bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মাজহারউল মান্নানের ভ্রমণ গদ্য: দিল্লি বহু দূর

দুই হাজার সতের সালের জুন মাসে গিয়েছিলাম ভারতে। বিশাল এবং বিচিত্র দেশ ভারত। বলা হয়ে থাকে যা নাই ভারতে তা নাই ভূ-ভারতে। মোঘল আমলে বাদশাহদের বলা হতো দিল্লীশ্বর বা জগদীশ্বর। এ থেকে ভারতের বিশালত্ব অনুমান করা কষ্ট হয় না। বেশ কয়েক বার গিয়েছি ভারতে কিন্তু হরিয়ানা, হিমাচল আর রাজস্থানে যাওয়া হয়নি কখনো। এবারের ভারতভ্রমণ ছিলো সেই ইচ্ছা পূরণেরই ফল।

প্রথমে দিল্লি। দিল্লি থেকে আগ্রা। আগ্রায় দেখেছি লাল কেল্লা। দেখেছি মোঘল সম্রাটদের অন্দরমহল। দেখেছি সম্রাট শাহ্জাহানের প্রেমের তাজমহল। কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল। দেখেছি শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি মথুরা-বৃন্দাবন। দেখে এসেছি ইতিহাসের আর এক জাদুপুরী সম্রাট আকবরের নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রি। গিয়েছি ভারতের শীতকালীন রাজধানী শৈলশহর শিমলা। 

শিমলা থেকে ফিরে গিয়েছি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির আজমির শরিফ। পথে পৃথ্বিরাজের পিঙ্ক সিটি জয়পুর। গিয়েছি আজমিরের হিন্দু তীর্থ পুস্কর। দেখেছি তারাপুর গড় দুর্গ দরগাহ্ শরিফ। আনালেক সাগর। প্রাচীন মসজিদ ঢাই দিন কা ঝোপরি’র ভগ্নাবশেষ। 

পথে পড়েছে স্মরণাতীত কালের কতো কতো প্রাচীন মন্দির-মসজিদ-দরগাহ্-প্রাসাদ। সব কথা এই স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। এবার শুধু বলবো দিল্লিতে দেড় দিনের কথা।

দিল্লি এয়ারপোর্টে নেমেই বুঝলাম আমার দুটো কাজ ঠিক হয়নি। এক, একা আসা। দুই, এই অসময়ে আসা। মে’র শেষ। জুনের শুরু। দিল্লির বাতাসে আগুনের হল্কা। মাটিতে জ্বলন্ত কয়লার উত্তাপ। বাইরে বেরুলে মনে হয় মগজ গলে পড়বে। অথচ ঠিক একই সময়ে হিমালয়কন্যা হিমাচলের শিমলায় হিম হিম ঠান্ডা। কুয়াশা কাটে না সকাল দশটা পর্যন্ত। 

এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় আঠার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যখন পুরাতন দিল্লির হোটেল ‘আইওয়ানে শাহী’তে পৌঁছলাম তখন বেলা অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। ফ্রেশ হয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিচে নামতেই কম বয়েসী রিসেপশনিস্ট ছেলেটা বললো, স্যার মানিব্যাগ সামলে রাখবেন। এখানে যত্রতত্র পকেটমার। আর হাতের সেলফোনটা শক্ত করে ধরে রাখবেন। যেকোনো মুহূর্তে থাবা মেরে নিয়েই উধাও হয়ে যাবে। 

আমার অজান্তেই একবার মানিব্যাগ আর সেলফোনটার অবস্থান পরখ করলাম। এই বিদেশ বিভূঁয়ে একা। খানিকটা ভয়ই পেলাম।

হোটেলের একেবারে সামনেই দেখি পুরাতন দিল্লির প্রখ্যাত স্থাপনা জামে মসজিদ। প্রায় আধা কিলোমিটারের অধিক জায়গা জুড়ে নির্মিত পাঁচ শ’ বছরের পুরোনো এই বিশাল মসজিদটি ভারতের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্যের ধারক। সেই সময় দশ লাখ রুপি ব্যয়ে এটি নির্মাণ করেছিলেন মোঘল সম্রাট শাহ্জাহান। ভূমি থেকে ত্রিশ ফুট উঁচু এই মসজিদটির ফার্সিতে নাম ছিলো মসজিদ-ই-জাহান্নুম। যার অর্থ বিশ্বকে প্রতিফলিত করা মসজিদ। তিনটি বিশাল ফটক। চারটি সাদা মার্বেল পাথরের গম্বুজ। চল্লিশ মিটার উঁচু দু’টি মিনার। নামাজিদের জন্য মসজিদের মেঝেতে আছে নয় শত কাতার। ওয়াক্তি নামাজ ছাড়াও প্রতি শুক্রবারে প্রায় পঁচিশ হাজার মুসল্লি এখানে একসাথে জুম্মার নামাজ আদায় করে।

নয়নাভিরাম এই মসজিদটির চার পাশ কিন্তু খুব অপরিচ্ছন্ন। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে নোংরা দোকানপাট। চায়ের দোকান। রিকসা বাইকের গ্যারেজ। ছড়ানো ছিটানো ভাঙাচোরা পুরাতন পার্টস। যত্রতত্র ডাস্টবিন। উপচে পড়ছে ময়লা আর উচ্ছিষ্ট । ভন ভন করছে মাছি। কাকেরা মেতেছে ময়লা ছড়ানোর উৎসবে।  

আসরের নামাজ শেষ। আমি মসজিদ চত্বরে উঠতে যাবো একজন বললেন, জুতা খুলে যান। আর একজন সাথে সাথে বললেন, জুতা হাতে নিয়ে যান, না হলে চুরি যাবে। আর আপনার হাতের ক্যামেরা আর কাঁধের ব্যাগ কোথাও রাখবেন না। মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যাবে। এসব দেখে শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। 

বেলা শেষ। অস্তগামী সূর্যের বর্ণিল রশ্মিছটা এসে পড়েছে লাল বেলে পাথর আর সাদা মার্বেলের স্ট্রাইপ দেয়া সুউচ্চ মিনারে। সৃষ্টি হয়েছে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। সেদিকে তাকিয়ে আবার মনটা ভালো হয়ে গেল।


পরদিন সকালে উঠেই ভাবলাম দিল্লির লালকেল্লা দেখেই শুরু করবো আজকের ট্যুর। শুনলাম, খুব কাছেই, বড় রাস্তা পার হলেই কেল্লা। প্লান অনুযায়ী পা বাড়ালাম। কিন্তু বাধ সাধলো একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। সে হিন্দিতেই কথা বলে তবে বাংলা বোঝে বেশ। সামান্য কিছু বলতেও পারে। সে বললো, কেল্লা তো খুব কাছেই, যেকোনো সময় দেখতে পাবেন। তার চেয়ে চলেন দিল্লি শহরটা এক চক্কর ঘুরে নিয়ে আসি। বলেই সে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। দরদাম করার সুযোগই দিলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গাড়ি থামিয়ে বললো, এই যে বাম পাশে দেখছেন, এটা হচ্ছে রাজঘাট। মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থল। তাঁর মৃত্যুর এক দিন পর এখানেই তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। 

যমুনার কোল ঘেঁষে বিরাট চত্বর। দুই দিক থেকে দেয়ালঘেরা সরু প্রবেশপথ। দুই দিকেই দেয়ালের পাশে নানা বাহারি রঙের ফুলের বাগান। সবুজ ঘাসে মোড়া চত্বরের মাঝখানে খোলা আকাশের নিচে কালো মার্বেল পাথরে বাঁধানো সমাধিস্থল। এক পাশে কাঁচঘেরা একটি শিখা জ্বলছে অবিরাম। কাছেই বড় একটা কেতকীর গাছ। সাদা সাদা ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে ডাল। সমাধির একপাশে মহাত্মার খুব বড় একটা পোর্ট্রেইট। নিচে লেখা My life is my message. লোকজন সারিবদ্ধভাবে ঘুরে ঘুরে দেখছে সব। 

একদল শিক্ষার্থী ঘিরে ধরে আছে তাদের লেডি টিচারকে। তিনি একজন চৌকস গাইডের মতো গান্ধী হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিচ্ছেন ইংরেজিতে।

তিনি বলছেন, শোনো ছেলেমেয়েরা, সেই বেদনাদায়ক দিনটি ছিলো ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মসের ৩০ তারিখ। গান্ধীজী তখন থাকতেন নতুন দিল্লির তিস জানুয়ারি রোডের বিড়লা হাউসে। ভারতীয় শিল্পপতি বিড়লা পরিবারের অনুরোধে তিনি প্রায়ই এখানে এসে বিশ্রাম নিতেন। বিকেলে বিড়লা ভবনের সামনেই একটি উঁচু চত্বরে নিয়মিত প্রার্থনা সভা করতেন তিনি। অন্যান্য দিনের মতোই দুই তরুণীর কাঁধে ভর দিয়ে প্রার্থনা সভায় এলেন। সেদিন আসতে একটু বিলম্বই হলো। ঠিক এমন সময় বিপরীত দিক থেকে অতি সন্তর্পণে এক যুবক এসে দাঁড়ালো তাঁর সামনে। প্রথমে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করলো সে। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার ভঙ্গি করতেই গান্ধীজীর ডান পাশের তরুণী বাধা দিলেন। বললেন, এ কী করছেন দাদা? এমনিতেই বাপুজী আজ লেট। এই সুযোগে যুবক তার জামার নিচে লুকোনো সেমি অটোমেটিক পিস্তলটি বের করলো। একেবারে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে সোজা মহাত্মার বুক লক্ষ করে গুলি করলো তিন তিন বার। 

গান্ধীজী একবার শুধু উচ্চারণ করলেন, Oh God. পরক্ষণেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি। জীবনের পরপারে চলে গেলেন ব্রিটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভারতের জাতির জনক, জাতির পরম শ্রদ্ধেয় বাপুজী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। 

সেই যুবকের নাম নাথুরাম গডসে। ইতপূর্বে ছয় ছয়বার মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় সে। বিচারে তার ফাঁসি হয়। আদালতে দাঁড়িয়ে সে বলেছে, গান্ধীর জন্যই ভারত ভাগ হয়েছে। তিনি হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের স্বার্থ দেখেছেন অধিক। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের শত্রু। কাজেই তাঁকে হত্যা করা ছাড়া উপায় ছিলো না। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস সারা জীবন যে মানুষটি স্বজাতির অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন তাঁকেই জীবন দিতে হলো স্বধর্মের একজন হিন্দুত্ববাদীর হাতেই। এই মর্মস্পর্শী কাহিনী বলতে বলতে কণ্ঠ ভারি হয়ে গেল টিচারের। শিক্ষার্থীদের অনেকের চোখ পূর্ণ হয়ে এলো পানিতে।

গাড়িতে ফিরে এসে ড্রাইভারকে বললাম, সোজা চলো বিড়লা হাউস। গান্ধীস্মৃতি মিউজিয়াম দেখবো।

বিড়লা হাউসের সামনে বিশাল আকারের পোর্ট্রইেট। চিরায়ত গান্ধী। লাঠিহাতে বাঁকা বাপুজী। সামনের চত্বরে স্মৃতির মিনার। যেখানে শহিদ হয়েছেন মহাত্মা গান্ধী। মিউজিয়ামের প্রবেশমুখে দুটি কক্ষ শুধু গান্ধীময়। প্রতিকৃতির নিচে ধুপধুনা আর পূজার উপাচার। মিউজিয়ামের মূল কক্ষের দীর্ঘ গ্যালারিতে সাজানো আছে নানা ধরণের চরকা আর তাঁত। পাশেই আছে তাঁর সাদাসিধে জীবনযাপনের নানা সামগ্রী। দীনহীন চারচালা খড়ের ঘর। তাঁর ব্যবহার করা খড়ম। তালের হাতপাখা। টায়ারের স্যান্ডেল। হ্যারিকেন। কাগজ কলম কাঠপেন্সিল আর কাসার বাসনকোসন। সমগ্র মিউজিয়াম জুড়ে আছে শত শত স্মৃতিময় ছবি। বালিকাবধূ কস্তুরী বাঈয়ের সাথে বিয়ে। চরকাকাটারত গান্ধী ও কস্তুরী বাঈ। আফ্রিকায় তরুণ ব্যারিস্টার গান্ধী। নেতাকর্মীদের সাথে লাঠি হাতে লং মার্চ। কারাগারে কারা ফটকে বাপুজী। দুই তরুণীর কাঁধে ভর দিয়ে জনসভার মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ানোর সেই চিরায়ত দৃশ্য।

ট্যাক্সি যখন সফদর জং রোডের ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালো তখনো আমার মাথায় মহাত্মা গান্ধী। ড্রাইভার জানালো টিকেট করতে হবে। গেট পেরুলেই ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবন। এই বাড়িকে ঘিরে এক সময় বিশাল ভারতের রাজনীতি আবর্তিত হতো। বিশাল সবুজ চত্বরের এক পাশে শ্বেতশুভ্র একতলা বাড়িটা এখন স্মৃতির মিউজিয়াম। 

এ কামরা ও কামরা হেঁটে বেড়াই। শুরুতেই ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার দিনে তাঁর পরনের রক্তমাখা শাড়ি দেখে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। তাঁর নিত্য ব্যবহারের সব সামগ্রী সাজানো আছে পরিপাটি করে। আলনাভর্তি তাঁতের শাড়ি। সাদামাটা স্যান্ডেল। শান্তিনিকেতনী সাইড ব্যাগ। গায়ের সাধারণ চাদর। তাঁর ব্যবহার করা কাসার তৈজসপত্র। সাদামাটা ড্রইংরুম। বইভর্তি পড়ার ঘর। লেখার টেবিল। দেখে অবাক হয়ে যাই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী প্রধানমন্ত্রী কি সাদামাটা জীবনই না যাপন করতেন। কক্ষে কক্ষে ফ্রেমবন্দী স্মৃতিময় সব অমূল্য ছবি। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পাশে কিশোরী ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। প্রিয়দর্শিনী নামটা কবিগুরুই দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে বসা সেই অসাধারণ ছবিটি। 

ছবিটা দেখেই একাত্তরের কথা মনে পড়ে গেল। বাঙালি জাতির সেই দুর্দিনে কী না করেছেন তিনি। আহার দিয়েছেন। আশ্রয় দিয়েছেন। সারা বিশ্ব ছুটে বেড়িয়েছেন সমর্থন আদায়ের জন্য। সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরঋণী করে রেখে গেছেন। 

ফ্রেমেবন্দী হয়ে আছে গান্ধী পরিবারের নানা বেদনাদায়ক মুহূর্তের ছবি। নিহত হওয়ার সময়ের রাজীব গান্ধীর ছিন্নভিন্ন পাঞ্জাবি। পায়ের জুতামোজা। 

বিমান দুর্ঘটনায় নিহত সন্তান সঞ্জয় গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অশ্রুভেজা চোখে মা ইন্দিরা গান্ধীকে দেখে সব দর্শকের চোখই পানিতে পূর্ণ হয়ে আসে।

মিউজিয়াম থেকে বেরুতেই দেখা একজন বাঙালি অধ্যাপকের। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ওপর গবেষণা করছেন। তাঁর কাছেই শুনলাম ইন্দিরা হত্যাকান্ডের কাহিনী। 

সত্তরের দশকে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখরা সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড চালিয়ে বহু ভারতীয়কে হত্যা করে। তাদের মূল আস্তানা ছিলো অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির কমপ্লেক্সের আকাল তখ্ত। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সামরিক অভিযান চালিয়ে স্বর্ণমন্দির বিচ্ছিন্নতাবাদীমুক্ত করেন। এই অভিযানে স্বর্ণমন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। নিহত হয় শত শত শিখ। সেই থেকে শিখদের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে। তারা এর বদলা নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। 

দিনটা ছিলো ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। সকাল ৯টা। প্রধানমন্ত্রীর দুই শিখ দেহরক্ষী বেয়ান্ত সিং ও সতবন্ত সিং সকালে ডিউটিতে এসে অস্ত্র বুঝে নিয়ে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে পড়লো। একবার দু’জন অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো। শিখ হলেও দু’জনই ছিলো প্রধানমন্ত্রীর বেশ আস্থাভাজন। নয়টা বিশ মিনিটের দিকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর বাসভবন সংলগ্ন অফিস থেকে বেরিয়ে এসে সামনের বাগানের একটি সরু রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন গেটের দিকে। সাথে ক’জন নেতাকর্মী। আর ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভ। তিনি আইরিশ টেলিভিশনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকার নিচ্ছিলেন। এমন সময় বেয়ান্ত সিং রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। প্রথমে সে সামনে থেকে সামরিক কায়দায় স্যালুট করলো একবার। পরক্ষণেই কোমরের বাঁধা খাপ থেকে রিভলবার বের করে সোজা তাক করলো প্রধানমন্ত্রীর দিকে। 

সহসা সামনের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন ইন্দিরা গান্ধী।একবার শুধু উচ্চারণ করলেন, বেয়ান্ত সিং, ইয়ে তোম কেয়া কর রাহা হো? ত্বরিত জবাব দেয় বেয়ান্ত সিং। বলে, আকাল তখ্ত কি বদলা ম্যাডাম। বলেই সে পর পর তিন বার গুলি করলো প্রধানমন্ত্রীর বুকে। ঠিক এই সময় পেছন দিক থেকে সতবন্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ত্রিশ রাউন্ড গুলি ছুড়ে ঝাঁঝড়া করে দিলো ইন্দিরার শরীর। দু’বার পাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। জীবনের পরপারে চলে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী নেত্রী, ভারতের দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, নেহেরু কন্যা, রবি ঠাকুরের ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী।

বিষণ্ন মন নিয়ে বেরিয়ে এলাম ইন্দিরা মেমোরিয়াল থেকে।

ইন্ডিয়া গেটের সামনে এসে আমার ভুল ভেঙে গেল। আমার ধারণা ছিলো ইন্ডিয়া গেট বোধহয় কোনো প্রবেশদ্বার। দেখি মোটেও তা নয়। গেটের আদলে তৈরি অসাধারণ সৌকর্যময় একটি স্থাপনা। একটি ওয়ার মেমোরিয়াল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত নব্বই হাজার সেনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের স্মৃতিসৌধ। নয়া দিল্লির কেন্দ্রে অবস্থিত এই গেট তৈরি করা হয়েছে লাল ও সাদা বেলে পাথর আর গ্রানাইট পাথর দিয়ে। গেটের গায়ে লেখা তের হাজারেরও অধিক সেনার নাম। সবুজ ঘাসে মোড়া বিরাট চত্বর। মাঝখানে বিয়াল্লিশ মিটার উঁচু এই স্মৃতির মিনার। চূড়ায় বড় করে লেখা  INDIA. 

চারদিকে ফুলের বাগান। বাম পাশে লেক। লেকে একটি ফোয়ারা। অবিরাম কুয়াশার মতো ছড়াচ্ছে পানি। গেটের মাঝ বরাবর একটি শিখা জ¦লছে অবিরাম। কোনো এক ভারতীয় সৈন্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রজ্জ্বলিত এই শিখার নাম অমর জ্যোতি জওয়ান। শুনলাম, দিনশেষে যখন নানা রঙের আলো জ্বলে ওঠে তখন অপার্থিব এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। সেই সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। গেটের খুব কাছে যেতে দিলো না সতর্ক প্রহরী। মন খারাপ করে ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ কানে এলো গানের সুর। লক্ষ করে দেখি, চারদিকে বসানো ছোট ছোট স্পিকারে বাজছে গান: 

মেরা রঙ দে, মেরা রঙ দে বাসন্তী চোলা মায়ে, রঙ দে বাসন্তী চোলা ... 

মনে পড়ে গেল মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিংয়ের কিংবদন্তীতুল্য জীবনকাহিনীর ওপর নির্মিত অসাধারণ চলচ্চিত্র দ্য লিজেন্ড অব ভগৎ সিংয়ের কথা। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় লাহোর জেলে বিপ্লবী ভগৎ সিংকে ফাঁসি দেয়া হয়। অজয় দেবগণ অভিনীত ছবিটি বানিয়েছিলেন রাজকুমার সন্তোষী। ফাঁসির দৃশ্যে চিত্রায়িত এ আর রহমানের সুরে গাওয়া মর্মস্পর্শী এই গানটি শুনলে এমনিতেই দু’চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে আসে।

ট্যাক্সিতে ফিরতেই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, স্যার, মন খারাপ?

সচকিত হয়ে বললাম, কই? না তো! 

কিন্তু নিজের কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝলাম কতোটা বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছে আমার মন।

ইন্ডিয়া গেট থেকে বেরিয়ে প্রায় পনের কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছলাম কুতুব মিনারের সামনে। আজীবন বইয়ের পাতায় দেখা কুতুব মিনার চোখের সামনে দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। শুনলাম তিয়াত্তর মিটার উঁচু এই মিনারটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত টাওয়ার। এটি মুসলমানদের ভারত বিজয়ের স্মারক হয়ে আছে সাত শ’ বছর। সুলতান মুহাম্মদ ঘোরির সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯২ সালে পৃথ্বিরাজ চৌহানকে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত করেন। এ বিজয়ের পরপরই তিনি দিল্লি দখল করে এই মিনারটি নির্মাণ করেন। পাঁচ তলা বিশিষ্ট মিনারের প্রত্যেক তলায় আছে ঝুলন্ত বারান্দা। ভেতরে সিঁড়ি আছে ৩৭৯ টি। নিচের দিকে মিনারের আয়তন সাড়ে চৌদ্দ মিটার। উপরের দিকে পোনে তিন মিটার। কুতুব মিনারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মনোরম একটি কমপ্লেক্স। এক শ’ একর জমির ওপর স্থাপিত এই কমপ্লেক্সে আছে কুয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আলাই গেট, আলাই মিনার, লোহার পিলার। আছে সুলতান ইলতুৎমিশ, সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন, সুলতান আলা উদ্দিন খলজী এবং ইমাম জামিনের সমাধি। লাল বেলে পাথর দিয়ে তৈরি কুতুব মিনারের গায়ে চমৎকার ক্যাালিওগ্রাফিতে উৎকীর্ণ আছে পবিত্র কোরআনের আয়াত। আছে অসংখ্য ডিজাইনের কারুকার্যময় নকসা। দেখলাম মহিলারা খুব কাছ থেকে তুলছে সে সবের ছবি। শুনলাম রাতে বিদ্যুতের বর্ণিল আলোয় কুতুব মিনার কমপ্লেক্স না কি স্বপ্নীল রূপ ধারণ করে। সময়ের কারণে তা আর দেখার সৌভাগ্য হলো না।

দিল্লির সর্বাধিক পরিদর্শনীয় স্থাপত্য লোটাস টেম্পলে যখন এলাম তখন গ্রীষ্মের আগুনঝরা সূর্যটা পশ্চিমাকাশে অনেকটাই হেলে পড়েছে। এই মন্দিরটি আসলে বাহাই ধর্মের উপাসনালয়। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি বিশ্বের নবীনতম এই ধর্ম প্রবর্তন করেন ইরানের মির্জা আলি নুর। বাহাই ধর্মের নিয়মানুযায়ী যে কেউ এই উপাসনালয়ে যেমন প্রবেশ করতে পারেন তেমনি উপাসনায়ও অংশগ্রহণ করতে পরেন। 

বিশ্বের প্রায় সকল ধর্মই যখন একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক তখন বাহাইয়েরা দু’বাহু বাড়িয়ে সকল ধর্মের মানুষকে আমন্ত্রণ জানায় একসাথে স্রষ্টার উপাসনা করতে।

ছাব্বিশ একর জমির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই বিশাল স্থাপত্যটির নির্মাণশৈলী এমনই সুন্দর যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় পানির উপরে যেন একটি প্রষ্ফুটিত পদ্ম। পদ্মফুল বাহাই ধর্মের প্রতীক। যা বিশুদ্ধতা ও সৌন্দর্যেরও প্রতীক। সমগ্র মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে মার্বেল পাথরের সাতাশটি পাপড়ি দিয়ে। পাপড়িগুলো আসমানি আলো প্রতিফলনের কাজ করে। মৃদু ব্যাপ্ত আলো ছড়ায়। পানির ওপরে ভাসমান পদ্মফুলের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য নয়টি পুকুর ঘিরে আছে লোটাস টেম্পল। সূর্যাস্তের পর বিদ্যুতের বর্ণিল আলোতে পদ্মমন্দির না কি হয়ে ওঠে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের প্রতীক। চোখ মেলে সে সৌন্দর্য দেখা হয়নি।

ফেরার পথে গেলাম হযরত নিজমুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ্ দেখতে। ভেবেছিলাম সেখানে একটি ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ দেখবো। কিন্তু আমি শুরুতেই কিছুটা আশাহত হলাম। মাজারের মূল ফটকে যাওয়ার আগে প্রধান সড়ক থেকে যে সরু রাস্তাটা একে বেঁকে গেছে তার দু’পাশ নোংরা দোকানপাটে ভরা। ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় মাজার চত্বরে পৌঁছাই মুশকিল। মাজারের বারান্দায় শুয়ে বসে আছে নানা ধরণের মানুষ। গরিব ভিক্ষুক থেকে শুরু করে অভিজাত ঘরের নারীপুরুষও আছে তার সাথে। তবে মাজারের ভেতরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। বাইরের চত্বরে গোল হয়ে বসা একদল কাওয়ালি গায়ক। মূল গায়ক হারমোনিয়ামে মৃদু সুর তুলছেন, ইয়া নিজাম উদ্দিন আউলিয়া, ইয়া নিজাম উদ্দিন সরকার ... ফায়াকুন কুন ফায়াকুন ... 

সাদা সবুজ সোনালী রঙের কারুকার্য খচিত মাজার স্থাপনাটি দৃষ্টিনন্দন। পুণ্যার্থীরা সারিবদ্ধভাবে ঘুরে ঘুরে জিয়ারত করছে গিলাপ আর গোলাপ আচ্ছাদিত মাজার। কেউ হেঁটে যেতে যেতে করছে মোনাজাত। কেউ বা মাজারে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে উঠছে শব্দ করে। একপাশে লাইন দিয়ে মাজারের উদ্দেশে সিজদা দিচ্ছে পুণ্যার্থী মানুষ। একটু বেশি সময় সিজদায় থাকলে তাকে টেনে তোলা হচ্ছে আর একজনকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য। আমি ভারতের যে ক’টা দরগাহ্ কিংবা মাজারে গিয়েছি সর্বত্রই প্রায় একই রকম এসব দৃশ্য দেখেছি। এমন কি হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ্ শরিফেও।

দরগাহ্ চত্বরেই আছে সম্রাট শাহ্জাহনের প্রিয়তম কন্যা শাহ্জাদী জাহানারার কবর। পড়ে আছে অনাদর অবহেলায়। কবরে মূল্যবান পাথরের কারুকাজ আছে। আছে ফুলের নকশা। কিন্তু মোঘল জমানার সেই আড়ম্বর নেই। বিদ্যায় বুদ্ধিতে জাহানারা ছিলেন পিতার চেয়েও অধিক অগ্রসর। সাহিত্য শিল্পকলাতেও ছিলেন পারদর্শী। তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন বিশিষ্ট কবি। পিতার শাসনামলে তাঁর ছিলো অসীম প্রভাব। দিল্লিতে চাঁদনি চকের নাম সকলেরই জানা। খুব কম মানুষই জানেন, এই চাঁদনি চকের পরিকল্পনা করেছিলেন জাহানারা। একসময় তিনি সব কিছু ছেড়ে সুফি ভাবধারায় মন দেন। গরিবদের কল্যাণের কথা ভাবতে থাকেন। তিনি নিজেও গরিবদের মতো সাদামাটা জীবনযাপন শুরু করেন। তিনি তাঁর এক কবিতায় লেখেন, তার কবরে থাকবে শুধুই ঘাস অন্য কিছু নয়। কারণ গরিবের কবরে ঘাসই মানায়। মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে কবর দেয়া হয় মাজার চত্বরেই। তিনি নিজেই লিখে যান তাঁর সমাধিলিপি: 

‘বাগায়ের সুবজা না পোসাদ মাজার মেরা 

কী কবর পোস গরিবাঁ হামে গায়া বাস আস্ট।’ 

There can be no other curtain of my tomb 

Except the humble covering of grass 

Grass alone is sufficient 

To cover the grave of a poor person

As I am.


এই লেখা শেষ করবো একজন সম্রাট-কবির করুণ কাহিনী দিয়ে। 

সকালে বাহাদুর শাহ্ রোড দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রাইভার সহসা গাড়ি থামিয়ে বললো, স্যার, ডান পাশে দেখুন, খুনি দরওয়াজা। তাড়াতাড়ি দেখে নিন, ব্যস্ত রাস্তা, বেশিক্ষণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। 

খুনি দরোজা আসলে কোনো দরোজা নয়। লাল ইটের তৈরি কারাগার সদৃশ একটি অভিশপ্ত স্থাপনা। একরখানেক জমির ওপর গাছগাছালির মাঝে ঠিক যেন বড়সড় একটি কারাকক্ষ। মোঘল স্থাপত্য কৌশলে নির্মিত এই স্থাপনার চারদিকে চারটি খোলা দরোজায় আছে তালাবদ্ধ লোহার গরাদ। এর খুনি দরোজা নামকরণের পেছনে আছে একটি মর্মস্পর্শী ইতিহাস। 

১৮৫৭ সালে শেষ মোঘল সম্রাট বাাহাদুর শাহ্ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করে সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। বাদশাহ্ জাফর সিপাহি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ সংবাদে সারা ভারতের সিপাহিরা গর্জে ওঠে, ‘খাল্ক-ই খুদা, মুল্ক-ই বাদশাহ্, হুকুম-ই সিপাহি।’ ‘আল্লাহ্ র দুনিয়া, বাদশাহ্ র রাজ্য, সিপাহীর হুকুম।’ একের পর এক সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইরেজরা প্রথম পর্যায়ে পর্যুদস্ত হলেও শেষ পর্যন্ত নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। সম্রাটের দুই পুত্র মির্জা মোঘল, মির্জা খিজির সুলতান এবং নাতি মির্জা আবু বকর সপরিবারে আশ্রয় নেন হুমায়ুনের মাজারে। 

ব্রিটিশ সেনানায়ক মেজর হাডসন পুরো মোঘলকেল্লা ঘিরে ফেলে। প্রথমে সে বিরাশি বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। পরে পরিবার পরিজনসহ তিন শাহজাদাকে গরুর গাড়িতে করে এনে হাজির করে খুনি দরোজার সামনে। সেখানে তিন শাহজাদাকে বিবস্ত্র করে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে হাডসন। তাদের মস্তক কেটে পাঠিয়ে দেয়  সম্রাটের কাছে। মৃতদেহগুলো ঝুলিয়ে রাখে খুনি দরোজায়।

ক্ষমতা, মর্যাদা ও স্বজন হারানোর শোক ভুলে থাকার জন্য বাদশাহ্ জাফর গজল ও মুশায়েরায় মগ্ন থাকতেন। তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন। জীবনের কষ্ট-বিষাদ ও পরাধীনতার গ্লানি ছিলো তাঁর কবিতার বিষয়। 

তথাকথিত বিচারে সম্রাটের মৃত্যুদন্ডের আদেশ হয়। পরে বয়স বিবেচনায় তাঁকে সপরিবারে নির্বাসন দেয়া হয় রেঙ্গুনে। তাঁর ইচ্ছা ছিলো স্বদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়া। প্রিয় জন্মভূমিতে তাঁর কবরের জন্য দু’গজ জমিন পাওয়া। কিন্তু সে সাধ পূরণ হয়নি তাঁর। 

মৃত্যুর পূর্বে এক কালোত্তীর্ণ কবিতায় তিনি লেখেন, 

উমর ই দরাজ মাঙ্গ কে লিয়ে থি চার দিন

দো আরজু মেঁ কাট গ্যয়ে দো ইন্তেজার মেঁ

কিৎনা হি বদনসিব জাফর দাফন কি লিয়ে

দো গজ জমিন ভি না মিলা কুয়ে ইয়ার মেঁ।

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তাঁর সমাধিসৌধ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন বইতে তিনি লেখেন, 

দো গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে 

পর তেরি কোরবানি সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ 

বদনসিব তো নাহি জাফর 

জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে 

আজাদী কি পয়গাম সে।  


////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////

 

লেখক পরিচিতি:

মাজহারউল মান্নান (জন্ম: ১৫ অক্টোবর, ১৯৪০)  
মাজহারউল মান্নান প্রথমত বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, এরপরে লোকসাহিত্য সংগ্রাহক এবং গদ্যকার। কথিত যে, নিজ ক্লাসের সবচেয়ে অমনোযোগী শিক্ষার্থীটি থেকে শুরু করে ভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ুয়া আগ্রহী শিক্ষার্থীরাও সাহিত্যের রস আস্বাদনে তাঁর বাংলা সাহিত্যের ক্লাসসমূহে উপস্থিত থাকত। জাদুকরি ক্ষমতার অধিকারী এই শিক্ষকের জন্ম গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রাম বাগুড়িয়ায় ১৯৪০ সালে। রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬) থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশোনা শেষে দেশের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন চৌত্রিশ বছর ধরে এবং ১৯৯৯ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে অবসর গ্রহন করেন। বর্তমানে তিনি গদ্যকার লেখক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘চোখ ভেসে যায় জলে’ (২০১১)। এছাড়া অন্যান্য স্মৃতি-সন্ধান ও আত্মজৈবনিক গ্রন্থসমূহ: কারাগারে কারাবাসে, জীবন ঘষে তুষের আগুন। গবেষণা-গ্রন্থ: গাইবান্ধার গাঁওগেরামের সাহিত্য। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ