bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

কালো বরফ : এক অনিঃশেষ রক্তক্ষরণের আখ্যান

নূর সালমা খাতুন ||

বাংলাদেশের ষাটের দশকের শক্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮) । তাঁর গল্প ও উপন্যাসের আয়তন বৃহৎ নয়, কিন্তু মননে দাগ কাটতে ভীষণ পারঙ্গম । ছুঁয়ে যায় অন্তরের অন্তস্তল এবং সেখানে তৈরি হয় এক হিরণ্ময় জগৎ । তাঁর শিল্পীসত্তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর কালো বরফ (রচনাকাল : ১৯৭৭) ।  '৪৭ এর দেশভাগের বেদনাময় আলেখ্যের শৈল্পিক উপস্থাপনা এই উপন্যাসটি ।

কালো বরফ-এর পোকা ওরফে আবদুল খালেক দেশভাগের সময় ওপার বাংলা থেকে এদেশে চলে আসে । তার ফেলে আসা শৈশব আর সংক্ষুব্ধ বর্তমানকে ঘিরে আখ্যান নির্মাণ । উত্তম পুরুষে বর্ণিত এই আখ্যানের নির্মাণশৈলী বিশেষত্বে ভরা । বেজোড় অধ্যায়গুলো পোকার কথা মানে অতীতস্মৃতি আর জোড় অধ্যায়গুলো বর্তমান সময়ের মানে আবদুল খালেকের কথা । শেষ অর্থাৎ নবম অধ্যাইটি আলো ছায়ায় যুগলবন্দি শিরোনামে অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধন । এখানে আবদুল খালেক তার দাম্পত্যসংকট থেকে উত্তরণের জন্য অতীতকে ভুলতে চেষ্টা করলেও শেষে অতীতেই নিমজ্জিত হয় । স্ত্রী রেখাকে নিয়ে মরণ ঢালির নৌকায় করে নৌভ্রমণে বের হয় । সংসারের ‘সব ব্যাপারটাই হচ্ছে গরমিলের’ এমন একটা ধারণা আবদুল খালেক লালন করে । আসলে দাম্পত্যকলহের অবসানকল্পে তারা নিজেদের অতীতের ঝাঁপি খুলে বসে । লেখক অনেকটা সন্তর্পণে আবদুল খালেকের মনের অন্দরমহলে উঁকি মারেন । নৌভ্রমণে এসে লৌহজং, ভাগ্যকুল, তারপাশা নামগুলো তাকে নিয়ে যায় রক্তাক্ত অতীতে।

‘এইভাবে সবকিছু  একদিন গল্প হয়ে যায় ।  জীবনে সেই প্রথম, এক গভীর রাতে, তার কানে বেজে উঠেছিল- লৌহজং, লৌহজং । পাশে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান, মনি ভাইজানের জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দুঃখ, যে দুঃখে অনেক ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় অনেক ছেলেবেলা…’

পোকা মানে আবদুল খালেকের ছেলেবেলায় ‘সবকিছু ছিল থিতানো । কোথাও কোন কোলাহল নেই, উপদ্রব নেই,’  কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রচণ্ড কোলাহলে সবকিছু তছনছ হয়ে যায় ।
‘…হুট করে একদিন পাকিস্তান হয়ে গেল । কি হলো না হলো অতো বুঝতাম না, কেবল মনে আছে আমাদের বাড়িতে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো সেদিন ।…দু'একদিনের মধ্যেই বুঝলাম এমন একটা কিছু ঘটে গেছে, যাতে আমরা কেউই ভালো নেই, আমাদের আর ভালো থাকা সম্ভব নয়, আমাদের পরিবারের সুখ-শান্তি চুরি হয়ে গেছে,…’

রাজনীতির পাশাখেলায় অভ্যস্তরা কখনও কি সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কথা ভেবেছে ? আজন্মকালের সম্পর্ক ছেড়ে চলে আসাটা যে মৃত্যুর অধিক বেদনাদায়ক তা আবদুল খালেকের ভাঙাচোরা জীবনের দিকে তাকালেই বুঝা যায় । দেশ ছেড়ে আসার প্রসঙ্গে বলে, ‘সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না । আর কখনো জোড়া লাগবে না ।’ জীবনের এই ছন্দপতন কখনও ঠিক হয় নি । বারবার ফিরে গেছে সে তার হারানো শৈশবে । যেখানে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে পরিবার, আত্মীয়-অনাত্মীয়রা, খেলার সাথী পাঁচু, ঝুমি, পুঁটি, ডালপুরিবুড়ো, পানু, রানিবুবু, গিরিবালা, ছবিদি, মাধুরীদের সাথে ঠ্যাং ভাঙা শালিক, বিড়াল কুন্তি এবং টোটা । লেখক বলছেন, ‘ক্যাঁ ক্যাঁ করে শালিকটা ডাকার পর পুঁটি বললে,'…পাকিস্তান চাই বলে হিন্দু পাখিরা নাকি ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে,…।’ এভাবে একটি শালিকও পোকার শৈশবে দেশবিভাগের চক্রান্তে নিজের অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যায় । অসাধারণ প্রতীকী উপস্থাপনা । ওদিকে পোকার মনি ভাইজান ভালবাসার মানুষ ছবিকে কথা দিয়েও ফিরে যেতে পারে নি আর প্রিয়জন ও প্রিয় স্বদেশের বিচ্ছেদ তাকে শেষপর্যন্ত পরাস্ত করে । মায়ের সামান্য কথায় ঘুমকে আপন করে নেয় । ঠিক যেভাবে আবদুল খালেক জীবিত থেকেও জীবনকে আপন করে নিতে পারে নি ।

লেখক কালো বরফ-এর শরীর জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের আখ্যান বুনে চলেন । পোকার বাবা সকলের অমতে এদেশে চলে আসে মাথা উঁচু করে চলতে পারবে বলে । কিন্তু মা আসতে চায় নি ।  আমরা ব্যক্তি মাহমুদুল হকের জীবনের গল্পটাও জানি । প্রায় একইরকম । হয়তো এজন্যই দক্ষ ডুবুরির মতো সত্তার গভীরে ঢুকে তুলে আনতে পেরেছেন মাহমুদুল হক সেই মর্মস্পর্শী অনুভব যেখানে গল্পের এক পোকার শৈশবের সঙ্গে পাঠকের মনে দেশবিভাগে বিচ্ছিন্ন হাজারো পোকার শৈশব উঁকি দেয় । একটি কণ্ঠ বহু কণ্ঠ হয়ে যায় । একজনের ছেলেবেলা সকলের ছেলেবেলা হয়ে যায় । তাঁর কলম সেসব না বলা কথার মালা গাঁথে যা হৃদয়ের গহিনে ভীষণভাবে নাড়া দেয় ।

আবদুল খালেকের বন্ধু নরহরি ডাক্তার । সে দেশ ছাড়ে নি কিন্তু দেশ কি তাকে ধরে রেখেছে ? মাঝেমধ্যেই তাকে শুনতে হয়, ‘যাও না শালা পড়ে আছো কেন, তোমার বাপের দেশে যাও । তবু মাটি কামড়ে পড়ে আছি। …বেঁচে থাকতে হলে কিছুটা কম্প্রোমাইজ তো করতেই হয়-।’ লেখক শুধু দেশবিভাগের যন্ত্রণার মর্মস্পর্শী ছবি আঁকেন নি সমকালকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেছেন এই উপন্যাসে । সামাজিক অসন্তোষ, অর্থনৈতিক সংকট, সাম্প্রদায়িকতার ঘুণপোকা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে সমাজ ও ব্যক্তিমানুষকে যেন । কলেজশিক্ষক আবদুল খালেক সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কিছুই করতে পারে না । তার সহকর্মীদের মনে হয় ‘স্থূল, পরশ্রীকাতর, লোভী, অসৎ ।’ আর ছাত্ররা ‘কেটে সিগ্রেটের প্যাকেট ঠেলে বেরুনো একরাশ ভ্যাদামার্কা ছেলে ।’ এমন বিষাদে ভরা চারপাশ থেকে মুক্তি পেতে মরণ ঢালির নৌকায় স্বামী-স্ত্রী ভ্রমণে বের হয় । দাম্পত্যপ্রণয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন লেখক । দুজন দুজনার অতীত উজাড় করে দিয়ে বর্তমানকে সুন্দর করে গোছাতে চায় । প্রকৃতি তার অকৃত্রিম উদারতা দিয়ে দুটো মানুষকে আবারও এক গ্রন্থিতে বাঁধার চেষ্টা করে । কিন্তু সব আয়োজনই প্রায় ব্যর্থ হয়ে যায় । উপন্যাসের শেষে তন্দ্রাচ্ছন্ন আবদুল খালেকের কাছে স্ত্রী রেখা হয়ে যায় শৈশবের মাধুরী । বলে, ‘আমাকে কোলে নাও মাধুরী- ।’ এভাবে উপন্যাস জুড়ে শৈশব তার মায়াময় আবেগে জড়িয়ে রাখে পোকা ওরফে আবদুল খালেককে । সমালোচক সনৎকুমার সাহা বলেন,
‘কালো বরফে এই স্মৃতিকাতর মানুষের আরোগ্যাতীত দুঃখবেদনার সান্ত্বনাহীন ছবি তিনি (মাহমুদুল হক) হৃদয়ের গভীরতম তল থেকে তুলে এনে কথামালায় জীবন্ত করে তোলেন। পড়তে পড়তে মনে হয়, কোন ভান নেই এতে । অনুভবের সততাই খাদ নেই এতটুকু । জমাটবাঁধা স্মৃতি হিমঘরের বরফের মতো । তাতে আলো পড়েনি কতদিন । পরতে পরতে অন্ধকার মেখে মেখে তা কালো ।’


কালো বরফ-এ ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক বাস্তবতার ভেতরে আরও এক বাস্তবতার সন্ধানে ব্যাপৃত । যেটাকে অন্তর্বাস্তবতাও বলা যায় । চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের কথাসাহিত্যে কাহিনির যে বর্ণনাধর্মিতা কিংবা সামাজিক বিভিন্ন সংকটের সাদামাটা রূপায়ণ পরিলক্ষিত হয় সেখানে এক নতুনত্বের স্বাদ আনেন শিল্পী মাহমুদুল হক । নিছক কাহিনির তরল উপস্থাপনা নয় কিংবা চরিত্র নির্মাণেও বাইরের ঘটনার প্রাধান্য নয়, তিনি দেখান কাহিনির ভেতরকার কাহিনি । দেখান একটি ঘটনা কী করে মানুষকে প্রভাবিত করে বাইরে ও ভেতরে । বর্তমানের সংকট  থেকে বাঁচতে মাহমুদুল হকের চরিত্ররা বাস্তব থেকে পালিয়ে যায় না তবে বাস্তবকে উপেক্ষা করার জন্য বারবার ডুব দেয় শৈশবে । কমবেশি সবাই নিঃসঙ্গ, স্মৃতিকাতর, নস্টালজিক অনুভবে আচ্ছন্ন বিষণ্ণ মানুষ । নিজেকে সবসময় ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত সচেতন কথাকার মাহমুদুল হকের প্রিয় লেখা 'কালো বরফ' । তিনি এক সাক্ষাৎকারে এই বাহুল্যহীন, মেদহীন, ঝরঝরে উপন্যাসটি লিখে তৃপ্তি পাওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন । এবং পাঠকেরও তৃপ্ত হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে এই আখ্যান পাঠে । কেননা '৪৭ এর দেশবিভাগের জটিল সমীকরণের চুলচেরা বিশ্লেষণে লেখকের আগ্রহ নেই, নেই রাজনীতির চক্রব্যুহের ভেতরে ঢুকার আগ্রহ । বরং রাজনীতি জীবনের যে ছন্দপতন ঘটিয়েছে তাকে আঁকার চেষ্টা করেছেন । কাঁটাতারের বেড়া আসলে দুটো দেশকে ভাগ করে নি, দ্বিখণ্ডিত করেছে ব্যক্তিমানুষের হৃদয়কে । আর লেখক সেই দ্বিখণ্ডিত, রক্তাক্ত হৃদয়ের মর্মন্তুদ বেদনার চিত্রায়ন করেন 'কালো বরফ'এর ক্ষীণকায় অবয়ব জুড়ে । অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' বা 'মানুষের ঘরবাড়ি' উপন্যাসে বৃহৎ কলেবরে যে জীবনের বয়ান করেছেন মাহমুদুল হকও এখানে একই অনুভবে জারিত হয়ে জীবনের কথা বলেছেন । 'কালো বরফ' এর শরীর ছোট হলে কি হবে- অবগাহনের জন্য প্রশস্ত নয় প্রয়োজন গভীর জলাধার । আর 'কালো বরফ' এ পাঠকের নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট গভীরতা রয়েছে । আসলে মাহমুদুল হকের গল্প বলায় আছে অনন্যতা । বড় ক্যানভাসে বিশাল অবয়বে রংতুলি টানতে তাঁর আগ্রহ কম । তিনি বেছে নেন ঘটনা নয়, ঘটনার প্রতিক্রিয়া, প্রতিধ্বনি, প্রতিবিম্ব আর এসবের প্রতীকী উপস্থাপনা । তাই মাহমুদুল হকের শিল্পের রূপময় জগতে প্রবেশ করতে গেলে পাঠককে শতভাগ মনোযোগ নিয়ে যেতে হবে । মাহমুদুল হক কী বলছেন এবং কীভাবে বলছেন দুটো বিষয়েই সমান গুরুত্ব না দিলে রসভঙ্গ হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে । আসলে তিনি মানবমনের অবচেতন স্তরে উঁকি দিয়ে বাস্তবতার অন্তরালের বাস্তবতা (ইনার রিয়ালিটি) কে নির্মোহভঙ্গিতে শানিত গদ্যে তুলে ধরেন । যেখানে তাঁর জাদুকরি ভাষার মোহনীয়তায় আটকে যায় পাঠক । আখ্যানের সাথে তৈরি হয়ে যায় অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক । আর এখানেই মাহমুদুল হকের অনন্যতা ।

শেষকথায় বলতে চাই, কালো বরফ রাজনীতির জটিল সমীকরণের নির্মম প্রকাশ কাঁটাতারের আঘাতে সৃষ্ট ব্যক্তির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ- যা কখনই শুকোবে না তারই ইতিবৃত্ত । মাহমুদুল হকের তীক্ষ্ণ, নিপুন, গভীরতলসঞ্চারী প্রকাশক্ষম ভাষায় লেখাটি হয়ে উঠেছে দেশবিভাগের শিকার মানুষদের শেকড় হারানোর যন্ত্রণার গল্পগাথা । উন্মূল ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের অনিঃশেষ ক্ষরণের রক্তাক্ত কথামালা কালো বরফ । শেষ করবো মাহমুদুল হকের গদ্যের হিরণ্ময় জগতের মধ্যে দিয়ে :
‘যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে ; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শোনে, শুনতে পায় । পোকা পোকা হয়ে যায় ।’


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ