এখনাে অন্ধকার আসেনি। কিন্তু আসবে। কালাে পিপড়ের মতাে সারি বেঁধে আসবে অন্ধকার। আর বিশ্রী জড়ভরতের মতাে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে ঘরময়! বারান্দাময়। এমনকি গােলাপগাছটার তলায়ও বিশ্রী শুয়াের-গা অন্ধকার ঘোঁৎঘোঁৎ করবে।
অন্ধকার দেখলে কান্না পায়। ভয় হয়। আর ঘেন্না লাগে।
এই ছবিটা আব্বা কিনে এনেছিল। আব্বার নাকি খুব ভালাে লেগেছিল এই ছবিটা। আব্বার অনেক কিছু ভালাে লাগত। আব্বা বুঝি খুব প্রাণখােলা লােক ছিল । তার মনে আছে। আব্বা খুব হাসত। অকারণেই মাঝে মাঝে হেসে উঠত। সে হাসিকে অট্টহাসি বলেও ভুল করেছে অনেকে।
আব্বার ফটো হাসছে। মায়ের মুখ নিচু। লাজুক লাজুক। আব্বা হাসছে। আব্বা নেই। মা সুন্দর। মা নেই। মা থেকেই নেই। মাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে। মাকে ঘৃণা করতে নেই। মা কি আমাকে ভালােবাসত? বেশ বড় হয়েছিলাম তবু মা আমাকে চুমু খেত। আদর করত। তবু মা চলে গেল। আব্বা চলে গেল। আব্বাকে কী বলে ডাকতাম? পাপা বলে। পাপা আমাকে মণি বলত। পাপার ফটো হাসছে। পাপা নেই । মায়ের ফটো লাজুক লাজুক। মা হয়তাে মীনাকে এতক্ষণে সাজিয়ে দিচ্ছে। হয়তাে আরাে কিছু। অনেক পরে সে মীনাকে দেখছে। এই মাত্র সেদিন। মীনা কি তাকে চিনতে পেরেছে? তাহলে অমন ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিল কেন? মীনা কি জানে? মীনা কিছুই জানে না। মা তাকে কিছুই বলেনি।
পাপা ছবি আঁকত। পাপা গান জানত। গান করতে ভালােবাসত। কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে হারমােনিয়ামটা ঢাকা রয়েছে বেঞ্চের উপর। পাপার তুলি, ড্রইং পেন্সিল হারমােনিয়ামের পাশের স্যুটকেশে বন্ধ। পাপা থাকলে ওগুলাে এখন বাইরে থাকত। হারমােনিয়ামের রিডগুলাে অমন খুলে পড়ে থাকত না, আমি কিছুই জানি না। পাপার মতাে আমার কোনাে গুণই নেই।
পাপার পাথরবাটিটা বেঞ্চের নিচে! কত দিন ধুলাে খেয়েছে কে জানে। কী রং ওতে ছিল তা আজ হারিয়ে গেছে। পাপা ওতে তুলি ধুয়ে আবার ছবিতে বুলােত। নতুন রঙের রেখা আঁকত। ধুলাে-খাওয়া পাথরবাটি রয়েছে। পাপা নেই।
মিউ করে বিড়ালটা ডাকল। বেঞ্চের কোণার দিকে যেখানে একটু-একটু অন্ধকার এসেছে সেখানে সে আজ তিনদিন বাচ্চা প্রসব করেছে। বেশ গােটা-গােটা দুটো বাচ্চা। একটা ধবধবে সাদা। অন্যটার গায়ে কালাে ডােরাকাটা। বাঘের মতাে ডােরাকাটা । বিড়ালটা আবার ডাকল। পাথরবাটিতে খাবার দিলে কেমন হয়?
পাথরবাটিতে পাপা তুলি ধুয়ে নিয়ে নতুন করে রং লাগাত। পাপার বুঝি ঐ ছবির মতই আর-একটা ছবি আঁকার ইচ্ছে ছিল। সে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি। এ-বাড়িতে অমন ছবি আর-একটিও নেই। পাপার ছবি ওর কাছে কাঁচা হাতের বলে মনে হয়।
পাপা ঐ ছবি কিনে এনেছিল। আর সেইসাথে কিনে এনেছিল কালাে নদীর কালাে রং। তাই সব কালাে হল। অন্ধকার হল । অন্ধকারকে আমি ভয় করি । অন্ধকারকে আমি ঘৃণা করি।
মা অন্ধকারেই চলে গিয়েছিল। মাকে আমি পাইনি। আমি জেগে উঠেছিলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম। মাকে পাইনি । পাপা ছুটে এসেছিল, কী হল মণি? আমি বুঝি কেঁদে উঠেছিলাম। মাকে পাইনি। মা এ-বাড়িতে ছিল না। তখন কতই-বা আমার বয়স হবে । ক্লাস ফাইভে পড়তাম না?
পাপা হাসত। পাপা বলত হাসির মূল্য আছে। গভীর মূল্য আছে। কাঁদার মূল্য মাত্র দুটো। বিরহ আর বেদনা। হাসির মূল্য অনেক। হাসিতে প্রাণের রূপ আছে। জীবনের রূপ আছে। মা শুনে হাসত। পাপার সাথে এখানে মায়ের মতের মিল হল না।
অথচ মিল হয়েছিল। তা সে অনেককাল আগে। কলেজজীবনে সেই হাসিই তাদের মিলিয়েছিল। মা বুঝি প্রাণপ্রাচুর্য খুঁজে পেয়েছিল পাপার মধ্যে। পাপা হাসতে গেলে তার বুকটাও দ্রুত ওঠানামা করত। কোনাে মেয়ে হলে তার হারের লকেটটা ঠিকরে পড়ে উজ্জ্বল আলাে ছড়াত। সেই চিন্তা আর কল্পনা মায়ের মনে রামধনু রং এঁকেছিল। আর মা ভালােবেসেছিল পাপাকে।
নানারও নাকি ভালাে লেগেছিল পাপাকে। দুইপক্ষের গুরুজনেরও তাই একমত হতে দেরি হল না। পাপা নীড় বাঁধল মাকে নিয়ে। মা নীড় বাঁধল (?)
রেবা নীড় বাঁধতে চায়। রেবা স্বপ্ন দেখে। চাকরি যদিও পাইনি। রেবার বিশ্বাস চাকরি পেতে আমার আদৌ দেরি হবে না। আমি চেষ্টা করিনে তাই। বলে, তােমার মতাে স্কলারের কি চাকরির অভাব! শুধু তােমার চেষ্টার ত্রুটি। জানাে, তােমার জন্যে আমি কত চিন্তা করি। রেবা স্বপ্ন দেখে।
আমি স্বপ্ন দেখতাম। এখন দেখিনে। মেঘের আড়ালে নীল আকাশ যেমন ঢেকে যায় তেমন ঢেকে গেছে। স্থবির আর জবড়জং। স্বপ্ন আর চিন্তা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বাতাস খেলতে নিষেধ। আলাে-বাতাস আমি চাইনে। অন্ধকারের কিনারে চিরদিন ঘুমিয়ে থাকব। অন্ধকার আসবে। এখনাে আসেনি। কিন্তু পায় পায় আসবে। গজগতিতে আসবে। আর অন্ধকারে আমার স্বপ্ন ঢেকে দেব।
পাপার স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি। পাপার নীড়ের ভিত কাঁচামাটির উপরে গড়া ছিল বুঝি। সেই কিনে-আনা ছবি মডেল করে পাপা ছবি আঁকতে চেয়েছিল। তা আর হয়নি। সেই ছবির লাজ-নম্র হাসি এখনও ম্লান হয়নি। এখনও তার চোখে ভাসা-ভাসা কথার ঢেউ। আমি সহ্য করতে পারিনে। ও ছবি আমার সহ্য হয় না। ও ছবিকে অন্ধকারের মতোই ভয় করি। অন্ধকারের মতাে ঘৃণা করি। ওর কটিবসনে, নিচোল বাসে কালো নদীর কালাে রং বুঝি ঢেউ খেলছে।
![]() |
শহীদুর রহমান(১৯৪২-১৯৯৩) |
0 মন্তব্যসমূহ