয় ভগির সাথে। তার প্রতি হলধর আবারও আসক্ত হয়। এক পর্যায়ে সে শোনে মেনকার খুড়তুত ভাই কেশব মাছধরার ঘাটের দখল নেয়ার তালে থাকে। এই কেশবের উপর তার রাগ কম নই। কারণ সে একসময় মেনকাকে নিয়ে হেথায় হোথায় ঘুরেছে। একপর্যায়ে দুপুর বা সন্ধ্যার গাঢ় আলোয় সর্বহারা পার্টি নামের দুর্মুজ পার্টির কবলে পড়ে হলধর। তাদের সাথে একপর্যায়ে তার দফারফা হয়, পার্টিতে নাম লেখায়, মাসে মাসে পয়সাকড়ি দেয়ার শর্তে আসে। বিনিময়ে সে মাতব্বরি বাড়ানোর ইশারা পায়। এমনকি মাত্র ২ হাজার টাকায় কেশবের কল্লা কেটে নেয়ার ব্যবস্থাও করে। একসময় সে ফিরে আসতে থাকে, তবে ভগির শরীরে তার বউ মেনকার মতোই ওপড়ানো গাছের গন্ধ পায়! এ যেন আরও এক সর্বনাশা বন্ধনের ইশারা। তার গা গোলায়, হাত-পা অবশ হয়ে আসে। এমনই এক সর্বনাশা তবে অর্থময় জীবনযাপনের ভিতর দিয়ে গল্প শেষ হয়। অথচ সে ভালোবাসে গঙ্গার শরীরের আশ্বিন-কার্তিকে খালের নীলচে জলের পেতলকাসার মতো দেহের গুমড়ানো গন্ধ। সে তা অবুঝের মতোই ভালোবাসে। সে এই নেশাটুকু ডাকাতের মতো দুমদাম লুটে নিয়ে বুকের ভিতর বাক্সবন্দি করে একদিন সে যোগী হয়ে কোথাও চলে যাবে। কিন্তু তা কি যাওয়া হয়একেবারে যাওয়া কী অতই সোজা। এভাবে গল্প শেষ হয়ÑÑতবে তা বেড়ে উপন্যাসের নানান রূপ নেয়ার স্কোপ কিন্তু এতে আছে। তবু একে গল্প ভাবতেই বাসনা হয়। যেমন, এখানে এমন সব ঘটনা আছে যা অনায়াসে এক-একটা উপন্যাসীয় প্রবণতা নিয়ে রেখেছে। আজ যে চৈতন্য দাস লিচুর খোসার মতো চোখ (দারুণ উপমা!) নিয়ে বসে থাকে, সময় পার করে, ছেলের অবহেলা দেখে, পরনারীতে মগ্নতা টের পায়, নিজের পুত্রবধুর নিঃশব্দে সব মেনে নেয়ার করুণ-চিত্র বুঝতে পারেসবসবয় সে তো এমন থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ সেও কম দাপুটে ছিল না। আভারানীকে পাওয়ার আশায় সে জোড়া-খুনের আসামী পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। কুমার আর ধোপাদের ঘরে ঘরে তার দারুণ দাপট ছিল। সে বুঝত যেখানে টাকার জোর সেখানেই মনে জোর। তার ছেলের পাঁচ আঙুলে পাঁচটি আংটি দেখে তার নিজের জীবন পাঠ করতে থাকে। অথচ এই হলধরই বউটার জন্য কী পাগল ছিল। আর্মির ক্যাম্প থেকে পালানো/মুক্ত হওয়া/ কারো সাহায্যে বেরিয়ে আসা মেনকার জন্যেও তার মায়ার কমতি ছিল না। অথচ এখন আর তাকে সে সহ্যই করতে পারে না। ‘মেনকা সুন্দরি থেকে এখন সে মেনকা খানকি হয়ে গেছে। এখন সে হলধরের কাছে বাসিমড়ামাত্র!... মেনকার সরু ঠ্যাং আর চ্যাপ্টা উরু দুখানাকে দায়ের কোপে কলাগাছের মতোই কুচি কুচি করে কাটতে ইচ্ছা করে।’ এমনই দুর্ধর্ষ উপস্থাপনা গল্পসাহিত্যে বিরল নয় কি? কিন্তু এখনকার দিন পাল্টে যাচ্ছে, মুসলমানরা তাতে ভাগ বসাচ্ছে, নিকারিগিরির ব্যবসা ওরাও করতে শুরু করেছে। দাদন ব্যবসা আরো জোরদার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বেয়াদব-দুর্ধর্ষ একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী যেমন বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দ্রুত বেড়ে যেতে শুরু করেছে। বাম-প্রগতিশীল সংগঠন তখন হুহু করে বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু মাহমুদুল হক তা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে দেখছেন না, বা এর ফিলসফি মানছেন না। এখানেই তার শিল্পের স্বাধীন মুক্ত চর্চা নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের প্রচুর অবকাশ থেকে যায়! মুক্তির লড়াই তো তখন মানুষের চৈতন্যকে নানাদিকেই বিস্তৃত করছে, মানুষ আর বাধ মানতে চাইছে না। এই সহজ-সত্য তিনি দেখেননি বা গা করেননি!
যাই হোক, তিনি নিজেকে তার কন্ট্রোলে রেখে একটা চমৎকার গল্পই করতে পেরেছেন। ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা (যা কখনও ছোটগল্পের সংজ্ঞা হিসাবে খোদ রবিঠাকুরও বলেননি, বা মানেননি; এটি মূলত ‘বর্ষাযাপন’ কবিতার পঙ্ক্তি, যেখানে কবি তার বর্ষা কিভাবে পার করতে চান তাই বলেছেন। অথচ অনেকানেক পাঠক একে ছোটগল্পের সংজ্ঞা বলে দেদারসে প্রচারণা চালাচ্ছেন) ধরনের আব্দার তাতে নেই। বিশাল প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি তার প্রতিভাবলে একটা গল্পের আবহ বজায় রেখেছেন। ভাষার দাপট এখানে বেশ কার্যকরভাবে এসেছে। তিনি যে সংলাপ ব্যবহার করেছেন, তাতে গল্পের প্রাণ যেন নানাভাবে কল্লোলিত হয়েছে। গল্পের একটা শক্তি তাতে প্রকাশ পেয়েছে। এখানে চরিত্র কি কার্যত একটিইহলধর নিকারিই? বাকি সবাই তাকে সঙ্গ দিয়েছে কেবল! তা কিন্তু মনে হয়নিএই যে একেবারেই কথা না-বলা মেনকা বা কেশব, তারা কত প্রয়োজনীয়ভাবেই না গল্পে হাজির-নাজির থেকেছেন। নিজেদের প্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছেন। এটাই মাহমুদুল হকের চমৎকারিত্ব। অতি অল্প সময়ের জন্য এলেও নিজের রক্ত-মাংস সহযোগে তার মানুষতা জারি রাখতে পেরেছে। গল্পটি সাধারণ বর্তমানে বলা হলেও পুরাঘটিত বর্তমান আর নিত্য বর্তমানও ব্যবহার করেছেন। আবার একই বাক্যে পুরাঘটিত বর্তমান আর নিত্য বর্তমান ব্যবহার হতে দেখি। এতে যতিচিহ্নের নবতর ব্যবহার দেখি। বিশেষ করে ড্যাশ এখানে নতুন অবয়ব নিয়ে এসেছে। এটি কখনও বাক্যের শেষে, কখনও শুরুতে, এমনকি মাঝখানেও গল্পকার ব্যবহার করেছেন। গল্পে ৪৭টি ড্যাশ ব্যবহৃত হয়েছে বাক্যে ব্যবহৃত অকথিত কথাকে পূর্ণতা দেয়ার ইঙ্গিত হিসাবে। আইন কী বলেএ নিয়ে আবার কোনো রুলনিশি জারি হয় কিনা? এখন তো আমরা আইন দিয়ে সব যাচাই-বাছাই করার কাল পার করছি। আদালত অলরেডি বলে রেখেছে ভাষা বদলানো যাবে না! প্রমিত ভাষার মান বজায় রাখতে হবে। এই ধরনের ড্যাশ ব্যবহারের স্বাধীনতা তো বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রমিত বাংলার ব্যাকরণে দিয়ে রাখেনি। এ প্রশ্নও আসে, সৃজনশীল ব্যাকরণ বলে তো কিছু কারও জানা নাই। গল্পকার কর্তৃক কাজেই চিহ্ন বদল হয় কী করে! এ প্রশ্ন আসতেই পারে। আমরা আপাতত আতঙ্কিত হয়েই থাকলাম। তবে গল্পটিতে কতিপয় উপমা দারুণ সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়েছেঅপসৃয়মাণ আঁধার, খোসা ছাড়ানো লিচুর মতো চোখ, গুমরানো গন্ধ, হরেদরে বিকোনো বরফে ঠান্ডা, ঝটাৎ ঝটাৎ করে চুল ঝাড়ছে, পচা বাদলা নামবে...
আবারও বলতে হয়, গল্পে দারুণ কন্ট্রোল প্রকাশ পেয়েছে, তাতে গল্প থেকে উপন্যাসের মজাই শুধু প্রকাশ পায়নি, বরং আমরা বোর্হেসের গল্পত্ব নিয়ে অহঙ্কার স্মরণ করব। এমন একটা কথা চালু আছে যে বোর্হেস বলেছিলেন, আমি যদি দশপাতায় সব কথা বলে দিতে পারি তাহলে তলস্তয়ের মতো অত বড়ো যুদ্ধ ও শান্তি বেহুদা সৃজন করব কেন? এটা একটা বাণী বটে, যে বাণী হলধর নিকারির একদিন পড়তে পড়তে আমারও কেবলই মনে হতে থাকে।
এই যে গল্পটা মাহমুদুল লিখলেন, তাতে কোনো বাড়তি চাপ কি নিয়েছেন; মানে কোনো পক্ষকে রাজি/নিমরাজি বা খুশি করার প্রকল্পে তিনি নামেননি। তিনি তার নিজের কাছেই দায়ী থেকেছেন। তিনিই আসামী, তিনিই এর ফরিয়াদী! তাতে শৈল্পিক স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ হওয়ার একটা চান্স কিন্তু থেকেই যায়! এই গল্প এই মানুষ, এই সমাজা তো তখন ছিলই। অনেকেই গল্প লিখেছেন, তিনি এ গল্প নিয়ে আলাদা কিভাবে হলেন? তা হলে এভাবে যে তাকে কারও মায়ায় রাখতে হয়নি, কারও মায়ায় তিনি জড়াননি। তিনি নিজের ঈশ্বরত্ব নিজেই নাজেল করতে পেরেছেন। নিজের রাজা নিজে হওয়ার মতো শৈল্পিক-উন্মাদন আর কিছুই হয় না। এখন কথা হচ্ছে, এই দাপট, এই জীবন-সমাজ, বুদ্ধিবৃত্তিক মহল মানবে কিনা? তিনি কি কারও মানা-না মানার নছিহত নিয়ে তা সৃজন করেছেনÑÑতা করেননি বোধ করি। এটাই হচ্ছে কথা, কথা সেটাই যার কোনো অংশীদার নেয়, বাড়তি চাপাাচপি নেই, নিজের কাজটি নিজেই সমাধা করার বাসনা রাখেন। নিজের জগৎ নিজেই সৃজন করেন। তিনি নিজেই নিজের আনন্দ, নিজের ইন্দ্রিয়ানুভূতি, এমনকি নিজেই নিজের ঈশ্বর।
‘গরু-ছাগলের গল্প’টি পাঠকালে মনে হতে পারে, কথার সাগরে আমরা অবগাহন করছি। কখা আর কথা,তিনি কথা লিখতে জানেন বটে। এই কথা মানে ডায়লগ,প্রচুর ডায়লগ এখানে। সেই একাত্তরের গল্প। রাজাকারদের মোকাবেলা করার জন্য, তাদেরকে বাগে আনার বা রার্খাও গল্প। কিভাবে তাদের হাত থেকে বাঁচা যায়, তার বুদ্ধি চলে। এ তো গল্পের বেশিরভাগই হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষ। এ গল্পকার যখন কথা বলেন, মানে গল্প নির্মাণ করেন, তখন কাউকে ক্ষমাঘেন্না করে কিছু করেন না। যার যা প্রাপ্য তাই তিনি দিতে জানেন। শিল্পের স্বাধীনতার একটা চেহারা আমরা তার কাছ থেকে পাই। তিনি কোনো ধারণাই থাকেন না, সমাজ-সংসার উদ্ধারের নামে শ্লোগান দেন না। পাঠককে নিয়ে দল পাকান না। তারা যা দেখে, যা জানে, তাকেই রাঙিয়ে তোলে। একধরনের আনন্দময়তা তার থাকে, যন্ত্রণা থাকে, হাহাকার থাকে। থাকে রোদনময়তাও। এখানেও আছে রাজাকারদের ভয়ে, তাদের বাবা অর্থাৎ পাক-আর্মিদের ভয়ে মানুষ গরু-ছাগলের মতোই কেবল দৌড়াদৌড়ি করে। তবু তাদেরকে ঘিরে ফেলে, একে একে জড়ো করে। তাদের ভিতরই আমরা তপা আর ননীকে দেখি। তারা তাদের জীবনকে দেখায়, ওরা ভালোবাবাসার চেয়েও পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু তারা বাঁচতে তো পারে না। জোছনাকেও তারা শত্রু মনে করতে বাধ্য হয়। কারণ তাদের জীবন ম্রিয়মাণ হতে থাকে। কথার পিষ্টে কথা দিয়ে রোজ-কেয়ামতের এ আলামত আমরা দেখি আমরা দেখি শব্দ কতো তাপময়, রোদনমুখর, কত বেদনার্ত হতে পারে। আমরা শব্দ, কথা, ডায়লগ দিয়ে যা দেখি তা হচ্ছে শিল্পের অপার জমিন, বিশাল ল্যান্ডস্কেপ, জীবনকে যেন ছাড়িয়ে যায় তা। এমনই বিপুল কর্মযজ্ঞ নির্মাণ করেন একজন মাহমুদুল হক। ভাষার আলাদা এক চরিত্র পায়, মমতা পায়। সব মিলিয়ে একজন সৃজনীসত্তাকে আমাদেরকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে। কোনটা গল্প হবে তা কিন্তু একজন গল্পকার নির্ণয় করেই তার কাজ শুরু করেন। একটা গল্প শুরুতে গল্প থাকবে আর বাড়তে বাড়তে তা উপন্যাসের চেহারা বা মর্জি নেবে তা কিন্তু মনে করা মুশকিলই। গল্পকার তার প্রতিটি লাইন থেকেই তার জায়গা-জমিন ঠিকঠাক করেই লেখা শুরু করেন। এই বিষয়টা প্রায় সব গল্পকারের বেলায়ই হয়ত সত্য। একজন মাহমুদুল হকের গল্পে তা আরও জোরালোভাবেই বোঝা যায়। এই যেমন তার সৃজিত ‘বুড়ো ওবাদের জমা-খরচ’-এর কথাই ধরা যাক, এর শুরু হচ্ছে, ‘আজ তিনদিন থেকে গাছের পাতার পলক পড়ে না; দুপুরের হা-হা শূন্যতায় কেবল তপ্ত হাওয়া হলকা তীব্র ঘুর্ণির পেকে খায়।’ এইভাবেই প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার উপর যেই গল্পের শুরু সেখানে একজন ওবাদের দেখা জীবন আছে, চুরি-চামারি, মানুষ হত্যা, তীব্র খরা সবই আমরা গভীর পরিকল্পিত বয়ানে লক্ষ করি। আমরা গল্পের শেষে দেখি তিনটা শিশুকে গোর দেয়ার কাহিনি, যা আমাদের রক্তমাংসেও আলাদা এক যন্ত্রণা আনে। গল্পের মানবিক আচরণ এখানে ভিন্ন রূপ পায়। একজন ওবেদ আর চোরাকারবারি থাকে না, মানসলোকের অদ্ভুত মধুর চরিত্র হয়। এ গল্পের ভাষাটায় গল্প নির্মাণের আলাদা এক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তার ব্যবহৃত ভাষা বইপত্র বা লেখককথন থেকে আসেনি। মা-মাটি-মানুষের নিবিড় ছায়া থেকে উঠে এসেছে। এমনই অপূর্ব স্থাপত্য লক্ষ করি ‘হৈরব ও ভৈরব’ নামের দীর্ঘ গল্পে। গল্পটি এক সম্প্রদায়ের ব্যথা-বেদনা হয়ে থাকেনি। ঢোলক সম্প্রদায় বা কথিত সংখ্যালগুর বিষয় শুধু নয়, এ হচ্ছে, একটা শিল্পধারার মনোযাতনার কথা। তারা আর ঢোল বাজাতে পারে না। সময় পাল্টে গেছে। মানুষ এখন বিকল্প সৌন্দর্য সন্ধান করে, বাদ্য-বাজনা শোনে। তবে এ গল্পের সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে এর বর্ণনাভঙ্গি, ডায়লগের ভিতর গল্পের প্রাণ ছেড়ে দেয়ার এক কৌশল। হৈরব আর ভৈরব হচ্ছে বাপ-বেটা। তাদের সংসারের কথা, ভালোবাসার কথা, ঝগড়া-ফ্যাসাদের নানান ধরন এখানে দেখি। সবকিছুর উর্ধ্বে আছে তাদের সম্প্রদায়গত মনঃকষ্ট, শিল্পের জন্য হাহাকার। এখানে একটা সামাজিক বিন্যাস এনেছে, ঢোলকদের জীবনীর ভিন্ন এক ধরন নিয়ে এসেছে। জীবননির্মাণের এমন মৌলিকত্ব, স্বাধীন চৈতন্য আমাদের গল্পজগতে তেমন একটা নেই।
মানুষ চায় বহুরকমের শান্তি, বাসনা, রসনাও বটে! সেইসব নির্ণয়ের এক-এক দিক তিনি উন্মোচিত করেছেন। তেমন গল্প ‘হঠাৎ জোৎস্নায়‘। যেখানে স্বামী নামের সিকান্দর শেষ পর্যন্ত জমিলা নামের বউয়ের কাছে নিজেকে একেবারে মেলে ধরে। এ যেন গল্প নয়, জীবনের গহীন কোনো নিবেদিত-সত্যকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার এক কথাস্থাপত্য। নিজেকে গড়া, ভাঙ্গা আর এক-একভাবে নিজেকে সেট করে নেয়ার নামই যেন জীবন! এমনই সংসারের গল্প তিনি প্রায়ই নির্মাণ করেছেন! ‘প্র্রতিদিন একটি রুমাল’র কথাই ধরা যাক, মনে হতে পারে এটি স্রেফ গার্হস্থ্য কথকতার গল্প, একধরনের ফ্যান্টাসি উৎপাদনের জায়গা, এখানে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের খাই-খাই মধ্যবিত্ত আছে, বা নষ্টভ্রষ্ট সময়ের কথা। কিন্তু এতে যে মধ্যবিত্তের পরাজয়ের জীবনগাথা আছে, রুমাল হারানোকে জীবনের যাবতীয় কিছু হারানোর চমৎকার জগৎ আছে, তা কি আমরা দেখব না? ‘কালো মাফলার‘ বা ‘বেওয়ারিশ লাশ‘ নামের গল্পসমূহে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান আছে, কিন্তু সেখানেও মানবচরিত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা নষ্ট হয় নাই। একটা মাফলার মুক্তিযুদ্ধের হাহাকারের এক জান্তব চিহ্ন যেমন হয়, ‘বেওয়ারিশ লাশ’ নামের গল্পে একটা লাশকে সরানোর কাজে অনেকেই নিয়োজিত হতে থাকলে, গল্পটির মূল চরিত্রটি ফাঁকা ঘরে বউয়ের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার সহজাত বাসনা প্রকাশ করে! এই তার সাহস, নিজেকে দেখানোর, মানুষকে খোলাসা করে প্রকাশের অত জান্তব তৃষ্ণা আমরা খুব একটা দেখি না। শেষ পর্যন্ত মানুষ যে মানুষই, কোনো দেবতা নয় তাই দেদীপ্যমান থেকেছে। আমরা সময়কে মহিমান্বিত করতে পারি, করতে চাইও; কিন্তু এর পরের জীবনের সাথে বা তারও আগের জীবনের সাথে যে এসবের যোগসূত্র আছে বা থাকাটাই স্বাভাবিক, তাই তিনি আমাদের জানাচ্ছেন। তার গল্পনির্মাণে ভাষা এক স্থাপত্যশৈলী হিসাবে কাজ করে। অত ডায়লগ, অত মাজাদার করে আর কেউ তেমন পারে না। ন্যারেশন আর ডায়লগের ভিতর যে মিতালিটা আছে তাও গল্পনির্মাণের এক জগৎ হয়ে আছে। তাঁর গল্পপাঠে কখনও মনে হয়, তিনি গল্পের ভিতর একধরনের জাদু রেখেছেন। তিনি গল্পের একেবারে শেষদিকে একটা বক্সের ভিতর থেকে এমনকিছু বার করবেন যাতে তার পাঠক একেবারে টাসকি লেগে যায়। জীবনযাপনের সমস্ত পর্যায়ে তিনি যেন সেই স্মৃতি, জাদুর সেই মমতা আর ভুলতে না পারেন। কিছু গল্পে তো এ বিষয়টা আছেই,যেমন, ‘মনসা, মাগো’, ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’, ‘রিজিয়ার পাপ’, ‘গরু-ছাগলের গল্প’ বা ‘ল্যুগার ও বেলুন’ ইত্যাদি গল্পে সেই বিষয়টা আছে। ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’, ‘মনসা, মাগো’ নামের গল্প দুটি প্রায় একই ধরনের দায়িত্ব পালনে রত। মধ্যবিত্তের একধরনের চিৎকার, বা একধরনের মানবিক এরেঞ্জমেন্ট আছে। ‘মনসা, মাগো’ গল্পের মূল জমিন মদ খাওয়াখাওয়ি হলেও নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর এক নান্দনিক মতলব লেখকের আছে। একটি মেয়েচরিত্র নিজের শরীর নিয়েই জীবন চালায়, ঘাটে ঘাটে তার শরীর বিলানোর ইতিহাস আছে। তবু তার ভিতর শুদ্ধতা আছে, একধরনের দ্রৌপদী, এক পবিত্র সত্তা আমরা আবিষ্কার করি। ভাষার প্রবল প্রতাপ এ গল্পে আছে। ভাষাই যে কথার জীবন তা এ গল্পে ভালোভাবে এসেছে। একধরনের মমতা জীবনে থাকেই, যে মমতা আমরা ‘রিজিয়ার পাপ’-এ দেখি। মানুষের প্রতি ভালোবাসার সে কি ব্যবস্থা এখানে আছে! তবে কিছু গল্পের শরীর, ভাষা, মেজাজ নির্মাণে কিছু হতচকিত ভাব দেখি, তেমনই গল্প হচ্ছে ‘পালক’, ‘রিজিয়ার পাপ’ ইত্যাদি। আমরা তার গল্প-মারফত একধরনের গল্পজমিনের মুখোমুখী হই, নিজেদেরকে রাঙাতে পারি, প্রস্তুতও করতে পারি। গল্প বলার ধরন, মেজাজ, আবহ তৈরি, মুক্তচৈতন্যকে লালনের ব্যবস্থা, সর্বোপরি শিল্পের স্বাধীনতা কত ব্যাপক আর প্রাণবন্ত হতে পারে তা তার গল্পের নির্মাণে প্রত্যক্ষ করি। 

 [চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত গল্পকথা (মাহমুদুল হক সংখ্যা), রাজশাহী, ২০১৪ থেকে মুদ্রিত]









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ