bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

শফিক আশরাফের জানালা ꘡ আমাদের ভুটানযাত্রা ꘡ পর্ব-৬


আমাদের ভুটানযাত্রা [পর্ব-৬]

আমরা হোটেল কক্ষে ফিরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আমাদের ড্রাইভার সুপোকে ফোন করে জানতে চাইলাম বিকেলে আমাদেরকে থিম্পুর আশপাশের কয়েকটি স্পট ও রাজবাড়ি দেখাতে নিয়ে যেতে পারবে কি না? সুপো বললো সাড়ে চারটার মধ্যে সে আমাদের হোটেলের সামনে এসে হাজির হবে, আমরা যেন রেডি হয়ে থাকি। আমাদের হোটেলের নিকটেই দোচুলা পাস, পোনাখা যাওয়ার পারমিশন অফিস। আমি একফাঁকে ওদেরকে হোটেলে রেখে পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিয়ে পুনাখার পারমিশন নিয়ে ফিরে আসলাম। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আমরা চারটের আগেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য আশপাশের মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা। বেশিরভাগ ভুটানি মেয়ে জিন্স ও টিশার্ট পরে তবে কিছু কিছু মেয়ে ভুটানের ঐতিহ্যবাহী কিমানো জাতীয় এক ধরনের চেক কাপড় আমাদের আদিবাসী নারীদের মতো করে পরে আছে। এরকম একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে আইরিন ওই ড্রেসগুলোর দাম জিজ্ঞাসা করলো। তারা যে দাম বললো সেটা শুনে সেখানে দাঁড়াবো, নাকি দৌড় দেব বুঝতে পারলাম না! আমরা ভেবেছিলাম একটা পোশাকের দাম ৫/৬শ টাকা হয়তো হবে। জিজ্ঞাসা করাতে জানালো, একটা পোশাকের দাম পঞ্চান্ন হাজার রুপি! দাম শুনে আমি আইরিনকে বললাম:
- আমাদের আর ভুটান দেখা হবে না! একটা ভুটানি পোশাক নিয়েই দেশে ফিরে যেতে হবে! আইরিন রাগ দেখিয়ে বললো,
- যাও, কি যে বলো, দেখলেই কিনবো নাকি! আমি হাসতে হাসতে বললাম,
- আর যাই কিছুর দাম করো, ওই ভুটানি পোশাকের দাম আর জিজ্ঞাসা করো না!
ভুটানে যেকোন জিনিসের দাম ইন্ডিয়ার চেয়ে বেশি। বেশি এই কারণেই যে, বেশিরভাগ জিনিসপত্র তারা ভারত ও বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য কম। আমরা দোকানে দোকানে ঘুরতে ঘুরতেই গাড়ির ড্রাইভার ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো আমরা কোথায় আছি? বাইরের সাইনবোর্ড দেখে আমি মার্কেটার নাম বলে, তার সামনে গাড়ি নিয়ে আসতে বলে, রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই একটা গাড়ি এসে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করতেই ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন একটু বয়স্ক বয়স্ক লাগলো। ভালো করে দেখে বোঝার চেষ্টা করছি আমাদের ড্রাইভার সুপোই তো! এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো, ড্রাইভার সুপো ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে আপনারা কোথায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভুল বুঝতে পারলাম।
‘রুখ রুখ, রুখ যাও’ বলে গাড়ি থামালাম। সব ভুটানিদের চেহারা প্রায় একইরকম। রাস্তার পাশে আমাদের দাঁড়াতে দেখে এ ড্রাইভার ভেবেছে আমরা হয়তো খালি কোন ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি, আর আমাদের পাশে গাড়ি থামতেই সুপোর গাড়ি ভেবে সেটাতে উঠে বসেছি। ড্রাইভারকে সরি বলে, আমরা আবার মার্কেটের সামনে এসে সুপোর গাড়িতে উঠলাম। ঘটনা দেখে স্বনন, বুনন হেসে গড়াগড়ি। বুনন বললো:
- দুপুরে বিয়ার খাইতে চাইছো, সেটাতে নেশা হয়ে ভুল গাড়িতে উঠে বসেছে! আমি তাদের খুশি দেখে ফোসফোস করে বললাম,
- তোরা তো খাইতে চাস নাই! তাইলে আমার ভুল ধরিয়ে দিলি না কেন? স্বনন বললো,
- ড্রাইভারকে দেখে আমারও কেমন বুড়া বুড়া মনে হইছিল।
- এহন বলতাছ কেন, আগে বলবি না, বদ পোলাইফান?
আমি ওদের থামানোর জন্যে তখন কপট রাগ দেখাচ্ছি।
ঘটনাটা ওদের সবাইকে খুব আনন্দ দিচ্ছে। আমার বোকামি দেখে ওদের মজা আরো বাড়ছে। আইরিন বাচ্চাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে, ব্যাপারটা এমন, এতদিন পরে তোমার মতো পণ্ডিতকে ধরতে পারছি। আমাদের হাসাহাসি দেখে সুপো জিজ্ঞাসা করলো, ব্যাপার কি? সুপোকে ঘটনাটা বলতে ও-হাসতে লাগলো।
সমগ্র থিম্পু থেকে দেখা যায় এই বুদ্ধমূর্তি

আমরা হনুমান মন্দির দেখে থিম্পু শহরের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তি দেখার জন্যে রওনা দিলাম। এই বুদ্ধমূর্তি সমস্ত থিম্পু শহর থেকে দেখা যায়। বিশাল এক পাহাড়ের চুড়ায় বুদ্ধ বসে আছেন ধ্যানভঙ্গিতে। আমরা গাড়ি নিয়ে বেদির গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। প্রশস্ত ও খাড়া সিঁড়ি অনেকদূর উঠে গেছে।
সুপো জিজ্ঞেস করলো, গাড়ি নিয়ে উপরে যাবো নাকি এখানে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠবো?
গাড়ি থেকে সিঁড়ির ঢেউ দেখতে এত সুন্দর লাগছে যে, আমি গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাচ্চারা আমার সঙ্গে হৈহৈ করে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। সুপো বললো, গাড়ি নিয়ে সে উপরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা দৌড়ে উঠলাম আমরা। কিছুটা উঠার পরেই মনে হলো, গাড়ি ছেড়ে দেওয়া আমাদের ভুল হয়েছে। খাঁড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠছি তো উঠছিই, সিঁড়ি আর শেষ হয় না!
বৌদ্ধমন্দিরে ওঠার সিঁড়ি
আইরিন কিছুটা উঠে সিঁড়িতে বসে পড়লো। আমাদের বললো, তোমরা যাও, আমি আর উঠতে পারবো না। আইরিন হাঁপাচ্ছে। সিঁড়ি দেখতে অপূর্ব কিন্তু খাড়া হওয়ার কারণে উঠতে কষ্ট হয়। আমি বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে বাচ্চাদেরসহ উঠে পড়লাম। পিতলের তৈরি চমৎকার বুদ্ধমূর্তি। বিশাল বেদি ঘিরে অসাধারণ সব ছবি। হাতি, ময়ূর ও বিভিন্ন দেবদেবী ছাড়াও পরীর নৃত্যরত মূর্তি। এখান থেকে তাকালে সমস্ত থিম্পু শহর দেখা যায়। চারপাশ দেখে আমাদের উঠার কষ্ট দূর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সিঁড়িতে আইরিনের মাথা দেখা গেল। স্বনন সেটা লক্ষ্য করে চিৎকার করে বললো:
- পারছে, ওই আম্মু পারছে! আমরা তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে আইরিন সিঁড়ি দিয়ে বেদিতে উঠে এসেছে। উপর থেকে চারপাশের অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে ওয়াও বলে উঠলো।
আমরা হাতির সামনে, ময়ূরের সামনে ও দেবী বিভিন্ন দেবী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি উঠলাম। আমরা বেদীতে দাঁড়িয়ে ভুটানের অপরূপ ভূ-প্রকৃতির সুধা আকণ্ঠ পান করলাম। কোথাও পাহাড়ের কোলে মেঘগুলো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে আবার কোথাও ধীরে ধীরে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের দিকে বেড়াতে যাচ্ছে। আমরা সারাজীবন আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখেছি কিন্তু এখানে পাহাড়ের মাথা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখছি। অপরাহ্নবেলা সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মেঘের এই অপরূপ মিলনমেলা না দেখে ঠিক বোঝানো যাবে না এর সৌন্দর্য। ধ্যানী বুদ্ধমূর্তির নির্মিলিত চোখ দেখে আমার খানিকটা হিংসাও লাগছিল, মনে হচ্ছিল বুদ্ধমূর্তির জায়গায় বসে একটাজীবন কাটিয়ে দিতে পারলে হয়তো জীবনকে খোঁজে পাওয়া যেত।
মন্দিরের দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন কারুকার্য
আমার কখনো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বুকটা হাহাকার করে উঠে, মনে হয় কি যেন একটা জরুরি কাজ করার জন্যে এসেছি কিন্তু মনে নাই, ভুলে গেছি। এক ধরনের অস্থিরতা চেপে বসে। আমি আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করি আমার কাজটা কি! প্রশান্ত বুদ্ধের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে জীবন ও প্রকৃতিকে উপলব্ধি করাই জীবনের কাজ। আমরা মানুষরা অতীতে বাঁচি, না-হয় ভবিষ্যতে কিন্তু বাঁচার অর্থ বর্তমানকে উপলব্ধি করা, কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো সেটাই আমরা ভুলে যাই।
আমরা গোধূলীবেলা বৌদ্ধমন্দির থেকে বেরিয়ে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সন্ধ্যার থিম্পু শহর অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে। পাহাড়ের খাঁজে আলোর নাচন। মনে হচ্ছে পাহাড়ে পাহাড়ে কোন উৎসব উপলক্ষে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলে উঠেছে! বাতাসে, মেঘে মোমবাতির আলোগুলো দুলছে। আমরা পৌঁছতে পৌঁছতে রাজবাড়ির গেট বন্ধ হয়ে গেছে। স্বননের খুব মন খারাপ হলো। ওর মন খারাপ দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম:
- কি রে রাজার মেয়েকে দেখতে পারলি না বলে খারাপ লাগছে?
- যাও বিরক্ত করো না তো।
- সুপো বললো,আমি গাড়িটাকে উপরে নিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে পুরো রাজবাড়ি দেখা যাবে।
আমরা একটা পাহাড়ের মাথায় গিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। পুরো রাজবাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। স্বনন তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে পা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছে। আমি বললাম,
- আমার ঘাড়ে উঠে ভালো করে শ্বশুরবাড়ি দেখ। স্বননকে ঘাড়ে নিয়ে আকাশের অসংখ্য তারার নিচে পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছিল আদিবাসী বুঙগা দেবতার মতো তাবৎ পৃথিবীর ভার আমার কাঁধে।

স্বননকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম:
- বড় হয়ে কি হতে চাস? স্বনন পাল্টা প্রশ্ন করেছিল,
- এই দেশে সবচেয়ে বড় কি?
- বড় তো অনেক প্রকারের হয়, জ্ঞান-পাণ্ডিত্য, বিদ্যা-প্রযুক্তি, রাজক্ষমতা ইত্যাদি অনেক ভাবে বড়। সে আমার এসব কথা বুঝতে না পেরে বলে,
- বুঝি নাই, সোজা করে বলো।
- এই যেমন ধর, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী তারা রাজা। তাদের কাছে কোন দরজার চাবি থাকে না কিন্তু সব দরজা তাদের জন্যে খোলা। স্বনন বিস্মিত হয়ে বলে,
- বাবা! তারা কি জাদুকর!
- অনেকটা জাদুকরের মতোই, সেটা ক্ষমতার জাদু। তুই যদি রাজা হোস তাহলে মুখ দিয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে কাজটা হয়ে যাবে!
- আমি যদি একটা ড্রোন চাই বা একশ বেলুন চাই, পঞ্চাশটা মার্বেল চাই সেটা কি সঙ্গে সঙ্গে পাবো!
- হ্যাঁ, পাবি।
- তাহলে আমি রাজা হতে চাই।
- বেশ, এখন থেকে তুই আমাদের মহামান্য রাজা।
মন্দিরের বেদি থেকে থিম্পু, পাহাড়ের মাথায় বরফের আভা
এরপর থেকেই মাঝে মাঝে আমরা স্বননকে আমাদের রাজা বলে ডাকি। ওর রাজবাড়ি দেখার অতিআগ্রহ সেই রাজা নামক জাদুকর দেখার আগ্রহ থেকেই জন্ম বলে আমার মনে হলো। আর আমি বাচ্চাটাকে রাজবাড়ি দেখাতে না পেরে খানিকটা বিষণ্ণ হলাম। আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। আগামীকাল সকালে পুনাখা যাবো। ড্রাইভারকে সকাল সাতটার মধ্যে হোটেল থেকে আমাদের পিক করতে বললাম।
আমরা হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আমাদের হোটেলেও একটা ক্যান্টিন ছিল। সেখানে না-খেয়ে আমরা বাইরে খাওয়া ও রাতের থিম্পু দেখার উদ্দেশ্যে রাস্তা ধরে ক্লক টাওয়ারের দিকে হাঁটলাম। ক্লকটাওয়ারের সামনে কি একটা গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। বেশ কিছু দর্শক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে, দাঁড়িয়ে গান শুনছে। একটা মেয়ে নেপালী গান গাচ্ছে--
‘কুটমাকুটু সুপারি দানা, কুটুমাকুটু...’
আমরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সুপারিদানার গান শুনলাম। ফোক ঢংয়ের গানটা বেশ ভালই লাগলো। রাতের আলো ঝলকানো নিপাট থিম্পু শহর যেন স্বপ্নপুরি। ঠাণ্ডাটা বেশ টের পাচ্ছিলাম। বুনন আবার বেশি শীত সহ্য করতে পারে না। আমাদের গায়ের জ্যাকেট, সোয়েটার, কানঢাকা টুপি রাতের থিম্পুর জন্যে পর্যাপ্ত নয়। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে আমরা একটু তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে আসলাম। হোটেলে ফিরে রুম হিটার চালিয়ে গরম হওয়ার অপেক্ষা করছি, কিন্তু রুম গরম হচ্ছে না! বুনন হিটারের আশপাশে হাত বুলিয়ে বললো:
- বাবা, এটা কোনও কাজ করছে না!
আমি রুম সার্ভিসে ফোন দিলাম। ওরা এসে খানিকক্ষণ হাতাহাতি করে ঠিক করতে না-পেরে, নতুন একটা রুম হিটার দিয়ে গেল। এবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমটা গরম হয়ে উঠলো। বাচ্চারা কম্বলের নীচে শুয়ে টিভি চালিয়ে দিয়েছে। আমার গরমের চেয়ে ঠাণ্ডাই বেশি পছন্দ। শীতকালে অ্যাজমাটিক সমস্যা বেড়ে গেলেও আমি শীত উপভোগ করি। একা থাকলে শীতে কম্বলমুড়ি দিয়ে ফ্যান চালিয়ে অনেক সময় শুয়ে থাকি। আমি বারান্দার দরজা খুলে সেটা আলতো করে চাপিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই আমার বুকে ধক করে একটা ধাক্কার মতো লাগলো! বিশাল এক পূর্ণ চাঁদ ঠিক পাহাড়ের মাথায় বসে আছে। আমার মনে হলো কে যেন ঠিক পাহাড়ের মাথায় চাঁদটাকে বসিয়ে রেখেছে। জ্যোৎস্নার থৈ থৈ আলোয় পাহাড়গুলো যেন ভেসে যাচ্ছে! পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফে মধ্যে চাঁদের আলো হিরক দ্যোতি ছড়াচ্ছে। খণ্ড খণ্ড হিরের আলোক বিচ্ছুরণে চারপাশ অপূর্ব মায়াবি আলোয় ভরে উঠেছে। ‘অসহ্য সুন্দর’ বলে যে শব্দটা আছে আমার ঠিক সেটাই মনে হলো। এই অসহ্য সুন্দরের সামনে বেশিক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকা যায় না!
ছাত্রাবস্থায় বিভূতিভূষণের আরণ্যক  উপন্যাস পড়ার পরে চন্দ্রাহত হই। সেখানে তিনি এভাবে লিখেছেন- ‘সে রূপ তাহার না দেখাই ভালো, যাহাকে ঘরদুয়ার বাঁধিয়া সংসার করিতে হইবে...। অসম্ভব তাহার পক্ষে ঘরকন্না করা একবার সে ডাক যে শুনিয়াছে, সে অনবগুণ্ঠিতা মোহিনীকে একবার যে প্রত্যক্ষ করিয়াছে।... গভীর রাত্রে ঘরের বাহিরে একা আসিয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি, অন্ধকার প্রান্তরের অথবা ছায়াহীন ধু-ধু জ্যোৎস্না-ভরা রাত্রির রূপ। তার সৌন্দর্য পাগল হইতে হয়-একটু বাড়াইয়া বলিতেছি না-আমার মনে হয় দুর্বলচিত্ত মানুষ যাহারা, তাহাদের পক্ষে সে-রূপ না দেখাই ভাল, সর্বনাশী রূপ সে, সকলের পক্ষে তার টাল সামলানো বড় কঠিন।’ চন্দ্রাহত বিভূতিভূষণ আরো লিখেছেন,‘ জ্যোৎস্না আরও ফুটিয়াছে-সে কি জ্যোৎস্না! কি রূপ রাত্রির ! নির্জন বালুর চরে, দীর্ঘ বনঝাউয়ের জঙ্গলের পাশের পথে জ্যোৎস্না যাহারা কখনও দেখে নাই, তাহারা বুঝিবে না এ জ্যোৎস্নার কি চেহারা ! এমন উন্মুক্ত আকাশতলে ছায়াহীন উদাস গভীর জ্যোৎস্নাভরা রাত্রিতে, বন-পাহাড়-প্রান্তরের পথের জ্যোৎস্না, বালুচরের জ্যোৎস্না-ক’জন দেখিয়াছে?’ 
আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বন্ধু শুভ্রকে নিয়ে অনেকবার পূর্ণিমা রাতে পদ্মার বালুচরে শুয়ে বিভূতিভূষণের জ্যোৎস্না উপলব্ধির চেষ্টা করেছি, সারারাত জ্যোৎস্না ও শিশিরে ভিজেছি। কলা ভবনের সামনে আমগাছের নিচে চুঁইয়ে পড়া চাঁদের আলো আমাদের হাতের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়েছে। কোনওদিন ধরতে পারিনি! আজ সুদূর ভুটানে পাহাড়ের মাথায় আমাদের না-দেখা জ্যোৎস্না তার সকল সৌন্দর্য ঢেলে হাজির হয়েছে! একদম বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে চাঁদের আলো। আমার পক্ষে এই জ্যোৎস্নার রূপ সহ্য করা মুশকিল হচ্ছে। বিভূতির মতোই মনে হচ্ছে-‘দুর্বলচিত্ত মানুষ যাহারা, তাহাদের পক্ষে সে-রূপ না দেখাই ভাল, সর্বনাশী রূপ সে, সকলের পক্ষে তার টাল সামলানো বড় কঠিন।’
আমার মতো দুর্বলচিত্তের মানুষ টাল সামলাতে না-পেলে চেয়ারে বসে পড়লাম। কি ঠাণ্ডা এই জ্যোৎস্নার আলো! সেই ঠাণ্ডা আলো আমার চিত্তকে বিবশ করে দিলো।

[চলবে]


শফিক আশরাফ। জন্ম: ৬ আগস্ট ১৯৭১

শফিক আশরাফ গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। জন্মস্থান টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানার অন্তর্ভুক্ত সিঙ্গাইর গ্রামে। বর্তমানে রংপুরে বসবাস করেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বিভিন্ন লিটলম্যাগে লেখালেখির শুরু। ২০০০ সালে তিনি ও বন্ধু কবি শামীম নওরোজ এবং ফারুক আকন্দ মিলে অন্যতম ছোটকাগজ ‘চিহ্ন’ প্রথম বের করেন। পরবর্তী সময়ে ‘চিহ্ন’ সম্পাদক এবং আরো পরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শিমুল মাহমুদ সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘কারুজ’ এর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। ছোটকাগজ অন্বীক্ষা, লোকপত্র, মাটি, প্রকৃতি -তে তিনি নিয়মিত লিখেছেন।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘নহর আলীর মা’ (১৯৯৯)। দীর্ঘ সময়ে তিনি বেশকিছু গল্প লিখেছেন।চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত গল্প পঞ্চাশৎ, রাশেদ রহমান সম্পাদিত এই সময়ের নির্বাচিত ছোটগল্প প্রভৃতি সংকলনে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁতি সম্প্রদায়কে নিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পাউঠি’র খসড়া সম্প্রতি শেষ হয়েছে। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পাগল অথবা প্রত্যাশিত মৃত্যু’।   

প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ: বাংলাদেশের গ্রাম ভিত্তিক ছোটগল্পে জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতি ১৯৪৭-২০০০ (প্রকাশকাল ২০১৩); প্রবন্ধ-গ্রন্থ: সিনেমা ও সাহিত্য প্রাসঙ্গিক পাঠ (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ