bdtime

বঙ্গাব্দ ꘡

শফিক আশরাফের জানালা ꘡ আমাদের ভুটানযাত্রা: শেষপর্ব

শফিক আশরাফ গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সম্প্রতি প্রথম উপন্যাসের খসড়া করলেন। লেখার টেবিলে বসে উপন্যাস বা গল্প লেখার ফাঁকে ফাঁকে আখ্যান ফুঁড়ে আরও কত শত ভাবনারা বেরিয়ে আসে। ভাবনার আকাশে কল্পনার, অভিজ্ঞতার, আনন্দ-বিষাদের হাজারো ইমেজ উঁকি মারে, দোল খায়--ফের হারিয়েও যায়। টেবিলের ওপারে ছোট্ট জানালা দিয়ে সে আকাশ দেখা যায়। কত্ত বিশাল আকাশের খানিক মাত্র! সেখানে খেলা করে কত রঙ! কত তার রূপ! প্রিয় পাঠক, লেখকের মানসপটে ভেসে থাকা ওই জানালায় আমরাও চোখ রেখেছি ।
গতিপথ বাংলা ওয়েবজিনে ধারাবাহিক গদ্য বিভাগে শফিক আশরাফের জানালা শুরু হয়েছে তাঁর ভ্রমণ গদ্য আমাদের ভুটানযাত্রা  দিয়ে। আজ প্রকাশিত হলো ভ্রমণ গদ্যের দশম ও শেষ পর্ব।


আমাদের ভুটানযাত্রা : শেষপর্ব

পারো শহরের সন্নিকটে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ফাঁকা উপত্যকায় গড়ে উঠা একটা রিসোর্ট ভাড়া করে ফেললাম। রিসোর্টটার ভেতরে বেশ পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির পাম, ওক, খ্রিসমাসট্রি দিয়ে সাজানো। সাদা পাথর বিছানো রাস্তার দুপাশে কাঁটামেহেদী ছোট ছোট করে ছাটা। সামনে একটা ফুলবাগান। চারপাশে বাংলো টাইপ ছোট ছোট কটেজ। বাগানে বিভিন্ন প্রজাতির রঙিন ফুল দেখে স্বনন, বুনন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। একেবারেই নিরিবিলি, মনোরম, পরিচ্ছন্ন রিসোর্টটি আমাদের খুবই ভালো লাগলো। রিসোর্টে আমাদের বাংলোটাতে ঢুকে মনটা আরো ভালো হয়ে গেল। বেশ বড় ডাবল বেডের রুম। সঙ্গে ছোট্ট একটা ড্রইং রুম। দু দিকে বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে উপত্যকা ও পাহাড়ের চমৎকার একটা মেলবন্ধন দেখা যায়। চারদিকে মন ভালো হওয়ার দৃশ্য ও পরিবেশ। 
ভিউপয়েন্ট থেকে পারো
দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। কটেজে লাগেজপত্র রেখে আমরা সুপোকে নিয়ে দুপুরে খাবারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসলাম। রিসোর্ট থেকে পারো শহর দেখা যায়, হাঁটাপথ। তবুও গাড়ি ও সুপো যেহেতু সঙ্গে আছে সেহেতু আমরা টেনশন ফ্রি। চমৎকার ঝকঝকে তকতকে পারো শহর। একই ধরনের কাঠের রঙিন দরজাওয়ালা, একই ধরনের ঘর রাস্তার দু’পাশে। মনে হচ্ছে ইউরোপের কোনও দেশে চলে এসেছি। শহরের পাশ দিয়ে কলবল করে ছুটে চলেছে একটা বরফগলা নদী। পারো শহরের চারপাশে উঁচু পাহাড় আর মাঝে বেশ বড় একটা সমান্তরাল উপত্যকায় গড়ে উঠেছে পারো শহর। থিম্পু শহর অনেক উঁচুনিচু, প্রশস্ত জায়গা কম। পারো শহর সেরকম না হওয়াতে আমাদের মনে হচ্ছে ভুটান ছেড়ে আমরা অন্য কোন দেশে চলে এসেছি। আমরা মূল রাস্তা থেকে ভেতর দিকে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে ঢুকলাম। রেস্টুরেন্টের মালিক মনে হয় সুপোর পরিচিত। টেবিলে বসার পর মালিক এসে আমাদের হ্যালো বলে গেল। আমাদের পাশের টেবিলে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা এক দম্পত্তি বসে বসে ফ্রায়েড রাইস খাচ্ছে। সঙ্গে স্বননের সমান একজন ছেলে, খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে টেলিভিশনের তুমুল মারামারির একটা তামিল সিনেমা দেখছে। তার বাপ খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দু’বার ধমক দিলো। কিন্তু ছেলেটার তাতে কিছু যায় আসে না, নায়ক একা আট-দশ জনকে পিটাচ্ছে, বিভিন্ন ড্রাম বাক্সপেট্টা কখনো ভ্যানগাড়ি উল্টে ভিলেনদের উপর পড়ছে! কিন্তু তাতে ওদের কিছুই হচ্ছে না, আবার উঠে দাঁড়িয়ে বিকট শব্দে নায়কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ওসব তাকিয়ে দেখলেও এক ধরনের উত্তেজনা হয়। আর বাচ্চারা এসব উত্তেজনা মনে হয় বেশি পছন্দ করে। স্বনন আরো ছোট থাকা অবস্থায় ‘হান্ড্রেট পার্সেন্ট লাভ লাভ লাভ লাভ’ বলে ব্যাপক চিল্লাচিল্লি মার্কা একটা গান কোন চ্যানেলে চালু হলেই সব কাজ বন্ধ করে হা করে শুনতো। এটা শুনে সে কি মজা পায় এটা ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, গান নয়, গানের বিট বাচ্চাদের আকৃষ্ট করে। 
পাশের টেবিলের বাচ্চাটার ফ্রায়েড রাইস খেতে দেখে স্বনন-বুনন বললো তারা ফ্রায়েড রাইস খাবে। বাচ্চাদের জন্যে চিকেন ফ্রায়েড রাইস আর আমাদের জন্যে ভুটানি লাল চালের ভাত, বিফ, ঢেড়স ভাজি, ডাল অর্ডার করলাম। লম্বা করে কাটা ঢেড়স ভাজিটা অন্যরকম। আইরিন আমাকে বোঝালো সব্জি কাটিংয়ের উপর এর স্বাদ পরিবর্তন হয়। আমরা যমুনা তীরবর্তী মানুষ চাকচাক করে কাটা ঢেড়স ভাজি খেয়ে অভ্যস্ত। রংপুরে এসে জানি, সাধারণ একটা আলু কত প্রকার ও কত স্বাদের হয়। কোন আলু শুধু ভর্তা খাওয়ার জন্যে, কোন আলু তরকারির জন্যে, কোন আলু শুধু ভাজি খাওয়ার জন্যে আবার কোন আলুর ডাল হয়। আলুর এত প্রকারভেদ বাংলাদেশের আর কোনও অঞ্চল কেন, পৃথিবীর কোথাও আছে কি না আমার সন্দেহ হয়! আমাদের সারা দেশের মানুষ আলুর এই প্রকারের সাথে পরিচিত নয়। 

দুপুরের খাবার শেষ করে আইরিন রিসোর্টে ফিরতে রাজি হলো না। সুপো জানালো এখানে একটা জাদুঘর, জং দেখতে যেতে পারি। দুপুর গড়িয়ে পড়েছে। ঝকঝকে উজ্জ্বলরোদের মধ্যে গাঢ় নীল আকাশের দিকে তাকালে ক্লান্তি কোথায় দূর হয়ে যায়। আমার ছোটবেলার কথা মনে আছে। সকালে ঘুম ভাঙতো, ভেতরে প্রচুর প্রাণশক্তি ও উদ্দীপনার ভেতর। সারাদিন খেলাধুলা, ছোটাছুটি  শেষে কখন যে দিন শেষ হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। সন্ধ্যার পরে দু’চোখ ঘুমে টলে আসতো, কোন ভাবেই তাকিয়ে থাকতে পারতাম না। আমি জোর করে তাকিয়ে থাকতাম, অনেকদিন পেঁয়াজে চিমটি কেটে চোখের সামনে ধরেছি যাতে ঘুম কেটে যায়। খালি মনে হতো ঘুমালেই দিনটা শেষ হয়ে যাবে। ঘুমালেই পৃথিবীর আনন্দ ও সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবো। কখন কীভাবে ঘুমিয়ে পড়তাম জানি না। ঘুম ভেঙে বিছানায় কিংবা বিছানার নিচে শুয়ে আছি। এখানে ভুটানের পারোতে এসে মনে হচ্ছে, ঘরে ঢুকলেই বাইরের এই অপার সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবো। 

চিলড্রেন পার্কে স্বনন
আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবগাহন করতে করতে জাদুঘর দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেশ একটা উঁচু পাহাড়ের মাথায় ন্যাশনাল মিউজিয়াম। টিকেট কেটে, লকারে আমাদের মোবাইল ফোন জমা রেখে মিউজিয়ামে ঢুকতে হলো। মিউজিয়ামে ছবি তোলা পুরোপুরি নিষেধ। সাজানো গোছানো এবং সমৃদ্ধ একটা জাদুঘর। ভুটানের বিভিন্ন পশু-পাখির রেপ্লিকা তৈরি করে, বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আলো ফেলে এমনভাবে রাখা হয়েছে, যেন জীবন্ত। ভালো লাগলো, ভুটানের আদিম অধিবাসীদের ব্যবহৃত অস্ত্র, কৃষিযন্ত্রাংশ, পোশাক-আকাশ। এগুলো দেখে সমস্ত ভুটানের অতীত ও বর্তমান স্পষ্ট বোঝা যায়। জাদুঘরের সামনেই একটা মন্দির, মন্দিরের পাশে পারো শহরের ভিউ পয়েন্ট। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বেলায় মুগ্ধ হয়ে চারপাশের সৌন্দর্য দেখলাম। ঐ দূরে নদীটা দেখা যাচ্ছে। প্রশস্ত উপত্যকা সবুজ ও সতেজতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। পাহাড়ের ওপার থেকে ঠাণ্ডা বাতাস একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। অচেনা একটা গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে বসে আমরা বাদাম খেলাম। বেঞ্চির খানিকটা দূরেই পাহাড়ের খাড়া ঢাল। স্বননের দিকে সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখতে হয়, কখন ঢালের কাছে চলে যায়। এখানে বসে বসে মনে হচ্ছিল- একজীবন এই সৌন্দর্য দেখে দেখে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমরা এই ভিউপয়েন্টে অনেকটা সময় কাটিয়ে নিচে নেমে আসলাম। বাচ্চারা চিলড্রেন পার্কে যাওয়ার বায়না ধরছে। সুপো আমাদের একটা চিলড্রেন পার্কের গেটে নামিয়ে দিয়ে পাকিংয়ের জায়গায় নিয়ে গাড়ি পার্ক করলো।
পার্কের ভেতর অনেকগুলো রাইড, বেশ কিছু ভুটানি বাচ্চা সেখানে খেলা করছে। বুনন-স্বননকে পার্কের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে আইরিন আমাকে বললো, চলো ভুটানের মিষ্টি খাই। রাস্তার ওপাশে একটা মিষ্টির দোকান চোখে পড়লো। আইরিনকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টির দোকানে প্রবেশ করলাম। আমরা বাঙালিরা আমাদের মিষ্টির ঐতিহ্য ও নানাপ্রকার নিয়ে সব সময় গর্ব করি। এই ভুটানিরা আর কি মিষ্টি বানাবে! এরকম একটা ভাব নিয়ে দোকানে ঢুকলাম। দোকানে ঢুকে বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি দেখে আমাদের গর্ব কিছুটা খর্ব হলো। বেশ কয়েক প্রকারের ভুটানি মিষ্টি চেখে দেখলাম, স্বাদ আমাদের মিষ্টির চেয়ে কিছুটা আলাদা। একটা প্যারাসন্দেশ জাতীয় মিষ্টি খেলাম, চমৎকার লাগলো। মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে  আইরিন বিভিন্ন শোপিচের দোকানে ঢুকে জিনিসপত্র দেখতে লাগলো। আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে।
পারো শহর, লেখক ও একটি কুকুর
ইদানীং তরুণ-তরুণীরা ‘ক্রাশ’ নামক একটা কিছু খায়! বিশেষ করে তরুণরা কোনো সুন্দরী তরুণী দেখলে ওই জিনিস খায়! ভুটানের এই ছিমছাম পারো শহরে, এই গোধূলীবেলা, যখন বুনন-স্বনন কাছাকাছি চিলড্রেনপার্কে ভুটানি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করছে, আইরিন দোকানের ভেতর জিনিসপত্র দেখছে। আমি ইতিউতি করছি এককাপ চায়ের আশায়। পাহাড়ের ওপার থেকে কনকনে হিম ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তখন লক্ষ্য করলাম রাস্তার ওপাশে একটি মেয়ে ফ্লাক্সে চা বিক্রয় করছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা পার হয়ে আনমনে তার কাছে গিয়ে চায়ের অর্ডার করলাম। হাত বাড়িয়ে চা নিতে গিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ‘ওই জিনিস’ খাইলাম। কনে দেখা আলোয় ঝলমল করছে মেয়েটি! মনে হচ্ছে, ক্লিউপেট্টা, হেলেন কিংবা মোনালিসার তাবৎ সৌন্দর্য তার উপর ঢেলে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মেয়েটিকে। সাধারণ দরিদ্র ঘরের মেয়ে। পরনে জিন্স, গায়ে ভারি জ্যাকেট কিন্তু স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরীর মতো রূপ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা বিক্রয় করছে। আমি সেই অপরূপ সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে প্রচুর পরিমাণে ‘ক্রাশ’ খাইলাম!

সূর্যটা পাহাড়ের ওপারে আড়াল হওয়ার আগেই আমরা বাচ্চাদের চিলড্রেনপার্ক থেকে বের করে এনে নদীর ওপর  ছোট্ট একটা পোল পার হয়ে আমরা ওপারে গেলাম। একদম নদীর ধার ঘেঁষে ক্যান্টনমেন্ট। নদীর পাশ দিয়ে চমৎকার একটা রাস্তা একেবেঁকে চলে গেছে। নদীর পাথরে বাধা পেয়ে জল এক ধরনের উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে চলেছে। নদীর ধারে আমরা সন্ধ্যাটা কাটালাম। 
পারো শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী
রাত আটটার মধ্যে ভুটানের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বাইরে রাতের খাবার খেয়ে রাত আটটার মধ্যে রিসোর্টে ফিরে আসলাম। বিভিন্ন রঙের গার্ডেন লাইটে রিসোর্টটা তখন ঝলমল
করছিল। রাতে শীতটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। রুম হিটারও সেই শীত নিবারণের জন্যে পর্যাপ্ত ছিল না। রাত দশটার মধ্যে টেলিভিশন দেখতে দেখতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পরলো। আমি আইরিনের সঙ্গে আরো বেশ কিছুক্ষণ গল্প করতে করতে ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি  টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো প্রচণ্ড হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচিতে। হঠাৎ করে এরকম শব্দে ঘুম ভাঙলে যে আতঙ্ক ও ভয় হয়, সেরকম আতঙ্ক ও ভয়ে আমার বুকটা ধকধক করছিল! তাকিয়ে দেখি আইরিনও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। মনে হচ্ছিল একসঙ্গে অনেকগুলো কুকুর বিকট শব্দে যুদ্ধ করছে। কুকুরের আত্মচিৎকারের শব্দে জানালার কাঁচ পর্যন্ত ঝমঝম করছিল। আমি উঠে ঘটনা দেখার জন্যে বারান্দার দরজা খোলার উদ্যোগ নিতেই আইরিন বাধা দিলো। বললো:
- দরজা খুলে দেখার দরকার নেই, কি না কি হয়েছে কে জানে!
তখনো কুকুরগুলো ভয় ধরানো গলায় ডেকে চলেছে। আমি আইরিনের কথা না শুনে, বারান্দার দরজা খুললাম। অসংখ্য তারার আবছা আলোয় দেখলাম, কালো প্যান্থার জাতীয় কিছু একটাকে দশ/পনেরটা কুকুর ঘিরে ধরেছে। জন্তুটা হঠাৎ পাহাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করলো, সেটা চোখের পলকে ও বিদ্যুৎ গতিতে। কুকুরগুলো প্রচণ্ড শব্দে ডাকতে ডাকতে জন্তুটার পেছনে ধাওয়া করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে কুকুরের ডাক অনেকটা দূরে মিলিয়ে গেল। আমি রিসোর্টের অন্যান্য ঘরগুলোর দিকে তাকালাম। সব নিঝুম। এই সময়ে টুরিস্ট কম থাকায় বেশিরভাগ খালি পড়ে আছে। আইরিন তখনো কম্বলের ভেতর বসে রয়েছে। আমি ঘটনা বলাতে ওর উদ্বেগ কিছুটা দূর হলেও আমাকে বকা দিয়ে বললো:
- তোমার সাহস বেশি, নিষেধ করার পরেও দরজা খুললা! কোনও বিপদ যদি ঘটতো? 
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, 
- পারোতে আরো একদিন থাকবা নাকি কাল দেশে ফেরত যাবা?
ফেরার রাস্তায় পাহাড়ি ঝর্না
আইরিনের হঠাৎ করে ঘুম ভাঙার আতঙ্ক পুরোপুরি না কাটাতে সিদ্ধান্ত জানালো আগামীকাল সকালে দেশে ফেরৎ যাবে। আমি বললাম, 
- ও কে , সুপোকে সকালে ডেকে নেব। এখান থেকে সরাসরি ফুলসিলিং, ফুলসিলিং থেকে বুড়িমারি। এখন শান্তিতে ঘুমাও।

পরের দিন ভুটানের অসংখ্য ঝর্না দেখতে দেখতে, রাস্তার ধারে বা ধাবায় বিভিন্ন ফলের পসরা সাজিয়ে বসা নারী দোকানিদের নিকট থেকে আপেল, কমলা ও নাম না-জানা ভুটানি ফল খেতে খেতে, কিছু শুকানো ফল কিনে, অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভুটানকে টাটা বাই বাই করে আমরা দেশের পথে যাত্রা করলাম। 


আর পেছনে ফেলে এসেছি পারো শহরে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসা এক আদিম রাতকে। 


সমাপ্ত

এই করোনা বন্দী সময়ে মাঝে মাঝে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে কল্পনায় ভুটানের সৌন্দর্যের ভেতর ঢুব দিলে একটা প্রশান্তি পাওয়া যায়। ঠিক সাহিত্য করার জন্যে নয়, আমি অনেকটা নিজের প্রশান্তির জন্যে লেখাটা লিখেছি। পাঠক কতটা সেই সৌন্দর্য অবগাহন করতে পেরেছে  সেটা নিয়ে চিন্তা করিনি। তবে আমার অনেক নিকটজন/ প্রিয়শিক্ষার্থী লেখাটি পড়ে ফেসবুকে/ ফোনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, তাদের ভালো লাগার কথা বলেছে, তাদের সেই বলা আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে।  ফেসবুকের কমেন্টে আমি সবসময় রিপ্লাই না করলেও, এই লেখায় যারা কমেন্ট করেছেন তাদের রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেটাও সেই আনন্দ থেকেই।
আবার হয়তো অন্যকোন বিষয় নিয়ে এই জানালায় হাজির হবো, আপনারা নিশ্চয়ই তখনো আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
- শফিক আশরাফ

আগের পর্বগুলোর লিঙ্ক:
আমাদের ভুটানযাত্রা ꘡ পর্ব-১


সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি:
শফিক আশরাফ (জন্ম: ৬ আগষ্ট ১৯৭১)
শফিক আশরাফ গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। জন্মস্থান টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানার অন্তর্ভুক্ত সিঙ্গাইর গ্রামে। বর্তমানে রংপুরে বসবাস করেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বিভিন্ন লিটলম্যাগে লেখালেখির শুরু। ২০০০ সালে তিনি ও বন্ধু কবি শামীম নওরোজ এবং ফারুক আকন্দ মিলে অন্যতম ছোটকাগজ ‘চিহ্ন’ প্রথম বের করেন। পরবর্তী সময়ে ‘চিহ্ন’ সম্পাদক এবং আরো পরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শিমুল মাহমুদ সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘কারুজ’ এর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। ছোটকাগজ অন্বীক্ষা, লোকপত্র, মাটি, প্রকৃতি -তে তিনি নিয়মিত লিখেছেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘নহর আলীর মা’ (১৯৯৯)। দীর্ঘ সময়ে তিনি বেশকিছু গল্প লিখেছেন।চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত গল্প পঞ্চাশৎ, রাশেদ রহমান সম্পাদিত এই সময়ের নির্বাচিত ছোটগল্প প্রভৃতি সংকলনে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁতি সম্প্রদায়কে নিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পাউঠি’র খসড়া সম্প্রতি শেষ হয়েছে। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পাগল অথবা প্রত্যাশিত মৃত্যু’।   
প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ: বাংলাদেশের গ্রাম ভিত্তিক ছোটগল্পে জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতি ১৯৪৭-২০০০ (প্রকাশকাল ২০১৩); প্রবন্ধ-গ্রন্থ: সিনেমা ও সাহিত্য প্রাসঙ্গিক পাঠ (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ