bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

শাহাদুজ্জামানের গল্প: চিন্তাশীল প্রবীণ বানর


এক নারীর রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে পুরান ঢাকার জমজমাট, কৌতুহলােদ্দীপক জনপদের জনৈক যুবক বলে, ‘চান্দের আলাে হালায় মাইয়ার শরীলে ঢুইকা আর বারাইবার পারতাছে না।’ পুরান ঢাকার জনতা ছাড়া জোছনা এবং নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে এমন আশ্চর্য বাক্য জগৎ-সংসারে কেউ রচনা করতে পারে না। আবার এই জনপদেরই জনৈক ক্ষুব্ধ বাকরখানি বিক্রেতা চিৎকার করে বলতে পারে, ‘তােরে আমি টিকটিকি দিয়া চোদামু।' টিকটিকির সঙ্গে মনুষ্য সংগমের এই অভূতপূর্ব জাদুদৃশ্য রচনাতেও পারঙ্গম এই এলাকার মানুষ। এই এলাকাতেই যুগপৎ গুঁড়া মসলার গন্ধ এবং ঘােড়ার খুরের শব্দ মিলেমিশে থাকে। লেখক শহীদুল জহির এই এলাকার এক যুবকের গল্প শােনান যে শৈশবে দারিদ্র্যের কারণে বানরের দুধ খেয়ে বড় হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি চুরির সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য হয়ে ওঠে। মানুষের সাথে সাথে এই এলাকার নিয়মিত বাসিন্দা লম্বা লেজওয়ালা খয়েরি রঙের বানরদের ঘাের তৎপরতা দেখা যায়।

পুরান ঢাকার নারিন্দার পঞ্চাশ কামরার বিশাল বাড়ি ‘পাঠান মঞ্জিল'-এর ছাদে, কার্নিশে কতিপয় বানর পরিবারের ঠিকানা। সেখানে একটা বিশেষ প্রবীণ বানর তার খয়েরি রঙের লেজ ঝুলিয়ে চিন্তাশীল ভঙ্গিতে বসে থাকে। অন্যান্য বানরের মতাে যে চঞ্চল নয়। কার্নিশে বসে যে জগৎ-সংসারকে দেখে। হতে পারে সে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি চোরের দুধমার বংশধর। সে পাঠান মঞ্জিলের দক্ষিণ প্রান্তের ঘর থেকে আবদুল মােমেনকে সন্ধ্যার পর মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে দেখে। আবদুল মােমেন একরকম পথের দিকে তাকিয়েই হাঁটেন। কদাচিৎ কারও সাথে কথা বলেন। লােকে তাঁকে দেখলে সালাম দেয়, আসসালামালাইকুম চাচা মিয়া, শরীল বালা তাে?' মােমেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে মসজিদে ঢুকে যান। ইবাদত-বন্দেগি করেন। হাদিস-কোরআন পড়েন।

প্রবীণ বানর মােমেনকে বিশেষভাবে দেখে। কারণ, সে জানে এই লােক এ মহল্লায় নতুন। আবদুল মােমেন পুরান ঢাকায় এসেছেন কলকাতার শহরতলি থেকে। কলকাতা থেকে আবদুল মােমেন ঠিক কেন ঢাকা এসেছেন প্রবীণ বানর তা জানে না। মহল্লার মানুষও ঠিক জানে না তাঁর কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসার কারণ। এ নিয়ে তাদের বিশেষ ভাবনাও নেই। কারণ, এমন অনেককেই তারা এই মহল্লায় আসতে দেখেছে। তারা ধারণা করে, হয়তাে তিনি কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের কোনাে দাঙ্গার ভেতর পড়েছিলেন।এইটুকু জানে যে তাঁকে কলকাতা থেকে এখানে নিয়ে আসার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছেন আলী হায়দার। কথা সত্য, আবদুল মােমেনকে ঢাকা চলে আসবার ভাবনাটা সরবরাহ করেন আলী হায়দার, যিনি আবদুল মোমেনের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ঢাকার একটি বিমা কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি এবং থাকেন বাংলাবাজারে। আলী হায়দার কলকাতায় যাওয়া-আসা করতেন এবং তাঁদের ভেতর চিঠিপত্রের যােগাযােগও ছিল। কলকাতায় সংখ্যালঘু হয়ে থাকার চেয়ে ঢাকায় চলে আসার বিবিধ সুবিধার বয়ান আবদুল মােমেনকে দেন আলী হায়দারই। তারপর নানা ঘােরা পথে, ঘােরা প্রক্রিয়ায় আবদুল মােমেন সপরিবার চলে আসেন ঢাকায়। পাঠান মঞ্জিলে ওঠেন, আলী হায়দারের সহযােগিতায় বিমা কোম্পানিতে একটা চাকরিও জোগাড় করেন। একপর্যায়ে বাংলাদেশের পাসপাের্টও জোগাড় হয় তাঁর। প্রবীণ বানরের এত সব জানার কথা নয়। সে কেবল মহল্লার এই নতুন মুখের মৃদু হাঁটাচলা লক্ষ করে।

মহল্লায় এক আলী হায়দারের সঙ্গেই বস্তুত মােমেনের যােগাযােগ। আলী হায়দার ওয়ারী ফুটবল দলের সাপোর্টার। চাকরির বাইরে সেটিই তাঁর ধ্যানবিশ্ব। ওয়ারী মৃতপ্রায় দল। ফুটবলও লােকে তেমন দেখে না। তাতে আলী হায়দারের কিছু যায় আসে না। আলী হায়দার ওয়ারীর খেলা দেখেন এবং তাদের ফুটবল দক্ষতা বিষয়ে গবেষণা করেন। দুই স্কুলপড়ুয়া ছেলে আর তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার আলী হায়দারের। ফরিদ নামে তাঁর স্ত্রীর গ্রামের এক দরিদ্র আত্মীয়ও থাকে তাঁর সাথে। পােলিও আক্রান্ত হয়ে এক পা পঙ্গু হয়ে যাওয়া ফরিদকে বাংলাবাজারে বই বাঁধাইয়ের কাজ দিয়েছেন হায়দার। মহল্লায় সে ল্যাংড়া ফরিদ নামে পরিচিতি। মােমেনের পরিবারের নানা ফুটফরমাশ খাটবার জন্য ফরিদকে পাঠান হায়দার মাঝে মাঝে।

প্রবীণ খয়েরি রঙের বানর পাঠান মঞ্জিলের শেষ কামরার জানালা দিয়ে মােমেনের স্ত্রী নিলুফার বেগম এবং মেয়ে টুম্পাকেও দেখে। আবদুল মোমেন  মেয়েদের অবাধ চলাচলে বিশ্বাসী নন। কলকাতায় পর্দা, আকিদা চর্চার বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও ঢাকায় এসে তিনি কঠোর নিয়ম করেছেন যে নিলুফার পাঠান মঞ্জিলের বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না। কলকাতার বাসে ট্রামে ঘুরে বেড়ানাে নিলুফারের গতিবিধি ঢাকায় এসে সীমিত হয়ে পড়ে কেবল পাঠান মঞ্জিলের বিভিন্ন কামরা এবং ছাদে। ঢাকায় নিলুফারের কোনাে আত্মীয়স্বজন নাই, চেনা পরিচিত নাই। তা ছাড়া তাঁর এক গােপন ভয়ও আছে। নিলুফার আশঙ্কা করেন, মােমেন তাঁকে ত্যাগও করতে পারেন। ফলে প্রতিবাদবিহীনভাবে তিনি তাঁর গতিবিধির সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েছেন। আবদুল মােমেন অফিসে গেলে নিলুফার পাঠান মঞ্জিলের কামরা থেকে কামরা ঘুরে বেড়ান। ছাদ থেকে যােগাযােগ স্থাপন করেন পাঠান মঞ্জিল ছাড়িয়ে অন্যান্য বাড়ির ছাদে।

কলকাতায় বেড়ে ওঠা নিলুফার পুরান ঢাকার প্রেক্ষাপটে এসে নানা বিভ্রাটের ভেতর পড়েন। তার একটি নিলুফারের ভাষা। পাশের বাড়ির মাহমুদা ছাদে কাপড় নাড়তে নাড়তে যখন নিলুফারকে জিজ্ঞাসা করে, আউজকা কী রানছেন আপা?

নিলুফার তখন বলে, এই ধরুন একটু সুক্তো রেঁধেছি আর তার সাথে টমেটোর সেলাদ। এ দিয়েই খাওয়া হবে আজগে। 

মাহমুদা : আমরা তাে সুক্তো খাই নাইক্কা কুনদিন। আমারে একদিন ছিখাইয়া দিয়েন আপা। 

নিলুফার : নিশ্চয়। শিখিয়ে দেবখন।

আবদুল মােমেন কথা বিশেষ বলেন না বলে তার বচন বিশেষ কারও নজরে আসে না কিন্তু নিলুফারের কলকাতাই বচন শাঁখের করাতের শব্দ আর খয়েরি রঙের বানরের প্রেক্ষাপটে বিচিত্র ব্যতিক্রম হিসেবে নারিন্দার বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। মহল্লায় বানরের সহাবস্থান বিষয়ে প্রবাসী নিলুফারের অনভ্যস্ততা এবং আনাড়িপনা দ্রুতই নজর কাড়ে প্রবীণ বানরের। সে প্রায়ই নিলুফারের রান্নাঘরে ঢুকে বিবিধ জিনিস নিয়ে চম্পট দেয়। নিলুফার থেকে থেকে বলেন, মরণ আমার। 

প্রবীণ বানরের বিশেষ পছন্দ নিলুফারের বাড়ির কনডেন্সড মিল্ক । আবদুল মােমেন তিন চামচ কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে কড়া মিষ্টি চা খেতে ভালােবাসেন। ফলে তাঁদের ঘরে সব সময় কনডেন্সড মিল্ক থাকে। প্রবীণ বানর একদিন রান্নাঘরের জানালার কার্নিশ থেকে সেই কনডেন্সড মিল্ক চুরি করে নিয়ে যাবার পর বিশেষভাবে সেই কনডেন্সড মিল্কের নেশায় পড়ে যায়। সে তার খয়েরি রঙের লেজ ঝুলিয়ে তক্কে তক্কে থাকে কখন কনডেন্সড মিল্কের কৌটাকে মালিকবিহীন পাওয়া যায়। কনডেন্সড মিল্কের কৌটা মিটসেফে রেখেও কাজ হয়নি। রাতের বেলা কৌশলে রান্নাঘরের জানালা খুলে মিটসেফ থেকে ও্ই কৌটা চুরি করে নিয়ে গেছে প্রবীণ বানর। এরপর নিলুফার মিটসেফেও তালা লাগানাের ব্যবস্থা করেছেন।

প্রবীণ বানর রান্নাঘরের জানালা দিয়ে রন্ধনরত নিলুফারকে দেখে। ভেতরের ঘরে বেণি দুলিয়ে বছর ছয়-সাতের মেয়ে টুম্পাকে টেবিলে বসে পড়তে দেখে। বানর নিশ্চয়ই টের পায়, টুম্পার চেহারা পূজার সময় যে মূর্তিগুলাে তৈরি হয় তার আদলের মতাে। গােল, নিটোল, উজ্জ্বল। 

মহল্লার বানর প্রজাতির সাথে বিশেষ জুতসই সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও.মহল্লার মহিলাদের সাথে বিশেষ করে সখ্য ভালােই গড়ে ওঠে নিলুফারের। আবদুল মােমেন প্রতিবেশীদের সাথে বিশেষ কথা না বললেও নিলুফার তাঁর ছাদ এবং নানা কামরা পদচারণের মাধ্যমে ভালােই যােগাযােগ স্থাপন করেছেন পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে। তিনি প্রতিবেশীদের কলকাতার গল্প করেন। গল্প করেন এসপ্লানেড, গড়ের মাঠ, বিড়লা প্লানেটোরিয়ামের।

সুলতানা জিজ্ঞাসা করে, কইলকাতার কফি হাউসের নাম সুনছি। গেছেন নিহি?

নিলুফার : কত গিয়েছি। কফি খেয়েছি, কাটলেট খেয়েছি। ওখানে ওয়েটাররা সব পাগড়ি পরে থাকে। বিখ্যাত লােকেরা সব কফি খেতে আসে সেখানে। ওখানে একবার আমি সৌমিত্রকে দেখেছি, ওই যে নায়ক।

সুলতানা : হাচা নিহি? 

নিলুফার পাঠান মঞ্জিলের ছাদ থেকে মহল্লার গতিবিধি লক্ষ রাখেন। জানতে পারেন কোথায় কী ঘটছে। নিলুফার ছাদে উঠলে দূর কার্নিশ থেকে প্রবীণ বানর বরাবর একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নিলুফার মাহমুদাকে বলে : দেখেছেন আপা, এই বানরটা না কেবলই আমার দিকে ওমন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে।

মাহমুদা; আপনেরে বিয়া করবার চায় মনে লয় । 

হাসে দুইজন। মহল্লা নিয়ে গল্প জুড়ে দেয়। 

নিলুফার : মাহমুদা আপা, ওই ৪২ নাম্বার বাড়ির মায়াকে পড়াতে আসে যে ছেলেটা, ওকে দেখি বাড়িতে ঢুকবার আগে গলির মােড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রােজ একটা কলা কিনে খায়। মায়ার মা কি ছেলেটাকে নাশতা টাশতা কিছু খেতে দেয় না নিকি? 

মাহমুদা : মায়ার মায়ে যে কিপটা, আমার মনে লয় খালি এক গেলাস পানি খিলাইয়া বিদায় করে।

সন্ধ্যায় মােমেন যখন মসজিদে থাকেন, তখন নিলুফার আকাশবাণী কলকাতায় অনুরােধের আসরের গান শােনেন। সেটা রেডিওর যুগ। ঘরে ঘরে টিভি আসেনি তখনাে। মিউজিক শুরু হলেই নিলুফার বলে দিতে পারেন, এটা শ্যামল মিত্রের ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়' কিংবা হেমন্তের ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা, দূর নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা।'

তারপর একদিন মহল্লার লােকেরা বলতে থাকে, সুনছেন নিহি, মােমেন মিয়ার বউয়ের তাে মিরকি ব্যারাম।

নিলুফারের মৃগীরােগের ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে যখন একদিন পাঠান মঞ্জিলের ছাদে তাঁর খিঁচুনি ওঠে। নিলুফারের দিকে বরাবর অপলক তাকিয়ে থাকা প্রবীণ বানর এ সময় নিলুফারকে এমন বিচিত্র ভঙ্গিতে মাটিতে শুয়ে কাঁপতে দেখে অস্বাভাবিক শব্দে ডাকতে থাকে। পাশের কামরার মাহমুদা বানরের এই অস্বাভাবিক ডাকে কৌতূহলী হয়ে ছাদে এসে নিলুফারকে খিঁচুনিরত দেখতে পায়। মাহমুদাই তারপর নিলুফারের নাকে এক পুরােনাে চামড়ার স্যান্ডেলের গন্ধ শুঁকিয়ে পরিস্থিতি মােকাবিলা করে।

নিলুফারের গােপন ভয় আর দুর্বলতার জায়গাটা এখানেই। মােমেনের সাথে যখন বিয়ে হয়, তখন নিলুফারের বাবা-মা তাঁর মৃগীরােগের ব্যাপারটা গােপন করেছিলেন। জানাজানি হয়ে যাবার পর মােমেন তাঁকে তালাক দেবার কথা বলেছেন বার কয়েক । দেননি। কিছুটা তাঁর ধর্মীয় কর্তব্যবােধে, অনেকটা কলকাতার সংখ্যালঘু মুসলমান জনপদে বিবাহযােগ্য মেয়ে পাবার সীমিত সম্ভাব্যতা ইত্যাদি বিবেচনা করে। তবে নিলুফারের ভয় ঢাকায় তাে মােমেনের জন্য পাত্রী পাওয়া দুরূহ কিছু হবে না। ফলে এই মৃগীরােগের অভিযােগে তিনি তাঁকে ত্যাগও করতে পারেন। মােমেন ও নিলুফারের সম্পর্ক নেহাতই আনুষ্ঠানিক। প্রয়ােজনীয় সাংসারিক কথাবার্তার ভেতরই সীমিত থাকে তাদের যােগাযােগ।

মােমেন, নিলুফার, টুম্পা ক্রমশ প্রবীণ বানরের চোখের অভ্যস্ত অবয়বে পরিণত হয়ে ওঠেন। তবু সকল লােকের ভেতর থেকে তাঁদের দিকে তার বিশেষ নজর থাকে। নিলুফারও ক্রমশ বানর প্রজাতির সাথে সমঝােতায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রবীণ বানর মােমেনকে ক্রমশ আরও সাবলীলতার সাথে মহল্লায় হাঁটাচলা করতে দেখে। যদিও তাঁর গতিবিধি অফিস এবং মসজিদ পর্যন্তই সীমিত। ইংরাজি ভালাে জানেন বলে ইতিমধ্যে অফিসে মােমেনের প্রমােশন হয়। ক্রমশ টুম্পা আরও নিটোল আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বড় হয়ে যাওয়াতে নিলুফারের মতাে টুম্পারও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেন মােমেন। স্কুল থেকে তাকে সােজা চলে আসতে হয় পাঠান মঞ্জিলে।

তবে একটা ব্যাপারে তাঁরা টুম্পাকে বিশেষ নিয়মে বাঁধতে পারেননি। ইতিমধ্যে নিলুফার ও মােমেন লক্ষ করেন, তাঁদের অজান্তেই টুম্পা কখন মুখে তুলে নিয়েছে পুরান ঢাকার কথ্য বচন। হয়তাে তার স্কুলের বান্ধবীদের কাছ থেকেই প্রাথমিকভাবে বাধা দিলেও একপর্যায়ে তাঁরা আর বিশেষ বাধা দেন না। টুম্পার মুখে ঢাকাই বচন শুনে তাঁরা একরকম কৌতুকই বোধ করেন। এ ছাড়া মনে মনে এ-ও ভাবেন যে মহল্লার মানুষের সাথে তাঁদের যে ভাষাগত দূরত্ব আছে সেটা যদি টুম্পা ঘুচিয়ে দিতে পারে, তবে আখেরে তা বস্তুত ভালােই। আবদুল মােমেন উপভােগই করেন যখন টুম্পা তাঁকে বলে, ‘আব্বা, আপনেরে যে লাল মিয়ার দুকান থিকা সন্দেশ আনবার কইছিলাম অনেন নাই ক্যালা?'

এ সময় এক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটে। যে বিমা কোম্পানিতে আবদুল মােমেন চাকরি করেন, সেখান থেকে তাঁকে দুই সপ্তাহের জন্য একটা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানাে হয় আমেরিকার বােস্টন শহরে। এই সংবাদে মহল্লায় বেশ একটা সাড়া পড়ে। তখন মহল্লা থেকে এমন বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপার বিশেষ ঘটেনি। স্বল্পবাক আবদুল মােমেনের ব্যাপারে লােকের কৌতূহল দেখা দেয় ।

রাস্তায় থামিয়ে তাঁকে মহল্লার লােক জিজ্ঞাসা করে, আপনে বলে আমেরিকা যাইবার লাগছেন?

আবদুল মােমেন বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখান না। শুধু বলেন, জি। 

টুম্পা বলে, আব্বা, আপনে আমার লিগা বিদেশি পুতুল আইনেন।

নিলুফার বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন না। মােমেন নিলুফারকে বলেন, সাবধানে থেকো।

কিন্তু আমেরিকা যাবার পর দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও আবদুল মােমেন আমেরিকা থেকে ফেরেন না। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে তিন সপ্তাহ, এক মাস পেরিয়ে যায়। মােমেন ফেরেন না। নিলুফার বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের পারিবারিক বন্ধু হায়দারও। নিলুফারের যেহেতু পাঠান মঞ্জিলের বাইরের জগতের ব্যাপারে কোনাে ধারণা নেই, তিনি নির্ভর করেন আলী হায়দারের ওপর। আলী হায়দার ভিন্ন এক বিমা কোম্পানিতে চাকরি করেন, তিনি আবদুল মােমেনের অফিসে গিয়ে খােঁজখবর করেন। আবদুল মােমেনের দেশে না ফেরা নিয়ে তাঁর অফিসও বিভ্রান্ত। তাঁরা জানান, মােমেনের ফিরতি টিকিট কাটা ছিল। তবু সেই ফ্লাইটে তিনি আসেননি। আমেরিকায় যেখানে তিনি প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন তাঁদের সাথে যােগাযােগ করে তাঁর অফিস। তারাও জানায়, আবদুল মোমেন যথারীতি দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণ করেছেন কিন্তু তারপর কোথায় গেছেন তারা বলতে পারে না।

আলী হায়দার নিলুফারকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনাকে কিছু বলে টলে নাই ভাবি?

নিলুফার : না তাে, ঘুণাক্ষরেও কিছু বলেনি তাে। কী হলাে বলুন তাে হায়দার ভাই?

হায়দার : আমিও তাে ভেবে কিছু পাচ্ছি না। দেখি, আরও কয়টা দিন দেখি।

জানালা দিয়ে প্রবীণ বানর দেখে, নিলুফার এবং টুম্পা একে অন্যের সাথে আবদুল মােমেন বিষয়ে আলাপ করছে। সে-ও নিত্যদিন মসজিদের পথে হেঁটে যাওয়া আবদুল মােমেনকে দেখতে না পেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে ছাদের কার্নিশে লেজ ঝুলিয়ে বসে চিন্তা করে।

মহল্লার লােকেরা কৌতূহলী হয়ে ওঠে, বলে, ‘মােমেন মিয়ার হইচে কী? অক্করে যে লা পাত্তা হইয়া গেল।’ 

নিলুফারের হাতে সঞ্চয় ফুরিয়ে আসে। আলী হায়দারের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেন তিনি। আলী হায়দার নিলুফারের বাজারঘাটও করে দিয়ে যান।

দেড় মাসের মাথায় আবদুল মােমেনের চিঠি আসে। মােমেন জানান, তিনি প্রশিক্ষণ শেষ হবার পর এয়ারপাের্টে যাবার পথে হঠাৎ ট্যাক্সি থেকে নেমে সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকাতে থেকে যাবেন। জানিয়েছেন তিনি এখন বােস্টনেই আছেন। একটা গ্রোসারি দোকানে এক বাংলাদেশি তাঁকে কাজ দিয়েছেন। তিনি থাকারও ব্যবস্থা করেছেন। মােমেন বলেন, তিনি এখানে থেকে যাবেন এবং একদিন নিলুফার ও টুম্পাকেও নিয়ে আসবেন। কাগজপত্র হতে তাঁর কিছু সময় লাগবে। তবে টাকাপয়সার সমস্যা হবে না। তিনি কাজ করে যা কামাই করছেন, তাতে নিজের খরচ চালিয়ে ঢাকাতেও পাঠাতে পারবেন । জানান, টাকা তিনি হায়দারের নামেই পাঠাবেন। হায়দার তা পৌঁছে দিয়ে আসবেন নিলুফারকে। মােমেন নিলুফারকে আল্লাহকে স্মরণ করতে বলেন সব সময়। পাঠান মঞ্জিলের বাইরে যেতে মানা করেন। বলেন, আল্লাহ সব দেখছেন।

নিলুফার ও হায়দার মােমেনের এই বিচিত্র সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়। কী প্রতিক্রিয়া জানাবেন বুঝতে পারেন না। মহল্লার লােকেরা বলে, মােমেন মিয়া বিদ্যাশ গিয়া কোন চক্করে পড়ল?

মােমেন ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে টাকা পাঠান হায়দারের নামে। সে টাকা তুলে নিয়মিত নিলুফারকে দিয়ে যান তিনি। নিলুফারকে বাজারঘাট, ঘরের নানা কাজের জন্য হায়দার প্রায়ই পাঠিয়ে দেন পঙ্গু ফরিদকে। 

নিলুফার মােমেনের কথা রাখেন। মােমেনের অনুপস্থিতিতে পাঠান মঞ্জিলের বাইরে যান না। তা ছাড়া কথা না রেখেও উপায় নাই বিশেষ, কারণ, অনভ্যস্ততায় এই দালানের বাইরে যাবার সাহসও তাঁর মনে কখনো জাগে না। টুম্পাও স্কুল শেষে সােজা চলে আসে বাসায়। মােমেনের আমেরিকা থেকে যাবার সিদ্ধান্তে নিলুফারের প্রাথমিক বিচলিত হবার ভাবটা ক্রমশ চলে যায়। একধরনের নির্বিকারত্ব দেখা দেয় তাঁর ভেতর। একটা খুদে জনপদের পঞ্চাশ কামরার সেই বাড়ির এক কোনায় নিলুফার তাঁর কন্যাকে নিয়ে দিন যাপন করতে থাকেন। বরাবরের মতাে সুক্তো রান্না করেন, মাহমুদার সাথে গল্প করেন। আরেক বারান্দায় নিরঞ্জন বাবুকে ধ্যান করতে দেখেন। রেডিওতে অনুরােধের আসরে মান্না দের গান শােনেন, ‘ও রুপের মিথ্যে গরব ওমন যদি বিরূপ থাকে ও গুণের কী দাম বলাে লাজে যদি আগুন ঢাকে।’ মাঝে আরও কয়েকবার মৃগীর ঘটে তাঁর। মহল্লার ডাক্তার হাকিম চিকিৎসা করেন তাঁর। প্রবীণ বানর তার খয়েরি লেজ ঝুলিয়ে চিন্তাশীলভাবে নিলুফার ও টুম্পার দিকে নজর রাখে।

মাহমুদা বলে, আপা, টুম্পার বাপে ওই দ্যাশে গিয়া সাদি উদি ক্ইরা ফালায় নাই তাে। 

নিলুফার: ও মরুগ গে, চুলােয় যাক। আমি কী জানি!

এক বছর যায়, দুই বছর যায়, যায় তিন বছর। আবদুল মােমেনের আর কোনাে খোঁজ নাই। মাঝে মাঝে হায়দারের কাছে চিঠি আসে, তাতে কাগজপত্র হয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি। পাঠান মঞ্জিলের লােকেরা বারান্দার দক্ষিণপূর্ব কোণের শেষ কামরার নিলুফার ও টুম্পাকে নিয়ে কথা বলে।

তারপর একদিন ঘটনার মােড় ঘােরে।

পাঠান মঞ্জিলের যে কামরায় নিলুফার আর টুম্পা থাকে, সেখানে একদিন বাথরুমে পানি নেই। টুম্পা নিচের কলতলা থেকে বালতিতে পানি দোতলায় তুলবার চেষ্টা করে। এ সময় হঠাৎ সে পা পিছলে পড়ে যায় সিঁড়িতে। মুহূর্তে সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে। ছাদ থেকে এই দৃশ্য দেখে প্রবীণ বানর আবার অস্বাভাবিক শব্দ করতে থাকে। আবার ছুটে আসে মাহমুদা। দেখা যায় টুম্পার শরীরে কোনাে আঘাতের চিহ্ন নাই কিন্তু তার পায়জামা ভিজে গেছে রক্তে।। টুম্পার মাকে ডাকে মাহমুদা। টুম্পাকে ধরাধরি করে ঘরে নেওয়া হয়। ডাক্তার হাকিম এসে টুম্পাকে দেখেন। একটা পরীক্ষা দেন। সন্ধ্যায় পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আসেন তিনি। এসে জানান, টুম্পার গর্ভপাত হয়েছে'।

নিলুফারের চোখ স্থির হয়। শক্ত হয় চোয়াল। 

জানতে পেরে মাহমুদা বিস্মিত হয়ে বলে, কয় কী?

অবিবাহিত কিশােরী টুম্পার গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার ব্যাপার মহল্লায় আলােচিত হতে থাকে। পুরুষ সদস্যহীন পাঠান মঞ্জিলের দক্ষিণ প্রান্তের এই কামরার ব্যাপারে কৌতূহল বেশ কিছুকাল জারি আছে মহল্লায়। এ ঘটনায় ব্যাপারটা সুরাহা করবার বিষয়ে মহল্লার মুরব্বিরা নৈতিক দায়িত্ব বােধ করেন। সত্য উদঘাটনে ডাক্তার হাকিমের অবস্থান সুবিধাজনক বলে তাঁকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলেন মুরব্বিরা। ডাক্তার হাকিম তাঁর চিকিৎসক অবস্থানের সুবাদে টুম্পার সাথে বিশেষ আলাপের সুযােগ গ্রহণ করেন এবং সত্য উদঘাটনে সফল হন। টুম্পা স্বীকার করে তার গর্ভধারণের জন্য দায়ী ল্যাংড়া ফরিদ।

ঘটনা পাঠান মঞ্জিলের মুরব্বিদের ক্ষিপ্ত করে। এ ধরনের নৈতিক অধঃপতনের একটা বিচার হওয়া জরুরি মনে করেন তাঁরা। এদের দুজনের ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার বলেও তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত হয় টুম্পা ও ল্যাংড়া ফরিদকে নিয়ে সালিস হবে এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে এদের দুজনের ব্যাপারে।

ইতিমধ্যে ডাক্তার হাকিম চিকিৎসা চালিয়ে যান। টুম্পার বিছানার পাশে বসে নিলুফারকে ডাক্তার জানান টুম্পা ও ল্যাংড়া ফরিদকে নিয়ে মহল্লার মুরব্বিরা একটা সালিস বসাবেন অচিরেই। নিলুফার নীরব থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর বলেন, বসুন, আপনাকে এক কাপ চা দিই।

বলে তিনি চলে যান রান্নাঘরে। 

নিলুফার রান্নাঘরে চলে গেলে কাঁথায় শরীর ঢেকে শুয়ে থাকা টুম্পা খােলা জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে যা বলে, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না ডাক্তার হাকিম। টুম্পা বলে, আপনারা যেই কামের লিগা আমার নামে বিচার বহাইছেন, ওই কাম তাে আগে করছে আমার মায়ে। আগে ফরিদ আর আমার মায়ের বিচার করেন, হের বাদে আমার বিচার করবার আইয়েন।

এ সময় দেখা যায় জানালায় মুখ বাড়িয়ে চিন্তাশীল ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে প্রবীণ সেই খয়েরি বানর।

---------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি:

শাহাদুজ্জামান বাংলাদেশের লেখক, ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহন করেন। বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে শাহাদুজ্জামানের অবদান অনন্য উচ্চতায় পৌঁছতে আরম্ভ করেছে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ একইসাথে পাঠকনন্দিতও। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: কয়েকটি বিহ্বল গল্প (১৯৯৬)। উল্লেখযোগ্য রচনা: ক্রাচের কর্ণেল (২০০৯), একজন কমলালেবু (২০১৭) ও গল্পগ্রন্থ: মামলার সাক্ষী ময়না পাখি (২০১৯) । ২০১৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।   


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ