bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

সৈয়দ শামসুল হকের গল্প: তাস

প্রচ্ছদ: হিম ঋতব্রত

দুখানা দশ হাত বারো হাত কামরার সামনে একচিলতে বারান্দা আর বিশ্রীরকমের ছোট এক দরজা এক জানালা নিয়ে রান্নাঘর । রান্নাঘর বলতেও ওই, ভাঁড়ার বলতেও ওই । শোবার ঘরদুটো তাই তৈজসপত্র এটা-সেটায় এত গাদাগাদি যে নিশ্বাস ফেলবার জায়গাটুকু খালি নেই। পথ থেকে ডানধারের কামরায় আবার পার্টিশন দিয়ে একটা বসবার ঘরের মতো করা হয়েছে। বারান্দার নিচে হাত-তিনেক ঢালু জায়গা, তারও অর্ধেক আবার কুয়োয় আটকানো। বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে কখনও আকাশ দেখা যায় । জানালা দিয়ে মুখ ফেরালে পথটুকু। বাসা বলতে তো এই ৷ ঘষে-মেজে সাফ-সুতরো করবার কোনো কথাই ওঠে না। তবুও কি মা দিনরাত কম চেষ্টা করেন একটু ছিমছাম করে তোলার জন্য। কিন্তু হলে হবে কী, আশপাশের আবহাওয়াই এমনিতর যে, সব সময়েই মনে হয় বাসাটা যেন মুখ ভার করে রয়েছে। এত করেও কিছু হয় না।

তবুও আজ মা-র কেমন ছায়া-ছায়া অন্ধকার বলে সব মনে হল। মনে হল কে যেন পুরু করে সারা বাসায় মেখে দিয়েছে গা-ছমছম-করা নির্জনতা। অথচ সকলেই তো রয়েছে বাসায়। সন্ধে হয়েছে একটু আগেই । কিন্তু কেমন যেন পুরু অন্ধকার করে এসেছে চারদিক এখনই। বারান্দায় চালভরা কুলো হাতে করে মা ভাবলেন, সালেহা রান্নাঘরে, বুলু-টুনু-বেবি ওই তো বাঁ-ধারের ঘরেই তো রয়েছে, হয়তে পড়ছে। আর খোকন--। তবু মা’র যেন বড্ড একলা মনে হল। মনে হল, অন্ধকার কোনো এক পাথারে তিনি একা । নিঃসঙ্গ । কেউ নেই !

পা দুটে মা-র থরথর করে কেঁপে উঠল। হয়তো দুর্বলতায় । তাড়াতাড়ি তিনি কুলো হাতে করে বসে পড়লেন। তারপর আনমনে যেটুকু আলো এ-ঘর ও-ঘর থেকে বারান্দার অন্ধকার মুছে দিচ্ছিল তাতেই তিনি চাল বাছতে বসলেন।

বারান্দার উত্তরকোণে দাঁড়িয়ে বাঁ-ধারের কামরার দেয়ালঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যায় দরজার ফাঁক দিয়ে । কেমন বড় আর অদ্ভুত এই পুরনো ঘড়িটা। সেকেন্ড থেকে শুরু করে মিনিট থেকে ঘণ্টা অবধি, এমনকি মাসের আজ কত তারিখ, সব তুমি ঘড়ি দেখে বলে দিতে পারবে। একটুও কষ্ট হবে না। সেই কবে যে ওটা কেনা হয়েছিল তা মা নিজেই বলতে পারবেন না । এতদিন ওটা দেশের বাড়িতে বড়ঘরে, পেছনের দেয়ালে,খুঁটিতে ঝোলানো ছিল । খোকন যখন শহরে চাকরি পেল, তিনিই তো তখন ওটা ছেলেকে বলে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে সেই এক জায়গাতেই ঘড়িটা রয়েছে। একটুও নড়চড় হয়নি।

বেশ মনে পড়ে তার, বিয়ের পর পাঁচগাঁ থেকে যখন কদমতলি শ্বশুরবাড়িতে এলেন তিনি স্বামীর হাত ধরে, যখন উৎসবের অত কোলাহল আর নিজের নিদারুণ লজ্জায় বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল, তখনও তিনি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলেন, বড়ঘর থেকে অদ্ভুত গম্ভীর সুরে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। এক দুই তিন করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুনেছিলেন তিনি।

তারপর রাতে শোবার পালা। কারা যেন হাত ধরে তাকে টেনে বড়ঘবে নিয়ে এসে কানে কানে বলেছিল কী যেন ভালো করে মনে নেই। এ-কথা সে-কথায় স্বামী হাত ধরে আরও কাছে এনে মিষ্টি গলায় জিগ্যেস করেছিলেন, ঘড়ি দেখতে জানো তুমি?

এখনও তিনি চোখের সামনে দেখতে পান স্বামীর বাঁ-হাত ঘড়িটার দিকে তুলে ধরা। তর্জনীর দৃঢ় সৌষ্ঠব আজও তিনি ভোলেননি । তারপর হাত ধরে ধরে কেমন তৃপ্তস্বরে স্বামী তাকে শিখিয়েছিলেন ঘড়ি-দেখা।

আর ওই-যে পেতল-রঙ সরু কাঁটা দেখছ, ওটা মাসের আজ কত তারিখ তা বলে দেয়।

আশ্চর্য, হুবহু মনে পড়ে তার। একটা হারিকেনই বুঝি মৃদু আলোতে ঘর ভরে দিয়েছিল সে-রাতে।

সেই থেকে এইতো সেদিন অবধি কতবার যে ঘড়ি দেখে সময় জেনেছেন, তারিখ জেনেছেন, তার তো আর লেখাজোখা নেই ।

নির্জন দুপুরবেলায় গোটা পৃথিবী যখন অলস হয়ে পড়ে, যখন বাসায় কেউ থাকে না, তখন বিধবা মেয়ে সালেহার পাশে বসে এটা-সেটা কথা কইতে কইতে তিনি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ঘড়িটার দিকে তাকান। চোখ ফিরিয়ে আনতে পারেন না।

স্বামীর স্পর্শ যেন এখনও লেগে রয়েছে ঘড়িটার গায়ে। এখনও ঘড়িটা যখন ঢং ঢং করে বেজে ওঠে তখন মাঝে মাঝে কিশোরীবয়সের সেই লজ্জা আর চঞ্চলতা ভিড় করে এসে তাকে বিমূঢ় করে দেয় ।

ঘড়িটার চারধারের ফ্রেম ঘুণে খেয়ে ফেলেছে আর চকচকে কালো বার্নিশ তো কবেই উঠে গেছে, তার খোঁজ কে রাখে।

স্বামী মারা গেছেন আজ প্রায় পাঁচ বছর। এরপর থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে তিনি নিজহাতে দম দিয়েছেন ঘড়িতে। আর খোকনের সাথে শহরে যখন এলেন, তখন তিনি ছাড়া আর কেউ কি ঘড়িটার দিকে এতটুকু নজরও দিয়েছিল! ক’টা বাজে? খোকন ফস করে বাঁ হাত ওঠায় । হাতঘড়িগুলো দুচোখে দেখতে পারেন না তিনি। এতবড় একটা ঘড়ি থাকতে ঘরের মধ্যিখানে খোকনের কাছে সবাই সময় জানতে হুড়মুড় করে পড়ে কেন, মা ভেবে পান না। অবশেষে কী করে যে নিজের ওপরেই দুঃখ হয় তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না।

জানালাটা খুলে দাঁড়ালে এবড়োথেবড়ো খোয়া-ওঠা পথ চোখে পড়ে। কেমন একে-বেঁকে মুদি দোকানের সমুখ দিয়ে, কয়েকটা হালকা একতলা বাড়িতে ডানহাতিতে ফেলে তারপর মোড় নিয়ে কোন সড়কে উঠেছে, কে জানে? জানালার ধারে কতদিন পথ দেখতে দেখতে মা ভেবেছেন— রাজার মতো লোক ছিলেন খোকনের বাবা, দুধের বাটিতে হাত ডুবিয়ে ননী দেখে তবেই না একচুমুকে সবটুকু খেয়ে ফেলতেন। সে কথা তো আজও ভোলেননি; এলোমেলো খাপছাড়া সব স্মৃতি মা-র মনে এসে ভিড় করে।

অসহায়ের মতো তিনি ভাবেন, বাবাকে খোকন ওরা কেউ ভালোবাসে না, একটু ও শ্রদ্ধা করে না । নইলে আজ কয়েক সপ্তাহ ধরে, মা-র জীবনে এই প্রথম, ঘড়িটা বেঠিক চলছে। ভুল সময়ে বেজে ওঠে ঢং ঢং । অথচ খোকনের এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। কতবার বলে বলে হদ্দ হয়ে গেলেন, কই খোকন তো কোনো গরজ দেখায়নি। ওরা কি জানে, ঘড়িটা বেঠিক চললে, অন্ধকারে পথ চলার মতো তারিখের কাঁটা এলোপাতাড়ি চললে, তার মন কেমন করে ওঠে। কেমন এক দম-আটকানো কান্না তার গলার কাছে এসে পাথরের মতো আটকে রয়েছে, ওরা তার কী জানবে? ভারি কান্না পায় মা-র। হয়তো তিনি কাঁদেনও। নইলে হঠাৎ কেন তিনি আঁচল খুলে চোখ মুছতে যাবেন?

এটা হয়তো মা-র বাড়াবাড়ি। স্বামীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন সত্যিকারের । দেবতার মতো তাঁকে করেছেন শ্রদ্ধা। আর দেবদাসীর মতো করেছেন সেবা ! তাই না স্বামীর ব্যক্তিত্বের প্রভাব আজ অবধি তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে নিবিড় ছায়ার মতো।

কেমন যেন তার ভালো লাগে ভাবতে, সারাটা জীবন ভেবেছেনও-- স্বামীকে তিনি ছাড়া আর কেউ আপন করে দেখেনি। তাই কেউ যদি ওঁকে আপনার বলে দাবি করে, শ্রদ্ধা জানায় তাহলে তার চোখ অবিশ্বাসে ভরে ওঠে ! তিনি ভাবেন এটা ওদের কর্তব্য, তাই করে গেল । তাই আজও স্বামীর স্মৃতিকে তিনি একলাই একটু-একটু করে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে চান। কিন্তু লজ্জা এসে দেখা দেয়, দ্বিধা জাগে। ভয় হয়, পাছে কেউ জেনে ফেলে। তাই ভেতরে ভেতরে গুমরে মরেন তিনি। ভালো করে খোকনকে বলতে পারেন না, আদেশের কথা তোলাই থাক, অনুরোধ করতেও কেমন সঙ্কোচ দেখা দেয় । কিন্তু এ তিনি কেমন কেমন করে ভাবেন যে, তার নিজের ছেলেরা অবধি ওঁকে ঠিকমতো শ্রদ্ধা করে না, যতটুকু করে তাও হয়তো লৌকিকতা। এটা হয়তো মা-র বাড়াবাড়ি ।

কেন, আজকেই তো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই খোকন বলেছে, মা, আজ মাইনে পাবার তারিখ । আজকেই ভালো মেকার নিয়ে আসব’খন দেওয়ালঘড়িটা মেরামত করাতে। তারপর একটু থেমে চোখ তুলে বলেছিল, দিন মাত্র ঘড়িটা বেতালা হয়েছে আর দেখ দিকি।

কী মনে করে মা ফস করে বলে বসেছিলেন, ‘কিন্তু অল্প’র জন্য কি এতদিনের পুরনো ঘড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে?' 

সহসা তাঁর দৃষ্টি শঙ্কাতুর হয়ে উঠেছিল গভীরভাবে। কিন্তু কী ভাগ্যি, খোকনের চোখে পড়েনি। খোকন বলেছিল, ধেৎ, তুমিও যেমন, কালকের সকালের ভেতরই দেখবে কেমন নতুন হয়ে গেছে ঘড়িটা। ভাবছি একপোঁচ রঙ করাব আবার ফ্রেমে। আচ্ছা মা, কী রঙ করলে ভালো মানাবে বলো তো?

ঘুণেধরা কাঠে আবার রঙ দিয়ে শুধু শুধু—তার চেয়ে আগে ঠিক হােক তো ঘড়িটা। 

খোকন সহসা মিষ্টি হাসে। ঠিক হয়েছে, মেহগনি রঙ করাব। গাঢ় মেহগনিতে পুরনো জিনিস ভারি মানায় কিন্তু।

আগে ঘড়িটাতো ঠিক কর্, তারপর ওসব দেখা যাবে।

খোকন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে বিছানায় শুয়ে। মা শুধুশুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী করবেন ভেবে পেলেন না।

মা, চা হল? 

একটা ছুতো পেয়ে মা চঞ্চল হয়ে ওঠেন।

সালেহা মুড়ি তেল মাখাচ্ছে। আমি নিয়ে আসছি, তুই উঠে বস্ । খেতে খেতে চা হয়ে যাবে’খন। 

সালেহার দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে খোকন ভাবে, সালেহার বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা বড় আদর করে। অনেক খরচ করে। কিন্তু টেকেনি সে সুখের সংসার। খোকনের চাকরি পাবার কিছুদিন বাদেই নিরাভরণ সালেহা এসে পা দিয়েছিল এই বাসায়। আর তার চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। বাবা বেঁচে থাকলে দুঃখ পেতেন অনেক। হঠাৎ তার মনে পড়ল মাসখানেক আগে ও একখানা চুলপেড়ে ধুতি চেয়েছিল তার কাছে । মিহি জমিন হলে ভালো হয়, কত সময়ে লাগে, এমনি কী কী যেন বলেছিল সালেহা। কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল সে। জিগ্যেস করল, আচ্ছা সালেহা, কাপড় চেয়েছিলি না তুই?

সালেহা কোনো উত্তর করে না।

কাপড় চাইতেও তোর লজ্জা? এক্কেবারে ছেলেমানুষ তুই । যা দরকার চাইবি, চাইবি বৈকি।

খুব বেশি দরকার নেই আমার।

মিছে কথা। আজকেই আনব’খন । দেখিস তুই । 

দাঁড়াও-- বেবির পড়া বলে দিয়ে আসি। 

হুঁ। 

পড়তে জানে না মোটে, তুমি ফোরে ভর্তি করে দিয়েছ, এখন ভুগছে দেখছ তো।

সালেহা কথা বলতে বলতে বাঁদিকের কামরায় ঢােকে। এ-ঘরে বসেও স্পষ্ট বুঝতে পারে সে, সালেহা চুপ করে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। জানালাটা দিয়ে পথ দেখা যায়।

কেমন এক অদ্ভুত মানসিকতায় মা ভাবতে শুরু করেন, কী বা প্রয়োজন ছিল খোকনের আপিস থেকে ফিরবার পথে রিকশা করবার । কেন, অন্যদিনের মতো বাসে করে এলে কি তার শাস্ত্র অশুদ্ধ হত? মা ঠিক জানেন না রিকশার ভাড়া আপিস থেকে কত, কিন্তু এটা তো ঠিক জানেন মিছেমিছে কতগুলো পয়সা খোকন অপব্যয় করল ।

কিন্তু খোকন যখন সন্ধের একটু আগে বাসার দরজায় রিকশা থেকে নামল তখনও তো মা-র মন এই সামান্য অপব্যয়ে বিচলিত হয়ে ওঠেনি।

খোকনের এটা অনেক দিনের অভ্যাস । মাইনে পেয়ে ফিরতি পথে কোনোদিন বাসে কিংবা হেঁটে ফেরেনি । পুরানা পল্টনের মোড় থেকে একটা রিকশা করে ফেরা অন্তত সেদিনের জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেছে।

মাইনে নিয়ে সে আজ একটু সকাল সকালেই আপিস থেকে বেরিয়েছিল। পথে এটা সেটা কিনে যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধে হতে আর বড়বেশি বাকি নেই। মা এসে দরজা খুলে দিলেন। ঘরে চৌকির উপর বসল খোকন। বুলু, টুনু, বেবি আর সালেহা কাছাকাছি ভিড় করে এসে দাঁড়ায়। মা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রইলেন।

সালেহা, এই নে তোর মিহি জমিন কাপড়। দ্যাখ তো কেমন হয়েছে? খোকন কাগজের মোড়ক খুলে কাপড়টা ওর দিকে ছুড়ে দিল। দাম যদিও নিয়েছে পনেরো টাকা আট আনা, কিন্তু জিনিস ভালো। আর মা, এই নাও তোমারও কাপড়। তুমি তো আর কোনোদিনই চাইবে না কিছু। নাও।

মা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কাপড়খানা হাতে তুলে নেন। কিন্তু ক্রমেই তিনি অধৈর্য হয়ে পড়ছেন, আজকেই তো খোকনের কথা ছিল ঘড়িওয়ালাকে নিয়ে আসবার। কই খোকন তো কোনো কথাই বলছে না সে নিয়ে। ভাবলেন তিনি একবার জিগ্যেস করবেন, পরমুহূর্তেই আবার সেই লজ্জা এসে তাঁকে ঘিরে ধরল । বুলু, টুনু, বেবির জন্য খাতা কলম মার্বেল এটা-সেটা আরো কত কী কিনেছে ও। হাতে ধরে তুলে দিচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত অতৃপ্তি মাকে ক্রমে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

বুলু, এই দ্বিতীয়বার তোমায় কলম কিনে দিলাম, এবারও যদি হারাও তাহলে আর রক্ষে নেই । যাও সন্ধে হয়ে গেছে পড়তে বসো গিয়ে।

ওরা সবাই চলে গেল । মা-ও নিঃশব্দে পিছনে বেরিয়ে এলেন।

তারপর মা অস্থির অশান্ত হৃদয়ে বারকয়েক উঠানে পায়চারি করলেন। দু-একটা তারা ফুটে উঠছে আকাশে, তাকিয়ে দেখলেন খানিক। অবশেষে যখন মোড়ের মসজিদ থেকে বুড়ো মোয়াজ্জিনের আজান ভেসে এল তার কানে তখন চমক ভাঙল। কুয়ার পাড় থেকে ওজু করে এসে বারান্দার এককোণে পাটি বিছিয়ে মনকে শান্ত সংযত করে বসলেন মাগরিবের নামাজ আদায় করতে।

খোকন মুগ্ধ হয়ে গেল । মায়ের এমন মূর্তি সে কোনোদিন দেখছে বলে মনে পড়ল না তার! কী সৌম্য সংযত মা-র মুখখানি। আর কী তন্ময়তা তার প্রতিটি মুহূর্তে। খোকন বিস্মিত হয়ে গেল । মাকে খুঁজতে এসে সে দেখল মা নামাজ আদায় করছেন । হাতমুখ ধুয়ে সে পথের দিকের দরজা খুলে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল ।

পেছনে ফিরে থেকেও খোকন স্পষ্ট বুঝতে পারল, মা হাঁটছেন বারান্দায় । ডাকল, মা ।

মা এসে ঘরে ঢুকলেন। খোকন পেছন ফিরে মা-র দিকে তাকিয়ে একটু হেসে উঠে দাঁড়াল। শার্টের পকেট থেকে টাকাগুলো বের করল। তারপর এক দুই করে দশ টাকার নোট দশখানা গুনে মা-র হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই নাও এ-মাসের বাজারের টাকা। ওতেই হবে বোধ হয়, তাই না? ওদের ইস্কুলের বেতন কালকে আমি দিয়ে দেব’খন। আর শোনো, বাড়িওয়ালা এলে সন্ধের পর আমার সাথে দেখা করতে বােলো।

মা টাকাগুলো হাতে নিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়, নিতান্তই অপ্রত্যাশিতভাবে পাশের ঘরে দেয়ালঘড়িটা বােকার মতো ঢং ঢং করে তিনটে বেজে চুপ হয়ে গেল। মা চকিতে পাশের কামরার দিকে তাকালেন । তিনিও আশা করেননি, ঘড়িটা এমন বেমওকা বেজে উঠবে । খোকন যেন ঘড়ির ঘন্টার প্রতিধ্বনি করেই বলল, ওই যাহ্। দেখেছ, একেবারে ভুলে গেছি। আসবার সময়, সেই কোন সকাল থেকে মনে করে রেখেছি, চাঁদ মিয়া মেকারকে ধরে আনব ঘড়িটা নিয়ে যেতে— দ্যাখো তো কাণ্ড! এমন ভুল মানুষের হয় কখনো? 

মা অস্ফুটস্বর উচ্চারণ করলেন, এমন ভুল মানুষের হয় কখনো! কিন্তু শোনা গেল না। কী আশ্চর্য, একটু পরেই ছোট্ট হাসি হেসে নোট কখানা নাড়তে নাড়তে বললেন, সন্ধেবেলায় না-ডেকে ভালোই হল, কাল সকালেই সব বুঝেসুঝে নিতে পারবে। কালকে এলেও হবে ।

সেই ভালো।

খোকন একটু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কিন্তু মিইয়ে পড়েন মা। চুপসে যান তিনি একেবারেই। তিনি আশা করেননি খোকন এত ছোট্ট জবাবে দায়মুক্ত হবে। ভেবেছিলেন সে তার কথায় প্রতিবাদ না হােক অমনি একটা কিছু করবে ! তাই খোকনের ওই উত্তরে তিনি মুষড়ে পড়লেন বৈকি।

মা ভেবে কোনো থৈ পান না, খোকন এত জরুরি কথাটা ভুলে গেল কী করে? কী করে ভুলতে পারে সে? এত আজেবাজে জিনিস কিনতে তো কই তার এতটুকু ভুলে যাবার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বরঞ্চ না-চাইতেই তো ও সবকিছু নিয়ে এসেছে। নাকি খোকন খরচের ভয় করছে? হবেও বা। হয়তো তার মন সেকেলে একটা জবুথবু দেয়ালঘড়ির পেছনে খরচ করতে সায় দেয়নি। কিন্তু রিকশা করে খোকন যে খরচ করল সেটার সার্থকতাই বা কোথায়? মাসের তিরিশ দিন বাসে এসে একদিন রিকশা করলে কীইবা এমন লাভ? পরমুহূর্তেই ভাবেন, ক্ষতিটাই বা কী? এতগুলো টাকা ও রোজগার করে সংসারে ঢালছে, দুটো পয়সা নিজের জন্য ব্যয় করলে কীইবা এমন দোষের হয়? আনমনে চৌকির পাশে খোকনের ছোট্ট টেবিলটায় মা হাত বুলোতে থাকেন। এসময় কিসে যেন হাত ঠেকতেই তিনি চমকে ওঠেন। মসৃণ আর ঠাণ্ডা । চোখ ফেরান । কিছু নয়, দেখে তার বুঝতে একটুও কষ্ট হল না, এক প্যাকেট তাস। আনকোরা নতুন, কড়কড়ে । মা অজ্ঞাতসারে প্যাকেটটা হাতে তুলতেই খোকন তড়বড় করে বলে উঠল— কিছু না মা, রেখে দাও তুমি । আসবার পথে কী খেয়াল হল কিনে ফেললাম।

মা তাসের প্যাকেটটা নামিয়ে রাখেন টেবিলে, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে আনতে পারেন না। কেমন নীল রঙ আর অদ্ভুত ছন্দ প্যাকেটটার গায়ের নকশায়। ছোট্ট, এতটুকু, কিন্তু চোখ ফেরানো যায় না ওইটুকুর জৌলুসেই। মা যেন সম্মোহিত হয়ে পড়লেন। কয়েকবার নাড়াচাড়া করে তিনি একসময় হাতে টেনে আনেন।

খোকন বলছে, মা শুনছ?

কী?

আজ রাতে ওরা আসবে বলেছিল—

মা কি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন? না, মা-র মনে এই মুহূর্তের চিন্তাধারা সহসা প্রকাশ হয়ে পড়ল? একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তিনি।

কারা? 

খোকন একটু অপরাধজড়িত সুরেই বলে, না, ওসমানরা, মানে আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে বলেছিল। আসে না কিনা অনেকদিন--

'ও।

তাই কষ্ট করে একটু চায়ের জোগাড় হয়তো করতে হতে পারে। মানে—

খোকনের কথা শেষ না হতেই মা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন, আচ্ছা ।

কূলো হাতে করে সেই কখন মা চাল বাছতে বসেছেন এখনও শেষ হয়নি । এলোপাতাড়ি ভাবতে ভাবতে তার হাত যে কখন থেমে গেছে, নিজেই টের পাননি। সালেহা রান্নাঘর থেকে বলে, কই মা, চাল বাছা এখনও হয়নি তোমার? এদিকে তো চুলা খালি যাচ্ছে ।

তাইতো! মা যথাসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে বাছা শেষ করেন।

সালেহা খকখক করে কেশে উঠল । কাশবে না? রান্নাঘরে একটা জানালা ফোটানোর জন্য কতবার মা বলেছেন খোকনকে, অভিমান হল মা-র, ধোঁয়া আটকে দম বন্ধ হয়ে মরুকগে, তার কী? তার কী এসে যাবে? চালের হাঁড়িটা চুলোর উপর ভালো করে বসিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। এত ঘেমেছেন কখনও তিনি? 

বাইরে বসবার ঘরে পদশব্দ। খোকনের বন্ধুরা এসেছে, বুঝতে পারলেন । সালেহা মলিনমুখে প্রশ্নোৎসুক দৃষ্টিতে মা-র দিকে তাকাল। মা জানেন কারা এল, কিন্তু কোনো উত্তর করলেন না। 

মা জানেন খোকন মিছেকথা বলেছে ! ওরা এসেছে তাস খেলতে। নিশ্চয়ই আপিস-ফিরতি পথে খোকন ওদের বলে এসেছে, নইলে নতুন তাস কেন ওর টেবিলে? আর ঘড়িটার কথা বেমালুম ভুলে গেল খোকন? কী করবেন তিনি, কী করতে পারেন? আক্রোশে অভিমানে মা-র মন ভরে উঠল। গলা ধরে এল ।

কেমন করে অন্ধকার ঠেকছে চারদিকে । আলো নেই, বাতাস নেই, শুধু বদ্ধ আবহাওয়া । বিমর্ষতার ভারে যেন নুয়ে পড়েছে বাসাটা। আর মা-র বুকখানা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল। কিন্তু কাউকেও বুঝতে দিতে চান না তিনি, তাই সালেহাকে প্রায় এককোণে, নিজেই রান্নায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এখনও মাছ চড়োন, তার ওপর ভাজা-চচ্চড়ি তো পড়েই রয়েছে। বাইরের ঘর থেকে শোনা গেল খোকন বলছে, বুলু, দ্যাখগে ঘরে টেবিলের উপর চকোলেটের বাক্সের নিচে প্যাড রয়েছে, নিয়ে আয় তো।

রান্নাঘর থেকে মা দেখতে পেলেন বুলু খেলার প্যাড দিয়ে এল ও ঘরে। ফিরতি পথে এসে মাকে বলল, মা, চা চাইছে বড়ভাই।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, কয় কাপ?

কেন, চার কাপ।

বুলুই আবার চা নিয়ে এল । মা কানখাড়া করে শুনতে চেষ্টা করেন বাইরের ঘরের প্রতিটি কথা, প্রতিটি ধ্বনিতরঙ্গ!

বিস্ময়, আনন্দ, উল্লাস, বিমর্ষতা, স্তব্ধতা, সব কিছু একের-পর-এক রেখা কেটে চলেছে এই চারটি লোকের মনে।

স্তব্ধতা! আবার আবারও। মাঝে মাঝে খোকনের গলা শোনা যাচ্ছে। আরও কারা যেন! কিন্তু কোনো কথাই তাদের বুঝতে পারছেন না তিনি। একবর্ণও না। মনে হল, এ ভাষার সাথে বুঝি পরিচিত তিনি নন। অদ্ভুত এক বাক্যবিন্যাস ভঙ্গি আর বিচিত্র এর ধ্বনিতরঙ্গ । কেউ বুঝতে পারে না সে ভাষা।

খোকন একসময়ে ও-ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রান্নাঘরে চাপা অথচ উত্তেজিত সুরে বলে, ধেত্তর ছ্যাঁকছ্যাঁকানি? বলি ভাজাপোড়ায় এত গন্ধ ওঠে কেন? বাইরে লোক বসে তোমাদের খেয়াল হয় না ! যত সব । গজ গজ করতে করতে খোকন আবার চলে যায়। মা-র যে কী হয়েছে আজ, খালি কান্না পাচ্ছে!

কিন্তু খোকন তাস কিনতে গেল কেন? খেলতে? ও ছাই খেলে কী লাভটাই বা হয়? আর যদি খেলতেই হয় তবে পুরনো তাসে দোষ করল কী? তাস পুরনো হয়ে গেছে বলেই কি ফেলে দিতে হয়? হঠাৎ আবার ঘর থেকে দেয়ালঘড়িটা ঢং করে বিগত তিরিশ মিনিটের সংকেতধ্বনি করে চুপ হয়ে গেল। আর মা-র মন এবার একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ভয়াবহভাবে গোটা গলিপথটা ঘুমিয়ে পড়েছে । রাত এখন অনেক । নিবিড় অরণ্যের মতো একটানা রাত। ছেদ নেই, যতি নেই এ তমিস্রা প্রপাতের । শুধু রাত । চুলে চুলে ঘষলে কেমন এক মিহি আওয়াজ বেরোয়, সূক্ষ্ম অথচ গভীর, তেমনি ছন্দময় যেন এ ছায়া রাত।

অস্বচ্ছ আকাশে গুটিকয় তারা। মা খোলা-জানালা দিয়ে দেখলেন তাকিয়ে ।

হারিকেনটা জ্বলছে ছোট হয়ে আলনার পাশে। ছোট আর বিষন্ন। খোকন ও-ঘরে বুলুকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। এ ঘরে মা-র পাশে টুনু । আর ও-পাশের চৌকিতে সালেহা বেবিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে কাতর। ঘুম আর ঘুম। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ঘুম নেই মায়ের চোখে।

গোটা পৃথিবী যখন ঘুমে অচেতন, যখন রাত কুটিল সরীসৃপের মতো শুধু বাড়ছে, তখন মা-র মনে সারাদিনের সেই অদ্ভুত, পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলো এসে ভিড় করে দাঁড়াল। একে একে মনে পড়ল খোকনের কথা, নতুন তাসের প্যাকেট আর দেয়ালঘড়িটার কথা । ঘড়িটা এখনও চলছে। টিক টিক টিক। তন্ময় হয়ে শুনলেন প্রতিটি সেকেন্ডের গম্ভীর শব্দ।

সময় হয়ে যাচ্ছে—যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। চোখ বুজে মা স্পষ্ট দেখতে পেলেন স্বামী শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন! চোখ খুলে তাকে হারাতে চান না। তাই তিনি চোখ বুজেই রইলেন নিঃসাড় হয়ে । একসময়ে স্বামীর মুখখানা অস্পষ্ট হয়ে এল। তারপর তিনি তাঁর সেই দগ্ধ আবেগ সামলাতে না-পেরে দু-হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরলেন শক্ত মুঠিতে।

তারপর এলোমেলো কত কথা স্মৃতি তার মনের পটে নতুন করে ভেসে উঠল ছায়াময় অশরীরী রহস্যময় হয়ে ! একসময়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালেন । অনেকক্ষণ কেটে গেল। 

তারপর কী ভেবে পা টিপে টিপে খোকনের ঘরে গিয়ে পা দিলেন । দুটো কামরার মাঝের দরজা সবসময়েই খোলা থাকে, তবু কত সতর্কতা প্রতিটি পদক্ষেপে। কী করবেন তিনি ও-ঘরে গিয়ে? কী করতে চান? হারিকেনের আবছা আলোয় ঘর ভরে রয়েছে। মা গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন।

ভয়, দ্বিধা আর সংকোচ । তবুও দুহাতে তাসের প্যাকেটটা তুলে নিলেন। তেমনি মসৃণ আর ঠাণ্ডা । ইচ্ছে হল তাসগুলো কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলেন। চিহ্নমাত্র রাখতে চান না তিনি। সন্ধে থেকে যে-আক্রাশগুলো মনের অন্ধকার কোঠায় গুমরে মরছিল তারা যেন ছাড়া পেয়ে দলবেঁধে তাসের প্যাকেটটার ওপর নামল। আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন ওটা। তিনি ছিঁড়ে ফেলবেনই । আর দ্বিধা নয় । আর সংকোচ নয় ।

সহসা ঘুমন্ত খোকন পাশ ফিরে মায়ের দিকে মুখ করল। আর মা ভীত হয়ে তাড়াতাড়ি প্যাকেট নামিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। আবার ভয় এসে তাঁকে ভর করল ।

ছোটবেলা থেকে খোকনের মুখ দিয়ে লালা পড়ত, এখনও পড়ে মাঝে মাঝে ঘুমের ঘােরে। মা তাকিয়ে দেখলেন, লালায় ভরে গিয়েছে বালিশের কোনাটা আর খোকনের ডান গাল। তিনি চোরের মতো এগিয়ে এসে আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিলেন লালাটুকু। খোকনের মুখখানা কী সুন্দর আর কেমন মিঠে। মা দেখেন আর দেখেন। ছোটবেলার সেই কচি আদলটুকু এখনও ওর মুখ থেকে উঠে যায়নি। তেমনি মাংসল গাল দুটো আর প্রশস্ত কপাল ! দু-একগোছা চুল এসে কপালে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি আলতো করে সরিয়ে দিলেন। কপালে হাত বুলাতে মা-র ভারি ভালো লাগল। কতদিন মা খোকনকে ছোটবেলার মতো এত আপন করে পাননি। তিনি ধীরে ধীরে হাত বুলোতে লাগলেন খোকনের কপালে, মুখে আর সারা গায়ে।

আবার সেই চিন্তাগুলো তার মনে এসে আছড়ে পড়ল উন্মাদের মতো। তিনি বড় বিব্রত হয়ে পড়লেন।

খোকনের ঘুম গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে দুচোখে । কেমন তৃপ্তি গাঢ় ঘুম। আবছা আলোতেও তাসের নকশাগুলো চকচক করছিল। তিনি চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন ।

সহসা তাঁর সারা অন্তর মথিত করে একটা কথা ঠোট থেকে গড়িয়ে পড়ল— না, না, তিনি পারেন না, অসম্ভব। দুহাতে মুখ ঢেকে চোখ বুজে একদৌড়ে তিনি নিজের শোবার ঘরে এসে ঢুকলেন।

সালেহা তেমনি ঘুমুচ্ছে ।

ঘুমুচ্ছে বেবি আর টুনু। প্রতিটি মাংসপিণ্ড তারই দেহের রক্ত দিয়ে তৈরি ! তিনি একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখলেন। তারপর জীবনে এই প্রথম, সর্বপ্রথম, তিনি বিছানার উপর ঝড়ের মুখে ছিঁড়ে যাওয়া লতার মতো অসহায় হয়ে উবু হয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে ফুলে কেঁদে উঠলেন।

মা কাঁদছেন।


⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧⤧

লেখক পরিচিতি: 

সৈয়দ শামসুল হক
(২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)    

সৈয়দ শামসুল হক বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি সিদ্ধহস্ত হওয়ায় তাঁকে সব্যসাচী লেখক বলা হয়।তাঁর সাহিত্যিক জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরা। লেখালেখিকে প্রথম জীবন থেকেই তিনি তাঁর কাজ বা পেশা মনে করতেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘উদয়াস্ত’(১৯৫১) এবং প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৬)। কবিতা, কাব্যনাট্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিনশত।বাংলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও গান রচনায়ও তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক ও পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। তাঁর জন্মস্থান বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম এবং মৃত্যুর পরে শেষ ইচ্ছায় সমাহিতও হয়েছেন কুড়িগ্রামে।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ:- গল্প: তাস (১৯৫৪), শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২)। উপন্যাস: নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), খেলারাম খেলে যা ( ১৯৯১)। কাব্যনাট্য: পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), নুরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২)। কবিতা: বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০)।  প্রবন্ধ: মার্জিনে মন্তব্য (২০০৫)। আত্মজৈবনিক: তিন পয়সার জ্যোছনা (২০১৪)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ