bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

মাটির লিথোগ্রাফ ꘡ আবু হেনা মোস্তফা এনাম


আবু হেনা মোস্তফা এনাম গদ্যশিল্পী হিসেবেই পরিচিত। গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা সাহিত্যে সরব থেকে তিনি কবিতায়ও মগ্ন-শিল্পী। দুর্দান্ত শুরু হয়েছে সনেট বা চতুর্দশপদী দিয়ে। শিল্প-সাহিত্যের অনলাইন - প্রতিকথা  তে সম্প্রতি প্রথম ‘দ্রুতগামী নভোনীল’ শিরোনামে চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১ থেকে ১০) প্রকাশিত হয়েছে। তারপরের অংশ থেকে গতিপথে শুরু...  

মাটির লিথোগ্রাফ


১১

লুব্ধক দিন চলে যায়, সন্ধ্যাবিভ্রমে অভাবিত
সোনালি কেয়ূর জ্বালো। লণ্ঠনের ইন্দ্রজাল বুঝি
ভেঙে পড়ে রাতের সন্ধিক্ষণে, বহুবিকীর্ণ খড়ের
মিনার তোমার অনিদ্রিত চোখের তারায় নাচে;
তারা নিভে গেলে নির্লিপ্ত ঘুঘুদানা ক্রীতদাসের
মতো প্রহেলিকাময় সুপ্ত লিথোগ্রাফ রেখে যায়।
যেন এইসব অচিহ্নিত সুর ও অক্ষরসৌধ
মুছে যাওয়া অশ্রুশোকে ঝরে মায়ার তিরস্কারে;

রাতের রসিকতায় হেসে ওঠে যারা কূটাভাসে━
হিরণ্ময় শীতযামিনী থেকে আরেকবার, গাঢ়
নিদ্রার আয়োজন আনমনে জাগে মাধুরীখণ্ডে,
বেদনায়। এমন বিবসিত পরিখা খুঁড়ে ত্রস্ত
কারাগারে তোমাকে দেখি, পাতার কর্পূরে ঘুমন্ত
শব্দের মতন প্যাপিরাসজুড়ে তুমি, উজ্জয়িনী!


১২

মৌরীফুলের গন্ধের ভেতর পড়ে আছি, একাকী
উরুপ্রদেশে নিদ্রানাট্যের ভেতর, যেন প্রথম
জন্মধ্বনির বিসম্বাদী গিটার। ছেঁড়া বর্ণমালা
ভিজিতেছে নক্ষত্রের স্বাদে। বারবার স্পর্শ খুঁজে
ফিরি, স্মৃতির ময়ূর সোনালি গ্রীবার ফণা তুলে
বলে━ পাখিমৃত্যুর পর কীভাবে গোলাপসংগীত
হারালো, কীভাবে বিকেলের ধ্বনিগুলো জিহ্বার
ছায়ায় আত্মহননের আলোয় জ্বলে, নেচে ওঠে।

মৌরীফুলও উটপাখির মতো অলৌকিক ডানা
থেকে পালক খুলে পুড়িয়ে দিচ্ছে শরীরসৌষ্ঠব।
অন্ধ ডুমুর গাছের পুষ্প হারানোর শোক মুছে
অশ্রুগন্ধে লেখা বাগানের পরিচয়লিপি ভুলে
যায়। আগাছাবিলাসে এইসব স্মৃতি ছুঁয়ে ঝরে
গোধূলিবিতান, তুমিও কি ঝরে যাবে, শব্দহীন?


১৩

নদীরা যেমন অন্ধ ও উৎফুল্ল--চন্দ্রমল্লিকা
বাঈজীদের প্রণয়ের দিকে জেগে ওঠা নাচের
নক্ষত্রকঙ্কন━ যেমন স্থির বৃক্ষ, স্ত্রৈণ পুরুষ━
বিবাহিত আর করুণ মানুষের ঘরবাড়িও।
পাখিরা তবু ঘোরে গাছে গাছে━ বিস্তারকামী তারা,
আকাশেও লেগে থাকে তার পালকের ছায়ামেঘ;
বৃক্ষের আছে অপরূপ ইন্দ্রজাল━ পাতা, ফুলের
অলিখিত আহ্বান। কেবল মানুষের সংসার

যেন নিরবচ্ছিন্ন সমাধি━ অন্ধ বধিরতাকূলে।
তোমার ঈশ্বর চন্দ্রমল্লিকার আত্মবিসর্জনে
কাঁপে। তুমি সমুদ্রে, লবণজলে ডুবে, নক্ষত্রের
মতো মাছের হৃদয়ে তুলে আনো বিষণ্ন হাড়ের
সুরভিদানা, সংসারের ফসিল, স্থাণু ভাষার
গ্লানি; যেন তোমার কুটির অভিনব নাট্যালয়।


১৪

মুখোশের আড়ালে সাজানো মানুষের সংসার,
রাক্ষসের ভাঁড়ারে ঘাস খায়। ঈশ্বরের অসীম
করুণা ভেবে━ অবিনশ্বরতার আয়োজনে অন্ধ,
স্বপ্নডানা মেলে উড়ে আসে ধবল হাঁসের গান,
আলোর বিদগ্ধে ভেসে যায় অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা
বানর। মুখোশের কৌশলে, জলসাঘর সাজায়।
তুমি প্রহেলিকা নও, রূপাতীত; অপরূপ দুর্গ
তোমার। লাবণ্যগন্ধে ডুবে থাকো, প্রহেলিকাতমা;

মুখোশের জ্যোৎস্নায় ঢাকা ঈশ্বরেরা গেছে ঘাস
শিকারে, রূপাজলে লুকানো ভ্রমর━ তুমি অরূপে
নিদ্রিত রৌদ্রের বারান্দায়। অদৃশ্য বানরনাচে
মর্মরিত প্রতিধ্বনির ভেতর তোমার পদ্মরথে
আমাকে ডাকো, ভাঁড়ারে অনাবৃত গ্রাম থেকে দূরে;
আমারও নেশা চৈতন্য সমাধির তৃষ্ণায় জাগে।


১৫

মৃত্যুও কি ময়ূর, অলঙ্ঘ্য ধনুকের অভিপ্রায়ে
গ্লানিহীন! জলের সুরভিমাখা কচ্ছপের খোলে
অবলীলারূপ! ময়ূরেরা ফিরে আসে দ্রবিভূত
জ্যোৎস্নায়, ঘাসে। মাটির রাজপ্রাসাদ নৈঃশব্দ্যে
ডুবে যায়, জেগে জেগে চিরায়ত খেলার সজ্জায়,
মঞ্চ উৎসবে ভাসে মুখরতাতমা; নাভিরন্দ্রে
তোমার সোনালি হৃদয়, মৃত্যু থেকে তোমাকে, বেঁধে
রাখে হাড়ে; এই মৃত্যুপাথারে জীবিতরাই মৃত!

ধনুকের ডাঙায় নিমগ্ন নদী মৃত্যুর পর কি
ভুলে যায় মানুষের প্রেম? প্রণয়ের অহম ও
পাখির ডানার ভেতর, বিসম্বাদী মেঘের মতো
উড়ে যায় নিরুদ্দেশ নদী? তোমার দেহরঞ্জিত
অলংকার ফেলে দাও ময়ূরাক্ষীর রূপাজলে।
মাটির মাছেরা হয়তো, উগরে দেবে লুব্ধ মৃত্যু!


১৬

তোমার শরীর রূপক, প্রণয় ও প্রত্যাখ্যানের
ভয়ে; ভাষায়, বাক্যে, কমায়, রূপালয়ে পৃথিবীর
দৃশ্যে, দর্শনে, নীতি ও শীতের সকল রাজ্যপাট
ফেলে চলে গেছে অলৌকিক আপেলের গর্ভকোষে।
স্মৃতিচিহ্নলুপ্ত উপহাস, ললিত স্বপ্নের ফাঁদ
খুলে উড়ে যাওয়া পাখিদের পায়ে এখনও কি
লেগে আছে অনুতাপময় চিঠিলিপি, অক্ষরের
সমাধি? এইসব অহেতু উপাখ্যান জেগে থাকে,

চন্দ্রদগ্ধ ফণায় কবন্ধ শরীর ছুঁয়ে আনন্দ
বর্ধন-স্তূতিময়। নীলাভ গোধূলির দিকে খুলে
ফেলো তোমার বাজুবন্ধ, কেয়ূর, সোনালি চুলের
ঊর্মিমুখর কাঁটা। আঁচলে শিশুর হেমন্ত গন্ধে
ভুলে যাও গতজন্মের যতিচিহ্ন ও নির্বিকার
নিশ্চুপতা। বিন্দুর পরিহাস তোমাকে ঘিরে নাচে।

১৭

যত অনুশোচনা, মশলার ঘ্রাণ লুব্ধক রাতে
গোপনে বয়ে চলে। শিশিরের নিশ্ছিদ্র অভিপ্রায়
নিয়ে তুমি পড়ে আছ ধূলি ও নীহারিকার রিক্ত
ডানায়; ধরো, এসব মসৃণ হিরার শরীরের
প্রতিচ্ছায়া, রূপ ভুলে যাওয়া দ্রাক্ষাবনে ঝরছে
অবিরাম। তুমি অশ্রু সাজিয়ে রেখেছ, কোনো এক
গোলাপের এপিটাফে। অথচ তোমার নাভিমূলে
বিস্তীর্ণ দূর্বাদল, মাংসের স্নিগ্ধ স্নানভঙ্গিমা

অবিরত তৃষ্ণাযামিনী, যেন অদ্ভুত কূটাভাস;
সুপ্ত গর্ভকোষে রসমঞ্জরিত নীলপদ্ম পাতায়,
তবু কী করে যেন, অনুশোচনার মৃত্যুকাঁটা
ফুটে থাকে সম্পর্কের সঘন গোপন অনুরোধে,
দূরের আর্তনাদে জড়িয়ে যায় রেশমপোকার
মৈথুন গন্ধে━ যেন সম্পর্ক মানে প্রধূমিত দূরত্ব!


১৮

আমি ক্রীতদাস, তোমার রূপধূর্ত বর্শাফলক
হাতে, চন্দ্রমল্লিকার চুম্বনে জাগি। অদ্ভুত ভাঁড়,
বিদগ্ধ নূপুরের পরিখা খুঁড়ে ঋতুর মহিমায়
নক্ষত্রদেহের সুষমা বয়ে চলে কলঙ্কবিষাদে।
জ্যোৎস্নায়, রাতের তৃষ্ণা যেমন, জোনাকিরা জ্বলে
ওঠে বিস্মরণের ঘাসে ঘাসে; সুপ্ত মৃত্যুজঠরে,
লুপ্ত করোটির মোহগ্রস্ত পতঙ্গেরা গোধূলির
দৈব ইশারায় চলে যায় ব্যাধের বিস্মৃতিচিহ্নে,

ক্রীতদাসী তুমিও কি? আমৃত্যু, প্রণয়ের বিক্ষত
কার্নিশে মিশে ছিলে শরীর ফুঁড়ে হিরার গৌরবে।
নিভৃত নভোচারী নাচের নহবত ফেলে তুমি
চলে গেছ। দ্বিধাহীন, ভাষাহীন কারুবাসনার
নিরুপম ঘুঙুর বাজে, সকরুণ, বিষাদশ্যামে।
কেবল দৃশ্য, দৃশ্যান্তরে কান্নার গাঢ় ভাষা নেই!


১৯

তোমার দেহ টুকরো কাচের মহিমা, বিদীর্ণিত
দর্পণ পড়ে আছে, যেন কবোষ্ণ চোখের ধ্রুপদী
ভাষা, দাড়ি-কমা-কোলনের সুদীপ্ত মেঘকঙ্কন।
রুপালি রেখায় উঁকি দিয়ে যায় সহস্র ভ্রুভঙ্গি,
অচিহ্নিত নিশ্বাস, অথচ গোলাপ জানে দেহের
অনাঘ্রাত চিহ্নগুলি, মাংসের ভেতর ফুটন্ত
শঙ্খধ্বনি, স্পর্শের ব্যাকুল সরিষাবন। লুব্ধ
উরুডাঙায় তোমার মুখ নিবিড় যতিচিহ্নের

দর্পণে বিদীর্ণ ছায়া হয়ে মিশে আছে, ছায়া নও
তুমি, অদৃশ্য শিকারিরা পারদের রুপালি রহস্য
থেকে খুলে ফেলে তোমার শরীর। রক্তাক্ত আঙুলে
জড়িয়ে যাওয়া নীহারিকার বুদবুদ তবে কি
লুব্ধ তারার গোপন সন্ত্রাস? আয়নাকাহিনির
পদ্মগন্ধ্যা কুয়াশায় লাল, তোমার ধ্বস্ত করপুট?


২০

পুরোনো শ্লোকের মতো ঈশ্বর ঘুমায়, পদপ্রান্তে
লুটিয়ে পড়ি আমি, তুমি দ্রবীভূত? করুণাহীন,
শূন্য বনস্পতির নিরালম্ব ছায়া? রৌদ্রের সকল
লাবণ্য ঝরে পড়ে, দাহ ও দমিতের অগ্রন্থিত
ধাতুফলকে। মানুষের শ্লোকে জন্ম কাঁঠালপাতা
চিবুলেও তোমার নিদ্রা অটুট। নীল ময়ূরের
ধ্বনিময় বিকেল, যেখানে নক্ষত্রেরা প্রতারিত।
নিস্ফল রাতে নিদারুণ রসিকতায় মিতবাক

গাছেদের শরীরে, ঈশ্বর হারানোর বিজ্ঞাপন...
না কি অনন্ত রাত্রির গোপন অভিলাষ তোমার,
আরক্তিম বাসনার বেদীমূলে খেলা করে! তবু,
অধিরূঢ় শ্লোকের করুণ তাড়নাটুকু আসলে
প্রাকৃতিক। তন্দ্রার অনুভবে রূপজীবী ধূপাধার
তৃষ্ণার অমীমাংসিত ক্ষুধার শঙ্খভাঁজে জ্বলো?


╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬╬

লেখক পরিচিতি:
আবু হেনা মোস্তফা এনাম
আবু হেনা মোস্তফা এনাম। জন্ম ডিসেম্বর ১৯৭২।
গল্পগ্রন্থ :  ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী (২০০৫), নির্জন প্রতিধ্বনিগণ (২০১০), প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প (২০১১), জোনাকিবাবুই (২০১৯)।
উপন্যাস : ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো (২০১৪)।
সম্পাদিত গ্রন্থ : অগ্রন্থিত গল্প মাহমুদুল হক (২০১০), আলোছায়ার যুগলবন্দি, মাহমুদুল হক স্মরণে (২০১০)।
জীবনীগ্রন্থ : কথাশিল্পী মাহমুদুল হক (২০১৬)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. কবিতাগুলো, যেন ঐন্দ্রজালিক আচ্ছন্নতার কুহক।

    উত্তরমুছুন
  2. চন্দ্রের মতো মায়াবী ও মল্লিকার মতো সুরভিত

    উত্তরমুছুন