bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

হাসান আজিজুল হক স্মরণে: উজানের যোদ্ধা



নূরুননবী শান্ত

১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিয়েই আবৃত্তি সংগঠন স্বননে সম্পৃক্ত হলাম। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে এই সংগঠনের গোড়াপত্তনের অন্যতম কুশীলব ছিলেন হাসান আজিজুল হক। স্বনন নামটি তাঁরই দেওয়া। 

স্বনন সূত্রেই হাসান স্যারের সান্নিধ্যলাভ। মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের ১৩৭ নম্বর কক্ষটি ছিল হাসান স্যারের বসার ঘর। স্বননের প্রধান পুরুষ নাজিম মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেবার পর আমরা স্বননের বসার জায়গা হারিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয় তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতায় সন্ত্রস্ত। স্বননের কার্যক্রমসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর বিবিধ নিষেধ আসছিল প্রশাসনের তরফ থেকে। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গেলো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। সন্ধ্যার আগেই মেয়েদের হলে ফেরা বাধ্যতামূলক করা হলো। আড্ডা ও গানের আওয়াজ করলেই প্রক্টরের বাহিনী এমনকি প্রক্টর নিজেও ধমক ও হুমকি দেওয়ার দায়িত্ব পালন করা শুরু করলেন। স্বনন বসার জায়গা পাবার আশাই আর রইল না। এমনকি আমাদের প্রিয় শিক্ষকগণ কবিতা পড়ার জন্য একটু জায়গা আমাদের দিতে পারছিলেন না ভয়ে। সেই ভীত-সন্ত্রস্ত ক্যাম্পাসে হাসান স্যার তাঁর মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের নিজ কক্ষের একটি চাবি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “যতদিন আমি আছি, আমার ঘরে বসবে তোমরা, আমি কাউকে ভয় পাই না”। কেবল স্বনন নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি থিয়েটার গ্রুপ থেকে শুরু করে সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভিভাবক ছিলেন তিনি। সে সময়কার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভয়াবহ হুমকিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরম প্রেরণা হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের। 

তাঁর বন্ধুরা অনেক সময়ই তাঁর প্রতি হতাশা ব্যক্ত করেছেন দেখেছি। তাঁরা মনে করতেন, হাসান এসব করতে গিয়ে লেখালেখির পেছনে কম সময় দিচ্ছেন! হ্যা, কথা ঠিক। তবে তাঁর পরম বন্ধু নাজিম মাহমুদকে বলতে শুনেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সে দায়িত্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সরে গেছে। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মানবিক, সাংস্কৃতিক ও মুক্তচিন্তা বিস্তারের বিকল্প প্রতিষ্ঠান করে তুলতে হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, শহিদুল ইসলাম, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, আলী আনোয়ার, জুলফিকার মতিন, জাহেদুল হক টুকু, সনৎ কুমার সাহা, মলয় ভৌমিক, মোহাম্মদ নাসের প্রমুখ শিক্ষকদের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। সত্যি বলতে কি, হাসান আজিজুল হক ছিলেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর পথ প্রদর্শক। নতুন প্রজন্মকে ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার পথ দেখাতে যত রকম বিকল্প খুঁজে পেয়েছেন, সব পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন হাসান আজিজুল হক ও তাঁর সতীর্থগণ। 

তাঁর ডাকনাম ‘কালো’। ওদিকে নাজিম মাহমুদের ডাকনাম ‘আলো’। খুলনা জীবন থেকেই দু’জন প্রাণের বন্ধু। তবে পরস্পরকে ‘আপনি’ বলতেন। নাজিম মাহমুদই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খান সারোয়ার মুরশিদকে অনুরোধ করেন হাসানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে। ততদিনে হাসান সমকালে তাঁর শকুন গল্পের জন্য বিদ্বৎমহলে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তাছাড়া খান সারোয়ার মুরশিদ জানতেন তরুণ হাসানের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে। কেননা, খুলনায় হাসান আজিজুল হক, কবি আবুবকর সিদ্দিক, খালেদ রশিদ গুরু, সাধন সরকারসহ এক ঝাঁক যুবক সন্দীপন নামক সংগঠনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণআন্দোলনের আগে থেকেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সেখানে নাজিম মাহমুদ ও আবুবকর সিদ্দিক আগুণঝরা গান লিখছেন তখন, আর সাধন সরকার সুর করছেন। হাসান আজিজুল হক, খালেদ রশিদ গুরু বলিষ্ঠ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করছেন, আর গল্প লিখছেন হাসান আজিজুল হক, কুখ্যাত আইয়ুবের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কিন্তু অবদমিত হননি  -- এসবই জানতেন খান সারোয়ার মুরশিদ। এরকম মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা মানে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আপনা থেকেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়া। হাসানকে খুলনার ফুলতলা কলেজ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে খান সারোয়ার মুরশিদ তাই আর দেরি করেননি। 

শিক্ষক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তার কথা সর্বজনবিদিত। নিজ বিভাগের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের সবার শিক্ষক ছিলেন তিনি। শিক্ষকদেরও শিক্ষক ছিলেন। অন্যদিকে, একজন টগবগে আপাদমস্তক সৃষ্টিশীল ব্যক্তি হিসেবে কেবল ঘরে বসে সাহিত্য করে সন্তুষ্ট থাকেন নি হাসান স্যার। তিনি সত্যিকারের পরিবর্তন চেয়েছেন। কুপমণ্ডুকতার অবসান ঘটিয়ে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। পশ্চিম বাংলার জন্মভিটা ছেড়ে আসার দুঃখ বুকে পুষে রেখেও বৈষম্যহীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কর্মসাধনা করে গেছেন সদাপ্রফুল্ল চিত্তে। ভালো-মন্দ সকল রকম উৎস থেকেই রস আহরণ ও বিতরণ করতে জানতেন তিনি।

একদিন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান স্যার। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার দু’জন স্থানীয় ব্যক্তির ঝগড়া শ্রবণ করছেন ও তাদের দেখছেন মন দিয়ে। ঝগড়া করতে করতে ব্যক্তিদ্বয় এমন সব গালি দিচ্ছিলেন পরস্পরকে যে স্যারের সামনে ঐ বয়সে স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত হচ্ছিলাম। স্যার বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, “দেখ, মানুষ রেগে গেলে কেমন অঙ্গভঙ্গি করে। গালিগুলো শুনছ তো, আহা, শব্দ তো নয় যেন মুখ থেকে মধু ঝরছে। সবকিছু থেকেই শেখার আছে, বুঝলে!” বলেই তাঁর আইকনিক হাসি ছড়িয়ে দিলেন কাজলা গেটের ওপারে। হাসির সময় এক প্রকার চাপা চিকন ধ্বনি প্রলম্বিত হতো স্যারের স্বরে। স্যারের সাথে এক মিনিট বাক্য বিনিময় করলেও, তা সে যত সিরিয়াস বিষয়েই হোক, তিনি ওইটুকু সময়ের মধ্যে হাসিয়েই ছাড়বেন। অথচ, সাহিত্যে তিনি একেবারেই উল্টো। হাসি আসার সম্ভাবনা নেই একেবারে কোনো পাঠকেরই। তাই বলে পাঠককে কাঁদানোর মতো আবেগও তাঁর রচনায় বিরল। কেউ কষ্ট পেলে পেতেও পারেন মা মেয়ের সংসার এর মতো অনেক গল্পেই। স্যারের একাত্তুর করতলে ছিন্নমাথা আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়ার পর একবার আমার ক্লাস টেনের এক ছাত্রী বইটা ফেরত দেবার সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কান্নার কারণ জানতে চাইলে বললো, এত সুন্দর ভাষায় এমন ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা পড়েই নাকি তার চোখে পানি এসে গেছে! এই তো হাসান আজিজুল হক।

আমরা অনেকেই জানি না, অনেক বড় মাপের অভিনয় শিল্পী ছিলেন তিনি। নাটক করেছেন মনোজ মিত্রের, রবীন্দ্রনাথের, নাজিম মাহমুদের। কেবল অভিনয় করেছেন তা নয়, নির্দেশনাও দিয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন সাবলীল। আবৃত্তি ও উচ্চারণের কুশলী প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নাজিম মাহমুদের চেতনার সৈকতে অ্যালবামের ভূমিকা বক্তব্য প্রদান করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন পরম উৎকর্ষের ছাপ। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে শিখিয়েছেন কীভাবে শব্দ ও বাক্যের অর্থ সাবলীল অকৃত্রিম উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়।  

হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা যারা একবার হলেও শুনেছেন, তারা জানেন যে তাঁর কথায় কখনও পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ছিল না। অথচ বিশ্বসাহিত্য ও দর্শনের গভীরতর অধ্যয়নে তাঁর মগ্নতা ও বিশ্লেষণ পণ্ডিত মহলের ভালোভাবেই জানা। আমরা মূর্খরাও সবাই তাঁর প্রতিটি শব্দ বুঝতাম। হিউমার ধরতে পারতাম। সেগুলো এমনই সরস যে আমরা হাসিতে ফেটে পড়তাম। আবার রাগে জ্বলে উঠতাম। তবে তাঁর বক্তব্যের কোথাও কোনো সস্তা আবেগ ছিল না। আবেগাপ্লুত গদগদ প্রকাশ ছিল না। হাস্যকৌতুকের উপমায় মৌলবাদী গোষ্ঠির পিঠের উপর শক্ত চাবুক চালাতেন, মুখের উপর সমালোচনা করতে পারতেন যে কারো অসঙ্গত কার্যের। অকুতোয় যোদ্ধার মতো। যোদ্ধাই ছিলেন তিনি। কেবল তাঁর কথা শোনার জন্য নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস বাদ দিয়ে দর্শনের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের সময়ের অনেকেই করতো কাজটা।

একবার অধ্যাপক আব্দুল খালেক যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খালেক স্যারকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। হাসান আজিজুল হক সে অনুষ্ঠানে বললেন, ‘সবাই স্বপ্ন দেখছেন যে প্রফেসর আব্দুল খালেক উপাচার্য হয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুনন রাতারাতি পালটে যাবে। আমি তেমন সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো দেখলেও ততোটা আশা করতে পারছি না। যে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা মাপা শুরু হয়েছে, সেটা দিয়েই ওঁকেও (আব্দুল খালেক) মাপামাপি করতে হবে। দাঁড়িপাল্লায় ত্রুটি থাকলে যত সৎ ব্যবসায়ীই হোন, জিনিশ ঠিকঠাক মাপতে পারবেন না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন’। খালেক স্যার ও হাসান স্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু ঘনিষ্ঠজনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই যখন তেলতেলে বক্তব্য দিয়ে হাততালি নিচ্ছিলেন, হাসান আজিজুল হক তখন বেশ কঠোর বার্তাই দিয়েছিলেন সেদিনের নতুন উপাচার্যের বরাবর। তাঁর এসব প্রতিবাদী ও পথনির্দেশনামূলক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছুটে যেতেন দেশের যেকোনো জেলা শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে, আদিবাসী পল্লীতে, সর্বত্র রয়েছে হাসান স্যারের উদ্দীপনাময় পদচিহ্ন। 

কথাসাহিত্যিক হিসেবে হাসান আজিজুল হকের উচ্চতাই শেষ কথা নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হাসান স্যারের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলার কয়েক প্রজন্মের মানস গঠনে। মাঝে মাঝে অবাক লাগতো, এই যে এতসব কাজে জড়িয়ে থাকতেন, হৈ-হুল্লোড়-আড্ডায় মেতে থাকতেন, তাহলে লিখতেন কখন, পড়তেনইবা কখন! তাঁর পড়ার বহর সামান্য নয় তো। আমাদের মতো ক্ষুদ্র লেখকদের বইয়ের কোনো বাক্য আচমকা বলে দিতেন পৃষ্ঠা নম্বরসহ। আর লেখা? দুর্দান্ত সব নবরসে সমৃদ্ধ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও তাঁকে লিখতে হতো কতো যে স্মরণিকার রচনা, লিফলেট, স্মারক বক্তৃতা, শুভেচ্ছা বার্তা, নতুন লেখকদের বইয়ের ভূমিকা তার হিসেব নেই। এরকম কর্মপ্রাণ আড্ডাবাজ দিলখোলা মানুষ এদেশে আর কি দ্বিতীয়টি ছিলেন? যিনি রাজধানীর মোহে আকৃষ্ট হননি, অথচ প্রান্তে টেনে নিয়ে গেছেন বৃহত্তর বাংলাকে!  বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে যিনিই গিয়েছেন তাঁকেই তিনি উজাড় করে সময় দিয়েছেন ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন। 

বাংলাদেশের প্রথম থিয়েটার ওয়ার্কশপটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় বলেই জানি। সে ওয়ার্কশপের অন্যতম পুরোহিত ছিলেন হাসান স্যার। যতদূর জানা যায়, গুণি নাট্যজন মলয় ভৌমিক এবং অনুশীলন নাট্যদল সেই থিয়েটার ওয়ার্কশপেরই ফসল। নতুন লেখকদের জন্য নতুন জায়গা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন আন্তরিকভাবে। তাঁর সম্পাদনায় সাহিত্য পত্রিকা প্রাকৃত  প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। প্রাকৃত মারফত পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইনের। অতি তরুণ অনুবাদক আনন্দময়ী মজুমদারের। যদিও দু-তিনটি সংখ্যার পর প্রাকৃত আর চালিয়ে নিতে পারেননি হাসান আজিজুল হক।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেবার পর স্যার নিজের বাড়ি তৈরি করলেন শহর থেকে বেশ দূরে, বিহাস আবাসিক এলাকায়। বাড়ির নাম দিলেন উজান। খুবই প্রতিকী নাম। নিজেও তো উজানেই চলেছেন একরোখা ভঙ্গিতে। জানতে পেরে কলকাতার বন্ধুরা (সুশীল সাহার উদ্যোগে) উজান নামে একটি সুভেনির ছাপিয়ে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কে সেখানে লেখেননি! শঙ্খ ঘোষ, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী কে নন! শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা মহাশ্বেতা দেবী (আজ আর স্পষ্ট মনে করতে পারছি না) লিখেছিলেন যে ‘হাসানের বাড়ি হলো মানে আমাদেরই বাড়ি হলো। বাংলাদেশে আমাদের সবার আশ্রয় হলো’! এমনই সুবিশাল ছিল হাসানের ভালোবাসার পরিসর।

হাসান স্যার নিজের জন্মদিন পালন করতেন না। আমরা একবার জানতে পারলাম (সম্ভবত ১৯৯৪) যে হাসান স্যারের জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি। স্বনন আয়োজন করলো তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেই প্রথম হাসান স্যারকে দেখলাম স্যুট-টাই পরেছেন। জন্মদিনের বক্তৃতায় নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না। তিনি জানালেন যে সেটাই ছিল প্রথমবারের মতো তাঁর আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন। তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারে জন্মদিন মনে রাখার সংস্কৃতি ছিল না। তাঁর জন্মদিন ২ ফেব্রুয়ারি কিনা তাও তিনি নিশ্চিত নন। তবে যেহেতু লিখতে হয়, তাই এই তারিখটাকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। আরও বললেন, ‘ডাকনাম ‘কালো’ হলেও গাঁয়ে আমাকে ‘কেলো’ বলে ডাকতো’।  

হাসানের লাখো ভক্তের কাছে একটি সংবাদ অবিদিতই ছিল ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আর তা হচ্ছে এই যে তিনি কবিতাও লিখেছেন। ‘ওসব কিছু হয়নি’ বলে কখনো প্রকাশ করেননি। সম্ভবত বড় ভাই কবি মোহাম্মদ কামালের সৌজন্যেই হাসান আজিজুল হকের কবিতার খাতা আমাদের হস্তগত হয়। সরাসরি স্যারের খাতা থেকে আমার ডায়েরিতে একটি কবিতা টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটির কোনো শিরোনাম ছিল না। সেই কবিতাটি উদ্ধৃত করছি:


কী কী বদলে নেওয়া যায় না?

আপন জন্ম আর অন্যের যৌবন


কপালের একেবারে ভিতরের দিকে

খোদাই করা খুদে খুদে অক্ষর

দুই চোখের পাশে চামড়ার উপর 

কাকের পায়ের ছাপ

হয়তো আরও আছে

আঁকাবাঁকা আঙুল, ফাটা পায়ের ভিতরে শুকনো হাড়


ফিরে পাওয়া যায় না

মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন

ফেরা যায় না উৎস-মুখে --

পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়


এরা সবই একমুখে বয়ে যায়

শূণ্য থেকে শূণ্যে।


এই কবিতাকে কি প্রকাশের অযোগ্য বলা সম্ভব! 

ফিরে পাওয়া যায় না / মৃত্যুর পরে কাটিয়ে আসা জীবন / ফেরা যায় না উৎস-মুখে --/পাথরে, লবণে, মাটিতে জলের রেখায়...। ভাবতে হয়। কিন্তু তিনি কবিতা প্রকাশ করার সামান্যতম উৎসাহ বোধ করেননি। 

কলকাতায় তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। নির্মাণ করেছিলেন ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়। হাসানের জন্মজগৎ চিনতে তথ্যচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। বাংলাদেশে তা সংরক্ষণ করা আবশ্যক। পরে বাংলাদেশের সাজ্জাদ বকুল হাসান আজিজুল হককে নিয়ে চমৎকার ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন। রাজশাহীর স্থানীয় কেউ একজন আরও একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন হাসানকে নিয়ে। এগুলো হাসানকে চিনতে সহায়তা করে যথেষ্ট।

হাসান স্যারের সাথে শেষ দেখা করতে গিয়ে কড়া বকা খেয়েছি। সেদিন মনে হয়েছে, তাঁর লেখার সমালোচনা কি উনি নিতে পারতেন না! তা কি করে হয়! সনৎ কুমার সাহা একদিন নাজিম মাহমুদের কার্যালয়ে বসে অনেকের সামনে হাসানের একটি গল্পের সমালোচনা করলেন। হাসান স্যার নতমস্তকে মেনে নিলেন। সেটা ছিল ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের এক দুপুর। আসলে উনি আড়াল থেকে করা কোনো সমালোচনা পছন্দ করতেন না। সেবার (২০১৮) আদিবাসীদের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সুলতানা কামাল আপাসহ রাজশাহী থেকে ফেরার পথে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সুলতানা আপাও রাজি হলেন। উজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি কোনো ভূমিকা ছাড়াই সুলতানা আপাসহ সিঁড়ির নিচে দাঁড় করিয়ে রেখেই আমাকে বললেন, “তুমি তো আমার ছেলের মতো, আমার কোনো সমালোচনা করতে হলে সরাসরি আমাকেই বলতে পারতে। অলক্ষ্যে সমালোচনা করা আর পেছন থেকে ছুরি মারা তো একই কথা”। আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। শিক্ষাও নিয়েছিলাম। আসলে, প্রথম আলোয় স্যারের একটি গল্প ছাপা হয়েছিল তার মাস তিনেক আগে। যেটি গল্পকার হাসানের মানের নয় বলে আমার মনে হয়েছিল। ওনাকে সরাসরি না বলে নাজিম মাহমুদ পুত্র সাংবাদিক মজতুবা হাকিম প্লেটোর ফেসবুক স্ট্যাটাসের মন্তব্য হিসেবে সেই গল্প সম্পর্কে নেতিবাচক কথা আমি লিখেছিলাম। স্যার রাগ করেছিলেন। অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা মনে রাখতে পারতেন স্পষ্টভাবে। উনি নিজে ফেসবুক চালাতেন নাকি অন্য কেউ সে দায়িত্ব পালন করতেন সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। কারণ উনি হাতেই লিখতেন শেষ পর্যন্ত। তাই মনে হয়েছে, যিনি ওনার ফেসবুক আইডি চালাতেন তিনি স্যারকে কথাটা বলে থাকতে পারেন। যাহোক, স্যার নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করেছিলেন। চা আপ্যায়ন করেছিলেন সেদিন। সেটাই স্যারের সাথে শেষ দেখা। সেদিন স্যারের কাছে এই শিক্ষা আমি নিয়েছি-- কাউকে যদি কিছু বলার থাকে, সরাসরি তাকে বলাই সঙ্গত। 

সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রচার করেছে যে, “হাসান আজিজুল হক মারা গেছেন”। খুব কান্না পেয়েছে । সারারাত ঘুমাতে পারিনি। হাসান আজিজুল হক মারা যেতে পারেন না। স্বার্থহীন সৃষ্টিশীল প্রাণ অমর। তিনি আছেন বাঙালির অন্তরে।

-------------------------------


নূরুননবী শান্ত গল্পকার, অনুবাদক ও আবৃত্তিশিল্পী। জন্মস্থান বগুড়া হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে রংপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলায়।  পেশায় উন্নয়নকর্মী। প্রান্তিক মানুষের জীবন আচার সংস্কৃতি সমস্যা নিয়ে দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লেখালেখি করেন। কৈশোরে কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও গল্প লেখা শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়। প্রথম গল্প, ‘সুখলোকে যাত্রা’ শাশ্বতিক পত্রিকায় ছাপা হয়।
প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: গ্রামে প্রচলিত গল্প (২০০৯)।
প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থ: রাস্তা (২০১১); মেঘের ওপারে আকাশ (২০১৪); প্রিয় দুঃস্বপ্ন (২০১৭); মড়ার মাথা (২০২১)
প্রবন্ধ-সংকলন: প্রান্তকথা (২০১৯)।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ