bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের গল্প: বদল

আনন্দ খুব শক্তিশালী অনুভূতি। দ্রুত এই অনুভূতি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই যে গেট দিয়ে ঢোকার সময় তাকে দেখেও কে একজন আদাব-কেতাব কিছুই না দিয়ে বেয়াদবের মত হনহন করে হেঁটে গেলো বিষয়টা পাত্তাই দিলেন না সুনীল কুমার রাহুত। আনন্দে থাকলে আশেপাশের এমন অনেক ছোট ছোট অসঙ্গতি স্বেচ্ছায় উপেক্ষা করে মানুষ। গেটের কাছে বাঁশের খুটির মাথায় সটকে দেয়া মাইকের শব্দের তোড়ে স্কুলটা কাঁপছে গম গম করে। বিন্দিয়া চমকে গি, চুরি খানকেগি, মুঝে ইয়াদ পিআকি... হিন্দী গানের সুর স্কুল পেরিয়ে গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তারই স্কুল থেকে গোটা এলাকাবাসীদের এ সব শব্দ শোনানো হচ্ছে দেখে মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার কথা কিন্তু সুনীল কুমারের তাও হচ্ছেনা দেখে নিজেই অবাক হলেন। অনেকদিন পর এখানে এসে তাঁর আসলে সবই ভালো লাগছে। এই স্কুলের ছাত্র সরকারের মন্ত্রী হয়েছে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় সেই মন্ত্রী আসবে বলে ঢোকার মুখে কালভার্ট দুটো মেরামত হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা প্রাইমারী সেকশনের ঘরটায় এবার ছাদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতদিন বাচ্চারা কি কষ্টই না করতো। জৈষ্ঠ্য মাসে টিনের চাল তেতে ওদের মুখগুলো লাল হয়ে যেত। অমন সময় অংক মাথায় ঢোকে না কি মাস্টারের হাত কামড়ে দিতে ইচ্ছে করে! এখন নতুন ছাদের সাথে ফ্যান ঝুলছে। তবে মাঘ মাস হলেও সুনীল কুমার অনেকটা পথ এসেছেন বলে কিছুটা ঘেমে গেছেন, তার বগলের তলা ভিজে পাঞ্জাবীর কিছু কিছু যায়গা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। 

যাবেন নাকি একটা রুমে? সুইচ অন করে হাওয়া খাবেন একটু, ফ্যানের তলায় বসে। বাচ্চারা দেখলে কি ভাববে মনে করে নিজেই হেসে ফেললেন। এরই নাম ভালো লাগা। দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃত্ব করা দাপুটে মানুষটা এখন ক্লাশ রুমে বসে বাতাস খেতে চায়। তিনি স্কুলের উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখতে দেখতে এল প্যাটার্নের বারান্দার কোনায় এসে দাড়ালেন। ক্লাশ রুমগুলোতে লম্বা বেঞ্চের বদলে ডেস্ক বসানো হয়েছে। পরিত্যক্ত একটা বেঞ্চ ফেলে রাখা বারান্দায়। তারই এককোনায় বসে সুনীল কুমার রাহুত ভাবলেন, এখন নিশ্চই আর বাচ্চারা আগের মত বন্ধুর সাথে ঝগড়া করে বেঞ্চে পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে বলেনা, এই যে আমার অংশ এদিকে আসবিনা। 

সময় কত দ্রুত বদলে যায়। বারান্দাতেও মাথার উপর তিন ব্লেডের ন্যাশনাল ফ্যান ঘুরে ঘুরে গরম বাতাস তাড়াচ্ছে। তবে তার এক গ্লাস ঠান্ডা জল দরকার। কাকে বলবেন, বুঝতে পারছেনা না। আশেপাশে স্কুল ড্রেস পরা সদ্য গোফ দেখা দেয়া যেসব মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে এরা অপরিচিত। এখন যারা ক্লাশ নাইন টেনে পড়ছে তারাওত বড়জোড় ছয় বছর আগে ভর্তি হয়েছে। সে চলে যাবারও কত পরের ঘটনা। তাহলে অনেকদিন হয়ে গেল সে আসলে নেই এখানে--- সুনীল কুমারের এই প্রথম বুকের ভেতর একটু কি কেমন লাগলো! তিনি উড়িয়ে দিলেন এই একটুকরো কেমন করে উঠা। বরং জল খাওয়া জরুরি। ঠিক তখনই সামনে এসে দাড়ালো একজন।

এটা সেই সিদ্দিক। যখন জয়েন করেছিল একেবারে ছোকরা। গত কয়েক বছরে সন্তান সম্ভবা নারীর মত শরীরের একটি জায়গা ফুলিয়ে তুলেছে, সেই সাথে প্রতিযোগিতা করে কমেছে কেশগুচ্ছ। চশমার ভেতর দিয়ে এসব দেখতে দেখতে সুনীল কুমার মুখ এগিয়ে বললেন,

- সিদ্দিক বাবু তেষ্টা পেয়েছে, জল দিতে পারেন? 

- স্যার আপনার শরীর খারাপ?

- তেমন কিছু না, অনেকটা পথ এসেছি ত।

- রিটায়ারের পর কি গ্রামে চলে গেছেন?

- শহরে ত বাড়ি-ঘর কিছু করিনি। গ্রামেই থাকতে সুবিধে হয়।

- আচ্ছা স্যার আপনি বসেন, আমি দেখি পানি খাওয়ানো যায় কিনা, আজ যে কে কোথায় আছে? হাতের কাছে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আর বলবেন না স্যার, সবদিক তো আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। বলতে বলতে সমাজ শিক্ষার দায়িত্বপূর্ণ সিদ্দিক স্যার ভেতরের দিকে চলে গেলেন। 

সুনীল কুমার বসে রইলেন। স্কুলটাকে বিয়ে বাড়ির মত দেখাচ্ছে। গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত কয়েক লাইন করে দড়ি টানিয়ে লাগানো তিন কোনা কাটা রঙিন কাগজগুলো তির তির করে কাঁপছে পাতার মত। মাঠের একপাশে প্যান্ডেল-মঞ্চ। নতুন চুনকামে ঝকঝক করছে দেয়াল। রঙের ঘ্রান এখনো শুকোয়নি তাতে কেমন নি:শ্বাস আটকে আসে। সুনীল কুমারের ভালোই লাগছে। এই সেই স্কুল যেখানে একটা টিনের ঘর দিয়ে শুরু হয়েছিল। ছেলেপেলেরা সুর করে ঝুলে ঝুলে পড়া বলতো। ক্লাশ শুরুর আগে এ্যাসেম্বলি হতো তখন জাতীয় সঙ্গীত আর শপথ পাঠ করতো সব ধর্মের শিক্ষার্থীরা। সে পানির জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখলেন, রোদের ভেতর মাঠের একপাশে ঝোলানো ঘন্টাটা। এই ঘন্টার শব্দ খুব তীক্ষ নয়, লোহার পাত ভারি বলে গ্রুম গ্রুম শব্দ হয়। এর আগে একটা কাঁসার ঘন্টা ছিল। সেটার মাঝখানে লাগানো দড়ি ধরে হাতুড়ি দিয়ে পেটালে বেশ রিনরিনে শব্দ হত। অনেক বছর আগের কথা। চোখ বন্ধ করলে ছেলেদের মুখ এখনো চোখে ভাসে। হাফ প্যান্ট পরে ভর্তি হতো আর  ম্যাট্রিক পাশ করে বেরিয়ে যাবার সময় প্রায় কৈশোর শেষ। এ এলাকার বেশিরভাগ ছেলেই তাদের জীবনের দুরন্ত সময়টা পার করেছে বৈরাগী মহাবিদ্যালয়ে। স্কুলের পেছনের দিকটাতে ছিল ধান ক্ষেত। বর্ষায় সেই ধানের চারা ডুবে যেত পানিতে। এর ভেতর দিয়েই ছোট ছোট নৌকা চালিয়ে আসতো ডানপিটেগুলো। ওই দলে তো মুসাও ছিল। সবচেয়ে দুরন্ত ছেলেটা। মুক্তিযুদ্ধের আগে এ অঞ্চলে অবস্থাসম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা খারাপ ছিলনা তবে দেশভাগের পর থেকেই কমতে শুরু করে। ৬৪’র দাঙ্গা এরপর ৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণার পরতো কথাই নেই। অবস্থাসম্পন্নদের বেশিরভাগই চলে গেছে সে সময়। কিন্তু সুনীল কুমারের এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি এ দেশ তার নয়। হয়ই বা কি করে, ধর্ম পরিচয় দিয়ে কি মাটির সাথে মানুষের সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ হয়! এই যে এই মাটির মানুষেরা প্রাণভয়ে অন্য ভুখন্ডে চলে গেলো তারা কি ভুলে গেছে তাদের শৈশব-কৈশোর, ঘরের চালে তুলে দেয়া গাছের ফুল আর পুকুরের পাশের আম গাছটার কথা! এমনিতে তো আর এ জায়গার নাম গোপালপুর হয়নি। একসময় এ এলাকার বেশিরভাগ জমিই ছিল হিন্দুদের, তবে বর্গা দেয়া। চাষ করতো মুসলমান কৃষকরা। শীতের দেড় দুই মাস প্রতিদিনই কোন না কোন জমিতে ধান কাটা চলতো আর স্কুলের সামনে দিয়ে গরুর গাড়ি বোঝাই করে ধান নিয়ে যাবার সময় ওই গাড়িতে উঠে পড়তো স্কুলের ছেলেরা। আবার মুসলমানদের বাড়ি থেকে গরু এনে ধানের মলন দিতো হিন্দুরা। মুসাদের মুন্সী পরিবারের বেশ কিছু গরু ছিল তখনই। অন্য সব মুসলমানদের চেয়ে সম্পত্তিও বেশি। মুসা প্রায়ই না হেঁটে গরুর পিঠে চড়েই স্কুলে আসতো। 

বারান্দায় বসে পানির জন্য অপেক্ষা করতে করতে আর রোদের দিকে তাকিয়ে এসব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে সুনীল কুমারের মাথার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠছে। ব্যস্ত মানুষ অবসরে গেলে মনের বাঁধন দুর্বল হয়। হঠাৎ মনে হতে লাগলো স্কুলের মাঠে মুসা অনেকগুলো গরু তাড়িয়ে নিয়ে আসছে আর ওই পালের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে তিনি হাঁটছেন। এসব ভাবনা যে কেন আসছে, শরীর বোধহয় একটু বেশীই খারাপ করেছে। এ অবস্থায় আসাই ঠিক হয়নি। তবুও ভাবলেন বৈরাগী স্কুলের অনুষ্ঠান আর তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে থাকা প্রধান শিক্ষক। না এলে হয়! তবে একটা ছোট কষ্ট বুকের ভেতর রয়েই গেছে। রিটায়ারের পর স্কুল কমিটিতে  তার নামটা রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, এখনো তা হয়নি। গোপালপুরের নামই পরে মুন্সী পাড়া হয়ে গেছে। তখনো তিনি চিঠি লিখেছিলেন পৌরসভায়, চেয়ারম্যান বলেছিলেন দেখবো, তাও হয়নি। 

সুনীল কুমারের নি:শ্বাসে একটু কষ্ট হচ্ছে। প্রধান অতিথি তার গাড়ি বহর নিয়ে সার্কিট হাউজে উঠেছে সেখানে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে আসবে। তিনি কি একটু বেশি আগে আগে এসে পড়েছেন? পুরনো বেঞ্চটাতে বসে এসব স্মৃতিচারণের মধ্যে দপ্তরি কাঁচের গ্লাশে পানি নিয়ে এলো বারান্দায়। গ্লাশ নিয়ে গলায় ঢালতেই ছেলেদের হৈচৈ শোনা গেল। মিনিস্টার আসছে মিনিস্টার আসছে। শেষ পানিটুকু তার গলায় নামছে। কাঁচের তলানির ভেতর দিয়ে দেখলেন ছেলেরা লাইন ধরে দাড়িয়ে যাচ্ছে গেটের দুপাশে। গেটের বাইরে গাড়ি বহরের ভিড়। সুনীল কুমারের ভেতরটা কেঁপে উঠছে আনন্দে। মুসা কি তাকে দেখলে এখন চিনতে পারবে? ছোটবেলায় কতবার অংকে ভুল করায় কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আজ সেই মুসা মন্ত্রী হয়ে নিজের স্কুলে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছে। সরকারি সাদা জিপের পেছনে পেছনে নিরাপত্তা বাহিনী আর ডেপুটি কমিশনারের গাড়ি। ছাত্ররা বুকে ব্যাজ পরেছে। আশ্চর্য তার বুকে একটা ব্যাজতো কেউ লাগিয়ে দিলোনা। মন্ত্রী নাকি আজ অনুষ্ঠানে বৈরাগী মহাবিদ্যালয় নিয়ে একটা ঘোষণা দিবেন তাই সবার মধ্যে উত্তেজনা। এ পাড়ার ছেলে মন্ত্রী হওয়ার পর সবার খুব একটা আশা জেগেছে যে এবার বোধহয় দরিদ্র এই স্কুল এমপিও ভুক্ত হবে। তার না হয় আর কিছু পাওয়ার নেই কিন্তু এই স্কুলের শিক্ষকরা খুব আর্থিক কষ্টে আছে। তাছাড়া ছাত্ররা সারা বছর এখানে পড়ে যখন ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটটা অন্য স্কুল থেকে আনে ওদেরও মনটা ছোট হয়ে যায়।

মন্ত্রীর গাড়ি বহর মাঠের ভেতর থেমে পড়লো। সুনীল কুমার আনন্দ-আগ্রহ রাখতে না পেরে উঠে দাড়ালেন। পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেলেন ভিড়ের দিকে তবে কাছে যাওয়া দূরের কথা, এত ভিড় দেখাই যায়না ভালো করে, তবুও এর ওর শরীরের পাশ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন তার ছাত্রকে। মন্ত্রী তার প্রশাসনিক দল সমেত শিক্ষক রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে মাঠে চেয়ার পাতা শুরু হয়েছে। ভিড় কমলে সুনীল কুমার শিক্ষক শ্রেণীর দিকে পা বাড়ালেন। নিরাপত্তা রক্ষী এসে আটকে মৃদু আপত্তি করলো। দু’এক কথার মাঝখানেই সেই সিদ্দিক স্যার উপস্থিত।

- স্যারের সাথে দেখা করবেন?

- ও তো আমার ছাত্র ছিল।

- জি স্যার, জানি কিন্তু একটু অপেক্ষা করুন, মন্ত্রী সাহেব মাত্রই তো এলেন, নিশ্চই দেখা হবে।

- সিদ্দিক বাবু ওকে একটু বলবেন তোমার মাস্টার মশাই আছে এখানে।

- অবশ্যই বলবো স্যার, আপনি আমাদের লাইব্রেরি রুমে বিশ্রাম নিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী মঞ্চে উঠে সবার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিবেন।

- আপনি বলেন আমি আসছি , একটু দেখি ছেলেটাকে, গরুর পিঠে চড়ে স্কুলে আসা আমার মুসা এখন কত বড় মানুষ!

- মন্ত্রী আসলে হেড মাস্টার আর ডিসি সাহেবের সাথে স্কুল নিয়ে কথা বলছেন। উনি নাকি এখান থেকেই ঢাকা ফিরে যাবেন। আচ্ছা দাঁড়ান দেখি।  

এরই মধ্যে হেডমাস্টারের কণ্ঠ শোনা গেল, আমাদের দিক থেকে কোন আপত্তি নেই, আপনার উপরই নির্ভর করছে সবকিছু। মন্ত্রী ঘরের ভেতর অনুষ্ঠান শুরুর নির্দেশ দিলেন। প্রধান শিক্ষক বেরিয়ে গেলেন আয়োজনের তাড়া দিতে। সিদ্দিক স্যার সুনীল কুমারকে সাথে নিয়ে ঢুকলেন রুমে। সুনীল কুমার এবার প্রায় ১০ বছর পর মুসাকে দেখলো। এই সেই ছেলে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না। ডাঙ্গুলি খেলতো অংক ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে এখন মাঝ বয়সি হয়ে গেছে। তার ঝাপসা চোখ আরো কেমন আনন্দে ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। এগিয়ে গেলেন কাছে। মুসা তাকে দেখেই চিনেছে। চেয়ার থেকে যদিও উঠে দাঁড়ায়নি কিন্তু খুব আন্তরিক সুরেই বললো, মাস্টার বাবু না? আছেন কেমন? সুনীল কুমারের ভেতরটা আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। মুসা তাকে চিনেছে! কিন্তু মুসাকে তুমি বলবে না মন্ত্রীকে আপনি বলা উচিৎ বুঝে উঠতে পারছেনা। এর মধ্যে হেডমাস্টার বললেন, চলেন স্যার, ছাত্ররা অপেক্ষা করছে, বলেই চোখ পড়লো তার দিকে। আরে মাস্টার মশাই যে, আপনিও চলুন। খুব ভালো লাগছে তার। উত্তরসূরীদের কাছে সন্মান ছাড়া আর কি বা চাইতে পারে! 

কাঠের মঞ্চের উপর সাদা ফরাস পাতা। লম্বা টেবিলের ওপাশে কয়েকটি চেয়ার। মাঝেরটা রাজকীয় ওটা প্রধান অতিথির। তার জন্য আসলে চেয়ার বরাদ্দ ছিলনা তবুও তাকে এনে বসানো হয়েছে বলে গর্ব হচ্ছে। অনুষ্ঠান কর্মসূচি তালিকায় প্রথমে সুরা ফাতেহা ও গীতা পাঠ এবং জাতীয় সংগীত। দুজনের পর প্রধান অতিথির ভাষণ। তিনি জানেন দাওয়াত পত্রে তার নাম নেই কিন্তু মঞ্চে এনে যেহেতু বসানো হয়েছে নিশ্চই এরা কিছু না বলিয়ে ছাড়বেনা তাদের প্রিয় মাস্টার মশাইকে। সুনীল কুমার মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন কি বলবেন। এতদিন পর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন তিনি। আজ যদি তার উপস্থিতিতে স্কুলটার এমপিও ভুক্ত করার ঘোষণা আসে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। 

শরীরটা এখন ভালো লাগছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে বসে বসে সামনের ছাত্রদের মুখ দেখতে দেখতে বারবার পুরনো দিনের কথা মনে হচ্ছে সুনীল কুমারের। কত ছাত্র এই স্কুল থেকে পাশ করেছে? কত হাজার ছাত্র তাকে মাস্টার বাবু ডাকে? বক্তৃতায় হাত তালি পড়ছে। সভাপতির ভাষণের পর এবার মন্ত্রী বক্তৃতা দেবেন। অনুষ্ঠান নাকি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। মন্ত্রী কয়েকটি কথা বলেই মঞ্চ ত্যাগ করবেন। সবাই প্রত্যাশার চোখ নিয়ে চেয়ে আছে। মাইকে দাড়িয়ে যথারীতি আঞ্চলিক টানেই কথা শুরু করলেন মন্ত্রী। শিক্ষা ব্যবস্থা ও সকল স্কুলের উন্নয়নে তার সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বলতেই হাত তালি পড়লো একবার। অনেকদিন আগে এখানকার এক জনহিতৈষি জমিদার স্কুলটি চালু করেছিলেন। এতদিন বেসরকারি থাকলেও এখন স্কুলটি এমপিও ভুক্ত করার একটি সুযোগ এসেছে। সরকারের ৫০০ স্কুল এমপিওভুক্ত করার ঘোষণার প্রেক্ষিতে বৈরাগী মহাবিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আবেদন পত্র জমা পড়েছে। এমপিওভুক্তিকরণে সব ধরনের চেষ্টা নেয়া হচ্ছে, আশা করছি অচিরেই তা হয়ে যাবে। মন্ত্রীর এই আশ্বাসের পর হাত তালির বন্যা বয়ে গেল। সুনীল কুমারও আনন্দে চশমার ভেতর হাত দিয়ে চোখের কোনা মুছলেন। মন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হয়নি। একটি কথা আছে। এ পাড়ার নাম এখন মুন্সী পাড়া। মুসলমান অধ্যুষিত একটি স্কুলের নাম হবে বৈরাগী মহাবিদ্যালয় এটা ঠিক সামঞ্জস্য হয় না। মৃদু গুঞ্জন উঠলো কি,  নাকি তিনি ভুল শুনছেন? আমি স্কুলের নাম পরিবর্তন করে মুন্সী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রস্তাব করছি। সুনীল কুমারের নি:শ্বাস আটকে আসছে। কিছুতেই দম নিতে পারছেন না। কাউকে ডাকতে চাইছেন কিন্তু মাইকের শব্দে তার ফিসফিসে কণ্ঠস্বর নিজের কানেই পৌঁছায়না। গা ঘামছে তার...মন্ত্রী বলে যাচ্ছেন, আমি এখানে পড়েছি...সুনীল কুমারের চোখে স্কুলের পেছনের সেই ধান ক্ষেত তার ভেতর মাথা উঁচিয়ে থাকা সবুজ ধান সরে সরে যাচ্ছে...স্কুলের ছাত্রদের জন্য ল্যাবেরটরি আর শিক্ষকদের যাতায়াতে একটি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করবো...মুসা গরুর পিঠে আসছে.. পেছনে একপাল গরুর ভেতর হামগুড়ি দিয়ে আসছে সুনীল কুমার...তবে এমপিওভুক্তির জন্য নামের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, স্কুলের ছেলেরা যাতে ধর্ম শিক্ষা পেয়ে সঠিক পথে চলতে পারে তাই একটি স্কুল মসজিদ স্থাপনের আকাঙ্খা রাখি...সুনীল কুমারের মনে হচ্ছে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন বিষন্ন বিকেলে স্কুলের মাঠে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন...মন্ত্রীর বক্তব্য প্রায় শেষের দিকে... মসজিদসহ একটি স্কুলের নাম কি বৈরাগী হয়! তাছাড়া এটা যখন এমপিওভুক্ত হবে...সুনীল কুমারের ঠান্ডা লাগছে, চারপাশে এত নি:শব্দ হলো কি করে হঠাৎ? মনে হচ্ছে বৈরাগী স্কুলের মাঠের ঘাসে পা ডুবে যাচ্ছে। সুনীল কুমার রাহুতের মনে হলো হঠাৎ দুখন্ড হয়ে গেছে স্কুলের মাঠ, পেতলের গোল ঘণ্টা এমনকি নারকেল গাছটা এমনকি ক্লাশ রুমের ব্লাকবোর্ডটাও দুভাগ হয়ে গেল। কী নাম এই স্কুলের!

>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>

লেখক পরিচিতি: 

(জন্ম: ১৯৮২)

সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। জন্মস্থান বাংলাদেশের ফরিদপুর, পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণমাধ্যামের ভূমিকা বিষয়ে গবেষণা করেছেন।তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পা’ ২০১৫ সালে এক্সিম ব্যাংক অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করে। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: পা (২০১৪), রক্তমূলে বিচ্ছেদ (২০১৭), বৈদিক পাখির গান (২০২০)।       

       



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ