bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

অমর মিত্রের গল্প: কলসপুর যাইনি


অনেকবার দীপিকাকে বলেছি, কলসপুর নিয়ে যাব। বলতে গেলে সেই বিয়ের পর থেকে। আমাদের যাওয়া হযনি। কতবার কলসপুর যাত্রা শুরুর মুখেই ভেস্তে গিয়েছে। আমি কলসপুরের কাছাকাছি থেকে ঘুরে এসেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু যেতে পারিনি কেন যে--তা ঠিক ধরতে পারি না। ভেবেছিলাম একবার একাই ঘুরে আসব। কিন্তু শেষে মনে হয়েছে দীপিকা দুঃখ পাবে। লুকিয়ে না যাওয়াই ভালাে।

অফিসের কাজে আমাকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। কখনও সঙ্গে কোনও সহকর্মী থাকে, আবার কখনও এমন হয়, যেখানে গেলাম সেই সাহেবগঞ্জ ভাগলপুর, ভুবনেশ্বর, বালেশ্বর বা বহরমপুর, মালদা, শিলিগুডির সহকর্মীকে সেখানে পেযে গেলাম। যে অতিথিশালায় উঠি সেখানে পানীয় সামনে রেখে আমি কলসপুরের কথা বলি জড়ানাে গলায়। এত জায়গায় যাওয়া হল, কলসপুরে যাওয়া হয়নি।

আমি কলসপুরে যাইনি শুনে, আমার সহকর্মী হাসে-কী বলছ তুমি? সত্যি যাওনি? কেন ট্যুর নিয়েও তাে কলসপুরে যেতে পার।

আমার জোনের বাইরে, আর আমি একা গেলে দীপিকার আর যাওয়া হবে না।

শুনে সহকর্মী বিস্মিত হ্য়—একবার গেলে হয় নাকি? কলসপুরে বারবার যেতে হয়।

আমি চুপ করে থাকি। কলসপুর যখন আমার জোনের ভিতরেই ছিল, তখন দীপিকাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে ও মাথা নেড়েছিল—তা হয় না। তুমি অফিসের কাজ করে বেড়াবে। আর আমি হােটেলে বন্দি হয়ে থাকব। এভাবে বেড়াতে যায় না।

কথাটা মিথ্যে ছিল না। কোথাও আয়েশ করে হাত-পা ছড়িয়ে তাে অফিসের কাজ করা হয় না! মিটিং-এর পর মিটিং করতে হয়। ইন্সপেকশন হয় ছ'সাত ঘণ্টা ধরে। কলসপুরে গেলে অফিসের কাজে জড়িয়ে যেতে হবে—এই ভয়ে আমি আমার জোন থেকে বাদ দিয়ে দিলাম জায়গাটাকে। যখন যাব ভ্রমণকারীর মতাে যেতে পারব। সহকর্মী প্রীতিময় বলল, সে নিজেই কলসপুরে অনেকবার গিয়েছে।

অনেকবার যাওয়ার মতাে জায়গা? 

নিশ্চয়ই! যে যায়নি সে বুঝবে কী করে? 

তুমি কলসপুরের সেই চন্দনা নদী দেখেছ? আমি জিগ্যেস করলাম। 

তুমি কী করে জানলে নদীটির নাম চন্দনা? প্রীতিময় অবাক। 

শুনেছি, খুব খরস্রোতা সেই নদী।

প্রীতিময় বলল, পাহাড়ি নদী ত!

আমি বললাম, পাহাড়ি নদী আমি অনেক দেখেছি। 

তা দেখতে পার, কিন্তু কলসপুরের নদী আলাদা, কলসপুরই আলাদা।

অরণ্যের ভিতর শহরটা তাে? 

বাহ, তুমি দেখছি সব জানাে। যাও ঘুরে এসাে। 

যাব তাে নিশ্চয়ই, বলছি শালবনের ভিতরে ভিতরে বাড়ি-ঘর তাই না?

প্রীতিময় বলল, বড় পাহাড়ের গায়ে গেস্ট হাউস।

আচ্ছা ওই নদী, মানে চন্দনা, জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে নাকি আচমকা হারিয়ে গিয়েছে? তাকে নাকি আর খুঁজে পাওয়া যায় না?

প্রীতিময় বলল, তুমি নিশ্চয়ই কলসপুর গিয়েছ, না গেলে এত জানলে কী করে?

আমার মাথা ভারী হয়ে যাচ্ছিল। চোখ টানছিল। প্রীতিমযের কথা শুনে আমার মনে হল সত্যিই হয়তাে কলসপুরে গিয়েছি কোনও এক সময়। অনেক বছর আগে। হয়তাে আগের জন্মে! ভাবতে বেশ ভালাে লাগছিল।

প্রীতিময় বলল, যারা কলসপুরে গিয়েছে অনেকবার, তারাও এত জানে না। 

আমি বিড়বিড় করে বললাম, নদীটা খুব নিঃসঙ্গ।

বলতে পারাে তা। নদী যেমন খরস্রোতা, তেমনই তার নানান বাঁক, ঘন জঙ্গলের ভিতরে বাঁক নিয়ে একেবারে মিলিয়ে গিয়েছে, কে একজন নদীর পাড় ধরে যেতে চেয়েছিল নদীর সঙ্গে। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় জঙ্গলের ভিতরে।

আমি বললাম, চলাে প্রীতিময় দুজনে ঘুরে আসি।

প্রীতিময় বলল, নেশা হয়ে গেলে তুমি কলসপুর যাওয়ার কথা বলাে, যাও সত্যি সত্যি ঘুরে এসাে, এটা হাই-টাইম।

হাই-টাইম কেন?

এইসময় কলসপুরের জঙ্গলে পাতা ঝরে, পাহাড়ে পাহাড়ে সাতশাে রকম ফুল ফোটে। বাতাসে সবসময় ফুলের গন্ধ ভেসে থাকে। এই সময় অনেকে যায়।

আমি ভাবছিলাম, যাব যাব করতে করতে, কলসপুর নিয়ে নানা কথা বলতে বলতে, শুনতে শুনতে এই বসন্তও কেটে যাবে। কলসপুর আমার যাওয়া হবে না। তবু প্রীতিময়কে জিগ্যেস করলাম, তুমি বসন্তে গিয়েছ?

মাথা নাড়ল প্রীতিময়। সে গিযেছে বর্ষায়। বর্ষায় পাহাড়গুলাে মাথায় ঘন মেঘ কুণ্ডলী পাকিযে থাকে। জঙ্গল দূর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। জঙ্গলের ভিতর গড়ে ওঠা কলসপুর শহরটিও ছেয়ে যায় বুনো গাছগাছালিতে। শাল গাছের গা দিয়ে সোঁদা গন্ধ বেরোয়। শুনতে শুনতে আমি বললাম, তুমি বর্ষায় বা যাও কেন?

প্রীতিময় বলল, ওইসময় আমার ওয়াইফ একটু ফ্রি হয়, ওর কোনও ছুটি নেই বলতে গেলে, রেনি সিজনে একটু ফুরসত পায়।

আমি বললাম, তা হলে আর কলসপুরের কী দেখলে, বসন্তেই যদি দেখতে না পেলে সাতশাে রকমের ফুল, জঙ্গলে পাতা ঝরা! তবে গিয়ে কী লাভ?

প্রীতিময় গম্ভীর হয়ে বসে থাকল। আমি ওকে কলসপুরের কথা শােনাতে লাগলাম।


দুই

সহকর্মী শুভময়ের বাড়ি গেলাম শিলিগুড়ি ট্যুরে গিয়ে। হাই রােডের ধারে কী চমৎকার বাড়ি করেছে শুভময়। ওর একটি ছেলে, দিল্লিতে নামি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। তিনবার আমেরিকা ঘুরে এসেছে, নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখে এসেছে। শুভময়রা স্বামী-স্ত্রী এর ভিতরেই জীবনের অনেক কর্তব্য সমাপন করে ফেলে ঝাড়া হাত-পা। ওর স্ত্রী স্কুল টিচার। শুভময় ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে অনেক টাকা পেয়েছে অফিস থেকে। সব সুদে খাটাচ্ছে। সুদের টাকাতেই কত আনন্দ শুভময়ের। ওর স্ত্রীর হাতে বানানাে আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইনে চুমুক দিয়ে শুভময় বলল, তিরিশ লাখ ইনট্যাক্ট আছে ব্যাংকে, শুধু সুদটা তুলি, কলসি ফুরােচ্ছে না, অথচ জল পাচ্ছি বিধান। আমি জিগ্যেস করলাম, কলসপুর গিয়েছ তুমি?

শুভময় বলল, অনেকবার, কতবার—তা হিসেবে নেই। 

অনেকবার যাওয়ার মতাে জায়গা?

শুভময় ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ বিধান, তবে আমার ভালাে লাগে কলসপুর যাওয়ার রাস্তা, চড়াই-উতরাই, জঙ্গল প্রান্তর, কখনও নদীর ধার দিয়ে, কখনও গ্রামের ভিতর দিয়ে, কখনও জঙ্গলে আদিবাসী গ্রামের পাশ দিযে..

শুভময় সুর করে বলে যাচ্ছিল। তার সঙ্গে আমিও গলা মেলালাম, কখনও শপিং মলের পাশ দিয়ে, কখনও মস্ত ইস্পাত কারখানা ফেলে রেখে, কখনও সুইমিংপুলের নীল হাওয়ায় জেগে জেগে ঘুমোতে ঘুমোতে।

শুভময় বলল, এই তাে তুমি গিযেছ, ঠিক গিয়েছ।

কী চমৎকার ফুরফুরে ভাব এসেছে মনের ভিতরে। আমি বললাম, কতবার গিয়েছি, মনে মনে গিয়েছি শুভময়। মনে মনে যাওয়াও তাে যাওয়া!

শুভময় বলল, একতরফা ভালবাসার মতাে, মনে মনে উত্তমকুমারকে কতজন ভালবাসত, কিন্তু জীবনে উত্তমকুমারকে সশরীরে দেখেনি। কিন্তু তােমার তা নয়। কলসপুরে আগে শপিং মল ছিল না, এখন হয়েছে, ট্যুরিস্টরা কেনাকাটা করছে খুব, শপিং করার জন্যই কতজন যাচ্ছে কলসপুর, শপিং করে ফিরে আসছে।

আমি তখন ওকে নদীর কথা বললাম। শুনতে শুনতে শুভময় বলল, এই সময় জঙ্গলের ভিতরে অনেকটা ঢুকে যাওয়া যাবে। পাতা ঝরছে ত! নদীটা ভালাে করে দেখতে পাবে।

আমি বললাম, জানি, হলুদ শুকনাে পাতায় ছেয়ে থাকে মাটি।

হাসল শুভময়, ভালই তাে জান সব, কতবার গিয়েছ? 

আমি বললাম, সহস্রবার, এই সময়ে একটা পাখি, তার গাযে সাতটি রং...।

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শুভময় বলে, জানি, ওই পাখির নাম কুবাই।

পাখিটাকে দেখা যায় শুধু এই সময়, তাই তাে? 

শুভময় বলল, সে দেখেনি, শুনেছে পাখিটার কথা, কলসপুরে গিয়ে তাস খেলতে তার খুব ভালাে লাগে, সে আর তার বউ মল্লিকা, একবার সমস্ত দিন ধরে টোয়েন্টিনাইন খেলছিল, আরও দুজন ট্যুরিস্টকে ডেকে নিয়ে।

ফুরফুরে মেজাজে আমি বললাম, আমি গেলে ব্রিজ খেলব।

হা হা করে হাসল শুভময়। বলল, তা হলে বােঝাে, কলসপুরে গিয়ে তাস খেলে কী আনন্দ! জঙ্গল, পাহাড়, নদী, কুবাই পাখি, আদিবাসী বুড়াে-বুড়ি দেখতে হল না, শুধু রঙ মিলিয়ে পয়সা ফ্যালাে, তাসের জুয়ো খ্যালাে, কী আনন্দ বলাে!

হুঁ। আমি টের পাচ্ছিলাম, কলসপুরকে নিয়ে এভাবে কথা বলা ঠিক নয়।

শুভময় বলল, কলসপুরকে তার মনে থাকবে, কলসপুরে গিয়ে একবার পাঁচ হাজার দুশাে বিয়াল্লিশ টাকা জুয়ায় জিতেছিল সে, আমাকে ওখানে গিয়ে জুয়ায় বসতে বলল শুভময়। অনেক জিততে পারব। কলসপুরে গিয়ে নাকি কেউ হারে না।

চুপ করে আছি। মনে পড়ে যাচ্ছে, বার চারেক টিকিট কেটেও আমাদের যাত্রা করা হযনি। একবার মেয়ের জ্বর এল খুব। শেষে কলসপুরের টিকেট বাতিল করতে হল। একবার যাব সব ঠিকঠাক, আচমকা আমাদের কোম্পানির মালিক নিউইয়র্ক থেকে উড়ে এলেন। জরুরি মিটিং, সকলকে থাকতে হবে। আর একবার কী যেন হল। টিকিট বাতিল করে থেকে গেলাম কলকাতায়। দেখেছি কলসপুর যাওয়া ঠিক হযে গেলেই, একটা না একটা বিঘ্ন ঘটে যায়।

আমার কথা শুনে শুভময় বলে, সত্যি যদি তুমি না গিয়ে থাকো বিধান, তবে বলব কলসপুর যাওয়া নিয়ে তােমার মনের ভিতর দ্বিধা আছে। সেই দ্বিধা থেকেই বিঘ্ন ঘটে যায়। একবার আমি আর আমার ছেলে দু'জনেই জ্বর গায়ে ট্রেনে উঠেছিলাম বিধান। ট্রেন থেকে নেমে...ট্রেকারে করে কলসপুর পৌছতে না পৌছতে জ্বর উবে গেল। একেবারে ফিট। কী সুন্দর কেটেছিল!

হতে পারে হয়তাে। কলসপুর নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। শুভময় বলছে, আমার মতাে লােক নাকি দেখা যায় না। কলসপুর যায়নি এমন লােক খুঁজে পাওয়াই ভার। শুভময় আরও বলল, আমি এক অদ্ভুত মানুষ। কলসপুরের অনেক কিছু জানি, অথচ নাকি যাই্ইনি। কে বিশ্বাস করবে আমার কথা? না কি আমি গিয়ে কোনও গােলমাল করে এসেছি কলসপুরে? আমি কি জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, নদীর জলে গা মাজতে থাকা যুবতীদের দেখেছি? তারপর কী হয়েছিল, তা তাে আমিই জানি।

তুমি শেষ কবে গিয়েছিলে ওখানে? আমি জিগ্যেস করলাম। শুভময় জবাব দিল না। গুনগুন করে গান গাইতে লাগল, কলসপুরে যাইয়ো রে মন কলসপুরে যাইয়াে।


তিন

বাড়ি ফিরে দীপিকাকে বললাম, চলাে এবার ঘুরে আসি কলসপুর, ছুটি নিচ্ছি। 

দীপিকা ঘুরে দাঁড়ায়, হঠাৎ কলসপুর? 

যাইনি তাে, সবাই গিয়েছে, শুধু আমরা বাকি। 

দীপিকা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আমরা তাে কত জায়গায় যাইনি!

আমি চুপ করে আছি। দীপিকা যে এভাবে আমাকে নিরাশ করবে, তা আগে ভাবিনি। জানলার ধারে গিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে দীপিকা বলল, যখন বয়স ছিল, তখন যাওয়া হয়নি। এখন গিয়ে কী করব?

দেখব, এখন বসন্ত এসেছে, সাতশাে রকম ফুল ফুটেছে কলসপুরের পাহাড়ের গায়ে। পাতার আড়ালে থাকা কুবাই পাখিকে দেখা যাচ্ছে পাতা ঝরে যাওয়ার কারণে। চলাে ঘুরে আসি, এত শুনেছি এবার চোখে দেখে আসি।

তুমি গৌরীদির কাছে যাও, ওরা ঘুরে এল পরশু, শুনে এসাে কলসপুর কেমন।

দীপিকার মাসতুতাে দিদি গৌরী আর তার হাজব্যান্ড অনুপম—অনেকবার গিযেছে কলসপুর। এখনও যায়। ওদের দুজনের পায়ের তলায় যেন সর্ষে! সমস্ত দেশ ঘুরে বেড়ায়। ওদের মুখে কতবার যে শুনেছি কলসপুরের কথা! ওদের মধুচন্দ্রিমাও নাকি হয়েছিল ওখানে। কী চমৎকার বলত! সেখানে তারার আলােও গাছের পাতা থেকে গড়িয়ে মাটিতে এসে ঘুমােয়। আবার যখন মেঘের জন্য তারারা ফোটে না, অন্ধকারের কী আবছা নীলচে রং। কলসপুরে সব যেন কলসভরা হয়ে আছে। 

গৌরীদি কী বলল, আমি জিগ্যেস করলাম। 

ওর কাছেই শুনে নিয়াে।

চললাম গৌরীদির কাছে। দীপিকার দিদি আমারই বয়সি, কিংবা আমার চেয়ে বছরখানেকের ছােট। সওয়া পাঁচফুট মাথায়, ছিপছিপে। সুন্দরী তাে নিশ্চয়। গৌরী যখন গ্রীবা বাঁকিয়ে ধীরে ধীরে কথার জবাব দেয়, ওর কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করে। দীপিকা বলে ওদের আত্মীয়স্বজনের ভিতর গৌরীদির তুল্য সুন্দরী আর নেই। কোনও সিনেমাওয়ালা ওর কাছে সিনেমার অফার নিয়ে এসেছিল, গৌরীদি হেলায় না করে ছিল। খুব অহংকারী। গৌরীর হাজব্যান্ড অনুপম খুব স্বাস্থ্যবান দীর্ঘদেহী পুরুষ। গায়ের রং তামাটে, চোখ দুটি যেন আগুনভরা। মানুষটার ভিতরে লালিত্য কম, পৌরুষ বেশি। সিনেমায়-টিভিতে এমন পুরুষকে দেখা যায় ব্রিফ অথবা ভেস্ট-এর বিজ্ঞাপনে। অনুপমদাকে কখনও কখনও আমার ভয় করে। আমাকে অনেকদিন বাদে দেখে গৌরী খুশি হল। বলল, কে পাঠাল, দীপিকা?

না নিজেই এলাম। 

গৌরী হাসল, মাথা নাড়ল-হতেই পারে না, তােমার এত সাহস নেই।

আমি বললাম, অনুপমদা কোথায়? 

ফিরবে, আমি ওকে বিলাসপুরের গেস্ট হাউসের খোঁজ নিয়ে আসতে বলেছি। 

জিগ্যেস করলাম, এরমধ্যে কলসপুর গিয়েছিলে? 

গৌরী বিষন্ন গলায় বলল, হ্যাঁ, আর আমি লক্ষ করেছি, প্রতিবার যখন কলসপুর থেকে ফিরি, তুমি আসাে বিধান, প্রতিবার কলসপুরের কথা শােনাে, কেন বলাে দেখি?

কলসপুর যাব তাই। 

কতবার শুনেছ, একবারও তাে যাওনি! 

তাই বলে যাব না, এমন তাে নয়! কলসপুর কেমন আছে বলাে।

গৌরী চুপ করে থাকল। ওর অত সুন্দর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বলল, “আমি বেশ কয়েকবার ফিল করছিলাম, কিছু একটার অভাব হয়ে যাচ্ছে ওখানে, ছমাস আগে, এক বছর আগে, দেড় বছর আগে...।"

আমি চুপ করে গৌরীর কথা শুনছি। মাথার ওপর বনবন করে পাখা ঘুরছে। কলকাতায় আচমকা গরম পড়ে গিয়েছে। গৌরী বলল, এতদিন যখন যাওনি, এখন না গেলেই হয়।

কেন কী হল কলসপুরে? 

গৌরী বলল, শুনতে তােমার ভালাে লাগবে না বিধান।

কেন, সেই চন্দনা নদী, নদী আছে? 

গৌরী বলল, নদী যাবে কোথায়? তার যাওয়ার রাস্তা তাে ওইটা..আছে তবে ওর জলে কোনও মাছ বেঁচে থাকে না।

শুনিনি তাে আগে? 

ওর জলে স্নানও হয় না।

আমি বললাম, আগে তাে বলনি?

আগে খেয়াল করিনি বিধান, জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে অ্যাসিড কারখানার বিষে, দূর থেকে দেখতে নদীটা তেমনই আছে, কিন্তু যদি সামনে যাও, টের পাবে।

সাতশাে রকম ফুল ফুটেছে তাে।

গৌরী বলল, পাহাড়ের গায়ে তাে ফোটে, পাহাড় ভাঙছে ডিনামাইটে, স্টোন ক্রাশার বসে গিয়েছে, ধুলাে উড়ছে সবসময়, ফুল ঝরে যাচ্ছে অকালে।

আগে খেয়াল করােনি?

না বিধান, ভেবেছিলাম কলসপুর দ্রুত বড় হয়ে উঠবে, এসব তত উন্নতির লক্ষণ। থমথমে হয়ে যাচ্ছিল ঘর। পাখাও যেন থেমে যেতে চাইছিল। গৌরী বলছে, কলসপুরের পূর্ণ কলস অপূর্ণ হতে শুরু করেছে বিধান, খালি হয়ে যাচ্ছে যে, তা কেউ টের পাচ্ছে না।

কী করলে এবার গিযে? 

কিছুই করিনি, গেস্ট হাউসে বসেছিলাম। 

তাস খেলেছ? 

গৌরী গম্ভীর, ঘাড় উঁচু করে বলল, না বিধান, আমি তাস চিনি না।

জঙ্গলে পাতা ঝরছে তাে?

ঝরছে, আর সেই পাতায় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে অ্যাসিড কোম্পানির লােক। 

কেন গৌরী তাদের কী লাভ? 

খেলা বিধান, ওই আগুনে কতগুলাে শাল-মহুয়া পুড়ে গেল, কুবাই পাখি পালিয়ে গেল, কত জীবজন্তু মারা গেল, শজারু, বাঘরােল, বনবিড়াল, খটাস, সাপ, ব্যাঙ, আদিবাসীদের ঘর পুড়ে গেল কতগুলাে—সব খেলার ছলে হল।

থমথমে হয়ে গিয়েছি। খেলার ছলে!

গৌরী একটু থেমে আবার বলল, এই খেলার পিছনে কী আছে জানি না, কিন্তু মানুষ পালাচ্ছে নদীর সঙ্গে, জন্তু জানােয়ার পালাচ্ছে মানুষের আগে আগে, মানুষ কোলেকাঁখে বাচ্চা নিয়ে মাথায় বাক্সপেটরা নিয়ে পালাচ্ছে বিধান, ভয়ে পালাচ্ছে যুবতীরা, কতজন যে নিরুদ্দেশ হযেছে!

তুমি এসব দেখেছ?

শুনেছি। 

যেমন আমি শুনেছি কলসপুরের রূপের কথা?

বিষন্ন গৌরী বলল, হ্যাঁ বিধান, বলতে পারাে সেইরকম। 

তুমি তাে দেখতে পারতে নিজের চোখে, ছিলে তাে কলসপুরে। 

গৌরী বলল, যাব যাব করে যাওয়া হয়নি, জঙ্গল যে পুড়ে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে, মানুষ যে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে নদীর সঙ্গে, পাহাড় যে ভাঙছে, হারিয়ে গিয়েছে যে যুবতী মেয়েরা, ফুল যে ধূলােয় রং হারিযে ঝরে পড়ছে—একথা তাে শুনেছি বিধান।

যেমন আমি শুনেছিলাম কলসপুরের নদী, পাখি, ফুল, পাহাড়, জঙ্গলের রূপের কথা। দেখা হয়নি, কিন্তু শুনেছি কতবার! .

হ্যাঁ বিধান হ্যাঁ, কতজন যে এসে বলল, আদিবাসী বুড়াে, বুড়ি, কলসপুরের পুরনাে মানুষ, কলসপুরে বেড়াতে যাওয়া মানুষ—শুনতে শুনতে সব দেখতে পাচ্ছিলাম বিধান, অবিকল, কী হয়েছে সব হুবহু বলে দিতে পারি!

আমার মতাে আমার মতাে! আমি কাঁপতে লাগলাম গৌরীর কথা শুনে। অ্যাসিড কোম্পানি জায়গা দখল করতে এবার পােড়া গাছ কাটবে, তারপর না-পােড়া গাছ কাটবে, জঙ্গল ফাঁকা করবে, করাতকল বসছে কলসপুরে, টিম্বার মার্চেন্টও হাজির।

গৌরী বিনবিন করে সব বলে যাচ্ছিল। আমি ভেঙে পড়ছিলাম। চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলাম ডিনামাইটে ফাটা পাহাড়ের মতাে। ক্রাশারে গুঁড়াে হয়ে ধূলাের মতাে ঝরে পড়ছিলাম আমি, আমার সাধের কলসপুরকে নিয়ে। গৌরী আমাকে বলতে লাগল। আমি উঠতে যাব আমার হাত ধরে বলল, বােসাে বিধান, শেষ হয়নি বলা।


রাতে দীপিকা জিগ্যেস করল, সব শুনে এলে?

হ্যাঁ।

অনুপমদা ছিল?

না।

দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল দীপিকার, বিড়বিড় করল, ওরা তাে শুনে এসেছে, দেখেনি, চলাে আমরা কলসপুরের সর্বনাশ ছুঁয়ে আসি—তা যদি সত্য হয়। 

(২০১০)


লেখক পরিচিতি

অমর মিত্র বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক। পূর্বপুরুষগণের নিবাস বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ধূলিহর গ্রামে। বর্তমানে তিনি কলকাতায় বসবাস করেন। ১৯৭৪ সালে ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্প নিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রথম প্রকাশ। সুদীর্ঘ তাঁর লেখকজীবন। অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর গল্প সাহিত্যে। গ্রাম ও শহর, জমি মাটি আর নিরুপায়, নিরালম্ব মানুষ সর্বাগ্রে তাঁর লেখার বিষয় হয়ে উঠে আসে। লেখার পটভূমি হয়ে আসে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে বর্তমান অবধি এ অঞ্চলের নানা কোণ, গ্রাম ও নগর। মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস তাঁর সৃষ্টিতে ছায়া ফেলে ক্রমাগত। ‘স্বদেশযাত্রা (১৯৯৭)’ গল্পের জন্য ১৯৯৮ সালে সর্বভারতীয় কথা পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০১ সালে ‘অশ্বচরিত’ উপন্যাস বঙ্কিম পুরস্কার এবং ২০০৬ সালে ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ (১৯৭৮)’ এবং প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ (১৯৭৮)’।
তাঁর গল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে মঞ্চপ্রিয় কয়েকটি নাটক: পিঙ্কি বুলি (গল্প:বালিকা মঞ্জরী); দামিনী হে (গল্প: আকাল ও অন্য কয়েকটি তারই গল্প); পাসিং শো (নভেলা:পাসিং শো); পুনরুত্থান (উপন্যাস: পুনরুত্থান); ধ্রুবপুত্র (উপন্যাস: ধ্রুবপুত্র); এবং অশ্বচরিত (উপন্যাস: অশ্বচরিত)। উল্লেখযোগ্য ভ্রমণকাহিনি ‘সূর্যাস্তের পথে সূর্যাস্তের দেশে (২০১৯)। 
এছাড়া উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান ও অন্যান্য কাহিনি, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, আগুনের গাড়ি, কৃষ্ণগহ্বর, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, নয় পাহাড়ের উপাখ্যান, সারিঘর, শূন্যের ঘর শূন্যের বাড়ি, সোনাই ছিলো নদীর নাম, বহ্নিলতা, কুমারী মেঘের দেশ চাই, কন্যাডিহি, ধনপতির চর, নিসর্গের শোকগাথা, ভুবনডাঙা, হারানো দেশ হারানো মানুষ, একটি গ্রাম একটি নদী, দশমী দিবসে ও মোমেনশাহী উপাখ্যান।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ