bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

বাংলাদেশের ভিত্তিমূলেই আমাদের লোকজ সংস্কৃতি-- নওশাদ জামিল

যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এখন ম্যাসেঞ্জার। ম্যাসেঞ্জারে হাই, হ্যালো চলতে থাকে! কবি, কথাসাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী—কেউ বাদ পড়েন না। হাই, হ্যালো ছাড়িয়ে চ্যাটিং গড়াচ্ছে বিভিন্ন চিন্তামূলক আলাপে। সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক মেহেদী উল্লাহ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে এমনই চিন্তামূলক চ্যাটিং আয়োজন--'হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার' (Half an hour chatting about culture) প্রকাশ করছেন। বলে রাখা ভালো, আমাদের বিগতকালের লেখক-বুদ্ধিজীবীগণের সংস্কৃতি বিষয়ক বহুবিধ ও বহুমাত্রিক চিন্তা তাঁদের রচিত গ্রন্থগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁদের সময়ের চিন্তার সাথে বর্তমান সময়ের লেখক-বুদ্ধিজীবীর চিন্তার তূলনামূলক এই পাঠ এক অতি বড় সুযোগ। আমরা মেহেদী উল্লাহ’র এমন উদ্যোগকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করি। তাই এটির সংকলন ও প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। গতিপথ বাংলা ওয়েবজিনের আলাপ-সিরিজে প্রতি রবিবার মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার এর একটি করে পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে।

আলাপ সিরিজ : মেহেদী উল্লাহ’র হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার পর্ব-৫

মেহেদী উল্লাহ’র টাইমলাইন: সোমবার, ১৮ মে ২০২০; সন্ধ্যা ৭ টা ৫১ মিনিট

আজ থাকছেন কবি নওশাদ জামিল (Naushad Jamil) ভাই। সংস্কৃতি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে—

মেহেদী উল্লাহ : সাংবাদিকতার সূত্রে দেশের সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আপনার কথা হয়৷ কখনো কি এমন মনে হয়েছে তাঁরা দেশের সংস্কৃতি নিয়ে যা বলেন তার প্রয়োগ সমাজে বা দেশে নেই? থাকলেও সার্বজনীন না?

নওশাদ জামিল : সাহিত্য ও সাংবাদিকতার সূত্রে সংস্কৃতি অঙ্গনের দিকপালদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে কমবেশি। যাদের তুমি সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ বলছো, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তাঁদের অধিকাংশের চিন্তাধারা মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। সমাজের বিশাল ও বৃহত্তম অংশ নিম্নবিত্তের মানুষের কাছে তাদের কথা পৌঁছায় নি।

মেউ : তার মানে, মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির ব্যাখ্যাদাতা তাঁরা। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় সংস্কৃতি, নিম্নবর্গের সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? কারণ সংস্কৃতি অধ্যয়নে একটা দেশের আশিভাগ মানুষের সংস্কৃতি 'জনপ্রিয় সংস্কৃতি'কে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, সেই কাতারে লোকসংস্কৃতিরও অবস্থান।

নওশাদ জামিল : সবাই যে মধ্যবিত্তের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন তা নয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তের রুচি ও মনন এবং চিন্তাধারা থেকে আলোচিত হচ্ছে সংস্কৃতি। শহরকেন্দ্রিক যারা, তারাই এখন সংস্কৃতির আধিপত্যের চালিকাশক্তি। নিম্নবর্গ সেখানে উপেক্ষিত। লোকসংস্কৃতি সেখানে অবহেলিত। লোকসংস্কৃতি ছাড়া আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আসলে নেই। নিজস্বতা ছাড়া, মূল ভিত্তি ছাড়া সেই সংস্কৃতি কখনও সর্বজনীন হবে না। সংস্কৃতিকে সব শ্রেণি ও মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে নিজস্বতা ধরে এগোতে হবে।

মেউ: মূলধারার গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করছেন যে শ্রেণিটি, অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণি মধ্যবিত্তের রুচি অনুযায়ীই সংবাদ তৈরি করে। গণমাধ্যমে লোকসংস্কৃতির উপস্থাপন কতটা হয়? মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সেই সংস্কৃতি মধ্যবিত্তের রুচিরই বিনির্মাণ কিনা? আরেকটা বিষয় এখানে এসে যাচ্ছে, আপনার সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করছি, নিম্নবিত্তের কাছে নাগরিক শিল্পবোদ্ধার সাংস্কৃতিক আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে না বা নিম্নবিত্ত সেই ভাষা ও রুচিরও না, কিন্তু সত্য এটাই যে, এই চাষা-ভূষা, কৃষক শ্রেণিটিই মুক্তিযুদ্ধ করেছে, অর্থাৎ একটা স্বাধীন দেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আওয়াজ যারা শুনতে ও বুঝতে পেরেছিল, বর্তমানে তাদের জন্য মঙ্গলের এমন অনেক সাংস্কৃতিক চর্চার আওয়াজ তারা শুনতে পাচ্ছেন না, যেমন ধরুন বাউলের চুল কেটে দেওয়া, মন্দির ভাঙচুর করা, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইত্যাদি। বোঝাপড়ার এত দূরত্ব কেন তৈরি হলো?

নওশাদ জামিল : গণমাধ্যমের মালিক উচ্চবিত্তের, আর তাতে কাজ করেন মধ্যবিত্তের মানুষজনই বেশি। মধ্যবিত্ত কয়েক যুগ আগে নিম্নবিত্ত থেকে উঠে এলেও ভুলে যায় তার সংস্কৃতি। শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে সব কিছু এখন কেন্দ্রীভূত। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা হবে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ কোটি। বাকি ১০ কোটি মানুষই নিম্নবিত্তের। ষোলআনার মধ্যে ছয়আনাই শক্তিশালী। ক্ষমতা ও কেন্দ্রের কাছে দশআনার ভাষা, আচার, ব্রত বা সংস্কৃতির আওয়াজ ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে মলিন ও বিষণ্ণ।
রাষ্ট্র ও সমাজে শ্রেণি বিভাজন যত প্রকট হচ্ছে, সাংস্কৃতিক ঐক্য ততই ব্যহত হচ্ছে মনে হয়। বঙ্গবন্ধু শ্রেণি বিভাজন না করে সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ভাষাভিত্তিক ঐক্য থেকেই মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। ভাষা, সংস্কৃতি ভিত্তিক যে বাঙালি জাতি, যে রাষ্ট্র বাংলাদেশ, তার ভিত্তিমূলই হলো আমাদের লোকজ সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি গণমাধ্যমে উপেক্ষিত ও অবহেলিত মনে করি।
এ দেশের গ্রামাঞ্চলে, নদ-নদী ও হাওর-বাওড়ের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতি। জলে-স্থলে মানুষের কণ্ঠে ভেসে বেড়ায় ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, জারি, সারি গান; লালন, হাসন, জালাল, শাহ আবদুল করিমের বাউল-মরমি গানের বাণী ও সুর। লোকসংগীতের এই বিশাল ভাণ্ডারই দেশের সংস্কৃতির অন্যতম মূল স্তম্ভ, যা কি না ছড়িয়ে থাকে আমাদের শিকড়ের গভীরে। যার আবেদন কখনোই হারানোর নয়। শুধু লোকসংগীত নয়, লোকনৃত্য, লোকনাট্যসহ বৈচিত্র্যময় যে ধারা বহমান, তার কাছে আমাদের বারবার ছুটে আসতেই হবে শিকড়ের টানে, জীবনের দর্শনের টানে।

মেউ: প্রায়ই লোকসংস্কৃতি বাধার মুখে পড়ছে। মূলধারার ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই অশাস্ত্রীয় সংস্কৃতির পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু আমাদের সমন্বয়ের সংস্কৃতি কোথায় যাচ্ছে এই সময়ে?

নওশাদ জামিল: সবসময়ই বাধা পেরিয়ে ছড়িয়ে যায় সংস্কৃতি। বাধা কিংবা প্রতিবন্ধকতায় তা যদি বিলীন হয়, তবে তা সংস্কৃতি নয়। পাকিস্তান আমলে পহেলা বৈশাখ পালনে সরকারি বাধা ছিল, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ছিল। শেষত পাকিস্তান তা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। পাকিস্তানের দুই অংশের ধর্ম এক হলেও সংস্কৃতি ছিল আলাদা। এ সংস্কৃতির ওপর আঘাত থেকেই পতন শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সব দেশের ভাষা ও ধর্ম এক হলেও সংস্কৃতি আলাদা। মধ্যপ্রাচ্যে একটি দেশ না হয়ে অনেক দেশেরই জন্ম হয়েছে। যার ফলে বোঝা যায়, সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি।
একটি দেশে, একটি সমাজে নানা সংস্কৃতি থাকবে। এটা স্বাভাবিক। সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমন্বয় করতে হয়, বহুমাত্রিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন করতে হয়।

মেউ: কিন্তু বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিভক্তিগুলো প্রকট হচ্ছে কেন?

নওশাদ জামিল : বহুধারার সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা না করলে বিভক্তি প্রকট হবেই। সমাজ ও রাষ্ট্রকে বহুধারার সংস্কৃতিকে মেনে নিতে হবে, সম্মান করতে হবে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি, সমতলের সংস্কৃতি এক নয়। শহুরে সংস্কৃতি আর গ্রামীণ সংস্কৃতিও এক নয়। বৈচিত্র্যে ঐক্য খুঁজতে হবে, বৈচিত্র্যে শক্তি খুঁজতে হবে।

মেউ: কবিতা লিখতে গিয়ে কি এমন মনে হয়েছে কখনো, আপনি নিজেই যেকোনো একটি সংস্কৃতির কণ্ঠস্বর হয়ে গেছেন?

নওশাদ জামিল : কখনও কখনও মনে হয়েছে যে, আমি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব করি, কবিতায় যে আবহ থাকে, সেটা মধ্যবিত্তের। আমি তো নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্তের জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে নেই। আমি লিখতে গিয়ে মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি তুলে ধরলেও সমন্বয় করি। কেননা বহুধারার আচার, ব্রত ও সংস্কৃতির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা নেই। একজন সৃষ্টিশীল শিল্পী ও লেখকের প্রধানতম কাজই হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুমাত্রিকতার মধ্যে, বহুবিচিত্রতার মধ্যে ঐক্যের সুর অনুসন্ধান।

মেউ: অনেক ধন্যবাদ ভাই, সময় দেওয়ার জন্য, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল।

নওশাদ জামিল : ঠিক আছে মেহেদী। তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ

অন্যপ্রান্তের লেখক: নওশাদ জামিল কবি ও সাংবাদিক। জন্ম ১ মে, ১৯৮৩ সাল। জন্মস্থান ময়মনসিংহ ভালুকায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত প্রথম কবিতাবই: তীর্থতল (২০১১)। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: কফিনে কাঠগোলাপ (২০১৪), ঢেউয়ের ভেতর দাবানল (২০১৬) ও প্রার্থনার মত একা (২০২০)। এছাড়া প্রকাশিত ভ্রমণগ্রন্থ ‘লঙ্কাপুরীর দিনরাত্রি’ (২০১৭)।

ᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬᕫᕬ

লেখক পরিচিতি:
মেহেদী উল্লাহ জন্ম:১৯৮৯ সাল
মেহেদী উল্লাহ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক। জন্মস্থান নোয়াখালীর সুবর্ণচর, বেড়ে ওঠা চাঁদপুরের কচুয়ায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। তিরোধানের মুসাবিদা (২০১৪) তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। তিরোধানের মুসাবিদা গ্রন্থের পান্ডুলিপির জন্য তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৩ অর্জন করেন। প্রকাশিত অন্যান্য গল্পগ্রন্থ: রিসতা (২০১৫), ফারিয়া মুরগীর বাচ্চা গলা টিপে টিপে মারে (২০১৬), জ্বাজ্জলিমান জুদা (২০১৭), অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ (২০১৯)। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস: গোসলের পুকুরসমূহ (২০১৮)। প্রবন্ধ গ্রন্থসমূহ: ফোকলোরের প্রথম পাঠ (২০১৫), ফোকলোর তত্ত্বপ্রয়োগচরিত (২০২০), লোকছড়া: আখ্যানতত্ত্বের আলোকে (২০২০), নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন (২০২০)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ