উঠানের ওপর মাছ ধরার পলাই খাঁচার নীচে পেঁচিয়ে থাকা আধমরা সাপটাকে লোকেরা বলছে আজরাঈল!
সাপ কি কখনও আজরাঈল হয় নাকি! ক্যামনে হয়? হযরত আজরাঈল আলাইহিসসাল্লাম তো জান কবজের ফেরেশতা। নির্ধারিত সময়ে মানুষের জান কবচ করার মহা দায়িত্বপালনকারী তিনি। মিঞারা- সাপ হতে যাবে কেন? এই সব কুফরি । বুঝছ, তোমরা বড়ই গুনাহর কথা কও। এমন কথায় সকলের গোর আজাব শুধু শুধু বাড়বে মিঞারা। খবরদার! – জুমা ঘরের হুজুর সাহেবের গমগমে গলায় উঠানে ভীড় করা লোকগুলো শীত আসার আগেই কেমন জমে বরফ হয়ে গেল। সাপটাকে ঘিরে যে হৈ চৈ হট্টগোল চলছিল তা হঠাৎ থেমে গেল। তবে আয়নালদের বাড়ীর ভেতর থেকে মহিলাদের সমস্বরে পাল্লা দেওয়া কান্দন জোরালো হয়ে বাইরেও তা শোনা গেল। এতক্ষণ বাইরের শোরগোলের সাথে বাড়ীর ভেতরের কান্দনের শব্দটা মিশে ছিল। তাই ব্যাপারটা হয়তো খেয়াল করা যায়নি। হুজুর সাহেব পরিবেশটা বুঝতে পারলেন। গ্রামের আনপড়হ্ মজুর কিষাণ লোকগুলোর হাবভাব দেখে মনে হল, তারা চোখের সামনে নিজেদের গোর আযাব দেখতে পারছে। ব্যাপারটার সমাধান তিনি টানলেন এভাবে- মিঞারা সকলে তাওবা পড়। বলো, আস্তাগফেরুল্লা…
সকলে সমস্বরে হুজুর সাহেবের সাথে তাওবা পড়ার পর যে স্বস্তি বোধ করছে সেটা বেশ বোঝা গেল। সাক্ষাত গোর আজাব থেকে মুক্তি পেলেও তাদের চোখে মুখে আগের প্রশ্নগুলো আবারও ফিরে এল। বয়স্ক মতন একজন কিষাণ হুজুর সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, হুজুর, এই সাপটা আসলে কী সাপ? এই তল্লাটের কেউ তো এরে চিনতে পারতেছে না?
ছোকড়াদের ভেতর থেকে কে একজন নিচুস্বরে বলে উঠল, বাপের জম্মেও তো অমন বাদামি ছাপ ছোপ দেখি নাই গো--
যে সাত আটজন তরুণ ছোকরা সাপটাকে বাউছেচ্চান পাথার থেকে গর্ত খুঁড়ে টেনে বের করেছিল তাদের একজন আয়নালের প্রিয় দোস্ত বশির আলী। সে বড় রাস্তার দিক থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এল। তার কাছ থেকে খবর জানা গেল দশ গ্রাম দুর থেকে বিখ্যাত সাপুড়িয়া কবিরাজ আনোয়ার হোসেনকে পাওয়া গেছে, তিনি আসতেছেন। তাকে আনতে গিয়েছে লিটন মিঞা। মোটর সাইকেল স্টার্ট করার আগে লিটন মিঞা মোবাইল ফোনে খবর দিয়েছে। আসতে আর বড় জোর আধ ঘন্টা।
হুজুর সাহেব পলাইটার কাছাকাছি গিয়ে বাইরে থেকে সাপটাকে গভীরভাবে দেখতে লাগলেন। বিড়বিড় করে তিনি মুখে কিছু একটা বলছেন কিন্তু তা কারও কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। তবে হাবভাবে হুজুর সাহেব যে সাপটাকে চিনতে পেরেছেন, সেটা সবাই বুঝল। আগের সেই বয়স্ক কিষাণ কৌতুহল দমাতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, হুজুর গো, সাপটারে কি চিনতে পারলেন?
হুজুর সাহেব চোখ বন্ধ করে সোজা হয়ে দাড়ালেন। সবাই চুপ করে অপেক্ষায় আছে তিনি কখন চোখ খুলবেন। এমন সময় উঠান ঘেষে আয়নালদের দুয়ার খোলা চালা ঘরের অন্ধকার থেকে গাই গরুরটার আর্তনাদ ভেসে এলো। দুই তিনজন ছুটে গেল সেই দিকে। সেখানে এইমাত্র একটা খয়েরি লাল বাছুরের জন্ম হলো। সদ্যজাত বাছুরটির গা মাথা চেটে দিচ্ছে গাই মা। তুলতুলে শরীরের মায়াবী চোখের বাছুরটি কোনওরকমে উঠে দাঁড়াতে চাইছে। কাকে যেন আপসোস করতে শোনা গেল। লখিন্দরের কপাল দেখো! কাইলে বিয়া করা নয়া বউ ঘরে তুললো। আর রাইত না পার হ্ইতেই কি হইয়া গেল!
চালা ঘরের অন্ধকার থেকে চার পায়ে টলতে টলতে ফুটফুটে ছোট্ট লাল বাছুরটা উঠানে বেরিয়ে পড়ল। একজন বাড়ীর ভেতরে গেল খবরটা দিতে। সুখবর হলেও আয়নালের বুড়ি মা কপাল-বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বাছুর গাইটার দিকে ছুটে গেল। দৌড়াতে গিয়ে বুড়ি ঠনঠনে উঠানের শক্ত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে বাড়ীর ভেতর থেকে পাড়া-পড়শী বয়স্কা বৃদ্ধারা আয়নালে মায়ের দিকে মাতম করতে করতে ছুটে এসেছে। দুর্ভাগ্য বয়ানের মাতম গীত শুনতে শুনতে বাইরের জটলাটা বুড়িকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল।
কোন বা সর্প কাটিল রে আয়নাল//কোন বা ঘরে থাকি রে//নতুন বউ হে নাগিন হামার//পরথম রাইতে কাটিল রে//ওরে মোর কলিজার টুকরারে//
হুজুর সাহেব মহিলাদের ঘিরে থাকা জটলার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে হুকুম করলেন, ইনাদের বাড়ীর অন্দরে নিয়ে যাও। বাইরে বেগানা পুরুষের সামনে এমন মাতম করা ঠিক না, গুনাহ হয়। তার চেয়ে বলতে হয়, আল্লাহুমা রাব্বীর হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগিরাহ।
মাতম গীত করতে থাকা মহিলাদের দলটি দমে গেল। তারাই বুড়িকে ধরে টেনে উঠিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। লাল বাছুরটা তখন নতুন পৃথিবীতে হতভম্ভ উঠানের ভীড় হইচই কান্নাকাটি দেখে ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছিল। সে আবার টলতে টলতে হাঁটতে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাফাতে শুরু করলে সকলে অপলক চেয়ে রইল। ক্ষণিকের জন্য সকলে যেন ভুলে গেল এখানে কী ঘটেছে...
হুজুর সাহেব উপরে তাকিয়ে দুইহাত মোনাজাতের ভঙ্গিতে খাড়া করলেন। বললেন, সব তাঁর ইচ্ছা। তিনি পলাইটার দিকে এগিয়ে গেলেন। পলাইর বাইরে থেকে ভেতরের বন্দি সাপটা গভীরভাবে দেখলেন। বললেন, আয়নালের গোসল দেওয়া হয়েছে? জানাজার টাইম কখন?
সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি শেষে একজন বললেন, হুজুর, কবিরাজ আসতেছেন, শুনছি কবিরাজ নাকি বিষ নামাইতে পারে। আয়নালের গায়ের বিষ যদি ঝাড়তে পারে, যদি আয়নাল আবার বেঁচে ওঠে—
হুজুর সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ধবধবে সাদা দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে শুধু বললেন, আচ্ছা। হুজুর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পলাইর খাঁচার ভিতর দিয়ে সাপটার দিকে আরো ভালভাবে তাকালেন। সাপটা নিজের শরীরকে পেঁচিয়ে দলা করে রেখেছে। চোয়াল মুখ কোন প্যাঁচের ভেতর সেঁধিয়ে রাখা তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে দম যে আছে, তা বোঝা যায় দেহের ওঠা নামা দেখে। লম্বায় খুব যে বেশি তা নয় তবে গা দেখে বোঝা যায় বয়েস আছে। বাদামী পিঠের ওপর দিয়ে ছাই রঙা নকশার দিঘল চক্র। সাপটার কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাই হয়তো নড়তে চড়তে পারছেনা। এখনো কোমর গা বরাবর বর্ষা হানা জায়গাগুলো থেকে আঁশ-ছাল ছিলে ফাঁক হয়ে আছে।
হুজুর কি সাপটাকে চিনতে পারছেন? সেই বুড়ো কিষাণ আবার জিজ্ঞেস করলে হুজুর সাহেব এমন ভাবে মাথা ঝাকালেন তাতে ঠিক বোঝা গেল না তিনি হ্যাঁ নাকি না উত্তর করলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে সকলের মুখোমুখি হয়ে ঘোষণা করলেন, মিঞারা, জ্বীন জাতি নানান রূপ ধারণ করতে পারে। তয় আমার বলার সাধ্য কি, যে এইটা কী সাপ!
উপস্থিত সকলে হুজুর সাহেবের পিছে এসে লাইনে দাঁড়ালেন। তিনি আগের মতোই হাত উঁচু করে আবার দোয়া ধরলেন। অচিন ভাষার সুরেলা দোয়ার কী যে মানে তা না কেউ স্পষ্ট না বুঝলেও এতে যে সবার মঙ্গল হবে এই নিশ্চয়তায় সকলে হাত তুলে আমিন, আমিন ধ্বনিতে চোখের পাতা ভিজিয়ে ফেললো।। দোয়া পড়া শেষ হলে হুজুর সাহেব বড় রাস্তার বাঁকের দিকে চলে গেলেন যেখানে গিয়ে উঠান শেষ হয়েছে। যাওয়ার আগে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধুই বললেন, সব তাঁর ইচ্ছা। উঠানে থাকা সকলের চোখেমুখে তখন প্রশ্ন একটাই। বিয়ের রাতটা পার না হতেই এত ভোরে আয়নাল কেন বাউছেচ্চান পাথারে গেল?
প্রশ্নের মানেটা বুঝতে পেরেই কিনা বশির আলী ঝটপট উত্তর দিচ্ছিল, বলল, ঘাস কাটতে। কিন্তু শিঙ মাছের গর্তে হাত দিয়েই তো-।
বয়স্ক একজন তাকে থামিয়ে দিল, বলল, যা বোঝনা বাপু তা নিয়ে কথা কওয়াটা ইচড়ামো। বাসর রাত পার হতে না হতে কেন সে মাছ ধরতে যাবে পাথারে? বাড়ীতে কি তার খাওয়ার আকাল আছিল, অ্যাঁ? নাকি পাথারে মাছের বোয়াইত পড়ছিল রে? শেষ কথাগুলো বশিরকে উদ্দেশ করে বলার পরে সে আবার অন্যদের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল--এর মধ্যে কী রহস্য আছে? বলতে পারো মিঞারা?
সকলের মুখ চাওয়া চাওয়িতে এটা পরিষ্কার হলো যে, হুজুর সাহেবের ইঙ্গিত তাহলে সত্য। জ্বীনের আছর না হলে আয়নাল এত ভোরে উঠে পাথারে যাবে কেন?
তড়িৎ লুঙ্গিতে মালকোচা ছেড়ে দিলেন বশীর আলীর বাপজান গফুর আলী। ছেলেরা বর্ষার ডগা দিয়ে খুঁচিয়ে সাপটা ধরে আনলে গফুর আলীই প্রথম সাপটাকে তার হাতে থাকা বাঁশের কাড়াল দিয়ে মেরেছিল। মেরে কোমরটা ভেঙে দিয়েছিল। এখন তার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। যদি সত্যিই জ্বীনের আছর হয়ে থাকে তাহলে তার পরিণতিই বা কী হবে? সে হাঁসফাঁস করতে করতে দৌড়ে গেল বড় রাস্তার দিকে, যেদিকে একটু আগে হুজুর সাহেব গেছেন। হুজুর সাহেব বোধ হয় এতক্ষণে জুমা ঘরে পৌঁছে গেছেন।
২.
অন্দরে মাতমের স্বর তখন ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়েছিল। তল্লাটের নামকরা কবিরাজ আনোয়ার হোসেন আঙিনায় পা দিয়েই জোরেশোরে আচমকা হাঁক দিয়ে উঠলেন, রাখে আল্লায় মারে কে!
মাটির ঘরের বারান্দায় আয়নালকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। নতুন মাগী বোবার মত নিথর হয়ে আয়নালের দেহের পাশে বসা। মাগা’র গায়ে নীল রঙের নতুন শার্টের দিকে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। যেন শার্টের ভেতরে থাকা আয়নালের থেমে যাওয়া বুকের ওঠানামা এক্ষুণি শুরু হবে- সেই অপেক্ষায় সে বসে আছে। কবিরাজ আয়নালের বাম হাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন। কবিরাজের সাথে একজন অল্প বয়স্ক কোয়াক ডাক্তারও এসেছেন। তিনিও স্টেথেসকোপ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নালকে দেখতে লাগলেন। দেহের বিভিন্ন স্থানে টিপে টিপে দেখলেন। এরপর তার জিহ্বা আর চোখের মনিও তিনি পরীক্ষা করলেন। আয়নালের বাম হাতের মধ্যমার একটু ওপরেই হাতের তালুর উল্টোদিকে ছোট্ট দুটো দাঁতের দাগ পাওয়া গেছে। ডাক্তার ও কবিরাজ দুজনেই দাগ দুটো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের দুজনের চোখাচুখিতে কিছু একটা সিদ্ধান্ত হলো। আধ পাকা লম্বা চুলের বাবরি দুলিয়ে কবিরাজ আবারো আচমকা আয়নালকে বসিয়ে দেওয়ার আদেশ করলেন। সকলেই বলেছিল ছেলেটা মরেছে, কিন্তু কবিরাজের আদেশে উপস্থিত সকলের মধ্যে আয়নালের বেঁচে ওঠার সম্ভাবনাও যেন জেগে উঠলো। আয়নালের শিশুকালের বন্ধু বশির এগিয়ে গিয়ে আয়নালের শক্ত হয়ে থাকা ঘাড় মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলো। কবিরাজ তার ময়লা মাখা পুরনো ঝোলাব্যাগ হতে কালো সুতার ঢোপটা বের করে আয়নালের হাতে গুণেগুণে পেঁিচয়ে দিলো। কবজি থেকে ওপরের বাহু পর্যন্ত চারটা গিট বেঁধে দিয়ে তিনি বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়া শুরু করেন। আয়নাল হয়তো বেঁচে উঠবে, কবিরাজ তার মন্ত্রগুণে বিষ নামিয়ে ফেলবেন এই আশা সকলের মধ্যেই সঞ্চার হল। সবাই অপেক্ষা করে আছে সেই মহাক্ষণের। এক্ষণে আয়নাল খক খক করে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। বুড়ি মা এগিয়ে গিয়ে নতুন মাগীর পাশে গিয়ে বসেছে আয়নালের কাছ ঘেঁষে। কবিরাজ মন্ত্র পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কালো সুতার গিট গুলোতে একটা একটা করে তাবিজ বেঁধে দিচ্ছেন। মন্ত্র পড়া শেষে তিনি পিতলের গ্লাসে রাখা পানি পাঁচ আঙুলে ছুইয়ে রোগীর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিতেছেন এমন সময় ভীড় থেকে কে একজন চিৎকার করে উঠল, ঐ যে, পায়ের বুড়ো আঙুল নড়তেছে, দেখো। কবিরাজ সাহেব অলৌকিক মন্ত্রের শেষ শ্লোকগুলো বিড়বিড় করলেন। এরপর জানালেন, আমার কাজ শেষ। এরপর বললেন, চল এবার জন্তুটাকে ভাল করে দেখি। কালো লুঙ্গির কোঁচায় কবিরাজ নিজের ময়লা গামছাটা শক্ত করে বেঁধে সোজা হয়ে দাড়ালেন। লম্বা পায়ে ভীড়টা তাকে বাইরে উঠানের পলাইর দিকে নিয়ে গেল। ক্ষণিক বাদে সকলেই দেখতে পেলো আয়নালের হাতের আঙুলও নড়ছে। বুকের ওঠানামা না বোঝা গেলেও, কবিরাজের সাথে আসা গঞ্জের গ্রাম ডাক্তার জানালেন, আয়নাল এখনও মরে নাই। বিষের কারণে তার শরীরের সব পেশি অচল হয়ে আছে। সময় খুবই কম। এখন দ্রুত একে জেলার হাসপাতালে নিতে হবে। তবেই সে বাঁচলেও বাঁচতে পারে।
চারিদিকে শোর পড়ে গেল, আয়নাল বেঁচে আছে রে। আয়নাল মরে নাই। নসিমনে করে জেলার হাসপাতালে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। লিটন আর বশির হাসপাতালে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে গেল।
৩.
ঠাসা ভীড়ের ভেতর কাউকে বলতে শোনা গেল কবিরাজের বাহাদুরির কেচ্ছা। কবিরাজের সাথে আসা অল্প বয়স্ক গ্রাম ডাক্তারটির গুনাগুণও প্রচার হতে থাকল। কবিরাজ সবাইকে শান্ত হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
তখনও পলাইর ভেতর পেঁচিয়ে থাকা সাপটা তেমনই পড়ে আছে আগে যেমনটা ছিল। সাপটা দেখে কবিরাজ আৎকে উঠলেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, এই জিনিস ছিল কোথায়? কোন খান থেকে একে পাওয়া গেছে? ছেলে ছোকরারা যারা সাপটা ধরে এনেছিল, তারা জানাল, পাথারের যেখানে ডীপ টিউবওয়েল তার পানির নালার ধারে একটা মাছ থাকার গর্তে সাপটা ছিল। আয়নালই সকালে তাদেরকে গর্তটা দেখিয়ে দিয়েছিল।
তাদের একজন জানাল, আয়নাল সেখানে ভোরে গিয়েছিল গাভীন গাইটার জন্য ঘাস কাটতে। গর্তের পানিতে ঘোলা দেখে সে ভেবেছিল শিঙ মাছের হাড়ি। ভেতরে হাত গলিয়ে শিঙ মাছ ধরতে গিয়ে প্রথমে মনে করেছিল বুঝি বা শিঙ মাছে কাঁটা বিন্ধিয়েছে। এরপর ভয়ে গর্তে আর হাত না গলিয়ে কাটা ঘাসের বস্তা নিয়ে বাড়ী ফিরেছিল সে। কিন্তু সকাল যত গড়াল তার হাত পা ততই ভারী হয়ে উঠল। তখনও কেউ ভাবেনি সেটা আসলে সাপের বিষ। আয়নাল বলাবলি করতেই উৎসুক কেউ কেউ এগিয়ে এল, হাতটা দেখে বলল, মাছ না বাপু, এই খরালির দিনে মাছ কই পাবা? সাপ না হয়ে যায় না। তাড়াতাড়ি কবিরাজ ডাক। কেউ কেউ সাপের বিষ কী না সেটা পরীক্ষার জন্য আয়নালকে কাঁচা চাল মুখে চাবাতে বলেছিল। যদি বিষাক্ত সাপ হয় তবে দাতে টক লাগবে। আর যদি ঢোড়া সাপ হয় তবে চিন্তার কিছু নাই। আয়নাল ভয় পেয়ে গেল যখন সে দাতে টক অনুভব করল। আর তখনই আয়নালের সঙ্গি ছেলে ছোকরারা হই হই করে সাপটা ধরতে পাথারে গেল। আয়নালই তাদের সেই গর্তটা দেখিয়ে দিল। পাথার থেকে বর্ষার ফলায় সাপটা ধরে আনা দলটার সাথে বাড়ীতে ফিরেই আয়নাল মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।
এখন বেলা গড়াতে শুরু করেছে। কবিরাজ সাহেব পলাইটা সরানোর নির্দেশ দিলেন। কেউ ভয়ে সাপটার কাছে না গেলে তিনি নিজেই পলাইটা সরিয়ে দিলেন। তার হাতের ময়লা ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট কাল লাঠি বের করলেন। পেঁচিয়ে থাকা সাপটাকে সতর্ক হাতে সেই লাঠি দিয়ে সোজা করে দিলেন। চেরা জিহ্বার ভারী প্রশ্বাসে জন্তুটা জেগে উঠেছে, মাথা ঘাড় বাকিয়ে সামনে চলার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ, কারণ সকালেই বাঁশের কাড়াল দিয়ে বর্ষাবিদ্ধ সাপের কোমরটা ভেঙে দিয়েছিল গফুর আলী।
বয়স্ক এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল, কবিরাজ সাহেব কি সাপটারে চিনতে পারলেন?
কবিরাজ বললেন, আমি এই সাপ আগে কখনও দেখি নাই। তবে এর জাত আমি চিনি। আমি অনেক বাইদার কাছে এর গল্প শুনছি। বাইদারা এরে বলে- বোড়া। কিন্তু এই সাপ তো এই তল্লাটের না। দক্ষিণে সাগর পাড়ের বনে জঙ্গলে এরা থাকে। তবে এই সাপ এই তল্লাটে আইল ক্যামনে সেইটা একটা প্রশ্ন! হ্যাঁ, হইতে পারে যে বানে ভেসে আসতে পারে। কিন্তু অনেক বছর ধরে এমন বান তো হয় নাই, যাতে বোড়ারা এই তল্লাটে আসতে পারে!
সুযোগ মতন সেই বয়স্ক বৃদ্ধ জানালেন, হুজুর সকালেই বলছিল না বদ জ্বীনেরা কত কিছুর রূপ নিতে পারে! কবিরাজ সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অন্য একজন জিজ্ঞেস করল, কবিরাজ সাহেব আপনার কী মত? হুজুরের কথা কি ঠিক? কবিরাজ সাহেব উত্তর দিতে পারলেন না, তবে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সকলে বুঝল, হুজুরের কথাই ঠিক। এমন কি কবিরাজ সাহেবের চোখেমুখেও এমন কিছুরই বিশ্বাস ভর করে রইল।
তবে তিনি জন্তুটাকে ভাল করে পরখ করতে চাইলেন। বললেন, যদি বদ জ্বীন হয়েও থাকে, তবে এটা ধরা দিল ক্যামনে? তিনি আরো বললেন, এটাকে কেউ মারবেন না। একে খাঁচায় আটকে রাখুন। আমি বাইদাদের খবর পাঠালে, দুই একদিনের মধ্যে ওরা এসে একে নিয়ে যাবে। কবিরাজ পলাই দিয়ে আবারো সাপটাকে আগের মতই বন্দি করে রাখলেন।
আয়নালকে নিয়ে জেলার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জেলার হাসপাতাল এই অজ গা হতে অনেক দুরে। ইন্জিনের নসিমনে করে নিতেও সময় লাগবে প্রায় ঘন্টা তিনেক। সকলের মনে একটাই চাওয়া, হতভাগাটা বেঁচে উঠুক। হুজুর সাহেবের মত করেই একজন বলে উঠলেন, আল্লা’মাবুদ সব জানেন। সব তার ইচ্ছা।
উঠানে পলাইটা ঘিরে গাছের ছায়ায় বসে পাহারা দেওয়া দুই একজন ছাড়া গাঁয়ের সকলেই যার যার কাজে চলে গেল। কবিরাজ সাহেবকে আবারও মোটরসাইকেলে করে গঞ্জের দিকে নিয়ে গেল লিটন মিঞা। জেলা হাসপাতালের দিকে চলে যাওয়া বড় রাস্তার পাশে মাথায় হাত রেখে আয়নালের বুড়ি মা টা ধুলায় মাটিতে বসে আছে। আয়নালের নতুন বউটা বুড়িকে ধরে উঠিয়ে বাড়িতে আনার চেষ্টা করল। ততক্ষণে ফাঁকা উঠানে আবার টলতে টলতে লাল ফুটফুটে বাছুরটা বেরিয়ে পড়েছে। নাক সিটকিয়ে সে উঠানে মাটি ধুলার গণ্ধ শুকছে। গোয়ালের ভেতর সদ্য মা হওয়া গাইটা ‘হাম্বা’ ডাক পাড়ল। যার অর্থ হতে পারে, বেশী দুর যেও না মানিক সোনা!
৪.
জেলার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও আয়নালকে বাঁচানো যায়নি, অথবা আয়নাল আসলে বেঁচেই ছিল না। হাসপাতালে নিলে ডাক্তার তাকে ভর্তিই করায়নি, গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে জানিয়ে দিল লাশের গাড়ীর সাথে থাকা বশির। ইন্জিনের নসিমনটি লাশবাহী গাড়ী হয়ে বাড়ীতে ফিরল সন্ধ্যা রাতে। কথায় কথায় সাপে কাটার ঘটনাটা খবর হয়ে গেল আশপাশের দুই চার গ্রাম থেকে আরো অনেক দুর পর্যন্ত। সাপে কাটা মরা দেখতে বাড়িতে ভীড় জমিয়েছে গঞ্জ থেকে বড় রাস্তা ধরে বাড়ী ফেরা লোকজনও।
উঠানে হারিকেন জ্বালিয়ে পলাইর নীচে থাকা সাপটাকে পাহারা দিচ্ছে কয়েকজনে মিলে। গঞ্জ থেকে আসা কেউ কেউ টর্চ ফেলে সাপটাকে এক নজর ভাল করে দেখে নিচ্ছে। কেউ বলছে, কী আজব সাপরে বাবা!
নেছপার ব্যাপারিও ভাল করে এক ঝলক দেখে নিল সাপটার নিথর পড়ে থাকা। ব্যাপারি পরিবারের ঘর গেরস্থালী কাজের সব দেখাশুনা করত আয়নাল। গরুর খাবার দেওয়া, ঘাস কাটা, জাল ফেলে পুকুরের মাছ তোলা, ক্ষেতের নাড়াই মাড়াই থেকে শুরু করে ভাতের উনুনের মুখে তুষ ছিটানো সবই করতে পটু ছিল আয়নাল।
আয়নালকে বিয়ে করিয়েছিল ব্যাপারি সাহেব নিজেই। গঞ্জের পিঠে দক্ষিণ বাতাসনের ময়নাখুলি গ্রামে বাপ মা মরা মেয়ে বিউটি বানু তার ফুফুর বাড়িতে মানুষ। দক্ষিণে বিয়ের কথা-বার্তায় আয়নালের মা প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল। আপত্তি জানিয়েছিল কারণ গ্রামের অনেকেই এটা এখনও মানে যে, দক্ষিণে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে করালে একটা না একটা বিনাশ হবেই। এটা তো জানা কথা, আয়নালের মা নিজেই তার প্রমাণ। আয়নালের বাপ দক্ষিণ বাতাসনের উছলাপাড়ার গেরস্থের ছাওয়াল, বিয়ের দুই বছরের মাথায় হঠাৎ ভাল মানুষটা গঞ্জ থেকে বাড়ি ফিরেই ছটফট করতে করতে মরে গেল। তারপরেই তো অপবাদ নিয়ে বাপের ভিটায় ফিরতে হয়েছিল শিশু আয়নালকে নিয়ে। আয়নালের মা অনেকের কাছ থেকেই শুনেছিল সেই পুরনো কালের দক্ষিণ বাতাসন আর উত্তর সরহাট্টা গ্রামের আরো গন্ডাখানেক এইরকম বিনাশের ঘটনা।
নেছপার ব্যাপরি বলেছিল, ধুর ঐ সব কেচ্ছা কাহিনি। বৃটিশ আমলের জমিদারির সময় দক্ষিণ বাতাসন আর উত্তর সরহাট্টা ছিল দুই রাজ্যের সীমানা বর্ডার। কারণে অকারণে দুই রাজ্যের মানুষের ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকত। তখনকার দিন জমানার গল্প কি আর এই আমলে চলে? বাপ মা মরা মেয়ে হলেও সুন্দরি আর লক্ষীরূপ কি সবসময় একসাথে মেলে? উত্তর আর দক্ষিণের সেই বিবাদ এখন তো কেউ মানে না, দেখনা, এখন উত্তর দক্ষিণের সম্বন্ধে কোন বিনাশও হয়না। ব্যাপারি সাহেবের নিজের পরিবারই তো দক্ষিণ বাতাসনের। কই, কি বিনাশটা হয়েছে?
আয়নালের মা তখন আর আপত্তি না করলেও এই ছেলে হারানোর রাতে নেছপার ব্যাপরিকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে কেটে সেই সময়ের আপত্তির কথাই আবার তুলে ব্যাপারিকে দুষছিল, কই ব্যাপারি, বিনাশ তো হইলই, এখন কী কবা? সাথে নতুন বউটার দিকে আঙুল তুলে গজ গজ করতে করতে বুড়ি আরো বলল, ঐ যে নাগিন, আমার ছেলেটারে বিয়ার প্রথম সকালেই কাটল রে নাগিন।
মাটির বারান্দায় বাশের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে এখনও লাল শাড়ি পরে বসে আছে সদ্য বিধবা বউটি। কিশোরী বিউটি বানু সারাদিনের মত তখনও শুষ্ক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইল। নেছপার ব্যাপারি বিউটির দিকে এগিয়ে গেল, ভারি গলায় বলল, কী বলবরে মা, সব দোষ আমার।
হয়ত এতক্ষণে তার প্রতি সহমর্মিতার স্বরে এই প্রথম কেউ কিছু বলাতে কী না কে জানে, হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে ব্যাপারি সাহেবের বুকে আছড়ে পড়ল বাপ মা স্বামী হারা ছোট্ট মেয়েটা। এখনও সে কোন মতে বুঝে উঠতে পারছেনা, কী থেকে কি হয়ে গেল!
৫.
রাত গড়াতে থাকলে উঠানের ভীড় হালকা হয়ে এল। দুর গ্রামের দেখতে আসা লোকেরা ফিরে যেতে শুরু করেছে। সেই ছেলে ছোকরারা যারা সকালে পাথার থেকে সাপটা ধরে এনেছিল, তারাই পালা করে এখনও পলাইর নিরাপদ দুরত্বে দাড়িয়ে বা বসে সাপটাকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ সাপটাকে মেরে ফেলার কথা বললেও ভয়ে কেউ সাপের গায়ে হাত উঠাতে রাজি হয়নি। হুজুর সাহেবের কথা মত যদি বদ জ্বীনের আছর হয়, তাহলে তো যে সাপের গায়ে হাত তুলবে তারও একটা কিছু ঘটে যেতে পারে!
আবার কেউ কেউ কবিরাজের কথায় সায় দিয়ে সাপটা বাঁচিয়ে রাখার কথাই বলেছে। বাইদারা আসলে না হয় তারাই ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাইদারা আসবে কখন? যদি তারা আসতে দুই তিন দিন লাগিয়ে দেয়?
শেষে হুজুর সাহেব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আগে জানাজা দাফন হোক পরে বিষয়টা দেখা যাবে। অনেকের সাথে ব্যাপারি সাহেবও সেই কথায় সায় দিয়েছেন। আরো সিদ্ধান্ত, অযথা দেরী করা ঠিক হবে না, রাতেই জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হবে। সে মতন জুমা ঘরের মিনারে ঘোষনাও দেওয়া হল।
আয়নালের গোসল দেওয়া শেষ হলে কাফনে মুড়িয়ে খাটিয়ায় করে তাকে জুমা ঘরের সামনের ময়দানে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে দুই চারটা হ্যাজাক বাতি লাগানো হয়েছে। গ্রামে এখনও বিজলী বাতি না আসায় যে কোন অনুষ্ঠানে হ্যাজাক বাতিই ভরসা। পাশের গ্রামের জুলু মাতব্বর এই ওয়ার্ড থেকে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনিও জানাজায় অংশ নিতে এসেছেন। জানাজার লাইনে দাড়িয়ে উপস্থিত গণ্যমান্যদের কাছে তিনি গ্রামে বিজলী বাতি আনার অগ্রগতির খবর দিচ্ছিলেন। গত ইউনিয়ন কাউন্সিল ইলেকশনের আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলে গ্রামে বিজলী বাতির ব্যবস্থা করবেন। সেই ভোট শেষ হয়ে নতুন ভোটের সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি কারণে যেন ভোটও আর হচ্ছেনা, আর বিজলী বাতিরও কোন খবর নাই।
হুজুর সাহেব জানাজার সকল প্রস্তুতি শেষ করে সকলকে সোজা কাতারে দাড়ানোর নির্দেশ দিলেন। এবার মরহুমের পক্ষ থেকে ব্যাপারি সাহেবকে কিছু বলার জন্য জানানো হলে, তিনি লাইনে দাড়িয়েই সকলের কাছে আয়নালের শৈশব থেকে তার বাড়িতে মানুষ করার স্মৃতিচারণ করে বললেন, কোন বেয়াদবি বা ঋণ থাকলে যেন সবাই তা মাফ করে দেন। এমন সময় জানাজার লাইন থেকেই কেউ একজন জোরে অর্তনাদ করে করে উঠলেন, হুজুর, সাপ! আয়নালের খাটিয়ায় সাপ ঢুকল যে!
এমনতর চিৎকারে সবাই হতভম্ব হয়ে কে কি করবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সকলের আতঙ্কিত চোখ তখন হ্যাজাক বাতির পাশে থাকা কাপড়ে ঢেকে রাখা মোর্দার খাটিয়ার দিকে। সকলে সাপ খুঁজছে, হুজুর সাহেবও সেদিকে ভাল করে চেয়ে রইলেন। বেশ বোঝা গেল, সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জুলু মাতব্বর রাগের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কে দেখেছে সাপ? আমরা তো কেউই দেখলাম না! কে দেখেছে?
হুজুর, আমিই দেখছি- হুজুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে লোকটি জোর গলায় বলে উঠলেন। দ্বিতীয় সারি থেকে বুড়ো গফুর আলীকে দেখা গেল, যে সকালবেলা তার বাঁশের কাড়াল দিয়ে পলাইয়ের ভেতরে থাকা সাপটার কোমর ভেঙে দিয়েছিল।
সকলের মধ্যে একটা বড় সড় গুঞ্জন উঠলে হুজুর সাহেব সবাইকে শান্ত হতে নির্দেশ দিলেন। স্বভাবমত বললেন, সব তাঁর ইচ্ছা। জানাজায় দাঁড়িয়ে কোন হট্টগোল করা গুনাহর কাজ। সাপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে। আগে সবাই জানাজার নিয়ত করেন।
জানাজা শেষে মোর্দার খাটিয়া ঢাকা কাপড় সরানো হল, কিন্তু সাপ তো দুরের কথা কোন সাপের আলামতও পাওয়া গেল না। গ্রামের এজমালি গোরস্তানে আয়নালের দাফন সম্পন্ন হলে সবাই আবার জুমা ঘরের ময়দানে আসলেন। সাপের বিষয়টা আগে ফয়সালা হওয়া দরকার। জুলু মাতব্বরও বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, লোকটা বেয়াদবি করেছে কি না, কে জানে!
না মেম্বার সাব, আল্লার কসম, আমি সাপটাকে খাটিয়ার তল থেকে খাটিয়ায় উঠতে দেখছিলাম, গফুর আলী বলল। সে আরও জানাল যে, এই সাপটাও ঠিক একইরকম, যেটা আয়নালকে কেটেছিল।
বিষয়টা বড়ই চিন্তার, হুজুর সাহেব সগোক্তিতে বলে উঠলেন। তিনি গফুর আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কি করে হয়, মিঞা? তুমিই তো সকালে বললা, তুমি সাপটার কোমর ভাঙছ। আর সেটা তো এখনও পলাই খাঁচায় বন্দি। সেটা কী করে এখানে আসবে!
হুজুর, সেইটা তো আমি জানি না, আমি কেবল সাপটাকে খাটিয়ার ভেতর ঢুকতে দেখলাম যে!
জুলু মাতব্বর বললেন, চল মিঞারা দেখাও সেই সাপটা। কোথায় সেই পলাইর খাঁচা?
কৌতুহলী গ্রামবাসী সকলেই জুলু মাতব্বরকে নিয়ে গেল আয়নালদের বাড়ীর উঠানে। বড় রাস্তার বাঁক থেকে উঠানে পা দিতেই হ্যাজাকের ঝলমলে আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল, উঠানের এক কোণ থেকে একটি অল্প বয়স্ক মেয়ে হারিকেন হাতে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। শাড়ি পরা মেয়েটি যে আয়নালের সদ্য বিধবা বউ, সেটা অন্যদের মত নেছপার ব্যাপারিও চিনলেন।
জুলু মাতব্বর বললেন, কই সেই সাপ?
পলাইটার কাছে গিয়ে দেখা গেল খাঁচাটা উল্টে পড়ে আছে, পাশেই একটা কুড়াল। আর এটাও স্পষ্ট, এই কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে একটু আগেই সাপটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। শক্ত চামড়ার সাথে দেহের টুকরাগুলো তখনও আটকে থেকে মৃদু নড়াচড়া করছে। তবে মাথাটা আলাদা হয়ে কুড়ালের কোপের সাথে তৈরি হওয়া ঈষৎ মাটির গর্তের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
জুলু মাতব্বর জানালেন, এই সাপ তো কাটা পড়ছে। এবার বল দেখি গফুর আলী, তুমি সত্যিই কী দেখছিলা?
হুজুর সাহেব এগিয়ে এসে জানালেন, মাতব্বর সাহেব, গফুর আলীর দেখাটা সত্যি হইতে পারে। এই সাপটা কোন সাধারণ সাপ নয়। এইটা বদ জ্বীনের আছর না হয়ে যায় না। এই দ্যাখেন, প্রমাণ নষ্ট করার জন্য ওই বেয়দ্দব বউ একে কোপয়া টুকরা করছে। বউটাই যত নষ্টের গোড়া।
গফুর আলী সহ অনেকই হুজুর সাহেবের সাথে সুর মেলাল, হুজুর ঠিক কথা কইছে, মাতবর সাব।
জুলু মাতব্বর কিছু একটা বলতে যাওয়ার আগেই হুজুর সাহেব বাড়ীর দিকে মুখ করে হুঙ্কার দিলেন, আমার নির্দেশ অমান্য করে এই সাপ মারল কে? কার এত বড় হিম্মৎ হয়?
হুজুরের সাথে মিলিয়ে আরেকজন বললেন, কই? পাহারা দেওয়া ছেলে ছোকরারা গেল কই?
ছেলেদের একজন মাথায় টুপি পরে এগিয়ে এসে নম্র স্বরে জানাল, চাচা, আমরা তো জানাজায় গেছিলাম।
হুজুর সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, আমি সকালেই বলছিলাম, বদ জ্বীনের আছর! এই সাপ সাধারণ কোন সাপ না। আর এই বউটার সাথেই এর কোন না কোন যোগ সংযোগ আছে। মিঞারা সকলে সতর্ক থাকেন, এই গ্রামের ওপর বদ জ্বীনের আছর পড়ছে।
জুলু মাতব্বর নির্দেশ দিলেন বউটাকে সামনে আনতে। বললেন, ঘটনা শুনতে হবে। ডাকো আয়নালের বউকে। নির্দেশ মত আয়নালের ক্লান্ত রুগ্ন বুড়ি মা বিউটি বানুকে নিয়ে উঠানে বেরিয়ে আসলেন। আসামীর মত দাড়িয়ে থাকা বউটার দিকে তাকিয়ে মাতব্বর সাহেব আদুরে গলায় প্রশ্ন করলেন, মা, তোমার নাম কী?
বিউটি বানু।
জুলু মাতব্বর আগের মতই গদগদ গলায় বললেন, মা নিজের নাম বলার আগে মোসাম্মৎ বলতে হয়। বলবা- মোসাম্মৎ বিউটি বানু। একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে মাতব্বর আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা তুমি কি সাপটা মারছ?
-জ্বী- সোজা সাপ্টা উত্তর করে বিউটি বানু।
-কেন মারছ?
বিউটি বানুর আবার উত্তর দেওয়ার আগেই ভীড়ের ভেতর থেকে বশির আলী চিৎকার দিয়ে বলে উঠে, মিছা কথা। সবাই শোনেন, দোস্তাইন সব মিছা কথা কয়। সাপটা আমি মারছি। সে হারিকেন নিয়া দাড়ায়ে আছিল মাত্র। সাপটা আমিই কোপায় টুকরা করছি।
সকলের ভেতর একটা মৃদু গুঞ্জন তৈরি হল। ঘটনা দেখি আরেক দিকে মোড় নিতেছে, জুলু মাতব্বর এর সাথে আসা কেউ একজন বলে বসল। গফুর আলী বশির আলীকে ধমকাল, হারামজাদা!
হুজুর সাহেবের সাথে পরামর্শ করে বিষয়টা ফয়সালার জন্য জুলু মাতব্বর পরের দিন বাদ জুম্মায় সালিশ ডাকলেন, সিদ্ধান্ত যা হওয়ার সেখানে হবে। রাত বাড়তে থাকলে যে যার মতন গন্তব্যে উঠান ছেড়ে চলে গেল।
উঠান ছেড়ে গেল না কেবল একজন। সে আয়নালের সবচেয়ে কাছের দোস্ত বশির আলী। ঝিঁ ঝিঁ ডাকের সাথে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বশির আলী দেখতে থাকে- বিস্ময়কর ওই ওপর আকাশ। সেখানে নিকষ অন্ধকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আকাশ গঙ্গায় অগুণতি তারা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তারাগুলো এই আছে আবার এই নাই। অন্ধকার আকাশ থেকে এই উঠান অবধি ফুটফুটে জোৎস্নার আলো দেওয়ার মত চাঁদটা ডুবে আছে। বশির আলী তবু ভাবল, জোৎস্নার খুব দরকার !
হাসান পারভেজ (১৯৮০) |
1 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভাল ❤️বড় ভাই
উত্তরমুছুন