bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

শিল্পের দাবি, শিল্পীর দায়

কায়েস আহমেদ

লেখকের দায়বদ্ধতা বা দায়বদ্ধ লেখক কথাটি খুব স্পষ্ট নয়, কেননা এর বহু মাত্রা আছে। 

তিরিশের দশকের মধ্য পর্বে পৃথিবীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের করাল ছায়া ঘনিয়ে আসতে থাকে। জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, স্পেনে ফ্রাঙ্কোর উত্থান, ইতালীর মুসোলিনী ও জার্মানীর হিটলারের দাঁত ঘসটানির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষ এক প্রবল পরাক্রান্ত ভয়াল দানবিক রূপকে প্রত্যক্ষ করে, যার নাম ফ্যাসিবাদ। 

দেশে দেশে মানুষ এই দানব ফ্যাসিবাদকে রুখে দাঁড়াবার জন্যে জোট বাঁধতে থাকে। স্পেনীয় প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯৩৬ সালে ফ্রাঙ্কোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ যখন আক্রমণ চালায় তখন স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের আহ্বানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল মানুষ স্পেনের পাশে এসে দাঁড়ালেন, গড়ে তুললেন ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’।

এই আন্তর্জাতিক বাহিনীতে ছিলেন পৃথিবীর বহু সেরা বুদ্ধিজীবী লেখক। ফ্যাসিবাদকে রুখতে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে স্পেনের মাটিতে প্রাণ দিয়েছেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল, র‌্যালফ ফক্স প্রমুখ লেখক। 

পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে স্পেনের পপুলার ফ্রন্টের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের এই আক্রমণ বস্তুত: আসন্ন মহাযুদ্ধের স্টেজ রিহার্সাল। 

মানবতাবিরোধী এই অন্ধ দানবিক শক্তির বিরুদ্ধে রোমারলা থেকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববাসীকে হুঁশিয়ার করেছেন। বারবার, প্ৰবল ধিক্কার দিয়েছেন এই বর্বর মূঢ়কে। 

কিন্তু ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যাণ্ডের ওপর হিটলারের আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় মহাসমর। 

ফ্যাসিবাদের উত্থানের পর থেকে শিল্প সাহিত্যে লেখক শিল্পীর দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। ফ্যাসিবাদ মানব সভ্যতার সাধারণ শত্রু অতএব একে রোখা জরুরী -- এই ভিত্তিতে ধনতন্ত্রী, সামজতন্ত্রী উভয় শিবিরই সেদিন এক কাতারে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু লেখক শিল্পীর দায়বদ্ধতা শেষ পর্যন্ত শুধু ফ্যাসিবাদকে রোখাই নয়, সমষ্টির আর্থ-সামাজিক মুক্তির সঙ্গে তা একাকার হয়ে যেতে থাকে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, ক্রমে রূপান্তরিত হয় প্রগতি লেখক সংঘে। 

সাম্যবাদী রাজনৈতিক চিন্তা প্রসূত মাত্রাটি প্রাধান্য পেতে থাকলে প্রচলিত সাধারণ মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়েছিলেন তাঁরা এই সংঘ থেকে সরে দাঁড়ান। 

সেই থেকে লেখকের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটি আমাদের কাছে উঠে আসে মার্কসবাদের সঙ্গে সংলগ্নতার মাধ্যমে। 

আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর অন্যত্রও এ ধরনের চিন্তাই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তার পাশাপাশি ইউরোপে আর এক নতুন দর্শন নিয়ে হাজির হন ফরাসী লেখক জাঁ পল সার্ত্র। জার্মান বন্দী শিবিরে থাকাকালে তিনি এই চিন্তাসূত্রটি লাভ করেন। সেই চিন্তাসূত্রটিকে আপন কালের যন্ত্রণা এবং নিজের জীবনের উপলব্ধির মাধ্যমে ব্যপ্তি এবং গভীরতা দিয়ে নিজস্ব এক দর্শনের জন্ম দেন। 

অস্তিত্ববাদী সার্ত্র বলেন, ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে ব্যক্তি কেবল তার নিজের কাছেই দায়বদ্ধ, অন্য কারুর কাছে নয়- তার সত্তা স্বাধীন। ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার স্বাধীন সত্তারই প্রকাশ। 

ইউরোপের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী সমাজের যুদ্ধবিধ্বস্ত বিপন্ন মানুষের কাছে এ দর্শন ব্যাপকভাবে আদৃত হয়। 

গল্প, নাটকে, উপন্যাসে প্রবন্ধে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর সেই দর্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি জীবনের নানান সাহসী ভূমিকার মাধ্যমে সারা বিশ্বে তিনি পরিচিতি লাভ করেন দায়বদ্ধ লেখক হিসাবে। 

বিশ্ব মানবতার বিভিন্ন সঙ্কট ও বিপন্নতায় কথায় ও কাজে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ হিসাবে এবং লেখক হিসাবে যে ভূমিকা তিনি পালন করেছেন দায়িত্ববোধের তাগিদ থেকে সে তো সারা বিশ্বের লেখক শিল্পী তথা গোটা মানব সমাজের কাছে সর্বকালের দায়বদ্ধতার সশ্রদ্ধ উদাহরণ হয়ে থাকবে।

সার্ত্র মার্কসবাদী ছিলেন না। সার্ত্র–এর দর্শনকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের চরম প্রকাশ বলে নিন্দা করেই কি তাকে নাকচ করা যায়? ব্যক্তির দায়িত্ব গ্রহণের যে প্রবল তাগিদের কথা বলা হয়েছে তাকে অস্বীকার করা যাবে কিভাবে? 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় এবং বিভিন্ন সময়ে স্বদেশের নানান সঙ্কটে বিপন্নতায় সক্রিয়ভাবে যে রকম সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন তা দেশের অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদ নেতাও করেননি। তাঁর আন্তর্জাতিক ভুমিকা বাদ দিলেও দেশবাসীর একজন হয়ে তাঁর এই দায় পালনকে কি একজন সামন্তবাদী চেতনা-পালনকারী বুর্জোয়া ভাববাদী কবির ভাব বিলাস বলে নাকচ করে দেয়া যায়?

চল্লিশ দশকে এমন চেষ্টা হয়েছিলো। শুধু তাঁর দায়বদ্ধতা নয়, গোটা রবীন্দ্র সাহিত্যকেই প্রতিক্রিয়াশীল বলে নাকচ করার কথা তুলে ছিলেন প্রগতি শিবিরের একাংশ, সে প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐ শিবিরেরই অন্যান্য প্রতিবাদ করেছিলেন প্রবলভাবে। কিন্তু এ কথাও সত্যি, সম্পূর্ণ নাকচের কথা না বললেও এখনও সেই ঝোঁকটি একেবারে অবসিতও হয়নি।

শিল্প সাহিত্যে ‘আধুনিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ এই দুটি শব্দ বহুকাল ধরে চলে আসছে, বিশেষত: বাঙলা সাহিত্যে এই দু'টি শব্দ প্রায় পরস্পর বৈরী হিসাবে বিবেচিত। 

আধুনিকতার মূল ভিত্তিই হলো যুক্তি: এই যুক্তিই একদিন মধ্যযুগের প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণের অন্ধত্ব ঘুচিয়ে মানব চৈতন্যকে স্থিতাবস্থা সম্পর্কে প্রশ্নশীল, নিরন্তর জিজ্ঞাসু এবং আত্মতৃপ্তির আলস্য বিলাস থেকে টেনে তুলে কঠিন মাটিতে দু’পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে তাকে দিয়েছিলেন ঐতিহ্য অবগাহনের অবাধ স্বাধীনতাও। 

যার ওপর দাঁড়িয়ে একদিন কার্ল মার্কস সর্ববিধ শোষণের বিরুদ্ধে কামান দেগে ছিলেন। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর aesthetically badly traind প্রগতিবাদী আধুনিকতার সেই নির্যাসকে না বুঝে প্রগতিশীলতাকে দাঁড় করিয়েছেন তার বৈরী হিসাবে। 

আধুনিক ও প্রগতি শব্দ দু’টি এক সময়, এমন কি আমাদের দেশেও সমার্থক বিবেচিত হতো। (বিশের দশকে ঢাকা শহর থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘প্রগতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো যা ছিলো একান্তভাবেই রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক সাহিত্যন্দোলনের বাহন। 'প্রগতি' নামটি তারা গ্রহণ করেছিলেন আধুনিক এর বিকল্প হিসাবেই ৷) কালে তা রাজনৈতিকতায় অবুলিপ্ত হয়ে পড়ে, এই অনুলিপ্তিরও এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে।

ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে যে জটিল সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই গড়ে তুলেছিলো, কালে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই হয়ে দাঁড়ালো তার আত্মবিকাশের পথে বাধা। এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দানবিক রূপটি বিশাল হতে হতে শোষণে পীড়নে ব্যক্তি তথা সমাজের অন্তর বাহিরকে শূন্য, রিক্ত, ধূসর এবং বিভক্ত করে ফেলতে থাকে।

'আধুনিকতা' রেনেসাঁসের সমস্ত ইতিবাচকতা হারিয়ে হয়ে উঠলো এই যন্ত্রণা কাতর বিছিন্ন নিঃসঙ্গ মানুষের অন্তহীন দায়টানা ক্লান্ত অশ্ব। 

১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকে এই ক্ষয়গ্রস্ত মুমূর্ষ ব্যক্তি তার মুক্তির নিশানা দেখতে পেলো সমষ্টির মুক্তির মধ্যে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশের দশকে ধনতান্ত্রিক বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা, যারা বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসন শৃংখলা চূর্ণ করার অপরাজেয় উদ্যত হাত এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ক্রমপ্রসারিত জোয়ারের মুখে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপন্ন জরাগ্রস্ত রূপটি প্রকট হয়ে ওঠে।

‘প্রগতিশীল’ ক্রমে হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক সভ্যতা সজ্ঞাত 'আধুনিকতার প্রতিস্পর্ধী। যুদ্ধ, রাষ্ট্র বিপ্লব বা সামাজিক পরিবর্তনের পর যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় তাহলো পুরোনো মূল্যবোধের বিপর্যয়, এই বিপর্যস্ত ধ্বংস স্তুপকে সরিয়ে সেখানে যদি সাবলীল কোনো ইতিবাচক মুল্যবোধ গড়ে তোলা না যায় তাহলে যেমন দেখা যায় মারাত্মক নৈরাজ্য, প্রগতিশীল শিল্প সাহিত্য আধুনিকতার প্রতিস্পর্ধী হতে গিয়ে সেই অবস্থায় পড়ে। 

মার্কসবাদের সবচেয়ে জোরালো হাতিয়ার দ্বান্দ্বিকতা; জীবন ও জগতের সমস্ত কিছুকে যেখানে দ্বান্দ্বিকতার নিরিখে বিচার করাই মার্কসবাদ সম্মত সেখানে লক্ষ্য করা যায় রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক অর্থনৈতিক-তাবৎ বিষয়ের ক্ষেত্রে এই পথ অনুসরণ করা হলেও শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয় পারম্পর্যহীন এক উদ্ভট যান্ত্রিকতা। 

দ্বান্দ্বিকতার পারম্পর্যময় বন্ধুর ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে যেমন রেনেসাঁস উত্তর ধনতন্ত্র ও আধুনিকতা, তেমনি সেই ধনতন্ত্র ও আধুনিকতার সুফল গুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে মার্কস-লেনিন অনুসৃত সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া। 

ধনতন্ত্রের ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজ সৃষ্ট আধুনিক শিল্প সাহিত্যও ক্ষয়গ্রস্ত হবে এ যেমন সত্য তেমনি তাকে অতিক্রম করতে হলে তার সমস্ত কলাকৌশল ও সুফলগুলোকে আত্মস্থ করেই তাকে এগোতে হবে। এও দ্বান্দ্বিকতারই শিক্ষা। তত্ত্ব যতক্ষণ চেতনায় অভিসিক্ত হয়ে ফলিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর না হবে ততক্ষণ তা তত্ত্বই থেকে যায়। মার্কসবাদ একটি সৃজনশীল দর্শন, এই সামাজিক তথা রাজনৈতিক দর্শন সজ্ঞাত চেতনাকে শিল্প সাহিত্যের মতো অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও সংবেদনশীল মাধ্যমের সঙ্গে মিশিয়ে রসমূর্তি গড়তে গেলে এই মাধ্যমে হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিক পারম্পর্য বিষয়ে সতর্ক ও শ্রদ্ধাশীল থাকা প্রয়োজন, কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে তা হয় না বলেই আধুনিকতার প্রতিস্পর্ধী এই নতুন সাহিত্য নানা বিভ্রান্তিতে আজো ঘুরপাক খাচ্ছে।

লেনিন একদা যে মস্কোর কমসোমল যুব কর্মীদের কাছে কমিউনিষ্ট কবি ভ্লাদিমির মায়কোভস্কির চেয়ে অকমিউনিষ্ট আলেকজান্দার পুশকিনের কবিতার প্রতি তাঁর অধিকতর পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করেছিলেন, কিংবা কার্ল মার্কস তাঁর সমকালীন সমাজতন্ত্রী কবিদের চেয়ে ইসকিলাস, দান্তে সেক্সপীয়ার, গ্যেটে এবং তাঁর বন্ধু স্থানীয় হাইনরিখ হাইনের কবিতার অনুরাগী ছিলেন অনেক বেশী পরিমাণে, রাজতন্ত্রী বালজাক ছিলেন তাঁর প্রিয় লেখক। এসবের কারণ কি? কারণ, মার্কস ও লেনিন এঁদের মধ্যে দেখেছিলেন মানব প্রগতির সৃজনশীল নির্যাসকে যার নাম শিল্প; যে হয়ে ওঠে, যাকে জোর করে হওয়ানো যায় না।

এই হয়ে ওঠা শিল্পের দাবীকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের চেয়ে অধিকতর মূল্য দিয়েছিলেন বলেই ব্যক্তি বালজাকের প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রী চিন্তাকে পরাস্ত করে লেখক বালজাক ও তাঁর সাহিত্য অমর হয়ে আছে, একই কারণে বিপ্লব বিরোধী, প্রতিরোধ বিরোধী, ধর্ম প্রচারক টলস্টয়কে ছাপিয়ে তাঁর সাহিত্য হয়ে ওঠে লেনিনের ভাষায় ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’, গান্ধী বাদী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে বেরিয়ে আসে ভেঙে পড়া সমাজতন্ত্রের সঙ্গে নব্য ধনিকতন্ত্রের দ্বন্দমুখর রূপচিত্র। 

দূর্ভাগ্যের বিষয় মার্কস বা লেনিন সমাজ ও রাজনীতির মতো শিল্প সাহিত্যের নান্দনিক দিকটিকে যথেষ্ট খোলসা করে যাননি। ফলে মার্কসবাদী বা প্রগতিশীলদের হাতে থাকে মার্কস লেনিন প্রবর্তিত রাজনৈতিক তত্ত্বটি। শিল্প সাহিত্যের ওপর এই তত্ত্বটিকে সরাসরি প্রয়োগের ইচ্ছা থেকে একটি ছাঁচ তারা নির্মাণ করেছেন, সৌন্দর্য সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম বহির্ভূত বলে যে ছাঁচটি তাদের নিজেদের কাছেই খুব স্পষ্ট নয়, সে কারণে স্বগোত্রীয় লেখক শিল্পীকেও কখনো কখনো এক কথায় প্রতিক্রিয়াশীল বলে নাকচ করার উগ্রতা লক্ষ্য করা গেছে। 

প্রয়াত ওস্তাদ গুল মোহাম্মদের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম বহুকাল আগে, হুবহু লাইন মনে করতে পারবো না, মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, তিনি বলেছিলেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়কদের মধ্যে তিনিই সার্থক যিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ব্যাকরণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ শ্রোতাকেও তার গানে মুগ্ধ করতে পারেন। 

তত্ত্ব যতো অভ্রান্তই হোক শিল্প সৃষ্টির নিয়মের অধীনতা তাঁকে মাথা পেতে নিতে হবেই। শিল্প সৃষ্টি মানেই সৌন্দর্য সৃষ্টি, সৌন্দর্য সৃষ্টির নিয়ম জানার গণ্ডি ছাড়ানো-- ‘হোথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনখানে’। আরো স্পষ্ট করে বললে, বলতে হয়, ‘সাহিত্য সৃষ্টির ধারা আর তত্ত্বের ধারা এক জিনিস নয় বলেই শিল্পীর মনের চূড়ান্ত যন্ত্রণা অবিশ্রান্তভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে চায়।’ 

(বলাই বাহুল্য সাহিত্য বলতে এখানে তাবৎ শিল্পকলাকেই বোঝানো হচ্ছে।) এও দ্বান্দ্বিকতা। এই দ্বান্দ্বিকতা যেমন সমাজ, ইতিহাসের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি শিল্প সাহিত্য ও তার স্রষ্টার ক্ষেত্রেও সত্য। শিল্প সাহিত্যের স্রষ্টার কাজ যে জীবন তিনি যাপন করছেন লক্ষ কোটি মানুষের সঙ্গে, তাকে অর্থময় করে তোলা বহির্জাগতিক ও আন্তর্জাগতিক দ্বান্দ্বিকতায় স্রষ্টার ব্যক্তিসত্তা যেভাবে বিকশিত হতে থাকে তিনি যে সাড়া দেন, তাঁর দায়বদ্ধতা সেই নিরিখেই বিচার্য। কোনো ক্যাটাগরির নির্দিষ্টতার ভিত্তিতে নয়।


লেখক পরিচিতি

(২৫ মার্চ ১৯৪৮- ১৪ জুন ১৯৯২)

বাংলাদেশে বিভাগােত্তর ষাটের দশকে যে-নতুন ধরনের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়, কায়েস আহমেদকে তার শক্তিমান প্রতিনিধি বলা যায়। খ্যাতি, বিত্ত, ঐশ্বর্য-এসব কিছুরই তােয়াক্কা না করে নিজের নির্জনে তিনি যুক্ত ছিলেন সাহিত্যসাধনায়; অথচ আজ, এর মধ্যেই, এই মহৎ নিভৃতচারী লেখক মাটি ও মহাকালের অংশ। জীবৎকালে চারটি মাত্র বই বেরােয় : ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ (১৯৭৮); ‘দিনযাপন’ (১৯৮৬); ‘নির্বাসিত একজন’ (১৯৮৬); ‘লাশকাটা ঘর’ (১৯৮৭)। গল্প উপন্যাস মিলিয়ে এই ক’টি বই ছাড়া কায়েস আহমেদ আর কিছু রেখে যান নি—অথচ এই অল্পসংখ্যক রচনার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে কথাশিল্পী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ