প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ। প্রকাশক: চন্দ্রবিন্দু |
সঞ্জয় পুণীকের প্রথম কবিতাবই পায়ের লোকাল মুদ্রাদোষে’র পাণ্ডুলিপি থেকে পাঁচটি কবিতা—
অবশেষ
সবকিছু মরে গেছে?
আমাদের নদী
সত্যি কি হয়ে গেছে পিপাসা বিরোধী?
আমরা কি বেঁচে আছি?
আমাদের সংসার, ঘর ও দুয়ার
আঙিনায় বেঁচে আছে আজও?
মায়ের কপালে পড়া ভাঁজও
বাবার দু'চোখ জুড়ে আছে?
ঝড়ে ভাঙা ছাইতন গাছে
জীবন কি ঝুলে আছে মরে যাওয়া কাকতাড়ুয়ার?
জানা গেছে— কিছু নেই,
আঁধারে ও গোপনেই
আমাদের সুখী করে চলে গেছে সংসার, ঘর ও দুয়ার।
আমরা তো শ্মশানের ফুল— চন্দনের শোক,
আমরা দেখেছি ঘুরে বহুদিন—
মানুষের নকল নরক।
আমরা এবার যাবো মানুষের গানে ও ললাটে—
বোনের ঘুঙুর বেচে
গোপনে কিনেছি সুর বুধবার হাটে;
কবরের দিকে যাবো, কবরের ফুল
কিছুটা বিব্রত হবে, সম্বোধনে ভুল
হবে তারও,
লজ্জায় ও সংকোচে তার রঙ হয়ে যাবে গাঢ়।
জলে ও জলজে যাবো, পোকা আর মাকড়ের কাছে
আমাদের সব জমা আছে;
ব্রহ্মার ঘরে ঢুকে চিনে নিবো সে প্রজাপতিকে,
বহুবার থেমে যাবো যেতে গিয়ে বিবাহের দিকে।
সঙ্গমে ও স্নানে যাবো—
শেফালির মতো করে ঝরে যাবো রোজ,
বারবার মরে গিয়ে জেনে যাবো— মরণ সহজ।
পিতলের গেলাসে আঁকা ফুলগুলো
ফুলের ধারণা হতে কিছুকিছু পাপড়ি ঝরে যায়
ধার করা রোদেরোদে তার রঙ বিধবার চোখেতে ভিড়ুক,
পাথরে খোঁদাই করা ফুলগুলো কার গান গায়?
তবে কি ফুলের নামে মানুষ পাথরে আঁকে মানুষের মুখ?
কথাদের জেল হলে বাতাসেরা বসে মদ খায়—
নৌকার পাল ঠেলে কোনদিকে বেদেদের সাথে যায় ভেসে?
হাতঘড়ি অচল হলে হাতে তবু দাগ থেকে যায়—
কথারা বাঁচলে প্রেম, মরে গেলে পরে কবিতা হয়ে আসে।
হাটবারে গাছে-গাছে চলে ফুল ফোটার বিরতি,
সব ফুল সেঁটে গেছে মানুষের আসবাব-বাসনের গায়ে,
সুখের সন্ধানে দেখো চারদিকে লুকানো পিরিতি
নিমেষে আছড়ে পড়ে পাথরের দগদগে পুরাতন ঘাঁয়ে।
তবু—
পিতলের গেলাসে আঁকা ফুল হতে ঘ্রাণ শুঁকে দেখি—
ফুলের ছবিতে মিশে কোনো কোনো ফুল থাকে নাকি!
অরুবালা দাস
ওইদিকে তোমাদের বাড়ি?
দুপুরের নীল রোদে মেলে দেওয়া কৃষাণীর শাড়ি
বেয়ে পড়া জল উড়ে যায় যেইদিকে— বাতাসের ভুলে?
সে শাড়ির আঁচলের নয়নতারা ফুলে
ফুটে আছে বেদনার মতো
লাঙলের ব্যথা নিয়ে কৃষকের দুইচোখ— ক্ষতবিক্ষত—
সে চোখের ভাষা বোঝো তুমি? নইলে কেমনে চেয়ে চেয়ে
সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে গীতার শোলক পড়ো, মেয়ে?
যখন সন্ধ্যাবেলা বিঁধবার শাড়ি হতে রঙ যায় উড়ে,
চড়ুইপাখির পাখা ঝাপটালে কুশান গানের সুরে সুরে
একবার এইদিকে এসো,
আমার বুকের খই খেয়ে যায় কাক হয়ে জন্মানো পিকাসো,
সে খইয়ের ভাজ হতে শাড়ির কোঁচা ভরে তুলে নিও গান,
তোমার ঈশ্বরের পায়ে অর্ঘ্য দিও আমার পরান।
যখন সোনালু ফুল ছুঁতে গিয়ে নুয়ে পড়ে জঙ্গলের বেত,
আমার বুকের 'পরে ভেসে ওঠে গম আর সরিষার ক্ষেত—
তখন তাদের শীষে বয়ে গেলে দখিনের বিরহী বাতাস
কৃষাণীর হাসি নিয়ে আমার সামনে তুমি দাঁড়াবে কি, অরুবালা দাস?
রঙচটা কফিনের সংসার
অনুচ্চারিত দিন হতে খুলে রাখি শোকের পোশাক,
নরকের হাঁসগুলি পৃথিবীর বিছানায় ফের ফিরে যাক।
মুখ হতে বকবক, বুক হতে ঢিপঢিপ কেনা হবে জেনে
আওয়াজের আড়ত খুলেছি পাড়ার এ ছোট্ট দোকানে।
যে ইশারা খেলেছিলো তোমার আঙুলে তার কসম—
চাবিদের যেই ভুলে আলমারি খোলেনি তারও কম
ভুল করে তোমারে ডেকেছি ঘরে, খেতে দিয়েছি জল,
বিশ্বাসে— সংসারে খুলে যায় সন্ন্যাসের সব কৌশল।
তীর্থযাত্রীর থেকে পুরোনো চাদর আর ডাহুকের গান
আমরা পেয়েছি ফিরে, বিশদে ও গোপনে এই আহ্বান
স্বর্গে ও নরকে ছড়িয়ে পড়েছে জানি, আমাদের সুখ—
বড়শিতে গেঁথে থাকে কখনো যেমন করে মৃত মাছমুখ।
সন্দেহে কিছু দিন, আর কিছু দিন পাপে বিগত ফুলের
গাছের নামের কোনো শহরে হেঁটেছি, আর চেনা পুতুলের
রঙ গেছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে, উঠোনসমুদ্রে এসে মিশেছে নদী;
সংসারে ফুটে থাকা কিছু কিছু ফুল তবু সংসার বিরোধী।
শীতলক্ষ্যা
নারীর দোহাই দিয়ে নদী গেছে আচমকা বেঁকে
জলে কার ছায়া ছিলো সেই কথা হয়নি তো শোনা,
কথার প্রসঙ্গে কিছু গভীরের কথা ঢেকে রেখে
সে নদীর বুক চিরে চর ভাসে কেমন দেখো না!
বৈশাখের রাতে রাতে কাঁচা ধানে ঝড় দিলে ব্যথা
বাতাসের হুল্লোড়ে রাত জাগা কৃষকের শোক,
তেমনি আমার ক্ষতে মিশে থাকে ধুলার মমতা
আহারের সুখ নিয়ে অনাহারী পাতিলের চোখ।
তোমারও সূর্য ডোবে? তোমারও শীতলক্ষ্যা আছে?
নিজের বুকের কাছে হাত রেখে খোঁজো তারে, চলো,
থাকলে দেখবে তার তীরে তীরে দুঃখ ফলেছে
সে দুঃখের কসম নিয়ে এইরাতে সত্যি করে বলো—
কাঁদালে কাঁদিতে হয়– এ আদিম বাক্য যদি ঠিক,
আমি তো কাঁদাইনি, কেন আমারে কাঁদাায় চারিদিক?
0 মন্তব্যসমূহ