bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

নিজের শিকড়ের সন্ধান করতে হবে--মোজাফ্ফর হোসেন

কারিগরি সমস্যার কারণে গতিপথ এতদিন থেমে ছিল। বলতে, একমাসেরও বেশী সময় পেরিয়ে আবারও শুরু হচ্ছে আলাপ সিরিজ।
করোনা মহামারীর অস্থির সময়ে গত মে-জুন মাসে কথাসাহিত্যিক মেহেদী উল্লাহ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে সমসময়ের কবি, কথাসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীগণের সাথে 'হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার' (Half an hour chatting about culture) শিরোনামে প্রায় প্রতিদিনই চিন্তামূলক আলাপসমূহ প্রকাশ করেছিলেন, যা সে সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। গতিপথ বাংলা ওয়েবজিনের আলাপ-সিরিজে আবারও প্রতি রবিবার মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার এর একটি করে পর্ব প্রকাশিত হতে থাকবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, আমাদের বিগতকালের লেখক-বুদ্ধিজীবীগণের সংস্কৃতি বিষয়ক বহুবিধ ও বহুমাত্রিক চিন্তা প্রবাহ তাঁদের রচিত গ্রন্থগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে এবং তাঁদের সময়ের চিন্তার সাথে বর্তমান সময়ের লেখক-বুদ্ধিজীবীগণের চিন্তার তূলনামূলক পাঠ হিসেবে ‘হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং অ্যাবাউট কালচার’ এক অতি বড় সুযোগ। আমরা মেহেদী উল্লাহ’র এমন উদ্যোগকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করি। তাই আমরা এটির সংকলন ও প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী হয়েছি।


আলাপ সিরিজ : মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার পর্ব-১১

মেহেদী উল্লাহ’র টাইমলাইন: রবিবার, ২৪ মে ২০২০; রাত ০৯ টা ৪২ মিনিট

এ পর্বে থাকছেন কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মোজাফ্ফর হোসেন (Mojaffor Hossain)। সংস্কৃতি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে—
মেহেদী উল্লাহ : 'বিশ্বসাহিত্য' হিসেবে পুরো পৃথিবীতে যে ধরনের টেক্সট ছড়িয়ে পড়ে, অনুবাদ হয়, এটা আসলে কার কার্যকারিতার ফল; লেখকের লেখার মান, প্রকাশকের আগ্রহ, পাঠকের চাহিদা না লেখকের সময়ের বাস্তবতা?
মোজাফ্ফর হোসেন : অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। যে টেক্সটগুলো ছড়িয়ে পড়ে, সবগুলো কিন্তু একইরকমের না, না শৈলীর বিচারে, না গল্পের বিচারে, না শিল্পের বিচারে। এর মধ্যে তুলনামূলক দুর্বল বইও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কয়েক ধরনের কার্যকারিতার ফল। প্রথমত, পলিটিক্স। টেক্সটচুয়াল পলিটিক্স। মানে পশ্চিমা প্রকাশক কোন দেশের লেখককে বা কোন ধরনের কন্টেন্ট পিক করবে সেটা দেখার বিষয়। প্রথমত বলি, ভালো অনুবাদে ভালো টেক্সট আমাদের দেশ থেকে প্রকাশিত হলে পশ্চিমের মার্কেটে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর আন্তর্জাতিকতার বিষয়টি যেহেতু ওখান থেকে ছড়ায়, মানে ওদের হাত ধরে সেটা আসে, লেখক যে দেশেরই হোক না কেন। তাই পশ্চিমা প্রকাশক/এজেন্টরা কি চাচ্ছেন সেটা বড় বিষয়। মানটা এখানে আপেক্ষিক। এমনকি পাঠকের চাহিদার বিষয়টিও। একটা উদাহরণ দিই। আরববিশ্বের এক নারী লেখক পশ্চিমা এজেন্টের কাছে তার ইংরেজি পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছে। এজেন্ট বইটা পড়ে করতে চান। কিন্তু তিনি চান, সেখানে কিছু পারিবারিক যৌনতার বিষয় আসুক। মুসলিম বিশ্বের এ ধরনের গল্পে ইউরোপের আগ্রহ আছে। আবার পাকিস্তানী এক লেখক পাণ্ডুলিপি দিয়েছে, তার এজেন্ট তাকে বলে ভারতীয় বিষয় যুক্ত করে দিতে, কারণ ভারতীয় সাহিত্যের ব্রান্ডিং ইউরোপ আমেরিকায় ভালো মতো হয়েছে।
আরেকটা কথা বলি। এখন কিন্তু সাহিত্য শুধু শিল্পসৃষ্টির বিষয় না। ভালো শিল্প হলেই পাঠক বিদেশি বই পড়বে তা না। সাহিত্য এখন কালচারাল স্ট্যাডিজের বিষয়। অনেক বিষয় এখন চলে আসে। তাই টেক্সট নির্বাচনের বিষয়টি কোনো সরল অংকে মেলে না। আফ্রিকার এক ধরনের টেক্সট, আবার এশিয়ার আরেক ধরনের টেক্সট পাঠক প্রত্যাশা করে। আরেক ধরনের টেক্সট জনপ্রিয় হয়, যেটা পপসাহিত্য। যেমন ধরুন, গোয়েন্দা, ফ্যান্টাসি, অ্যাডভেঞ্জার, coming age ফিকশন। এগুলো এশিয়ার লেখকরা ভালো লিখতে পারেন না। অন্তত পশ্চিমে সেটাই ধারণা। ফলে বাংলাদেশি এক লেখক যখন সায়েন্স ফিকশন লিখে এজেন্টকে দিলেন, তারা সেই গল্পটা পছন্দ করার পর বলল, লেখকের নাম বদলে দিতে হবে। মুসলিম লেখক সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন. এটা আমেরিকার পাঠক নেবে না। শেষ পযন্ত 'সিডেরা জাকস' নামে বাংলাদেশি লেখকের উপন্যাসটা প্রকাশিত হলো।
মেউ : এইযে অথরকে চাহিদা অনুযায়ী টেক্সটকে এদিক সেদিক করতে বলেন, তার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক আধিপত্য কীভাবে তৈরি হয়, পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে?
মোজাফ্ফর হোসেন : সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের যে রাজনীতি সেটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন নেটিভ লেখকরা। যারা ডায়াসফোরিক কনটেক্সট থেকে লিখছেন তারা সবসময় এই আধিপত্যবাদবিরোধী যুদ্ধটা করতে পারবেন না। কোথাও না কোথাও টান পড়বে। কারণ তার প্রকাশক, পাঠক সকলে যেটা চান সেটাকে একেবারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিতে পারেন না। নাইপল, রুশদির মতো শক্তিধর লেখকের কথা আলাদা, যারা দিনশেষে কোনো দেশেরই বা জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেননি। তাই আমি মনে করি, নেটিভ সাহিত্য হলো কোনো দেশের আসল সাহিত্য, যেটা অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কারণ এই ধরনের সাহিত্য কোনো রকম আন্তর্জাতিকতাবোধের বিবেচনায় নেই। লেখক ভাবেননি যে তাকে আমেরিকার একজন পাঠককে সন্তুষ্ট করতে হবে। যেমন ধরুন, পামুক নিজে বলছেন, আমার স্বদেশি পাঠকের চেয়ে বিদেশি পাঠক বেশি। তাই গল্পটা লেখার সময় আমার মাথায় কোনো স্বদেশি চিন্তা থাকে না। এখানে সমালোচিত হবে কিনা সেটি ভাবি না।
সরাসরি আপনার প্রশ্নে আসি, ভীষণভাবে আধিপত্য তৈরি হয়। অল্পকথায় যদি বলি, দেখবেন পশ্চিমের তৃতীয় শ্রেণির টেক্সটকেও আমরা আমাদের প্রথম শ্রেণির টেক্সটের চেয়ে মর্যাদা দিই। আমরা যখন আন্তর্জাতিকতার কথা বলি, নিজেদের সাহিত্যকে সেই আন্তর্জাতিকতার অংশ মনে করি না। খুব ভালো হলে বলি, বিশ্বমানের হয়েছে। কিন্তু এই আদর্শ মান কারা সেট করে দিয়েছে, সেটা ভাবি না। বাংলা সাহিত্যও যে বিশ্বসাহিত্যের অংশ এটা তো আমরা ভুলেই গেছি। আধিপত্যবাদের কারণে শুধু মার্কেট না, আমাদের মননেও ওরা জায়গা করে নিয়েছে।
মেউ : দারুণ বলেছেন!
মোজাফ্ফর হোসেন : কদিন আগে আমি এ নিয়ে একটা পোস্টে লিখেছি যে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইংরেজি বিভাগে পশ্চিমা সাহিত্য পড়ানো হয় এমন করে যে বাংলা সাহিত্য যেন কিছুই না। ঢাকায় বসে বিদেশি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করার একটা শিক্ষাব্যবস্থা ঢুকে গেছে। ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে। আমরা শিখব। কিন্তু ওদের শিল্পসংস্কৃতির দাস হয়ে নয়।
আমার মনে হয়, আপনি অন্য বা সম্পূরক প্রশ্ন করতে পারেন। আমি বেশি বলে যাচ্ছি।
মেউ : আচ্ছা। ভালো লাগছে আপনার কথা। এই হীনমন্যতা কি ঔপনিবেশিক বাস্তবতার কারণে তৈরি হয়েছে? ওদেরই সব ভালো?
মোজাফ্ফর হোসেন : একভাবে তো বটেই। অনেক বছর ধরে এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে। চিরন্তন ইমেজই তো এখন হয়ে গেছে, সাদা ভালো, কালো মন্দ। দেখবেন সাহিত্যের ইমেজ শুধু না, জীবনধারণের অনেক কিছু আমরা ওদের থেকে নিয়েছি। আমার কেন জানি মনে হয় আফ্রিকার চেয়ে আমরা বেশি অনুকরণ করতে গেছি। আফ্রিকাও তো দীর্ঘ সময় ঔপনিবেশিক ছিল। কিন্তু ওদের সাহিত্যের ইমেজ যত নেটিভ, আমাদের তত না। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের সৌন্দর্যের যে ধারণা আমরা লালন করছি এখন সেটা কয়েকশ বছর আগে এই অঞ্চলে ছিল না। আমরা এত বেশি গ্রহণ করেছি যে মৌলিকতার প্রশ্নে আফ্রিকার চেয়ে আমরা এখন পিছিয়ে আছি। আর এটাও ঠিক অনুকরণ দিয়ে বিশ্বে নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি করা যাবে না। আচেবে থেকে শুরু করে জিব্রান, ওয়ালকট, এলিতেস এরা কেউ অনুকরণ করে উঠে আসেনি। ঔপনিবেশিক বাস্তবতা থেকে বের হতে হবে। এখন আমাদের নিজের শিকড়ের সন্ধান করতে হবে। আমাদের আধুনিক সাহিত্যের অনুপ্রেরণা বলি, রুট বলি সেটা এখন ইংরেজি সাহিত্য বলে আমার ভীষণ মনে হয়। কিন্তু মধ্যযুগীয় সাহিত্যের যে কাঠামো বা প্রবণতা সেটাও আমরা কাজে লাগাতে পারতাম, পারিনি।
তবে একটা কথা যোগ করি। বাংলাদেশের নেটিভ বা আঞ্চলিক সাহিত্য বিদেশি পাঠকদের কাছে পৌঁছতে হলে আমাদের দেশের ইংরেজি সাহিত্যকেও শক্তিশালী করতে হবে। ভারত যেটা করেছে। চীন করেছে। ডায়াসপরিক কনটেক্সট থেকে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশ্বে দাঁড়িয়ে গেলে বাংলাদেশের সাহিত্যের ব্র্যান্ডিং হবে। সেটাই সব না। পাশাপাশি দেশের ভেতর থেকেও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চার কমিউনিটি থাকবে। এর ফলে বাংলা ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করা সহজ হবে কারণ, বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ইতোমধ্যে ইংরেজি ভাষায় চলে যাবে। আমরা দোকানপাটের নাম থেকে শুরু করে উপন্যাস, নাটক, সিনেমার নাম ইংরেজি করে ফেলেছি। কথায় কথায় আমাদের চরিত্র ইংরেজি বলে, কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইংরেজি ভাষায় ভালো মানের বাংলাদেশি লেখক তৈরি করতে পারিনি। বরঞ্চ নিরুৎসাহিত করেছি। বাংলা ভাষার প্রতি তখন দরদ উতলে উঠেছে। আমি বরং বলি শুধু ভাষার বিষয় না, কেউ যদি ইংরেজি ভাষায় বাংলা সংস্কতি, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-লোকজীবন, এবং বাংলাদেশের গল্পটা চর্চা করে ভালোমতো, তাকে মেইনস্ট্রিমের গ্রহণ করা উচিত।
আমরা যদি চাই ইংরেজিতে অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের সাহিত্য বিশ্বজয় করুক, এবং এ জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দও থাকে। তাহলে দেশে একজন ইংরেজি ভাষাতেই যদি সরাসরি লেখে, তাকে কেন নিরুৎসাহিত করা হবে? এমন তো না ইংরেজি বাদে আমরা বিশ্ববাজারে পৌঁছাতে পারব।
মেউ : হ্যাঁ, আমার মনে হয় আমরা প্রত্যক্ষ উপনিবেশের সময়ে যতটা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম, উত্তর উপনিবেশের সময়ে নানাভাবে সেটাকে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চাইছি। বিউপনিবেশ চিন্তা আমাদের শিল্প-সাহিত্যে কিছুটা থাকলেও জীবনাচারে কমে যাচ্ছে।
মোজাফ্ফর হোসেন : আমাদের সবকিছু তো আসলে অনুকরণ। শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, মার্কেটব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিল্পব্যবস্থা, কোন ক্ষেত্রটা না? ফলে বের হওয়া মুশকিল। কিন্তু এর ভেতর থেকে নিজের বোধ ও দর্শনটা যোগ করতে হবে। নিজেকে বড় করে চিনতে হবে।
মেউ : কিন্তু ভাষাকে আপনি উপনিবেশের বাইরের কাঠামো থেকে কীভাবে ভাবছেন? ইংরেজি ভাষা মানেই তো একটা বড়সড় ঔপনিবেশিক টুল, নাকি? বলছেন, ইংরেজিতে লিখতে। ইংরেজি ছাড়াও তো অন্য ভাষার সাহিত্যের আধিপত্য আছে। জর্মন, স্প্যানিশ, রুশ ইত্যাদি।
মোজাফ্ফর হোসেন : সেটা কদিন আগ পর্যন্তও ছিল। এখন ইংরেজি ভাষাটা ব্রিটিশদের একক সম্পত্তিতে আর নেই। এটা এখন বিশ্বভাষা। এই ভাষাতে আমরাও অবদান রাখতে পারি। 'বাংলাদেশি ইংরেজি' বলে একটা স্বকীয় ইংরেজি ভাষা দাঁড়াতে পারে, যেখানে লুঙ্গি থেকে শুরু করে গামছা, শিমুল, জবা প্রভৃতি শব্দ যুক্ত হবে। আমরা কেন ভাতের অনুবাদ রাইস করব? আমরা ভাতই লিখব। ইংরেজির মধ্যে আমাদের মূল শব্দ ঢুকে যাবে। জর্মন, স্প্যানিশ, রুশ সাহিত্য দিয়ে আপনি আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার সব ধরনের পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারবেন না। ওসব ভাষার সাহিত্যও যে কারণে ইংরেজিতে অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে। আর আমরা জর্মন, স্প্যানিশ, রুশ গ্রহণ করতে পারলে ইংরেজিতে অসুবিধা কোথায়? বরঞ্চ ইংরেজিটা আমাদের লোকজন জানে। এটাতে অনুবাদ না করাতে পারলে আমরা জর্মন, স্প্যানিশ, রুশ ভাষায় তো পারবই না। আর প্রকাশই বা কে করবে?
মেউ : পুঁজিবাদী পৃথিবীতে বিশ্বমার্কেটের বিশ্ব ভাষাই ইংরেজি, ভাষার ক্ষেত্রেও ল্যাঙ্গুয়েজ মার্কেট আছে, ইংরেজি এখন তাই। সেই মার্কেটে গেলে আমরা কতটা সফল হব?
মোজাফ্ফর হোসেন : সফল ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে বড় কথা আপনি সেই ভাষার মধ্যেই আছেন। ঢাকার পথেঘাটে ঘুরলে কি মনে হয় ইংরেজি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা আর আমদানি করা সম্ভব? সেটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে একটা কমন ভাষা তো আপনাকে নিতেই হবে। না নিলে আরো একশ বছর হাহুতাশ করতে হবে। আমাদের মানিক-তিন বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত হলো না, বিদেশে কেউ পড়ল না, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশ্ববাজারে পৌঁছতে হলে এখন ইংরেজি লাগবেই। এর চেয়ে সত্য আর হয় না। কিন্তু সেই ইংরেজিটা আমেরিকান বাংলা ব্রিটিশ না হয়ে বাংলাদেশি হতে পারে। সেজন্য বাংলাদেশের ইংরেজি লেখক লাগবে ভাষাটাকে নিজস্ব করে দাঁড় করানোর জন্য।
শুধু অনুবাদ দিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব ইংরেজি দাঁড় করানো যাবে না।
আমাদের লেখকদের হীনমন্যতার আরেকটা প্রসঙ্গ তুলে ধরছি। দেখবেন, যারা ইংরেজি সাহিত্য পড়ে মোটা দাগে তারা বাংলাদেশের সমকালিন সাহিত্যকে গুরুত্ব দেয় না। বলে এখানে নতুন কিছু হচ্ছে না। আবার বাংলা সাহিত্য পড়ে অনেকে তাদের গদ্যের মাঝে বাংলা শব্দের পাশে অকারণে ব্র্যাকেটে ইংরেজি শব্দ দিয়ে দেয়। অকারণে বিদেশি লেখকদের উক্তি ব্যবহার করে। রেফারেন্স হিসেবে আমাদের লেখকদের অনেক সময় ব্যবহার করার থাকলেও কেউ করে না। তাতে গুরুত্ব নাকি কমে! অর্থাৎ পাঠকও সম্ভবত ইংরেজি শব্দ বা বিদেশি লেখকদের রেফারেন্স পছন্দ করে। এরকম ছোটোখাটো অনেক বিষয় আছে, অল্প সময়ের আলাপে সব হয় উঠে আসবে না।
মেউ : এখানে একটা বড়প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, অন্য ভাষার শব্দ যখন আরেক ভাষায় ঢোকে তখন সেই শব্দগুলো ওই ভাষার শব্দ হিসেবেই অভিধানে ঢোকে। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, পর্তুগিজ, চিনা ইত্যাদি অনেক শব্দই আমরা নিয়েছি, সে হিসাবে ইংরেজি থেকেও শব্দ আসছে। ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢোকা এবং বাংলার অংশ হয়ে ওঠা, আর বাংলা ভাষাভাষির ইংরেজি বাক্যের কাঠামোতে ঢোকা কি একই বিষয় হবে?
মোজাফ্ফর হোসেন : অনেকটা সেরকমই। ধরুন অবতার, জঙ্গল, বাংলো, চিঠি বা গুরু এরকম শব্দ যেমন ইংরেজিতে ঢুকে গেছে। সংস্কৃত প্রচুর শব্দ আছে। বাংলা ভাষার যত বেশি শব্দ ইংরেজি ভাষায় ঢুকবে ভাষাটায় তত বেশি আমাদের অধিকার জন্মাবে।
মেউ : আচ্ছা। আপনি ত দুই ভাষার সাহিত্যের বেশ খোঁজ রাখেন। এই সময়ের বাংলা, ইংরেজি ও অন্য ভাষার সাহিত্যের কী অবস্থা? আপনার পর্যবেক্ষণ কী? আমাদের বাংলা ভাষার সাহিত্য চিন্তার দিক থেকে অন্য ভাষার সাহিত্যের চেয়ে কতটা আগানো?
মোজাফ্ফর হোসেন : প্রথমেই বলি বাংলা ভাষায় রচিত হলেও বাংলাদেশের বাইরে বসবাসকারী যেকোনো মানুষের জন্য বাংলাদেশের সাহিত্যও বিশ্বসাহিত্যের অংশ। সব দেশেই খারাপ লেখার তুলনায় ভালো লেখা কম। কিন্তু এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের মোটা দাগে তুলনা চলে না। যেভাবে পরিসংখ্যান দিয়ে বলতে পারি, এই মুহূর্তে ফুটবলে আর্জেন্টিনা সেরা, না পর্তুগাল সেরা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এভাবে বলা যায় না। প্রতিটা দেশের লেখক সেই দেশের সাহিত্য ঐতিহ্য অনুযায়ী গল্পটা লেখেন। শিল্পধারণাটাও সবখানে একরকম না। জীবনযাপনের, চিন্তাভাবনার, বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি সাহিত্যের মধ্যে ফুটে ওঠে। ফলে চিন্তার দিক থেকে আমরা অন্য যে কোনো দেশের থেকে এগিয়ে বা পিছিয়ে নেই। মানে বলতে চাচ্ছি, আমি ঢাকায় বসে আমেরিকার চিন্তায় আমার দেশের মানুষের গল্পটা বলতে যাব কেন? আমার চরিত্র বিশ্বাসী হবে, সাম্প্রদায়িক হবে, দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়বে, বাউল হবে, আবার বাউল সংস্কৃতিবিরোধী হবে—ব্রিটিশদের মতো হবে না।
তবে আমি নিজে সমকালে সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, দেবেশ রায় এঁদের চেয়ে চিনের মো ইয়ান, ব্রিটেনের জর্জ সন্ডার্স, আমেরিকার জুনোট ডায়াজ, জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ইশিগুরো, পাকিস্তানের হানিফ কুরাইশি, ভারতের অমিতাভ ঘোষ কিংবা ঝুম্পা লাহিড়ি কাউকেই বড় লেখক মনে করি না। মানে বড় অনেক লেখক কিন্তু এঁদের চেয়ে বড় না। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের বাজারে সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, দেবেশ রায়দের কোনো স্থান আছে? ফলে আমরা যেমন কারো কারো তুলনায় এগিয়ে, আবার কারো কারো তুলনায় পিছিয়ে। মোটের উপর পিছিয়ে বা এগিয়ে এটা আমি বলতে চাই না।
মেউ : একটি গল্প বা উপন্যাস পড়ে কীভাবে বুঝেন এটা বড়কিছু?
মোজাফ্ফর হোসেন : বড় কিছু বোঝার প্রয়োজন হয় না। ভালো লাগার মতো কিনা এটা ভাবি। অনেক সময় দেখা যায়, আমার খুব ভালো লাগল একটা গল্প/উপন্যাস, কিন্তু সেটা বড় সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত না। আবার উল্ট বিশ্বসাহিত্যে বিরাট কিছু কিন্তু আমার পড়ে ভালো লাগল না। আমি নিজের পাঠরুচিকে গুরুত্ব দিই। আমি যখন পাঠক, তখন আমি অন্যের মতকে গুরুত্ব দিই না। আবার অন্য পাঠকের উপর আমার মত চাপিয়ে দিতে চাই না। তবে একটা কথা বলি, পাঠক হিসেবেও এক ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকে। ক্রিটিকরা সেটা দূর করে দেন। যেটা আমাদের সাহিত্যের নেই। উদাহরণ দিই একটা: আমি বছর বিশেক আগে প্রথম যখন হেমিংওয়ের অ্যা ক্লিন ওয়েল লাইটেড প্লেস গল্পটা পড়ি। আমার কাছে তেমন কিছু মনে হয়নি। ক্যাট ইন দ্য রেইন তো খুবই সাধারণ গল্প মনে হয়েছে। কিন্তু ক্রিটিকদের পড়ে আমি আমার প্রিয় গল্পের তালিকায় অ্যা ক্লিন ওয়েল লাইটেড প্লেইস গল্পকে গ্রহণ করি। ফলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবসময় ভালো মন্দ বিচার করা যায় না।
মেউ : আপনি ইংরেজিতে লিখছেন?
মোজাফ্ফর হোসেন : না। কারণ আমি ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই বাংলা ভাষায় লিখতে শুরু করেছি। আমার লেখক হওয়ার পরিকল্পনার ভেতর ছিল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়া। যে কারণে আমি ঢাবির অর্থনীতি ছেড়ে রাবির ইংরেজি বিভাগে থেকে গেছি। আমি নিজের গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। ইংরেজি বিভাগ থেকে বাংলায় শাশ্বতিকী সাহিত্যপত্রিকা করেছি। অনেক শিক্ষক বলেছেন ইংরেজিতে পত্রিকা করতে। আমি করিনি। আমি সবসময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কাজ করতে চেয়েছি। কিন্তু একইসঙ্গে আমার বন্ধু হিশাম মো. নাজের যখন ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেছে, ওকে উৎসাহ দিয়েছি। ইংরেজিতে কেউ লিখলে ভালো, কিন্তু ওটা আমার কখনোই পরিকল্পনার অংশ ছিল না।
মেউ : শাশ্বতিকীর কয়েকটা সংখ্যা দেখেছি। বেশ সমৃদ্ধ!
একটা মজার প্রশ্ন করি, অনেকগুলো সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন আপনি? পুরস্কারের মঞ্চে যাদের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন, একটা যেমন আনিসুজ্জামান স্যারের হাত থেকে, তাঁরা দিতে দিতে কী বলতে ছিলেন আপনাকে? নাকি হাতই শুধু কথা বলে?
মোজাফ্ফর হোসেন : আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি যা বলেছেন সেটা বললে অনেকে ভাববে আমি আত্মপ্রচার করছি। মানে এত বড় প্রশংসা করেছেন আমার 'বাঁশিওয়ালা মজ্জেল' নিয়ে যে আমি এখন আর বলতে চাই না। তবে আসাদুজ্জামান নূর একটা ভালো কথা বলেছেন, বলেছেন যে, আমি মেহেরপুর অঞ্চলের যে রাজনৈতিক সামাজিক ভাষ্য তুলে এনেছি ওটা উনার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এটা ভালো লেগেছে।
মেউ : আমরা আনিসুজ্জামানের বলাটা শুনতে চাই। আত্মপ্রচারের কিছু নাই। আপনি ভালো লেখেন।
মোজাফ্ফর হোসেন : বাদ দেন। উনি বেঁচে থাকলে বলতাম। যেমন, নূর আছেন বলে বলা।
মেউ : আত্মজীবনীতেও লিখবেন না? ভবিষ্যতে?
মোজাফ্ফর হোসেন : না। আত্মজীবনীতে আমার নিজের এত কথা লেখার আছে, যদি সত্যিই কোনোদিন আত্মজীবনী লিখি সেসব লিখব। এগুলো আসলে পাঠকের জন্য খুব জানার কিছু না। তবে আমার গল্প উপন্যাস এখন পযন্ত যা লিখেছি সেটাও আত্মজীবনীর ফিকশন ভার্সন।
মেউ : কিন্তু আনিসুজ্জামান স্যার সেটা প্রকাশ্যে বললেন না কেন? নাকি খুবই ব্যক্তিগত ছিল, যেটা আপনাকেই বলার ছিল?
মোজাফ্ফর হোসেন : প্রকাশ্যে অনেকটাই বলেছেন। উনার বক্তব্যের অর্ধেকটা ছিল আমার গল্প নিয়ে বলা। সেসব রেকর্ড আছে হয়ত কর্তৃপক্ষের কাছে। আমি নিইনি। তবে আমাকে দুয়েকটি বাক্য বলেছেন, শুধু আমার জন্য। আপনি গল্প লেখেন। অন্যরকম গল্প। নিজেও পুরস্কৃত হয়েছেন। আপনি তো বোঝেন। আসলে কিছু অনুপ্রেরণা ভেতর থেকে আসে। নিজের থেকে। অন্যরা উসকে দিতে পারেন বড়জোর।
মেউ : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এত গুরুত্বপূর্ণ আলাপে ছিলাম আমরা, সেটা আসলে এত কম সময়ের না। তবুও এটাই ঘটেছে, খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আপনি দ্রুত চিন্তা করতে পারেন। এই চ্যাটিং তার সাক্ষী হয়ে রইল। ভালো থাকবেন ভাই।
মোজাফ্ফর হোসেন : ধন্যবাদ আপনাকে, আমাকে স্মরণ করার জন্য।
ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ
অন্যপ্রান্তে: কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মোজাফ্ফর হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির অনুবাদ উপবিভাগে কর্মরত। প্রধানত কথাসাহিত্যিক। পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: অতীত একটা ভিনদেশ (২০১৬), খুন হয়ে যাচ্ছে সব সাদেক (২০১৮), পরাধীন দেশের স্বাধীন মানুষেরা (২০১৯)। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস: তিমিরযাত্রা (২০২০)। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ: বিশ্বসাহিত্যের কথা (২০১৮), পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প: ছোটগল্পের শিল্প ও রুপান্তর (২০১৯), দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য (২০২০)।
ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ

লেখক পরিচিতি:
মেহেদী উল্লাহ জন্ম:১৯৮৯ সাল
মেহেদী উল্লাহ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক। জন্মস্থান নোয়াখালীর সুবর্ণচর, বেড়ে ওঠা চাঁদপুরের কচুয়ায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। তিরোধানের মুসাবিদা (২০১৪) তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। তিরোধানের মুসাবিদা গ্রন্থের পান্ডুলিপির জন্য তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৩ অর্জন করেন। প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থ: রিসতা (২০১৫), ফারিয়া মুরগীর বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে (২০১৬), জ্বাজ্জলিমান জুদা (২০১৭), অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ (২০১৯)। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস: গোসলের পুকুরসমূহ (২০১৮)। প্রবন্ধ গ্রন্থসমূহ: ফোকলোরের প্রথম পাঠ (২০১৫), ফোকলোর তত্ত্বপ্রয়োগচরিত (২০২০), লোকছড়া: আখ্যানতত্ত্বের আলোকে (২০২০), নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ