bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

বাঙলা সাহিত্যের উপক্রমনিকা ꘡ আহমদ শরীফ


আহমদ শরীফ

পাক ভারত বর্ণ-সঙ্কর জাতি অধ্যুষিত দেশ। গ্রীক, হুন, কুশান, তুর্কী, মোঘল ও ইংরেজ জাতির আগমন ও বসবাস তো ঐতিহাসিক ব্যাপার। তারও আগে যারা এদেশে এসেছিল, তাদের মধ্যে দ্রাবিড়, আর্য, নিগ্রো, অর্ষ্ট্রিক, মঙ্গোলীয়দের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়াও আরো কত জাতি এদেশে বিজয়ীর বেশে এসেছে- সে খবর কারুর জানা নেই সত্য, কিন্তু অনুমান করা যায়, পাক ভারত চিরকাল বিদেশী বিজিত দেশই ছিল।


ভাগ্যের সে এক পরিহাস। এ দেশে যারাই যখন এসেছে কিছুকাল পরে তারা বীর্থহীন হয়ে পড়েছে। ফলে বিদেশ থেকে নতুন নতুন জাতি এসে তাদের উপর অধিপত্য করেছে। এটি হয়তো এদেশের আবহাওয়ারই প্রতিক্রিয়া।

আসল কথা, কোন জাতির চারিত্রিক বিকৃতি না ঘটলে তার পতন হয় না। এ বিকৃতির দরুণ যখন সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় ঘটে, অর্থাৎ দেশের বেশিরভাগ লোক নীতিবোধ হারিয়ে ফেলে; ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা প্রভৃতির প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়ে পড়ে; মহৎ ও বৃহতের সাধনায় পরাভুখ হয়, তখন তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠে।

পুরাকালের কোন খবর ইতিহাস দিতে পারে না। কিন্তু মধ্যযুগের কোন কোন ব্যাপারে আমরা এ বিপর্যয়ের আভাস পাচ্ছি। মধ্যযুগে বিদেশী বহু দরবেশ ও প্রচারক এদেশে ধর্ম প্রচার করতে আসেন। তাঁদের অনুচর রূপে আসে নানা মন ও মতের বহুলোকও। এদেশের সমাজ ও শাসন সম্বন্ধে কৌতুহলী লোকেরও অভাব ছিল না এদের মধ্যে। রাজনীতি-সচেতন স্বদেশ-প্রাণ ও স্বজাতি-বৎসল কেউ কেউ হয়তো এ দেশের দন্ডশক্তির দৌর্ব্যল্যের খকবর দিয়ে স্বাজাতি-বিদেশীকে এদেশে জয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে। অন্তত আজকাল ঐতিহাসিকেরা তা-ই অনুমান করেন।

এ অনুমানের স্বপক্ষে অন্তত কিছু তথ্যের আকস্মিক যোগাযোগও রয়েছে। হযরত খাজা মঈন-উদ্দিন চিশতির আগমনের পর মুসলমানদের দিল্লি রাজ্য দখল , বাবা আদমের আগমনে সোনারগাঁ জয়, শাহ্ জালাল ও বদর আল্লামাহর ‘খানকা করার পরে যথাক্রমে শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম বিজয় প্রভৃতি ঐতিহাসিকের অনুমানের পরিপোষক। এ ভাবেই ইংরেজ-ফরাসীর রাজ্যলাভ তো একরকম চোখে-দেখা সত্য। অবশ্য দরবেশ-প্রচারকদের উপর এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কেউ আরোপ করে না।

ইতিহাস-আশ্রয়ী ঘটনার কথাই বলি, য়ুরোপীয় বেনেরা এল বাণিজ্য করতে। এদেশের আদর্শচ্যুত নির্বোধ দন্ডধরদের দূর্বলতা টের পেয়ে শুরু করল লুটপাট আর জনগণের উপর উৎপীড়ন। বাধা না পেয়ে বেড়ে গেল তাদের সাহস ও লোভ। আর বেনেবৃত্তি একসময় রাজ-শক্তিতে রূপান্তরিত হল। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পলাশী আর অর্ধভারতের ভাগ্য-বিধাতা দুর্ধর্ষ মারাঠাগণ। কিন্তু তাদের সঙ্ঘ-শক্তি ছিল না। তাই ছিদ্রপথ নদী হয়ে দেখা দিল, সাত সাগরের ওপারের কুমীর এসে জুড়ে বসল। এমনি-ই হয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এদেশে ক্ষাত্র ধর্মের অনুকূল পরিবেশ নেই। তাই ‘শক হূন দল পাঠান মুঘল’ শক্তি একই পথে লোপ পেল।


এ জন্যেই পাক-ভারত সঙ্কর জাতির দেশ। বাঙলা দেশের পক্ষে এ কথাটি আরো খাঁটি। আদিকাল থেকে এ দেশে নানা বর্ণের ও গোত্রের লোকের বাস। পুণ্ড্র সুহ্ম, বঙ্গ, গৌড়, রাঢ় প্রভৃতি যে গোত্রবাচক শব্দ, তা বিশ্বাস করবার কারণ রয়েছে। এগারো বারো শতকের সংস্কৃত পুরাণগুলোতে এদের বহুবচনের রূপ পাওযা যাচ্ছেঃ গৌড়াঃ, বঙ্গাঃ, রাঢ়াঃ প্রভৃতি। এতে বোঝা যায়, এক এক গোষ্ঠী বা গোত্রের বসতি-অঞ্চল বাসেন্দাদেরই গোত্রীয় নামে পরিচিত হত। [মহাভারতেও আমাদের অনুমানের সমর্থন রয়েছে। মহাভারতোক্ত কাহিনী এরূপ: ‘‘ বলিরাজার মহিষী সুদেষ্ণা নিঃসন্তান ছিলেন্ স্ত্রী-পুত্র কর্তৃক বিতাড়িত জন্মান্ধ মহর্ষি দীর্ঘতমাকে রাজা স্বীয় মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে ধর্মার্থকুশল পুত্র উৎপাদন করিতে অনুরোধ করিলেন তদনুসারে মহর্ষি দীর্ঘতমার ঔরসে বলিরাজ-মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুহ্ম নামে পাঁচ পুত্র জন্মে। দীর্ঘতমা সুদেষ্ণাকে বর দিয়াছিলেন ‘‘ তোমার পুত্রগণের অধিকৃত রাজ্যসমূহ তাহাদের নামে খ্যাত হইবে।’’]
অস্ট্রিক, আলপাইন, পামিরীয়, দ্রাবিড়, আর্য, নিগ্রো, মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতির সমবায়ে আধুনিক বাঙালী জাতির উদ্ভব। সাত শতকের গোড়ার দিকে বোধ হয় শশাঙ্কের নেতৃত্বে প্রথম বঙ্গ-গৌড় রাজ্য গড়ে উঠে। চর্যাপদে ‘বঙ্গ’ - এর সঙ্গে ‘আল’ ও ‘আলী’ প্রত্যয় যোগে বঙ্গাল ও বঙ্গালী শব্দ চালু হয় দেশ ও জাতি অর্থে। ঐতরেয় আরণ্যকে (আঃ ৫ম শতক) ‘বঙ্গ’ শব্দ দেশ বা জাতি অর্থে পাওয়া যায়। চর্যাপদে ‘আজি ভুসুক বাঙালী ভইলী’ বা ‘অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ’ আর সর্বানন্দের ‘অমর কোষে’ (১১৫৯ খৃঃ) ‘বঙ্গাল বচ্চার’ শব্দ পাচ্ছি। নিত্যাহ্নিকতিলকে (লিপিকাল ১৩৯৫ খৃঃ) ‘বঙ্গিদেশ’ ব্যবহৃত হয়েছে। মুঘল আমলেই কেবল গৌড়-বঙ্গাদি অঞ্চল ‘সুবা-ই-বঙ্গাল’ নামে আখ্যাত হয়। ফলে কয়েক শ বছরের অব্যবহারে অন্য নামগুলো অপরিচিত হয়ে উঠল, আর ‘বঙ্গ’ নামটি গোটা সুবার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকল। কাজেই ‘বঙ্গ’ নামের প্রাচীনতা চর্যাপদ ও ঐতরেয় আরণ্যকের প্রাচীনতার ও প্রামানিকতার উপর নির্ভর করে।

কোল, ভীল, ওরাঁও, মুণ্ডা, সঁওতাল, দ্রাবিড়, চাকমা, নাগা, কুকী, আর্য, শক, হুন, তুর্কী, মুঘল, আরবী, ইরানী, হাবসী প্রভৃতি দুনিয়ার নানা গোষ্ঠী, গোত্র ও জাতির সমবায়ে উদ্ভূত আধুনিক বাঙালী জাতির মধ্যে তাই বিচিত্র আচার-সংস্কার, মননধারা, চারিত্রিক বৃত্তি-প্রবৃত্তি ও রুচি-সংস্কৃতির আভাস আজো দুর্লভ নয়। দেহাকৃতিগত বৈচিত্র্যও কি কম!

৩আমাদের দেশে ‘আর্য’ ছাড়া আর সব গোত্রীয় মানুষই ‘অনার্য’ --এই সাধারণ নামে পরিচিত। সংস্কারবশত আমরা ‘অনার্য’ বলতে অসভ্যই বুঝে থাকি, যেন ‘অনার্য’ ‘অসভ্য’-এর প্রতিশব্দ। দেশের পুরোনো ইতিহাসের যে সব উপাদান পাওয়া যাচ্ছে, তাদের সবগুলোই আর্য ভাষায় ও আর্য প্রভাবে লিখিত বা উক্ত। তাই ঋগ্বেদের আমল থেকে আজ পর্যন্ত অনার্যদের সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, তা নিন্দা ও অবজ্ঞাসূচক। অনার্যেরা বিজেতার গৌরব-গর্বী আর্যদের কাছে মানুষ নামের যোগ্যও ছিল না। এ জন্যই বিভিন্ন গোত্রের অনার্যেরা আর্য সমাজে দস্যু, রাক্ষস, যক্ষ, নাগ, পক্ষী, কুকুর, দৈত্য প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য আদিতে এগুলো ছিল ‘টোটেম’ নাম। কিন্তু আর্যেরা ব্যবহার করেছে অবজ্ঞার্থে। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, রাক্ষসকুলে রাবণ, নাগকুলে বাসুকী-জরৎকারু, যক্ষকুলে কুবের প্রভৃতির কাহিনী আমরা পাচ্ছি। মহাভারত ও পুরাণাদিতে অনার্যদের সম্বন্ধে নানা উদ্ভট কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। অথচ এই যুগে আমরা জানতে পারছি কোন কোন অনার্য গোত্র বিশেষত দ্রাবিড়েরা আর্যদের চেয়েও সভ্য ও উন্নত ছিল। তার প্রমাণ--কেবল ময়েঞ্জোদারো, হরপ্পা ও কোটদিজির আবিষ্ক্রিয়ায় নয়--আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষভাবে পাচ্ছি। ঋগ্বেদের আলোকে উত্তরকালের আর্য শাস্ত্রগ্রন্থগুলো যাচাই করলে আমরা দেখতে পাব, সেখানে শুধু যে অনার্য দেব-দেবীরাই ভীড় জমিয়েছে তা নয়--জ্ঞান ও ভক্তিবাদ, যোগ আর সাঙ্খ্যদর্শনও গড়ে উঠেছে, যা একান্তভাবে অনার্য প্রভাব প্রসূত।

মহাভারত বর্ণিত ‘‘ময়’’ দানবের কৌরবের সভা সাজানোর কাহিনীটি অনার্যশিল্প ও সভ্যতার উৎকর্ষের আভাস দিচ্ছে। ভক্তিবাদের উদ্গাতা শুক, নারদ, প্রহ্লাদ ও ব্যাসদেব অনার্য রক্ত সম্ভূত। ‘নবঘনশ্যাম’ কৃষ্ণ আর ‘নবদূর্বাদল শ্যাম’ রামও হয়তো অনার্যদের রক্তে ঋণী। নারী দেবতা এবং শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতা একান্তভাবেই অনার্য। দৈবকী, বাসুদেব, শিব, উমা প্রভৃতি অনার্য নাম। আর্য দেবতা প্রকৃতির প্রতীক। কিন্তু অনার্য দেবতা গুণ ও ভাবকল্পের প্রতিমূর্তি। এভাবে আমরা নানা সূত্রে আর্যদের উপর অনার্যদের সাংস্কৃতিক বিজয়ের আভাস ও পরোক্ষ প্রমাণ পাচ্ছি। প্রতিমাপূজা, বৃক্ষ, পশু, পক্ষী ও নারী দেবতার পূজা, অবতারবাদ, জন্মান্তরবাদ, মন্দিরোপাসনা, যোগ, তন্ত্র ও সাঙ্খ্যদর্শন, ধ্যান, সন্ন্যাস এবং ভূত, যক্ষ প্রভৃতি অপদেবতার পূজা প্রভৃতি অনার্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসূন।

আর্যরা বিজয়ী হিসেবেই বিদেশ থেকে এসেছে। কাজেই তাদের সংখ্যা বেশী হবার নয়। আমরা অনুমান করতে পারি আর্য বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের উচ্চবিত্তের ও আভিজাত্যের লোকগুলো আর্য সমাজে মিশে গিয়েছিল। নইলে দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড়েরা উচ্চ বর্ণের আর্যশ্রেণীভুক্ত হল কি করে? আর্যদের বসবাসের সাথে সাথেই উত্তর ভারত ‘আর্যাবর্তে’ পরিণত হল। ব্রহ্মাবর্ত, কুরুক্ষেত্র, মৎস, পাঞ্চাল, শূরসেন প্রভৃতি অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণ ভারতে সামীয় দ্রাবিড় আজো রয়ে গেছে। এ দিকে মগধ পেরিয়ে বহুকাল অবধি আর্যেরা আধুনিক বাঙলা দেশের খবর নেয়নি। এই ‘পান্ডববর্জিত’ দেশ সম্বন্ধে আর্যদের যেমন অবজ্ঞার ভাব ছিল, তেমনি এর সম্বন্ধে নানা অদ্ভুত ধারণাও তারা পোষণ করত। এভাবে কতকাল কেটেছে জানা যায় না, তবে গৌড়বঙ্গাদি অঞ্চলে যে বর্বর-প্রায় গোত্রগুলোর বসতি ছিল, তার আভাসও জৈন আর ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থাদিতে পাওয়া যাচ্ছে।


অনেককাল অবধি আর্য-অনার্যের রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলেছিল, এও অনুমান করা কষ্টকর নয়। বিভিন্ন অঞ্চলের অনার্য রাক্ষস, নাগ, দৈত্য প্রভৃতি গোত্রশক্তিকে রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক রণে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে চিরদাসে পরিণত করতে বা এদের উচ্চবিত্তের লোকগুলোকে আর্যসমাজভুক্ত করে নিতে আর্যদের সময় লেগেছিল অনেক। যারা বশ্যতা স্বীকার করেনি, তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরে গিয়ে কিংবা বনে জঙ্গলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। যে সব বিত্তহীন অজ্ঞ মানুষ আর্যসমাজে দাসরূপে ঠাঁই পেল, তারা কিরূপ উৎপীড়িত হত ও অবজ্ঞা পেত, তার চিত্র মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতির ব্রাহ্মণ্য সংহিতার পাঁতিগুলো থেকে পাওয়া যায়। আর্যেরা সম্ভবত বহুকাল ধরে প্রবল প্রতাপে শাসন চালিয়ে যায়। এমনি করে এক সময় যখন বিজেতা-বিজিতের স্মৃতি গণমন থেকে মুছে গেল, অথচ বেশীর ভাগ অনার্য সমাজে হীনবর্ণরূপে লাঞ্ছিত, অবজ্ঞাত ও উৎপীড়িত হচ্ছিল, তখন জৈব নিয়মেই সেকালের প্রথামত ধর্মবিপ্লবের আবরণে সমাজ বিপ্লব দেখা দিল। এ বিপ্লবের সার্থক নেতা বর্ধমান মহাবীর ও গৌতমবুদ্ধ। গৌতম-পূর্ব বহু বোধিসত্ত্বের এবং জৈনদের মহাবীর-পূর্ব তেইশ জন তীর্থঙ্করের উল্লেখ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অসন্তোষ ও বিদ্রোহ অনেক আগে থেকেই দানা বেঁধে উঠছিল, সাফল্য আসে তথা পূর্ণ রূপায়ন সম্ভব হয় মহাবীর ও গৌতমের নেতৃত্বে। এই দেব-দ্বিজ-বেদদ্বেষী বিপ্লবীদ্বয়ের অনুশাসন থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ব্রাহ্মণ্য দৌরাত্ম্য সমাজদেহ কিরূপ বিষাক্ত করে তুলেছিল। তাঁরা দুজনেই প্রচলিত ধর্ম-দর্শন তথা সমাজ ব্যবস্থা অস্বীকার করলেন। যাগ-যজ্ঞ, ক্রিয়া-কাণ্ড, বর্ণাশ্রম ও ব্রাহ্মণ-মাহাত্ম্য-এক কথায় তাঁরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি প্রভৃতি সবকিছুরই বিলোপ সাধনে ব্রতী হলেন। মানুষের দুঃখ ঘুচাতে গিয়ে, মানুষের প্রাণ ও আত্মার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্রতী হয়ে তাঁরা সর্বজীবের জীবনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য প্রচারে এগিয়ে এলেন। এতবড় কথা এর আগে আর কোথাও কেউ বলেন নি। সাম্য, মৈত্রী ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার বাণীবাহক মানবতার এই মহাসাধকগণ সেদিন কোটি কোটি নিপীড়িত নরনারীকে [দেবী পূজার যুগেও মর্যাদা বেশী ছিল না।] সম্প্রদায় বিশেষের খামখেয়ালী অত্যাচার থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। আর্য-অনার্যের বিভেদ উঠে গেল, ইতর-ভদ্রের ব্যবধান ঘুচে গেল। সাধারণের ‘বুলি’ অভিজাত ভাষার আসনও কেড়ে নিল। নিম্নবর্ণের নর-নারী নতুন ধর্মচ্ছায়ায় ও সমাজশ্রয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। [উচ্চবর্ণের খুব কম লোকেই জৈন-বৌদ্ধ ধর্ম বরণ করেছিল।]

এই বিদ্রোহ বিপ্লবের লক্ষণটা আরো পস্ট করে বলা দরকার: দেবতার নাম করে বামুনেরা শোষণ ও পেষণ করত। গৌতম দেবপূজা অস্বীকার করলেন--আত্মা-নরক-পিণ্ড প্রভৃতির ব্যাপারে নিরীহ লোকদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে পীড়ন করা হয়। তাই বুদ্ধ বললেন-- সব মিথ্যে। বর্ণাশ্রম-দুষ্ট সমাজে ভয়ঙ্কর বিভীষিকা দেখা দিল। তাই প্রচারিত হল সাম্যবাদ। দেব ও দ্বিজের দৌরাত্ম্য অসহ্য হয়ে উঠল।--তাই দেব-দ্বিজ পূজা অস্বীকৃত হল। সংস্কৃতে ব্রাহ্মনেতর শ্রেণীর অধিকার ছিল না--তাই গণভাষা পালি ও প্রাকৃত মর্যাদা পেল। বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদকে অনার্য অভ্যুত্থান বলেও আখ্যাত করা যেতে পারে। গৌতম জন্মেছিলেন অনার্য অধ্যুষিত নেপালের তরাই অঞ্চলের কপিলাবাস্তুতে। তিব্বতী ভোটচীনা লিচ্ছবীরা ছিল তার মাতৃকূল। মহাবীরও ছিলেন অনার্য-অধ্যুষিত তথা আর্যাবর্ত বহির্ভূত অঞ্চল-সম্ভূত।

যে দেবতাকে নিজের সুখ-দুঃখের কথা নিজ মুখে নিবেদন করা চলে না, যে ধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড নিজের আচরণ সাধ্য নয়, যে-ধর্মের বাণী নিজ মুখে উচ্চারণ ও নিজ কানে শ্রবণ সম্ভব নয়, তার সঙ্গে কারো আত্মিক যোগ থাকার কথা নয়। একারণে লোকেরও কোন অন্ধসংস্কারের বন্ধন ছিল না। তাই ভারতময় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সহজেই প্রচারিত হতে পেরেছিল।

আর্য-অনার্যের বিভেদ যখন ঘুচে গেল, তখন দেশ বা মানুষ অবিশেষের কাছে বুদ্ধ-মহাবীরের বাণী পৌঁছিয়ে দেবার পক্ষে কোন বাধা রইল না। এ সময়েই প্রথম জৈন ও বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মগধের সীমা অতিক্রম করে রাঢ়ে-পুণ্ড্রে তথা আধুনিক বাঙলা দেশে নবধর্ম প্রচারের জন্যে উপস্থিত হলেন। এ দেশের বর্বর-প্রায় জনগণের মধ্যে আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির আবরণে এই দ্রোহী-ধর্ম অর্থাৎ জৈন-বৌদ্ধ মতবাদ প্রচারিত হল। এদের লিপি ছিল না, সাহিত্যের শালীন ভাষা ছিল না, উঁচুমানের সংস্কৃতি ছিল না, তাই আর্য ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতিও তাদের বরণ করে নিতে হল। এভাবে বাঙলাদেশে অল্পকালের মধ্যে আর্যধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রসার লাভ করল এবং এ সঙ্গে কিছুসংখ্যক তথাকথিত আর্যও এদেশে প্রচার উপলক্ষে বসবাস করতে শুরু করেছিল বলে অনুমান করতে বাধা নেই।


বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মান্দোলনকে আমরা অনার্য অভ্যুত্থানও যে বলতে পারি, তার পক্ষে কিছু তথ্য আছে। মেঘাস্থিনিসের বিবরণে দস্যু সর্দারের রাজ্যলাভ এবং নাপিতপুত্ররূপে ঘৃণিত নৃপতির কথা আছে। [ সমসাময়িক ভারত ১ম খণ্ড, ভূমিকা-যোগীন্দ্রনাথ সমদ্দার] রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন--‘‘শুদ্রগণ অনার্য বংশ সম্ভূত।...শিশুনাগ বংশীয় মহানন্দের শূদ্রাপত্নীর গর্ভজাত পুত্র ভারতের সমস্ত ক্ষত্রিয়কুল নির্মূল করিয়া একচ্ছত্র সম্রাট হইয়াছিলেন।...মগধে শূদ্রবংশের অভ্যুত্থান ও আর্যাবর্ত পুনর্বার নিঃক্ষত্রিয় করণের প্রকৃত অর্থ বোধ হয় যে, এই সময়ে বিজিত অনার্যগণ অবসর পাইয়া পুনরায় মস্তকোত্তলন করিয়াছিলেন এবং মহাপদ্মানন্দের পূর্বে ভারতবর্ষে কোন কোন রাজা সমগ্র আর্যাবর্ত অধিকার করিয়া ‘একরাট’ পদবী লাভ করিতে পারেন নাই।’’[বাঙলার ইতিহাস ১ম খণ্ড]

রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্তে যদি ত্রুটিও থাকে, তবু আমরা বলতে পারি, মহানন্দ, চন্দ্রগুপ্ত কিংবা অশোক--এ তিন জনের যে-কোন একজনের নেতৃত্বে অনার্য অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। রাজবংশী প্রভৃতি কৈবর্ত শূদ্রগণও এক সময় আর্য শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। গৌতমবুদ্ধের দেব-দ্বিজ ও দেবদ্রোহিতা এতই তীব্র ছিল যে, নির্বাণ কালে তিনি নাকি সংস্কৃত-চর্চা করতে নিষেধ করে যান। মহাভারতে আর্য-অনার্যের যুদ্ধ-বিগ্রহের বহু কাহিনী আছে। বাসুকীর বিদ্রোহ, বৃত্রের দেবতাতাড়ন, রাবণের সীতাহরণ, প্রহ্লাদের আর্যধর্ম গ্রহণ, রামের হরধনু ভঙ্গকরণ, রামের পাদস্পর্শে অহল্যার প্রাণলাভ, অগ্যস্তের দাক্ষিণাত্য যাত্রা প্রভৃতি আর্য-অনার্যের সংঘর্ষ ও মিলনে কাহিনী। ব্যাস, বশিষ্ট, নারদ, সত্যকাম, শুকদেব প্রভৃতির জন্ম অনার্যার গর্ভে। আর্যেরা যে অনার্যা সুন্দরীদের ধর্ষণ করত এগুলো তারও নজির।


মনে করা যাক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রচারিত হওয়ার আগে বাঙলাদেশে আর্য-প্রভাব পড়েনি। কিন্তু দেশে মানুষ ছিল, অথচ তাদের ভাষা ছিল না, সুখ-দুঃখের গান বা গাথা ছিল না, ছড়া ছিল না, ‘বচন’ ছিল না কিংবা ধর্ম সঞ্জাত সংস্কার ছিল না- এমন হতেই পারে না। কাজেই মেনে নিতে হয় যে, আর্য পূর্ব যুগে এ দেশে কোন একটি সার্বজনীন ভাষা কিংবা গোত্রীয় ভাষাগুলো চালু ছিল। জৈন-বৌদ্ধ ধর্ম বরণ করে নিয়ে তারা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করে উন্নত আর্য ভাষা গ্রহণ করে। এর সঙ্গে তাদের বিশিষ্ট সংস্কৃতির ও বস্তু নির্দেশক কিছু কিছু শব্দ ও বাগ্বিধি আর্য ভাষার (সম্ভবত মাগধী প্রাকৃত) সঙ্গে মিশে গেল। কোন জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি অপরিণত থাকলে সেগুলোকে উন্নততর ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে পড়ে অপমৃত্যু বরণ করতে হয়। সবক্ষেত্রে না হলেও কোন কোন অবস্থায় এ বিপদ এড়ানো যায় না। বাঙলা সেদিন এই শেষোক্ত অবস্থায় পড়েছিল। কোন ভাষা সেকালে কোন ধর্ম-বিপ্লবের বাহন হলে তার বিকাশ দ্রুততর হত--এ কালে যেমন হয় রাষ্ট্রভাষা কিংবা কোন মতবাদের বাহন হলে। এর প্রসারও হত, কারন কোন ভাষা কোন ধর্মবিপ্লবের বাহন হলে তার প্রভাব এড়ানো সে-ধর্মে দীক্ষিত জাতির পক্ষে অসম্ভব। এবং যে-কোন ভাষার প্রসার নতুন ভাব, চিন্তা ও নতুন বস্তু ভিত্তিক। জৈন ধর্ম নয়--বৌদ্ধমতবাদই বাঙলাদেশে বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছিল। যারা এ মতবাদ গ্রহণ করতে পারেনি, তারা আত্মরক্ষা কিংবা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার জন্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা বনে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এ জন্যেই আজো কোল, ভীল, মুণ্ডা, কুকী, লেপচা, ভুটিয়া প্রভৃতি নিজেদের ভাষা ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে, দেখতে পাই। এ সব ভাষাকেই সম্ভবত ‘আর্য-মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে (৮ম শতক খৃঃ) ‘অসুরভাষা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘অসুরানাং ভবেৎ বাচা গৌড়-পুণ্ড্রোদ্ভবা সদা।’

কিংবা ঐতরেয় আরণ্যকে ‘বায়াংসির’ বুলি বলে নিন্দিত হয়েছে।


ব্রাহ্মণ্য-উৎপীড়ন থেকে নিস্কৃতির উপায় রূপে জনগণ বৌদ্ধ ও জৈন মত উৎসাহের সাথে গ্রহণ করলেও, প্রথম উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উভয় ধর্মে নানা বিকৃতি দেখা দিল। কারণ, এ দুটো ধর্মের শিক্ষা ও অনুশাসন জৈব ধর্মের এতই প্রতিকূল যে তা প্রাত্যহিক জীবনে আচরণসাধ্য নয়। সাধারণভাবে, মানুষের জীবনে সাধনা হচ্ছে ধন-জন-মানের সাধনা। অন্তরের অভাব ও অতৃপ্তিবোধই আশা-আকঙ্খা এবং কর্ম-প্রেরণারূপে প্রকাশিত হয়, ভোগেচ্ছাবিহীন জীবন সাধারণ মানুষের কল্পনাতীত। অথচ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মূল কথা- বৈরাগ্য-তৃষ্ণাবিহীন জীবন-সাধনা--অর্থাৎ ব্যবহারিক জীবনকে পঙ্গু ও অথর্ব করে তোলা। তাই বৌদ্ধধর্মের বিকৃতি ও বৌদ্ধদের নৈতিক চারিত্রিক দৌর্বল্যের সুযোগে শঙ্করাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য শক্তি আবার সুপ্রতিষ্ঠিত হল।

বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য সংঘর্ষে দেদার হত্যাকাণ্ড, বহু অত্যাচার ও নানা উৎপীড়ন যে হয়েছিল, তার প্রমাণ সে যুগের পুঁথিপত্রে নানা সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ‘শঙ্কর বিজয়ে’ আছে : দুষ্টমতাবলম্বিনঃ জৈনান অসংখ্যাতান অনেক বিদ্যাপ্রসঙ্গে নির্জিত্য তেষাং শীর্ষাণি পরশুভিশ্ছিত্ত্বা বহুষু উদূখলেষু নিক্ষিপ্য কটভ্রমণেশ্চূর্ণীকৃত চৈবং দুষ্টমত ধ্বংসম আচরণ নির্ভয়ো বর্ততে। [অর্থাৎ : অসংখ্য দুষ্টমতাবলম্বী বৌদ্ধ ও জৈন রাজ্যমুখ্যদিগকে অনেক বিদ্যাপ্রসঙ্গে নির্জিত করিয়া তাহাদের মাথা কুঠার দ্বারা ছিন্ন করে, অনেক উদূখল নিক্ষেপ করে, মুষল দ্বারা চূর্ণ করে, এইরূপ দুষ্টমত ধ্বংস আচরণ করে তিনি নির্ভয় থাকতেন।] এই ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে বৌদ্ধগণ নির্মূল হয়ে গেল। তাদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি প্রভৃতিও বৌদ্ধদ্বেষী নবজাগ্রত ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় কর্তৃক হয়তো বহুলাংশে বিনষ্ট হয়েছিল।

বাঙলাদেশের কথায় আসা যাক। বাঙালীরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করল সত্য, কিন্তু ধর্মের অনুশাসনের সাথে জনগণের আন্তর যোগ ছিল না, তাই নিরীশ্বর নৈরাত্ম্য বৌদ্ধ চৈত্যগুলো ক্রমে বহু দেবতা ও উপদেবতার মন্দিরে পরিণত হল। হীনযান, মহাযান, সহজযান, বজ্রযান প্রভৃতি নানা মতাদর্শ ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল।কারণ ‍সুখে দুঃখে সুদিনে দুর্দিনে স্বস্তি ও প্রবোধ পাবার জন্যে একটি মহাশক্তিকে অবলম্বন স্বরূপ পাওয়া চাই। নইলে ভরসা কি? বাঙলার পাল রাজগণ বৌদ্ধ ছিলেন। তাই তাঁদের সময়ে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম নামত টিকে ছিল। সেন রাজাগণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের প্রতিকূলতায় বাঙলাদেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তৎসঙ্গে বৌদ্ধযুগের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হল। বাঙলাদেশ কোনকালে যে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব ছিল, তা’ অনুমান করবার সামান্য উপাদান পর্যন্ত অবশিষ্ট রইল না। এতেই বোঝা যায়, কি অসামান্য উগ্রতা নিয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মধ্বজীগণ বৌদ্ধদের ধর্ম, সংস্কৃতি তথা বৌদ্ধ জাতিকে ধ্বংস করেছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গেও জনসাধারণের বিশ্বাস সংস্কারের যোগ নিবিড় ছিল না। রাজধর্ম বলে সেন বংশীয় শাসনকালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুস্যূত হলেও, আসলে ধর্মগ্রন্থ, মন্দির, দেবতা প্রভৃতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ও সম্পর্ক ব্রাহ্মণের মারফত হত বলে, তা’ কখনও অকৃত্রিম হয়ে উঠেনি। তাই বাঙলাদেশে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (সেন রাজ-বংশের পতনযুগেই এর সূচনা) রাজরোষ ভয়মুক্ত জনসাধারণ স্ব স্ব বিশ্বাস সংস্কার দিয়ে নিজেদের ইষ্ট দেবতা সৃষ্টি করল। এটাই বাঙলা দেশে ও সাহিত্যে লৌকিক ধর্মান্দোলন। মনসা, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর, নাথপন্থ প্রভৃতি দেবতার ও মতের সৃষ্টি হল। এইগুলো মূলত বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবিত অনার্য ধর্ম। অবশ্য এতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব প্রচুর। এ প্রভাব পড়ে প্রধানত রামায়ন অথবা মহাভারত ও পুরাণের মাধ্যমে।

এ সব লৌকিক দেবতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন--‘‘এক কালে পুরুষ দেবতা যিনি ছিলেন তাঁর বিশেষ কোন উপদ্রব ছিল না। খামকা মেয়ে দেবতা জোর করে এসে বায়না ধরলেন, আমার পূজা চাই। অর্থাৎ যে জায়গায় আমার দখল নেই, সে জায়গা আমি দখল করবই। তোমার দলিল কী? গায়ের জোর। কি উপায়ে দখল করবে? যে উপায়ে হোক। তারপর যে সকল উপায় দেখা গেল মানুষের সদ্ বুদ্ধিতে তাকে সদুপায় বলে না। কিন্তু পরিণামে এই সকল উপায়েরই জয় হোলো। ছলনা, অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা কেবল যে মন্দির দখল করল তা নয়, কবিদের দিয়ে মন্দিরা বাজিয়ে চামর দুলিয়ে আপন জয়গান গাইয়ে নিলে।’’ রবীন্দ্রনাথের এ মন্তব্য একটু কঠোর। আসলে সমাজের যে স্তরের লোক-দ্বারা এ সব লৌকিক দেবতা পরিকল্পিত, প্রতিষ্ঠিত ও পূজিত, তাদের বিদ্যাবুদ্ধি ও রুচিসংস্কৃতি কোন কালেই উঁচু ছিল না। যে-পরিবেশ ও শিক্ষা পেলে মানুষের মন ও মননের বিকাশ ও প্রসার হয়, তা চিরকাল এদের কাছে রুদ্ধ ছিল, তাই এদের অপরিণত মন-বুদ্ধি-বোধিরই নগ্নরূপ ধরা দিয়েছে দেবতার শক্তি ও ঐশ্বর্য পরিকল্পনায়।

মঙ্গল কাব্যের উদ্ভবের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ... ‘‘তখন সমাজের মধ্যে যে উপদ্রব-পীড়ন, আকস্মিক উৎপাত, যে অন্যায়, যে অনিশ্চয়তা ছিল, মঙ্গলকাব্য তাহাকেই দেবমর্যাদা দিয়া সমস্ত দুঃখ অবমাননাকে ভীষণদেবতার অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছার সহিত সংযুক্ত করিয়া কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা লাভ করিতেছিল এবং দুঃখক্লেশকে ভাঙ্গাইয়া ভক্তির স্বর্ণমুদ্রা গড়িতেছিল। এই চেষ্টা কারাগারের মধ্যে কিছু আনন্দ, কিছু সান্ত্বনা আনে বটে কিন্তু কারাগারকে প্রাসাদ করিয়া তুলিতে পারে না। এই চেষ্টা সাহিত্যকে তাহার বিশেষ দেশকালের বাহিরে লইয়া যাইতে পারে না।’ রবীন্দ্রনাথ মুসলমান বিজয় ও তজ্জনিত অত্যাচারকেই লৌকিক দেবতা ও তাঁদের মাহাত্ম্যজ্ঞাপক কাব্য সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়। কারণ খ্রীস্টীয় এগারো-বারো শতকে অর্থাৎ সেন রাজত্বের শেষের দিকে রচিত সংস্কৃত পুরাণগুলোতে এ সব লৌকিক দেবতার উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। বরং ‘বাঙলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাসে’ আশুতোষ ভট্টাচার্য (১ম সংস্করণ) যা বলেছেন তা’ অনেকটা সমীচীন বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন--‘সেন রাজাদিগের সময় হইতেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি সাধারণের মধ্যে বিস্তৃত হইতেছিল সত্য কিন্তু এত কালের একটা দেশীয়-ধর্ম সংস্কৃতিও--যাহা জাতির একেবারে মজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছিল--মুখ্যতঃ না হউক গৌণতঃ হইলেও এই সমাজদেহেই রহিয়া গেল। সেকালের বাঙালী হিন্দুর সামাজিক জীবনের এই সন্ধিযুগে, দেশীয় প্রাচীন সংস্কার ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নতুন আদর্শ এই উভয়ের সংঘাত- মুহুর্তে বাংলা পুরাণ বা মঙ্গলকাব্যগুলি সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল।...তাহারা (বাঙালী হিন্দুগণ) নূতনকে(ব্রাহ্মণ্যধর্মকে) যেভাবে গ্রহণ করিল তাহা পুরাতনেরই রূপান্তর মাত্র হইল; এই দেশীয় প্রচলিত ধর্ম-সংস্কারই যুগোচিত পরিমার্জনা মাত্র লাভ করিয়া সমাজের অন্তঃস্থলে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করিতে লাগিল। মঙ্গল কাব্যগুলি এই নূতন ও পুরাতনের মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বিধান করিয়া দিয়া পরস্পর বিপরীতমুখী দুইটি সংস্কারকে এক সূত্রে গাঁথিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। বাংলার জলবায়ুতে দেশীয় লৌকিক সংস্কারের সহিত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার যে কি ভাবে একদেহে লীন হইয়া আছে মঙ্গল কাব্যগুলি পাঠ করিলে তাহাই জানিতে পারা যায়।...তাহারই ফলে বর্তমান বাঙলার হিন্দুসমাজে পঞ্চোপাসক হিন্দু সম্প্রদায়ের সৃষ্টি।’’ সুতরাং ডঃ সুকুমার সেনের উক্তি যথার্থ বলে গৃহীত হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘‘মুসলমান অভিযান যে আলোড়ন ও বিক্ষোভ জাগাইয়া তুলিল’’--কথাগুলো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মুসলমান বিজয় ও তারপরে কিছুকাল বাঙলার রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থা কিরূপ ছিল তা’ সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখা যাক।


১২০২-৪ খ্রীস্টাব্দের কোন সময়ে বখতিয়ার খালজী নদীয়া অধিকার করেছিলেন সত্য, কিন্তু গোটা বাঙলাদেশ জয় করা বহুকালাবধি তুর্কীদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। লক্ষ্মণ সেনের বংশধরগণ এবং অপরাপর সামন্তগণ মধ্য ও পূর্ব বাঙলায় অনেককাল স্বাধিকার বজায় রেখেছিলেন। সুতরাং ডঃ দীনেশ সেন, ডঃ সুকুমার সেন বা অন্যান্য হিন্দু ঐতিহাসিকগণ ‘দু’শ আড়াইশ বছর যাবৎ বাঙলাদেশে মুসলমানগণ অত্যাচার ও ধ্বংসের তান্ডব লীলা’ চালিয়েছে বলে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন--তা’ সত্য নয়।

লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাঙালীর নৈতিক দৌর্বল্য, চারিত্রিক বিকৃতি ও সামাজিক শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল। এর বহু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। হলায়ূধ মিশ্রের, ‘শেখ শুভোদয়া’, জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ শূন্য পুরাণ বা ধর্ম পূজাবিধানের ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ প্রভৃতিতে এর আভাস আছে। গীতগোবিন্দে আধ্যাত্মিকতা সন্ধান করা বাতুলতা মাত্র--কারণ এতে তা নেই। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্য উৎপীড়নের রেশ তখনো ছিল। রাজধর্মে ক্ষাত্রশক্তিতেও শিথিলতা এসেছিল। মন্ত্রতন্ত্র প্রভৃতি আধি-দৈবিক শক্তির উপর একান্ত নির্ভরতা এ যুগের প্রাসাদ ও কুটীরবাসীর চিত্তদৌর্বল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সেন আমলের রণনীতির একটু নমুনা : ‘‘তুকতাকের উপর বিশ্বাস সেকালে রাজশক্তিরও যে কতটা দৃঢ় ছিল তার একটু নিদর্শন দিচ্ছি সেকালের একটি তথাকথিত রণনীতির বই থেকে। শত্রুসৈন্য যদি চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়ায় তখন কি কর্তব্য সে সম্বন্ধে বইটিতে অনেক রকম বিধান আছে। তার মধ্যে একটি বলছি। শ্মশানের ছাই কয়েকটি বিশেষ বিশেষ গাছের ছাল ও মূলের সঙ্গে বেটে তূর্যের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে এই মন্ত্র পড়ে বাজাতে হবে,
ওং অং হং হালিয়া হে মহেলি বিহঞ্জহি সাহিনেহি
মশানেহি খাহি লুঞ্চহি কিলি কিলি কালি হুংকট স্বাহা।
আর শ্বেত অপরাজিতার মূল ধূতুরাপাতার রসে বেটে নিজের কপালে তিলক এঁকে সর্বঞ্জোদয় মন্ত্রজপ করতে হবে। তা হলে সেই তূর্যের শব্দ শুনে ‘‘ভবতি পরচক্রভঙ্গঃ স্বসৈন্য বিজয়ঃ।’’ (ডঃ সুকুমার সেন--মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী)

মুসলমান অভিযানের সময় বিজেতা-বিজিতের দ্বন্দ্ব স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান ছিল। বিজেতাগণ প্রয়োজনের তাগিদে দেউলদেহারা ও দেশীয় সামন্তশক্তির উপর হামলা করতে যে বাধ্য হয়েছে তা অস্বীকার করবারও কারণ দেখি না। বিজেতাগণের উত্তম্মন্যতা ও বিজিতদের হীনমন্যতার দরুন পারস্পারিক সম্পর্ক যে কিছুকাল অবজ্ঞা ও বিদ্বেষদুষ্ট ছিল তাও সত্য। তুর্কী অভিযান তথা ভারতে মুসলমান বিজয় যে ধর্ম সম্পৃক্ত নয় তা সবাই স্বীকার করেছে। সুতরাং শাসক বিশেষের অত্যাচার-উৎপীড়ন জাতীয় কলঙ্করূপে চিত্রিত হওয়াও উচিত নয়। যেমন, গণেশের পুত্র জালাল উদ্দীন যে-কয়জন ব্রাহ্মণকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করিয়েছিলেন, তা একান্তভাবেই তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ বশে। ইসলাম বা মুসলমানের এর সঙ্গে কোন যোগ ছিল না। ভারতে ইসলাম প্রচারে কোন কোন রাজশক্তির সহানুভূতি ছিল হয়তো, কিন্তু সহযোগিতা যে ছিল না তা অস্বীকার করবার উপায় নাই। তুর্কী মুসলমানেরা রাজত্ব করতে এসেছিল, ধর্ম প্রচার করতে নয়। অবশ্য মুসলমান বিজয়ের আনুষঙ্গিক ফল পরোক্ষভাবে ইসলাম প্রচারের সহায়ক হয়েছিল। বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতায়’ এবং বৈষ্ণব গ্রন্থগুলোতে মুসলমান অত্যাচারের যে সব কথা বর্ণিত হয়েছে, তাদের সত্যতা স্বীকার করেও বলা যায়, এ সব অত্যাচার-উৎপীড়ন অহেতুক ছিল বলে বিশ্বাস করা উচিত নয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগেও স্বদেশী সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বজাতির উপর রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে রূঢ় ও কঠোর হতে বাধ্য হয়। বিরোধী দল একে অকারণ অত্যাচর উৎপীড়ন বলে রটিয়ে থাকে। কে না জানে সকারণ শাস্তি চিরকালই শাস্তিভোগীর দ্বারা অকারণ উৎপীড়ন বলে বর্ণিত হয়? আত্মপক্ষ সমর্থন মানুষের সহজাত বৃত্তি। আবার কোন কোন মুসলমানের কাফেরদের প্রতি অবজ্ঞা, কাফের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত দায়িত্বহীন উক্তি ও কার্য পুঁথিপত্রে বিধৃত থেকে গোটা মুসলমান জাতিরও কলঙ্কবাদী ঘোষণা করছে। বস্তুত ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধদের মধ্যে যে ভাবে ধর্মীয় সংঘর্ষ হয়েছিল এবং হবার কারণ ছিল, হিন্দু-মুসলানের মধ্যে সে কারণ থাকার কথা নয়। ওটাতে প্রতিবেশী সুলভ বহুকাল পোষিত আক্রোশের রেশ ছিল, এটাতে ছিল না। কেননা দীক্ষিত মুসলমানের বিরলতার দরুণ মুসলমান তখনো হিন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী হয়ে উঠেনি। তখন কেবল বিদেশী প্রশাসক মুসলমান ও দেশী হিন্দুই ছিল--অনেকটা ইংরেজ শাসক ও ভারতীয় প্রজার মতো।

হিন্দু ও শাসক মুসলমানের বিরোধই সত্য ছিল, সম্প্রীতি মিলন কাহিনীই কি মিথ্যা? ‘‘ এ দেশে আসিয়া মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপাইয়াছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ-মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন। সেসব ঐতিহাসিক নজীর দিন দিনই নূতন করিয়া বাহির হইতেছে।’’ (ক্ষিতিমোহন সেন)
তুর্কী রাজত্বের প্রথম যুগে রাষ্ট্রশক্তির স্থিরতা ছিল না। রাজা ও রাজপুরুষগণ নিজেদের মধ্যেই স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে ষড়যন্ত্র, হানাহানি ও কাটাকাটিতে লিপ্ত ছিলেন। সুতরাং এ সময় দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না থাকারই কথা। কিন্তু ইলিয়াস শাহী শাসনে দেশে যে স্থায়ী শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এ সময় থেকেই মুসলমান শাসকগণ দেশের সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নে তৎপর হন। এ সময়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রক্তসম্পর্কও স্থাপিত হতে থাকে। কোন কেন মুসলমানের ব্যক্তিগত লাম্পট্যে হিন্দু রমণী ধর্ষণ যে চলেনি তা নয়, তবে এগুলো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিজাত নয়--কামজ। সুন্দরীর প্রতি পুরুষসম্ভব আকর্ষণজাত।

শাসকগোষ্ঠী চিরকার আলাদা একটা জাতি। তাঁদের স্বার্থ ও সুখের প্রেরণাতেই তাঁদের কর্ম প্রচেষ্টা। তা জনসাধারণের পক্ষে কখনও বিপদের কারণ হয়ে উঠে মাত্র। শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ নরশ্রেষ্ঠ, আবার কেউ বা নরদানব। এসবই হচ্ছে ব্যক্তিগত চরিত্রনির্ভর ব্যাপার। কোন বিশেষ জাতি বা গোত্রের সঙ্গে সুশাসন-কুশাসনের কার্য-কারণ সম্পর্ক সন্ধান নিতান্ত নিরর্থক। বাঙলার তথা ভারতের মুসলমান নৃপতিদের অনেকেই সুশাসক ছিলেন, নরদানবও ছিলেন কেউ কেউ। তাঁদের অনুগ্রহ-নিগ্রহ স্বজাতি-বিজাতি সমভাবে ভোগ করেছে। আস্তিক মানুষেরা কেবল স্বধর্মকেই সত্য বলে জানে। পর ধর্মে আস্থার অভাবহেতু ধার্মিক মাত্রেই পর ধর্মের প্রতি অবজ্ঞাপ্রবণ। কাজেই ধর্মের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা কখনো ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু তাই বলে বৈষয়িক ও রাজনীতিক ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান ভেদবুদ্ধি যে প্রবল ছিল, তার প্রমান দুর্লভ। প্রতাপ-শিবাজীর মুসলমান অনুচর ছিল বহু। আওরঙজীবের হিন্দু সেনা ও সেনাপতির সংখ্যাও কি কম! তারপর যে সব সূত্রে আমরা বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্য অত্যাচার, হিন্দুর উপর মুসলমান উৎপীড়নের সংবাদ পাচ্ছি, তাতে লেখকের ব্যক্তিগত মতাদর্শ নিশ্চয়ই রয়েছে। যেমন, পাক-ভারতে সাম্প্রদায়িক বিরোধ যেমন আছে, তেমনি সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছাও কম নয়। কিন্তু ব্যক্তি বিশেষে বিরোধের কথা ফলাও করে বেড়ায়, আবার কেউ সম্প্রীতির কথা তুলে ধরে। অথচ সত্য থাকে এ’দুয়ের মাঝখানে। ‘১২০০ থেকে ১৪৫০ পর্যন্ত আড়াইশ’ বছর যাবৎ মুসলমানগণ বাঙলা ‘দেশে অত্যাচার ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা’ চালাবার ফলেই এ সময়ে বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি হয় নি বলে ডঃ সুকুমার সেন প্রভৃতি যে সিদ্ধান্ত করেছেন তার অযৌক্তিকতা প্রদর্শন করবার জন্যেই আমাদের এত কথার অবতারণা করতে হল।

১০
আমাদের ধারণা, মুসলমান বিজয় ও তারপরের বাঙলার অবস্থা নিম্নরূপই ছিল:

মুসলমানদের বাঙলা অভিযানকালে তারা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে, নরত্ন প্রাপ্তির আশায় এবং পলাতক শত্রুর সন্ধানে দেউলদেহারা আক্রমণ করেছে ও ভেঙ্গেছে। বিজয়ী হয়ে এদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরে দেউলদেহারা ভাঙবার কোন কারণ ছিল না। অবশ্য ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় অপরাধ বা আক্রোশবশে সামন্তশ্রেণীর কোন কোন হিন্দুর উপর দুর্ব্যবহার যে করতে হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। তেমন অত্যাচার থেকে মুসলমানও নিষ্কৃতি পায়নি। সাধারণ মুসলমানের উত্তম্মন্যতা ও সাধারণ হিন্দুর হীনমন্যতাজাত পারস্পারিক অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ তাদেরকে কিছুকাল অনাত্মীয় করে রেখেছিল বলেও অনুমান করা যায়। কিন্তু হিন্দুদের উপর মুসলমানরা অত্যাচার করতে পারেনি। কারণ :

১. ‘রাজ্যশাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমন কি সৈন্যপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।’ -(ডঃ সুকুমার সেন)। ‘‘অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন।...এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্তই ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং ইঁহারাই ব্যবসায়-বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন।’’ (স্টুয়ার্টের বাঙলার ইতিহাস)

২. সাধারণ মুসলমানরা বিশেষ করে প্রচারক দরবেশরা চাইতেন এদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার হোক। কাজেই ইসলামের মাহাত্ম্য ‍ও মুসলিম জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্যও সাধারণ মুসলমানকে সংযত হয়ে চলতে হয়েছে। বিশেষতঃ গৌড়েই হযরত জালালউদ্দীন তাবরেজী ও আলাউল হক, তাঁর পুত্র হযরত নূর-কুতবে-আলম প্রভৃতি অবস্থান করতেন।

৩. গৌড়ের প্রথম দিককার সুলতান ও রাজপুরুষগণ নিজেদের মধ্যেই স্বার্থ ও ক্ষমতা নিয়ে ষড়যন্ত্র, হানাহানি ও মারামারিতে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময়ে হিন্দু প্রজাদের [যারা প্রায় শতকরা পঁচানব্বই জন] তাঁরা উৎপীড়ন দ্বারা উত্তেজিত হবার সুযোগ দিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। ধর্মান্তর ও বৈবাহিক সম্বন্ধের ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অতি অল্পকালের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এরূপে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রতিবেশী সুলভ সম্প্রীতি স্থাপিত হওয়া সম্ভব। ইলিয়াসশাহী শাসনকালে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি ছিল। গৌড়ের সুলতানের অধীনে হিন্দুরাও মুসলমানদের ন্যায় নিজেদের স্বাধীন জাতি বলে মনে করত। এজন্যেই মুঘলের বিরুদ্ধে বাঙলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে তারা কখনো উদাসীন ছিল না। ধর্ম ব্যাপারেও পারস্পারিক সহনশীলতার ভাব বিরাজ করত। বৃন্দাবন দাস বলেন-
‘‘হিন্দুকুলে কেহ যেন হইয়া ব্রাহ্মণ। আপনে আসিয়া হয় ইচ্ছায় যবন।। হিন্দুরা কি করে তারে তার যেই কর্ম। আপনে যে মৈল তারে মারিয়া কি ধর্ম।।’’
এবং বৈষ্ণবদের হাতে অনেক মুসলমান স্বধর্ম স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

এই ইলিয়াসশাহী আমল থেকেই বাঙলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। কবিচক্রবর্তী, রাজপণ্ডিত, পণ্ডিতসার্বভৌম, কবিপতি ও চূড়ামণি মহাচার্য রায়মণি বৃহস্পতি মিশ্র এ সময়কার পরপর কয়েকজন সুলতানের দরবার অলংকৃত করেছিলেন। হোসেনশাহী আমল বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের সুবর্ণযুগ। এ সময়ে বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের নতুন অধ্যায় সূচিত হল। ধর্মে, সাহিত্যে, শিল্পে, সংগীতে বাঙালীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য ফুটে উঠল। বাঙলার নিজস্ব সংস্কৃতি আর্য-সংস্কৃতিকে ম্লান করে দিয়ে মহিমার আসনে প্রতিষ্ঠিত হল। দীনেশ চন্দ্র সেন (বৃহৎ বঙ্গ) বলেন- ‘‘ বাঙ্গালা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাঙ্গালার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশের সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়াছিল, এই পরাধীন যুগে সেই শ্রী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল।...এই পাঠান যুগে সর্ব প্রথম হিন্দু সমাজে নূতন বিক্ষোভ দৃষ্ট হইল। জনসাধারণের মধ্যে শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ প্রচারিত হওয়াতে, তাহারা গরুড়পক্ষী হইয়া ব্রাহ্মণের নিকট করজোড়ে থাকিতে দ্বিধাবোধ করিল। ব্রাহ্মণেরা বাধ্য হইয়া শাস্ত্রগ্রন্থ বাঙ্গলায় প্রচার করিলেন। তাঁহারা ঘোর অনিচ্ছায় ইহা করিয়াছিলেন। এই অনুবাদ কার্য সম্পন্ন করিয়া তাঁহারা শাস্ত্রের অনুবাদ ও শ্রোতাদিগের বাপান্ত করিয়া অভিশাপ দিতে লাগিলেন, ‘অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।’ একদিকে মুসলমান ধর্মের প্রভাব, অপর দিকে বাঙ্গলা ভাষায় ধর্মপ্রচার--এই দুই কারণে বঙ্গীয় জনসাধারণের মন নবভাবে জাগ্রত হইল। শাসন ও রুচি হইতে মুক্ত হইয়া চিন্তাজগতে হিন্দুরা গণতান্ত্রিক হইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণেরাও রাজ্য শাসন হইতে মুক্তি পাইয়া অবাধে স্বীয় মত সমাজে চালাইতে লাগিলেন। এই পাঠান-প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল, এই স্বাধীনতার ফলে বাঙ্গলার প্রতিভার যেরূপ অদ্ভূত বিকাশ পাইয়াছিল, এদেশের ইতিহাসে অন্য কোনও সময়ে তদ্রূপ বিকাশ সচরাচর দেখা যায় নাই।’’

মিথিলার পণ্ডিত চক্রায়ূধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রালোচনার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে উঠে। এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এতই প্রবল হয়ে উঠে যে, নবদ্বীপসম্ভব কোন ব্রাহ্মণ বীর মুসলমানদের বিতাড়িত করে হিন্দু রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে বলে গুজব রটে, ফলে হোসেন শাহ চঞ্চল ও সতর্ক হয়ে উঠেন এবং নবদ্বীপ অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হওয়ায়, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের স্বপ্নসাধ ধ্বসে গেল। রঘুনন্দন, রামনাথ ও রঘুনাথ শিরোমনি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য সংহতির প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই হয়তো রাজনৈতিক স্বার্থে হোসেন শাহ চৈতন্যের মত প্রচারে পরোক্ষ সহায়তা দান করেন।

১১
ব্রাহ্মণ্য দৌরাত্ম্যের বাহন দেবভাষা সাধারণ বাঙালীকে বহুকাল মূক করে রেখেছিল। বাঙালী তার বুকের আশা মুখের ভাষায় বহুকাল প্রকাশ করতে পারেনি। সেন রাজাদের আমলে ‘শূদ্রমাত্রেরই উচ্চ শ্রেণীর লেখাপড়ার অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইল।...এই জনসাধারণ অজ্ঞ ও মূর্খ হইয়া রহিল।’ (দীনেশ সেন--বৃহৎ বঙ্গ)। ব্রাহ্মণ্য শাসনের অক্টোপাস থেকে ছাড়া পেয়ে বাঙালীর যুগযুগান্তের সঞ্চিত আবেগ নানা ধারায় প্রকাশিত হয়ে বাঙালীকে আর্যপ্রভাব মুক্ত পৃথক জাতিরূপে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করল। এমন শুভযুগ বাঙালীর জাতীয় জীবনে এর আগে বা পরে কোনদিন আসে নি।

শেখ শুভোদয়া বা গীতগোবিন্দের ভাষা তো প্রসিদ্ধ গৌড়ীয় রীতির তুলনায় নিকৃষ্ট। শেখ শুভোদয়ার ভাষা তো বিশুদ্ধও নয়, তবু এঁরা দেশীভাষায় গ্রন্থ রচনা করতে সাহস পান নি দেবদ্বিজের ভয়ে। নাথপন্থীদের প্রচেষ্টা এখানে উল্লেখযোগ্য নয়--কারণ হিন্দু বাঙালীর সমাজে তাঁদের কোন প্রভাব ছিল না। সুতরাং একান্তভাবে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার ফলেই বাঙলা ভাষার পুষ্টি ও বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। শুধু কি তাই, মুসলমানেরা কেবল সাহিত্যের উৎসাহদাতা বা পাঠক ছিলেন না, সাহিত্য সৃষ্টিতেওে হাত দিয়েছিলেন হিন্দুদের সাথেই। আর এ ব্যাপারে তাঁদের কোন বাঁধাও ছিল না। বেশীর ভাগ বাঙালী মুসলমান তো হিন্দু থেকেই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। কাজেই অনুকূল পরিবেশ তারা যে মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহবোধ করবে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

১২
তবু পণ্ডিত ও প্রতিভাবানদের কাছে এ ভাষা মধ্যযুগে কোনদিন কদর পায়নি। তাঁরা সংস্কৃত ও ফারসীকেই স্ব স্ব অবদানে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যাঁরা সেবা করেছেন তাঁদের প্রতিভা খুব উঁচু দরের ছিল না। তাই কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম প্রভৃতি যতই পাণ্ডিত্যাভিমান দেখান না কেন, আলাউল, দৌলতকাজী, ভারতচন্দ্র, ঘনরাম যত বড় প্রতিভার পরিচয় দিন না কেন, কেউই সমসাময়িক সংস্কৃত বা ফারসী সাহিত্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট রচনা রেখে যেতে পারেন নি। বাঙলা সাহিত্যের পাঠকদের মতো অধিকাংশ লেখকও যে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, তা নিশ্চিতভাবে বলা চলে। এ জন্যেই চারশ’ বছর ধরে অনুশীলিত হয়েও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য আশানুরূপ ঋদ্ধ হয়ে উঠতে পারে নি। যদিও এসব রচনা রূপকল্পে না হোক, রসকল্পে তথা মনন ভঙ্গীর স্বাতন্ত্র্যে বাঙলার সংস্কৃতির কিছু রূপান্তর ঘটিয়েছিল।

কোন জাতির মুখের বুলিও যে সাহিত্য সৃষ্টির বাহন হতে পারে, তা অসামান্য প্রতিভা ছাড়া কারুর মনে জাগেও না। তাই বাঙলায় হিন্দুদের সাহিত্য ‍সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না, জনগণের মধ্যে লৌকিক দেবতার পূজা প্রচারের আগ্রহ ও গরজই তাঁদেরকে বাঙলা লেখায় প্রবর্তনা দিয়েছে। এজন্যেই হিন্দুর হাতে আমরা নিছক সাহিত্য-শিল্প পাই নি। গোড়া-থেকেই কিন্তু মুসলমানরা এ কাজে হাত দেন। বাঙলার মাধ্যমে ধর্ম-কথা শোনানোর সাথে সাথে উত্তর ভারতীয় ও ইরানী রস-কথাও শোনানোর ব্যাপারে তাঁরা উদ্যোগী হলেন। আধুনিক পাক-ভারতীয় ভাষার মধ্যে সম্ভবত বাঙলা ভাষাতেই প্রথম রোমান্স রচিত হয়। এ কৃতিত্ব ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচয়িতা শাহ্ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪০৯ খৃঃ)। কিন্তু এ প্রয়াস দেখা দেয় সেকালের মুষ্টিমেয় কয়জনের মধ্যে মাত্র। জনসাধারণ তাদের দিকে চেয়ে বসে ছিল না। তাদের সাহিত্যের ভাষা না থাক, মুখের বুলি ছিল। আরো ছিল জৈব-রস পিপাসা ও হৃদয়-নিঃসৃত বক্তব্য। তাই শিল্প সৃষ্টির মহৎ আদর্শে নয়, বক্তব্য প্রকাশেরই জৈব-প্রয়োজনে তাদের নিজ নিজ আঞ্চলিক বুলিতে অঞ্চলবাসীর উদ্দেশে গান, গাথা, ছড়া, বচন, রূপকথা ও রসবার্তা তৈরী করে তারা মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। এগুলোই আমাদের আধুনিক সজ্ঞায় ‘লোক সাহিত্য’ বা ‘পল্লী সাহিত্য’। বহু মুখের স্পর্শে এগুলো রূপ ও রস বদলেছে, তাই এ সব ব্যক্তিক রচনা আর নেই। এ কারণেই এগুলোকে ‘গণ রচনা’ বলে নির্দেশ করা হচ্ছে আজকাল। দেশের লেখ্যভাষায় রচিত নয় বলে, এ সব রচনা কোন কালেই অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারেনি। আগেই বলেছি ‘পল্লী সাহিত্য’ সাহিত্য সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস প্রসূত নয়। অনুভূতির আন্তরিকতা ও গভীরতাই এ গুলোকে সাহিত্যের স্তরে উন্নীত করেছে। আর আজকাল মর্যাদা পাচ্ছে সাহিত্য হিসেবে। আমাদের মঙ্গল কাব্যও বলেছি দেবতার মাহাত্ম্য প্রচার প্রয়াসের ফল। তবু আনুষঙ্গিকভাবে তাতে সাহিত্যরস ও সাহিত্যশিল্প গড়ে উঠেছে। তাই ওগুলোও সাহিত্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

অতএব, অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের মাধ্যম রূপে বা গেঁয়োলোকের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি উপলব্ধি প্রকাশের বাহন রূপে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে, আমাদের বাঙলা বুলির সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরের ইতিহাসও সেরূপ। এর জন্ম তারিখ জানা নেই, তবে এর জন্ম পদ্ধতি ও জন্মের ইতিকথা আঁচ করা যায় সহজেই।

এবার যে-বাঙালী এ সাহিত্য সৃষ্টি করেছে, তাদের মন-মননের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করা যাক। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বুঝবার জন্যে বাঙালীকে তথা বাঙালীর চরিত্র জানা আবশ্যক। কেন না, জীবের বিশেষত মানুষের কর্ম ও আচরণে তার আন্তর সত্তার (Innerself)নিবিড়তম প্রকাশ ঘটে। মানুষের কর্ম ও আচরণ তার অভিপ্রায়েরই বহিঃপ্রকাশ। আর অভিপ্রায় হচ্ছে মন-মনন প্রসূত। এবং ব্যক্তির বা জাতির মন-মনন গড়ে উঠে তার (Heredity জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বৃত্তি-প্রবৃত্তি) ও environment কে (পরিবেশ) ভিত্তি করে। যেহেতু মানুষের কর্ম ও আচরণ তার ভাব-চিন্তা ও অনুভূতি-উপলব্ধিরই প্রতিমূর্তি, এবং যেহেতু ভাষা-সাহিত্যও জাতির কর্ম ও আচরণের অন্তর্গত, সেহেতু ভাষা ও সাহিত্য ব্যক্তি বা জাতির মানস-সন্তান--মানস ফসল। আবার আমরা এও জানি, প্রত্যেক ক্রিয়ারই কারণ রয়েছে, তেমনি সব কারণেরই ক্রিয়া আছে। কিন্তু ক্রিয়ার কারণ একাধিক হতে পারে। যেমন, কোথাও যদি আমরা দূর থেকে দেখি যে, আমাদের অপরিচিত একটি ছেলে অপর একটি ছেলের পিঠে একটি ঘুষি বসিয়ে দিল, তাহলে এ ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না। কেন না, এর তিনটি কারণ থাকতে পারে। এক, হয়তো এরা বন্ধু, রসিকতাচ্ছলে একে অপরকে ঘুষি মারল; দুই, হয়তো ঘুষি-খাওয়া ছেলেটি আগে ওকে চটিয়েছে, তাই ও প্রতিশোধ নিল; তিন, হয়তো ঘুষি-দাতা ছেলেটি অন্য একটি ঘটনার বর্ণনাচ্ছলে ঘুষিটি কোথায় কেমন করে দেয়া হয়েছিল, তারই বাস্তব দৃষ্টান্ত দিচ্ছে। কাজেই ঘটনার বিশ্লেষণে ও বিচারে পূর্ব-ইতিহাস জানা আবশ্যিক। কারণ আমরা জানি, ব্যক্তিকে না জানলে তার কর্ম ও আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তার ফলে ব্যক্তির কর্ম ও আচরণের গুরুত্ব লঘু্ত্ব ও যথার্থ্য বিচারেও ভুল হয়। যাকে সত্যবাদী বলে জানি, সে একটা প্রায় অসম্ভব কথা বললেও পূর্বধারণাবশে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয়, আর মিথ্যাবাদীর মুখের সত্যকথাও যাচাই না করে প্রত্যয় করা সম্ভব হয় না। কাজেই বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি তথা স্বরূপ জানতে হলে বাঙালীর চরিত্রও জানা দরকার। আর চরিত্র জানতে হলে অতীতে-ঘটা পৌনঃ পুনিক ক্রিয়া ও আচরণের সাধারণ লক্ষণ বিচারেই তা সম্ভব।

আগেই বলেছি, বাঙালী সঙ্কর জাতি। নানা গোত্রের রক্তের মিশ্রণের ফলে বিভিন্ন চারিত্রিক উপাদানের বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছে তাদের জীবনে।

এর ফলে বাঙালী চরিত্রে নানা বিরুদ্ধগুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। ভাবপ্রবণতা ও তীক্ষ্মবুদ্ধি, ভোগলিপ্সা ও বৈরাগ্য, কর্মকুণ্ঠা ও উচ্চাভিলাষ, ভীরুতা ও অদম্যতা, স্বার্থপরতা ও আদর্শবাদ, বন্ধনভীরুতা ও কাঙালপনা প্রভৃতি ও দ্বান্দ্বিক গুণই বাঙালী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

বাঙালী ভাবপ্রবণ ও কল্পনাপ্রিয়। উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনাতেই এর প্রকাশ। তাই বাঙালী যখন কাঁদে, তখন কেঁদে ভাসায়। আর যখন হাসে তখন সে দাঁত রে করেই হাসে। যখন উত্তেজিত হয়, তখন আগুন জ্বালায়। তার সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত। তার অনুভূতি--ফলে অভিভূতি--গভীর। কেঁদে ভাসানো, হেসে লুটানো আর আগুন জ্বালানো আছে বটে, কিন্তু কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়--যেহেতু উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা মাত্রেই তাৎক্ষণিক ও ক্ষণজীবি। বাঙালীর গীতি প্রবণতার উৎস এখানেই।

কালো পিঁপড়ের মত বাঙালী অতিচালাক। তাই সে ধূর্ততা যত জানে বুদ্ধির সুপ্রয়োগ তত জানে না, ফলে আত্মরক্ষা ও স্বার্থপরতার হীন প্রয়োগে তার তীক্ষ্মবুদ্ধি কলুষিত হয়, আত্মপ্রতিষ্ঠার মহৎ প্রয়াসে প্রযুক্ত হয় না। তাই তার সঙ্ঘশক্তি নেই, ব্যবহারিক জীবনের উন্নয়নে বুদ্ধির অবদান গ্রহণে সে অক্ষম।

ভাবপ্রবণ বলেই বাঙালী মুখে আদর্শবাদী ও বৈরাগ্য ধর্মী। কিন্তু প্রবৃত্তিতে সে একান্তভাবে অধ্যাত্মবাদীর ভাষায় ‘বস্তুবাদী’, গণভাষায় ‘জীবনবাদী’ এবং নীতিবিদের ভাষায় ‘ভোগবাদী’। এ জন্যে বাঙলাদেশে জীবনবাদ বা ভোগবাদ অধ্যাত্মচিন্তার উপর বার বার জয়ী হয়েছে। নৈরাত্ম্য ও নিরীশ্বরবাদী এবং নির্বাণকামী বৌদ্ধধর্ম বাঙালী মুখে স্বীকার করে নিয়েছিল মাত্র, সে জন্যেই তার অন্তরের জীবন সাধনা ধর্মের উপর জয়ী হল, তাই বৌদ্ধচৈত্য হল, দেব-দেবীর আখড়া। নির্বাণের নয়--জীবনের ও জীবিকার আরাম ও বিলাসের দেবতা রূপে পূজিত হলেন তাঁরা। পারত্রিক নির্বাণ নয়, ঐহিক ভোগই হল কাম্য। যেহেতু বাঙালী কর্মকুণ্ঠ, তাই পৌরুষের দ্বারা আত্মপ্রতিষ্ঠা বা জীবনোপভোগের প্রয়াস তাদের ছিল না। মহাজ্ঞান, তুক্-তাক্, ডাকিনী-যোগিনী প্রভৃতির দ্বারা ‘সিসম ফাঁক’ আয়ত্ত করে খিড়কীদ্বার দিয়ে জীবনের ভোগ্য সম্পদ আহরণের অপপ্রয়াসই তাদের কর্মাদর্শ বা জীবনের লক্ষ্য হ’ল। পালদের আমল এমনি করেই কাটল। আবার সেন আমলে যখন শঙ্করাচার্যের শিষ্য উপশিষ্যেরা সেন রাজশক্তির সহায়তায় এদেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রবর্তন করেন, তখন বাঙালী বাহ্যত ব্রাহ্মণ্য মতবাদ গ্রহন করে নিল, কিন্তু হৃদয়ে জিইয়ে রাখল তার জীবন-বিলাসের আকাঙ্খা। তাই ‘মায়াবাদ’, পরব্রহ্মপ্রীতি, জীবাত্মা-পরমাত্মার রহস্য প্রভৃতিতে তার কোন উৎসাহ ছিল না। শুধু তাই নয়, এতে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাই নিজের জীবনে নিরাপত্তা ও ভোগের দেবতা সৃষ্টি করে সে আশ্বস্ত হয়। এভাবে চণ্ডী (অন্নদা, দুর্গা), মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি, লক্ষ্মী, স্বরস্বতী প্রভৃতি দেবতার পূজা দিয়ে সে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়। এ সব দেবতা তার পারলৌকিক মুক্তির কিংবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নের কোন ব্যবস্থা করতে পারেন না। একই কারণে ইসলামোত্তর যুগে, বিশেষত মুঘল আমলে বাঙলা দেশে হিন্দুর পুরোনো দেবতাকে ও ইসলামের নির্দেশকে ছাপিয়ে উঠেন সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, বনবিবি-বনদেবী, কালুগাজী-কালুরায়, বড়খাঁ গাজী-দক্ষিণ রায়, ওলাবিবি-শীতলা প্রভৃতি জীবন ও জীবিকার ইষ্ট দেবতা। অতএব কোন বৃহৎ ও মহতের সাধনা সাধারণ বাঙালীর কোন কালেই ছিল না। সে একান্তভাবেই জীবন-সেবী ও ভোগবাদী। এ ব্যাপারে সে আত্মা-পরমাত্মাকে তুচ্ছ জেনেছে, স্বর্গ-নরককে করেছে অবহেলা। বৈষ্ণব সমাজের বিকৃতিও এই একই মানসের ফল। যেখানেই সে ভোগের সামগ্রী দেখেছে, সেখানে তার লুব্ধচিত্ত কাঙাল হয়েছে। পৌরুষ তার ছিল না। ভীরুতা ও কর্মকুণ্ঠা তার মজ্জাগত। তাই জীবনধারণের প্রয়োজনে দেব-নির্ভর তথা অপ্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তি ও উপায় খোঁজাই ছিল তার আদর্শ। তবে লোভের তীব্রতায় এবং ত্রস্ত জীবনের মমতায় কখনো কখনো সে ক্ষণকালের জন্যে মরীয়া হয়ে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে নেমেছে, সে সাহস দেখিয়েছে। কিন্তু জৈব ধর্ম বিরোধী নির্জলা অধ্যাত্ম-চিন্তা তাকে প্রলুব্ধ করে নি। সে আদর্শবাদের বন্ধনভীরু এবং জীবন-সাধনায় ও ভোগে অদম্য।

বাঙলার ও বাঙালীর যা গৌরব-গর্বের অবদান, তা সব সময়েই ছিল ব্যক্তিক অবদান, সামগ্রিক জীবনে তা ক্বচিৎ ফলপ্রসূ হয়েছে। তাই বাঙালী মহৎ পুরুষদের মহা অবদানের ফলভোগে ধন্য হতে পারেনি তারা। এই বাঙলা দেশেই চিরকাল নতুন চিন্তা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু লালন পেয়েছে সামান্য। তবু যখন আমরা স্মরণ করি এই মাটির বুকেই--এই মানুষের মনোভূমেই উপ্ত হয়েছিল বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান, কায়াবাদ, নবন্যায়, নবস্মৃতি, নবপ্রেমবাদ, ওহাবী-ফরায়েজী মতবাদ কিংবা ব্রাহ্মদর্শন; তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠে। আবার যখন স্মরণ করি, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, দীপঙ্কর, শীলভদ্র, জীমূতবাহন, রামনাথ, রঘুনাথ, চৈতন্যদেব, রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, তীতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এদেশেরই সন্তান, তখনো নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।

আমাদের মধ্যযুগীয় পাঁচালী সাহিত্যে বাঙালীর এই চরিত্র--এই মানসই ফুটে উঠেছে। আমাদের সাহিত্যে তাই ইষ্ট দেবতাই প্রধান হয়ে উঠেছেন। কারণ তিনি জীবন-জীবিকার অবলম্বন। তবু তার প্রাণ-প্রাচুর্যের লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার স্ব-ধর্মে সুস্থিরতায়। বহিরাগত কোন ধর্মই সে মনে-প্রাণে বরণ করে নেয় নি। এ স্বাতন্ত্র্য ও অনমনীয়তা এ কালে ক্ষেত্র বিশেষে তার মর্যাদা বাড়িয়েছে।


লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
আহমদ শরীফ ( ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২১ - ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯)
একজন বাংলাদেশী ভাষাবিদ, খ্যাতনামা মনীষী এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতি পরিমণ্ডলের অন্যতম প্রতিভূ। তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দুর্লভ অমূল্য পুঁথির ভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকার সম্ভারের মধ্যে। তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য। যা ইতিহাসের অন্যতম দলিল। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য, তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজে ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাঁথা হয়ে থাকবে। তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ লায়লী মজনু ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এই নামে দৌলত উজির বাহরাম খানও একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মৌলিক গ্রন্থ বিচিত চিন্তা প্রকাশ হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ