bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

নূরুননবী শান্ত’র গল্প ক্যারিকেচার



ফুলমিয়া যে দশগাঁয়ে এক মহাবাউদিয়া যুবক হিসেবে বিখ্যাত ছিল সেকথা তো আগে থেকেই আমরা অনেকেই জানি।

গাঁও-গেরামে বাউদিয়া যুবকের নামে নানারকম মুখরোচক বদনাম থাকে। ফুলমিয়ারও ছিল। তবে বাউদিয়াত্ব ছাপিয়ে ফুলমিয়ার একটা সুনাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে খুব ভালো ক্যারিকেচার করতে পারতো। এতই ভালো তার ক্যারিকেচার যে নিজের কারিসমা আড়াল করার জন্য জনগণের চোখের সামনে সে যে সাদা পর্দা টানিয়ে দিত, সেই সাদা পর্দার উপরে ফুলমিয়ার ক্যারিকেচারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি নানান বর্ণের চলমান কল্পচিত্র হয়ে ফুটে উঠতো। আশ্চর্যই বটে। সবচেয়ে আশ্চর্য রহস্যজনক ব্যাপার এটাই ছিলো যে এক শো ক্যারিকেচার শেষ হয়ে যাওয়ার পর দর্শক-শ্রোতারা যখন নিজ নিজ চোখে পর্দায় চলমান কল্পচিত্র দেখার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিত, তখনই তারা পরস্পর পরষ্পরকে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করতো। কেননা বিচিত্র ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আলাদা আলাদা দর্শকের চোখে আলাদা আলাদা চিত্রকল্পের জন্ম দিতো। যেমন, পর্দার আড়ালে ফুলমিয়া যখন মুখ দিয়ে রেলগাড়ি ছোটাচ্ছে তখন সাদা পর্দার উপরে চোখ রেখে বাচ্চা-বুড়ো-যুবতী নারী মুখ হা করে আছে। সত্যিকারের রেলগাড়ি ছুটে চলার শব্দ হচ্ছে- ঝিকিৎ-ঝিক-কটাস-ঝ্যাক-ক্যাচৎ-ঝ্যাং-কুউউউউউ...। তারপর এইসব বিচিত্র ধ্বনি থেকে পর্দায় উৎপাদিত দৃশ্য নিয়ে দর্শকদের মধ্যে কথা হচ্ছে। হয়তো এক শিশু বলে ওঠে, ‘দেখছু, দ্যাখ হে, রেলের লাইন তো বেঁকা, তাই লম্বা গাড়িডা বেঁকা হয়া বাতাসের আগে আগে ছুটিচ্চে’। সাথে সাথে যুবতী কেউ হয়তো মুখ ঝামটা দিয়ে চাপা স্বরে বলে উঠবে, ‘হুম, কলেই হলো! এত্তুকোনা ছইল, তাই আবার বেঁকা করে গাড়ি যাওয়া দেকিচ্চে। হামরা বোলে ঝকঝকা দেকিচ্চিলাম, নাল গাড়িডা সোজা হয়া বিজলির মতো পার হয়া গেলো!’ কথাবার্তা শুনে বৃদ্ধ হাজি সায়েব মুখ বুঁজে থাকতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক, তিনি মুখ টিপে হেসে বলে ওঠেন, ‘পর্দার উপ্রে কুন্টি তোমরা ছায়াছবি পালেন হে, পর্দা তো সাদা ফকফক করিচ্চে। এমন ভাব করিচ্চেন যে মনে হয় তোমরা বায়স্কোপ দেখপের আচ্চেন। ফুলমিয়ার জিন তোমাগেরেও কাম সারছে মনে হয় হে’। ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো, পর্দার উপরে দেখা জীবন্ত ছবির রকমফের নিয়ে কাজিয়া-ফ্যাসাদ করলেও গাঁয়ের লোকেরা হাজি সায়েবের কথায় বোঝে যে বাউদিয়া ফুলমিয়ার উপর আসমানী কুদরতের ভর আছে। তা না হলে কোনো মানুষের পক্ষে পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকায়ে রেখে মুখ দিয়ে আওয়াজ করে এত কিছু বায়স্কোপের মতো পষ্ট করে দেখায়ে দেওয়া সম্ভব হয় কীভাবে। কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা এমনকি বাচ্চাকাচ্চারাও কোনোদিন চাকু দিয়ে মাটিতে কাটা নিষেধের দাগ পেরিয়ে পর্দার ওপারে আসলে কী হয় দেখার চেষ্টাও করে না। এই ফাঁকে ফুলমিয়া সারাগায়ে খাঁটি সরিষার তেল মেখে জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি তেলাওয়াত করে নিয়ে, আলহামদু সুরা, দরুদ শরিফ শেষ করে একটা সিলভারের পাতিল, দুইটা বড় বড় চামচ, একটা ঝুনঝুনি, কয়েকটা পাঁচ পয়সার মুদ্রা ইত্যাদি পর্দার পেছনে গোছগাছ করে রেখে ধীর গতিতে পর্দার সামনে এসে ঘোষণা দেয়- ভাইসগল, আপনেরা হামাক এনা সহযোগিতা দিমেন। হামার ক্যারিকেচার যতক্ষণ চলবি কেউ কিন্তুক বড় বড় করে কথা কওয়া যাবি নে। হামার তাহলে বিপদ হয়া যাবি। হামার কলে মরণও হবার পারে তাতে করে। আর আপনেরা কেউ কল্যাম পর্দার কাছাকাছি আসপেন না। আসার চেষ্টা করলে আপনাগেরে মহাবিপদ হয়া যাবার পারে। মাথা ঘুরে পড়ে যায়া মরে যাবার পারেন। আর মাও-বোনেগেরে কাছে হামার মিনতি, কোলের ছইল সামলায়ে থুয়েন, কোল থাকে নামায়ে মাটিতে ছাড়ে দিয়েন না। ছইল জানি কাউৎ করে কান্দে না ওঠে খেয়াল থুয়েন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুইটি চিকন সোজাসাপ্টা মাক্লা বাঁশ শক্ত করে মাটিতে পুঁতে টান টান করে সাদা পর্দা ঝুলানো হয়। ক্যারিকেচারের পর্দা টানানোর বাঁশ পুঁততে পেরে গাঁয়ের ছেলেদের সে কি ডাটফাট, যেন জীবনে প্রথম তারা একটা বাপের বেটার মতো কাজ করে ফেললো! কিন্তু পর্দা টান টান করে লটকানোর কাজটা ফুলমিয়া নিজের হাতে করে। পর্দার একদিকে দর্শক উদগ্র হয়ে বসে-দাঁড়ায়ে মুখে কুলুপ এঁটে টান টান হয়ে চোখ বড় বড় করে ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় থাকে। হাসির ঘটনা ঘটলে মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসে। বেশি শব্দ করে না। কিন্তু হাসির বা কান্নার যে ঘটনাই ধ্বনি-ব্যঞ্জনার আকারে পরিবেশিত হোক না কেন, সবরকম আনন্দ-বেদনার অনুভূতি ছাপায়ে সবাই কীরকম যেন বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে কারো কানের কাছে মুখ নিয়ে কেউ হয়তো কয়ে ওঠে, ‘বড়ই ডেঞ্জারাস চ্যাংড়া হে, লিচ্চয় অর ঘাড়ে জিনের বাস আছে। জিনডাই আসলে এগ্লে কাম করে, আর নামডাক হয় এই বাউদিয়া ফুলমিয়ার। বাউদিয়া হইলে হবে কি, চ্যাংড়াটা চাল­াক আছে কিন্তুক। মানুষের পক্ষে এগ্লে সম্ভাব? কও? তোমরাই কও? বাপরে বাপ, পর্দার গোরোত যাওয়াই যাবি নে। শালার জিন একবার দেখলে ঘাড় কাত হয়া ঘপাৎ করে মাটিত পড়ে মরে যাওয়া লাগবি! কী সিরিকেস বিষয় হে’।
 
ফুলমিয়ার ক্যারিকেচারের কাহিনী সবার একরকম জানাই আছে। কাহিনীর মধ্যে রেলগাড়ি থাকবেই। পীরগাছার লোকেরা নানান কাজেকর্মে তো বটেই এমনকি বেড়াতেও যায় পাতানো সাগাই-কুটুম্বের বাড়ি। যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো রেলগাড়ি। ফুলমিয়ার পনের থেকে বিশ মিনিটের শ্বাসরূদ্ধকর ক্যারিকেচারের আখ্যানে একটা লোক সোনাতলা স্টেশন থেকে রেলগাড়িতে উঠে প্রায় তিনঘন্টার রেলভ্রমণ শেষে পীরগাছা স্টেশনে নামা পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটে, যত নারী-পুরুষের সাথে কথা হয়, সবকিছু কেমন নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে। একটাই লোক তার একমাত্র মুখ দিয়ে রেলগাড়ির ছুটে চলা আর স্টেশনে স্টেশনে থামার সবরকম ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে কেমন করে বাদাম ওয়ালা, পাউরুটি বিক্রেতা, বাউল ফকির, তিন তাশের চতুর খেলোয়ার, কালো মাজনের ক্যানভাসার, অসুস্থ মহিলা যাত্রীর গোঙানি, শিশুর কান্না, পত্রিকা বিক্রেতার বিজ্ঞাপনী হাকডাক, টিকিট চেকারের সাথে যাত্রীর বচসা, যুবতী যাত্রীকে আসন ছেড়ে দেওয়া নিয়ে দুই যুবকের কাজিয়া, নলডাঙ্গা স্টেশনের বড় বড় তেঁতুল গাছের ঝাঁকরা ডালের ভেতর থেকে ভেসে আসা বিচিত্র পাখির কলকাকলি, সিলভারের পাতিল পেটে ঠেকিয়ে পাতিলের গায়ে পাঁচ পয়সার মুদ্রা ঠুকে ঠুকে অন্ধ ফকিরের মৃত্যুবন্দনাগীতি সবকিছু ফুটায়ে তুলতে পারে অনায়াসে সে এক অমিমাংসিত বিস্ময়! একটা লোকের পক্ষে খালি ধ্বনি-ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করার ভেতর দিয়ে এত কিছু বুঝানো কি কম বড় কথা? দর্শকদের কেউ কেউ হয়তো ফিসফিস করে সন্দেহ প্রকাশ করে- গোপনে রেডিও ছাড়ে দিছে হে, খালি মুখের আওয়াজ দিয়ে এগ্লে সম্ভাব? কেউ বলে- আরে, ধুর করো, লিচ্চয় জাদু জানে এই ফুলমিয়া। নিজে যদি জাদু নাও জানে তাহলে হাজি চাচার কথাই ঠিক, অর উপ্রে জিনের ভর আছে হে। জিন সাথে করে নিয়ে যেরকম বাউদিয়ামো করে বেড়ায় এই চ্যাংড়া, ভর করা জিনের জাদু নিজের করে চালায়ে দেওয়ার বিদ্যা জাহির করা অর পক্ষে কোন ব্যাপারই লয়!

কিন্তু সন্দেহবাতিক সবাই হতে পারে না। বিস্মিত হওয়ার আনন্দ বেশিরভাগ গাঁয়ের মানুষ অন্তরের ভেতরে অনুভব করে। বিস্মিত হওয়ার জন্য তারা একরকম তৈরি হয়েই ক্যারিকেচার দেখতে জড়ো হয়। তারা ঠিকই ফুলমিয়া পর্দার আড়াল থেকে যে আওয়াজই সৃষ্টি করে, সেই আওয়াজেরই সংশ্লিষ্ট ঘটনার জীবন্ত ছবি পর্দার উপর বায়োস্কপের মতোন করে ঘটতে দেখতে পায়। বাতাসের আগে আগে নানান রঙের ছবির পর ছবি বদলে বদলে যায় পর্দায় স্থির হয়ে থাকা অজস্র ব্যগ্র চোখের সামনে। হতে পারে যে বিভিন্ন পরিস্থিতিসম্পন্ন জীবন-যাপনকারী আলাদা আলাদা মানুষেরা একেকজন একই ছবির নানান মাত্রার একেকটি মাত্রা আলাদা আলাদা করে দেখে থাকে। সেইজন্যই ক্যারিকেচার থেকে লাভ করা অভিজ্ঞতা পরে এইসব মানুষের নানান ভঙ্গির বিবরণে ভিন্ন ভিন্ন বিস্ময়কর জীবন্ত গল্প আকারে এক গাঁও থেকে আরেক গাঁওয়ের ভেতর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
     
এই পদ্ধতিতে গাঁও ছাড়ায়ে এ-গাঁও ও-গাঁয়ের পথ পার হয়ে অবশেষে ফুলমিয়ার খ্যাতি একদিন শহরের মানুষের কানে গিয়ে উপস্থিত হয়। শহরের যুবকদের সম্পর্কে গাঁয়ের লোকেরা এরকমই জানতো যে তারা স্বভাবে এমনিতেই, ফুলমিয়া আর কি এমন, তার থেকেও শতেকগুণ বেশি বাউদিয়া হয়ে থাকে। রংপুর শহরের সেইরকম কয়েকজন বাউদিয়া কীভাবে যেন ফুলমিয়ার কার্যক্রমের খবর পেয়ে যায়। তারা সবাই মিলে যুক্তি করে পীরগাছা স্টেশন থেকে চার মাইল দূরের এক গণ্ডগাঁয়ের ফুলমিয়াকে নিয়ে রংপুর টাউনহলে একবার এক ক্যারিকেচার শো এর আয়োজন করে বসে। খবর শুনে ফুলমিয়ার তো সারা গায়ে কাঁপাকাঁপি উঠে যাওয়ার জোগার হয়। কিন্তু গাঁয়ের মুরুব্বিরা তাকে বুঝায়, ‘যাও হে, তোমার উসিলায় হামাগেরে গাঁয়েরও ইজ্জত বাড়বি’। এইভাবে নানাজনের উৎসাহ উদ্দীপনার জোরে ফুলমিয়া নিমরাজি হয়ে রংপুর শহরের টাউন হলে এসে উপস্থিত হয় এক শুক্রবারে।

কিন্তু টাউন হলের মঞ্চের উপর নিজের পর্দা, বাঁশ, দড়ি, সিলভারের পাতিল, দুইটা বড় বড় চামচ, একটা ঝুনঝুনি, কয়েকটা পাঁচ পয়সার মুদ্রা ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হয়েই ফুলমিয়ার শ্বাসকষ্ট হওয়া শুরু হয়। ফুলমিয়া আর্তনাদ করে বলে, ‘ভাই, আপনেরা একটু আসেন হামার কাছে। হামার দুইটা কথা শোনেন। হামার সামনে এই ঢেউ খেলানো নাল পর্দা আপনেরা আগে থাকে ঝুলায়া রাখছেন ক্যা গো ভাই। আর হামার পর্দার পেছন দিকটা তো ফাঁকা করে দেওয়া লাগবি। এইখানে দালানের বেড়ার মধ্যে হামার তো ভাই দম বন্ধ হয়া আসতিছে। হামার তো ভাই এই বাঁশ দুইটা পুঁতে তারপর এই জ্যালজ্যালা সাদা পর্দাকোনা খাটানো লাগবি। এইখানে তো মাটি নাই ভাই। মাটি ছাড়া হামার ক্যারিকেচার হয় না গো ভাই। বাঁশ পুঁতমো ক্যাঙ্কা করে? আপনেরা হামাক বাঁচান ভাই। এরকম বদ্ধ ঘরের মধ্যে হামার শো করার উপায় নাই গো ভাই’।

ফুলমিয়ার বিলাপ শুনে তো আয়োজক বাউদিয়াদের মাথা বন বন করে ঘুরতে আরম্ভ করলো। তারা বললো, ‘অই মিয়া, কি কও এইগুলা। তোমার পর্দার চাইতে কতো পুরু দামি পর্দা এই হলে লাগানো আছে। ঠিক কিনা, তা তুমি নিজেই একবার চোখ মেলে ভালো করে দেখ। দর্শকরা কোনকালেও পর্দার পেছনে তুৃমি কি জাদু করো কিছুই দেখতে পাবে না। নেও নেও চান্দু, ক্যাচাল না করে রেডি হও। আমরা আর দশ মিনিট পরেই বেল বাজাবো, তারপর তুমি তোমার পারফরমেন্স আরম্ভ করবা। ধানাইপানাই করবা না কইলাম’।
খাঁটি সরিষার তেলের লাল টকটকে শিশিটা ফুলমিয়ার হাত থেকে ফসকে মঞ্চের কাঠের পাটাতনের উপরে পড়ে থাকা একটা মাইক্রোফোনের সামনে খট করে শব্দ তুলে পড়ে গেলো। তখন মাইক্রোফোন সেট করা হচ্ছিল আর কানেকশন দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছিলো।

এমপ্লিফায়ারের ভেতর দিয়ে সেই শব্দ এতটাই তীব্র আর বিটক আওয়াজে ফেটে বের হলো যে ফুলমিয়া নিজেও ভয় পেয়ে মঞ্চের উপর কাটা কলাগাছের মতো চিৎ হয়ে শব্দ করে পড়ে গেলো। আয়োজক বাউদিয়াদলের প্রায় সবাই হুরমুর করে মঞ্চে প্রবেশ নিলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করার উদ্দেশ্যে। তাদের হৈ চৈ লাউড স্পিকারে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দর্শকরা হাততালিতে ফেটে পড়লো। সেই হাততালির আওয়াজে সচকিত হয়ে উঠে আতঙ্কিত কোরবানির গরুর মতো এদিক সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে লাগলো ফুলমিয়া। বললো, ‘ভাই, শব্দ করা যাবিনে, কয়া দেন, ভাই, দর্শক ভাইয়েদেরকে অনুরোধ করে কয়া দেন। হামার ক্যারিকেচারের সমায় জোরে কোনো আওয়াজই করা যাবি নে, হামার বিপদ হয়া যাবি। ভাই, এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে হামার দম আটকে আসতিছে গো। হামি পারমো না গো ভাই। ক্ষমা দেন, আল্লার ওয়াস্তে ক্ষমা দেন’।

ঠিক সেই সময় দর্শকদের ভেতর থেকে হল্লা শুরু হলো। তারা পর্দা ওঠানোর দাবি জানাতে শুরু করলো। তারা সমস্বরে বললো, ‘অই শালার বেটারা, আমরা কি টিকিট কাটিয়ে ঢুকি নাই? পর্দা তোল্ হে। ক্যারিচোরঅলা কী করে আমরা চোখ দিয়ে দেইখপের চাই হে। এইসব গ্রাম্য টাউটদের বুজরুকি শয়তানি আমাদের ভালো করেই জানা আছে হে’।

আয়োজকদের একজন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে পর্দার আড়ালের মঞ্চ থেকে সুললিত কণ্ঠে অনুনয় করতে থাকে, ‘ভাইসব, আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু করবো’। কিন্তু দর্শকরা খুব একটা ধৈর্য সাথে নিয়ে হলে প্রবেশ করে নি সেদিন। তারা কেবল ধ্বনির খেলা শুনে চলে যেতে চায় না। তারা দৃশ্য দেখতে চায়। তারা আবার সমস্বরে বলে ওঠে, ‘আমরা কি কানা নাকি হে? আমাদের বাড়িতে কি টেলিভিশন নাই নাকি, হুম? খালি শুনে শুনে আমরা চলে যাব না। দুইচোখ দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান দেইখপো, পর্দা তোল্ হে যদি ভালো চাইস’। হলভরা দর্শকরা কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তারা মঞ্চের দিকে জুতা ও পানির বোতল ছুঁড়তে থাকলো। অবস্থা বেগতিক দেখে আয়োজকরা অবশেষে একরকম বাধ্য হয়ে পর্দা ওঠানোর সুইচে চাপ দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের মাঝখানে স্পটলাইট পড়লো। অদৃশ্য লোকজন ফুলমিয়াকে ঠেলে স্পটলাইেটের বৃত্তের ভেতরে বসিয়ে দিলো। ফুলমিয়ার সামনে তখন কুচকুচে কালো অন্ধকারের সমুদ্র। ঘোর অন্ধকারের অতল থেকে শত মানুষের অর্থহীন গুণগুণ আওয়াজ ফুলমিয়ার কানকে বধির করে দিলো প্রায়। আওয়াজ বাড়তেই থাকলো। শত-সহস্র বাক্যের ভেতর থেকে একবার, ফুলমিয়ার মনে হলো কে যেন বলে উঠলো, ‘আরে শালা ক্যারিকেচারের বাচ্চা, রেলের গাড়ি ছুটায়ে দে হে’। অন্ধকারের দ্বিধাগ্রস্ত পরিস্থিতির ভেতর যে পিন-পতন নিরবতার অনুভব ফুলমিয়ার সমস্ত শরীরে সর সর করে বয়ে গেলো, তাতে তার অসহ্য বোধ হলো। একটি ছোট্ট ইটের টুকরা উড়ে এসে অস্থির উ™£ান্ত ফুলমিয়ার মাথার বামদিকে প্রবল বেগে আঘাত করলো আচমকা। সঙ্গে সঙ্গে ফুলমিয়ার মুখ দিয়ে রেলগাড়ির হুইসেলের আওয়াজ এতটাই বিকট হয়ে বের হলো যে দর্শকরা দুইহাতে দুই কান ঢেকেও মাথার ভেতরের  অস্বাভাবিক যন্ত্রনার প্রশমন ঘটাতে পারলো না। দর্শকদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের অশেষ বিস্তারের ভেতর জ্বল জ্বল করতে লাগলো। ফুলমিয়া চিৎকার করে বলতে থাকলো, ‘হামার কোনো দোষ নাই, ভাই। আপনেরা এখন মাথা ঘুরে পড়ে মরে গেলে হামার কোনো দোষ নাই, ভাইসগল’। বলেই আবার সে ছুটন্ত রেলগাড়ির হুইসেলের বিকট আওয়াজ বের করলো। দর্শক-শ্রোতারা কানে কনকনে অসহ্য চিঁ চিঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলো না আর। ভয়ে তারা চোখ বন্ধ করতে চেয়ে ব্যর্থ হলো। সবার চোখ আগুনের বলের মতো ঝুলে রইলো ঘোর অন্ধকারের অশেষ বিস্তারের ভেতরে। আয়োজকরাও আর দাঁড়াতে পারলো না এইরকম অভাবিত পরিস্থিতির সামনে। সবার অলক্ষ্যে অন্ধকারের আড়াল দিয়ে তারা মঞ্চ ত্যাগ করলো কি করলো না সে বিষয়ে ফুলমিয়ার পক্ষে আর কিছুই জানা সম্ভব ছিলো না। ফুলমিয়া মুখ দিয়ে রেলগাড়ির হুইসেল বাজাতে বাজাতে কাঠের মঞ্চের উপর স্পটলাইটের বৃত্তের ভেতর কাত হয়ে পড়ে গিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে রইলো।

সেই বাউদিয়া ফুলমিয়া রংপুর টাউন হল থেকে কীভাবে গাঁয়ে এসে পৌঁছালো সেবার, সেটা আমাদের জানা নাই। ফুলমিয়া নিজেও এ ইতিহাস কিছুই বলতে পারে না। সে এখন পীরগাছা বাজারের এক চাউলের মিলে কামলা খাটে। সে ভুলেই গেছে যে একসময় দশগাঁও ছাড়িয়ে শহর পর্যন্ত তার ক্যারিকেচারের নামডাক ছিলো।     



লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
নূরুননবী শান্ত (জন্ম ১৯৭১)
নূরুননবী শান্ত গল্পকার, অনুবাদক ও আবৃত্তিশিল্পী। জন্মস্থান বগুড়া হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে রংপুর ও ঠাকুরগাও জেলায়।  পেশায় উন্নয়নকর্মী। প্রান্তিক মানুষের জীবন আচার সংস্কৃতি সমস্যা নিয়ে দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লেখালেখি করেন। কৈশোরে কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও গল্প লেখা শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়। প্রথম গল্প, ‘সুখলোকে যাত্রা’ শাশ্বতিক পত্রিকায় ছাপা হয়।
প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: গ্রামে প্রচলিত গল্প (২০০৯)।
প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থ: রাস্তা (২০১১); মেঘের ওপারে আকাশ (২০১৪); প্রিয় দুঃস্বপ্ন (২০১৭)।
প্রবন্ধ-সংকলন: প্রান্তকথা (২০১৯)।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ