bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

ভিয়েতনামের কবিতা ꘡ শাশ্বত ভট্টাচার্য অনূদিত



ভিয়েতনাম প্রসঙ্গ এলেই সাম্যবাদী বিপ্লব মগজে বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস এই ভিয়েতনাম। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যায্য যুদ্ধে জড়িয়ে নিরীহ শান্তিকামী মানুষের ওপর সামরিক বোমাবর্ষণের এ হেন ন্যাক্কারজনক ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কবি শামসুর রাহমান তার ভিয়েতনাম  কবিতায় সে ছবি এঁকে দেন। ...গোল বাধাল কারা? বর্গি নাকি তারা? ...বাজপাখিরা জেনো/ পণ করেছে যেন/ ঝাপটা মেরে জোরে/ তেড়ে এসে ওরে /ডানে কিংবা বাঁয়ে/ তীক্ষ্ম নখের ঘায়ে/ উপড়ে নেবে গ্রাম, পুড়ছে ভিয়েতনাম।...জ্বলছে অবিরত বারুদ জ্বলার মতো,জ্বলছে ভিয়েতনাম। 

নবারুণ ভট্টাচার্য’র ভিয়েতনামের ওপর কবিতা  পুরো ছবিটাকে আরো স্পষ্ট করে তোলে--এখানে অন্তত তার কয়েকটা লাইন তুলে দেওয়ার লোভ কোনভাবেই সংবরণ করা গেল না।

আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আজকে—এই সভায় ভিয়েতনাম নিয়ে একটা কবিতা আমার পক্ষে পড়া সম্ভব নয় কারণ ব্যাপারটা অসম্ভব কঠিন কীরকম দেখতে সেই কবিতা তার হাতে কী থাকবে
সে অন্ধকারে দেখতে পায় কিনা কতদিন তাকে জেলে থাকতে হয়েছে আমি তার কিছুই হদিশ করতে পারছি না
শব্দগুলো ভীষণ রক্তাক্ত, অসম্ভব বেপরোয়া তার ওপরে অনেক শব্দ ঝলসে গেছে নাপামে কিছু কিছু শব্দ উন্মাদ ও কালা হয়ে গেছে কোনো কোনো শব্দকে হাত বেঁধে হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে অথচ এই শব্দগুলোকে সাজাতে না পারলে ভিয়েতনামের কবিতা হবে না...

⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃⠃

শাশ্বত ভট্টাচার্য একাধারে বাচিক শিল্পী, সম্পাদক, সংগঠক, রবীন্দ্র গবেষক, লেখক, অধ্যাপক ইত্যকার নানা পরিচয়ে পরিচিত হলেও তাঁর আসল পরিচয়- তিনি কবি। কবিমানসে তিনি যথেষ্ট শিল্পবোধসম্পন্ন ও রুচিশীল। জীবনের নির্জনতাই তাঁর কবিতায় সুর হয়ে যায় ...জীবনকে আজ মেলো রঙের ফানুসে ফানুসে আকাশ মিলাও যদি এই যামিনী হায় বৃথা নাহি যায়...
সম্প্রতি এই কবি ভিয়েতনামের কবিতা বাংলায় অনুবাদের এক ভীষণ পরিশ্রমী কাজ হাতে তুলে নিয়েছেন নিজ দায়িত্বে। কবিতায় আমরা যেমনটা পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যমুখী বা আধুনিককালে আফ্রিকা বা লাতিন মুখে ছুটছি তাতে করে পুবমুখে তাকাবার সময় নেহাত থাকে না। অথচ পুবেও আছে হাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধ সাহিত্য। হয় না বলে তো হবে না তা তো নয়।  ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভিয়েতনামের সাথে আমাদের সীমিত সম্পর্ক, ফলে তাদের ভাষা আমাদের আয়ত্তের বাইরে। তবু আমাদের অগ্রজদের মধ্যে কেউ কেউ ভিয়েতনামের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করেছেন। তার অধিকাংশই ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিনের লেখা কবিতা। কবি শাশ্বত ভট্টাচার্য ভিয়েতনামের হাজার বছরের সংগৃহীত কবিতা থেকে অনুবাদের কাজ শুরু করেছেন। সেখানে আধুনিককালের কবিতা যেমন আছে তেমনি আছে প্রাচীন জনপদের কবিতাও। সেগুলো থেকে কয়েকটি কবিতা গতিপথে ওয়েবজিনে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হ’ল। 

অনূদিত কবিতাগুলো ভিয়েতনামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অনুবাদক এনঙগুয়েন এনজিওসি বিচ সম্পাদিত ও মূল থেকে ইংরেজিতে বার্টন র‌্যাফেল ও ডব্লিউ এস ম্যারউইন কর্তৃক অনূদিত A Thousand Years of Vietnamese Poetry এবং Black Dog, Black Night: Contemporary Vietnamese Poetry গ্রন্থ থেকে সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ভিয়েতনামের হাজার বছরের  সংস্কৃতি ঐতিহ্য প্রকৃতি আর জীবন সংগ্রামের ইতিহাস এসব কবিতায় স্পষ্ট।
ভিয়েতনামের কবিতার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। কবি শাশ্বত ভট্টাচার্য যে উদ্যোগটি গ্রহন করেছেন তা অনেক পরিশ্রমের কাজ, অনেক সাধনার ফসল। আশা করি তাঁর এ প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে মলাটবদ্ধ হয়ে বাংলা কবিতার পাঠককে ঋদ্ধ করবে।

ট্রান ভ্যাং সাও

আমি খাবার জন্য মাংস চাই

আমি একদিন মাংস খাওয়ার কথা নিজেই কল্পনা করি
আমি জোরে হেসে উঠে আনন্দের সাথে বলি
একটি মাংসের টুকরো তার সাথে চর্বির একটি বড় খণ্ড
আমার গলাদিয়ে পিছলে নেমে যায়
আমার দুই চোখ খুলে যায় প্রসারিত হয়ে
আমি আসন করে মেঝেতে বসেছি
অনেক মাংসে পূর্ণ একটি প্লেট আমার মুখের সামনে
সবুজ পেঁয়াজের দীর্ঘ ডালপালা ভাসছে তেলের মাঝে
হাতে ধরা চপস্টিকস মুখ দিয়ে চিবুচ্ছি
পাতার মধ্যদিয়ে সূর্য জ্বলছে
গ্রীষ্মের বিকেলে কোনো বাতাস নেই

আমি ঘুম থেকে উঠি এবং আমার গ্রীবায় আঁচড় কাটি
নদীর জল লবণাক্ত
আমি সরুগলির শেষপ্রান্তে গিয়ে ধুমপান করি
তারপর উচ্চস্বরে নিজেকে বলি
পরিবেশ শীতল করার জন্য আজ সন্ধ্যায় বইবে বজ্রসহ ঝড়ো হাওয়া।


স্ত্রীকে সন্তান প্রসবের জন্য নিয়ে যাওয়া

মে মাসের একটি সকালে আমি সন্তান জন্মদানের জন্য তোমাকে নিয়েছিলাম
বৃষ্টিময় ধানকাটার সময়
আমি খুশি হয়েছিলাম তুমি সহজেই প্রসব করেছিলে একটি পুত্র সন্তান
রাস্তার দুধারের বৃক্ষসারি স্থির ভেজা
আকাশ পৃথিবী আর আমাদের পূর্বপুরুষদের
ধন্যবাদ জানাতে মা একগুচ্ছ ধূপকাঠি জালিয়েছিলেন

আমার স্ত্রী প্রসূতিশয্যায় শুয়ে নিশ্বাস ফেলছিলো
তার বড় এবং গোলাকার পেট
একজন মানুষ হিসেবে আমার কিছুই করার ছিলো না আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম
আমি সিগারেট টানছিলাম আর উঁকি দিচ্ছিলাম
আমি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না
দুটো উর্দ্ধমুখী ধাতব পেয়ালা একটি জলপাত্রের কাছে
কিছু নুড়িপাথর ঘরের চালের প্রান্তভাগে
বৃষ্টি আর হবে না
আমি উবু হয়ে বসেছিলাম আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম আমি একটি সিগারেট টেনেছিলাম
আমি পিছনে আর সামনের দিকে তাকিয়েছিলাম
আমার স্ত্রী প্রসূতিশয্যায় শুয়ে নিশ্বস ফেলছিলো
তার বড় এবং গোলাকার পেট
তার মুখের সামনে একটি উজ্জ্বল খোলা জানালা
কাছের বাগানের একটি কলাপাতা জলবিন্দুর পতন দেখিয়েছিলো
আমি ঘরের ভিতর থেকে আসা দুজন নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম
থুয়ান আন স্ট্রিটে একটি ট্রাকের ইঞ্জিন অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে উঠল
এবং একটি শিশুর ক্রন্দনধ্বনি
আমি প্রবেশদ্বারে পা বাড়ালাম
দুজন নারী আমাকে দেখলো এবং হাসলো
আমি বাড়ির পথে হাঁটলাম
পাতাগুলির উপর ঝিরিঝিরি বাতাস
আমি জোরে জোরে নিজেকে বললাম
কিছুক্ষণের জন্য রৌদ্র হবে না
________________

[ট্রান ভ্যাং সাও হুতে ১৯৪৪ জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি এখনও বসবাস করছেন। প্রথম ইন্দোচিনা যুদ্ধের সময় ফরাসিরা তাঁর পিতাকে হত্যা করেছিল। ট্রান ভ্যাং সাও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ‘থানহান চ্যান মিং’ [আমেরিকার বিরুদ্ধে যুবকগণ] প্রকাশের কাজে অবদান রেখেছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে’ যোগ দিয়েছিলেন, তার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলিতে তিনি বসবাস করতেন। তাঁর ছদ্ম নাম ‘ভ্যাং সাও’-এর অর্থ ‘হলুদ তারা’।

১৯৬৯ সালে তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় ট্রান ভ্যাং সাও কমিউনিস্ট মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় এবং তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় আর তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ট্রান ভ্যাং সাও-এর কবিতাগুলি ইংরেজী অনুবাদ হয়েছে এবং American Poetry Review (খণ্ড ২৮ / নং ১, জানুয়ারি/ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) এবং The Literary Review (শীতকালীন সংখ্যা ১৯৯৯) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।


থানহ তম তুয়েন

পুনরুত্থান


বমি উগরে দেবার মতো আমি কাঁদতে চাই
রাস্তার উপর
স্ফটিক সূর্যালোক
আকাঙ্ক্ষা প্রশমিত করার জন্য আমি আমার নাম ধরে ডাকতে চাই
থানহ তম তুয়েন
সন্ধ্যার একটি তারা ভেঙে যায় চার্চের ঘণ্টাধ্বনির বিপরীতে
হাঁটু গেড়ে বসার জন্য আমার একটি গোপন জায়গা প্রয়োজন
একটি ছোট শিশুর আত্মার জন্য
ভয়ঙ্কর একটি হিংস্র কুকুর
বিবর্ণ একটি ক্ষুধার্ত কুকুর

আমি ঘুমের মতো মরে যেতে চাই
যদিও আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি নদীর তীরে
গভীর জলরাশি অশান্ত
আমার ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য আমি আমার নিজের নাম ধরে চিৎকার করছি
থানহ তম তুয়েন
রাত্রি পতিত হচ্ছে পাপপূর্ণ ফিসফিসে ধ্বনিরাজ্যে
হে লাল কাপড়ে মোড়ানো শিশু
ওহে সেখানে নেকড়ে

আমি আত্মহত্যা প্রার্থনা করি
একজন চিরন্তন খুনীর মতো অনেকটা
আমি নিজের নাম ধরে বেদনায় আর্তনাদ করি
থানহ তম তুয়েন
মনোবল হারিয়ে নিজেই নিজের স্বররুদ্ধ করি
যাতে আমি পুনরুত্থিত হতে পারি
জীবনের লক্ষ্য অর্জনের বিকল্প পন্থায়
মানবহৃদয় আত্মহত্যার অপরাধকে ক্ষমা করে না
জল্লাদেরা হাঁটু গেড়ে বসে আছে
পুনরুত্থানের সময়

একটি চিৎকার একটি প্রার্থনা
অপেক্ষমান শতাব্দীর জন্য
আমি যেমন মরতে চাই তেমনি আমি বাঁচতে চাই
বিদীর্ণ শ্বাস-প্রস্বাশের মাঝে
জ্বলন্ত হৃদয়
আমি মৃদু স্বরে ডাকি
প্রিয়
তোমার হৃদয়ের দরজা খুলে দাও
আমার জীবন্তআত্মা একটি শিশুতে পরিণত হয়েছে
একবারের জন্য শুদ্ধ এবং সত্য।
---------------------------

[থানহ তম তুয়েন ভিয়েতনামে একজন সাহসী এবং নিরীক্ষাধর্মী কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি ১৯৩৬ সালে ১৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম জুজ ভান টাম। ‘আমি আর একা নই’- এই কবিতা লিখে ১৯৫৬ সালে, ২০ বছর বয়সে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামের সাহিত্যের উপর তাঁর ভীষণ প্রভাব ছিলো। ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে তাঁর প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিলো। ১৯৫৪ সালে তিনি হ্যানয় স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। থান তম তুয়েনের সৃষ্টিকর্ম দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাহিত্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলো।
১৯৬২ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে অব্যাহতি নিয়ে আবার ১৯৬৯ সালে যোগদান করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকেন। তিনি রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম আর্মির অধিনায়ক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। ১৯৮২ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৯০ সালে এপ্রিল মাস থেকে তিনি আমিরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
থান তম তুয়েন ৭০ বছর বয়সে ২০০৬ সালের ২২ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
থান তম তুয়েনের গ্রন্থ সমূহ
কবিতা :আমি আর একা নই (ভিয়েতনাম, সাইগন, ১৯৫৬), দূর থেকে কবিতা কোথায়( ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৯০)
উপন্যাস: ফায়ার চুলা (১৯৫৭), স্যান্ডি ( ১৯৬৭), অন্ধ মাছ (১৯৭০), শব্দ (১৯৭০), অন্য রবিবার ( ১৯৭৫)
ছোটগল্প: মুখ ( ১৯৬৪), পথে (১৯৬৬)। নাটক: তিন বোন (১৯৬৭)]


হা থি থাও

আমাদের সন্তানের পেশা

তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করো আমাদের সন্তানের পেশা কি হবে
আমি বলি তাকে ছবি আঁকার শিক্ষা দাও
সে যেন ভিয়েতনামের মানচিত্র আঁকতে পারে
যেখানে আমাদের তৈরী করা ঘৃণা মুছে যাবে
তাকে কাঁটাতার কাটতে শিক্ষা দাও
যা আমাদের মাতৃভূমির কটিদেশকে তীক্ষ্ণভাবে বিদ্ধ করে আমাদের সম্পর্ক তিক্ত করছে
তাকে ওষুধের শিক্ষা দাও
যাতে সে অতীতের জমাটবদ্ধ ক্ষতগুলি সারিয়ে তুলতে পারে
সবশেষে তাকে শিখিয়ে দাও জমির ভাষা
অম্লাক্ত জমির এবং লবনাক্ত জলের
তারপর তুমি বাকী সব বই পুড়িয়ে ফেলতে পারো
আমি প্রসারিত করবো আমার কৃশ হাত আগুনকে লুকাতে
ছাইগুলি দূরে সরিয়ে দিতে
রক্ত শুষে নেয়া এবং অশ্রুপাত করা সারা বছরের সাথে
আমাদের সন্তানকে এই জমি পুনণির্মান করতে দাও
তাকে বৃত্তটি সম্পূর্ণ করতে দাও
যার ব্যাসার্ধ এখন লজ্জার নদী
তুমি আর আমি দাঁড়াবো উত্তরে দক্ষিণে
এবং আমাদের তরুন সন্তান যখন ঘুমাবে নজর রাখবো তার দিকে।


[হা থি থাও (জন্ম আনুমানিক ১৯৪০) এর এই কবিতাটি পাঠের পর এটি অনুবাদের জন্য আমার আগ্রহ জেগে ওঠে। যদিও এই অবরুদ্ধ সময়ে আমার হাতের কাছে যা আছে তাতে হা থি থাও-এর সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমি জোগাড় করতে পারি নি। তাঁর জন্ম সালটিও আনুমানিক। কিন্তু আমার আগ্রহের পিছনে কারণটি অন্য। এই কবিতাটতে ভিয়েতনামের ইতিহাসের ছায়া আপতিত এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
১৯ শতকের শেষের দিকে ফ্রান্স ভিয়েতনাম আক্রমণ করে। ফরাসিরা দেশটিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে দেয়। ফরাসিরা ভিয়েতনামের সম্পদ আহরণ করে নিজের দেশে পাচার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভিয়েতনামে উপনিবেশ বিরোধীরা সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৯৫৪ সালে ফরাসিদের পতন ঘটে। এরপর ভিয়েতনাম দুটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়- উত্তর আর দক্ষিণ। উত্তর ভিয়েতনামে সাম্যবাদী সরকার এবং দক্ষণি ভিয়েতনামে সাম্যবাদ বিরোধীরা শাসন শুরু করে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম চলে যায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে। দীর্ঘ ২০ বছরের লড়াইয়ে ভিয়েতনাম মার্কিনসাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়। এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিভাজনের কাঁটাতার উঠেগিয়ে একদেশে পরিণত হয়। কবি হো থি থাও (১৯৪০ আনুমানিক) যখন জন্মগ্রহণ করেছেন এবং বড় হয়ে উঠেছেন তখন ভিয়েতনাম উত্তর দক্ষিণে বিভক্ত ছিলো। তাঁর কবিতায় এই বিভাজন বিরোধী সুর ধ্বনিত হয়েছে।]

হু শোয়ান হাং

সুরম্য ভবন থেকে বসন্ত অনুভব



শান্ত বসন্তসন্ধ্যা নামে
বায়ুপূর্ণ, মেঘহীন পার্থিব ধুলিকণাময়।
তিনবার, ঘণ্টাধ্বনি তরঙ্গের মতো প্রতিধ্বনিত।
আমরা দেখি স্বর্গ ওলোট -পালোট হচ্ছে বিষন্ন কর্দমাক্ত ডোবায়।
ভালোবাসার বিশাল সমুদ্র পারে না শূন্য হতে।
এবং বসন্তের অনুগ্রহ প্রবাহিত সর্বত্র।
নির্বাণ কোথায়?
নির্বাণ এখানে, দশের মধ্যে নয়বার।

সৌগন্ধের মন্দির

কে করেছিল এই বিশ্মিত বাহার?
পাহাড়ে প্রশস্ত ফাটল, ফাঁপাগুহা।
ধার্মিক বুদ্ধদের ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা অবিরাম,
অন্যরা ক্লান্তিহীন তাকায় শুধু।
সৌন্দর্য চুঁইয়ে পড়ে নদীর থেকে,
ফিরে অাসা নৌকার নাবিকেরা যেমন নোয়ায় মাথা।
নাগরিক লোকেরাও ভিড় করে
এই ঝর্ণায় এই বনভূমিতে।
চতুর, সত্যি স্বর্গের বৃদ্ধরা।

হু শোয়ান হাং ( ১৭৭২- ১৮২২) লি রাজবংশের শেষের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ট্য সান বিদ্রোহের সময় তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক অশান্তির মধ্যে বেড়ে ওঠেন। চু নম (southern script) ব্যবহার করে তিনি কবিতা লিখেছেন। যখন চীনের অনুকরণে লেখা হচ্ছে তখন তিনি ভিয়েতনামের নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং লেখা শুরু করেন। হু শোয়ান হাং ভিয়েতনামের অন্যতম সেরা ধ্রুপদী কবি হিসেবে বিবেচিত। ভিয়েতনামের বিশিষ্ট আধুনিক কবি জুয়ান দিউউ তাকে ' নম কবিতার রাণী ' ( The Queen of Nom poetry) বলে অভিহিত করেছেন

জোয়ান কোয়াইন

শরতের শেষে ভালোবাসার কবিতা

দিগন্তে উড়ে যায় পুঞ্জিভুত সাদা মেঘ
হলুদপাতারা থেকে যায় সামান্য কিছুটা সময়
কখন তারা ছেড়ে যাবে তাদের বন
যখন শরৎ অনুসরণ করে তাদের পিছন?
পাতার একটি বিশাল নদীর মাঝে
শরৎ বয়ে চলে সমুদ্রের দিকে
এখন এটি চলে গেছে এর মঞ্চের সাথে
কিন্তু শুধু তুমি আর আমি

শুধু তুমি আর আমি
অনুভব করি অতিক্রান্ত শরৎ
উত্তর-পূর্ব থেকে প্রবাহিত শরতের বাতাস আমাদের পিছনে প্রবাহিত
সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে
একটি চেনা পথ
হয়ে উঠছে বিস্ময়কর
ঘাসের পাতা তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে
কুয়াশাচ্ছন্ন মুখ নিয়ে আমরা বাসায় ফিরছি

শীতলতা আমাদের হাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে
কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বৃক্ষ শোভিত পথের মতো
অনেক ঝড়বৃষ্টি দিয়ে বাঁকানো
আমাদের ভালোবাসা
বন্যা শেষের একটি নদীর মতো

সময় মৌসুমী বাতাস
দিন-মাস দ্রুত প্রবাহিত
বছরও বিদায় নেয় খুব তাড়াতাড়ি
কিন্তু শুধু তোমার এবং আমার মধ্যে


নৌকা ও মহাসাগরের গল্প


আমি তোমাকে একটি গল্প বলতে যাচ্ছি
একটি নৌকা ও একটি মহাসাগরের গল্প :
"অজ্ঞাত কোনো সময় থেকে
মহাসাগরের ডাকে সাড়া দিয়েছিলো এক নৌকা
সমুদ্রচিলের ডানা আর নীলতরঙ্গ
নৌকাটিকে নিয়ে গেছে নানা দিকে।
নৌকার হৃদয় উঠেছিলো ভরে বাসনায়
মহাসাগরের ভালোবাসা অন্তহীন
দীর্ঘ ভ্রমণে নৌকাটি ছিলো ক্লান্তিহীন
অনুভবে তার আসেনি কোনই শ্রান্তি।
তবুও মহাসাগর দূরেই ছিলো, অনেক দূরে।
অপরূপ এক চাঁদনী রাতে
মহাসাগর এক তরুণীর মতো
নিঃশব্দ হৃদয়মনে তরঙ্গলেহনে
শুষে নিতে চায় নৌকার চারিধার।
কখনো কোনো কারণ ছাড়াই।
তরঙ্গ চুম্বনে চুম্বনে খুব দৃঢ়ভাবে
নৌকাকে নেয় ঘিরে।
( এ কী অনন্ত ভালোবাসার চিরকালীন স্থায়িত্ব?)
শুধু নৌকাই বুঝেছিলো
মহাসাগর কতো বিশাল
শুধু মহাসাগরই জেনেছিলো
নৌকা কোথায় যাচ্ছে এবং আসছে।
যখন নৌকা এবং মহাসাগর হয়নি মিলিত
যখন মহাসাগরের ঢেউয়ের 'সফেদ মাথা'
মহাসাগর তখন শোকাকুল।
যখন নৌকা এবং মহাসাগর পারে নি মিলিত হতে
তখন নৌকার হৃদয় ভেঙে খানখান বেদনায়
যখন মহাসাগর নৌকাকে দিত ছেড়ে
তখন তীব্র তরঙ্গ অার তীব্র বাতাস থেকে যেত।"
যদি আমাকে থাকতে হয় তোমার থেকে দূরে
তখন তীব্র ঝড় শুধু বইবে আমায় ঘিরে।

জোয়ান কোয়াইন ভিয়েতনামের অন্যতম আধুনিক কবি। জন্ম ১৯৪২ সালের ৬ অক্টোবর।
খ্যাতনামা নাট্যকার ও কবি লু’ কোয়াঙ ভো ছিলেন ক্ষণজন্মা এই কবির জীবনসঙ্গী। বারো বছর বয়সী ছেলেসহ ১৯৮৮ সালের ২৯ আগষ্ট কবি দম্পতি হোই ডোয়াঙ সিটিতে মারাত্মক গাড়ী দূর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হন।



লেখক পরিচিতি:
শাশ্বত ভট্টাচার্য কবি, সম্পাদক ও বাচিক শিল্পী । জন্ম ১৯৬১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, কুড়িগ্রাম নাগেশ্বরী পয়ড়াডাঙ্গা গ্রাম। পেশা- অধ্যাপনা। সাহিত্যপত্র করুল (২০০৪) এর সম্পাদক। বর্তমানে উত্তরবাংলা নিউজ পোর্টালের সম্পাদক। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সংগঠক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: কবিতাপুস্তক: সমাবিষ্ট স্বপ্নের সমূহ প্রপাত (২০১৬); গবেষণাগ্রন্থ:  রবীন্দ্রনাথ অভিন্ন ভাবনার ভিন্ন উপস্থাপন (২০১৬); রবীন্দ্র নাট্যধারা প্রথম পর্যায় (২০১৫)। এছাড়া জীবনীগ্রন্থ: কমরেড মণিকৃষ্ণ সেনের জীবন ও কর্ম (২০০৫)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ