bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

কোনও দিনই কিছু হয়ে ওঠার তাড়া ছিল না ꘡ দেবেশ রায়

দেশ-এ আমার গল্প পরের সংখ্যায় বেরবে, এই খবর দিয়ে সাগরময় ঘোষের খাড়া অক্ষরে লেখা একটা পোস্টকার্ড বৃষ্টিভেজা সাত-সকালে আমার ছোটভাই সমরেশ সাইকেল চালিয়ে যখন আমাদের আনন্দ চন্দ্র কলেজে (জলপাইগুড়ি) পৌঁছে দিল, তখন আমি কলেজের ছাদের ওপর একটা ত্রিপলের দড়ি টানাটানি করছি বন্ধুদের সঙ্গে। দিনটা ছিল ২ সেপ্টেম্বর— আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস। আমি কলেজ ইউনিয়নের মাতব্বর। ঠিক করেছি, কলেজের মাঠেই অনুষ্ঠান হবে। সেই সব কাজে রাতে কলেজেই ছিলাম সবাই মিলে। শেষ রাত থেকে বৃষ্টি। তাই সকালে বাড়তি কাজ— ত্রিপল টাঙানো। পরের সপ্তাহের দেশ-এ বেরিয়েছিল ‘হাড়কাটা’, ১৯৫৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। আমার বয়স তখন উনিশ। তখনকার থার্ড ইয়ারে পড়ি।

এর বছর পনেরো পরে, জলপাইগুড়ির ডাকোটা প্লেন সার্ভিসের অফিস থেকে আমার একটা পার্সেল এসেছে ফোন পেয়ে সমরেশই, সেই সাইকেল করেই, পার্সেলটা আনতে গিয়ে দেখল সাইকেলে আনার পক্ষে ওটা একটু বড় ও ভারী। সুতরাং রিকশাই নিতে হল। বাড়িতে পার্সেল খুলে দেখল আমার প্রথম বই, ‘দেবেশ রায়ের গল্প’। আমি বাড়িতে ছিলাম না। তখন, ১৯৬৯ সালে, আমি ওই কলেজেই বছর দশেক পড়াচ্ছি, রাজনীতি করছি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। যুক্তফ্রন্টের নেতা। বাবা নেই, আমার পিতৃতুল্য অধ্যাপক অমূল্যচন্দ্র মিত্র নেই। তাঁদের দুজনকেই উৎসর্গ করেছিলাম বইটি। দাদা আন্দামানে, ভারত সরকারের চাকরিতে। দিদিদের ও বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমারও। কাকলি শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনে। ১৯৬৮-র অক্টোবরে জলপাইগুড়ির প্রলয়বন্যা হয়ে গিয়েছে। তখনও আমরা ফ্রি রেশন পাচ্ছি। আমার প্রথম বই বলতে এটাই। শুধু প্রথম বই-ই নয়, অনেক দিন পর্যন্ত এটাই ছিল আমার একমাত্র বই। বয়স তখন তেত্রিশ।

প্রথম গল্প বেরবার প্রায় পনেরো বছর পর, আটটি মাত্র গল্প নিয়ে অবশেষে আমার প্রথম বই বেরল কেন? এই পনেরো বছর পত্রপত্রিকায় গোটা উপন্যাস, ধারাবাহিক উপন্যাস, গল্পের পর গল্প অনবরত বেরিয়ে গেছে— ‘পরিচয়’, ‘এক্ষণ’, ‘দেশ’ ইত্যাদি আরও সব বিখ্যাত, বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক কাগজে। তার ভিতর কিছু গল্প নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে, ছোটগল্পের নামকরণ, ধরনধারণ, আকারপ্রকার নিয়ে দশ কথাও হয়েছে। ‘ছোটগল্প: নতুন রীতি’ বলে একটা আওয়াজও উঠেছে, ‘যযাতি’ বেরিয়েছে, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’, হয়তো ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’-এর দু-এক টুকরোও বেরিয়েছে, প্রবন্ধ, সমালোচনাও। মানে আমি দস্তুরমত লেখক এই পনেরো বছর ধরে, স্বাধিকারেই, সৌজন্যবশত নয়। কিন্তু বই বেরয়নি।

মনখারাপ হত না? ইচ্ছে করত না? টাইমও পেতাম না, কেয়ারও করতাম না। আমি তো জলপাইগুড়ির ছেলে। উত্তরবঙ্গেরও। কলেজে পড়াই, বিশ্ববিদ্যালয়ের এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের মেম্বারগিরি করি, পার্টির নেতাগিরি করি, কাকলির গান শুনি, কলেজ লাইব্রেরি আর বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি উজাড় করে পড়ি। দিনরাত এতই ব্যস্ত যে, মনখারাপ করার সময়ই পেতাম না। এ সবের মধ্যে নিজের লেখা তো লিখতেই হত, নিজের পড়াও পড়তেই হত। আমার একটা বই হওয়া দরকার— এমন প্রয়োজনবোধ কখনও কাঁধে চেপে বসত না। এই লেখায় যে ব্যস্ততার কথা লিখছি, তার সবটাই স্মৃতিকথা। আমার মধ্যে, মানে, আমার স্বভাবেই ব্যস্ততা বলেও কিছু নেই, সময়াভাব বলেও কিছু নেই। কিছু হয়ে ওঠার তাড়াও নেই। আমার কাজ নিজের মতো লেখা। নিজের বই বের করা নয়। সব কিছুর জন্যই যেন অজস্র সময় আছে। বোধহয় দুটো জীবন ছিল আমার। বা প্রায় দুটো। একটা জলপাইগুড়ির। সেখানে আমি লেখক ছাড়া সব কিছু, বা সব কিছুর মধ্যে লেখকও। আর একটা জীবন কলকাতার। সেখানে আমি লেখক ছাড়া আর কিছু নই। মাঝেমধ্যে কলকাতায় যখন আসতাম, হয়তো ভাবতাম, একটা বই হলে হত।

তেমনই এক বার কথাটা যেন কোনও বন্ধু বললেন। বন্ধু কবি তরুণ সান্যাল আমাকে নিয়ে গেলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি। তাঁদের পুরনো প্রকাশনা ব্যবসা আছে। এক ভাই, মুকুলবাবু সেটা দেখাশোনা করেন। ওঁরা তরুণের কথায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি। কফি হাউসে বিকেলে দীপেনকে (দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) বললাম। কী কী গল্প দেওয়া যায়, তাই নিয়ে একটু কথা হল। দীপেন জিজ্ঞেস করল মলাট কে করলে ভাল হয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘পৃথ্বীশ’। কফি হাউস বন্ধ হওয়ার পর নীচে ফুটপাথে আর রকে আরও কিছু ক্ষণ আড্ডা চলত। সেখানেই পৃথ্বীশকে পাওয়া গেল। দীপেন বলল পৃথ্বীশকে। পৃথ্বীশের জবাবটা মনে আছে— দেবেশ রায়ের বইয়ের মলাট আমি ছাড়া কে আঁকবে? নামটা কী বইয়ের? নামটা ভাবা ছিল আমার। তখন ‘সমর সেনের কবিতা’ বইটি বেরিয়েছে, ‘কবিতা’র আগে কোনও বিশেষণ ছাড়া। আমার খুব স্মার্ট লেগেছিল। যে গল্প একমাত্র আমারই, সে গল্পের একটা সর্বজনীন নাম হবে কেন? কিন্তু গল্পের বইয়ের অমন নাম কল্পনাও করা যেত না। আমি একটু লজ্জা নিয়েই নামটা বললাম। কফি হাউস-ভাঙা ভিড়টা একেবারে হইহই করে উঠল। একটু তো চালিয়াতি ছিলই। ‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’, ‘দুপুর’, ‘পা’, ‘কলকাতা ও গোপাল’, ‘পশ্চাৎভূমি’, ‘ইচ্ছামতী’, ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’, ও ‘উদ্বাস্তু’— এই আটটি গল্প নিয়ে আমার প্রথম বইটির এই নাম একটু উদ্ধতই ছিল, তখনকার বয়সের পক্ষে। কিন্তু বইটা তো বেরতে পারত বা বেরনো উচিত ছিল বছর দশেক আগে। চালিয়াতিটা সে বয়সেরও কি অবয়সোচিত ছিল?

‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’ পর্যন্ত সব বই আমার নিজের পয়সায় ছাপানো। এক দিন সুবীর ভট্টাচার্য এসে বললেন, দে’জ পাবলিশিং আমার বই বের করতে চায়। তাঁরা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ করলেন। তাঁরাই আমার প্রধান, বা বলা চলে একমাত্র প্রকাশক। দু-একটা বই হয়তো অন্য প্রকাশকও করেছেন বা করেন। কিন্তু আমি যা-ই লিখি, দে’জ তা-ই বের করে। কত বই লিখেছি তার হিসেব জানি না। ওই যা বলেছি, আমার সময়াভাবও নেই, ব্যস্ততাও নেই, সব কিছুর জন্যই সময় আছে। আমার সব বইয়েরই নাম, এমনকী যে বই লেখা হয়নি, তারও নাম, জলছবিতে ছাপা। আমার সেই প্রথম বইটির নাম ‘দেবেশ রায়ের গল্প’।


ᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃᐁᐃ

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

দেবেশ রায় (১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৬ — ১৪ মে, ২০২০)

দেবেশ রায় বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যিক। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে।  দেশভাগের কিছু আগে, ১৯৪৩ সালে, তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে যান। তাঁর বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতির সূত্রে শিখেছিলেন রাজবংশী ভাষা। কলকাতা শহরেও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে তিনি এক দশক পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা করেন।  তাঁর প্রথম উপন্যাস যযাতি। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল: মানুষ খুন করে কেন (১৯৭৬), মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), তিস্তা পারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), লগন গান্ধার (১৯৯৫), বরিশালের যোগেন মণ্ডল (২০১০)। তিস্তা পারের বৃত্তান্ত উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৯০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন ছকভাঙা আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসাবে পরিচিত ছিলেন।

তাঁর অন্যান্য উপন্যাস: আত্মীয় বৃত্তান্ত; শিল্পায়নের প্রতিবেদন; দাঙ্গার প্রতিবেদন; খরার প্রতিবেদন; তিস্তাপুরাণ; আঙিনা; ইতিহাসের লোকজন, উচ্চিন্নো উচ্চারণ; একটি ইচ্ছা মৃত্যুর প্রতিবেদন; চেতাকে নিয়ে চীবর; জন্ম; তারাশংকর:নিরন্তর দেশ; নবেলজোড়; বেঁছে বততে থাকা; শিল্পায়নের প্রতিবেদন; মার-বেতালের পুরান; যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ ও সহমরণ।
গল্পগ্রন্থ/সংকলন: দেবেশ রায়ের গল্প (১৯৬৯), দুই দশক (১৯৮২), দেবেশ রায়ের ছোটগল্প (১৯৮৮), স্মৃতিহীন বিস্মৃতিহীন (১৯৯১)।
প্রবন্ধগ্রন্থ: রবীন্দ্রনাথ ও তার আদি গদ্য; সময় সমকাল; উপন্যাস নিয়ে; উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে; শিল্পের প্রত্যহে; উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য; মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়: নিরন্তর মানুষ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ