bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মেঘ মল্লারের কথা

কুলদা রায়ের গদ্য: জলের মধ্যে লেখাজোখা: পর্ব ৯

মেঘ মল্লারের কথা 

আমরা ছিলাম গরীব। যে বাড়িটিতে জন্মেছিলাম, যখন বুঝতে শিখেছি- তখন জেনেছি- বাড়িটি আমাদের নয়। আমরা দয়ায় আছি। আমার ঠাকুরদা আমার নামটি রেখেছিলেন বড়ো করে। কুলদানন্দ রায়। নাম রাখতে তো পয়সা লাগে না। বিনি পয়সায়ই যখন নাম রাখা যায় তখন কেন ছোট করে রাখবেন। রাখলেন বড়ো করে আমার নাম- এমন নাম, কোথাও তুমি পাবে নাকো খুজেঁ। দাদাগিরি না করলেও সবাই আমাকে দাদা বলে ডাকে। এমনই নামের মাহাত্ম্য।

গরীব হওয়ার কারণে আমি আসলে গরীবদেরই ভালোবাসি। ধনীদের এড়িয়ে চলি। আমার জ্ঞাতিদের সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ ইতিহাসের গবেষণার বিষয়। আমার এতো সময় কোথায়! আমি রুটি রুজির সংগ্রামের ফাকেঁ ফাকেঁ যখন যেটুকু সুযোগ পেয়েছি, আমি পড়ালেখা করেছি। কাউকে বলিনি। কাউকে ধরিনি। আমার রোগা পটকা চেহারা দেখে অনেকেই টেনে তুলেছেন নিজ থেকে এসে। এক শিক্ষক বাড়ি থেকে ডেকে এনে আমাকে চাকরি দিয়েছিলেন। তার জন্যই আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিতে পেরেছিলাম। আমারতো এই রকম হওয়ার কোনো সামর্থ্যই ছিল না। গরীব মানুষের গরীব থাকাই ভাল। আমার প্রিয় মানুষ প্রয়াত শওকত চৌধুরী তো তাঁর সারাটি জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন গরীব মানুষদের জন্য। আমি তাই কখনো ধনী হতে চাইনি।

ছেলেবেলায় দুজন পাগল ছিল আমার বন্ধু। একজন অমূল্য পাগল। আরেকজন রমজান ছ্যাকা। অমূল্য পাগলের বাড়ি কোটালিপাড়ায়। বর্ষাকালে পাগল হয়ে যেতেন। আসতেন আমাদের শহরে। পাগলামি করে চেয়ে চিন্তে চলত তার দিন। রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি। গৌরকান্তি। পোলাপান তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। ঢিল ছুঁড়ত। আর অমূল্য পাগল তাদের দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে যেতেন। আমিও তাড়া খেয়েছি। দিনের বেলা আমাকে কখনো চিনতেন না। রাতের বেলায় আমার জানালার পাশে এসে দাঁড়াতেন। সারাদিনে পাওয়া টাকা পয়সা জমা দিতেন। আর প্রায়ই আমাকে ডিমটা, কলাটা, পেঁপেটা, পেয়ারাটা দিতেন। এগুলো তার ভিক্ষে করা খাবার দাবার। বলতেন, বেটা- শক্ত হয়ে দাঁড়া। আমি যেবার প্রথম পাবনা গেলাম, এই অমূল্য পাগল আমাকে সত্তরটি টাকা জোর করে গুজে দিলেন। বললেন, বেটা তোর ইচ্ছে পূরণ কর। সেই প্রথম একসাথে এতগুলো টাকা আমার নিজের হল। পাবনা শহরের একটি দোকান থেকে একটি হারমোনিকা কিনলাম। ফুঁ দিয়ে দেখি, বাজে না। বললাম, পাল্টে দিন। দোকানি বললেন, এটা বাজানোর জন্য বিশেষ কায়দা দরকার। শিখে নিও। সেই হারমোনিকা কোনোদিনই বাজে নি। নষ্ট বাঁশি কি বাজে? সেই ইচ্ছে পূরণের অমূল্য পাগলই আমার জ্ঞাতি। আর কে হবে আমার জ্ঞাতি?

আমার স্বজন কি কেউ বলেছে, ভাই- আমার ছায়ার পাশে এসে দাঁড়া।

আর রমজান ছ্যাকা ছোটখাটো মানুষটি। লেখাপড়া জানা মানুষ। একদম মৌনী বাবা। কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি। অনেক মুদির খাতা পত্র লিখে দিতেন। কেউ কিছু দিলে খেতেন। না হলে- অভুক্ত। শোনা যায় ছ্যাকা খেয়েই তার এই দশা। এজন্য তার নাম রমজান ছ্যাকা। এই রমজান ছ্যাকার কাছে আমি বটতলায় বসে অংক শিখেছি। শিখেছি- স্কুলের পড়া। একদিন তিনি শোনালেন, ‘আমরা দুজন একটি গায়েঁ থাকি/ সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ/ তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি/ তাহার গানে আমার নাচে বুক।’--এই রমজান পাগলই সেদিন আমাকে একটি গাঁয়ে পৌঁছে দিলেন। আমি আর সেখান থেকে নড়ি না চড়ি না। কাউকে দেখলেই মনে হয়, তাহার দুটি পালন করা ভেড়া / চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে/ যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া/ কোলের পরে নিই তাহারে তুলে। রমজান ছ্যাকাই আমার আত্মীয়।

সেই থেকেই আমি এই এক গায়েঁর লোক। এই এক গায়েঁর জন্যই আমার ভালোবাসা আছে। কিছু দায়িত্ব আছে।

এই ভালোবাসার সুরটি বেঁধে দিয়েছেন ড: আ ব ম নূরুল আনোয়ার। আমার শিক্ষক। সকলের নূরু ভাই। তাঁর দুটি কাজ- ক্রিকেট শেখানো আর গান ছড়ানো। জ্যোৎস্না রাতে তিনি আসতেন ময়মনসিংহ শহর থেকে। তার রিকশার টুং টাং শুনতাম। শুনতাম, তিনি আমার নাম ধরে কালোয়াতি সুরে ডাকছেন, খু-কন। তিনি নিয়ে যেতেন ব্রহ্মপুত্রে। নৌকায়। মাঝি- ঈশ্বর। শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গান। আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে। একটি কুরচি গাছের গোড়ায় নৌকাটি বেঁধে ফেলত ঈশ্বর। গাইতেন- তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে।। আমাকে তিনি দিয়েছিলেন বেগম আখতারকে। বেগম আখতার রাত্রি ভেদ করে কিন্নর কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন- ‘জোছনা করেছে আড়ি/ আসে না আমার বাড়ি/ গলি দিয়ে চলে যায়/ লুটিয়ে রুপালী শাড়ি।’ আমি সেই আড়ি দেওয়া অভিমানী জ্যোৎস্নার পিছনে দৌড়েছি। তার লুটিয়ে পড়া শাড়িটিকে তুলে দিতে চেয়েছি তার হাতে। শাড়িটির আঁচল থেকে ধুলো ঝেড়ে দিতে চেয়েছি।

আর এই অভিমানী চলে যাওয়া রূপকে দেখেছি- টিএসসির পিছনে বসে রয়েছেন। পাথরের চেয়ারে। আমি দূরে। একজন কবি তাকে শোনাচ্ছেন কবিতা, ছাট কাগজের মলাট। জলমগ্ন পাঠশালা। ফিরে এসো চাকা। কবির কণ্ঠ থেকে যে হিরক শব্দ শুনছি তা কেবল শব্দ নয়। মেঘ মল্লারের তান। এই তান যখন বাঁশিতে বেজে ওঠে- তখন সরস্বতী বন পেরিয়ে আসেন। মগ্ন হয়ে শোনেন মেঘ মল্লার। আর মনে হয়, আকাশটা যেন আয়না। সেখানে ফুটে উঠেছে কত রুপের জগৎ। কবি বলছেন, শোনো। ওটা আয়না নয়। আয়না হবে কেনো। ওটা মুকুর। মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে। সেই থেকে জেনেছি -আয়নায় নিজেকে দেখা যায়। আর মুকুরে দেখা যায় লাবণ্যকে। এই কবি কাজল শাহনেওয়াজই আমার আত্মীয়।

আমার আত্মীয় সেই রূপকথার বুড়ো। সকাল হলেই সূর্য দেখতে ছোটেন। আর সন্ধ্যায় পাখিরা ফিরেছে কিনা সে খবর নেন। তিনি হাঁটেন ঘাসের উপর দিয়ে। তার পায়ে পায়ে লাফিয়ে ওঠে রোদ আর শিশির। ফুলের ভিতরে দেখেন কতটা মৌমাছি এলে বীজের উদ্গম হবে। তিনি বললেন, জ্যোৎস্না ওঠে। জলের উপরে ঈশ্বর ঘুমিয়ে পড়েন। এ-ই তিনি। তিনিই আমি। আমার পালক নাইব উদ্দিন আহমদ।

কী দরকার আমার অন্য জ্ঞাতি-গুষ্ঠির।

এইভাবে চিনেছি, আমার ভাবনাটিকে। আমার আত্মীয়কে। এরা সবাই আমার গ্রামের লোক। কোনো বান এলে সবাইকে ডেকে তুলতে হবে। গ্রামটিকে বাঁচাতে হবে। গ্রামের সবুজটি ধরে রাখতে হবে। বলতে হবে, দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/ কেবলি শুনি রাতের কড়া নাড়া/ অবনী, বাড়ি আছো?

আমার ভুবনে যা পাই, সবাই ভাগ করে খাই। একটি ফুল পেলে, সবাইকে ডেকে বলি- এই দ্যাখো ফুল। গানটি পেলে বলি, এসো এক সাথে শুনি। কিছু পেলে, একসাথে পড়ি। সব সুন্দর একা একা কেন দেখব? সুন্দরকে সবাই মিলে দেখব। সত্য-সুন্দরকে সবাই মিলে চোখের মণির মতো বাঁচিয়ে রাখব।

এজন্য আমার নিজের কিছু নেই। আমার সবই- সবার সবকিছু। আবার সবার সব কিছু আমারও কিছু বটে। এজন্য যার যেখানে যা পাই- ভাল লাগলে নিয়ে আসি, সবাইকে দিয়ে দেই। আমার কাছে কেউ চাইলে আমি কখনো ফেরাই না । বলি- নাও, এ তোমার জিনিস। একেই কি অবাধ তথ্য প্রবাহ বলে? কি জানি।

আমি সময় পেলে কথা বলি। মন খুলে কথা বলি। সত্যের কথা বলি। আমার গরীব হওয়ার কথা বলি। আমার চোখের জলটির কথা বলি। আমার স্বপ্নের কথা বলি। কোনো লুকো ছাপা নেই। এখন এই আমার কথা যদি কেউ তার কথার ভেতরে সাজায়, তাতে আমার কী আসে যায়? সেতো তারই কথা। সেতো সবারই কথা। সেই এক গাঁয়েরই কথা। বলুক না যে কেউ। এতো প্রাণের মধ্যেই প্রাণে মিশে যাওয়া। সর্বপ্রাণের আলো-হাওয়া।

যে ধম্মা হেতুপ্পভবা

তেসং হেতুং তথাগতো আহ

তেসঞ্চ যে নিরোধা

এবং বাদী মহাসমনো।।

এটা কী সবার কথা নয়? সত্যের কথা নয়? সবাইকে ভালবাসার কথা নয়।

আসুন পড়ি একসাথে -

...এক এক রাত্রে সে বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। কোথাকার যেন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশ বনের মধ্যে লুকানো এক উর্দ্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুম রাতে সে পাহাড়ে বেতগাছ হাওয়ার দুলছে, বাঁশবনে শিরশির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতডাঁটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধ রাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবলি বাজছে মেঘ মল্লার!

ভোরে উঠে রাতের স্বপ্ন দেখে আশ্চর্য হয়ে যেত কোথায় পাহাড়, কোথায় বেতবন, কার ভাঙা মূর্তি, কিসের অর্থহীন দুঃস্বপ্ন!...

(-মেঘমল্লার/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

-------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি:

কুলদা রায়: জন্ম ১৯৬৫ খৃস্টাব্দ

কুলদা রায় কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। জন্ম বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ময়মনসিংহ) থেকে পড়াশোনা করেছেন। থাকেন আমেরিকার নিউইয়র্কে। কথাসাহিত্যের ওয়েবম্যাগ গল্পপাঠের প্রধান সম্পাদক।

প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য গল্প (২০২০); বৃষ্টি চিহ্নিত জল (২০১৫); কাঠপাতার ঘর (২০১৩); কাকমানুষের চকখড়ি (২০১০)। প্রবন্ধ গ্রন্থ: রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি ও অন্যান্য বিতর্ক (২০১৫)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ