bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

দেশের লোকসাহিত্যচর্চায় এখনও সামগ্রিকতা আসেনি--সুমনকুমার দাশ


যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এখন ম্যাসেঞ্জার। ম্যাসেঞ্জারে হাই, হ্যালো চলতে থাকে! কবি, কথাসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী—কেউ বাদ পড়েন না। হাই, হ্যালো ছাড়িয়ে চ্যাটিং গড়াচ্ছে বিভিন্ন চিন্তামূলক আলাপে। সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক মেহেদী উল্লাহ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে এমনই চিন্তামূলক চ্যাটিং আয়োজন--'হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার' (Half an hour chatting about culture) প্রকাশ করছেন। বলে রাখা ভালো, আমাদের বিগতকালের লেখক-বুদ্ধিজীবীগণের সংস্কৃতি বিষয়ক বহুবিধ ও বহুমাত্রিক চিন্তা তাঁদের রচিত গ্রন্থগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের সময়ের চিন্তার সাথে বর্তমান সময়ের লেখক-বুদ্ধিজীবীর চিন্তার তূলনামূলক এই পাঠ এক অতি বড় সুযোগ। আমরা মেহেদী উল্লাহ’র এমন উদ্যোগকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করি। তাই এটির সংকলন ও প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। গতিপথ বাংলা ওয়েবজিনের আলাপ-সিরিজে প্রতি রবিবার মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার এর একটি করে পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে।

আলাপ সিরিজ : মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার পর্ব-৬

মেহেদী উল্লাহ’র টাইমলাইন: মঙ্গলবার, ১৯ মে ২০২০; রাত ৯ টা ৪২ মিনিট

আজ থাকছেন ফোকলোর গবেষক সুমনকুমার দাশ (Sumankumar Dash)। সংস্কৃতি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে—

মেহেদী উল্লাহ : অনেকেই এ রকম তর্ক তুলেছেন বা তুলছেন, 'লোকসংস্কৃতি'র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত 'লোক' শব্দটি ব্যবহার করে সমাজের একটি শ্রেণিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হচ্ছে, অর্থাৎ, লোকসংস্কৃতি বলা মানে, এর বিপরীতে প্রধান কোনো সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু লোকসংস্কৃতিই বাংলাদেশের স্থানীয় সংস্কৃতি, সংস্কৃতির শেকড়—এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সুমনকুমার দাশ : আমরা ‘নাগরিক সমাজ’ যেটাকে ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করি, সেটা আসলে কী? এই চিহ্নিত করা অংশের বাইরের যে সংস্কৃতি, সেটা তাহলে কোন পর্যায়ে পড়ে? আসল কথা হলো, পুরো বিষয়টিই কথার মারপ্যাঁচ আর একটি নির্দিষ্ট মহলের ধারণাজাত তৈরি করা শব্দ। যেটাকে আমরা ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করছি, সেটাই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের মূল এবং আদিসংস্কৃতি। গ্রামীণ জনপদের মানুষের জীবনযাপন আর আচার-আচরণ থেকেই সংস্কৃতির পরম্পরা তৈরি হয়েছে। পরে, বন্দর বা নাগরিক সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও নানামুখী ধারার বিস্তার এবং প্রসার ঘটেছে। সেটিও পরম্পরাসূত্রে এগিয়েছে। তাই, এখন যে সংস্কৃতিতে নাগরিক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা কী ‘লোক’-এর পর্যায়ভুক্ত নন? আসলে, পূর্বসূরিদের শেখানো ‘বুলি’ অনুযায়ী ‘লোকসংস্কৃতি’ বলতে আমরা গ্রামীণ বা আদিকালের সংস্কৃতিকেই বুঝি। জেনে বা না-বুঝে আমরা সে মত গ্রহণ করেও নিয়েছি। আমিও ব্যক্তিগতভাবে নানা আলোচনায় বা লেখায় ‘লোকসংস্কৃতি’ ব্যবহার করেছি/করছি। তবে, এ নিয়ে পুনরায় ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন। আদি থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত যে সংস্কৃতি আমরা যাপন করে আসছি, সেটা পুরোটাই ‘লোক’-মানুষেরই সংস্কৃতি। এখানে কেবল পর্যায় বা ধারা আলাদা করা যেতে পারে। তবে এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। নিশ্চয়ই এর সঙ্গে অনেকর দ্বিমতও থাকতে পারে।

মেউ : একাডেমিকভাবে আমি 'ফোকলোর' বলি, যদিও 'ফোক'ও বাংলা 'লোক'র মতোই একই জাতের! যাইহোক, ব্যাপারটা সংস্কৃতিই আদতে, একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর। আচ্ছা, আপনি 'লোকসংস্কৃতি'র সঙ্গে জড়ালেন কীভাবে?

সুমনকুমার দাশ : আমার বাড়ি হাওরে। সেখানে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ লেগে থাকে। এমন একটা অঞ্চলে বেড়ে উঠেছি, যেখানে মায়ের গর্ভে সন্তান থাকার সময় ‘সাধভক্ষণ’ নামে একটা অনুষ্ঠান হয়, সে অনুষ্ঠান ঘিরে ধামাইলও হয় কোথাও কোথাও। আবার মৃত্যুর পর কীর্তন গেয়ে-গেয়ে মৃত ব্যক্তির শব কাঁধে করে শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গান-সংস্কৃতির আচার-অনুষ্ঠান, সেই অঞ্চলে জন্ম নিয়ে গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে জীবন যাপন না-করার সুযোগ কই? আসলে ঠিক এ কারণেই হয়তো গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী হই। আবার , আমাদের শৈশবে যাত্রা, পালা, কীর্তন, বাউল, মালজোড়া, উরিগানসহ নানা আসরে প্রায়ই যেতাম। প্রায়ই দেখতাম নৌকাবাইচ, পলোবাইচ, ঘোড়দৌড়সহ গ্রামীণ নানা চিরায়ত খেলা। ধান রোপণ, হালচাষ কিংবা হাওরের ‘আফাল’-এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার সংস্কৃতিতেই তো আমরা বড়ো হয়েছি। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি অন্য অনেক হাওরবাসীর মতো সঙ্গত কারণেই আমার প্রেম হয়, ভাব হয়। সেই যে শৈশবে হাওরের কাদামাটি, উত্তাল আফাল আর গান-নাটকের প্রতি টান তৈরি হয়েছিল, সম্ভবত নাড়ির সে ঋণ শোধ করতেই আমার ফেলে আসা শৈশব গ্রামীণ সংস্কৃতি নিয়ে আমাকে অবিরত লিখিয়ে নিচ্ছে। আর, এ সুবাদেই এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেলা-মচ্ছব-ওরস-মাজার-শ্মশান-আখড়ায় ঘুরে বেড়াই ফকির-সাধু-সন্তদের সাক্ষাৎ লাভের আশায়।

মেউ : আচ্ছা, এই যে আপনার নিজের অঞ্চলেরই সংস্কৃতি, যা ওখানেই পরিবেশিত হচ্ছে, এর রয়েছে প্রাতিবেশিক মূল্য। কিন্তু এসব সংস্কৃতিকে যখন নগরে আলাদা মঞ্চে পরিবেশিত হতে দেখেন বা ইউটিউবে ফোক ঘরানার কোনো চ্যানেলে পরিবেশিত হতে দেখেন—দুটির মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য দেখতে পান?

সুমনকুমার দাশ : নিশ্চয়ই, বিস্তর পার্থক্য দেখা যায় এসব পরিবেশনারীতিতে। এরও সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। ওই যে প্রবাদ আছে না, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। এ-কথা এখানেও খাটে। নগরের মঞ্চে পরিবেশনার যে আদল তৈরি করা হয়, সেটা নাগরিক ধাচেই হয়। নাগরিক সমাজে বিষয়টিকে ‘খাপ খাওয়ানোর’ উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্টরা প্রচলিত রীতি ভেঙে পরিবেশনায় আধুনিকতার ছোঁয়া দেন। সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণেই গ্রামীণ পরিবেশনারীতির বদল নগরে অনায়াসেই ঘটে যায়। গ্রামীণ সহজিয়া ভাবটা শহুরে পরিবেশনায় অতি চাকচিক্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। ফলে, প্রকৃত পরিবেশনারীতি আর তখন সেটি থাকে না। একই কথা বলা চলে, টিভি চ্যানেল কিংবা ইউটিউব চ্যানেলের ক্ষেত্রেও। ‘ফোক’ পরিবেশনাকে ‘আইটেম’ বানিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকৃত চর্চাকারীদের পাশ কাটিয়ে ভুল ব্যক্তি বা শিল্পীর মাধ্যমে উপস্থাপন করার ফলে যেমন চিরায়ত সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য হারাচ্ছে, তেমনই ভুল বার্তাও জনসমাজে যাচ্ছে। তবে নিশ্চয়ই কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে।

মেউ : লোকসংস্কৃতি নিয়ে আপনি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, যেগুলো বই আকারে পাওয়া যাচ্ছে ৷ এরমধ্যে লোকসঙ্গীত বিশেষ স্থান দখল করে আছে। রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, বাউল—ইত্যাদি গান নিয়ে কাজ আছে আপনার। আমরা যদি খেয়াল করি, এধরনের গান প্রচলিত লোকসংস্কৃতির পাশাপাশি জনপ্রিয় সংস্কৃতিরও অংশ। বিপুলভাবে সারাদেশে সব শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু অন্য জনপ্রিয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলো চটুল, হালকা চালের। এই যে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ লোকগানকেও জনপ্রিয় সংস্কৃতি আত্তীকরণ করছে, আবার সস্তা ধারাকেও নিচ্ছে—এসব বিষয়ে আপনার কী মনে হয়?

সুমনকুমার দাশ : আসলে আমাদের দেশে এই যে আধুনিক নাগরিক সভ্যতার বিকাশ এখন ঘটছে কিংবা গড়ে উঠেছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেখানে অবস্থান করা মানুষের বেশিরভাগেরই আদি বাড়ি কোথায়? পেশাগত কারণে গ্রামের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে পেটের দায়ে নিরক্ষর মানুষটি এখন শহরে অস্থায়ী/স্থায়ী আবাস গেঁড়েছেন, যাঁদের মূল শেকড় গ্রাম আর গ্রামীণ সংস্কৃতি। গ্রামীণ এসব মানুষের এক থেকে দুই প্রজন্ম এখন শহরেই বেড়ে উঠছে, তবে তাঁরা শহরে বসবাস করলেও তাঁদের রক্তে মিশে আছে পূর্ব-পুরুষের মজ্জাগত চেতনা আর সংস্কৃতি। ফলে, এখনও তাঁদের প্রতিনিয়ত গ্রামীণ সংস্কৃতিই টানে। তাই শহরে বসবাস করলেও তাঁরা লালন, হাসন রাজা, রাধারমণ আর শাহ আবদুল করিমদেরই খুঁজে বেড়ান সবসময়। এ কারণেই তাঁদের গানের এত কদর, এত প্রতিপত্তি। যেহেতু এসব গানের কদর রয়েছে, তাই একটা মহলও সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিষয়টিকে কাজে লাগাচ্ছে। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ব্যবসায়িক স্বার্থে তাঁরা ব্যবহার করে ‘জনপ্রিয়’ করার পেছনে কাজ করছেন। যদিও এর লাভ-ক্ষতি দুটোই আছে। লাভ হলো, শহরে গ্রামীণ সংস্কৃতির বিকাশ। আর ক্ষতি হলো, প্রায় ক্ষেত্রেই এসব গান যথাযথভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। ভুল কথা আর আদলে এসব গান পরিবেশিত হওয়ায় বিভ্রান্তি ছড়ছে। যদি বিষয়টিকে ‘পণ্য’ হিসেবে বিবেচনা না-করে ভালোলাগা আর দরদ দিয়ে প্রচার করা সম্ভব হতো, তাহলেই এসব গ্রামীণ গীতিকার-সাধক-মহাজনদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, এই বাংলায় কিন্তু একান্তই একটি নিজস্ব দর্শন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এসব সাধকদের হাত ধরেই। তাই তাঁদের প্রকৃত মূল্যায়নটাও কিন্তু আমরা দিতে পারি তাঁদের সৃষ্টির যথাযথ প্রচারের মধ্য দিয়েই। আর, আপনি যে বললেন, জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ লোকগানের পাশাপাশি সস্তা ধারার চটুল ও হালকা চালের গানও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আসলে এ প্রসঙ্গে আমার মত-দ্বিমত দুটোই রয়েছে। এ পরিসরে হয়তো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে, কেবল একটু ধারণা দিয়ে রাখি। যেটা আমার কাছে ‘হালকা’ কিংবা ‘চটুল’, সেটা আপনার কাছে না-ও হতে পারে। আবার যেটা আপনার কাছে ‘চটুল’ কিংবা ‘হালকা’, সেটা আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণও মনে হতে পারে। মূলত একেক মানুষের মেজাজ একেক রকম, রুচিও একেক রকম। মানুষ যার যার মতো করে ভাবেন, চিন্তা করেন। তাই মোটা দাগে ‘সস্তা’ কিংবা ‘দামী’ বলে কোনও বিষয়কেই ‘অচ্যুৎ’ ভাবাটাও আমাদের ঠিক হবে না। তবে হ্যাঁ, আপনি এটা বলতে পারেন, এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যক্তি/শিল্পী প্রচলিত এসব গানে সামান্য হেরফের করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে, ভুল রীতিতে পরিবেশন করছে। এটি অন্যায় এবং দোষেরও বটে। তবে যেখানে ভালো থাকে, সেখানেও মন্দের পাশাপাশি বসবাস থাকতে হয়। তা না হলে, ভালো-মন্দের ফারাক বুঝবেন কীভাবে?

মেউ : দাদা, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ফোকলোর চর্চা আর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফোকলোর চর্চার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পান?
প্রতিষ্ঠান বলতে বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি।

সুমনকুমার দাশ : আমি মাঝে মাঝে বিষয়টি নিয়ে ভাবি। যাঁরা প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে ‘লোকসাহিত্য’ সংগ্রহ, সম্পাদনা কিংবা গবেষণার বিষয়টি করছেন, সেটি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকেরা কীভাবে দেখছেন? আবার প্রাতিষ্ঠানিক কাজগুলোকে ব্যক্তি পর্যায়ের গবেষক-সংগ্রাহকেরা কেমনভাবে দেখছেন? আসলে এর উত্তর হয়তো একেক জনের কাছে একেক রকম। কেউ হয়তো প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থেকে ছকবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে আপন খেয়ালে চর্চা-গবেষণা করছেন, আবার কেউ ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ-চর্চায় থেকেও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রীতি অনুযায়ীই কাজ করছেন। তবে খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের দেশে লোকসাহিত্যচর্চায় কিন্তু এখনও সেই অর্থে সামগ্রিকতা আসেনি। সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যম যেমনভাবে চর্চিত হচ্ছে, লোকসাহিত্যচর্চা কিন্তু এর সিকি অংশও হচ্ছে না। এর দায় অবশ্যই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা হলেও নিতে হবে। লোকসাহিত্যের গবেষণায় প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহীদের উৎসাহিত করতে পারেনি, নতুন নতুন গবেষক তৈরি করতে পারেনি। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্মই হয়েছে গবেষণাকাজকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য। আবার এ-ও দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক কিংবা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-গবেষকদের মধ্যে নাক উঁচু স্বভাবও রয়েছে। তাঁরা লোকসাহিত্যচর্চাকে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে ফেলতে চান। নতুন-পুরোনো বই ঘাঁটাঘাঁটি করে একের পর এক তথ্যসূত্র ব্যবহার করে লোকায়ত সাহিত্যের সহজ-সরল সহজিয়া ভাবটিতে গবেষণার মারপ্যাঁচে তিরবিদ্ধ করে রক্তাক্ত করছেন। তাঁরা এ ফতোয়াও অনেক সময় দেন, ওই ফরম্যাট ছাড়া গবেষণা প্রকৃত রূপ পায় না! আখ্যান কিংবা মুক্তগদ্যের আদলে নাকি লোকসাহিত্যচর্চাকে গবেষণায় ফেলা যাবে না! কী হাস্যকর সব কথাবার্তা। অথচ দেখেন, এঁদের বেশিরভাগই এসি ঘরে বসে বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে নতুন বইয়ের জন্ম দিচ্ছেন, কিন্তু সামান্য সময়ের জন্যও তাঁরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে আসছেন না। তাঁরা মাঠের বর্তমান চিত্র না জেনেই ঢাউস সব বই রচনা করে ফেলছেন! এই মনোভাবের পরিবর্তন আসতে হবে। গৎবাঁধা ফরম্যাটের পাশাপাশি নতুন মতকেও গ্রহণ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ব্যক্তি পর্যায়ের গবেষকেরা কোনও ধরনের প্রণোদনা ছড়াই কিন্তু গবেষণাকাজে এসেছেন। তবে, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকদের সবাই যে একই রকম, সেটাও কিন্তু নয়। তাঁদের মধ্যেও নমস্য ব্যক্তি অবশ্যই রয়েছেন, যাঁরা আসলেই শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য।

মেউ : আপনার সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করছি। কেউ যদি ফিল্ডওয়ার্কের তথ্য সাবলীল-সুন্দর গদ্যে গল্পের ছলে পরিবেশন করেন সেটাও ফোকলোর পঠনকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। বরং বেশি বেশি রেফারেন্স নির্ভর চর্চাতেই বিরক্ত হই কখনো কখনো, যেখানে গবেষকের আর্গুমেন্ট থাকে না, থাকে তথ্যের সমাহার, উপাত্তের ঢের উপস্থিতি। আর বৈঠকি গদ্য না লেখা হলে গবেষণার জন্য রেফারেন্স তৈরি হবে না। কারণ রেফারেন্স -রেফারেন্স যোগাযোগে যে গবেষণা সেখান থেকে আবার রেফারেন্স দেওয়া নতুন বিষয় ও ভাবের দৈন্য তৈরি করছে।
মধ্যরাতে সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ, দাদা। ভালো থাকবেন, শুভরাত্রি।

সুমনকুমার দাশ : তবে, আমার কথায় অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। সেটাও আমি সবিনয়ে স্বাগত জানাই। ধন্যবাদ আপনাকেও। ভালো থাকবেন।

মেউ : শুভরাত্রি।

সুমনকুমার দাশ : শুভরাত্রি, দাদা।

ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ

অন্যপ্রান্তে: সুমনকুমার দাশের জন্ম ১৯৮২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, জন্মস্থান: হাওড়বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার সুকলাইন গ্রাম। তিনি কম্পিউটার-বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পেশায় সাংবাদিক। তাঁর আগ্রহ ও চর্চার প্রধান বিষয় ফোকলোর ও সংগীত-সংস্কৃতি। গ্রামাঞ্চল ঘুরে ঘুরে প্রাচীন ও বিলুপ্তপ্রায় গান সংগ্রহ করেন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে নানা ধারা-উপধারার অজস্র লোকগান। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: রচিত ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। এর মধ্যে ‘বাউলের আখড়ায় ফকিরের ডেরায়’; ‘বাংলাদেশের বাউল-ফকির: পরিচিতি ও গান’; ‘বাংলাদেশের ধামাইল গান’; ‘বাউলকোষ’; ‘বাউলসাধনা লালন সাঁই ও অন্যান্য’; ‘লোকভাবন’; ‘লোকগান লোকসংস্কৃতি’; ‘বেদে-সংগীত’; ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে বেরোচ্ছে গানের কাগজ ‘দইয়ল’।

ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ

লেখক পরিচিতি:
মেহেদী উল্লাহ জন্ম:১৯৮৯ সাল
মেহেদী উল্লাহ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক। জন্মস্থান নোয়াখালীর সুবর্ণচর, বেড়ে ওঠা চাঁদপুরের কচুয়ায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। তিরোধানের মুসাবিদা (২০১৪) তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। তিরোধানের মুসাবিদা গ্রন্থের পান্ডুলিপির জন্য তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৩ অর্জন করেন। প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থ: রিসতা (২০১৫), ফারিয়া মুরগীর বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে (২০১৬), জ্বাজ্জলিমান জুদা (২০১৭), অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ (২০১৯)। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস: গোসলের পুকুরসমূহ (২০১৮)। প্রবন্ধ গ্রন্থসমূহ: ফোকলোরের প্রথম পাঠ (২০১৫), ফোকলোর তত্ত্বপ্রয়োগচরিত (২০২০), লোকছড়া: আখ্যানতত্ত্বের আলোকে (২০২০), নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন (২০২০)




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ