উনিশশো একাত্তুরে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার আগে এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন মাহমুদুল হক, যে দেশে পেশাভিত্তিক, বর্ণ ও বংশভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাভিত্তিক সামাজিক স্তরবিন্যাসকে অস্বীকার করে সর্বাগ্রে মূল্যায়িত হবে অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা; ফলে অনিবার্যত তাঁকে লিখতে হয়েছিল ‘অনুর পাঠশালা’।
আমরা আমাদের মার্তৃভূমিকে স্বাধীন করেছি ত্রিশ লক্ষ শহিদ এবং মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। মাতৃভূমি স্বাধীন হবার আগেই রচিত হল ‘অনুর পাঠশালা’। ‘অনুর পাঠশালা’ রচিত হবার পর রচিত হল স্বাধীন বাংলাদেশ, অথচ অপ্রিয় হলেও সত্য এই স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর দাঁড়িয়ে আজ বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমরা মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছি।
প্রশ্ন উঠতে পারে মানুষ বলতে আমরা কী বুঝবো? এই বোঝাবুঝির বিষয়টির সুরাহা করতে চেয়েছেন মাহমুদুল হক ‘যেখানে খঞ্জনা পাখী’ উপন্যাসে। প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ১৯৭৩। এর পর উপন্যাসটির নাম হয়ে যায় ‘অনুর পাঠশালা’। প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা এই পাঠশালা অবলম্বনে পাঠ গ্রহণ শুরু করি।
২
মার্কস তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে’র ভূমিকায় বলতে চেয়েছেন, মানুষের সত্তা তার চেতনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না বরং বিপরীতভাবেই তা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে; অর্থাৎ সামাজিক সত্তাই মানুষের চেতনা নির্ধারণ করে। তা হলে কি মানুষ সমাজ সৃজন করে, নাকি সমাজই মানুষ তৈরি করে? বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা জানি, মানুষের তৈরি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর, আর সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মানবসত্তা। তা হলে মানুষ বলতে আমরা কী বুঝবো?
মানুষ অর্থ কাঙ্খিত সমাজের প্রতিচ্ছবি সম্বলিত একটি মনোদৈহিক সত্তা। অর্থাৎ বহুস্তরে আক্রান্ত সমাজে ধর্ম, বর্ণ ও পেশার ঊর্ধ্বে ব্যক্তিমর্যাদার চর্চা পরিলক্ষিত হলে আমরা একজন মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারি। অর্থাৎ মানুষ হয়ে ওঠার শর্ত সমাজকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল; মানবসত্তার ওপর নয়। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই অনু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ লাভ করলেও সে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর চেতনা পাঠে ব্যর্থ হয়। মানুষ হয়ে ওঠার প্রকৃত শিক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে প্রথমেই তাকে ক্রমাগত একের পর এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বিবিধ স্তরের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষ করে অনুর ক্ষেত্রে এই বিবিধ স্তর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা, লোকবিশ্বাস, লোকাচার, ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও বিশেষভাবে অর্থসম্পদ দ্বারা বিভক্ত সামাজিক স্তর। অনু নিজ আঙিনার বাইরে এসে, অনু চার দেয়ালের বাইরে এসে সমাজ ও প্রকৃতি থেকে পাঠ গ্রহণের মানবিক তাগিদ বোধ করে। ফলে অনু একদিকে যেমন ছকে বাঁধা সমাজ ব্যবস্থার কাছে, বিশেষ করে তার পরিচিত সংস্কৃতির কাছে, পিতা-মাতা আত্মীয়-সজনের কাছে ক্রমাগত বেখাপ্পা হয়ে ওঠে; ওপর দিকে সমাজের সিংহভাগ যে নিম্নবিত্ত মানুষ সেই মানুষের কাছে অনু কোনো দিনই আত্মীয় হয়ে উঠতে পারে না, হয়ে উঠতে পারে না বিশ্বাসযোগ্য কোনো মানবীয় সত্তা। তাহলে কি আমরা অনুকে শ্রেণিবিচ্যূত সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করবো? প্রকৃত প্রস্তাবে, কে এই অনু?
অনু এমন একজন মানবসত্তা যে মানবসত্তা এমন একটি বাংলাদেশের ওপর ক্রিয়াশীল যখন বাংলাদেশে উত্তেজনা এত তীব্র যে বলা উচিত এটা একটা যুদ্ধকালীন অবস্থা। বর্তমানের এই বাংলাদেশের এই সামাজিক অস্থিরতার সাথে অনু যুদ্ধরত। অনু ডিসেম্বরের ২০১৩ তে বর্তমান। বর্তমান, কারণ আজও অনুর মতো প্রতিটি কিশোর অথবা একেকটি বাঙালি সত্তা সমাজস্তরের পাঠশালার মুখোমুখিতে দাঁড়িয়ে পাঠগ্রহণে ব্যর্থ। সুতরাং যতদিন না কাঙ্খিত সমাজবিন্যাসের পাঠগ্রহণ আমরা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হবো ততদিন মাহমুদুল হকের অনু চরিত্র আমাদের চারপাশে ক্রিয়াশীল থাকবে।
চারদিকে বিভ্রান্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী আর পাকিস্তানী চেতনায় বিশ্বাসী দুটো ধারা এখনও এই স্বাধীন বাংলাদেশের ভূমিতে যুদ্ধরত। অমীমাংসিত এই যুদ্ধ চলমান। এর পাশাপাশি চলমান সামাজের প্রতিটি স্তরের সাথে প্রতিটি স্তরের লড়াই। এবং এক একটি স্তরের মানুষের কাছে অপর স্তরের মানুষ ক্রমশই দুর্বোধ্য। এ অবস্থায় প্রতিটি স্তরের সাথে প্রতিটি স্তরের অর্থনৈতিক সংযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ কারো মর্যাদাগত চেতনাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়।
এ অবস্থায় অনু নিজেও নিজের কাছে দুর্বোধ্য। সুতরাং ‘অনুর এক একবার খুব আচ্ছন্নভাবে মনে হয়, বেদম জ্বরের ঘোরে গ্লাস উপুর করে তৃষ্ণা মেটানোর পর যেমন ভেতরটা হাঁসফাঁস করে, এও তেমন। সব মিলিয়ে আঠারো কি উনিশটা ঘর, পুরোনা আমলের দোতলা, খড়খড়ির বড় জানালা, মোটা মোটা কড়ি-বরগা, উঁচু ছাদ। এমন উঁচু যে মনে হয় ওর ওপর আর আকাশ নেই।’
অনুর মতো বাংলাদেশের মানুষগুলোর মাথার ওপর কোনো আকাশ নেই। আকাশ নেই; কেননা আকাশ দেখার মতো, যে আকাশের অধিকার সবার জন্য সমমর্যাদার, সেই আকাশ দেখার শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয়নি এখনও; সুতরাং আমরা এখন আকাশশূন্য বাঙালি। সুতরাং আঠারো উনিশটা সামাজিক স্তরের পুরোনো একটা ছোট্ট দেশের ভেতর আমরা এখন হাঁসফাঁস করছি। সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তি এবং দলগত বিদ্বেষ, দার্শনিক দিকভ্রান্তি, ঐতিহাসিক বিভ্রম, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও রাজনৈতিক লুণ্ঠণ, অর্থনৈতিক অনৈতিকতা সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থান এখন কোথায়?
একদা এমন একটা অনাকাঙ্খিত বাংলাদেশ যেন আমাদের গিলে না খায়, সে দুশ্চিন্তা থেকেই মাহমুদুল হক ‘অনুর পাঠশালা’র রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে। এত বছর পর উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে আমার কাছে এ বিষয়গুলোই বারবার মুখ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
৩
মনে করা হয়ে থাকে, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। আসলেই কি তাই? অনু কি জন্মগতভাবে স্বাধীন? প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা কেউ স্বাধীন নই। অনু তার মেধা ও স্বভাবে পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সীমাহীন শৃঙ্খলা নিয়ে এই সমাজে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ফলে অনুর নিজের সীমানার বাইরের জগৎ পক্ষান্তরে সীমাহীন অপরিচিতের জগৎ। অনুর মা অনুকে সতর্ক করে দেয়, অনু সমাজের সাধারণ মানুষগুলো থেকে পৃথক। ‘ঐসব হাঘরে ইতরদের সঙ্গে তোর অনেক তফাৎ, ... তোর সবকিছু সাজে না। ভালো না লাগলে রেকর্ড বাজিয়ে শুনবি। ছবি আঁকা আছে, গল্পের বই পড়া আছে, ঘরে বসে যা ইচ্ছে করতে পারিস, কেবল টোঁ-টোঁ করে ঘোরা চলবে না।’
কিন্ত প্রশ্ন হল, আমরা আমাদের সন্তানদের এভাবে কী শিক্ষা দিচ্ছি? এই চূড়ান্ত জিজ্ঞাসার উন্মোচন ঘটিয়েছেন মাহমুদুল হক তাঁর ‘অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসে। এই অতি জরুরি জিজ্ঞাসার সূত্র ধরে আজকে আমরাও ভাবতে বাধ্য প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা কী চাই? কী হবে আমাদের আগামী প্রজন্মের রূপরেখা? এ প্রেক্ষাপটে মাহমুদুল হকের আলোচ্য উপন্যাসটি চূড়ান্ত অর্থে অতি গুরুত্ববহ একটি প্রকল্পও বটে। প্রকল্প এই অর্থে যে আমরা এই উপন্যাস পাঠেই বুঝতে পারি, প্রকৃত অর্থে মানুষ কী, সমাজের সাথে তার সম্পর্কটি আসলে কেমন হওয়া জরুরি আর সেই জরুরি অভিঘাতে দাঁড়িয়ে আমাদের করণীয় কী হওয়া আবশ্যক। কাজেই আজকের প্রেক্ষাপটে মাহমুদুল হকের ‘অনুর পাঠশালা’র পাঠগ্রহণ শুধু আঙ্গিক ও বিষয়নির্ভর আলোচনার মধ্যে আটকে থাকতে পারে না।
এথিকস শিল্পকে ব্যহত করে। এমন একটি প্রস্তাবনা অথবা বলা চলে সংশয় শিল্পের ইতিহাসে অনেক দীর্ঘ; কিন্তু শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ না করেও যে পাঠককে এথিকসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া সম্ভব তা দেখিয়েছেন আলোচ্য ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে। অনুর ‘অনেক কিছুই ইচ্ছাধীন নয়, লামাদের বাগানে যেতে পারে না--বারণ।’ প্রশ্ন হলো, কেন পারে না?
এই হাজারো না পারার শৃঙ্খলা আমরা প্রতিনিয়ত তৈরি করছি। প্রতিনিয়ত চাপিয়ে দিচ্ছি আমাদের মনোদৈহিক পরিবেশের ওপর। পক্ষান্তরে নিজের ওপর। এমনকি আমাদের সন্তানদের মগজের ভেতর। সভ্যতার ইতিহাস কী এই শৃঙ্খলা ভাঙার জন্য অনিবার্য এক ক্রম-লড়াইয়ের ইতিহাস নয়? অস্তিত্বগত সংকট থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য এই অনিবার্য লড়াইয়ের ফলাফলে শেষ পর্যন্ত কী একজন মানুষ তার মৌলসত্তাকে খুঁজে পায়?
অনু চরিত্রের মনোদৈহিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এই জিজ্ঞাসাও আমাদের খানিকটা ভাবিত করে। অনু চরিত্রের ভেতর দিয়ে এই এতগুলো সামাজিক ক্ষত, অপ্রিয় সত্য আর করণীয় চেতনা আবিষ্কার করার প্রয়াসে মাহমুদুল হক তৈরি করতে থাকেন অনুর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। ফলশ্রুতিতে উপন্যাসের পটচক্রে আরও কিছু অনিবার্য পরিপূরক চরিত্রের জন্ম হয়। অবলীলায় আমাদের চেতনাকে আক্রান্ত করতে থাকে ফকিরা, টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়াচাঁন আর সুরদাসীর মতো চরিত্র। এই অনিবার্য চরিত্রগুলো অনুর পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেইসাথে তার আধুনিকতাকে ম্লান করে দেয়। পক্ষান্তরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বস্তিবাসী কিশোর-কিশোরীদের, সেইসাথে শ্রমজীবী মানুষের গতিশীল জীবনাচার। পাশাপাশি প্রকৃতির সাথে সখ্যতা আর টিকে থাকার লড়াই উপন্যাসে মূখ্য হয়ে ওঠে।
এ অবস্থায় অপার প্রকৃতি আর খটমটে সমাজ-বাস্তবতার বেদির ওপর দাঁড়িয়ে শুরু হয় অনুর পাঠগ্রহণ; অথচ অনু যেন বা এই গোলমেলে সমাজের কাছে অনাহুত। টোকানি অথবা গেনদু অথবা সরুদাসী বুঝতে পারে অনু ওদের কেউ না। সরুদাসী বলে ওঠে, ‘তুই খুব সুন্দর দেখতে রে। তোরা সাহেব মানুষ তাই না?’ সাহেব মানুষের ছেলে অনু অপরিচিতের আহ্লাদে প্লাবিত হতে থাকে। হতবিহবল অনু এবং পক্ষান্তরে এক ধরনের উড়নচণ্ডী নেশা তাকে পেয়ে বসলেও অনুর ভেতর নিজ শ্রেণিচেতনা অবচেতনে জাগ্রত থাকে। সরুদাসী অনুর কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করে ক্রমাগত নিজের পরিবেশ, নিজেদের জীবন-জগতের নানা টুকিটাকি তথ্য উপস্থাপন করতে থাকে। অনু হতবাক হয়। অনু জানতে পারে সরুদাসীরা ঋষিপাড়ায় থাকে, ওরা মুচি; জুতা ছেন্ডেল সেলাইতে ওদের দক্ষতা।
সরুদাসীর কাছ থেকে অনু ক্রমাগত জানতে পারে সরুদাসীদের জীবনের দৈনন্দিন হিংসা-বিদ্বেষ আর যৌননির্ভর জীবনের সাথে পেশাগত আর অর্থগত বিষয়াদির কথা। অথচ অনু এমনতর জীবন-জীবিকার প্রকৃত তাৎপর্য অথবা প্রকৃত চেহারা কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নিজেদের শ্রেণির ফকিরা, ফালানি, গেনদুদের বিষয়ে সরুদাসী অনুকে সতর্ক করে দিয়ে বলতে থাকে, ‘মিশিস না ওদের সঙ্গে। চোর-ছ্যাঁচড়া আর গাঁটকাটার পাল ওগুলো। সবকটা জোচ্চোর আর ক্ষুদে বাটপার।’ এরপর সরুদাসী চারমানবাবুদের ছোটোমেয়ের বিয়ে না হলেও কীভাবে পেট হয়েছিল সেই পেট খালাস করতে সরুদাসীর মাকে নিয়ে গিয়েছিল; বড় লোকদের এইসব গোপন লজ্জার সংবাদ সরবরাহ করতে গিয়ে সরুদাসী মন্তব্য করে, ‘তলে তলে আবার এতো! আমি হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম, ছি করো, ছি করো!’
সরুদাসী অনুর থেকে বয়সে ৩/৪ বছরের ছোট; বয়স ৭ কি ৮; অথচ অনুর থেকে অভিজ্ঞতার স্কুলে সরুদাসী বিজ্ঞ যেন বা প্রৌঢ়া। কাজেই সরুদাসীকে বলতে শোনা যায়, তারা অনুদের মতো বড় লোক নয়; ওদের মতো দোতালা দালান ঘর তো দূরে থাক ওদের ঋষিপাড়ার সবাই জুতা সেলাই করে দিন চালায়; ওর বাবা অনেক ভালো ভালো কাজ পেলেও সেই কাজ করে না; ওদের জন্মই হয়েছে জুতা সেলাই করার জন্য; এ কাজ না করলে ভগবান রেগে যাবে; ওর মা দাইয়ের কাজ করলেও এখন আর কেউ ওর মাকে পেট খালাসের জন্য ডাকে না; কেননা, ‘আজকাল ধুমসী ধুমসী পোয়াতীরা গ্যাঁট গ্যাঁট করে সোজা হাসপাতালে চলে যায় পয়সা বাঁচাবার জন্য। মদ্দা ডাক্তারের হাতে খালাস করায়। ঘেন্নায় আর বাঁচিনে বাপু! তুই বুঝি ইস্কুলে পড়িস?’
অনুর স্কুল শিক্ষা, অনুর বিজ্ঞানশিক্ষা ক্রমাগত ফিকে হতে থাকে; উন্মোচিত হতে থাকে প্রাকৃত জীবনের প্রাকৃত বিশ্বাস আর যৌথ আচার। যেনবা ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’ এমন একখানা শ্লোগান অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় অনুর কিশোর চেতনায়। চিরায়ত বিশ্বাসের অনিবার্য গতির ওপর দাঁড়িয়ে অনুর মতো একজন ওপরতলার আধুনিক বালক শুনতে পায়, ‘কোনো একদিন ঝনঝনে থালার মতো দুপুরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে একটা পাখি দারুণ চিৎকার করে উঠলো; কানে বাজলো, এসো অনু--এসো।’
এই অনিবার্য স্বাধীনতার ডাককে অনু অস্বীকার করতে পারে না। তারপর অনু পরিচিত হয় মিয়াচাঁনের চিকন গলার সাথে। মিয়াচাঁনকে ‘ঘাটুদলের মাইনসে বিয়া কর্যা লয়া যাইবার চায়। বুঝচস কিছু? অর বাপে রাজি অইতাচে না। এতোডি মাল ছারবার পারলেই অরে দিয়া দিবো।’ অনুর কাছে এ এক ভিন্ন জগৎ। এই জগতের সাথে অনুর মতো ওপরতলার মানুষগুলোর পরিচয় অসম্ভব। এই অসম্ভব জীবনের পাঠ গ্রহণে অনুকে মিয়াচাঁনের মেয়েলি কণ্ঠের গান শুনতে হয়,
নাহে নোলক কানে ঝুমকা
মাইয়া একখান বডে
নদর গদর চলে মাইয়া
ফুশুর-ফাশুর রডে -
এরপর অনু গেনদুদের সাথে ঘেসোভুঁড়ি জঁটাধারী শিবের নাচ দেখতে গিয়ে দেখতে পায় একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে ফুকুর ফুকুর সিগারেট টানছে দশমহাবিদ্যাধরী মা কালী, হাতে টিনের লাল জিভ; আর তখন মা কালীর মুখ থেকে খিস্তি উগলে ওঠে, ‘বেজাইতা পোলাপান আয়া জুটচে সব, আব্বে নাটকির জানারা ভাগলি?’
অনু দিনের পর দিন ব্রাত্য জীবনের অলিগলির সাথে পরিচিত হলেও সে ব্রাত্য জীবনের প্রকৃত পরিচয়, প্রকৃত লড়াই আর টিকে থাকার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে কিনা তা অনুর কিশোর মন ঠিক ঠাওর করতে না পারলেও উপন্যাস পাঠে আমাদের পাঠক মনের ওপর ব্রাত্যজনদের জীবনাচার আর কষ্টের বিভীষিকা ফুটে ওঠে। আমরা তাড়িত হই। ‘টোকানীর বাবা ছুতোরের কাজ করে। খুবই গরিব ওরা, কিন্তু টোকানিকে দেখলে কখনোই তা মনে হয় না, মনে হয় কতো সুখী, দুনিয়ায় ওর কোনো সমস্যাই নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দুর্ভাবনা নেই, এপাড়া-ওপাড়ায় বিভোর হয়ে ব্রিং খেলছে তো খেলছেই। সুখী মনে হয় গেনদুকেও। তার বাবা গাড়োয়ান। ওরা প্রায়ই দু’বেলা পেটপুরে খেতে পায় না। পিটুনি খেতে খেতে গেনদু শুকনো ডাঁটার মতো হয়ে গিয়েছে।’
অনুকে সাথে নিয়ে আখের রস খায় ওরা। অনু নাক সিটকে বলে ওঠে, ‘ইস! কী কসটে গন্ধ!’ এ অবস্থায় গেনদু ক্ষেপে গিয়ে বলতে থাকে, ‘তরা এসবের কি জানস? লর গন্দে শরীল মোডা অইবো, কেঁচকি মাইরা টোকানিরে কাইত কইরা ফ্যালান যাইবো, বুঝচস? তুই হালায় অক্করে বোদাই।’
সত্যিই অনু অনেক কিছুই জানে না। যত কিছু জানে গেনদু, টোকানি, ফালানি, মিয়াচাঁন অথবা ওরা সবাই। ‘গাছের পাতায় জমে থাকা ধুলো ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করতে পারে গেনদু। গাছের ছায়া নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলতে জানে মিয়াচাঁন। টোকানি ফালানি গেনদু লাটু মিয়াচাঁন নাড়িনক্ষত্র জানে পথঘাটের। ছাগলের গলায় নুন্নুড়ি দেখলে কি হয়, জোড়া শালিখ দেখলে কি হয়, লাউ কিংবা পুঁইশাকের মাচায় আনজিরা দেখলে কিভাবে হ্যাক্--থু করে বুকে থুতু দিতে হয়, এক চোখ দেখলে কি কি অঘটন ঘটতে পারে কিংবা অসতী মেয়েমানুষের লক্ষণ কি কি--সবকিছুই ওদের নখদর্পণে।’
৪
প্রতিনিয়ত অনু তাড়িত হয় সরুদাসীর মতো কিশোরী-উচ্ছল জীবনীশক্তি দ্বারা। অথবা গেনদু, মিয়াচাঁনদের দুর্নিবার জীবনদর্শন দ্বারা অনু আলোড়িত হয়। এই যে ব্রাত্যজনদের সমাজ, এই সমাজের আরও কিছু চরিত্র, এই আরও কিছু চরিত্র এক এক করে উপন্যাসে উন্মোচিত হতে থাকলে আমরা বুঝতে পারি অনুর কী আছে আর কী নাই। এই কী আছে আর কী নেই, এটা শুধুমাত্র অনুর ভেতর সীমাবদ্ধ না থেকে তা হয়ে ওঠে সবার জন্য অনিবার্য এক সংকট। আমরা চিহ্নিত করতে থাকি আমাদের ক্ষত-অভাব আর স্বাধীন-সৃষ্টিশীল মানুষ না হয়ে উঠতে পারার যন্ত্রণাকে। আমাদের মত এই যে মানুষ, এই মানুষগুলোর অভিভাবক আসলে কারা, তাদের রূপরেখাই বা কী হবে, আর কেমন হবে আমাদের পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র?
এই যে উপন্যাসপাঠের মধ্য দিয়ে নিজেকে, নিজের পরিবার আর সমাজকে পর্যবেক্ষণ করার জায়গাগুলোকে দেখিয়ে দিচ্ছেন লেখক এখানে এসে ‘অনুর পাঠশালা’র টেক্সট শেষ পর্যন্ত একটি কার্যকরী শিল্পে উন্নীত হয়। আমরা আমাদের অর্জিত হাজার বছরের চেতনা আর সভ্যতার বর্ণিল প্রাপ্তিকে সাজিয়ে রাখি কাঁচের বোয়ামে। সময় পার হয়ে যায়। বয়স উপযুক্ত জীবনভোগ হয়ে যায় আমাদের হাতছাড়া। পক্ষান্তরে একটা মিথ্যে জীবনের জন্ম দেই আমরা; অথচ জীবন তো মাত্র একটি বারের জন্য আমাদের দেহ নিয়ে ধরা দেয় আমাদের হাতের মুঠোয়; দেহের সাথে সংযুক্ত থাকে যে ‘মন’ সেই মনের চেহারা আমাদের কারোই শেষাবধি দেখা হয়ে ওঠে না। ‘রঙ-বেরঙের বহু মার্বেল আছে বহুদিন আগেকার; কিন্তু সে ব্রিং খেলা জানে না। নিজের কাছেই সে বয়েস পার হয়ে গিয়েছে। বয়েমে সাজানো আছে মার্বেলগুলো। অদ্ভুতভাবে আলো ঠিকরে পড়ে কখনো কখনো। আর আছে এ্যাকোয়ারিয়ামে আমাজান সোর্ডের চারপাশে ছড়ানো, সিলভার ডলার এ্যানজেল আর লিওপার্ড কোরিডোরাসের খেলার সামগ্রী।’
চারপাশে এই এত খেলার সামগ্রী আমরা কৃত্তিমভাবে তৈরি করে নিয়ে জীবনগঠনের দিকে ধাবিত হবার যাবতীয় আয়োজন সমাপ্ত করি। ফলশ্রুতিতে, পক্ষান্তরে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের অতি মূল্যবান অর্জিত শৈশব, পায়ে ঠেলে দেই আমাদের অতি স্বাধীন-সুন্দর প্রকৃতিকে। যাবতীয় সৌন্দর্যের আধার আমাদের প্রকৃতিকে শত্রু বানিয়ে আমাদের ভেতর লালন করতে থাকি আমাদের দানবীয় চেতনাকে। আমরা প্রকৃতির কোল থেকে নাড়িছেড়া যন্ত্রণায় আমাদের শিশুদের জন্ম দেই চার দেয়ালের ভেতর, চার দেয়ালের ভেতর তাদের জন্য নির্মাণ করি জীবন সাজাবার যাবতীয় আসবাব। আমরা আমাদের চোখকে পাথর বানিয়ে ফেলি আর ভেতরে বিষ পুষে রেখে আমাদের প্রজন্মকে ঠেলে দেই রূপকথার ক্ষিরনদীর পরিবর্তে বিষনদীর অথই স্রোতে। ‘এই ধরনের কৌটা মার ট্রাঙ্কে আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে মা। প্রপিতামহদের আমলে তাদের কেউ গোলকুণ্ডার হীরা রাখতো সেটায়। দাদু রাখতো তার অব্যবহৃত একটি পাথরের চোখ। মা রেখেছে বিষ; যতোদূর মনে পড়ে একদিন চুপি চুপি তাই-ই যেন বলেছিলো।’
সত্যিকার অর্থেই আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের চোখকে পাথরে পর্যবসিত করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে আমরা বিষ পুষে রাখতে বাধ্য হই আমাদের মনকুঠুরিতে। প্রশ্ন হলো, মনোদৈহিক চেতনায় এভাবে বিষ পুষে রেখে শেষ পর্যন্ত আমরা কি আমাদের অনাগত ভবিষ্যতকে কাঙ্খিত স্বপ্নের জগত তৈরিতে উৎসাহিত করতে পারি? নাকি আমরা আদতে কেউই তা চাই না, প্রকৃত প্রস্তাবেই আমরা আমাদের সোনার বাংলাদেশ চাই না; আর চাই না বিধায় আমাদের স্বাধীন ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে এখনও অপশক্তি শক্তি সঞ্চয়ে ক্রিয়াশীল।
৫
প্রশ্ন উঠতে পারে ‘অনু’ কি নতুন দিনের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক? ‘অনু’ কি আমাদেরকে সকল প্রকার অপশক্তিকে পরাজিত করে শুভশক্তির চেতনায় জারিত হবার স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম?
আমাদের ভেতর থেকে অনুই সম্ভবত প্রথম বারের মতো গৃহশৃঙ্খলা ছিন্ন করে ছুটে গিয়েছিল সমাজের বৃহত্তর শ্রেণির কাছে, পতিত সমাজের কাছে, বস্তিবাসীর কাছে, হরিজনদের কাছে, শ্রমজীবী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিরায়ত বিশ্বাস আর পরিবর্তনহীন জীবনাচারের কাছে। এখানে গৃহশৃঙ্খলার অর্থ সমাজ-শৃঙ্খলা; যে সমাজ কেবল সমাজের ওপর তলার মানুষদের বিলাসিতার যোগান দেবার দায়িত্বে সর্বদা কৌশলী।
সহসাই আমরা দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথের অমলের ভেতর অনুকে। কিন্তু ডাকঘরের অমল শেষ পর্যন্ত রোমান্টিক আবেশে সমাজের আবেগকে সাথে নিয়ে জ্বলে উঠে জানালার বাইরে যে স্বাধীন নীলাকাশ সেই আকাশের বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। অমল আকাশের ভেতর চিরায়ত সৌন্দর্য আর অপার স্বাধীনতা আবিষ্কার করলেও সমাজের বৃহত্তর জনজীবনের মুখ সেদিন সেই স্বাধীন আকাশের ক্যানভাসে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও আমাদের আকাক্সক্ষা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা অমলের চেতনায় অনিবার্য পতিত সমাজের চেহারা স্বাভাবিক নিয়মেই ধরা দেবে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অমলকে আটকে রেখে দিলেন রোমান্টিক ইমেজের ইজেলে।
মাহমুদুল হক এক্ষেত্রে সতর্ক। তিনি অনুকে শুধু বালখিল্য স্বাধীনতার ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে এক এক করে উন্মোচন করলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষা আর রুচির বিকৃতিকে। অনুর অ্যাডভোকেট পিতা সমাজের আউটসাইডারদের, সমাজের ক্রিমিনালদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এক ধরনের যোগ্যতার অহমিকা বোধ করেন। পক্ষান্তরে আমরা অনেকেই এভাবে আত্মশ্লাঘায় অনুপ্রাণিত হই। তা হলে কি আমরা কমবেশি সবাই পারভাটেড?
এই প্রশ্ন উষ্কে ওঠে আমাদের ভেতর যখন আমরা অনুর পরিবার-কাঠামোর দিকে নজর দিতে বাধ্য হই। অনুর মা-ও আমাদের দৃষ্টি সেদিকেই ঘুরিয়ে দেন। অনুর মা তার স্বামীকে পছন্দ করেন না; তার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তিনি উচ্চাভিলাসী; তিনি ইংরেজি শেখার জন্য গৃহশিক্ষক রাখেন; এক পর্যায়ে এই গৃহশিক্ষকই তার জীবনের মহার্ঘ্য আইকন হয়ে দেখা দেয়। অনুর মা স্বাধীন হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন পরিবার প্রথার এথিকসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। ফলে অনু ক্রমাগত পতিত হতে থাকে উচ্চবিত্তের বিভীষিকার ভেতর। ‘অনু আব্বাকে সহ্য করতে পারে না। ঘৃণা করে। যে সময় তিনি ঘরে থাকেন সে সময় ইচ্ছে করে গা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে নিজেকে আড়াল করে রাখে। প্রথমে ছিলো ভয়। এখন ভয় থেকে ঘৃণা।’
এই যে ঘৃণা, এই যে অভিভাবক থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়া, এই যে নিজের গৃহে বিড়ালের মত নিজেকে আড়াল করা, এগুলো কীসের ইঙ্গিত? আমাদের ভবিষ্যত ছুটে চলছে কোন অন্ধ গলিতে? এই বিভীষিকা থেকে অনু মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টায় রত। ‘বাড়ি থেকে পালানো কতো আনন্দের, অনু বারবার রোমাঞ্চিত হয়েছে। বনে-পাহাড়ে, পদ্মার নির্জন কোনো কলাগাছ ঘেরা চরে, জেলেদের ছোট্ট কোনো গ্রামে--যার চারপাশে কেবল থৈ থৈ পানি--পালালে এইসব জায়গাতেই যাবে। তা না হলে এমন কোথাও যেখানে সকলে চিৎকার করে কথা বলে, ঘাসের বিছানায় ঘুমায়, যেখানে আঠারো কিংবা উনিশটা রাক্ষুসে হাঁ-র মতো ঘর নেই, বিশাল উঁচু ছাদ নেই, যেখানে বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম, হু হু হু হু বাতাস বয়ে যায়।’
এরপর আমরা মুখোমুখি হই অনুর অন্তর্দ্বন্দ্বের; যেখানে অনুকে আমরা আবিষ্কার করি এমন এক সংকটের ভেতর যে সংকটকে আমরা সবাই আজীবন লালন করে চলেছি আমাদের ভেতর, ‘অনু শিউরে ওঠে। বুকের মাঝখানে কাচের নীল পিরিচ ভেঙে খান-খান হয়ে যায়। মা’র যাবতীয় সুন্দর অভিলাষগুলো নির্দয় পাথরে পরিণত; এই বাড়ি ছেড়ে, শয়তানের এই থাবা থেকে আর কোনোদিন নিরাপদে পালানো যাবে না। ভয় হয়। তবু এতো ভালোবাসে সে মাকে যে প্রতি মুহূর্তেই উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করে, রাত্রিবেলা মাঝে মাঝে নির্বোধ শিশুর মতো বিছানা হাতড়ে কি যেন খোঁজে। তার কেবল ভয়, চিরকালের মতো এক দুর্জ্ঞেয় অন্ধকারে একে একে সব মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। মায়ের সব ইচ্ছেগুলো যদি নির্দয় পাথর হয়ে গিয়েও থাকে তবু মনে মনে অনু সেই পাথরটা কেটে টেবিলের ওপরে সাজানো ভাঙা যিশুখৃস্টের মূর্তির চেয়ে অনেক সুন্দর তার রূপ দিতে চেষ্টা করে।’
আমরাও বিশ্বাসে বুক বাঁধি আমাদের মায়েরাও যিশুখৃস্টের মতো শান্তির দূত হয়ে নতুন রূপে আমাদের শুশ্রুষা দেবে; নিরাপদ আশ্রয়ে আগলে রাখবে তার সন্তানদের। আমরা আমাদের নিজ নিজ মায়ের মুখের দিকে তাকাই; নিজের মাতৃভূমির দিকে তাকাই এবং শেষ পর্যন্ত আবারো সংকটের জন্ম দেই। সুতরাং সঙ্গত কারণেই নকশাল আলোয় পাঁচ উপন্যাস প্রসঙ্গে কুমার দীপংকর মণ্ডল বলতে বাধ্য হলেন,‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সংগ্রামশীল এবং বিপ্লবের ধারক। সময়ের প্রয়োজনে অথবা অস্তিত্বের সংকট নিরসনে মানুষ জীবনকে পুঁজি করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষের এই সহজাত প্রবণতা একান্তভাবেই প্রকৃতিপ্রদত্ত। মানুষের মত বেঁচে থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা মানুষকে ধাবিত করে বন্ধুর-উষর-কঠিন সম্মুখ সংগ্রামে। মানুষ সভ্যতার আদিমকাল থেকে আজ অবধি সংগ্রামের মাধ্যমে এতদূর আসতে পেরেছে, এতটা উন্নত হতে পেরেছে। মানুষের সভ্য হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষের জীবন, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ অতি সহজপথে কিংবা দৈবপথে আসে নি। মানুষ জন্ম থেকে যা শেখে, প্রকৃতি থেকে যা বুঝতে পারে--তাই আত্মস্থ করে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে।’
তাহলে অনুও কি প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে নিয়ে হেঁটে গিয়েছে মানুষের দিকে? সেক্ষেত্রে অনু কীভাবে সংগ্রামশীল, অথবা কতটুকু বিপ্লবের ধারক? এ কথা ঠিক যে অনু প্রকৃতিপ্রদত্ত তাড়না থেকে ঘর পালানো বালক। তারপরও অনুকে ঘিরে ক্রিয়াশীল রয়েছে শৃঙ্খলা এবং বিষাদ। অনুর বিপ্লব মূলত অন্তর্জগতের বিপ্লব। এক পর্যায়ে অনু পারিবারিক শৃঙ্খলা ভেঙে উলঙ্গ শীতল নির্জন মেঝের ওপর শুয়ে আবিষ্কার করে, ‘এইসব বিদীর্ণ দুপুরের মাঝখানে, ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে, গোল চারকোণা বাগানের চেয়ে, গাছের পাতার চেয়ে, সমুদ্রের চেয়ে, পাখির গানের চেয়ে, সুন্দর আর ঠাণ্ডা একটি মেঝে পরম নিভৃতে কোথাও আরামে চোখ বুজে অচৈতন্যপ্রায় পড়ে আছে জলেশ্বর মালীর মতো। অনুর মনে হলো, জলেশ্বর মালী কতো সুখী।’
এই যে অনুদের সামান্য একজন স্বল্পবেতনাশ্রয়ী কর্মচারী, একজন সামান্য মালী, সেই মালীর ভেতর অনু আবিষ্কার করে ফেলে জীবনের অর্থ, জীবনের স্বাধীনতা আর অপার সুখ। মাহমুদুল হকের এই দৃশ্যপট অনুকে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের অমলের কাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেয় জনসমাজআশ্রিত প্রেক্ষাপটের পটভূমিতে; যে পটভূমিতে বসবাস সমাজের ব্রাত্যজনদের। তা হলে কি ঔপন্যাসিক আমাদের ওপরতলার সুখ-সম্পদকে অস্বীকার করছেন? তাদের ঐশ্বর্যকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন? নাকি মাহমুদুল হক ওপরতলার মানুষের সাথে নিচুতলার মানুষের এক ধরনের যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন? কেননা আমরা দেখতে পাই, ‘পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।’
আমরা দেখতে পাই অনু গৃহশৃঙ্খল থেকে নিজেকে গোপনে বিচ্ছিন্ন করে রাস্তার টোকাইদের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেছে। বস্তির অলিতে গলিতে নিজেকে টেনে নিয়ে অবশেষে বস্তিবাসীদের দুর্বিসহ জীবনের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি অথবা ফকিরা, টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়াচাঁন আর সরুদাসীর সাথে অনু একাত্মতা বোধ করতে শুরু করেছে। অথচ শেষাবধি অনুকে আমরা একা এবং বিচ্ছিন্ন হিসেবেই আবিষ্কার করি।
আমরা দেখতে পাই, অনু শেষাবধি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি সমাজের এইসব হরিজন আর বস্তিবাসীদের সাথে। অনুর আধুনিক জীবনের শিক্ষা এ পর্যায়ে এসে অকার্যকর হয়ে যায়। অকার্যকর নয় বরং বলা উচিত অনু তার আধুনিক রুচি এবং শিক্ষাবোধ তথা শ্রেণিসতর্কতার কারণে নিজেকে বৃহত্তর জনচেতনার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছে। এটাও মাহমুদুল হকের ঔপন্যাসিক হিসেবে এক ধরনের সতর্ক হিসেব-নিকেশ। ফলে অনু চরিত্রের পাশাপাশি উপন্যাসের ভেতর উপস্থিত প্রত্যেকেই স্তরবিভক্ত সমাজের প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক ও জীবন্ত আচরণ করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত বর্তমান সমাজবাস্তবনির্ভর জীবন আর কিশোর অনুর স্বপ্ননির্ভর জীবনের এক অনিবার্য সংঘাত সূচিত হলেও আমরা সমাজের অসংগতিগুলোকে আমাদের সাদা চোখে খুব সহজেই চিনে ফেলি এবং চিনে ফেলার পরও আমরা গুলিয়ে ফেলি তখন, যখন আমরা ভাবি অনুর করণীয় কী অথবা ফালানি, গেনদু অথবা সরুদাসী এদের জন্য সমাজ-রাষ্ট্র আদৌ কোনো দায়ভার বহন করছে কিনা?
এভাবে অনিবার্য চেতনার বাস্তবভিত্তিক প্রশ্ন জাগিয়ে দেওয়াই কি একজন ঔপন্যাসিকের কাজ? যদি তাই হয়, এ অর্থে মাহমুদুল হক একজন সার্থক ও ব্যতিক্রম প্রয়াসের কথাশিল্পী। মাহমুদুল হক হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন সামাজিক বিচ্যূতিগুলোকে উপন্যাসের প্লট হিসেবে জায়গা করে দিতে হলে চরিত্রের নর্মগুলিকে না ভেঙে অগ্রসর হওয়া জরুরি; তিনি সেই কাজটিই করতে চেয়েছেন। ফলে সরুদাসীকে যেমন আমরা অবলীলায় আমাদের চোখের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখি; তেমনি দেখি টোকানি, ফালানি অথবা গেনদুর মতো অথবা ঋষিপাড়ার বাস্তবভিত্তিক দৈনন্দিন ক্রিয়াদি অথবা শ্রেণিবিভক্ত সমাজের শেকড়ে যে ফোকবিলিভ, যে লোকাচার সহসাই আধুনিক জীবনকে ফিকে করে দেবার ক্ষমতা রাখে সেই চিরায়ত জীবনের দৈনন্দিন ছবি এত অবলীলায় মাহমুদুল হক তুলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন; বিধায় সেই দৈনিকতা-নির্ভর চিরায়ত প্রাকৃত শক্তির দিকে দ্রুত ধাবিত হতে পেরেছিলো অনু।
এ প্রসঙ্গে বলা কর্তব্য, বার্তের মতে, ‘পাঠকের মধ্যে যে প্রভাষা’ আছে, সেই প্রভাষাকে পাঠ করার মতো যোগ্যতা থাকা উচিত লেখকের বা প্লট নির্মাতার। পাঠকের ভেতরের এই ‘প্রভাষা’ পাঠ করার মতো এক ধরনের সহজাত যোগ্যতা লক্ষ করা যায় মাহমুদুল হকের লেখক-চেতনায়। ফলে অনু অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের চেতনায় সমাজ-জটিলতার বিবিধ স্তরভিত্তিক ক্রিয়াদির রেখাপাত ঘটতে দেখা যায়।
৬
হারবার্ট রিড তাঁর ‘দ্য মিনিং অব আর্ট’ প্রবন্ধে শিল্প নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, এক অর্থে শিল্পকর্মে ব্যক্তিত্বের মুক্তি ঘটে। সে ক্ষেত্রে অনুর চরিত্র বিকাশে অনুর ব্যক্তিত্বের মুক্তি ঘটেছিল উন্মুক্ত সমাজ-পরিবারের অপার বাস্তবতায়; নিজ পরিবারে নয়; পারিবারিক শিক্ষায় মোটেও নয়। এ অর্থে গেনদু, টোকানি, ফালানি, মিয়াচাঁনদের জগৎ অনুর কাছে শিল্পতুল্য জগৎ। মানুষের চেতনা বিবিধ বিধিনিষেধে শর্তাধীন, স্থবির ও অবদমিত। শিল্পকর্মে আমরা এই শর্তাধীন অবদমনের মুক্তিপ্রত্যক্ষ করি। সেই সঙ্গে লাভ করি শর্তহীন মানসিক স্বাধীনতা। ফলে আমাদের ভেতর জেগে ওঠে বিবেচনাবোধ,পরম অনুভব ও প্রশান্তি। পাশাপাশি ক্রিয়াশীল হয় অপরাধবোধ, নিজেদের সীমাবদ্ধতা। এই যে নিজেকে আবিষ্কার করার চোখ, নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে পর্যবেক্ষণ করার চোখ, যা আমরা শিল্প থেকে পেয়ে থাকি। ঠিক এই চোখই আমরা পেয়ে যাই যখন আমরা অনুর চোখ দিয়ে নিজেদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা থকথকে অসাম্যের সমাজকে দেখতে পাই। তখন কি আমরা খানিকটা অপরাধী হয়ে উঠি? অপরাধ বোধ কি আমাদের তাড়া করে? নাকি শুধুই শিল্পের অপার আনন্দে শিহরিত হই?
মাহমুদুল হকের অনুকে পাঠ করতে গিয়ে শিল্পবোধের পাশাপাশি আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছি; হয়েছি যন্ত্রণাকাতর। এ কারণেই এই ছোট্ট শিশুতোষতুল্য ফিকশন ‘অনুর পাঠশালা’ আমার কাছে এখনও একটি বিস্ময় জাগানিয়া ফিকশন। যদিও মাহমুদুল হক কাজটি তাড়াহুড়োয় হয়তো বা কিছুটা ধৈর্যহীনভাবেই ছোট ছোট এপিসোডে হুট করে শেষ করেছেন, তারপরও এই আনফিনিসড এপিসোডের ইশারায় ইকোসোসিও ইথিকস, সেইসঙ্গে শিক্ষা-কালচার-দারিদ্ররেখার একেবারে নিচে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অনিশ্চিতভাবে টিকে থাকা সিংহভাগ মানুষের বঞ্চনাগুলো ভোগবাদী কালচারের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেখিয়ে দিতে সক্ষম; এই সক্ষমতার কারণেই এই ফিকশনটি অমীমাংসিত প্রশ্নের রেখায় ঝুলে রয়েছে; যা কিনা দৃষ্টি আকর্ষণকারী ফিকশনের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই ‘অনুর পাঠশালা’ আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয়, ওই সীমানাটি অনুদের অর্থাৎ ওপর তলার মানুষের। আর ওই যে ক্রমশ নিচের দিকে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া রেখা ওইটি সরুদাসীদের, ব্রাত্যজনের। সুতরাং অনু সরুদাসীকে খুঁজে পেতে অবশ্যই ব্যর্থ হবে। এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক বাস্তবতা আশ্রিত বিবেচনাবোধের মধ্য দিয়েই মাহমুদুল হক সমাজের থকথকে সত্যকে চিহ্নিত করেছেন কোনো প্রকার আবেগ অথবা কৈশোর প্রেমের প্যাঁচপেচে পিচ্ছিল পথে পা না রেখে। আর এই ফাঁকে আমরা ভোগবাদী জীবনে আরও খানিকটা স্বার্থপরজীবনের দিকে পা রাখি, হেঁটে চলি, ভোগবাদী প্রতিযোগিতায় সামিল হই।
তারপরও অনুর শৃঙ্খলিত জীবনের প্রথম অনুভব ব্রাত্যজীবনের অপার স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতির সাহচার্য; বলা সম্ভব আতিশয্য। পক্ষান্তরে যাকে বলা সম্ভব ‘মুক্তি’। এই মুক্তি এসেছিল শিল্পের পথ ধরে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, এই শিল্প মূলত বাস্তব জীবনাচারের সাথে সংযুক্ত; সংযুক্ত সমাজ ও প্রকৃতির সাথে। উদাহরণ হিসেবে বলা সম্ভব এই ধরনের মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু অথবা দুর্গা। অবশ্য অপু এবং দুর্গার জীবনের মানস-মুক্তি সীমাবদ্ধ ছিল নিজ শ্রেণিস্তরের সীমানায়। আর মাহমুদুল হকের অনুর জীবনের মানস-মুক্তি অর্জিত হয়েছে শ্রেণিবিচ্যূত জীবন উপলব্ধির মধ্য দিয়ে। অনুর সত্তাও ছিল নিজ শ্রেণিসীমানায় নানান নিষেধের বেড়াজালে শর্তাধীন ও আড়ষ্ট; ফলে তা ছিল অবদমিত।
এ অবস্থা থেকে অনু চরিত্রের মুক্তি ঘটাতে গিয়ে মাহমুদুল হক একদিকে যেমন আমাদেরকে দিয়ে সমাজবিজ্ঞান পাঠ করিয়ে নিচ্ছেন, অপরদিকে তেমনি শিল্পবোধের সীমানায় অনুভবের আস্বাদনও জাগিয়ে তুলছেন আমাদের ভেতর। কিন্ত প্রকৃতিবিস্তারি এই শিল্পবোধের ভেতরও অনুর ভেতর ভয় জেগে ওঠে, জেগে ওঠে দ্বিধা। কারণ, ‘গেনদু, মিয়াচাঁন, ফকিরা কিংবা ফালানি--এদের কারো মুখেই আলো খুঁজে পায় না অনু; এদের মুখের ধারালো অন্ধকার রক্তনেত্র রৌদ্র বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে কখনো কখনো, এইমাত্র। চৌ-পহর দিন এরা বিষদাঁত হাতড়ে ফিরছে। সামান্য একটা ব্যাঙকে যখন এরা পা দিয়ে চটকায় কিংবা এতোটুকু হালকা ঝিঁঝিপোকা কি প্রজাপতির ফিনফিনে শরীরকে শতেক টুকরো করে কুটকুটিয়ে ছিঁড়তে থাকে তখন এদের চোখমুখে উল্লাসের যে আগুন ঝলসে উঠে অনু তা দেখে ভয় পায়। এইতো কয়েকদিন আগেই মাঞ্জা দেওয়া করকরে লাল সুতোয় টান মেরে একজনের কান উড়িয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়েছিলো গেনদু, বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েছিলো।’
প্রকৃত বাস্তবতায় এগুলোই আসলে জীবনের উদ্দামতা; জীবনকে উপভোগের সহজাত লক্ষণ আসলে এগুলোই। এই উদ্দাম গতির সাথে ফালানি, গেনদু, টোকানি অথবা সরুদাসী সংযুক্ত। অথচ রুগ্ন অর্থনীতির জাতাকলে অতিষ্ঠ ওরা। এ অবস্থায় গেনদু, ফালানি, টোকানি অথবা সরুদাসীদের সাথে শেষ পর্যন্ত কি অনু একাত্ম হতে পেরেছে? আমরা উপন্যাসের শেষে এসে দেখতে পাই, অনু একাত্ম হতে ব্যর্থ হয়েছে। অনু ছুটে পালিয়ে এসেছে অথবা বলা চলে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে তার শ্রেণিচেতনার কারণে, তার অভিজাত রুচির আঘাতে, ‘পেছনে কয়েক পা সরে এসে বিভ্রান্ত অনু বললে, ‘চলো এখান থেকে, এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে! এখানে অন্য সরুদাসী! এখানে অন্য সরুদাসী!’ ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে যাবার পথে বারবার অনুর মনে হলো, জারজ নিনাদে উন্নীত পাখোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে আসছে তার দিকে।’
অর্থাৎ অনুর জন্য এই মুক্ত স্বাধীন অপার প্রকৃতিনির্ভর পৃথিবী নয়; এই পৃথিবী একমাত্র ফালানি অথবা সরুদাসীদের জন্য নির্ধারিত। থাকতে পারে সেখানে প্রকৃতির অবারিত স্বাধীনতা কিন্তু সে স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে ব্যর্থ; অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দারিদ্র-ক্ষুধা সেখানে সারা জীবনের জন্য স্থায়ী থাকে। অথচ এ অবস্থা থেকে প্রকৃত বাস্তবতায় কীভাবে প্রকৃত মুক্তি সম্ভব? আমরা কোন দিকে হাঁটবো? অনু কোন দিকে যাবে? অনু কি শেষ পর্যন্ত প্রকৃত মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে? এই অনিবার্য প্রশ্নগুলো সামনে রেখেই আমাদের উপন্যাসপাঠ শেষ করতে হয়।
0 মন্তব্যসমূহ