bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

সাদত হাসান মান্টো’র গল্প: লাইসেন্স

সাদত হাসান মান্টো


অনুবাদ: জাফর আলম 

আব্বু কোচোয়ান ছিল সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান। তার টাঙ্গার ঘোড়াও ছিল এক নম্বরের। আজেবাজে সওয়ারি সে টাঙ্গায় তুলত না। খদ্দের ছিল বাঁধাধরা । খদ্দেরের কাছ থেকে দৈনিক দশ-পনেরো টাকা পেলেই আব্বুর জন্য যথেষ্ট । অন্য কোচোয়ানদের মতো সে নেশা-ভাং করত না। সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করত।

ঘুঙুরের আওয়াজ তুলে আব্বুর টাঙ্গা যখন রাজপথ দিয়ে চলত, তখন সবার চোখ পড়ত তার টাঙ্গার ওপর। পথচারীরা মনে মনে বলত, ওই যে ফুলবাবু আব্বু যাচ্ছে। কেমন ডাঁট নিয়ে বসেছে, পাগড়িটা বেঁধেছে কেমন বাঁকা করে ।

পথচারীদের চোখের ভাষা সে বুঝত আর তখন তার ঘাড়-গর্দান আভিজাত্যে দুলে উঠত, ঘোড়ার তাল হয়ে উঠত আকর্ষণীয়। আব্বুর হাতে এমন কায়দায় ঘোড়ার লাগাম ধরা থাকত যে মালিকের হুকুমের প্রয়োজন হতো না । কখনো কখনো এমন মনে হয়, আব্বু আর তার চুন্নি ঘোড়াটা যেন একই । পুরো টাঙ্গাটাই যেন এক জীবন । আর এ জীবন আব্বু ছাড়া আর কার হবে!

যেসব সওয়ারি নিতে আব্বু অস্বীকার করত, তারা মনে মনে গাল দিত । কেউ কেউ অভিশাপ দিত, ‘ভগবান, এর অহংকার যেন নষ্ট হয় । ঘোড়াটা যেন নদীতে ডুবে মরে।'

আব্বুর ঠোঁটের ওপর যে গোঁফের রেখা ছিল, সেখানে ফিকে আত্মবিশ্বাসের এক মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সব সময়। তাতে অনেক কোচোয়ান জ্বলে-পুড়ে মরত। দেখাদেখি কয়েকজন কোচোয়ান ধারদেনা করে নতুন টাঙ্গা তৈরি করে । টাঙ্গাকে পিতলের সাজ দিয়ে সাজায়। তবু তাদের টাঙ্গা আব্বুর কাছে দাঁড়াতে পারেনি । তাদের টাঙ্গার চেয়ে আব্বুর টাঙ্গার ঘোড়াকে লোকে পছন্দ করত বেশি । 

একদিন দুপুরে একটি গাছের ছায়ায় তার ঘোড়াটা বেঁধে টাঙ্গার ওপর বসে আব্বু ঝিমুচ্ছিল, এমন সময় একটা শব্দ তার কানের কাছে গুনগুন করে উঠল। চোখ মেলে তাকাল সে। দেখল, এক মেয়ে তার টাঙ্গার পাশে দাঁড়িয়ে।

একঝলক তাকে দেখে নিল আব্বু। মেয়েটার উদ্ভিন্ন যৌবন তার হৃদয় উতলা করে তুলল । সে ছিল ষোলো-সতেরো বছরের তরুণী। ছিপছিপে গড়ন। কানে রুপোর ছোট্ট দুল । সোজা সিঁথি। তীক্ষ্ণ নাক । তার নাকের ডগায় কালো তিল। পরনে কামিজ আর নীল রঙের গারারা। মাথায় ওড়না ।

আব্বুকে মেয়েটি জিগ্যেস করল, 'এই, স্টেশনে যেতে কত নেবে?' 

মুচকি হাসি নিমেষে দুষ্টুমি হাসিতে পাল্টে গেল । আব্বু বলল, 'কিছু লাগবে না।’

শ্যামবর্ণ মুখের ওপর লালিমা ছেয়ে গেল, ‘কত নেবে স্টেশনে যেতে?'

আব্বু একনজরে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, 'তোমার কাছ থেকে আমি

আর কী নেব? এসো, বসো টাঙ্গায়?'

ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটি হাত দুটো বুকের ওপর রেখে যতটুকু সম্ভব ঢাকার চেষ্টা করল । সে বলল, ‘তুমি কী ধরনের কথা বলছ?'

আব্বু হেসে বলল, ‘আসো, উঠে বসো। তুমি যা দেবে, তা-ই নেব।' 

মেয়েটি একটু ভেবে টাঙ্গায় উঠে বসে বলল, ‘জলদি স্টেশনে নিয়ে চলো।' 

পেছন ফিরে তাকিয়ে আব্বু বলল, 'তোমার খুব তাড়া আছে, তাই না?' 

‘হ্যাঁ, তুমি...' মেয়েটি আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল ।

টাঙ্গা ছুটতে লাগল । কয়েকটি রাস্তা ছুটে পার হয়ে গেল। লজ্জায় জড়সড় হয়ে বসে আছে মেয়েটি। আব্বুর ঠোঁটে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে ভয়ার্ত কণ্ঠে মেয়েটি তাকে জিগ্যেস করল, ‘স্টেশনে এখনো আসিনি?'

‘মানে?' আব্বু পেছন ফিরে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, 'তুমি কি বোঝো না তোমার আর আমার স্টেশন একই? আব্বু প্রথম দেখায় তোমার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। তোমার জানের কসম, আব্বু দাসানুদাস মিথ্যা কথা বলে না ৷'

মেয়েটি ওড়না টেনে দিল । মুখ-চোখই ওকে বলে দিচ্ছিল আব্বু কী বলতে চায় । আর তার চোখ-মুখ দেখে মনে হয়, আব্বুর কথায় সে মোটেই ক্ষুণ্ণ হয়নি। 

কিন্তু মাথায় ওড়না টেনে দিয়েও দ্বিধা ছিল, দুজনের স্টেশন এক হোক আর দুই, আব্বু সুন্দর ।

‘কী ভাবছ,’ আব্বুর প্রশ্নে সে চমকে ওঠে।

ঘোড়া বেশ দুলকি চালে চলছিল। ভিজে ভিজে হাওয়ার আমেজ। রাস্তার দুধারের গাছপালা ছুটে ছুটে চলে যাচ্ছিল। ডালগুলো তার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। ঘুঙুরের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না। ঘাড় ফিরিয়ে শ্যামবর্ণ সৌন্দর্য নিজের হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছিল আব্বু। কিছুক্ষণ পর সে জানালার একটি শিকের সঙ্গে ঘোড়ার লাগাম বেঁধে দিয়ে এক লাফে পেছনের সিটে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসল। মেয়েটি চুপচাপ বসে ছিল। তার হাত দুটি ধরে আব্বু বলল, ‘তোমার লাগাম আমার হাতে যে।' মেয়েটি শুধু বলল, 'ছেড়ে দে।' কিন্তু এর পরই সে আব্বুর বাহুপাশে আবদ্ধ হলো। সে কোনো আপত্তি করল না। হয়তো তার হৃদয়েও তোলপাড় চলছিল। আব্বু ধীরকণ্ঠে মিষ্টি সুরে বলল, ‘এই টাঙ্গা ঘোড়া বেচে দিয়ে তোমার জন্য সোনার বালা তৈরি করে দেব । নিজে ছেঁড়া কাপড় পরে তোমাকে রাজকন্যের মতো সাজিয়ে রাখব। আল্লার কসম, জীবনে এই প্রথম প্রেম। তুমি যদি আমার না হও, তোমার সামনেই আমি গলা কেটে আত্মহত্যা করব।'

মেয়েটিকে নিজের বাহু থেকে মুক্ত করে আব্বু বলল, 'জানি না আমার কী হয়ে গিয়েছিল, চলো তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি ।’

মেয়েটি জবাব দিল, ‘না, তা হয় না। তুমি আমার গায়ে হাত দিয়েছ।' 

আব্বু মাথা নত করে বলল, ‘আমাকে মাফ করে দাও, আমার ভুল হয়ে গেছে।'

'ভুলটা শেষ পর্যন্ত কি মানিয়ে নিতে পারবে?' মেয়েটির কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ।

কেউ যেন আব্বুকে বলছে, ‘এই টাঙ্গাটা এগিয়ে নিয়ে যাও, নিজের টাঙ্গা।' 

আব্বুর মাথা সোজা হয়ে গেল । চোখ তার ঝিলিক দিয়ে উঠল । নিজের বলিষ্ঠ বুকের ওপর হাত দিয়ে বলল, 'আব্বু তোমার জন্য জান পর্যন্ত দিতে পারে।' 

মেয়েটি আব্বুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'আব্বু, নাও আমার হাত।' 

আব্বু তার হাত দৃঢ়ভাবে ধরে বলল, 'আমার যৌবনের আব্বু তোমার গোলাম ।'

পরের দিন আব্বু আর মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল। তার নাম এনায়েত বা নীতি । জনৈক আত্মীয়ের সঙ্গে এসেছিল । স্টেশনে ওরা তার প্রতীক্ষায় ছিল । এর মধ্যে আব্বুর সঙ্গে তার দেখা। আর সেই মোলাকাত ও প্রথম দেখা ভালোবাসায় রূপ নেয় । আব্বু অবশ্য টাঙ্গা ঘোড়া বিক্রি করে দিয়ে তার জন্য সোনার দুল কিনে দেয়নি। জমানো টাকা দিয়েই কিনে দিয়েছিল। রেশমির কয়েকটা জামাকাপড় তৈরি করে দিয়েছিল। রেশমি জামাকাপড় পরে যখন সে আব্বুর সামনে এসে হাজির হতো, তখন আব্বুর হৃদয় নেচে উঠত। সে বলত, ‘কসম পবিত্র পাঞ্জাতনের, পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই।' বুকে জড়িয়ে ধরে বলত, 'তুমি আমার হৃদয়ের রানি।'

যৌবনের পাগলামিতে দুজনেই ডুবে ছিল । গাইত, হাসত, ঘুরে বেড়াত । এক মাস এমনিভাবে কেটে গেল। হঠাৎ পুলিশ এসে আব্বুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল । নীতিকেও ধরে নিয়ে গেল। অপহরণের মামলা চলল । একটুও টলল না নীতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আব্বুর দুবছরের জেল হয়ে গেল । আদালত যখন এই ফরমান জারি করল, তখন নীতি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলল, ‘আমি মা-বাবার কাছে যাব না। তোমার জন্য অপেক্ষা করব।' 

তার পিঠে চাপড় মেরে আব্বু বলল, 'টাঙ্গা ঘোড়া আমি দিনার হেফাজতে রেখেছি, তুমি ভাড়া আদায় করে নিয়ো।'

নীতির বাবা-মা ওকে অনেক বোঝাল, কিন্তু সে কিছুতেই তাদের সঙ্গে গেল না। তারা হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল । নীতি একাই থাকতে লাগল। রোজ সন্ধ্যায় দিনা ওকে পাঁচ টাকা করে দিত। এই পাঁচ টাকা ওর খরচের জন্য যথেষ্ট। আর তা ছাড়া প্রতিদিনের পাঁচ টাকা থেকেই মোকদ্দমার জন্য খরচের জোগাড় হয়ে যেত ।

সপ্তাহে একদিন আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে যেত নীতি । সাক্ষাতের সময় ছিল সংক্ষিপ্ত । নীতির কাছে যে টাকা জমা ছিল, জেলে আব্বুর আরাম-আয়েশের জন্য তা খরচ হয়ে গেল । একদিন নীতির খালি কানের দিকে তাকিয়ে আব্বু বলল, ‘নীতি, তোমার কানের দুল কোথায়?'

হেসে ফেলে নীতি ।

‘চুপ হয়ে গেলে কেন?’ আব্বু রাগ করে বলল, ‘আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। যেভাবেই আছি, ভালোই আছি।'

নীতি কোনো উত্তর দিল না। তাই হাসতে হাসতে ওখান থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসে খুব কাঁদল। অনেক অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল । কারণ, আব্বুর শরীর একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। এবারের সাক্ষাৎকারে আব্বুকে প্রায় চেনাই যাচ্ছিল না। দোহারা চেহারার আব্বু যেন ভেঙে অর্ধেক হয়ে গেছে। নীতির মনে হচ্ছিল, আব্বুকে দুঃখ কুরে কুরে খাচ্ছে। তার বিচ্ছেদ তাকে এমন করে দিয়েছে। সে জানত না, আব্বুকে ক্ষয়রোগে ধরেছে। এ অসুখ সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। আব্বুর বাবা আব্বুর চেয়ে বলিষ্ঠ ছিল। কিন্তু ক্ষয়রোগ তাকেও অল্পদিনের মধ্যে কবরে নিয়ে গিয়েছিল। আব্বুর বড় ভাইও সুন্দর জওয়ান ছিল । কিন্তু পরিপূর্ণ যৌবনে এই অসুখ তাকে পিষে মারে । ও ছিল পুরোপুরি অনভিজ্ঞ। তাই জেলের হাসপাতালে আব্বু যখন শেষনিশ্বাস নিচ্ছিল, তখন সে দুঃখ করে বলল, 'আল্লার কসম, যদি জানতাম আমি এত তাড়াতাড়ি মারা যাব, তাহলে তোমাকে বউ বানাতাম না । তুমি তোমার দিকে, আমার ঘোড়া ও টাঙ্গার দিকে একটু নজর দিয়ো আর চুন্নি বেটার মাথার ওপর হাত বুলিয়ে বলবে, আব্বু তোমাকে ভালোবাসা পাঠিয়েছে।'

আব্বুর মৃত্যুর পর নীতিও মনমরা হয়ে পড়েছিল, কিন্তু সে ছিল সাহসী। ঘরে একা পড়ে থাকত। সন্ধ্যার সময় দিনা এসে তাকে সাহস দিয়ে বলত, 'কিছু ভেবো না, ভাবি, খোদার ওপর কারও হাত নেই। আব্বু আমার ভাই । আমার পক্ষে, খোদার কসম, যা করার তা-ই করব।'

প্রথম প্রথম নীতি কিছু বুঝত না। কিন্তু পরে দিনা নীতির কাছে খোলাখুলি বিয়ের প্রস্তাব দিল । নীতির মনে হলো, ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘরের বাইরে বের করে দেয়। শুধু বলল, 'ভাই, আমি বিয়ে করব না।'

সেদিন থেকে দিনার ব্যবহার পাল্টে গেল । আগে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাঁচ টাকা আদায় করত। এখন কোনো দিন চার টাকা, কোনো দিন তিন টাকা দিতে লাগল। বাহানা করে বলত, ‘খুব মঙ্গা চলছে।' আবার কখনো কখনো দু-তিন দিন লাপাত্তা। কখনো কখনো বলত, ‘গাড়ি খারাপ ছিল। তাই ঘোড়া জোড়াতে পারিনি ।’

নীতি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দিনাকে বলল, 'ভাই দিনা, তোমার আর হয়রান হওয়ার দরকার নেই। টাঙ্গা ঘোড়া আমাকে জমা দিয়ে যাও।'

অনেক টালবাহানার পর মুখ কাঁচুমাচু করে সে টাঙ্গা ও ঘোড়া নীতিকে ফেরত দিয়ে গেল। মাঝখানে আব্বুর বন্ধু মাজেকে টাঙ্গা চালাতে দিল । সে-ও কয়েক দিন পর নীতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিল । এতে নীতি অস্বীকৃতি জানালে সে-ও পাল্টে গেল । তার কাছ থেকে নীতি টাঙ্গা ঘোড়া ফেরত নিয়ে নিল এবং এক অচেনা কোচোয়ানকে দিল । একদিন সন্ধ্যায় সে নেশা করে এল আর পয়সা দেওয়ার পর নীতির গায়ে হাত দিতে গেল। নীতি তাকে গালমন্দ দিয়ে বিদায় করল।

আট-দশ দিন টাঙ্গা আস্তাবলেই পড়ে রইল । ঘাস ও দানাপানির খরচ ছাড়াও আস্তাবলের ভাড়া দিতে হয়। বেচারি নীতি এক অদ্ভুত চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিল । কেউ বিয়ে প্রার্থনা করে, কেউ পয়সা মেরে দেয়, কেউ গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। বাইরে বের হলে মানুষ খারাপ নজরে ঘুরঘুর করে দেখে। ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এখন সে কী করবে?

একদিন সে বসে বসে ভাবছিল । ভাবতে ভাবতে তার মাথায় এই বুদ্ধি এল, সে নিজের গাড়ি নিজেই চালাবে। যখন সে আব্বুর সঙ্গে বেড়াতে যেত, তখন সে নিজেই টাঙ্গা চালাত । শহরের রাস্তাঘাট তার চেনা। কিন্তু সে আবার ভাবল, লোকে কী বলবে? তার মন এবং চেতনা তাকে উত্তর জোগায়, এত ভাবনার দরকার কী? মেয়েরা মেহনত করে, রোজগার করে, কয়লার খনিতে কাজ করে, অফিস-আদালতে কাজ করে, ঘরে বসেও মেয়েরা জীবিকা উপার্জন করে, হাতের নানা কাজ করে । যেভাবে হোক, পেট তো চালাতে হবে।

কয়েক দিন নীতি চিন্তাভাবনা করেই কাটাল । শেষে সে টাঙ্গা নিজে চালানোর সিদ্ধান্ত নিল । নিজের ওপর তার পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল। সুতরাং, খোদার নাম নিয়ে সে আস্তাবলে গেল ।

নীতিকে টাঙ্গা জুততে দেখে সমস্ত কোচোয়ান অবাক হয়ে গেল। বয়স্করা তাকে এ কাজ না করার জন্য পরামর্শ দিল। কিন্তু নীতি তাদের কথায় কান দিল না। টাঙ্গা ঠিকঠাক করে নিল। পিতলের তকমাগুলো পরিষ্কার ঝকমকে করে তুলল ।

ঘোড়াকে খুব আদর করল । আর আব্বুর ভালোবাসার কথা মনে আওড়াতে আওড়াতে আস্তাবলের বাইরে চলে গেল। কোচোয়ানরা তার টাঙ্গা চালানোর ধরন দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল ।

শহরে হইচই পড়ে গেল, এক সুন্দরী মেয়ে টাঙ্গা চালাচ্ছে। শহরের সব জায়গায় শুধু এই একই আলোচনা । প্রথম প্রথম পুরুষ যাত্রীরা টাঙ্গায় চড়তে দ্বিধা করত। কিন্তু অল্পদিনেই তা দূর হয়ে গেল। বেশ রোজগার হচ্ছিল নীতির। এক মিনিটের জন্যও নীতির টাঙ্গা খালি থাকে না। একজন না-নামতেই আরেকজন যাত্রী উঠে বসত । কে তাকে প্রথম ডেকেছে, তা নিয়ে কখনো কখনো যাত্রীদের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যেত । কাজের চাপ বেড়ে গেলে নীতি টাঙ্গা চালানোর সময় ঠিক করে নিল । সাতটা থেকে দুপুর দুইটা আর দুইটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। এই সময়টুকুই তার কাজের জন্য সুখকর মনে হতো। চুন্নিও ছিল । সে বুঝত, বেশিরভাগ মানুষই তার সান্নিধ্যলাভের জন্যই টাঙ্গায় চড়ত। বিনা উদ্দেশ্যে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াত। যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে কুৎসিত আলাপও করত। এসব আলাপ-আলোচনা করত শুধু তাকে শোনানোর জন্য। সে বুঝতে পারল, নিজেকে না বেচলেও মানুষ চুপিসারে তাকে নিয়ে কেনাকাটা করছে। তা ছাড়া শহরের কোচোয়ানরা তাকে ভালো নজরে দেখছে না। এসব জানা সত্ত্বেও তার মনে এতটুকু উৎকণ্ঠা ছিল না। কারণ, নিজের ওপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস ।

একদিন পৌরসভা থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হলো এবং তার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হলো। কারণ হিসেবে বলা হলো, 'মেয়েমানুষ টাঙ্গা চালাতে পারে না।'

নীতি জানতে চায়, ‘মেয়েরা কেন টাঙ্গা চালাতে পারবে না?'

পৌরসভার কমিটি জবাব দিল, 'চালাতে পারবে না, ব্যস। তোমার লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হলো ।'

নীতি বলল, 'হুজুর, আপনি টাঙ্গা ঘোড়া বাজেয়াপ্ত করতে পারেন, কিন্তু একবার বলুন, মেয়েমানুষ কেন টাঙ্গা চালাতে পারবে না? মেয়েরা চরকা চালিয়ে পেট চালাতে পারে, টুকরি বয়ে পেটের জন্য আহার সংগ্রহ করতে পারে, তবে আমি কেন টাঙ্গা চালাতে পারব না? আমি আর কোনো কাজ জানি না। টাঙ্গা ঘোড়া আমার স্বামীর। কেন আমি তা চালাতে পারব না? হুজুর, আপনি দয়া করুন। আমার মজদুরি কেন বন্ধ করে দেবেন? তাহলে আমি কী করব?' 

অফিসার জবাব দিল, ‘বাজারে বসো গিয়ে, ভালো আয় হবে।'

অফিসারের উত্তর শুনে নীতির ভেতরে আসল যে নীতি ছিল, তা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। ‘আচ্ছা, জি হ্যাঁ' বলে সে বেরিয়ে এল ধীরপদে। জলের দামে টাঙ্গা ঘোড়া বিক্রি করে দিয়ে আব্বুর কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নীরবে। তার চোখের পানি গেল শুকিয়ে। শুধু বলল, 'আব্বু, তোমার নীতি আজ পৌরসভার অফিসে মারা গেছে।'

পরের দিন সে আবেদন পেশ করল। এরপর দেহ-বেসাতির লাইসেন্স পেয়ে গেল সে।

------------------------------------------------------------

লাইসেন্স গল্পের পাঠ-প্রতিক্রিয়া পড়তে এই লিঙ্কে ক্লিক বা ট্যাপ করুন।


[দক্ষিণ এশিয়া ও উর্দু সাহিত্যের শক্তিমান গল্পকার সাদত হাসান মান্টো। তাঁর অনেক গল্পই বাংলায় অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশি অনুবাদ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জাফর আলম। অনুবাদ সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য জাফর আলম পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা স্বীকৃতি। তাঁর অনুবাদ করা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে মির্জা গালিবের ‘দাস্তাম্বু: সিপাহি বিদ্রোহের রোজনামচা’, হেরমান হেসের ‘সিদ্ধার্থ’, কৃষণ চন্দরের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’, ‘চম্বল কি রানী’, সাদত হাসান মান্টোর ‘কাফনের জামা’, ‘টোবাটেক সিং ও অন্যান্য গল্প’ প্রভৃতি।]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ