মেহেদী উল্লাহ’র টাইমলাইন: বুধবার, ২৭ মে ২০২০; রাত ০৮ টা ২৬ মিনিট
আজ থাকছেন কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রুমা মোদক (Ruma Modak)। সংস্কৃতি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে—
মেহেদী উল্লাহ : আধা শহর, আধা গ্রাম—বাংলাদেশের প্রক্ষাপটে ব্যাপারটা কেমন? এতে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোও কি আধা শহুরে, আধা গ্রামীণ?
রুমা মোদক : বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই। কসমোপলিটান কালচার আর গ্রামীণ কালচারে মূল্যবোধগত কিছু পার্থক্য তো আছেই। যদিও দ্রুত তা পাল্টে যাচ্ছে।
শহর তো মানুষের প্রয়োজনে তৈরি। গ্রাম থেকে মানুষ তার বসতি পরিবর্তন করে নানা কারণে শহরে শিক্ষা, চিকিৎসা, আয়ের উৎস ইত্যাদি নানা কারণে মাইগ্রেট করে শহরে আসে। ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক, যুথবদ্ধতা শহুরে মানুষের কম। কেউ কারো রুট তেমনভাবে জানেনা। এর একটা মানসিক গঠন অবশ্যই আছে। প্রভাব আছে। আধা গ্রামীণ আধা শহুরে প্রভাবে কিছু সংকীর্ণতা মানুষের তৈরি হয়। খুব কম এর থেকে বের হতে পারে। কয়েকটি প্রজন্ম লাগে এর থেকে বের হতে। তবে এর মাঝ থেকে কেউ কেউ বের হয়ে আসতে পারে, তা সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায়। কিংবা কোন পথপ্রদর্শকের অনুপ্রেরণায়। তার হার খুব কম।
মেউ : সংকীর্ণতাগুলো কেমন?
রুমা মোদক : মানুষে মানুষে পারস্পরিক, সামাজিক সম্পর্ক গাঢ় হয় না, শ্রদ্ধাবোধ, সম্মানবোধ কম থাকে, নিজেকে সমৃদ্ধ (সমৃদ্ধ বলতে আমি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বুঝাচ্ছি না) করার প্রবণতা, এগুলোর স্পৃহা কম থাকে। সামগ্রিকভাবে মানসিক টানাপোড়েন থাকে।
মেউ : আচ্ছা। এসবের কয়েকটি উপাদান ফুল শহরেও আছে। আপনার কথায় মনে হচ্ছে হাফ শহরেও আছে। মফস্বলে এই কালচার কি আগে থেকেই ছিল, না নতুন চর্চা?
রুমা মোদক : ধরুন, আমাদের সামাজিক জীবনে এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে গত দুই যুগ ধরে। বলা যায় রাজনৈতিক ইতিহাসে সামরিক শাসনের পর।অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বৈশ্বিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ।
ধরুন, আমি যে শহরটিতে বাস করি তাতে আমি পঞ্চম জেনারেশন। বড় হয়েছি এই শহরে। মাঝে হয়তো পড়াশোনার জন্য কয়েকটা বছর শহরের বাইরে ছিলাম। পরে পেশাগত কারণে আবার এখানেই। চোখের সামনে গত ২০ বছরে দ্রুত শহর বদলে যেতে দেখেছি। গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা মানুষের ঢল দেখেছি। আবাদী জমিগুলোর উপর হাইরাইজ বিল্ডিং দেখছি। সব ব্রাণ্ড বুটিকের দোকান দেখছি। ভালো কি মন্দ সেটা বিবেচনা করছি না। পরিবর্তনটার কথা বলছি। এই যে শহরমুখী মানুষের ঢল, এরা কিন্তু কেউ কাউকে চিনে না। বিশ্বজুড়ে নগর সংস্কৃতির এটাই বৈশিষ্ট্য।
মেউ : হ্যাঁ। আধুনিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় বলা হচ্ছে, গ্রামকে গ্রামের মতো রেখে সেখানে সব শহুরে সুবিধা দেওয়া হবে—এমন উন্নয়ন কার্যকর হলে গ্রামের অবকাঠামো বদলে গেলেও সেখানকার মানুষের মানসিকতা ও সংস্কৃতির ওপর তা কতটা প্রভাব ফেলবে?
রুমা মোদক : নিশ্চয়ই সেটা হওয়া উচিত ছিলো। পারস্পরিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা সব বিনিময় হবে। বিনিময়ের সুযোগ থাকবে৷ আধুনিক প্রযুক্তি কিংবা উন্নয়ন শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সব বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া উচিত ছিলো। অবশ্যই তার মানসিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়তো। এখন যে আত্মকেন্দ্রিকতা, ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা নিয়ে আমাদের এতো হতাশা তা হয়তো হতো না। পুঁজির বিস্তারের ফলে পেশাগত কারণেও সেটা ঘটে। কিন্তু আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে সামাজিক জীবনের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিলো। সামন্ত কিছু কিছু মূল্যবোধ ইতিবাচকও ছিলো, কিন্তু টিকিয়ে রাখা গেলে সুফল পাওয়া যেতো।
মেউ : আপু, আপনার জন্ম হবিগঞ্জে, এখন থাকছেনও, 'হবিগঞ্জের জালালি কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া, সুরমা নদীর গাঙচিল আমি, শূইন্যে দিলাম উড়া...' গানটা শুনেছেন? খুব পছন্দের একটা ভালিয়ালি গান আমার, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে বার বার শুনি...
রুমা মোদক : শুনবো না মানে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান। চুনারুঘাট হবিগঞ্জের একটি উপজেলা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্মস্থান। শহীদ জগতজ্যোতিকে নিয়ে লেখা জ্যোতিসংহিতা নাটকে আমি গানটি ব্যবহার করেছি। যদিও তা দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা। আমি এটিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নবরূপায়ণের চেষ্টা করেছি। নেক্সট শো তে আপনার দেখার আমন্ত্রণ রইলো। জগতজ্যোতি ভাটি এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জের ভাটি জলমগ্ন এলাকায়।
মেউ : আচ্ছা। এই গানে যে আছে, 'যাইতে চান্দের চর, ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কোইলকাতার উপর', এটা কেন? তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন এ জন্য? হেমাঙ্গ?
রুমা মোদক : স্বাধীন মুক্ত পাখি হয়ে উড়তে গিয়ে স্বাধীনতার নামে তিনি উদ্বাস্তু হলেন। পূর্ববাংলার ভিটেমাটি ফেলে। কলকাতা বা পশ্চিমবাংলায় চলে যাওয়াকে তিনি রূপকার্থে বলছেন ডানা ভেঙে পড়েছেন। ডানা মেলে মুক্ত আকাশে উড়তে পারেন নি।
মেউ : চান্দের চর কোনটা? বাস্তবে আছে?
রুমা মোদক : না আমার জানামতে নেই। গানের লিরিকসের ছন্দ মেলাতে সম্ভবত শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন।
মেউ : আচ্ছা, সিলেটে জালালি কইতরের প্রতি কি বিশেষ কোনো ট্যাবু আছে মানুষের?
রুমা মোদক : হ্যাঁ। হযরত শাহজালাল সিলেট আসার সময় এই পাখিটি সাথে নিয়ে এসেছিলেন বলেন জনশ্রুতি আছে। এটি দেশীয় পাখি নয়। হযরত শাহজালাল এর নামানুসারে এটির নাম জালালি কইতর (কবুতর)।
মেউ : এই পাখি খায় লোকে?
রুমা মোদক : সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে এখনো হাজার হাজার জালালি কবুতর আছে। বিশ্বাসী মানুষ নানা মানত করে এদেরকে লালন করে।
না, এটাকে পবিত্র জ্ঞানে লালন পালন করে। কেউ খায় না।
মেউ : আচ্ছা, তাহলে ত টোটেম, ট্যাবু না। ভালো। এমনি কবুতর খায় তো?
রুমা মোদক : হ্যাঁ এমনিতে অন্য কবুতর খায়। হ্যাঁ, জালালি কইতর টোটেম বলতে পারেন।
মেউ : আচ্ছা। দুইটা আলাদা করে চেনা যায় তো?
রুমা মোদক : একদম। জালালি কবুতর একদম আলাদা। ছাই রং। ধূসর।
মেউ : আচ্ছা। ভালো। ভুলে না খেলেই হয়! শ্রদ্ধা তাঁদের টোটেমের প্রতি।
এই গানটাকে আমি দেশভাগের প্রেক্ষিত থেকেও দেখি। অবশ্য আপনি ইতোমধ্যেই দেশভাগের প্রেক্ষাপটে এটিকে ব্যবহার করেছেন। তানভীর মোকাম্মেলও দেশভাগের ডকুমেন্টারি 'সীমান্তরেখা'য় এই গান ব্যবহার করেছেন। ভালো একটা ডকু, বেস্ট!
রুমা মোদক : না, আমি দেশভাগের পটভূমিতে গানটি ব্যবহার করিনি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ব্যবহার করেছি। নতুন ডিসকোর্সে। তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার পূর্বক।
মেউ : ও আচ্ছা। আপনার জন্ম ১৯৭০ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স নিশ্চই শূন্য মাসের বেশি ছিল! বাবা-মা বা দাদা, দাদির মুখে কখনো শুনেছেন কীভাবে আপনার ওপরও প্রভাব ফেলেছিল মুক্তিযুদ্ধ? দশ মাসের ছিলেন বোধ হয়?
রুমা মোদক : ভীষণরকম। এই সময়ের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। রাতের অন্ধকারে পুরো পরিবারের পালিয়ে যাওয়া। সীমান্ত পাড়ি দেয়া। আগরতলার শরনার্থী শিবিরে উদ্বাস্ত জীবন। ডায়রিয়ায় আমার মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠা। আমার বাবা নয়মাস দেশে আটকা পড়েছিলেন। কাকা মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদা ছিলেন প্যারালাইসিস রোগী। বাবার কোন খবর আমার মাসহ পরিবারের কেউ জানতেন না। মৃত্যু হয়েছে এমন ভাসা ভাসা খবর পাচ্ছিলেন। তাঁর বেঁচে যাওয়াটাও অলৌকিক। মহাকাব্যিক ইতিহাস শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আমার বিভিন্ন লেখায় বিচ্ছিন্ন ভাবে তার ছাপ আছে। বৃহৎ কিছু লেখার স্বপ্ন আছে।
হ্যাঁ, তখন আমার দশ মাস। শুনতে শুনতে সব আমি চলচ্চিত্রের মতো দেখতে পাই। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের অমানবিক সেই লড়াইয়ের দিন।
মেউ : আপু, অনেক শ্রদ্ধা আপনি ও আপনার পরিবারের সবাইকে। অসংখ্য শিশু সেসময় শরনার্থী শিবিরে ডায়রিয়ায় মারা গেছে। দেশের জন্য আপনারও ত্যাগ আছে।
হ্যাঁ, লেখাই উচিত। ভালো কিছু হবে।
রুমা মোদক : আফসোসও আছে। আরো কয়েকটি বছর আগে জন্ম নিলে স্পষ্ট স্মৃতি কিংবা অংশগ্রহণ থাকতো। সেই ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বদেশ পেয়েছি তা কি প্রত্যাশিত ছিলো! এসব আফসোস আছে
মেউ : ঠিক। তবে আমরা আশাবাদী, ঠিক হবে সবকিছু একদিন। ঢাকায় থিয়েটারের জন্য সেসব সুবিধাদি আছে, বাংলাদেশের মফস্বলের কোথাও নাই। কেন্দ্র থেকে দূরে, আপনার নাট্যচর্চা কেমন চলছে?
রুমা মোদক : নিত্যদিনের লড়াই। নিত্যদিনের হতাশা অতিক্রম করে মঞ্চ আগলে থাকা। এই লড়াই বহুমাত্রিক। এটা তো আমাদের ভালোবাসার জায়গা। ভালোবাসার জন্য লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি।
মেউ : গল্পের পৃষ্ঠা আর নাটকের মঞ্চ— কোনটায় 'সমাজবাস্তবতা' বেশি? আপনার নিজের ক্ষেত্রে কী অভিজ্ঞতা? সমাজবাস্তবতার প্রসঙ্গ কেন আসে?
অনেকে তো হাসাহাসি করে!
রুমা মোদক : ইনভার্টেট কমা। হা হা। আমিও হাসলাম।
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের সব কার্যাবলীই তো সমাজবাস্তবতার অংশ। আলাদা করে আর সমাজবাস্তবতা কি। এখন লেখক হিসাবে আমার কিংবা আপনার অভিঘাত কিংবা আগ্রহের জায়গা ভিন্ন হতে পারে। সমাজ এবং বাস্তবতার বাইরে তো কেউ নই। একজন সাধারণ মানুষ ও তার ভেতরেই।
আর মঞ্চে নানাবিধ মঞ্চ বাস্তবতা রয়েছে। সেট লাইট প্রপস অভিনয়শিল্পী। ফলে মঞ্চে কাজের জায়গাটায় সুযোগ সীমাবদ্ধ। সেক্ষেত্রে সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমে বেশি।
মেউ : আপু, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সময় দেওয়ার জন্যে। সাবধানে থাকবেন। ভালো থাকবেন।
রুমা মোদক : আপনিও অনেক ভালো থাকবেন৷ শুভকামনা রইলো।
![]() |
মেহেদী উল্লাহ (জন্ম:১৯৮৯) |
0 মন্তব্যসমূহ