bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

হাসান আজিজুল হক স্মরণে: নামহীন গোত্রহীন


হাসান আজিজুল হক
মাহবুব মোর্শেদ

অসুস্থ হওয়ার আগেও হাসান আজিজুল হক আমাকে নিয়মিত ফোন দিতেন। তার নাম্বার আমার ফোনে হাসান আজিজুল হক নামে সেভ করা। তার ফোনে আমার নাম্বার সেভ করে দিয়েছিলাম মাহবুব সমকাল নাম দিয়ে। তখন আমি সমকালে কাজ করতাম। তাই এভাবে সেভ করে দিয়েছিলাম। হিসাবে আমাকেই ফোন করার কথা। কিন্তু, আসলে অন্য কাউকে ফোন করতে গিয়ে ভুলে আমাকে ফোন করতেন। প্রথম প্রথম আমি ফোন ধরতাম, বলতাম- স্যার, আমি মাহবুব মোর্শেদ। স্যার বলতেন, মাহবুব, কেমন আছো?
কিছু কুশল বিনিময়ের পর বলতাম স্যার, আপনি মনে হয় অন্য কাউকে খুঁজছিলেন। স্যার, হ্যাঁ বলে ফোন রেখে দিতেন। এই ভুলটা প্রায়ই হতো। 
কখনো কখনো আমি ফোন ধরতাম না। পরপর তিনবার কল করতেন তিনি। আমি নামটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনটা খুব খারাপ হতো। তার সঙ্গে ২০১৩ সালের পর থেকেই সম্পর্ক শীতল হয়ে এসেছিল। অবশ্য সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি বা হাসান আজিজুল হক কেউই দায়ী ছিলাম না। ব্যক্তিগতভাবে আমি আগাগোড়া তার প্রতি তীব্র উষ্ণতা ফিল করেছি। সাক্ষাতে সেটা প্রকাশিতও হয়েছে। যদিও শেষ দিকে দেখা সাক্ষাৎও কমে এসেছিল। শেষবার উপন্যাসের কাজে রাজশাহী গিয়ে তার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে এসেছিলাম। এখন বুঝতে পারি, কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি। 
হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সম্ভবত ১৯৯৯ সালের শীতকালে। সেখানকার গ্রাম থিয়েটারের আয়োজনে একটি লোকসংস্কৃতি উৎসব হবে। সেলিম আল দীন বললেন, ক্যাম্পাসে বসে থেকে কিছু হবে না। পুঠিয়া চল। বাংলার সংস্কৃতি আসলে কী সেটা নিজের চোখে দেখে আসবি। হাসান ভাইও আসবে। হাসান আজিজুল হকের কথা শুনে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তার লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে অনেক আগে। গল্প-প্রবন্ধের ভক্ত হয়ে আছি। এক বন্ধুর কাছে তার গল্প শুনে ব্যক্তি হাসান সম্পর্কেও বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আমরা যখন পুঠিয়া পৌঁছালাম তখন গভীর রাত। গিয়েই খেতে বসতে হলো। হাত-পা ধোয়ার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটা মাটির ঘরে। তার টিনের চালে টুপটাপ করে শিশির পড়ছে একটা নোয়ানো গাছ থেকে। ঘরে ঢুকতেই একটা হৈ হৈ রব শুরু হলো। মাটিতে পাতা পাটিতে খেতে বসলাম। হাসান স্যারদের খাওয়া তখন শেষ। তারা দই খাচ্ছেন আর খাবারের প্রশংসা করছেন। খেতে খেতে আড্ডা শুরু হলো। খাওয়ার পরও সেখানে বসেই আড্ডা চলতে থাকলো। বৈঠকী আড্ডায় হাসান স্যার খুব পাকা। জমিয়ে ফেলতে পারেন, নিজে হাসতে পারেন, হাসাতেও পারেন। হাসান স্যারের বিখ্যাত একটা শ্বাসটানের হাসি ছিল। শীত এসে স্যারের শ্বাস-প্রশ্বাসে কিছু সমস্যা দেখা দিত। বুক থেকে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ বের হতো। শুনেছিলাম, ছাত্রজীবনের আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বেদম পিটুনি খেয়েছিলেন। তখন থেকে সমস্যাটা শুরু হয়। সারাজীবন অসুখটা বয়ে বেড়িয়েছেন। শীতে বেশি সমস্যা হতো। ঘটনাটা স্যারকে জিজ্ঞেস করে আর কনফার্ম হতে পারিনি। হাসান স্যার যখন হাসতেন তখন ওই শ্বাসটানটাও তার হাসির সঙ্গে আওয়াজ দিতো। 
প্রথম দেখাতে বড় বড় লোকজন ছিল সাথে। হাসান স্যারের সঙ্গে তেমন আলাপ হতে পারলো না। পরে অবশ্য প্রথম দেখার কথাটা তিনি মনে করতে পেরেছিলেন।
সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখেছিলাম গুরু ও চণ্ডাল নামে। কথাভাষার লেখা সে ভয়াবহ বস্তু প্রকাশ করেছিলে ব্রাত্য রাইসু তার সম্পাদিত আর্টস পাতায়, বিডিনিউজে। পরে স্বকৃত নোমান সম্প্রীতি নামে একটা পত্রিকার জন্য লেখা চাইলে তাকে লেখাটা দিয়েছিলাম। সেখানেই হাসান স্যার লেখাটা পড়ে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খুব ভাল লিখেছো। তোমার স্মৃতির প্রশংসা করতে হয়। তবে যে অধ্যাপক পথের শেষ কোথায় শুনিয়েছিলেন তার নামটা ভুল করেছো। তার নাম হবে সারওয়ার জাহান। পুঠিয়ার প্রথম রাতের আড্ডায় তিনি গান শুনিয়েছিলেন। ওই আড্ডার কিছুদিন পর তিনি মারা যান। আমি ভুলে নামটা লিখেছিলাম, নাজিম মাহমুদ।
হাসান স্যার বলেছিলেন, বইয়েও কি এই ভাষাটা রাখার কথা ভাবছো? 
আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার। 
তিনি বললেন, ভাষাটা স্বতস্ফূর্তভাবে লিখেছো। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বই করার আগে একবার ভেবো।
আমি বই করার সময় স্যারের পরামর্শ অনুসারে ভুলগুলো সংশোধন করলেও ভাষাটা কথ্য রেখে দিয়েছিলাম।ছাত্রজীবনে হাসান স্যারের সঙ্গে আরও অনেকবার দেখা হয়েছে। কথা-আড্ডা হয়েছে। কিন্তু সেসব এক পাক্ষিক। দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের সূত্রপাত হলো, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের অধ্যাপক নিযুক্ত হওয়ার পর। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার ঠিক পরের ঘটনা। ২০০৯ সালের কথা। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করলেও হাসান স্যার মোটাদাগে বামপন্থী লেখক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সরাসরি আওয়ামী লীগের ঘরের লোক হিসেবে তাকে চিহ্নিত করার উপায় ছিল না। নতুন এই দায়িত্ব নিতে একটা দ্বিধার মধ্যে ছিলেন তিনি। কিন্তু, তাকে বঙ্গবন্ধু চেয়ারের দায়িত্ব দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আমি সমকালে ছোট একটা কলাম লিখেছিলাম। নানা বিষয়ে ৪০০ শব্দের ওরকম কলাম আমি নিয়মিত লিখতাম। আমার যুক্তি ছিল, হাসান আজিজুল হকের মতো লেখক ও শিক্ষকরা যদি অবসর নেবার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হতে পারেন তবে সেটা খুব ভাল হয়। এমন ধারা যেন অব্যাহত থাকে। লেখাটা পড়ে হাসান স্যার আমাকে ফোন দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বললেন, তোমরা যে এটাকে ইতিবাচকভাবে নেবে এটা আমি ভাবিনি। এই নিয়োগ বাবদ হাসান স্যারকে ফুলার রোডে একটা বাসা, একটা অফিস দেওয়া হয়েছিল। এখন আমি ভাবি, হাসান স্যারের নিয়োগ নিয়ে আমি কিছুটা ক্রিটিক্যাল থাকলেও পারতাম। বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই তাকে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করার দাবি জানানো যেত। যাই হোক, সেই নিয়োগের ধারাবাহিকতায় আরও নানাভাবে হাসান স্যার সরকারের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তার বাম অবস্থান মোটামুটিভাবে বিসর্জন দিয়েছিলেন। যা আমাদের জন্য বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।অবশ্য ওই লেখার সূত্রে তার সঙ্গে আমার দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঢাকা এলে তিনি আমাকে ফোন দিতেন। রাজশাহী গেলে আমি তার সঙ্গে দেখা করতাম। হাসান স্যারের সঙ্গে আমার এই সম্পর্কের মাঝে আর কেউ ছিল না। বলা চলে, সম্পর্কটা খানিক গোপনই ছিল।
আমি সাধারণত, বড় লেখকদের সঙ্গে মিশেলেও তার প্রভাব ব্যবহার করে কোনো স্বার্থসিদ্ধির চিন্তা করি না। কোনোভাবে বিষয়গুলোকে পুরস্কার, প্রশংসা বা ভূমিকা লেখার পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই না। এতে তার সঙ্গে সম্পর্কটা একান্তই সাহিত্যিক যোগাযোগে থিতু থাকে। কোনো লাভালাভের বিষয় এর মধ্যে আসতে পারে না। আরেকটা সুবিধা হলো স্যারের সঙ্গে অন্য যাদের ঘনিষ্ট ও নিয়মিত সম্পর্ক তারা আমার সঙ্গে স্যারের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তায় থাকেন না। ফলে, বছরে ছয়-সাতবারের যোগাযোগও প্রায় চার বছর ধরে উষ্ণ থাকতে পেরেছিল।
অনেকের মতো আমিও ইন্টারমেডিয়েটে পড়ার সময় আত্মজা ও করবী গাছ দিয়ে হাসান পড়তে শুরু করি। তারপর নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, রাঢ়বঙ্গের গল্প। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক আমি একই সময় পড়তে শুরু করি। প্রত্যেকের গল্প অসম্ভব শক্তিশালী, কিন্তু একেবারে আলাদা রকম। বলতে দ্বিধা নেই, সে সময় সবচেয়ে কঠিন লেগেছিল হাসান আজিজুল হকের গল্প। বারবার পড়তে হয়েছিল। অনেকেই অনেক কথা বলেন কিন্তু আমার বরাবরই মনে হয়, হাসান আজিজুল হকের গল্পের মূল বিষয় আসলে আইডেন্টি ক্রাইসিস, যৌনতা, সম্পর্কের জটিলতা আর অচেনা ভূগোলের বিস্ময়। নিজ দেশে জীবনের ১৫/১৬ বছর কাটিয়ে আরেক দেশে এসে বাকী ষাট/পঁয়ষট্টি বছর পার করলেও দেশ ছেড়ে আসার ট্রমার সমাধান তার আজীবন হয়নি। সমস্যাটা অদ্ভূত। যে দেশ থেকে তাকে চলে আসতে হয়েছে সে দেশটি তার কাছে বরাবরই শ্রেয়তর বাসস্থান। আর যে দেশটি তাকে আশ্রয় দিল সে দেশটি শাসকদের কারণে কখনোই তার জন্য স্বস্তিকর হতে পারছে না। এই সংকট হাসানের জীবনে কোনো সমাধান পেলো না।প্রথম দিকে গল্পের বাইরে হাসানের গদ্যের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। চালচিত্রের খুঁটিনাটি নামে ছোট একটা বই ছিল। কতবার যে পড়েছি বইটা। সক্রেটিস নামে একটা ছোট বই লিখেছিলেন। আর ছিল কথাসাহিত্যের কথকতা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা নিয়ে তার প্রবন্ধ আজও মনে আছে। হাসান স্যারকে আমি মাঝে মাঝে বলতাম, আপনার কোন লেখাটা আমার সবচেয়ে ভাল লাগে জানেন? স্যার বলতেন, তুমি বৃত্তায়নের কথা বলবে তো? ওটা তোমাদের মতো করে লেখা। 
ওইটুকু স্পেসের মধ্যেই তীব্র যৌনরাজনীতি ভয়াবহ উৎসার, মানুষের কী তীব্র ক্রাইসিস। নিম্নবর্গের যেসব কথা হাসান লিখেছেন সেগুলোর কতটাই বা তার দেখা ছিল। আমার মনে হয়, নিম্নবর্গ আসলে তার ক্যানভাসের প্রেক্ষাপট। গল্পগুলো তার জীবনেরই।
শুধু যে কথাসাহিত্যের জন্য তাকে আমার পছন্দ ছিল, তা নয়। ব্যক্তিত্বের একটা আকর্ষণ ছিল। তার অনেক গল্প শুনতাম কাছের লোকদের কাছে। সহজে মেশার একটা ক্ষমতা ছিল তার। সৈয়দ শামসুল হকের বিপরীত ব্যক্তিত্ব। সৈয়দ হক যেমন দেখা হলে ভান, ভণিতা, আড়ম্বড়, নাটকীয়তা মিলে একটা যাত্রাপালা সৃষ্টি করতেন হাসান ঠিক তার বিপরীত। ওহ মাহবুব, এসেছো, বসো। তারপর বলো। অথবা আমি তো ব্যাংকে যাবার জন্য বেরুচ্ছিলাম, তা তুমিও কি আমার সঙ্গে ব্যাংকে যাবে নাকি। চলো তাহলে ওখানে বসেই আড্ডা হোক। একবার রাজশাহীতে গিয়েছি। বাসায় পৌঁছাতেই স্যার বললেন, চলো ব্যাংকে যাই। আড্ডাই তো, ব্যাংকে বসে আড্ডা দিলে কী আর হবে। সরকারি ব্যাংকের লম্বা কাজের মধ্যে সোফায় বসে লম্বা আড্ডা দিলাম। এর মধ্যে শিক্ষক-ছাত্ররা আসছেন। স্যারকে সমীহ করছেন। স্যার বেশ যত্ন সহকারে সেসবের জবাব দিচ্ছেন। হাসান স্যার যে এমন সে কথা ১৯৯৬-৯৭ সালে শুনেছিলাম নূরুননবী শান্তর মুখে। শান্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়তেন। আবৃত্তি সংগঠন করতেন। তাদের সে সংগঠনের নাম স্বনন। স্বননের রিহার্সালের জন্য হাসান স্যার তার দর্শন বিভাগে রুম ছেড়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের বিপদে আপদে বেশ এগিয়ে আসতেন। কারও মধ্যে সাহিত্যের আগ্রহ দেখলে উৎসাহ দিতেন। নূরুননবী শান্ত আমাকে একটা অদ্ভুত জিনিশ দেখিয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে যে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটি বিহাস নামে পরিচিত সেখানে স্যারের একটা প্লট ছিল। সেখানে তিনি বাড়ি তুলেছিলেন ১৯৯৭ সালে। বাড়ির নাম উজান। সাধারণ কিন্তু সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়ি। সে বাড়ির উদ্বোধন উপলক্ষে একটা প্রকাশনা করা হয়েছিল। পত্রিকার মতো সে প্রকাশনাটা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সব লেখক তাতে লিখেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে স্বপ্নময় চক্রবর্তী কে লেখেননি? সবার কথার এক সুর, হাসানের বাড়ি হয়েছে মানে বাংলাদেশে তাদেরও একটা বাড়ি হয়েছে। এরপর থেকে বাংলাদেশে গিয়ে থাকার জায়গা নিয়ে আর কোনো চিন্তা রইলো না। পশ্চিমবঙ্গে লেখক সাহিত্যিকদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক বাংলাদেশের কোনো লেখকের কোনো কালে ছিল বলে মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গে লেখকরা হাসানকে সবসময় বাংলাদেশে হারিয়ে যাওয়া ভাই হিসেবে দেখেছেন। সবসময় স্নেহ ভক্তি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক রেখেছেন।
সেদিন কাকে যেন জিজ্ঞেস করছিলাম, বলেন তো হাসান আজিজুল হকের ক্ষমতার উৎস কী? এদেশে শুধু ভাল লিখে এতটা ক্ষমতাবান হওয়া সম্ভব? তাও আবার ঢাকার বাইরে সুদূর রাজশাহীতে থেকে। একে তো রাজশাহী থাকেন, এই আমলটুকু বাদ দিলে বাকী সময় বামপন্থী থেকেছেন। ঢাকার সাহিত্যিক রাজনীতির সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক নেই। মৌসুমী কিছু ভক্তগোষ্ঠী ছাড়া বিশেষ কোনো দলবল পোষার নজিরও নেই। আমি নিজে মিশে দেখেছি দল পোষার ব্যাপারে তার বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। অনেক ওপর থেকে ব্যাপারগুলোকে দেখেন তিনি। অন্য কেউ এমন হলে ঢাকার সাহিত্য সমাজ তাকে একেবারে ভুলে যেত। ওমর আলীদের মতো ফুটনোটে পাঠিয়ে দিতো। হাসান আজিজুল হকের বেলায় পারলো না কেন? শুধু গল্পের শক্তি? কথাসাহিত্যের ক্ষমতা? 
আমার মনে হয়, কলকাতা। কলকাতা হাতে ছিল বলেই তিনি সুদূর রাজশাহী থেকে ঢাকা শাসন করতে পারতেন।
একবার হাসান স্যারের সঙ্গে কোথা থেকে যেন মিরপুর যাচ্ছি তার মেয়ের বাসা সেখানে। স্যার বললেন, বাসা পর্যন্ত তো যেতেই পারি। কিন্তু জানো তো সিঁড়ি দিয়ে বাকীটা ওঠার সামর্থ্য নেই। তা তুমি যাবে নাকি?
আমি বললাম, আমার বাসাও তো মিরপুরেই। চলেন।
যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এই আনন্দ পুরস্কারের ব্যাপারটা কী?
স্যার বললেন, রমাপদ চৌধুরী বলে এক লেখক আছে চেনো তো। খুব ডাকসাইটে। তো বাংলাদেশের লেখা আনন্দ পুরস্কারের জন্য ওঠালেই তিনি ছ্যা ছ্যা করে ওঠেন। বলেন, আরে বাংলাদেশ। ওখানে কিছু হয় নাকি। ওদের সাহিত্য কিচ্ছু হয় না। এবার নেহায়েত শঙ্খদা রোখ চেপে ছিলেন বলে।
মাঝে মাঝে গল্পচ্ছলে লেখার কিছু টেকনিক জেনে নিতাম তার কাছ থেকে। যেমন একদিন বললাম, বড় লেখা লিখতে গিয়ে কোথায় থামতে হবে? 
হাসান স্যার বললেন, বুঝেছি। তা তুমি হেমিংওয়ে টেকনিকের কথা কিছু শোনোনি বুঝি। 
না তো। 
ওই তো যেখানে গল্প আসতেই থাকবে সেখানে সেদিনের মতো লেখা থামাবে। পরদিন যখন বসবে তখন দেখবে গল্পের আর অভাব হচ্ছে না। 
স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক হেমিংওয়ে টেকনিকের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি সে এক বিরাট কাহিনী। মেলা কিছু আছে। বড় লেখকেদের সঙ্গে মেশার এই এক সুবিধা। কত গোপন বইপত্র, টেকনিকের খবর জানা যায়। তাছাড়া কথাসাহিত্য একটু আলাদা ব্যাপার। শুধু জ্ঞান আর বুদ্ধি দিয়ে গল্প লেখা যায় না। 
একবার হাসান স্যারের উজানে গিয়েছি। পড়ার জায়গা দেখিয়ে তিনি লেখার জায়গায় নিয়ে বসালেন। রাজশাহীর বিখ্যাত গরম। লেখার জায়গায় ফ্যান নেই। স্যারের গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। বললেন, তুমি না থাকলে আমি হয়তো স্যান্ডোটাও পরতাম না। এখানে সকাল সকাল প্রাকৃতিক হাওয়ার মধ্যেই লিখতে বসি। এভাবেই ভাল লাগে। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঘেমে গেলেও অসুবিধা হয় না। নানা লেখার নানা অংশ সেখানে ছড়ানো ছিঁটানো। হাতেই লিখতেন হাসান আজিজুল হক। তার হাতের লেখা ছিল দুর্বোধ্য। একথা মনে করিয়ে দিলে তিনি শিশুর মতো খিলখিল করে হাসতেন।
সেবার বেশ কয়েকদিন রাজশাহীতে ছিলাম। বললাম, এই ফাঁকে একটা ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলি আপনার। হাসান স্যার বললেন, ভাল কথা মনে করেছো। তোমার জন্য কিছু কথা আমি ভেবে রেখেছি। শুনে আমি প্রমাদ গুনলাম। কারণ, স্যার যা ভেবে রেখেছেন তা মোটেও ইন্টারভিউ নয়। সমকালের জন্য লেখা। বিষয়টা শুরু হয়েছিল দুর্ঘটনাক্রমে। মাঝে মাঝে সম্পাদকীয় পাতায় লিখতেন তিনি। ঠিক লেখা নয়, বলতেন। সেটা ট্রান্সক্রিপ্ট করে লেখা কলাম হিসেবে ছাপা হতো। এভাবে যারা লিখতেন তাদের আমি বলতাম বলামিস্ট। কাজটা করতেন রাজশাহী প্রতিনিধি। তাকে বলতে তিনি হাসান স্যারের বাসায় গিয়ে কথা শুনে ট্রান্সক্রিপ্ট করে তাকে দেখিয়ে আমাদের পাঠাতেন। কিন্তু কোনো এক জরুরি বিষয়ে তার লেখা দরকার হলে আমি ফোন দিয়ে বললাম, আমাকেই বলেন। আমি লেখা তৈরি করে নেবো। সেটাই কাল হলো। কলামটা স্যারের এত পছন্দ হলো যে, তিনি পরদিন বললেন, এখন থেকে দরকার পড়লে তুমি লেখা নিও। তো ইন্টারভিউর বদলে স্যারের সে লেখার কথাই মনে হয়েছিল।
পরে একবার হাসান স্যার ঢাকা এলে আমি বললাম, এবার ইন্টারভিউ দিতেই হবে। একটা সময় ও স্থান ঠিক করা হলো। আমি গেলামও ঠিকঠাক। গিয়ে দেখি অনেক লোক। আর হলো না।
এর পরপরই সম্পর্ক খারাপ হলো। আমি যে খানিকটা ভিন্নমতাবলম্বী সেকথা হাসান স্যার জানতেন। কিন্তু, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের বিরোধিতা করে অবস্থান নেওয়ার কারণে কেউ তাকে বলেছিল মাহবুব তো হেফাজত হয়ে গিয়েছে। হাসান স্যার আমাকে তেমন কিছু বলেননি। শুধু একদিন নানা কথার ফাঁকে বলেছিলেন, তুমি কি রাজনৈতিক অবস্থান বদলে ফেলেছো?
আমি বললাম, না তো স্যার। এই পার্থক্যটা তো সবসময়ই ছিল। 
পরে যোগাযোগটা ফিকে হয়ে এসেছিল। 
হাসান স্যারের মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকে একটা লেখার কথা ভাবছিলাম। ফেসবুকে লেখাটা প্রায় লিখেও ফেলেছিলাম। কিন্তু ফেসবুকের স্টেটাস থেকে হাওয়া হয়ে গেল। 
আবার লিখলাম। 
সে লেখার শেষে একটা দৃশ্য ছিল। এ লেখাতেও সেই দৃশ্যটা মনে পড়ছে। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে কী একটা উপলক্ষে হাসান আজিজুল হক এসেছেন। হাতে লাঠি। তৃতীয় তলায় একটা রিহার্সাল রুম ছিল। সেখানে একটা মঞ্চ। তাতে চেয়ার পেতে বসেছেন। হাতে একটা লাঠি। তাতে থুতনি ঠেকিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। এমন মুড এসেছে। নিজে হাসছেন সকলকে হাসতে হাসতে নাকাল করে দিচ্ছেন। ওই দৃশ্যটা কাল থেকে বারবার মনে পড়ছে। উজ্জ্বল সেই হাসি মুখটা মনে পড়ছে। 
হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যের যুগটা শেষ হয়ে গেল। গল্পের মধ্য দিয়ে যারা একটা সংবেদী জগৎ তৈরি করেছিলেন সেই বড় ও প্রভাবশালী পরিসরটা হঠাৎ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। শুধু বুদ্ধি, জ্ঞান, ভিন্নমত আর বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে সেই জগৎটা বোঝা সত্যি কঠিন।

-----------------------------------

মাহবুব মোর্শেদ কথাসাহিত্যিক ও কবি । ২৯ জানুয়ারি, ১৯৭৭ সালে রংপুরে জন্ম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা শেষে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেন। একসময় বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলায় ব্লগে লিখতেন। বর্তমানে ফেসবুকেও চলমান ঘটনা নিয়ে নিয়মিত নোট ও পোস্ট দেন।   
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ: ব্যক্তিগত বসন্তদিন (২০০৬) ও প্রথম উপন্যাস: ফেস বাই ফেস (২০১০)। এছাড়া প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: দেহ (২০১১); উপন্যাস: তোমারে চিনি না আমি (২০১৮); নভেলা: অর্ধেক জাগ্রত রেখে (২০১৩); কবিতাবই: অরব বসন্ত (২০২০); কবিতা-ইবুক: বস্তু পৃথিবীর রহস্য (২০১০); সেলিম আল দীনের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ: গুরু ও চণ্ডাল (২০১৩)।      

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ