bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

রায়হান রহমান রাহিমের গল্প ꘡ কাটা ঘুড়ি

মাঝে মাঝে হরিণখোলার কথা খুব মনে পড়ে শওকতের ৷ এই তো কিছুদিন আগে অনলের মেয়েটা গ্রামের দৃশ্য এঁকে দাদাকে দেখাতে নিয়ে এলো ৷ শওকত সুপুরি কাটছিলো, তন্দ্রা এসে একদম ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকের উপর ৷ বয়স হয়েছে, এখন আর এত সয় না আগের মতন ৷ হুট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল তার ৷ কিন্তু নাতনীর আঁকা ছবিতে সে যেন বাড়ির বড় ঘরটার সামনে গনু মোল্লার গমক্ষেতটা, ছোট কাউনি নদীটা দেখতে পেল অবিকল ৷ মৃত্যু কি আসন্ন, নইলে ঘন ঘন এত স্মৃতিকাতরতা কেন পেয়ে বসে তাকে?

শওকত চাকরিতে ঢুকেছিল ৮১'র নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ৷ সেবার শীত পড়েনি খুব একটা ৷ লাইভস্টকে কেরানির চাকরিটা পেয়ে কি বাঁচাটাই না বেঁচেছিল— তা মনে পড়লে আজও শওকতের বুক থেকে পাথর নামার মতন আরাম হয় ৷ অনল তখন শাহিনার পেটে ৷ শাহিনারই বা কত বয়স তখন? মেট্রিক দিতে পারলনা ৷ তার আগেই বিয়েটা করতে হয়েছিল ৷ সুন্দরগঞ্জ বাজারের কাজী অফিসে বিয়ের সাক্ষী ছিল নবী আর শফিক ৷ নবীই সাহস দিচ্ছিল শওকতকে ৷ ছাত্র রাজনীতি করতো নবী, সেই তো পুলিশের গুলিতেই মরল শেষমেশ ৷ শফিক গত বছর স্ট্রোকে মারা গেছে নিউইয়র্কে ৷ পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে এই পড়তি বিকেলের ছাদে শওকতের নিজেকে মনে হয় মহাকালের খড়কুটো ৷ শওকত কি আসলেও তাই, নাকি এও কেবল একধরনের বয়সী ভাবালুতা ?

অনল-মুনিরার সংসারে শওকতের দমবন্ধ লাগে ৷ নাহ, ছেলে তাকে মন্দ রাখেনি ৷ সিজনাল ফল খাওয়াচ্ছে, দুধও রোজ করেছে বুড়ো বাপের জন্য ৷ তবু, মুনিরার সাথে অনলের এমন অকারন মাখামাখি, ঘরে ফিরে "বৌ বৌ" করা শওকতের ভাল লাগে না ৷ অনল সকালেই বেরিয়ে যায় ৷ কতদূর আশুলিয়া তার অফিস ৷ মুনিরা বের হয় দশটার দিকে, মেয়েসহ ৷ নিজের ইস্কুলেই মেয়েকে ভর্তি করেছে মুনিরা ৷ ছুটি হলে মা মেয়ে একসাথেই ফেরে ৷ শ্বশুরের জন্য ফ্রিজে রান্না তোলা থাকে ৷ ঘরে শওকতের কাজ বলতে ঐ রান্না গরম করে দুপুরের দিকে খাওয়া পর্যন্তই ৷ তবু শওকত টের পায়— হাত পা গুলোতে কেমন শেকড় গজিয়ে উঠেছে তার ৷

আজ এক মাস হতে চললো সবাই ঘরে বন্দী ৷ কি জানি ভাইরাস এসেছে শহরে ৷ বাতাসে ছড়ায় বলে  ঘর থেকে বেরুচ্ছেনা কেউ ৷ আগে শওকত বিকেলের দিকটায় হাউজিং লিমিটেডের শেষ মাথায় চায়ের দোকানটা অবধি একটু হাঁটতে বেরুতো ৷ অবসরের পর মোটামুটি বিকেলের এই সময়টাতেই শওকত পৃথিবীর সাথে নিজেকে একটু সম্পৃক্ত অনুভব করে ৷ সম্পৃক্ততার উৎসাহে প্রায় বিকেলেই একটা না একটা কিছু কিনে ঘরে ফিরতো শওকত আলী ৷ কোনদিন লাই শাকের মুঠি, কোনদিন কচুর মূল, কোনদিন বা শাপলার ভেট ভ্যানে করে বিক্রি হয় ৷ শওকত বুঝতে পারে মুনিরা বেশিরভাগ সময়ই এইসব জিনিসকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করে উটকো ঝামেলা মনে করে ৷ তবু এটুকু সম্পৃক্ততার আনন্দ কিংবা ব্যস্ততা শওকতকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে বেশ সহায়তা করে ৷ আজ একমাস হলো শওকত ঘর থেকে বের হতে পারছেনা ৷ অনল ও বৌ-বাচ্চা সহ ঘরবন্দি, শুধু সপ্তাহান্তে বাজার করতে বের হয় দু'জন ৷ বিকেলের দিকটায় বুড়ো শওকতের বেশ ছটফট লাগে ৷ তাই এই ক'দিনে বিকেল দিকে সে ছাদে উঠে বসে থাকে ৷ ছোট ছোট ঘর,উঁচু উঁচু বাড়িতে শহরের ঘরগুলিকে লাগে যেন কবুতরের খোপ ৷ এটুকই ৷ পাখির ঘরবন্দি বিষাদ শওকতকে চিড়ে খায়, সে বুঝতে পারেনা তাই তুচ্ছ বোধে প্রতিটা সন্ধ্যার সাথে সাথে নিজেকে বেশ অবসন্ন মনে হয়;  পুরনো দিনগুলো ঘুরে ফিরে আচড় কেটে আহত করে যায় তাকে--মৃত্যুকে দেখবার সাধ জাগে তার মনে ৷

আজ মঙ্গলবার ৷ প্রতিদিনের মতন আজও রোদ পড়তে না পড়তে প্লাস্টিকের চেয়ারটি হাতে করে ছাদে এসে বসে আছে শওকত আলী ৷ চৌদ্দ তলা বিল্ডিংয়ের নবম তলায় ছেলের বাসা ৷ লিফট আছে ৷ শাহিনা কোনদিনই দেখতে পেল না এসব ৷ একটা ছোট মশা পায়ের কাছে বসতেই শওকত তাকে উড়িয়ে দিতে দিতে ভাবে শাহিনার কি কষ্ট ছিল ৷ আত্মহত্যা করল কেন শাহিনা? শওকত তো কোনদিনই চায়নি শাহিনার বাপ মা'র অমতে তাদের বিয়েটা হোক ৷ শাহিনাই চাপাচাপি করছিল ৷ তার দু'বছর বাদে অনল এলো ওর পেটে ৷ নতুন চাকরি, কোয়ার্টার জীবন— গ্রামেও রাখেনি শওকত শাহিনাকে ৷ অথচ শাহিনার চলে যাবার পর কত মানুষের থেকে কত কথা শুনেছে সে ৷ পুলিশও তো এসেছিল, অনল তখন দুধের বাচ্চা ৷ কত বিশ্রী বিশ্রী প্রশ্ন, শওকতের এখনো সেসব ভাবলে নিজেকে প্রচন্ড ছোট এবং একা লাগে ৷ 'শাহিনা, যদি একটাবার বইলা যাইতা কেন এমন করলা? '—  বাতাসে বারি খায় শব্দরাজি ৷ সম্বিৎ ফিরে পায় শওকত ৷ নাহ ছাদে কেউ নেই ৷

চোখও তার শক্তি হারাচ্ছে দিন দিন ৷ ইদানিং ছাদে উঠলেই শওকত দেখে একদল ছোট ছোট ছেলেপিলে ঘুড়ি উড়াচ্ছে ছাদে বসে ৷ রং বুঝেনা, শুধুই অবয়বে অবয়বে ভাবনার ডট জোড়া লেগে ছুটে যায় হরিণখোলা গ্রামের বৈশাখী বিকাল গুলিতে ৷ ধান কাটা শেষ হলে সুন্দরগঞ্জ বাজারে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগীতার দিন তারিখ ঠিক করতো ব্যাপারীর ছেলেরা ৷ নির্ধারিত দিনে হরিণখোলার বড় মাঠে বসতো ঘুড্ডি উড়ানির 'বান্নি' ৷ বান্নিই ডাকতো তারা ৷ মেলার চেয়েও বড় ৷ কত কত ঘুড্ডি, কী জাঁদরেল সব নাম! সাগুফতা, আড়িয়াল খান, বাঁশপাতা, প্যাঁচ্চা সহ আরো অনেক নামে আকাশ শাসন করা প্রাগৈতাহাসিক ঘুড়ির দল কেটে ও কাটা হয়ে নেমে আসতো শওকতদের মাঠে, দাওয়ায় আর সিঁড়িঘরের পুকুরের ঘাটের পাড়ে ৷ ছোট্ট শওকত তাদের পেছনে কত দিন ছুটেছে! আব্বার ভয়ে একটা ঘুড়িও কিনতে পারেনি কোনদিন—  আজ সেসব কথা কেমন যেন পৌরণিক কাহিনীর মতন লাগে তার কাছে ৷

শওকত সেসব কথাই ভাবছিলো ৷ এখনো তো বৈশাখ মাস ৷ হঠাৎ করেই ধরে আসে আকাশটা ৷ বৃষ্টি আসবে না ৷ ওটুকু ঋতুর শহুরে আস্ফালন ৷ গর্জে, বর্ষে না ৷ শওকত তবু উঠে যাবে যাবে চিন্তা করতেই একটা হলুদ রঙের শীর্ণ ঘুড়ি ঠাস করে তার পায়ের সামনে গোত্তা খেয়ে পড়ে যায় ৷ কাটা ঘুড়ি ৷ তড়াক করে উঠে বসে সে ৷ এগিয়ে যায় ঘুড়িটার দিকে আর বুকে ঢিপঢিপানি বাড়ে তার ৷ জানুয়ারীতে তেপ্পান্ন হল বয়স— তবু মন উত্তেজনা দমাতে পারেনি ৷ ঘুড়িটা হাতে নিয়েই শওকত বুঝতে পারে কেউ কাউকে কেটেছে—  এ ঘুড়ি তারই স্মারক ৷ শওকত কাটা ঘুড়িটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ ৷ আব্বার ভয় নাই এখানে, মুনিরার কাছে কি একটু সুঁতো পাওয়া যাবে না? শওকতের গলার কাছে আনন্দ পাক খেতে থাকে ৷

একটু আগের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ এখন ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে শুরু করেছে ৷ সন্ধ্যার আগে এখানে এখন মহাকাল স্থির, মৌন বুদ্ধের মত ৷ মৌনতা ভেঙে ঐ দূরে কোথাও মেঘ ডেকে উঠলো ৷ সম্ভবত প্রকৃতি তার ক্যামেরা বের করে তৈরি হচ্ছে ৷ শওকত, তার হাতের হলুদ কাটা ঘুড়িটা সমেত আবহমান সন্ধ্যার একটা ছবি তুলবার চেষ্টা করছে ৷ সে ছবি নিজের কাছে বাঁধাই করে রেখে দেবার অনন্ত ইচ্ছা তার ৷


লেখক পরিচিতি:
রায়হান রহমান রাহিম (জন্ম ১৯৯৮)
রায়হান রহমান রাহিম নবীন গল্পকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিষয়ের শিক্ষার্থী। জন্মস্থান হবিগঞ্জের মাধবপুর ৷ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে অধ্যয়নরত ৷
প্রথম গল্প প্রকাশিত গল্প, কবর (২০১৯) । "কাটা ঘুড়ি" তার ২য় গল্প।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. মারুফ হুসাইন৩১ মে, ২০২০ এ ১:০৬ PM

    ভালো লেগেছে। তরুণ লেখকের জন্য শুভকামনা রইলো। এগিয়ে যাক অনেক দূর।

    উত্তরমুছুন