bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মাহমুদুল হকের অবিনাশী বর্ণমালা


আবু হেনা মোস্তফা এনাম||

সময়ের ক্রমআবর্তনে স্থির কৃতি ও কৃত্য কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও খণ্ডিত অভিজ্ঞতাজাত নয়। ওই কৃত্য ও কৃতির অনুশাসন সমাজ-রাষ্ট্র ও জীবনের অনুবর্তী হয়ে অনুগমন করে অবিনাশী আয়োজনের দিগন্তের দিকে। মাহমুদুল হক ওই কৃত্য ও কৃতির সহচর। তিনি শিল্পের সত্যে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রসংঘের জটিল মেরুকরণের মধ্য দিয়ে জাগ্রত করেন নতুন মানবিক সম্পর্কের কোমল প্রদেশ। তাঁর কথাসাহিত্য, অনির্দেশ্য এবং প্রতীকী ব্যঞ্জনায়, ব্যক্তিমানুষের দাঁড়াবার ওই মানবিক মাটির অনুসন্ধান।
‘সৈনিক’; ‘শাহীন’; ‘সেতারা’ পত্রিকায় কৈশোরে ওই কৃত্যের সূচনা তাঁর। কিন্তু চৈতন্যের অন্ধকার দূর হতে শুরু করেছিল স্কুল পালিয়ে কলোনির ফাঁকা ছাদে বসে দেব সাহিত্য কুটিরের বই, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, প্রহেলিকা সিরিজ, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ, শশধর দত্তের মোহন সিরিজ--এসব ডিটেকটিভ বই পড়ে। আট বছর বয়সে বড়ো ভাইয়ের সেলফ থেকে একটি বই টেনে পড়েন ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, তখন রোমাঞ্চে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। অষ্টম শ্রেণীতে পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ পড়বার পর তাঁর কাছে ডিটেকটিভ বই পানশে মনে হয়েছিল। বাবার সংগ্রহ থেকে শেক্সপিয়ার রচনাবলি এবং বাড়িতে নিয়মিত রাখা ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সাহেব বিবি গোলাম এবং অন্যান্য সাহিত্য তাঁর নিত্যদিনের পাঠের বিষয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন ‘ইত্তেহাদে’র বিশেষ সংখ্যায় ‘উঁচুতলার সিঁড়ি’ গল্প লিখে সঞ্চয় করেন আহসান হাবীবের স্নেহ ও প্রীতির আনুকূল্য।
স্কুলে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন প্রগতিশীল শহীদ সাবেরকে, তাঁর অনুপ্রেরণায় প্রকাশ করতেন ‘অগ্রগামী’ নামে দেয়াল পত্রিকা। প্রতিবেশী ছিলেন অগ্রজ মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। শিক্ষক মোহাম্মদ সুলতান, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রকাশক, তাঁর আগ্রহ ও অনুপ্রেরণায় ছাত্র ইউনিয়নের স্কুল শাখা গঠনের মাধ্যমে রাজনীতিতে তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সরকারি চাকুরে বাবার দৃষ্টি এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে মোম জ্বেলে লিখতেন রাজনৈতিক পোস্টার। ১৯৫৪ সালে ভুখা মিছিলে গিয়ে পুলিশে আটক হন, বাবাকে বন্ড দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছিল, এ মামলাও চলেছিল বেশ কিছুদিন। বেড়ে ওঠার এই পরিপ্রেক্ষিতসমূহ কৈশোরকালে মাহমুদুল হকের প্রগতিশীল, বৈজ্ঞানিক, যুক্তিনিষ্ঠ, জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে হয়েছিল সহায়ক। এই পরিপ্রেক্ষিতের আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত উপস্থাপন আমাদের প্রধান অন্বিষ্ট নয়। কেননা কৈশোর এবং পরবর্তীকালে মাহমুদুল হকের আড্ডার পরিমণ্ডল, পঠনের ইতিবৃত্ত, বন্ধুবর্গের সপ্রাণ উপস্থিতি সম্পর্কে আজ আর তরুণদেরও অজ্ঞাত নয়, বরং তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সূচিত করে এক ঈর্ষণীয় অহংকার। তবু কিঞ্চিৎ উল্লেখের কারণ, তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি থেকে বিরত হবার [নিয়মিত শেষ রচনা পাতালপুরী, ১৯৮১; পরবর্তীকালে একটি গল্প ও দু-একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন নিতান্তই দায়বোধে অনেকটা বাধ্য হয়েই, কিন্তু তাঁর লেখার খাতায় কিছু অনিয়মিত সাল-তারিখের উল্লেখ দেখে বিস্ময় ও অসহায়তা সূচিত হয়, নিভৃতে তাঁর লিখবার প্রস্তুতি চলেছিল দীর্ঘদিন। এমনকি মৃত্যুর বছর কয়েক আগে সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশের জন্য প্রস্তুতকৃত অশরীরী উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তিনি ফেলে রেখেছিলেন, শহীদ সাবের প্রসঙ্গটি পুনর্লিখনের জন্য রচনা করেছিলেন খসড়া। কিন্তু পুনরায় স্বভাবগত জাড্য ও মনস্তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের শৈথিল্য তাঁকে নিমজ্জিত করেছিল সীমাহীন নিরাসক্তির অন্ধকারে। ফলে খসড়াটি আর মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে সংযুক্ত করেননি।] তিন বছর পর নরসিংদীর বাউল অথবা সুফি মতাদর্শে বিশ্বাসী শ্যানাল শাহের আখড়ায় গমনাগমন করেন [২৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৪] এবং ক্রমেই নিয়মিত হয়ে ওঠা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত যে বিভ্রান্তি প্রচলিত, তারই একটি ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা মাত্র।
মনে রাখা প্রয়োজন, ইতিপূর্বেই তিনি বাউলদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন হারামণি, ময়মনসিংহ গীতিকা, উত্তরবঙ্গের লোকগীতি, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বাংলার বাউল ও বাউলগান, শশীভূষণ দাশগুপ্তের শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ-দর্শনে ও সাহিত্যে, সুকুমার দত্তের মহাপরিনির্বাণের কথা, আহমদ শরীফের স্বদেশ অন্বেষা, ড. শ্রী মতিলাল দাশ ও শ্রী পীযুষকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত লালন-গীতিকা ইত্যাদি গ্রন্থ। এছাড়া তিনি আগ্রহী ছিলেন বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রহের বিষয়ে। নৃগোষ্ঠি-সমাজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের চিন্তা থেকে তিনি ভ্রমণ করেছেন নৃগোষ্ঠি অধ্যূসিত অঞ্চল, সখ্যতা গড়ে তুলেছেন নৃ-জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। সুতরাং অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক স্বার্থ চরিতার্থের জন্য তিনি নরসিংদী যাননি। ভাববাদ বা ভক্তিবাদ অথবা গুরুবাদের প্রতি তাঁর স্বভাবগত চিত্ত-বৈপরীত্য এবং আমৃত্যু তিনি ছিলেন প্রচলিত ধর্মের আচরিত সংস্কৃতির বিরোধী ও অবিশ্বাসী। বরং অপার কৌতূহল এবং জীবন ও প্রকৃতিজগতের অজ্ঞাত, অব্যাখ্যাত সীমাহীন রহস্য সন্ধানের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা এবং একটি পারিবারিক শান্তি, শৃঙ্খলা ও অনেকাংশে ‘নিয়মরক্ষা’র তাগিদে ওই আত্মনিমজ্জনকে ক্রমেই করে তোলেন নৈমিত্তিক। এমনকি এই আকাক্সক্ষা নিরাকরণের মধ্য দিয়ে তিনি বড়ো কোনো সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন বলে সাহিত্য রচনার জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিজেকে অন্তরিন করে রেখেছিলেনব্যাপারটি আদৌ যে তা নয়, সেটি পরবর্তীকালে তাঁর লেখার অসংখ্য খাতায় [একটি লেখার খাতা ১৯৯৪ থেকে ’৯৯ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত, তাঁর লেখার অন্যান্য খাতা সম্পাদিত হলে, নিভৃতে তাঁর লেখকসত্তার আত্মপরিচর্যার একটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়ত আমাদের অনুধ্যানকে সমৃদ্ধ করবে] বিচিত্র শব্দের সংগ্রন্থনা, বাক্যবিন্যাস, ভাবনার টুকরো টুকরো স্ফুরণ লিপিবদ্ধকরণে স্পষ্ট। অর্থাৎ, লেখার জন্য নিভৃতে তাঁর প্রস্তুতি চলছিল, কিন্তু অন্তর্গত বোধ, যা জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা বলে, তা আর রক্তমাংসের সচল অনুভূতি-ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠেনি। বাউল শ্যানাল শাহ গান রচনা করতেন এবং স্বকণ্ঠে গাইতেন। তিনি সাহিত্য চর্চা থেকে মাহমুদুল হকের নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রভাবক রূপে কোনোই ভূমিকা রাখেননি। বরং তিনি মাহমুদুল হককে প্রায়ই লিখতে বলতেনএ তথ্য মাহমুদুল হক বর্তমান প্রবন্ধকারকে একাধিক একান্ত আড্ডা-সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। যদিও বর্তমান প্রবন্ধটি তাঁর ‘না লেখা’র কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্ত নয়, লেখকচৈতন্যের দর্শন অনুধাবনের জন্য কেবল এ তথ্য উন্মেষিত হল। উপর্যুক্ত বক্তব্য কাউকে হেয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অপমান করার উদ্দেশে নয়; বরং যাঁরা মাহমুদুল হকের ‘না লেখা’র কারণ হিসেবে অধ্যাত্মবাদের প্রভাব বলে মনে করেন, তাঁদের প্রত্যেকের চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাদের এই দ্বিধাহীন উচ্চারণ।
সমাজ ও সময়ের পরিবর্তমান পরিপ্রেক্ষিত, ব্যক্তির অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্যবোধ, মানবিকিকরণ, আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, বিশ্বপরিস্থিতি এবং জাতিগত ঐতিহ্য, ইতিহাসের মৌনবীথি ইত্যদি নানাবিধ ঘটনা ও অনুষঙ্গ ব্যক্তির যাপিত জীবনপ্রণালি ও শিল্পচিন্তাকে প্রভাবিত করে; আলোড়িত করে সংবেদনশীল ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের নির্জ্ঞানস্তর, অনুরণিত হয় শিল্পীর নিমগ্ন হৃদয়লোক; শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টির অনিবার্য বিন্দুসংহত আকাঙ্ক্ষা ও তীক্ষ্ণদৃষ্টির আধুনিক মনস্কতায় শিল্প হয়ে ওঠে সুদূরস্বপ্নচারীমাহমুদুল হক ওই জীবনদৃষ্টি ও শিল্পকৃত্য থেকে বিযুক্ত ছিলেন না। তাঁর গল্প ও উপন্যাস ওই সুদূরস্বপ্নচারিতা ও শিল্পসৌরলোকে যাত্রা। বিষয়-নির্বাচন, কাহিনিসংগ্রন্থনা, ভাষাবিন্যাস-প্রতিটি পর্ব ও পর্বান্তরে সমাজ, পরিপার্শ্ব ও সময়সংলগ্ন হয়েও মাহমুদুল হক কথাসাহিত্যে নির্মাণ করেছেন এসবের অন্তরালে সংগুপ্ত মানবিক নির্বেদ ও জীবনের প্রতি অন্তর্লীন প্রেমানুভব। ব্যক্তিমানুষের প্রতি এই দায়বোধ ও মানবিক আশ্রয় সন্ধানের শিল্পকৃতির জন্যেই তাঁর রচনা আমাদের আহ্বান করে অবিনাশী আয়োজনের দিকে। এই সূত্রে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের মৌলিক ও শাশ্বত ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

দুই
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আড়াই বছর বয়সে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস জেনেছিলেন, মাহমুদুল হকও কি উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর জীবনদৃষ্টির ইতিবৃত্ত, সৃষ্টিশীল চৈতন্য বিকাশের ঊষালগ্নে? তের বছর বয়সে, ‘সৈনিক’ পত্রিকায়, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে ‘কি লিখবে?’ [লেখক নাম মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, পরবর্তীকালে নামের মেদ ঝরিয়ে ফেলেন তিনি] শীর্ষক রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনদৃষ্টির শিল্পসূত্র:
গল্প লেখার জন্য তোমাকে অত ভাবতে হবে কেন? খাতা কলম বন্ধ করে উঠে পড়। রাজপথের ধারে ঘুরে বেড়াও, ঘুরে বেড়াও নোংরা অন্ধকার গলিতে ও বস্তিতে। দুর্গন্ধে তোমার গা ঘিন ঘিন করবে। তবুও তুমি এগিয়ে চল—দেখবে গল্প কবিতার বিষয়বস্তুর ছড়াছড়ি। তুমি চলেছ—একটা রোগা কঙ্কালসার, উলঙ্গ-প্রায় ভিখারি এসে তোমার দিকে একটা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে বললে : সাহেব একটা পয়সা! তুমি একবার খুব ভালো করে চোখ মেলে তাকাও, তার কাছ থেকে জেনে নাও তার জীবন কাহিনি। বুঝবে বিষয়বস্তুর সন্ধান এদের মতোই শত শত অবহেলিতের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
জীবন এবং সমাজ সম্পর্কে এই দ্রষ্টার ইতিবৃত্ত মাহমুদুল হকের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভিপ্রেতকেই স্পষ্ট করে। যদিও উপর্যুক্ত রচনায় কৈশোরক আবেগ এবং চেতনার উত্তুঙ্গ স্ফুরণ লক্ষণীয়, কিন্তু কৈশোরকালের এই আত্মস্বীকারোক্তি এবং পর্ব ও পর্বান্তরে, সমাপ্তি পর্যন্ত, জীবনের ওই অভিজ্ঞতাপুঞ্জে সাহিত্যকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা-ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিকতার এই পারস্পরিক সমীকরণ মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির প্রতি লেখকের আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক অঙ্গীকারের পরিচয়।
যদিও একই সময়খণ্ডে রচিত কোনো কোনো গল্প অপেক্ষাকৃত মাহমুদুল হকের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যচিহ্নিত নয়, তা নিয়ে তাঁর হৃদয়লোকে চলেছিল অদৃশ্য রক্তপাত। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন সৃষ্টিশীলতার যাত্রাপথ বড়োই দুর্গম ও দূরধিগম্য। তাই সৃষ্টিশীল সত্তার উৎসকালের কোনো রচনা, তা যতই অসফল ও কিঞ্চিৎকর হোক না কেন, তার মূল্য কম নয়। কেননা ওই রচনাসমূহের পারম্পর্যই সৃষ্টিশীল সত্তার বিকাশ ও শিখরস্পর্শের সোপান। ওই সোপানশ্রেণিতে ‘পতিত জনের কথা, ভাগ্য-বিড়ম্বিত চির অবহেলিতের কথা’ [কি লিখবে?] লিপিবদ্ধ করেছেন মাহমুদুল হক। ওই কথার সূক্ষ্মতার সঙ্গে জীবনদর্শনের ব্যাপ্তি এবং জীবনের অতলান্তিক অনুভব, ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট ও টানাপড়েনের সঙ্গে অন্ত্যজ মৃত্তিকাসংলগ্ন জীবন এবং সমাজবিলগ্ন, বিচ্ছিন্ন, অবহেলিত, বঞ্চিত জনজীবনের কথকতা, যা তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার উৎসেই চিহ্নায়িত। অবশ্য, স্বভাবতই কিশোর মনের আবেগ-চতুষ্পার্শ্বের যাপিত জীবন, জীবনের যন্ত্রণা, ক্লেদ এবং ওই মলিনতা থেকে উত্তরণের জন্য তীব্র, তীক্ষ্ণ, দুঃখবৈদগ্ধ্যময় দ্রোহচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উৎস-চিহ্নায়িত গল্পসমূহে। আবার কখনো কিশোর জীবনের সারল্যের সৌন্দর্যে মুখর কোনো কোনো গল্প। কিন্তু ‘সৈনিক’; ‘শাহীন’; ‘সেতারা’র কাল পেরিয়ে মাহমুদুল হক ক্রমশ অতিক্রম করেছেন নিজস্ব বৃত্ত, বদলেছেন তাঁর শব্দের সীমানা, চরিত্রপুঞ্জের বিন্যাস; হয়ে উঠেছেন মনোজগতের বিচিত্র আবেগ-অনুভব নির্মাণে আরো সূক্ষ্ম ও স্তরবহুল। একদিকে সমাজের কুটিল-জটিল অন্ধকারময়তা, অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনের যন্ত্রণা-জর্জরিত তরঙ্গাবেগএই দুই প্রান্তকে তিনি তাঁর কথাসাহিত্যে সমীকৃত করেছেন সংহত এক দিগন্তরেখায়। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন জীবনের নানা সঙ্কট, দ্বন্দ্ব, দুঃখ, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার করুণ আর্তির মধ্যে মাহমুদুল হকের কথাসাহিত্যে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে মানবচৈতন্যের অন্তর্লীন মানবিক মুক্তির সুবর্ণ উপাচার।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ময়না দ্বীপে নতুন বসতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে নতুন সম্ভাবনা, ঔপনিবেশবিরোধী বাঙালি জাতিসত্তার নতুন পরিচয় সন্ধান করেছেন, তারই নদীস্রোতে অন্বিত হয় সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোড়াইয়ের স্বপ্নময়তা, তারাশঙ্করের করালীর দ্রোহচেতনা, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড়শ্রীখণ্ডে জেগে ওঠা পদ্মার চর অথবা মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসে আকস্মিক বুনো ষাঁড়-মোষে রূপান্তরকৃত আসফাকের মানবিক মনস্তত্ত্ব। অথবা দেবেশ রায় তিস্তাপারের বৃত্তান্তে মেট্রোপলিটান জাতিরাষ্ট্রের বিপ্রতীপে উপস্থপান করেন বাঘারুকে, এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খোয়াবনামায় তমিজ ও তমিজের বাপের চরিত্রচৈতন্যে যে স্বপ্নদর্শনের বুনন করেন তারই ভিন্নরূপ নির্মিত হয় মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা [রচনাকাল ১৯৬৭], নিরাপদ তন্দ্রা [১৯৬৮], জীবন আমার বোন [১৯৭২], মাটির জাহাজ [১৯৭৭], কালো বরফ [১৯৭৭] অথবা পাতালপুরী [১৯৮১] উপন্যাসে।
কিশোর অনু মধ্যবিত্তের ঠুনকো আভিজাত্যের সংস্কার ছেড়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াতে চেয়েছে মুক্তির উদার দিগন্তে। কিন্তু ‘ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে যাবার পথে বারবার অনুর মনে হলো, জারজ নিনাদে উন্নীত পাখোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে আসছে তার দিকে।’ অনুর এই অনির্দেশ্য গন্তব্য নিরাপদ তন্দ্রায় অনেকাংশে স্পষ্ট। যন্ত্রণাময়, নিষ্পেষিত অগ্নিদগ্ধ পতিতাপল্লীর জীবন থেকে পালিয়ে এসে হিরন আশ্রয় নেয় তার পুরোনো বস্তিজীবনে, যেখানে জীবনের নতুন সম্ভাবনা ও স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষায় এসে উঠেছিল কেরামত আলীর হাত ধরে। অনেক পোড়খাওয়া জীবন অতিক্রমের পর কহিনির শেষ বৃত্তে ছিল কেরামত আলী নয়, গল্পকথক কামরান রসুল, কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন অবিশ্বাস্য স্বপ্নের ঘোরে তার প্রেমিক কেরামত আলীর নিকটেই সংশ্লেষিত ও রূপান্বিত। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত লুণ্ঠন, নিপীড়ন ও অন্ধকার থেকে মানবীয় প্রেমের আলোয় প্রত্যাবর্তনই লেখকের কাছে সত্য। এই শিল্পসত্য রাষ্ট্রীয় সামাজিক পুরুষতান্ত্রিক সামূহিক সভ্যতা ও আধিপত্যবাদী মস্তিষ্কচৈতন্য থেকে মুক্তির দিগন্তে প্রেমের শাশ্বত শক্তিতে উদ্ভাসিত।
মাহমুদুল হকের সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাস জীবন আমার বোন, এছাড়া খেলাঘর [১৯৭৮] উপন্যাসেও, শৈশব আশ্চর্য গোপন দুঃখের মতো অনুকম্পা ও শিহরিত আবেগে অনুরণিত। অঞ্জু ও মঞ্জু, পুকুরের জলে ডুবে  দুই সহোদরার মৃত্যু এবং কৈশোরের আবেগ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে সমগ্র কাহিনির কেন্দ্রীয় আলোবিন্দু হয়ে রয়েছে রঞ্জু। দু-বোনের মৃত্যুস্মৃতি কী পরিপ্রেক্ষিত উন্মোচন করে? উপন্যাসের শেষাংশে প্রাণপ্রিয় রঞ্জুর মৃত্যু, যাকে ঔপন্যাসিক রূপান্বিত করেছেন জীবনের প্রতীকে। তাহলে কী পঞ্চাশের দশকের শেষপ্রান্তে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং ক্রমশ পারিবারিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে উঠলেও ওই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে একটি সন্তর্পণ-সম্পর্ক রক্ষা করা এবং কেবল রাজনীতি সচেতন নন, তীব্রভাবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন মাহমুদুল হক ১৯৭২-এই অনুধাবন করেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পরিণাম? অঞ্জু-মঞ্জু কি অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রতীক? আর ‘নিরঞ্জন রঞ্জু’ শ্যামল বাংলাদেশ? যে শত্রুর পদলাঞ্ছনায় অপমানিত, বিমর্দিত, বিচূর্ণীত, বিধ্বস্ত ও অস্তিত্বহীন। জীবন আমার বোন, উপন্যাসটি সম্পর্কে ‘রোদ্দুরে’ দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাস রচনা করিনি, কোনোদিন ঠাট্টাচ্ছলেও বলিনি এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।’ অর্থাৎ এটি ইতিহাস নয়, এটি তাঁর ওই উপন্যাসের পটভূমি-কাল, জ্ঞাত করেছেন উপন্যাসটি রচনার সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞাপ্রসূত তাঁর নির্দ্বান্দ্বিক অভিজ্ঞান। ফলে আমাদের সবচেয়ে আবেগকাতর, স্পর্শচেতন এবং জাতিসত্তার অতলান্ত নিষ্কোষণ ও রক্তস্বাক্ষর স্বীকৃত গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধএই সময়-পূর্ব কথামালার পরিপ্রেক্ষিত এ উপন্যাসে অনেকাংশে গৃহীত সুস্পষ্ট একটি সীমাপরিচিহ্নে। সুতরাং উপন্যস্ত কাহিনিতে অবলম্বিত হয়েছে  ওই তরঙ্গসঙ্কুল সময়ের অস্থিতিশীল দ্বন্দ্বদোলাচলতা; সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতা; নিঃসঙ্গ, বিক্ষুব্ধ ও আত্মপীড়িত এবং পুঞ্জিভূত যুদ্ধের অগ্নিসংকেতের অনিবার্য অভিঘাতে উৎকেন্দ্রিক ব্যক্তি-মানসের যন্ত্রণা-জটিলতা। ওই জর্জরিত কালের অগ্নি ও অশ্রুবিন্দু, আবেগ ও প্রতিরুদ্ধ সংকল্প মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন উপন্যাসে অম্বিত।
খেলাঘর এবং অশরীরী [১৯৭৯] উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত যুদ্ধাক্রান্ত বাংলাদেশ। মুক্তিসংগ্রামকালীন ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কের টানাপড়েনের সঙ্গে যুদ্ধাক্রান্ত বাংলাদেশ, যুদ্ধদৃশ্যাবলি, যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যক্তিমনস্তত্ত্ব সমান্তরাল স্রোতে প্রবহমান এবং অনেকাংশে তা পরস্পরের প্রতীকার্থেও উপস্থাপিত। অপরদিকে মাটির জাহাজ এবং পাতালপুরী উপন্যাস দুটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ অত্যন্ত ক্ষীণ, পরিবর্তে অনুসৃত স্বাধীনতা-পরবর্তী বিপর্যস্ত বাংলাদেশে লুণ্ঠনপ্রবণতা, ধনবাদের বিকাশ, সামরিক শক্তির উত্থান এবং ওই বিপর্যস্ত ও নবোত্থিত ক্ষমতাকাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় বাস্তবতাস্পর্শী রক্তাক্ত মানবিক বোধ। এই উপন্যাসসমূহের বিষয়বিন্যাসে ও চরিত্রাবলির পরিণাম ভাবনায় প্রথাগত গাণিতিক মীমাংসা নেই, নেই নায়োকোচিত বীরত্ব প্রদর্শিত মুগ্ধতা। ফলে উদ্যোমহীন, তর্কপ্রবণ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক খোকার উদ্দাম তর্কের আশ্রয়ে মাহমুদুল হক এঁকে দিতে পেরেছিলেন তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনের ইতিহাস। ওই ইতিহাস কেবল ’৪৭ থেকে ’৭১ নয়, বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের যাবতীয় ঔপনিবেশিক চিন্তা, শোষণ, নির্যাতন, পুঁজিবাদী আগ্রাসন, সামরিকতন্ত্র ও পেশিশক্তির বিরুদ্ধে তর্জনি উঁচিয়ে ব্যক্তিমানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে যাত্রার ইতিহাস।
কিন্তু কোনো রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ আকস্মিকভাবে যুদ্ধকৌশলের মতো জটিল প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে না। যে জ্ঞানতত্ত্ব, সংগ্রাম-সামর্থ্য, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধাস্ত্র একটি জাতির রাষ্ট্রনৈতিক বিরোধকে দিতে পারে মীমাংসা, সেটি নয়, বরং উচ্ছসিত আবেগ-আকুলতা বাঙালির রক্তকণিকার অনুপ্রেরণা। এ কারণে সামরিক ক্ষমতা-সজ্জিত একটি রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের গোপন দীর্ঘ প্রস্তুতি ও আকস্মিক আক্রমণের ভয়াবহতা সম্পর্কে বাঙালি জাতি প্রকৃতই আত্মরক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণে কোনো বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি, সম্ভবও ছিল না। ফলে জাতিসত্তার অন্তর্চৈতন্যে সংগুপ্ত আবেগ, যে আবেগের মহত্তম কিংবদন্তীএকুশে ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী গণঅভ্যুত্থান, তা দ্বন্দ্ব ও দোলাচলতায়; স্বপ্নময়তা ও স্বপ্নভঙ্গের করুণ কান্নায়; প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির যন্ত্রণায় অবরুদ্ধ। মাহমুদুল হকের উপ্যাসের খোকা, মুরাদ, রঞ্জু, নীলাভাবী, রাজীব ভাই, লুলু চৌধুরী, রেহানা, ইয়াকুব, মুকুল চন্দ্র, আম্বিয়া, মন্টু, বিপুল, আঞ্জুম, তাহেরা, মনোহর, জয়নাল, কুসুম, আলমাছিবিবি, অথবা আমিনুল, জামশেদপ্রতিটি চরিত্রই বাঙালির সেই সঙ্কট ও সম্ভাবনাময় সময়ের প্রতিনিধি।
অপ্রিয় হলেও সত্য, বাঙালির স্বাধীনতাপ্রাপ্তি একটি ম্যাজিকের মতো, দৃষ্টি ধাঁধানো, আকস্মিক এবং অদূরদর্শী। যে-কারণে সেই গৌরবময় অর্জন ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রকোনোটিকেই দান করতে পারেনি সুস্থিতি। তাই যুদ্ধের ক্ষতদগ্ধ, অগ্নিপ্রজ্বলিত জীবন ও সমাজ সুস্থ হয়ে ওঠে না শুভময় কল্যাণকামী চিন্তাস্পর্শে। কল্যাণকর হয়নি এবং ভীতিসংকুল বলেই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মোতড়ার ঘন বনের কোলে পড়ে থাকা যে লাশ মুকুল আর ইয়াকুব দড়ি পেঁচিয়ে ভাসিয়ে দেয় বিলের জলস্রোতে, সেই লাশের উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মাটির জাহাজ উপন্যাসে: ‘গলা ডোবানো হিজলের ডালে আটকে আছে একটা লাশ। ফুলে ঢোল। বুকে কয়েকটা গর্ত, গর্তে চাক বেঁধে আছে বুনোমাছি।’ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ক্ষয়িষ্ণু পলাতক মূল্যবোধের গড্ডালিকায় আকণ্ঠমগ্ন অধিকাংশ মানুষ। কেউ নারী পাচারকারী, কেউ নারী সরবরাহকারী। অর্থের বিনিময়ে জয়নালের মতো নারী ব্যবসায়ীদের কাছে গ্রামের দরিদ্র, অসহায়, সরল ও সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যস্বত্বভোগী মনোহর। কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজবিলগ্ন মানবতাবিরোধী কর্মে লিপ্ত এই চরিত্র-দুটির অস্তিত্বসংকট, টিকে থাকার আতীব্র আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নময়তা মাহমুদুল হক গভীর মমতায় লিপিচিহ্নিত করেছেন। উপন্যাসটির শেষাংশে মনোহর যখন অবরুদ্ধ কান্নার আবেগে ভাঙা স্বরে বলে‘আর একটা কথা, তোমার যদি মায়ের গর্ভে জন্ম হয়ে থাকে, যদি এক বাপের জন্ম হয়, তাহলে একটা কথা তুমি রেখো জয়নাল ভাই, কখনো ভাতের খোঁটা [কুসুমকে] দিতে পারবে না’তখনই পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূল অন্ধকার অতিক্রম করে জ্বলে ওঠে পিতৃত্বের স্নেহমমতাময় চিরন্তন একটি প্রতিচ্ছবি। জ্বলে ওঠে ক্ষুধা-দারিদ্র্যকে আশ্রয় করে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থাপনার বিপরীতে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের মানবিক অশ্রু। আকুল করা বোবাকান্নার অশ্রুপাতে জীবনের পাত্র পূর্ণ হয়ে যায় কানায় কানায়। জীবনের জটিল স্বপ্নের ব্যাকরণে দিশেহারা, পরাজিত, ন্যুব্জ মনোহর তবুও দুঃখের ভেতর থেকে উঠে আসে চৈতন্যের মানবিক দিগন্তে। পাতালপুরী উপন্যাসে পরিগৃহীত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্তহীন, পরিণাম ভাবনাশূন্য, বিভ্রান্ত, স্বার্থান্ধ বাঙালি মধ্যবিত্তের সত্যিকার বিড়ম্বনার চিত্রাবলি। সাংবাদিক আমিনুলের ডায়েরির পাতায় চিহ্নিত সেই নির্মম সত্য, অন্যদিকে কালো বরফ উপন্যাসের শেষাংশে আব্দুল খালেক এবং রেখা নৌযাত্রা করে প্রত্যহিক সমস্ত গ্লানি এবং যাপিত জীবনের যন্ত্রণামুক্তির জন্য। পরস্পরকে কেউ দুঃখ না দেবার অঙ্গীকারে, দৈনন্দিনকে প্রত্যাখ্যান করে ওই নৌযাত্রা তাদের নিয়ে যায় নিসর্গের অন্তর্লীন শুশ্রূষায়। তবু ভেসে ওঠে স্মৃতি স্বপ্নের অনাবিল আবেগ, স্ত্রীর কাছে আবদুল খালেকের আকাঙ্ক্ষা: ‘একটা মেয়ে, তার জীবনের সবকিছু দিয়ে একজনকে ধরে রাখতে চায়, তার সব চিন্তার শেকড় ঐ এক মাটিতে, ঐ এক জায়গায় শক্ত করে বাঁধা,... জীবনভর তাকে চাই, তাকে ছাড়া আমার চলবে না, সবকিছু অন্ধকার, অর্থহীন তাকে ছাড়া’যে মাটির গভীরে ওই শেকড় প্রোথিত তা সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদের যন্ত্রণাহীন, দেশবিভাগের ক্রন্দনশূন্য, নিরন্তর অর্থলোলুপতার লোল জিহ্বা থেকে অনেক সুদূরে এক স্নেহময় প্রেমময় নিসর্গশোভিত নদীমাতৃক বাংলা।
ব্যক্তিমানুষের এই আশ্রয়-সন্ধানের ইতিবৃত্ত মাহমুদুল হকের গল্পসমূহে হয়ে আছে অন্তর্লীন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ, প্রতিদিন একটি রুমাল [১৯৯৪], এগারটি গল্পের সংকলন, প্রতিটি গল্পের আখ্যান, ঘটনাপরম্পরা এবং চরিত্র পরিচিত জীবন ও সময়প্রতিবেশকে করে তুলেছে আলোকিততর। পারিবারিক জীবনের শোক-দুঃখ ও বিবমিষার সঙ্গে গল্পকার সমাজের গভীরতম ক্লেদ, অন্ত্যজ ও মধ্যবিত্তের অস্তিত্বসঙ্কট ও গ্লানি সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন, তুলে এনেছেন একই সঙ্গে জীবনের প্রতি অতলান্তিক মমতা ও মানবিকতার শুভবোধ। ব্যক্তি মানুষের অন্তর্চৈতন্যে সংগুপ্ত এই শুভবোধ, কল্যাণময়তা দুঃখী সর্বংসহা অন্তর্লীন এক স্রোতোস্বিনীর মতো মাহমুদুল হক তাঁর গল্পের শরীরে প্রবাহিত করে দিয়েছেন। জীবনের সকল ক্লান্তি, ক্ষোভ, বিপদ, বিরহ, বিষণ্নতা, নৈরাশ্য, শূন্যতার বিপরীতে মানুষের অপরাজেয় মানবিক চৈতন্যের জাগরণ মাহমুদুল হকের শিল্পভাবনার অন্বিষ্ট, কিন্তু এই জাগরণ বিপ্লবী উচ্চকণ্ঠ-ঘোষণার মন্দ্রিত স্বরগ্রাম নয়; জীবনের মতো করুণ, নিসর্গের সবুজ আলো-অন্ধকারের মতো নিবিড়, স্বাভাবিক ও স্বপ্নসঞ্চারী।
প্রথম গল্প  ‘হৈরব ও ভৈরব’ থেকে শুরু করে প্রতিটি গল্পে দুঃখ ও অশ্রুজলের মধ্যে দিয়ে, বঞ্চনার কঠিন নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে জীবনের অপার সম্ভাবনা সুচিহ্নিত। সাহিত্য চর্চা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার প্রায় পনের বছর পর তিনি লেখেন ‘বনফুল’ গল্পটি। কিন্তু দীর্ঘ বিরতির কোনো প্রভাব, ভাষাগত শৈথিল্য অথবা দৃষ্টিভঙ্গিগত মৌলিক রূপান্তর গল্পটিতে লক্ষণীয় নয়। তুমুল সৃষ্টিমুখর মাহমুদুল হকের তীব্র উপস্থিতি গল্পটির কণায় কণায় বিকীর্ণ করে হীরক-দ্যুতি। সমাজের রক্তচক্ষু, ক্ষুধার্ত সন্তানদের আহাজারি, পথে পথে কুটিল ভয়ের দন্ত বিকশিত অট্টহাসি স্বামী পরিত্যাগী এক নারী জীবনের সীমাহীন লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে এসে উপনীত হয় ক্ষুধিতের প্রতি, মানুষের প্রতি মানবিকতা বোধের নিষ্কলুষ আলোর ভুবনে। ড্রেনের পচা পঙ্কিলতার পাশে অচেনা দুঃখী এক বৃদ্ধের হাসিভরা মুখে মা ডাক শুনে যে নারীর সমগ্র চৈতন্যে উদ্ভাসিত হয় মাতৃত্বের কোমল আর্তি, তার অন্তর্সত্তা আলোকিত হয় স্বপ্নময় অলৌকিক জ্যোৎস্নায়। যেখানে ‘গোলাপের নির্যাসে ধুয়ে দিচ্ছে তার কুসুম কোমল পায়ের পাতা একরাশ পরিচারিকা। আইভরি চিরুণীর কোমল স্পর্শে তার কেশদাম উৎফুল্ল।’ কিন্তু এইসব অচেনা জগৎ, যেখানে তার সন্তানরাই নেই, সেই রঙিন ভুবনে সে যেতে চাই না: ‘না, সেখানে লেদু নেই, লালমিয়া নেই, ময়না নেই, নেই তার প্রাণের প্রাণ হাড্ডিসার এই একফোঁটা দুর্বলপাতলা কালাচান্দ। ওরে আমার ময়না, আমার কালাচান্দরে, কেবলই ডুকরে ওঠে তার মন।’ [বনফুল]
অশ্রুসিক্ত এই রোদন মাহমুদুল হকের গল্পের অন্তর্স্রোতে ঘটায় অদৃশ্য রক্তপাত। উপরিস্তরের আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসের আন্তর্তরঙ্গে সর্বংসহা জীবনের দুঃখ, মানবিক হৃদয়লোকের উন্মোচন তাঁর গল্পে সৃষ্টি করে এক আশ্চর্য উন্মুখতা। অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ববোধের উদ্বোধন এবং একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য উচ্চতায় ব্যক্তিমানুষের চৈতন্যকে উন্নীত করা তাঁর গল্পের অন্তর্নিহিত শক্তি।
তিন
মাহমুদুল হকের কথাসাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য; আধুনিকতা, কাহিনির সঙ্গে তাঁর অনুপম গদ্যের সমন্বয়। একদিকে অসম্ভব গতিশীল ও জাদুময় সংলাপ সৃজন, অন্যদিকে চরিত্রের মনোজাগতিকতা পরিস্ফুটনের উদ্দেশে নানা উপাচার, নন্দন ভাবনার বিভিন্ন প্রকৌশল এবং তা উপস্থাপনের ঐশ্বর্যময় ভাষিক আয়োজন। প্রায় প্রতিটি গল্প ও উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রকে তিনি নির্মাণ করেছেন অসম্ভব মমতায়। অপ্রধান চরিত্রও তাঁর সংযমী স্বল্প বাক্যের আঁচড়ে হয়ে উঠেছে জীবন্ত এবং পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ। বরং অপ্রধান চরিত্রগুলোর একটি খসড়া রেখাচিত্র উন্মোচিত বা আভাসিত হয়ে ওঠে, ফলে পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের সামূহিক কৌতূহল পাঠকের রুচি ও স্পৃহাকে জাগরিত ও স্বপ্নবিহ্বল করে। এ কারণে তাঁর অনেক গল্পে রয়েছে উপন্যাসের উপাদান। কিন্তু তা কখনোই ছোটগল্পের বৃত্ত-পরিসর ছাড়িয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি।
সংযম ও পরিমিতিবোধের যথার্থ নান্দনিক প্রজ্ঞার এই পরিচয় মাহমুদুল হকের উল্লেখযোগ্য প্রায় গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে অনিবার্য। আবার কেবল শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টির প্রপঞ্চময় পথে পরিভ্রমণ করেননি তিনি, গজদন্তমিনারবাসী হয়ে রচনা করেননি বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন ঐন্দ্রজালিক কথামালা। যে জীবনের আখ্যান তাঁর বিনির্মাণের উপাচার সেখানে আখ্যানের সঙ্গে ব্যাখ্যান, অর্থাৎ কাহিনির সঙ্গে শিল্পের ব্যঞ্জনাময় বহুমাত্রিকতা প্রবহমান ও সমীকৃত। তাই তাঁর গল্প ক্রমশ হয়ে ওঠে আরো স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী, ভাষার কারুময়তাপূর্ণ; যদিও ওই ভাষা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকাংশে আবেগে ভারাক্রান্ত, অলঙ্কারবহুল বলে মনে হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।
মাহমুদুল হকের কয়েকটি উপন্যাসেবিশেষত অনুর পাঠশালা, জীবন আমার বোন এবং অনেকাংশে মাটির জাহাজ ও খেলাঘরফরাসি নব্য-উপন্যাস-বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ও তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার সংরাগরঞ্জিত। Contemporary French Literature গ্রন্থে হেনরি পিয়ের ফরাসি ‘নুভো রমাঁ’ বা নব্য-উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেনসেখানে কাহিনি নয়, প্রধান হয়ে উঠেছে ভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ, বাক্য বিন্যাসের অপ্রথাগত নিরালম্ব রীতি। ‘নুভো রমাঁ’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাতালি সারোৎ, আল্যাঁ রবগ্রিয়ে, মিশেল ব্যুতর এবং ক্লোদ সিমঁ। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রচল উপন্যাসরীতি পরিত্যাগসংকল্পে রূপান্তর করেন কাহিনির সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম বিবরণ, প্রথাগত স্যাঁতসেঁতে আবেগ; বিকল্পে গ্রহণ করেন অনুভূতি, মুগ্ধতা এবং মৃত্যুর তলদেশের প্রবল তরঙ্গ, কাহিনির পরিবর্তে ঘটনার উন্মেষ, চিত্রকল্পময় গদ্যে রচিত এক দীর্ঘ কবিতা; যার শব্দতরঙ্গে ক্রমশ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে আশ্চর্য বোধ। কাহিনি বর্জন করে তাঁরা অগ্রসর হলেন ভাষার দিকে, এমনকি চরিত্র রূপেও ভাষার নির্মাণ, কথার দৃশ্যমঞ্চফলে নব্য-উপন্যাস হয়ে ওঠে বিমূর্ত একটি শিল্প। যে শিল্প বহির্বিশ্ব থেকে আন্তর্চেতনা উন্মোচনের বিদ্রোহ। মাহমুদুল হকের এসব উপন্যাস সম্পূর্ণার্থে কাহিনিরিক্ত নয় বটে, কিন্তু কাহিনি এখানে নিতান্তই গৌণ, কাহিনি যা বিদ্যমান তাও ঘনসন্নিবদ্ধ নয়; বরং কাহিনির ধারাবর্ণনার পরিবর্তে তিনি উন্মেষিত ঘটনা পূর্ণ করে তুলেছেন ভাষার সূক্ষ্মতায়, সুকোমল আত্মমগ্ন সংলাপে। অবশ্য মাহমুদুল হকের প্রায় সমগ্র কথাসাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে এ বিবেচনা অত্যুক্তি নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, মাহমুদুল হক কি ফরাসি নব্য-উপন্যাস রচনারীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
ফরাসি ‘নুভো রমাঁ’ বা নব্য-উপন্যাস পর্বের প্রাথমিক লগ্ন বা সূচনাকাল ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল। এই পাঁচ বছরে, এবং পরবর্তীকালেও তার ধারাবাহিকতা ছিল, ‘নুভো রমাঁ’ সম্পর্কিত অ্যালাঁ রবগ্রিয়ে ও অন্যান্যদের প্রাথমিক রচনাসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে। উল্লিখিত রচনাসমূহ প্রাপ্তি ষাটের দশকের বাংলাদেশে কতটা সময়সাপেক্ষ ছিল তা গবেষণারই বিষয়। তবে ‘নুভো রমাঁ’ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম প্রবন্ধের যে তথ্য আমাদের অজ্ঞতা সত্ত্বেও কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে তা হল, নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ পত্রিকার শারদীয়, ১৯৭৩, সংখ্যায় লোকনাথ ভট্টাচার্যের ‘‘বস্তুপ্রেমিক ফরাসী ‘নব’ উপন্যাস’’ প্রবন্ধটি। এ সংক্রান্ত পরবর্তী প্রবন্ধ অরুণ মিত্রের ‘বর্তমান ফরাসী উপন্যাস : পটভূমি ও প্রবণতা’; যেটির প্রকাশকাল ১৯৭৮। যদি আমরা ধরেই নিই যে, মাহমুদুল হক ১৯৬৭ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস রচনার পূর্বে ফরাসি ‘নুভো রমাঁ’ রচনাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন, তত্রাচ অনুর পাঠশালা এবং তাঁর অপরাপর উপন্যাসে [এবং গল্পসমূহেও] ভাষার বৈচিত্র্য-প্রকৌশল বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার আশ্চর্য আত্মনিবেদন।
তবে রুশ, জর্মান, ইংরেজি এবং অন্যান্য বিদেশি সাহিত্য, বিশেষত ফরাসি সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি মাহমুদুল হকের আগ্রহ ছিল। ওই পাঠ-অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পমনস্তত্ত্ব নির্মাণে কোনো প্রভাবক রূপে ক্রিয়াশীল ছিল কিনা সেটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় নিরাকরণের পিছনে, অন্তত অনুর পাঠশালা রচনার ক্ষেত্রে, ফরাসি নব্য-উপন্যাস রচনারীতি ও তত্ত্ব তাঁর মনস্তাত্ত্বিক আধেয় নির্মাণে হয়তো হয়ে উঠেছিল সহায়ক ও স্বপ্নসঞ্চারী। তবে এই উপন্যাসের আখ্যান পরিকল্পনায় তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে গ্রহণ করেছিলেন ফরাসি ‘দেজা ভু’ তত্ত্ব।
প্রকৃতপক্ষে মাহমুদুল হকের অবলম্বিত ভাষাও তাঁর জীবনদৃষ্টি এবং মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিকতার সমীকরণের সাজুয্যে অন্বিত। সাহিত্যচর্চা থেকে নিজেকে অন্তরালে রাখবার এক যুগ পর, ১৯৯২ সালে, সাহিত্য সাময়িকী ‘রোদ্দুরে’ দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভাষা সম্পর্কে তাঁর চিন্তা: ‘যে ভাষাটি নিয়ে আমরা খেলছি আজ তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি রক্তাক্ত রাষ্ট্র, একথা যেন সকলের মনে থাকে। শুধু ‘বঁই ল্যাখা’ নয়, একসঙ্গে অনেক কিছুই করার আছে আমাদের।’
অর্থাৎ জীবনদৃষ্টির সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ মাহমুদুল হকের অন্বিষ্ট ছিল। যে ভাষা একটি জাতিসত্তার সামূহিক সংগ্রাম, উত্থান-পতন, ক্ষয়, সম্ভাবনা ও বিনির্মাণের প্রাণসঞ্চারকারী রক্তকণিকা। কেননা যে ‘রক্তাক্ত রাষ্ট্র’ বাঙালি জাতির সমগ্র অস্তিত্বের সঙ্গে নিঃশ্বাসের মতো সংমিশ্রিত, সেই রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার আত্মপরিচয় ও ক্রমবিকাশমান সম্ভবপরতার জন্যে একটি সার্বজনীন, সর্বগ্রহণীয় স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ লেখকের মানসচৈতন্যে হয়ে ওঠে সংকল্পিত। অপর একটি সাক্ষাৎকারে মাহমুদুল হক বলেছেন, ‘...আমার এটা প্রথমেই মনে হল, আমরা ভাষার পিছনে ঘুরছি আর কিঅনেকদিন তো হয়ে গেল, হিন্দুর ভাষা, মুসলমানের ভাষাসবাই কিন্তু খুব কলকাতা অনুসরণ করছে আমাদের এখানে... কলকাতার ভাষা আবার কলকাতার ভাষা না, ওটা নদীয়া শান্তিপুরের ভাষা।... ওরা ওই নদীয়া শান্তিপুরের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে নিয়েছে। তা আমরা নেব কেন? এসব ভেবে নানান রাজ্যের চিন্তা হচ্ছে, কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তখন, আমি অনুর পাঠশালা লিখলাম।’ [সুবর্ণরেখা, সম্পাদক : কাজী শাহেদ আহমেদ, ঈদসংখ্যা ২০০৩, পৃ ১৬০] অর্থাৎ অত্যন্ত সচেতন অভিনিবেশে তাঁকে কথাসাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ করে নিতে হয়েছে। ভাষা প্রসঙ্গে মাহমুদুল হক ছিলেন সদা সতর্ক, নিরীক্ষাপ্রবণ। প্রত্যেকটি শব্দকে তিনি গ্রহণ করেছেন বাংলার নির্বাক নিসর্গলোক থেকে, আঞ্চলিক শব্দপুঞ্জ থেকে, লোকায়ত সংস্কৃতি ও বাগধারা থেকে। কখনো সৃষ্টি করেছেন একেবারে নিজস্ব কতিপয় শব্দ, যে শব্দসমষ্টি ব্যক্তির মনোব্যকরণ প্রস্ফুটনের আধার। এসব নিজস্ব নবসৃষ্ট শব্দপুঞ্জ আমাদের কথাসাহিত্যের অনন্য সম্পদ। কিন্তু তাঁর ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দ আঞ্চলিকতাদুষ্ট নয়, নয় অনাধুনিক। আবার অভিধানের অন্ধকার সাম্রাজ্যে মৃত শব্দসৈনিক নয় তাঁর বাক্যাবলি। প্রত্যেকটি শব্দকে তিনি অত্যন্ত আবেগ ও রুচির সঙ্গে, যুক্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে, শিল্প ও প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গেথে তুলেছেন নান্দনিক সৌধ। প্রসঙ্গ ও পরিপার্শ্ব ব্যাখ্যার জন্যে স্থানিক বা আঞ্চলিক যথার্থ নামশব্দটিই তিনি ব্যবহার করেছেন। শব্দের এমন উপযুক্ত ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হয়েছে মাহমুদুল হকের নিজস্ব ভাষা।
অর্থাৎ মাহমুদুল হক অত্যন্ত সচেতন অভিনিবেশে একটি রুচিশীল সাহিত্যিক গদ্য নির্মাণে অšে¦ষী হয়েছিলেন। মাহমুদুল হক বাংলা গদ্যভাষার সেই অন্বেষাতে সংযোজন করেন নতুন সৃজনশীলতা। তাঁর গদ্য শিল্পের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের নতুন সৃষ্টিক্ষমপ্রাজ্ঞ চিত্রকল্পময় সাহিত্যভাষা নির্মাণে বৈপ্লবিক ও তীব্র অহংচৈতন্যসঞ্চারী।


[চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত গল্পকথা (মাহমুদুল হক সংখ্যা), রাজশাহী, ২০১৪ থেকে মুদ্রিত]









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ