bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মাহমুদুল হকের গল্প : অস্তিত্ববাদীচেতনা


শফিক আশরাফ ||

মাহমুদুল হকের (১৯৪১-২০০৮) গল্পগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র একটিই বলা চলে। ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ফেব্রæয়ারি-১৯৯৪। এই একটি গল্পগ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি বাংলা ছোটগল্পের মূল স্রোতে অবস্থান করে নিয়েছেন। আলবেয়ার ক্যমুর ‘আউট সাইডার’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’, জেমস জয়েসর ‘ইউলিসিস’ প্রমুখ লেখকদের উল্লেখ্য একটি গ্রন্থই তাঁদের বিশ্বখ্যাতির মূলে ছিল। মাহমুদুল হকের প্রথম গ্রন্থ উপন্যাসের, যেখানে খঞ্জনা পাখী [১৯৭৩], মূলত এটি অনুর পাঠশালা উপন্যাসেরই প্রকাশক কর্তৃক দেয়া নাম। তাঁর অনুর পাঠশালা (রচনাকাল ১৯৬৭), নিরাপদ তন্দ্রা (১৯৬৮), জীবন আমার বোন (১৯৭২), কালো বরফ (১৯৭৭), মাটির জাহাজ (১৯৭৭) প্রভৃতি উপন্যাস আমাদের সাহিত্য ভাÐারকে ঋদ্ধ করেছে। তবে গল্পের ক্ষেত্রে তাকে অসাধারণ বলার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যায়:

ক. মানব অস্তিত্বের বহুমুখিতাকে প্রকাশ
খ. সাধারণ জীবনের ভেতর অসাধারণত্ব তুলে ধরা।
খ. ছিন্নমূল ও বিচ্ছিন্ন জীবনকে গল্পের বিষয় করা।
গ. চলমান জীবনের গতিশীলতাকে ধারণ।
ঘ. উপস্থাপনায় নিজস্ব ঢং।
ঙ. নিরাসক্ততা ও নিরাবেগ শৈলী ইত্যাদি।
একজন গল্পকারের গল্পের ভেতর এতগুলো বৈশিষ্ট্য একত্রে ধারণ করলে অসাধারণ না বলে উপায় থাকে না।

আমাদের প্রতিপাশের প্রবাহিত সময় ও জীবনকে ধারণের কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন। এই কঠিন কাজটা যখন অবলীলায় করা হয় তখন তাঁকে দক্ষ শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মাহমুদুল হক তেমনই একজন দক্ষ শিল্পী। এই শিল্পদক্ষতা নিয়ে অতিসহজে তিনি অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের একেবারে ভেতরে ঢোকেন, তাদের অবস্থান তুলে ধরার জটিল কাজটি করেন সহজে। যেমন ‘হৈরব ও ভৈরব’ গল্পের পেশাদার ঢাকী হৈরবের জীবনের সুখ-দুঃখভরা প্রতিদিনের বঞ্চনাকে জীবনের সাধারণ ঘটনার মধ্য দিয়ে তার উপলব্ধিকে লেখক গভীরতর দার্শনিক বোধে পৌঁছে দিয়েছেন :

যহন মনিষ্যি আছিল না, তহন বাজনা আছিল; পর্বত বাইজা উঠছে, জল বাইজা উঠছে, মাটি বাইজা উঠছে, ধরিত্রী বাইজা উঠছে, বাইজা উঠছে আকাশ। তারপর য্যান বাইজা উঠলো মনুষ্যজন্ম, বাইজা উঠলো মনুষ্যধর্ম...। [হৈরব ও ভৈরব]

একজন গ্রামীণ ঢাকীর লোকজ দর্শন যখন সার্বজনীনতাকে স্পর্শ করে তখন উপলব্ধির এই গভীরতা আমাদের সামনে আলাদা একটা মাত্রা নিয়ে হাজির হয়। অসাধারণ কাব্যময় ভাষায় উপস্থাপিত ঢাকী পেশার বিলুপ্তি কিংবা হৈরবের অভাব অনটন অথবা তার বোন দয়ার প্রতি গণি মিয়ার দুর্বলতা এর কোনোটাকেই লেখক প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অস্তিত্বময় মনুষ্যজীবন। আর এটা জা পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শনের চেয়ে আলাদাÑ দেশ, কাল ও অবস্থানের কারণেই। যেমন হৈরবের সন্তান ভৈরব গনি মিয়ার মনোরঞ্জনের জন্যে প্রথমে ঢাক হাতে তুলে নিলেও একসময় নিজের অস্তিত্ব মিশে যায় ঢাকের সাথে :

দশখুশি, বাবু দশখুশি! ঢাকে কেমনে কথা কইতাছে হুইনা দ্যাহেন। দশখুশি, চৌদ্দমাত্রা, মানবজীবন কথা কইতাছে বাবু! দশখুশি বাবু, চৌদ্দমাত্রা, মনুষ্যধর্ম বোল তুলতাছে, আখিজলে আখিজলে, টলমল টলমল, ধরাতল ধরাতল রসাতল, হা-’ ধুপধাপ করে নেচে ওঠে ভৈরব। পায়ের চাপে চাপরা চাপরা মাটি বসে যায়। ঢাকের গরগরে শব্দে চির খাওয়া জ্যোৎস্না জোনাকির মতো মাঠময় ঝুরঝুর ঝরে পড়ে। একটু একটু করে ঘোমটামোড়া লোকালয় পিছু হটে, দূরে সরে যায়; সমগ্র বিশ্ব চরাচর এখন উপুড় হয়ে পেতে দিয়েছে তার পিঠ, ভৈবের পায়ের তলায়, সমগ্র শোভা দিয়েছে তার তলপেটে, ভৈরবের পায়ের তলায়; বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে, পেশি ফুলিয়ে, দুরমুশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সে সেইসব কাদাছানা করে রুদ্ধশ্বাসে। [হৈরব ও ভৈরব]

এই জীবনের সামনে দাঁড়ানোর সাহস গণি মিয়াদের নেই, ফলে তারা ছুটে পালিয়ে যায়। মাহমুদুল হক অত্যন্ত নির্মোহভাবে জীবনের এই রূপের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন। আর ভৈরবদের ঢাকের শব্দ তখন পাঠকের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তোলে।
জীবনের একই সুর ‘জোনাকি’ গল্পের আবুল হোসেনের। শুধু স্থান এবং অবস্থান ভেদে মানুষের অস্তিত্বসংকটকে ভিন্ন সুরে উপস্থাপিত হতে দেখা যায় এই গল্পে। আবুল হোসেনের সাথে স্ত্রীর ঝগড়া কিংবা   সন্তানের হাতে তার শারীরিক লাঞ্ছনা, মেয়ের বখে যাওয়া এসব গল্পের গৌণ বিষয়। এখানে মূখ্য হয়ে উঠে নিজের শৈশব কৈশোরের গ্রামীণ পরিবেশে ফিরে গিয়ে মূর্তিমান অস্তিত্বকে নতুন করে উপলব্ধি করা। শৈশব কৈশোরের তিক্ত ঘটনাও এখানে মধুময় রূপে ধরা দেয়। স্বরূপ অস্তিত্বের এই ভিন্নতায় বিচলিত হয় আবুল হোসেন। আসলে ভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের উপলব্ধির পরিবর্তিত রূপকে তুলে ধরার সফল প্রয়াস শিল্পীর দক্ষতারই প্রকাশ।

বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে গেলে প্রতিটি মানবসত্তা অসম্পূর্ণ, অপূর্ণাঙ্গ এবং আলাদা। এই অসম্পূর্ণ জীবনগুলোকে একত্রিত করলে একটা অখÐ ছোঁয়া পাওয়া যায়। মাহমুদুল হক বিচ্ছিন্ন মানবসত্তার খÐ খÐ ছবিতে আলোকপাত করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। ফলে অসম্পূর্ণ জীবন এতবেশি প্রকট ও বাস্তবমুখর যে মনে হয় চরিত্রগুলো আমাদের আশপাশের পরিচিত মুখ। গল্পের চরিত্রগুলোর প্রেম, মমতা ও পারিবারিক সর্ম্পকের ভেতর যাপিত জীবনের অস্থিরতা গতিশীলরূপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়। যেটি লেককের শক্তিমত্তার প্রকাশ। জীবনকথক মাহমুদুল হকের দেখার দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর। প্রকৃতি আর মানুষকে তিনি অবলোকন করেন নির্মোহভাবে। যেমন:

সকালের রোদ কি সুন্দর ঝামরে উঠেছে। এখনকার যে শীত, তা’ খুব আরামের। বেশ লাগে। না, রাস্তাঘাট গাছপালা জীবনযাত্রার টুকরো টুকরো দৃশ্য কোনো কিছুই অসহ্য মনে হচ্ছে না; বোগেনভিলিয়া ঠিক আছে, ফ্লক্সহলিহক ঠিক আছে, চড়–ইদের মন ভালো আছে, গোলাজামের ফুল পাউডার পাফের মতো গলে বুলাতে ইচ্ছে করে। জামমেদ নিজের ভেতরের এলোমেলোমির রাশকে নাগালে আনতে চায়। [একজন জামশেদ]

পচনশীল সমাজের শত দ্বা›িদ্বকতার ভেতর আদর সোহাগ দিয়ে শুধু মানুষকে তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। লেখক সমালোচক ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদের মতে- ‘মানুষ চেনার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মাহমুদুল হকের। এই ক্ষমতা না থাকলে গল্প-উপন্যাস লেখা যায় না। এই ক্ষমতা বলেই তাঁর পক্ষে গল্প-উপন্যাসের এত বিচিত্র চরিত্র চিত্রণ সম্ভব হয়েছে। মাহমুদুল হকের লেখায় স্থান পাওয়া বিচিত্র মানুষদের অধিকাংশের একটা জায়গায় মিল আছে। সেটা হচ্ছে তাঁর চরিত্রগুলো প্রায় একই রকম। সবাই যেন উন্মূল। কোথাও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।’ একথার সর্মথন পাওয়া যায় ‘বুলু ও চড়–ই’ গল্পে। এখানেও অস্তিত্বের শতরূপের একটি হলো পরিবার এবং পরিবারের বাইরে আচরণে ভিন্নতা। গল্পের চরিত্র আনুর দস্যিপনার কারণে সংসারে নানান ধরনের অশান্তি তৈরি হয় এবং এতে তাদের পারিবারিক দুর্ভোগ বেড়ে যায়। এর পরও পরিবার তাকে আদর সোহাগে আগলে রাখে। বুলুর মুখে উচ্চারিত হয় : মানুষ বড় ভালো... মানুষ বড় সুন্দর। অথচ এই মানুষই যখন পরিবারের বাইরে থাকে তখন তার আচরণের অপর রূপটি একধরনের বিভ্রম নিয়ে দেখতে হয়। যেমন ‘অচলসিকি’ গল্পে এনামুল জেবুন্নেসা দম্পতি শালবন বিহারে বেড়াতে যেয়ে নিজেদের বলয়ে কলতান মুখর অথচ তারাই বুড়ো দোকানদারের আপ্যায়নে চা-বিস্কুট খেয়ে একটা অচল সিকি চালিয়ে দিয়ে খুশী মনে ফিরে আসে। এই স্বার্থবোধের রূপটি আরো প্রকটভাবে প্রকাশ পায় ‘একজন জামশেদ’গল্পে। নীতি-নৈতিকতা কিংবা মানবিক মূল্যবোধ অবস্থাভেদে পরিবর্তনশীল। মানব অস্তিত্বের এই পরিবর্তিত রূপ এ গল্পেরও উপজীব্য। জামশেদ একজন বোধ সম্পন্ন মানুষ। জামশেদের বড় ভাই বাড়ির গৃহকর্মীর সাথে শারীরিক লালসা নিবৃত্ত করে চল্লিশ টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়। জামশেদ ব্যাপারটা লক্ষ করে। জামশেদ নিজে বেকার। নিজের প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাবে কিন্তু হাত খালি। ফলে সে গৃহকর্মীর টাকায় ভাগ বসায়। জোর করে তার হাত থেকে অর্ধেক টাকা কেড়ে নিয়ে প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্যে রওনা দেয় আর মনে মনে ভাবে- ‘আহা, চুল ধরা উচিত হয়নি ওভাবে, আচ্ছা, পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নিলে হয় না।’ প্রতিনিয়ত মানুষের এই পরস্পরবিরোধী আচরণ, দ্বা›িদ্বকতা, এবং দায়হীনতা দেখার যে সূ²চোখ সেটা মাহমুদুল হকের আছে। যেমন ‘হলধর নিকারীর একদিন’ গল্পে যে হলধর তার প্রেমিকাকে একদিন ডাকতো মেনকা সুন্দরী বলে; সময় গড়িয়ে গেলে ‘এখন ডাকে মেনকা খানকি, বলে। এই যে মানব চরিত্রের আচরণগত পরিবর্তন এটা প্রাকৃতজন থেকে বিশিষ্টজনের মধ্যে প্রবহমান।
মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতার চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায় ‘বুড়ো ওবাদের জমা খরচ’ গল্পে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ অতিবড় নিঃস্বার্থ কাজেও আপন স্বার্থ বিবেচেনা করে। চোর-ডাকাত নিধনের নামে একটা নিদিষ্ট গ্রামের সকল মানুষকে হত্যা করার উৎসব শুরু হয়। বুড়ো ওবাদ তাতে অংশগ্রহণ করে। একপর্যায়ে শত ঝুঁকির মধ্যেও নিঃষ্পাপ তিনটি শিশুর মৃতদেহ নিয়ে রওনা দেয় গোপনে দাফন করার উদ্দেশ্য। এ কাজে শিশুদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ এটি নয়, ভালোবাসা তার নিজের প্রতি। বুড়ো ওবাদের আত্মকথনে বিষয়টা প্রকাশ পায় এভাবে:

সোনারা তোমাগো বাপ মায়েমাটি পায় নাই, তোমরা পাইলা। দুনিয়াতে তোমাগো কুনো গুনা নাই, তোমাগো মনে কোনো দাগ লাগে নাই, আল্লায় তোমাগোর কথা শুনবো, আল্লায় য্যান আমারে বেস্ত দেয়, সোনারা তোমরা কয়ো।

তবে এসবের ভেতর মাহমুদুল হকের তীক্ষè রসবোধ পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না, আর এই রসের ভেতর খোঁচা পরিলক্ষিত হয়। যেমন ‘বুলু ও চড়–ই’ গল্পে ছেলে তার পিতাকে বলছে:

এ আপনার কি ধরনের বদহ্যাবিট ভকিল সাহেব, একজন শিকখিৎ লোক হয়ে আপনি নিচ্চয়কে নিশ্চয় বলেন।


মাহমুদুল হকের গল্পের বিশেষত্ব কিংবা বৈশিষ্ট্য যাই বলি না কেন সেটা হল তার বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার গভীরতা। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি আসলে কোনো একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করার জন্য গল্প লেখেন না, লেখেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের যাপিতজীবন এবং প্রবহমান সময়ের ক্ষতকে ধারণ করার জন্য। এক্ষেত্রে অর্পূব এক প্রচেষ্টা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট নিয়ে হাজির হয় তাঁর গল্প। এ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সময়ের চরিত্র হিসেবে কথা বলে। সমালোচকের মতে: ‘প্রবলভাবে জীবনবাদী মানুষটির আগ্রহ ও উৎসাহের ক্ষেত্র ছিল বিচিত্র, জীবনাভিজ্ঞতাও বিপুল, তাঁর পঠন-পাঠনের অবলম্বনও ছিল নানান বিষয়। ভ্রমণকথা যেমন ছিল তাঁর প্রিয়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মিল ছিল অনেক, চাঁদের পাহাড় ছিল তাঁর আরেক প্রিয় বই, তাঁর ঘরে থরে থরে সাজানো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একই আগ্রহের পরিচয় বহন করে। সেই সাথে তিনি ছিলেন বø্যাক ম্যাজিকে আগ্রহী, যে আগ্রহ ক্রমে অতীন্দ্রিয়বাদে সর্মথনের দিকে তাঁকে ঠেলে নিয়ে যায় এবং তিনি, এমন কি, জন্মান্তরবাদেও আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। ফেমি ফ্যাটালে নারীদের রূপ বর্ণনা করতেন যখন তিনি শ্রোতার জন্য সে-ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। মাহমুদুল হক পোকা-মাকড় কীট-পতঙ্গের জীবন বিষয়েও ছিলেন সমভাবে আগ্রহী, পিপীলিকার জীবনযাপন বিষয়ে বই আমি তাঁর কাছেই প্রথম দেখি, মৌমাছিদের সমাজিক জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা তাঁর ছিল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মানব ও জীবন সম্পর্কে তাঁর অপার আগ্রহ ও নিরন্তর অনুসন্ধিৎসা।’ (মফিদুল হক, ব্যক্ত ও অব্যক্ত মাহমুদুল হক)

নিটসে, সার্ত্র, হাইডেগার প্রমূখ দার্শনিকগণ ব্যাক্তিসত্তার পূর্বে সাধারণ সত্তাকে স্বীকার করার বিরোধী এবং ব্যক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার পূর্বগামী বলে মত প্রকাশ করেন। দ্বিতীয়ত তারা বলেন, নৈতিকতা বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদীরা অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক। মাহমুদুল হকের গল্পগ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন চরিত্র আপাতদৃষ্টিতে আত্মকেন্দ্রিক মনে হলেও একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে সেখান ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন অবস্থাকে ধারণ করে আছে। ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ গল্পটির দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টা কিছুটা পরিস্কার হয়। গল্পের আলতাফ ব্যাক্তিকেন্দ্রিক মানুষের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। সে যতক্ষণ বেঁচে আছে ‘আমি’কে প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করে। প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ে বেঁেচ থাকে। আলতাফ এবং সবুজ দুই বন্ধু। সবুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা, তুখোড় তার্কিক, কবি, ক্রিকেটার। সে বিয়ের পর তার স্ত্রী রেখাকে নিয়ে নিজের ভুবন তৈরি করে এবং সেটা নিয়েই বসবাস করতে থাকে। অর্থাৎ সে পরিবর্তিত অস্তিত্বকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে বন্ধু আলতাফ উদ্দাম, উচ্ছ¡ল, বেহিসাবি জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। সে প্রতিনিয়ত জীবনকে উপভোগ করতে চায়, নিজের আমিত্বকে সবসময় সে স্মরণ করে। এই আপাতবিরোধী অবস্থান দুই বন্ধুর। একদিন সবুজ কিছুটা জোর করে ধরে আলতাফ তার গাড়িতে করে বেড়াতে বেরোয়। রাস্তায় একটি অজ্ঞাত পরিচয় মেয়ের দিকে চোখ পড়ে আলতাফের। সবুজের বাধা উপেক্ষা করে আলতাফ মেয়েটির পেছনে ধাওয়া করে। শেষ পর্যন্ত সে হেরে যায়। এবং এই আয়ত্ব করতে না পারার পরাজয় মানতে না পেরে গাড়ি দিয়ে মেয়েটার রিক্সার পেছনে ধাক্কা মারে। গাড়ি থেকে নেমে সবুজ লক্ষ করে নদীর ধারে বাঁশঝাড়ের যেখানে তারা বসেছিল সেখানে তার রুমালটি রেখে এসেছে এবং মাঝে মাঝে সে একাজটি করে। এখানে ইঙ্গিতটা এরকম পরিবর্তনশীল ব্যক্তিসত্তা প্রতিনিয়ত পেছনে ফেলে নতুন সত্তার জন্মসন্ধানে ছুটতে থাকে। রুমাল এখানে শুধু রূপকমাত্র। তাঁর মৃত্যুর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে গল্পকার কাজল শাহনেওয়াজ আমাদের মন্তব্যের সর্মথনে বলেন, ‘দুএকটা ব্যতিক্রম বাদে মাটির জাহাজের চারদিকে আমরা সবাই রুমাল ব্যবহারকারীরা ভিড় করে থাকি। জীবিত মাহমুদুল হক আমাদের দরকার নেই, আমাদের দরকার মরহুম মাহমুদুল হককে। একটা মৃত রুমাল, কবরে ছুঁড়ে ফেলার জন্য।’

বাংলাদেশের ছোটগল্পে অস্তিত্ববাদীচেতনার একজন যথার্থ ও যোগ্য রূপকার মাহমুদুল হক। তিনি বাঙালি সমাজ-মানুষের ব্যক্তিসত্তা রূপায়ণে যেমন নতুনমাত্রা যোগ করেছেন। এভাবেই তিনি বাংলাদেশের গল্পে নিজের শিল্পীসত্তাকে করেছেন কালোত্তীর্ণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ