bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

সব আলো ঢেকে যায় চিরকালীন আঁধারে: নূর সালমা জুলি

আমিই সেই মেয়ে
বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন
তার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি
আপনি রোজ দেখেন।
আর
আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন।
স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন।
আমিই সেই মেয়ে।
................
একদিন হয়তো
হয়তো একদিন....হয়তো অন্য কোনো একদিন 
আমার সমস্ত মিথ্যে পোষাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে 
আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা
খোলা চুল মেঘের মতো ঢাকবে আমার খোলা পিঠ। 
দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন।
কপাল ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি। 
হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ।
দুপায়ের নুপূরে বেজে উঠবে রণদুন্দুভি। 
নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ।
দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন
মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং 
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাং ॥
বীভৎস দানবের মত
আমি এগোতে থাকবো! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে 
মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছট্‌ ফট্ করতে থাকবে---
সভ্যতার দেহ....
প্রগতির দেহ....
সমাজের দেহ
হয়ত আমিই সেই মেয়ে! হয়তো! হয়তো বা।

-কবি শুভ দাশগুপ্ত

দক্ষিণ এশিয়ার কিংবদন্তি ও উর্দু সাহিত্যের শক্তিমান গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর গল্প ‘লাইসেন্স’ এর পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন নূর সালমা জুলি। 


সাদত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫) উর্দু সাহিত্যের একজন প্রথিতযশা গল্পকার। কঠিন বাস্তবের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ ব্যক্তিমানুষ আর তাদের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া স্বপ্নকে অনাড়ম্বর ভাষায় রূপ দেন লেখায়। যেখানে জীবনের মানেই বদলে যায়, বদলে যায় বিশ্বাস, ভরসা, আস্থা। মান্টোবিশ্বে মানসিক বিকৃতি, স্বার্থবাদিতা, লোভ আর রাজনীতির জটিল সমীকরণে পড়ে পাল্টে যায় জীবন, এলোমেলো হয়ে যায় গোছানো সবকিছু। মানুষের চোখে কেবল কালো অন্ধকার ঘুরেফিরে বেড়ায়। এমনসব সত্য মানুষ দেখে যে আচরিত বোধ হাহাকার করে মরে। জীবনের এই রূপকে অনেকেই দেখে কিন্তু মান্টোর মতো এমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর গভীর সংবেদনশীল মন নিয়ে দেখার ক্ষমতা ক’জন রাখে? মান্টো তাঁর চারপাশে ঘটে যাওয়া সব অনভিপ্রেত আর অভিপ্রেত ঘটনার বিন্যাস করেন গল্পের শরীর জুড়ে। কখনো একলা নারীর কঠিন জীবনসংগ্রাম কখনো মাতাল কখনো জুয়াড়ি কখনো দেহপসারিণী কখনো দাঙ্গাকারী কখনো হিংসার আগুনে দগ্ধ মানবতা কখনো রাষ্ট্রকাঠামোর নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়া জীবন─তাঁর গল্পে এসে নিজেদের কথা বলে যায়। মান্টোর গল্পের মানুষেরা বিচিত্র, বিচিত্র তাদের পেশা, তাদের সমস্যা। অন্যদিকে জীবনের এই বৈচিত্র্যময়তাকে উপস্থাপন করতে মান্টো ব্যবহার করেন এক অনায়াস কৌশল। যা একান্ত তাঁরই। সেটা বিষয় নির্বাচন ও গল্প বয়ানের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। আর বয়ানের এই অভিনবত্ব ও অনায়াসভঙ্গি মান্টোকে ভিন্ন এক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

মান্টোর তীক্ষ্ণ এবং সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন মন আর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল অন্যায় ও অবিচার। কীভাবে মানুষ এসবের তৈরি করা ফাঁদে পড়ে আটকে যায়, পিষ্ট হয়ে মানবতা ধুলায় মিশে যায়, স্বপ্নহীন হয়ে যায় এক একটা জীবন─মান্টো তা দেখান। ঠিক এমনই এক বিশেষ বিষয়ের গল্প লাইসেন্স। ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্রকাঠামো একজন একলা নারীর জীবনকে কতটা দুর্বিষহ করে তুলতে পারে তার বয়ান এই গল্পটিতে রয়েছে। রক্ত হিম করা বিষণ্ণ অনুভবের গল্প এটি। এখানে দেখা যায় একজন সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান কোচোয়ান আব্বু। প্রাণবন্ত, উচ্ছল, আত্মবিশ্বাসী আব্বুর চুন্নি ঘোড়াটাও তার মতো। টাঙ্গা, চুন্নি আর আব্বু মিলে একটা পুরো জীবন। সেই জীবনে সওয়ারি হয়ে আসে একদিন এনায়েত বা নীতি নামের ষোলো/সতেরো বছরের এক তরুণী। ছিপছিপে গড়ন আর তীক্ষ্ণ নাকের অধিকারী নীতিকে দেখেই মন দিয়ে বসে আব্বু। নীতি টাঙ্গায় স্টেশনে যেতে চেয়েছিল কিন্তু পথ পাল্টে আব্বুর সহযাত্রী হয়ে যায়। স্টেশনের রাস্তাটি এসে মিলে যায় আব্বুর ঘরে। সুখসাগরে ভাসতে থাকে এই নবদম্পতির জীবন।  মাসখানেকের মাথায় পুলিশ এসে আব্বুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় অপহরণের মামলায়। নীতির বাবা-মা এই মামলা করে। নীতি অবশ্য আব্বুর স্ত্রী হয়েই তার ঘরে রয়ে যায়। মেয়েকে ছাড়ায় বাবা-মাকে ফিরে যেতে হয়। ওদিকে আব্বুর দুবছরের জেল হয়ে যায়। আব্বু তার টাঙ্গা ঘোড়া বন্ধু দিনাকে দিয়ে যায়। দিনা প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে নীতিকে দিত। সেই টাকায় সংসার ও মামলার খরচ চালিয়ে নিত নীতি। আব্বুর জেলে ভালো থাকার বা সুবিধার জন্য টাকা খরচ করত নীতি। একদিন এসব খরচ যোগাতে সে আব্বুর গড়িয়ে দেওয়া সোনার কানের দুলটা বিক্রি করে দেয়। আব্বু এটা জেনে খুব রাগ করে।  

জেলে দিনে দিনে আব্বুর চেহারা ভেঙে যেতে থাকে। নীতি ভাবে তাকে একলা রেখে গেছে বলে চিন্তা-ভাবনায় হয়তো শরীর ভেঙে পড়েছে তার। আসলে আব্বুর শরীরে তখন ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে। সে উত্তরাধিকারসূত্রে এই রোগ পেয়েছে। তার বাবাও এই রোগে মারা যায়। বড় দুঃখে আব্বু নীতিকে বলে যদি জানতাম আমি এত তাড়াতাড়ি মারা যাবো তাহলে তোমাকে বউ বানাতাম না। আব্বুর মৃত্যুর পর শুরু হয় নীতির জীবনে এক কঠিন সংগ্রাম। এক প্রতিকূল পরিবেশে তাকে ঝড়-ঝাপ্টা পোহাতে হয়। প্রকৃতির তৈরি করা ভাগ্যলিপি তাকে এই পৃথিবীতে একা করে দেয়। আর এই একা জীবনকে প্রতিবন্ধকতায় ভরিয়ে দিতে সমাজ ও সমাজের মানুষেরা জোটবদ্ধ হয়ে যায় যেন। সকলের অনভিপ্রেত আচরণে নীতি কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ে। কিন্তু সে সাহসী মেয়ে। প্রিয় মানুষের সঙ্গে থাকবে বলে বাবা-মাকে ফেরত পাঠিয়েছিল। এখন সে লড়াই করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। 

বন্ধু দিনা আব্বুর মৃত্যুর পর তার আচরণ পাল্টে ফেলে। টাকা কম দিতে থাকে এবং একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। এরপর নীতি দিনার কাছ থেকে টাঙ্গা ও ঘোড়া ফেরত নিয়ে নেয়। তারপর নীতি আব্বুর আরেক বন্ধু মাজেকে টাঙ্গা ও ঘোড়া দেয়। সেও কিছুদিন পর বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এতে নীতি সাড়া না দিলে তার আচরণও পাল্টে যায়। এবার নীতি টাঙ্গা ও ঘোড়া  ফেরত নিয়ে এক অচেনা কোচোয়ানকে দেয়। একদিন সন্ধ্যায় সে নেশা করে এসে নীতির গায়ে হাত দিতে গেলে তাকেও সে বিদায় করে। এরপর আট-দশদিন টাঙ্গা আস্তাবলে পড়ে থাকে। ঘোড়ার খাওয়ার খরচ, আস্তাবলের ভাড়া এসব কোথা থেকে আসবে─নীতি ভেবে পায় না। অথচ আশেপাশের মানুষেরা কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না। বরং ‘কেউ বিয়ে প্রার্থনা করে, কেউ পয়সা মেরে দেয়, কেউ গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। বাইরে বের হলে মানুষ খারাপ নজরে ঘুরঘুর করে দেখে।’ এমন অবস্থায় নীতি ভেবে ঠিক করে তার স্বামীর টাঙ্গা সে নিজেই চালাবে। সে তো আব্বুর সঙ্গে শহরে অনেক ঘুরেছে। রাস্তা-ঘাট তার ভালোই চেনা। লোকের কথা একবার তার মাথায় আসে। কী বলবে ভাবতে গিয়ে সুন্দর এবং যৌক্তিক ভাবনা তার মনকে ঘিরে ধরে। সে ভাবে, ‘মেয়েরা মেহনত করে, রোজগার করে, কয়লার খনিতে কাজ করে, অফিস-আদালতে কাজ করে, ঘরে বসেও মেয়েরা জীবিকা উপার্জন করে, হাতের নানা কাজ করে। যেভাবে হোক, পেট তো চালাতে হবে।’ অবশেষে আরও কয়েকদিন চিন্তা করে সে ক্ষুধা আর প্রয়োজনের তাড়নায় আত্মবিশ^াসী হয়ে টাঙ্গা নিয়ে পথে বের হয়। 

বয়স্করা এ কাজ না করতে পরামর্শ দিলেও নীতি নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ‘শহরে হইচই পড়ে গেল, এক সুন্দরী মেয়ে টাঙ্গা চালাচ্ছে।’ পুরুষ যাত্রীরা প্রথমে তাকে এড়িয়ে চললেও পরে তারাই অতি উৎসাহী ভূমিকায় নেমে এলো। টাঙ্গায় যাত্রী বেশে ওঠে অযথা ঘোরাঘুরি করে, কুৎসিত আলাপ করে নীতিকে শুনিয়ে শুনিয়ে। নীতি বুঝতে পারে সে ‘নিজেকে না বেচলেও মানুষ চুপিসারে তাকে নিয়ে কেনাকাটা করছে।’ পুরুষ কোচোয়ানরা নীতিকে খারাপ চোখে দেখতে  থাকে। কেননা নীতির সওয়ারি তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। এতসব প্রতিকূলতা নীতি তার আত্মবিশ^াস দিয়ে মোকাবিলা করতে থাকে। জীবনের চাকাকে সচল রাখতে একলা নীতিকে টাঙ্গার চাকাকে পথে গড়াতেই হয়। বেঁচে থাকার জন্য সে এই বিমুখ প্রান্তরে কঠোর বাস্তবতার মাঝে কঠিন লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। অদ্ভুত আমাদের সমাজ আর সমাজের মানুষ! কেউ নীতির লড়াইটাকে মন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে না। বরং নিজেদের অন্ধকার চেতনা দিয়ে তাকে, তার কাজকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে থাকে।

মানুষের এসব তৈরি করা প্রতিবন্ধকতার পাশে এবার এসে দাঁড়ায় রাষ্ট্রযন্ত্র। একদিন পৌরসভা থেকে নীতির ডাক পড়ে। সেখানে তার কাজের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়। এবং কারণ হিসেবে জানানো হয়, ‘মেয়েমানুষ টাঙ্গা চালাতে পারে না।’ নীতি জানতে চায়, ‘মেয়েরা কেন টাঙ্গা চালাতে পারবে না?’ তার প্রশ্নের উত্তর পৌরসভার সেই কর্মকর্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না কিংবা উত্তরটাই হয়তো তার জানা ছিল না। পুরুষতন্ত্র তো এমন অনেক অযৌক্তিক কাজ করে এবং অযৌক্তিক অনেক সিদ্ধান্ত নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়। নীতির কাতরোক্তি কর্তৃপক্ষকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না। নীতির আর্তনাদ তাদের ছুঁয়ে যায় না। 

নীতি বলল, ‘হুজুর, আপনি টাঙ্গা ঘোড়া বাজেয়াপ্ত করতে পারেন, কিন্তু একবার বলুন, মেয়েমানুষ কেন টাঙ্গা চালাতে পারবে না? মেয়েরা চরকা চালিয়ে পেট চালাতে পারে, টুকরি বয়ে পেটের জন্য আহার সংগ্রহ করতে পারে, তবে আমি কেন টাঙ্গা চালাতে পারব না? আমি আর কোনো কাজ জানি না। টাঙ্গা ঘোড়া আমার স্বামীর। কেন আমি তা চালাতে পারব না? হুজুর, আপনি দয়া করুন। আমার মজদুরি কেন বন্ধ করে দেবেন? তাহলে আমি কী করব?’

এর জবাবে অফিসার যা বলে তা আমাদের  সকল কল্পনাকে হার মানাতে সক্ষম। রাষ্ট্রযন্ত্র তো অন্য গ্রহ থেকে আসা কিছু নয়। এটা তো আমি, আপনি মিলেই বানিয়েছি। ব্যক্তিমানুষের কল্যাণের জন্যই এমন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। কিন্তু বিপদগ্রস্তকে যখন আরও বড় বিপদের মুখে ফেলে দেয় এমন প্রতিষ্ঠান তখন সাধারণ মানুষের আর কী-ইবা বলবার থাকে। নীতির আর্তনাদ আর অনুনয় অফিসারকে দয়ার্দ্র হতে সাহায্য করে না। বরং যতটা রূঢ় হওয়া সম্ভব এবং কঠোর বা ভয়ংকর হওয়া সম্ভব তা তিনি হন। অবাক ও শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার মতো এক পথের সন্ধান দেন নীতিকে। বলেন, ‘বাজারে বসো গিয়ে, ভালো আয় হবে।’ এরপর নীতির আর কিছু বলার বা করার থাকে না। সে চলে যায়। জলের দরে টাঙ্গা, ঘোড়া বিক্রি করে। আব্বুর কবরের কাছে গিয়ে বলে, ‘আব্বু, তোমার নীতি আজ পৌরসভার অফিসে মারা গেছে।’ রাষ্ট্র জীবিত একটা মানুষকে মৃত্যুর মতো ঘোর অমানিশায় নিপতিত করে। গল্পের শেষ বাক্য দুটি এমন, ‘পরের দিন সে আবেদন পেশ করল। এরপর দেহ-বেসাতির লাইসেন্স পেয়ে গেল সে।’

মান্টো তাঁর স্বভাসুলভ ভঙ্গিতে গল্পটা শেষ করেন। গী দ্য মোপাসাঁর গল্পের মতো সমাপ্তিতে একধরনের চমক অপেক্ষা করে পাঠকের জন্য মান্টোর গল্পে। কিন্তু ‘লাইসেন্স’ গল্পের এই চমক আমাদের তীব্র ঘৃণায় সংকুচিত করে দেয়। সঙ্গে বিষাদের মেঘে ছেয়ে যায় একটা সুনীল আকাশ। আমরা ভেবে উঠতে পারি না। যেভাবে নীতিও ভেবে উঠতে পারেনি তার এই পরিণতির কথা। অবশ্য এই পঙ্কিল পথে পথ চলাটা নীতির নয়। কেননা নীতির তো মৃত্যু সেদিন পৌরসভা অফিসেই ঘটেছে। যে মেয়েটি দেহ-বেসাতির লাইসেন্স পেয়েছে সে রাষ্ট্রব্যবস্থার শিকার এক জীবন্ত, লড়াকু, আত্মবিশ্বাসী নারীর মৃতসত্তা। এভাবে কালে কালে আর কতবার কতভাবে নারীদের মরতে হবে? কখনো সতীত্বের নামে কখনো ধর্মের নামে কখনো প্রথার নামে কখনো মনগড়া নিয়মের নামে পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য বিধান তৈরি করে চলেছে। সেই বিধানে নারীর আত্মমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে এমনকি মৃত্যু অবধি নিশ্চিত করা হয়েছে কখনোবা। তারপরও তারা থেমে থাকেনি। কালক্রমে এসব প্রথা আর দশটা নিয়মের কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে।

পুরুষতন্ত্র বারবার নারীর জন্য এমনসব কারাগারসদৃশ্য ফাঁদ তৈরি করেছে। আর নারী ভীষণ অসহায়ের মতো সব জেনে-বুঝে সেখানে পা দিয়েছে, আত্মসমর্পণ করেছে। তার হাতে আসলে অন্য কোনো অপশন ছিল না। গল্পে যখন পুরুষরা ফায়দা লুটতে চেয়েছে তখন নীতি সেটার প্রতিবিধান করেছে। তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছে। নিজের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু তখন সমাজ তথা রাষ্ট্রকাঠামো নিয়মের বেড়াজাল তৈরি করে নীতির সামনে পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে দিয়েছে। 

নীতির আর কী করার ছিল? তাদের বাতলে দেওয়া পথে হাঁটা ছাড়া নীতির সামনে সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ কেউ নীতির কথা ভেবে তার লড়াইকে সাপোর্ট দিতে আসেনি। বরং উল্টোটা করেছে। যেখানে তার আশ্রয় পাবার কথা সেই রাষ্ট্রও তার সামনে পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। তাকে দেখিয়ে দিয়েছে এক অন্ধকার কর্দমাক্ত পথ। সমাজ এই পথ নিজেদের স্বার্থে সেই প্রাচীনকালেই তৈরি করে রেখেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে আদি ব্যবসায় নামতে বাধ্য করেছে সমাজ নীতিকে। অথচ নীতি চেয়েছিল আত্মবিশ্বাসী হয়ে লড়াই করে একজন পরিশ্রমী মানুষের মতো জীবন কাটাতে। নারীর সংগ্রাম যেখানে বাহবা পাওয়ার কথা সেখানে সকলে মিলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তাকে এক পঙ্কিল জীবনের পথে হাঁটতে বাধ্য করে। তার স্বাভাবিকভাবে, আত্মসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ‘অপর’─গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এভাবেই বলেন। তো ‘অপর’ যারা তারা তো সমাজে সংখ্যালঘু। সংখ্যার হিসেবে নয় অধিকারের বিষয়ে। সমাজ তাদের গুরুত্বের মধ্যে ধরেই না। ফলে তাদের কণ্ঠস্বর শেষ অবধি সমাজের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাদের জীবনের সংগ্রাম সকলের আড়ালে রয়ে যায়। তবে আড়ালে রয়ে যায় বলে তাদের সংগ্রাম তো মিথ্যে হয়ে যায় না। নীতিরা সবসময় হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা নিয়মরূপী অনিয়মকে মোকাবিলা করে জীবনের পথে এগিয়ে যায়। লড়াই তাদের নিত্যসঙ্গী। এই সত্য পৃথিবীর মতোই প্রাচীন।

মান্টো তাঁর গল্পবিশ্বে জীবনের এমনসব কঠিন বাস্তবতাকে সূক্ষ্ম আর মর্মভেদী দৃষ্টিতে দেখেন এবং রূপায়ণ করেন । যেখানে মানবতার বিপর্যয় শুরু হয় রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে আবার কখনো ব্যক্তিমানুষ থেকে। হিংসা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস আর সন্দেহে ভরা মানুষ এবং মানুষের সমাজকে তিনি এঁকে তোলেন তাঁর লেখায়। জীবনের এমন দিকের রূপায়ণের বিচারে এক অন্যতম সেরা সৃষ্টি ‘লাইসেন্স’। যেখানে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিমাতাসুলভ এবং বিরূপ আচরণের শিকার হয়ে একলা নারীর জীবনের সংগ্রাম এক মহিমান্বিত রূপ লাভ করে। আর তার বিষাদঘন পরিণতিতে পাঠক এক অভাবিত বিষণ্ণতায় কাতর হয়। চিরকালীন অন্ধকারে ঢেকে যায় উজ্জ্বল একটি জীবন। আবহমান কাল ধরে প্রবহমান এই সত্যের এক অনবদ্য উপস্থাপনা ‘লাইসেন্স’ গল্পটি।

এই লিঙ্কে ট্যাপ করে বা ক্লিক করে ‘লাইসেন্স’ গল্পটি পড়ুন।


লেখক পরিচিতি:

nur salma juli

নূর সালমা জুলির জন্ম রাজশাহীতে ৭ আগস্ট, ১৯৮১ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষা বিষয়েও পড়েছেন। বর্তমানে তিনি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ‘মাহমুদুল হক : একজন কথাশিল্পীর প্রতিকৃতি’ গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। কথাসাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তাঁর। এই বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ : কথাশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ ; যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের। প্রকাশিতব্য গ্রন্থ : মাহমুদুল হক : একজন কথাশিল্পীর প্রতিকৃতি; এবং নারী; গ্রন্থপাঠ ও বীক্ষণ। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ